ফাঁকা রাস্তার মাথার ওপরে ঘন নীল মেঘ উঠছে, উল্টোদিকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলল, আর যে পাখি তিনটে এতক্ষণ টেলিফোনের তারে বসেছিল, তারা উড়ে গেল এইমাত্র ; দূর থেকে কিছু শব্দ এগিয়ে আসছিল যেন পথচারীদের সেই সব কথারা মাঝখানের এই ফাঁকা রাস্তাটুকু পেরিয়ে ডানদিকে যাবে কিম্বা উল্টোটা- ফলে এই জনহীন পথের দু’ দিকেই কিছু দৃশ্য ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছিল অথবা তৈরি হচ্ছিল। এখান থেকে যে রাস্তাটুকু দেখা যায় তা এমনই চৌকো আর ফাঁকা যেন এখনই নাটক শুরু পারে সেখানে - ছোটো, একাঙ্ক কোনো নাটক। ... ...
একদিনের গল্প, যা আসলে প্রতিদিনেরও... ... ...
গল্প লিখলাম। জানাবেন কেমন হয়েছে। ... ...
উপরে হচ্ছিল উড়াল রেলপথ, আর তাতে করে রাস্তাটিকে ভাঙা হয়েছিল ইচ্ছেমতন একটুও দয়া বা সন্মান না দেখিয়ে। ফলে জায়গায় জায়গায় খানা খন্দ তৈরী হয়েছিল, গ্রামের পাকা রাস্তার পাশে দেখতে পাওয়া লিকলিকে খন্দগুলোর সাথে এগুলোর পার্থক্য এইটুকুই যে ওরা প্রাকৃতিক, আর এরা কৃত্রিম। ... ...
একা থাকতে কিছুটা ভয়ই পাই আমি। আকাশপাতাল চিন্তা করতে একেবারে ভালবাসি না, তবু ফাঁকা ফ্ল্যাটে একা থাকলে সেসব কীভাবে যেন এসেই যায়। তাদের থেকে পালাতে চাইলেই আমি বাইকে উঠে বসে এক্সিলারেটর ঘোরাই। গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গলিতে আসতে না আসতেই বুঝতে পারি আমি পালাতে সক্ষম। কারণ বাইক চালাতে চালাতে অন্য কোন চিন্তা মাথায় আসে না। আসা সম্ভব নয়। এলে, দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ... ...
দেহটা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল পিঠের সিংহাসনটাতে, কিন্তু তেলের কাঁটার সাথে সঙ্গত করতেই কিনা, গাড়িটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। সিগনাল বাতি নেই, তাও এই জ্যাম! ‘’রাস্তায় নামলেই পাব্লিকের নাটকের আল্লাদ উডে… পাংখা গজান আরম্ভ করে…’’, বিড়বিড় করতে থাকে মারুফ গায়ের ক্যাটক্যাটে হলদে গেঞ্জিটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে। গেঞ্জিটা বুক পর্যন্ত উঠাতেই বেরিয়ে পড়ে রোমশ শরীরটা, এক রত্তি মাংস বাড়তি নেই কোথাও, হাড্ডিগুলো গড়েপিটে উঠেছে সেখানে বাইশটি বছর ধরে, তেল-মসলার কারুকাজ ছাড়াই। কিন্তু এই শরীরটারই চাকায় চাকায় বেজে চলে রাজপ্রাসাদী তান, যখন এক মনে আল্লা-খোদা করে যেতে থাকে তার পিছনে দন্ডায়মান এক দল নিরীহ ও নিপীড়িত যান! সংগীতটা আরো সুমধুর হয়ে উঠে, যখন সে বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকে পড়ে। তখন জায়গার অভাবে তার জ্যাকটাকে সাইড দিতে চেয়েও ব্যর্থ হয়ে মরাকান্না জুড়ে দেয় আগের থেকেও নিরীহ ও নিপীড়িত কিছু যান। মারুফ আপন মনে হেসে উঠে! এমন কোন প্রাণী আছে যে রাস্তার বুকে চড়ে বেড়াবে আর তাকে সমীহ করবে না? তাকে নিয়ে রাস্তার সবার দুশ্চিন্তা, অথচ কারো মুখে রা পর্যন্ত নেই! পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি মন্ত্রী- মিনিস্টারের গাড়িকে গুণতে চায় না পাব্লিক আজকাল! কিন্তু তাকে কেউ কিছু বলে না, গালাগালির তুবড়িও ছুটে আসে না। কি করবে, মানুষ যে ময়লা সহ্য করতে পারে না; টিয়ার গ্যাস, গুলি হজম হলেও ময়লা হজম হতে চায় না তাদের! বাসার পায়খানাটার মতই ঘেন্না একে তাদের! ... ...
সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল। বইটি রেখে দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে দীপ। আলনা থেকে শার্টটা গায়ে গলিয়ে বোতাম লাগাচ্ছিল - একটু বাইরে বেরিয়ে আসা দরকার, মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। ঘর থেকে বেরুনোর আগে বইটির দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই চমকে উঠে সে! বিমূর্ত প্রচ্ছদটিতে একটি ছবি ভেসে উঠেছে, একটি মেয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীপের দিকে, আর তার মুখটা আগের থেকেও রক্তশূন্য! ... ...
মেট্রো স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার পথে অটোটা ঠিক পাঁচবার বাঁক নেয় – অমিত হিসেব করে দেখেছে। সুধীন সমাদ্দারের বাড়ি ঠিক তিন নম্বর বাঁকের মুখে। সুধীন সমাদ্দারকে অমিত চেনে না। কিন্তু রোজই দেখে তাকে তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে লিখতে। সুধীন সমাদ্দার ছোট ছোট কবিতা লেখেন আর লিখে বাড়ির দরজা বা বাইরের দেওয়ালে আটকে দেন। তলায় সই – সুধীন সমাদ্দার। ... ...
গল্প পরে। আগে পটভূমি। সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এক ভূখণ্ড ছিল—উর্বর, শ্যামল। বহু কাল আগে, বাইরের দেশ থেকে আরবি ঘোড়ায় চড়ে আসা মুসলিম ঘোড়সওয়াররা সেই দেশ দখল করেছিল। তারা খাওয়ার আগে হাত ধোয়; শুয়োর খায় না, অন্য প্রাণীর মাংসও—বিশেষ কায়দায় না মারলে খায় না; জন্মের পরে খৎনা আর মৃত্যুর পরে গোর দেওয়ার নিয়ম পালন করে; তাদের পুরুষরাও হাতে-পায়ে রঙিন হেনা পরে—যার ফলে অন্যের চোখে তাদের ‘মেয়েলি’ মনে হয়। সব মিলিয়ে—এক অদ্ভুত, বিজাতীয় সংস্কৃতি। ... ...
বাবা গাছগুলোকে নিয়ে পড়ে থাকলো। দিন নেই, রাত নেই - ওগুলোকে জলখাবার খাওয়াল, রোদে গোসল করিয়ে আনলো, দোকান থেকে মালমশলা কিনে নিজের হাতে বেঁটে আর পিষে স্প্রে করলো। বাবার মত অবসর থাকলে আমিও তো করতুম! চাকরি খোঁজা, ট্যুইশানির পাশাপাশি ক্লাব চালানো দুটো! পাড়ার কতগুলি ছেলেপুলে আমার দিকে তাকিয়ে, তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আসে, শলা-পরামর্শ, আপোস-রফা; মাঝে মাঝে ট্যুর থাকে, ট্রেকিং চলে। আমি আনমনে গাছগুলি আর বাবাকে দেখতে থাকি। বাবা গাছগুলির সাথে এমনি মিশে থাকে যে, কোনটা গাছ, আর কোনটা বাবা -আলাদা করে চিনতে পারি না, প্রবল এক দৃষ্টি বিভ্রমে ভুগতে থাকি। ... ...
আজ সেই রাত।পার্কে গিয়ে তাই করি, বেঞ্চটা খুঁজে বার করে বসি । একটা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছে কেউ বেঞ্চটার ওপর, সেটা দুমড়ে পাশে সরিয়ে দিলাম। পার্কটা ফাঁকা । ঘড়ির দিকে চোখ রাখি, সেকেন্ডের কাঁটাটা ঘুরছে । এখনো পনেরো মিনিট বাকি আছে। হেলান দিয়ে বেঞ্চে মাথাটা তুলে ওপরে তাকালাম। ঝিকমিক করছে নানারকম তারা। একটা কৃত্রিম উপগ্রহ সপ্তষিমণ্ডলকে পিছনে রেখে আকাশ পেরিয়ে যাচ্ছিল। ... ...
আচমকা একটা খটখট শব্দটা শুনতে পেল - বন্ধুটির ট্যবলেট পর্দায় স্থির হল মোরসালিনের প্রজেক্টর। ভাবনায় ডুবে রয়েছে তার হৃদয়ের বন্ধু; তার আচমকা, অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। হঠাৎ কি মনে করে মোরসালিনের লেখাসমেত ইমেইলগুলো এক সাথে করল সে। নিঃশ্বাস পড়ছে না মোরসালিনের, শিহরিত নেত্রে চেয়ে রয়েছে বন্ধুটির ইমেইল পেইজে, হয়ত এখুনি কোন সম্পাদকের কাছে প্রেরিত হবে। ... ...
রণজয় চলে যাবার পর কুশল একবার ভাবল , আধঘন্টা সময় কাটাতে রণজয় এই স্বপ্ন দেখার সঙ্গে মৃত্যুর খবরের যোগ করে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে ? হতেই পারে , শুধু রণজয় কেন , আসলে কোম্পানি ফ্রিতে দিচ্ছে বলে এখানে যারা আসে অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। কুশল বুঝতে পারে কিন্তু বলেনা কিছু। কিন্তু রণজয় এরকম গল্প বানাবে শেষমেশ ? রণজয়ের কথাবার্তা শুনে এতদিন সেরকম মনে হয়নি । ... ...
রূপকথা, আজকের দিনের। মিতুলের অভিযান। অভি তারার আলো বুকে নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার। আগে প্রকাশিত। এখানে তুলে আনলাম। ... ...
মামা উড়নচন্ডি স্বভাবের জন্য শৈশবে তাকে ‘ঘোড়া’ উপাধি দিয়েছিল, সে খুব ক্ষেপে যেত দুষ্টুমির ছলে কেউ এই নামে ডাকলে…. অথচ সে প্রায়ই দাঁড়িয়ে ঘুমোত এবং তা কেউই জানতো না। ছোট থেকেই সে খুব সোজা হাঁটে, একই রকম করে কদম ফেলে; তার চোখ দেখে, সবই তো সরল পথ, যেখানে পথ বেঁকেছে বলে মনে হয়, সেখানেই তো নতুন পথের খোঁজ পেয়ে যায় সে। বেতার তরঙ্গের মত সে সোজা ছুটে, মাঝে মাঝে মহাকাশের কাছে পৌঁছে যায়, বায়ুমন্ডলের সর্বোচ্চ সীমায় বাঁধা খেয়ে আবার ফিরে আসে পৃথিবীতে। একদিন সে-ই নানাজানের হাতের বাঁধনে পিষ্ট হতে হতে এক গনজমায়েতের মুখে দাঁড়িয়ে জানলো, ‘এক রত্তি মাংস নাই শরিলে…সাধারন বৃত্তি না…ট্যালেন্টপুল…সবই তাঁর কেরামতি!‘ তীর্যক চোখে তাকিয়েছিল তারা সবাই, সম্মিলিত একটি ফিসফিসানি ঢেউয়ের মত আবর্তিত হয়ে প্রায় পিষে ধরছিল তাকে। ... ...
ঝুরো গল্পের সংকলন প্রকাশ করতে চাই ... ...