শিবরাম কিন্তু আর এগোল না। নানুকে ফিরে আসতে বললেও সে ফিরছিল না। তবুও শিবরাম তাকে একা ফেলে যেতেও পারছিল না। অগত্যা দাঁড়িয়ে দুজন দুজনের সম্মতির অপেক্ষা করছিল। এমন সময় তারা দেখল ভাঙা থামের পাশ থেকে কেউ একজন উঁকি মারছে। শিবরাম ভয় পেল ঠিকই কিন্তু কাপুরুষের মত পালিয়ে গেলনা। সে ভাল করে দেখল। একটি মহিলা তার দিকে তাকিয়ে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার রুপের ছটায় শিবরামের চোখ আঁটকে যাওয়ার জোগাড়। পড়নে দামী শাড়ি, সারা গা ভর্তি চকচকে গয়না। বেশ পরিপাটি করে সেজে সে এসেছে এখানে। ... ...
স্বস্তি জোড় হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, নিচু হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, “গুরুদেব, আজকে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন?” গৌতম আরও এগিয়ে স্বস্তিকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই? ঠিক কী রকম লাগছে বল তো?” স্বস্তি গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক কী বলতে পারব না, তবে একদম অন্যরকম। আপনি যেন কোন নক্ষত্রের মতো। সবে ফুটে ওঠা পদ্মফুলের মতো। কিংবা... কিংবা... গয়াশীর্ষ পাহাড়চূড়ার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো”। ... ...
[ এমনিতেই যে কোনো এমার্জেন্সিতে আমরা যে রক্ত নিয়ে আসি তার কোনো কাগজপত্তর পেশেন্ট পার্টির হাতে দেওয়াই হয় না। একমাত্র বর্তমানে ওই রক্তের পাউচের ওপরে যে কাগজ বা লেবেলটি সাঁটা থাকে সেটা যদি কেটে রেখে দিতে পারেন, তাহলে অন্তত ভবিষ্যতের আইন আদালতে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা খুব কম। এই প্রসঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম কলকাতার এক প্রাইভেট ব্লাড ব্যাঙ্কের এক বন্ধুর সাথে। সে অনেকদিন ধরেই জড়িয়ে আছে এই ব্লাড ব্যাঙ্কের সাথে। আমার প্রশ্ন ছিল যে ওদের থেকে নেওয়া রক্ত থেকে আমার যদি হেপাটাইটিস বি হয় তাহলে প্রমাণ করবো কি উপায়ে ? ] ... ...
বাংলার সমাজ অর্থনীতি সংস্কৃতির চলমান দলিল। পথে ঘাটে ট্রেনে বাসে অটো ট্রামের দেখা জীবন-সৃতি (স্মৃতি নয়)। ... ...
এইবার শিবরাম মাথা তুলে গড়্গড় করে বলতে লাগল “ আমি প্রতিদিন পড়া করে যাই বাবা। আজ পড়াটা হয়নি। কাল রারণ বধ খেলতে গিয়ে পড়তে বসা হয়নি। তাই পন্ডিত মশাই আমার কান মলে দিল। খুব লেগেছিল আমার। তাও কিছু বলিনি। কিন্তু তিনি আরও একবার…” কথাটা থামিয়ে একবার মাথা চুলকে নিয়ে কিছু একটা মনে করে বলল “ না না, একবার নয়। আরও দু-বার আমার কান মলে দিল। তাই আমিও তার কান মলে দিয়েছি।“ ... ...
পথে ঘাটে যা দেখি। শুনি। এই কলকেতায়। তার একটি হদিস হাদিস। ... ...
[ তিড়িং করে সে বাসের ফার্স্ট গেটে এক লাফ ! কি যে হলো অচিরেই ! ডান পা’খানা নীচের সিঁড়িতে লাগলই না আমার। হড়কে যেতে যেতে বুঝলাম রড ডান হাতে ধরা থাকলেও পা স্লিপ খেয়ে ঘষ্টাচ্ছে রাস্তায়। বাস থামল না। কণ্ডাক্টর দেখলো। গতি বাড়াল বাস। আমার হাত ছেড়ে গেল বাসের রড। চিৎ হয়ে সটান রাস্তায়। বাসের পেছনের চাকা অবলীলায় ঘষ্টে দিল আমার ডান উরু। একটা বিকট যন্ত্রণার মধ্যেই দেখলাম বাস চলে যাচ্ছে দূরে।] ... ...
মানুষের শৈশব ও বাল্য চেতনায় যে শিক্ষার বীজ রোপিত হয় – কৈশোর ও তারুণ্যে নিজের মস্তিষ্কের রসায়নে সেই শিক্ষাতেই সে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খুঁজতে থাকে। কেউ হয় অত্যাচারী এবং বিলাসী রাজা, কেউ মানবদরদী সমাজ-সংগঠক, কেউ দার্শনিক, কেউ দারুণ যুদ্ধবাজ, আর অধিকাংশ হয়, আমাদের মতো থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনের অধিকারী। মস্তিষ্কের এই বিশেষ রসায়নের ফর্মুলাটি আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ... ...
আসলে শিবপ্রসাদ রবীন্দ্রনাথকে একেবারেই পছন্দ করতেন না আগাগোড়াই। তার কাছে কবিত্ব কোনদিন পায়রার খোপে বসে হয়না। কবিত্ব করতে গেলে ডানা মেলতে হয়। আর তার কাছে রবি ঠাকুর পায়রার খোপের মধ্যে থাকা সেই পায়রা যে কিনা বাইরে বেরোতে ভয় পায়। শিবপ্রসাদ রমাকান্তের কথায় মুচকি হেসে বলে “ কবি হলেন মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র এরা। আর হ্যাঁ নবীন সেনও বটে। এরা উন্মুক্ত আকাশ নিয়ে লিখত। কারণ, তারা আকাশ দেখেছে। বন্ধ ঘরে কবিত্ব করা যায়না ভায়া। নবীন সেন, ভাগবতগীতা বাংলায় কাব্যানুবাদ করেছিল। পড়েছ?” রমাকান্ত আর কিছুই বলেনা। সে বুঝে গেছে কলকাতার রসগোল্লা থেকে শুরু করে কবি কোনটাকেই এই আলোচনায় জায়গা করে দিতে পারবেনা সে। শিবপ্রসাদের সামনে চাঁচরের সামনে টিঁকতে পারবেনা কলকাতা। তাই সে চুপ করেই থাকে। ... ...
ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নিচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। ... ...
[ আমার এমআরডি (ওখানকার ৬৯ঙ) নাম্বার জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার। গোটা শঙ্কর নেত্রালয় তখন সুন্নুনাটা। ডাক্তার এক সিকিউরিটিকে ডেকে আমার নাম্বার দিয়ে ফাইলটা আনতে বললেন। বিশ্বাস করুন ঠিক পাঁচ মিনিট। আমার সেই “এ্যালারজিক টু সালফার” লেখা ফাইল ডাক্তারবাবুর টেবিলে। তখন ডানচোখ পুরো অন্ধকার। কালো – নিকষ কালো।] ... ...
শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মাঝে মায়ের মুখটা যেন ভেসে উঠল। শিবরানী উঠোনে নেমে এসে জোড়ে চেঁচিয়ে বলল “ওই যে, ওই যে মায়ের মুখ। আমার মা আসছে আমার বাড়ি।“ তার চোখে মুখে সেই চেনা আনন্দ। সে প্রতিদিন তার ঠাকুরকে অনুভব করে। কথা বলে। তার ভক্তি বারংবার মা দুর্গাকে তার কাছে টেনে নিয়ে আসে। মায়ের সাথে অনেক গল্প করে শিবরানী। অনেক না বলা কথা মা দুর্গাকে বলে সে। যে কথাগুলো আর কেউ জানেনা। ... ...
ড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল “ হ্যাঁ বাবা। তোকে মনে পরবে না! তুই গেলি আর পাঁচু ডাকাত তোর বউকে মেরে সব লুট করে নিয়ে গেল। “ আসলে শিবপ্রসাদ যে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সেটি সবাই জেনে গেলেও। হেমাঙ্গিনীকে যে ডাকাতের দল মেরেছে সেই নিয়ে একটা ঘটনা রটে গিয়েছিল। মানে শিবপ্রসাদ বেঁচে গেল আর’কি। সবাই জানত পাচু ডাকাত লুট করতে এসে হেমাঙ্গিনীকে মেরে ফেলেছে। ... ...
যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে। ... ...
[ প্রথম কেনা এই ফেকো মেশিনটি বসেছিল ডাক্তার মেহতার বাড়ির বৈঠকখানায়। মেশিন বসানোর পরে যখন ডাক্তার মেহতা এই মেশিনের একটা ম্যানুয়াল চাইলেন তখন তাদের কর্মকতা নাকি বলেছিলেন যে এ মেশিনে মাত্র চারখানা কানেকশন। তার জন্যে আবার ম্যানুয়াল কি হবে ? ১৯৮৮ তে তিনি উড়ে যান আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রে ডাক্তার উইলিয়াম এফ ম্যালোনির কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে। তারপর থেকে আর পেছনে তাকাননি ডাক্তার মেহতা। ভারতও অর্জন করল এই নতুন মেশিনটার সুবিধে।] ... ...