সে সময় পুরুলিয়া মানে কিষেণজি। আমাদের যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে বাঘমুন্ডির দু'জন স্কুল শিক্ষককে অপহরণ ও হত্যা করা হয়। সে ঘটনায় তখন সারা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। ... ...
বাবা-মা চায় না আমি এইসব গল্প শুনি। কিভাবে তারা সব হারিয়ে এখানে এসে আবার গোড়া থেকে জীবন শুরু করেছে, রিফিউজীর জীবন, সেটা মা-বাবা-ঠাকুমা কেউ বেশী বলতে চায় না। কিন্তু বীণা পিসী আমায় চুপি চুপি তার গল্প বলে, আমি চুপি চুপি শুনি। আমি ভেবে পাই না লোকে কেন বর্ডার দেয়। কেন বর্ডার পার হতে হয়। এমন হয় না, পৃথিবীতে কোথাও কোন বর্ডার থাকবে না? ... ...
হারিকেন ইসাইয়াস এসে জোর ধাক্কা দিয়ে গেল উত্তর আমেরিকার ইস্ট কোস্টে| বিদ্যুৎবিহীন, নেটওয়ার্ক-বিহীন অবস্থায় আটকে পড়া দুটি ছেলেমেয়ের জীবনে কেমন করে প্রেম জমে উঠলো, আজ তারই গপ্পো| ... ...
পাশের টেবিলে তিনজন বসে গল্প করছিল। আমি আড়ি পেতে শুনছিলাম। আড়ি পেতে ঠিক নয়, কানে আসছিল। অসমবয়েসী তিনজন। একজন বছর পঁচিশেকের, একজন বছর পঁয়তিরিশের, আর অন্যজন আমার বয়েসী হবে। বছর পঞ্চাশেক। পানভোজনের মাঝারি মানের রেস্তোঁরা। আমি অনেকদিন থেকে এখানে আসি। পান আর আহার দুইই ভাল। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম যেমন বদলেছে, আমার রুচিও। এদেরও দেখলাম রুচির তফাত। ছোটজন নিয়েছে বিয়ার। মেজোজন রেড ওয়াইন। বড়জন শুনলাম সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি অর্ডার দিল। খাবারেও তিনজন ভিন্নপন্থী। ছোটজন অর্ডার করল ঝাল চিকেন উইংস। দ্বিতীয়জন চাইল নিউজিল্যান্ডের আমদানী ল্যাম্ব শ্যাংক। বুড়োজন নিল রেয়ার-মিডিয়াম ফিলে মিনিয়ন। আট আউন্সের। মানে খুবই ছোট। ... ...
“কারণ এলিয়েনেশন এই পৃথিবীতেই হয়!” এবার নিজের জায়গা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় অপরাজিতা, “আপনি যেমন করেছেন আপনার গপ্পে…”“আমি এলিয়েনেশন করেছি?”“করেননি? রাজপুত্র থেকে কেরাণীপুত্রের বৃত্তের বাইরে সবাইকে?” ... ...
এরপর একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে রেণু নামবে; পিয়ানো যেখানে বাজছে সেদিকেই যাবে রেণু- নামতেই থাকবে -তাকে আর আটকাতে পারবে না সুবর্ণ- আস্তে আস্তে রেণু কুহেলির সন্ধ্যা রায় হয়ে যাবে। ... ...
আলাদা বলেই এর একটা নাম রেখেছিলেন বিপ্লব - সানাই। ছোটবেলায় বাঁকুড়া জেলার খাতড়ায় যে পাড়াতে ওঁরা থাকতেন সেখানে একটা রাস্তার কুকুরের ওই নাম ছিল। কুকুরটা ডাকতো একটা অদ্ভুত গলায়, কেউ একজন ওই নাম দিয়েছিল, সেটা চালু হয়ে যায়। নামের কথা ভাবতে গিয়ে ওইটাই মনে এসেছিল তাঁর। এতদিন কোথায় ছিলে? ফিস ফিস একটা বনলতা সেনীয় প্রশ্ন করলেন বিপ্লব। ... ...
ওপরের তাক থেকে তিন চারটে বই টেনে নামাতেই একটা খাম মেঝের ওপর পড়ে গেল। টুলের ওপর থেকে রঞ্জন সাহা তাকিয়ে দেখলেন একটা বড়সড় ব্রাউন রঙের খাম। কিসের খাম বুঝতে পারলেন না। এই তাকটা খুব একটা ব্যবহার হয় না। মাসখানেক ধরে গৃহিনী তাগাদা দিচ্ছেন বই-এর আলমারির ওপরের তাকটা পরিষ্কার করার জন্য। আজ টুলে উঠে সবে কাজটা শুরু করেছেন, তার পরেই এই ঘটনা। ... ...
-ওই বেজান বেড়াটার জন্য কত চোখের পানি, কত ঘৃণা, কত যন্ত্রণা, কত যুদ্ধ। যার জান নাই তার লাগি কত জান যায়, আমি রাতের আন্ধারে বেড়াটারে খুইলা লই। যেহানে বেড়া নাই সেহানে দেশভাগ নাই। সব এক, কে কইবে কোনটা দেশ আর কোনটা বিদেশ? ... ...
পথ চলতে গিয়ে যে সকল মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি তেমন একজন কে মনে রেখে ... ...
সেদিন কী সাংঘাতিক কাণ্ডটাই না ঘটেছে জানো কি তোমরা? রানি ঝিলিমিলির রাজমুকুটখানি হারিয়ে গেছে। রানি ঝিলিমিলি তো লাল রেশমি উড়ুনিটা পেয়ারা গাছের ডালে ঝুলিয়ে আর মুকুটটি খুলে গোলাপগাছের তলায় রেখে সইদের সঙ্গে একটু কুমিরডাঙ্গা খেলতে গেছেন। খেলছেন তো খেলছেন, বেলা গড়িয়ে গেল, বিকেল ফুরিয়ে গেল, জলে সূয্যিমামার লাল লম্বা ছায়া পড়ল, তবু খেলা শেষ আর হয় না। শেষমেষ বহুদিনের পুরনো বুড়ো রাজপেয়াদা রামদয়াল ডাকতে এল.. ... ...
তারপর এখানে আর ভালবাসা হবার নয, নয বলেই যেন ইনফিনিটিতে প্রাণ বল্লম গুটিয়ে ফিরছেন জাদুকর তার দীর্ঘ ছায়া পড়ছে মাঠে। ক্রমে গাছে গাছে কমে আসছে সালোক সংশ্লেষ, বাতাসে শ্বাস বাযু কমছে কি? সে বড় করে শ্বাস নেয় ,ঠিক বুঝতে পারে না। ... ...
লোকটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। চাকরি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে মৃত মানুষ নিয়ে কারবার। চাকরি দরকার, আমি রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু আমাকে নদীর পাড়ে, ঠিক শ্মশানের পিছনে নিয়ে আসল কেন বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে অন্ধকার থাকে সব সময়। শ্মশানে আগে আসলেও পিছনে আসা হয়নি। কিন্তু আমার সুপারভাইজারের কোন দিকে কোন খেয়াল নেই, তিনি হনহন করে হাঁটছেন আর বলছেন, "আসেন, জলদি আসেন। কাজ ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সময়ের এদিক সেদিক হয়ে মহা কেলেঙ্কারি!" আমি তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি, আর ভাবছি, সমস্ত ব্যস্ততা শেষ করেই তো মানুষ শ্মশানে আসে, এখানে এত কিসের তাড়াহুড়া? আমার সুপারভাইজার, যার নাম মোহাব্বত, তাকে যে জিজ্ঞাস করব, তার সুযোগ তিনি দিচ্ছেন না। বিড়ি টানতে টানতে দ্রুত হাঁটছেন তিনি, পারলে দৌড় দেন! ... ...
ঘড়িটা কি স্লো যাচ্ছে? নাকি অপেক্ষা চিরকালই ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়? নইলে, কোন সকাল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি, তার দেখা নেই। অথচ নিশ্চিত আসবে বলে জানিয়েছিল। কতদিন যেন আসে নি। মাঝে কাটল কত মাস? নাকি অনেক অনেক বছর? ... ...
গ্রাম। কিন্তু তা বলে গন্ডগ্রাম নয়। গ্রামে স্কুল আছে। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। তারে করে ঘরে ঘরে কেবল কোম্পানির পৌঁছে দেওয়া আনন্দ স্ফূর্তি আছে। তবে সবাইকার পাকা বাড়ি নেই। সবাইকার জন্য পাকা শৌচাগার নেই। কিন্তু উদ্যোগ আছে। দেয়াল লিখন আছে। ঘরেতে একটি পায়খানা বানান, মা -বোনেদের ইজ্জত বাঁচান এমন দেয়াল লিখনের পাশেই গোলাভরা ধান আছে, আবার আলুচাষির আত্মহত্যা-ও আছে। আর আছে একজন ডাক্তার বাবু। ৮৪ বছর তার বয়েস। ... ...
গোরেস্তানে মধ্যরাত্রে পঙ্খিরাজ টানা গাড়ি নামে! গাড়ি ভরা লাশ! গোরেস্তানের নীরবতায় ঝিঁঝিঁর ঝিমঝিম টানা সুরের মধ্যে ঝুমঝুমি বাজিয়ে পঙ্খিরাজ গাড়িটা নাজেল হয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে আর ঘোড়ার ক্ষুরের ক্লান্ত শব্দ চারদিকের মৌনতার মধ্যে রহস্য ঢেলে দেয়! ... ...
আজকাল দেখছি পাখিদের লাফালাফি বেড়ে গেছে চতুর্গুণ। সক্কাল সক্কাল, পাশবালিশটা চেপে ধরে তৃতীয় দফার ঘুম দেবার চেষ্টা করছি প্রাণপন, দেখি জানলায় ঠক্ ঠক্ করে টোকা দিচ্ছে কে যেন। এই লক করে দেওয়া জীবনে কার এত অনুপ্রবেশের উৎসাহ? বাধ্য হয়ে বাঁ চোখটা কোনরকমে খুলে দেখি এক ব্যাটা ছাতার পাখি দিব্যি গা ফুলিয়ে মোটাসোটা হয়ে ঠোঁট দিয়ে ঠুকে চলেছে কাঁচের জানলায়। ... ...
হেমন্তের সকালে ফুলেশ্বরী গ্রামের এ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া একটু দেরিতেই হয়। মৌসুমী বন্যার জন্য এবারে ধান বুনতে দেরি হয়েছে, তাই মাঠে এখনও ধান কাটা শুরু হয়নি। সূর্যের দেখা মেলে বেশ দেরিতেই। বউ-ঝিও ঘর থেকে একটু দেরিতেই বের হয় সকালে। রান্নাঘর বলতে যা বোঝায় তা এ বাড়িতে নেই। উঠোনে কাদা দিয়ে কোমর সমান উঁচু দুইপাশি দেয়াল করে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা, মাথার ওপরে খড়ের সামান্য ছাউনি; বরষার দিনে কাজে দেয়। ... ...
রাহেলার শরীর ভালো যাচ্ছে না কামাল সেটা আগে থেকেই জানতো। গার্মেন্টস বন্ধ হওয়ার পরও বউটাকে গ্রামে নিয়ে যাবার ব্যাপারে তার কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। এরকম সময়ে গর্ভবতী মেয়েদের নিরাপদ জায়গায় সরে থাকা উচিত। সেসব নিয়ে কোনো চিন্তা না করে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাহেলাকে ফেলে ছুটির আমেজে বাইরে বাইরে আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছিল কামাল। ... ...
ঘরবন্দী স্মৃতিকথন -- ছোটবেলায় যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেটি ছিল টালির ছাউনির দু'কামরার ঘর। বারান্দা প্লাস্টারের। তার ওপর সিমেন্টের সর নেই। এবড়ো খেবড়ো হেতনেয় বসে চলত হুটোপুটি। খানিক পা ঘষলেই চামড়ায় সরু সরু দাগ পড়ত...সমান্তরাল; যেন স্কেল দিয়ে মাপজোখ করে কেউ বুঝি খোলস থেকে কয়েক পরত রং তুলে নিয়েছে। তিন হাত উঁচু সেই বারান্দার পাশেই ছিল ঘেঁটু ফুলের জঙ্গল। ... ...