আমার বাড়ীতে না জানলেও বিতানের বাড়ীতে আমাদের সম্পর্ক গোপন ছিলনা। বিতানের মা আর দাদাভাই প্রথম থেকেই সাদরে মেনে নিয়েছিলেন আমাকে, যদিও ওর বাবার মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছিল। সেদিন বিতানের বাড়ী গিয়ে পৌঁছে বেল বাজাতেই কাকিমা দরজা খুলল আর পিছনে কাকুর গলা, "বিতান তো বাড়ীতে নেই।" আমি দুজনকেই জড়িয়ে ধরে বললাম,"বিতান ছাড়া আমি যেন এ বাড়িতে আসিনা, আর তোমরা বুঝি আমার কেউ নয়।" আর তারপর যখন ওনাদের অবাক করে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানালাম সত্যিই অবাক হয়েছিলেন দুজনেই। দুজনের চোখে মুখে লজ্জা, আনন্দ ভাললাগার মিশেলে যে আলো সেদিন দেখেছিলাম তা আমার জীবনেও সেরা প্রাপ্তি । দাদাভাই ও অবাক হয়েছিল খুব। যে দিনটা ওরা জানত না, জানার কথাও ভাবেনি কোনওদিন সেটা এভাবে উদযাপন হবে কল্পনাও করেনি। আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বিতানকে ফোন করে দাদাভাই সবটাই বলেছিল। আর জীবনে প্রথম বার কেক কাটার আনন্দে চোখে জল এসেছিল কাকুরও, আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন," এভাবে আমাদের জন্য তুমি ভাবতে পার, আমি আগে কোনওদিন ভাবিনি, আমাদের দেখা সম্পর্কের বাইরে ছেলে ছেলের সম্পর্ক মানতে পারিনি, তাই হয়তো তোমাকে নিয়ে অসুবিধা ছিল। তুমি আমার ছেলের থেকেও বেশি।" কাকু কাকিমা দুজনেই চেয়েছিলেন আমাদের সম্পর্কটা যেন অটুট থাকে। যদিও ২০০৬ সালে আমার এইচ এই ভি ধরা পড়ার পর আমার আর বিতানের মাঝে সম্পর্কটা আর থাকেনি। তবে কাকু কাকিমার বিয়ের দিনটাতে আজও আমি ওই দিনটাতে ওদের ফোন করতে ভুলি না। ... ...
ছোটবেলায় কাজ ছিল, নতুন নতুন রাস্তায় গিয়ে সে রাস্তার নাম দেওয়া দেশের মতো করে। তখন মাথায় সবে সবে কলম্বাস! একটা কানাগলির নাম ছিল বারান্দাপুরী, সে গলির বাড়িগুলোর বারান্দা আমরা কিনে নেব। ঝিলের পাশের যে ঘরোয়া আলোছায়া রাস্তা, তার নাম দি রেখেছিল দীঘিনগর। এই দীঘিনগর নাকি অভিশপ্ত। দীঘিতে যারা যারা আজ অব্দি ডুবে গেছে, রাত্রে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলে জলে নাকি আজও বুদবুদ ওঠে, জলে কি যেন ভেসে ওঠে … ... ...
সত্যি কথা, পার্কসার্কাসের ওই ১/সি সার্কাস মার্কেট প্লেসের তিনকামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট, যার ভেতরে গাদাগাদি করে আমরা অন্ততঃ আঠেরো জন থাকি, তাতে চলতে ফিরতে কারও না কারও গায়ে ধাক্কা লাগার কথা। লাগত না, তার দুটো কারণ। এক, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের সংখ্যা কমতে থাকত। সবাই এক এক করে স্কুল-কলেজে বা অফিস-কাচারিত, একেবারে ‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’। ... ...
আমাদের মত মানুষদের একটা বড় অংশই তথাকথিত মেয়েলি হাবভাবাপন্ন। আবার এর একটা বড় অংশ নিজেকে সিনেমার হিরোইনদের সঙ্গে তুলনা করে মনে মনে হিরোকে নিয়ে স্বপ্নও দেখে। যেমন লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনে তাবড় তাবড় সিনেসুন্দরীদের দেখে অনেক মানুষ লাক্স ব্যবহারে নিজের না পাওয়া বোধটা চরিতার্থ করে। মনে মনে নিজেকে ওই সিনেসুন্দরীদের সমতুল ভেবে আনন্দ পায় তেমনই এই মেয়েলি ছেলেরাও নাচ বা ঠমকে নিজেদের মনে মনে ওই হিরোইন ভাবতে থাকে। আবার বেশির ভাগেরই মনের মধ্যে মর্দ পুরুষ হিসাবে পরিশ্রমী খেটে খাওয়া পুরুষমানুষের ছবি আঁকা থাকে। আর এই মর্দ পুরুষদের বিনোদনে সিনেসু্ন্দরীর কল্প-কামের পোলাওতে ঘি ঢালতে থাকে এই সকল মেয়েলী হাবভাবের রূপান্তরকামী পুরুষরা। এ এক অদ্ভুত ইক্যুয়েশন। বেশিরভাগ মানুষই পরিবার ও সামাজিক ব্যুলিড হতে হতে পড়াশোনার চৌহদ্দি থেকে সরে আসে। অথচ একটু নাচের প্রতি আগ্রহ, মঞ্চের হাতছানি, সঙ্গে দুয়সা রোজগারের স্বপ্ন সবমিলিয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে পিছপা হয়না আজও অনেকেই। বিহার, উত্তর প্রদেশের বিয়ে শাদী শুভ অনুষ্ঠানে বা লগনে এক প্রথা লণ্ডা নাচ। এই লন্ডা নাচে প্রতিবছরই ভিড় জমায় পূর্বভারত, নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলের রূপান্তরকামী পুরুষেরা। ... ...
সেদিন বুঝেছিলাম সিঁদুর নিয়ে স্বীকৃতির যে চাহিদা মনে মনে লালন করি যা নিয়ে আগের দিন অত মনখারাপ, তা আসলে বহুগামিতার মাঝে ভালবাসার স্বীকৃতি । এ সমাজে বহুগামিতা অনেক বেশি সহজ, না আছে আইনি দায়, না আছে সন্তানধারণের দায় না আছে সামাজিক দায়। শুধু মাত্র মনটাই সব নয়, আজকের কুসুমদের শরীর দিয়েও তো ভালবাসা মেলে না। সুখের লাগি প্রেম চাইলেও প্রেম মেলেনা শুধু সুখ চলে যায়। তাই ভালবাসার মানুষকে শুধুই ভালবাসায় আগলে রাখা যায় নিজের মধ্যে এ বিশ্বাস আনা বড় কঠিন। তবে কোথাও যেন একটা জেদ তৈরী হচ্ছিল মনে মনে। কেউ জানতে চাইলে চোখে চোখ রেখে উত্তর দেওয়াটা ততদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে। কোলকাতার আশে পাশে কাজ করা সংগঠনগুলোর সাথেও একটা বন্ধুত্ব হয়েছে কাজের সুত্রে। রিকির সূত্রে আলাপ হয়েছে সমকামী মহিলাদের নিয়ে কাজ করা পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সংগঠন "স্যাফো" র সাথে। বইমেলায় হাতে এসেছে স্যাফোর প্রকাশিত "স্বকন্ঠে" পত্রিকা। ওদের দেখেছি সারা বইমেলার মাঠ ঘুরে ঘুরে মানুষের সাথে কথা বলে তাদের কাছে "স্বকন্ঠে" পৌঁছে দিতে কতটা কষ্ট করতে হচ্ছে। অনুভব করতে পারছি ক্রমশঃ ভালবাসার জন্য জীবনের জন্য প্রতিটা মানুষের পথ চলা। আর সে পথে শরিক হয়ে গেছি নিজের অজান্তেই। ... ...
সামাজিক ফ্রেম অফ রেফারেন্সটা এত বেশি করে মাথায় গেঁথে বসে যায় যে সমলিঙ্গের সম্পর্কেও সেই নারী-পুরুষের তথাকথিত সম্পর্ক,বিয়ে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেই সম্পর্কের স্বীকৃতি বলে মনে হয়। নিজেদের অজান্তেই আমাদের সঙ্গীরা মনের ভেতর সঙ্গী/ বন্ধু / পার্টনার না হয়ে শুধুই বর-বৌ/ স্বামী স্ত্রীর খাঁচায় ঘুরতে থাকে। অভিধানটাও এত সেকেলে যে সেখানেও অন্য শব্দের কোনও অপশান নেই। তথাকথিত সিসজেন্ডার হয়েও কেউ কেউ মনে মনে শাঁখা-সিঁদুরের ফ্যান্টাসির লালনও করতে থাকি। আর তাই তো দশমীর সিঁদুর খেলায় অংশ নেওয়া বা দোলের লাল আবিরের আধিপত্য ও আমাদের জীবনে কয়েকগুন বেশি। আসলে মনে মনে তো সমাজ নিয়মে সিঁদুরের স্বীকৃতিটাই লালিত হয়। আর হাইলি পলিগ্যামাস সম্পর্কের মাঝখানেও প্রেমিকপুরুষের হাতের সিঁদুর,সম্পর্কের অধিকার নিয়ে কখনও কখনও আরও বেশি নেশা ধরাতে সক্ষম। নেশায় বুঁদ হতে মনে মনে অনেকের মত আমি তো আজও চাই। আসলে ওই নেশায় মাতাল হয়ে বোকা বনতে চাওয়াটাই যে আসল ফ্যান্টাসি, স্বপ্নে পোলাও রাঁধলে যতখুশি ঘি ঢালোনা কেন কে আটকাবে...সে রাতে সকলেই বুঝেছিল একচুটকি সিঁদুরের কিমত কতটা। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিল কান্নার রোল। সকলের জীবনেই কোনও কোনও সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার চেপে স্মৃতি বেড়িয়ে এসেছিল কান্না হয়ে। সারারাত মানুষগুলোকে সামলে ছিল যে দুজন মানুষ তাদের অবদান ভোলার নয়। দুই মানসিকস্বাস্থ্য সহায়িকা, দুই কাউন্সেলর। ... ...
সে এক অন্য জগত। বিভিন্ন রেলস্টেশন, বড় বাস টার্মিনাল, গঙগার ঘাট, পরিত্যক্ত কারখানা, হাইওয়ের ট্রাক টার্মিনাল বিভিন্ন অন্ধকার অংশে সন্ধ্যে হলেই পুরুষ সমকামী রূপান্তরকামী মানুষরা যেতেন সে সময়। কোথাও একসাথে বসে আড্ডা, কোথাও বা অন্ধকারে শরীর ছোঁয়া কোথাও আরও একটু বেশি কিছু। এর আগে অল্প বিস্তর কয়েকটা জায়গায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও এসমস্ত জায়গায় যাওয়া সেই প্রথম । সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা, এইচ আইভি বা অন্য যৌনরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা পাশাপাশি কন্ডোম বিতরণ, কারও কোনও যৌনরোগের লক্ষণ থাকলে তাকে সঙ্গে করে ড্রপ-ইন সেন্টারের ডাক্তারবাবু পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। তার সঙ্গে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কম করে বছরে দুবার এইচ আইভি ও প্রয়োজনে যৌনরোগের পরীক্ষা করানো ও প্রয়োজন মত ওষুধ দেওয়া। যতটা সহজ ভাবে লিখছি ততটা সহজ কাজ না। যে মানুষগুলো ছোট থেকে বড় হতে হতে শুধুই ব্যুলিড হয়েছে, যারা বারংবার সম্পর্কে বিশ্বাস করেছে আর ঠকেছে তাদের নিজেদের প্রতি ভালবাসা অনেক কম। হঠাত করে আমাকেই বা তারা বিশ্বাস করবে কেন। ... ...
আমি আমার ছেলের শরীরে সুখী। খুশি কিনা আজও ভাবিনা। ছেলে হয়ে জন্মানোর সুবিধা ভোগ করতে করতে অভ্যেস হয়ে গেছে। মনে মনে কখনও কখনও নিজেকে নারী ভাবলেও ছেলের শরীরটার পরিবর্তন আমি চাইনি কখনও । মেয়েদের "মত" হওয়া আর মেয়ে হওয়া এক না। আমার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের খামতি, অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও আমি তা নিয়ে ভাল আছি। আমি আমার জন্মগত লিঙ্গচিহ্ন পরিবর্তনের কথা আজও ভাবিনা। অথচ হ্যাঁ একথাও সত্যি আমিও মনে মনে নিজেকে মেয়ে ভাবতেই ভালবাসি, তথাকথিত হেটারোনর্ম্যটিভ মানুষদের মতই বিছানা ও জীবনে আমার পুরুষ সঙ্গীর জন্য তার তথাকথিত স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই। তারপরেও আমি চাইনা আমার স্তন নারীর মত হোক, বা আমার প্রশস্ত যোনি পথ থাকুক। শাড়ী আমার প্রিয় পোষাক আবার তার জন্য দাড়িও থাকবেনা এ ভাবনা আমার নেই। চিরকাল মনে ভেবে এসেছি পোষাক আমার পরিচয় না। যে গয়না আজ পড়লে লোকে হাসে, তাইই তো দেখি মন্দিরের দেবতার গায়ে। তবে কেন এ সামাজিক দ্বিচারিতা আজও বুঝিনা ... ...
আমার ছোট বেলা থেকে বড় হওয়ার মধ্যেও বেশ কিছুটা মেয়েলিপনা ছিল। একটা বয়স পর্যন্ত সেগুলো নিয়ে বাড়ীর লোকে প্যাম্পার করলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজের সাজগোজের ইচ্ছেটা মনের মাঝেই লুকিয়ে ছিল। রণ র সঙ্গে সম্পর্কের কারণে সেটা আরও চাপা পড়ে গেছিল। আসলে বিছানায় নারীত্বকে নিয়ে আদিখ্যেতা করলেও বাইরে যে সেটা করা যায় না। তারপরেও মেয়েলি পুরুষের সঙ্গে চলাফেরায় যদি নিজের সম্পর্কে লোকে কিছু বলে! যদি গোপন কথা গোপন না থাকে। নিজেকে তো মেয়ে মনে করে মেয়েলি হতে চাইতাম না। সেবার চন্দননগর থেকে বাড়ী ফেরার সময় ছলবলে কয়েকটা বাচ্চার সাথে আলাপ হল। এতদিন দূর থেকে দেখলেও সামনাসামনি আড্ডা দিতে দিতে একসঙ্গে ফিরলাম সেদিন। একসাথে ফিরতে গিয়ে আরও একটু জ্ঞান অর্জন হল। বুঝলাম আসলে কতি মানে মেয়েলি পুরুষ। এটা উল্টি ভাষা সে ভাষায় আরও কিছু বিশেষ শব্দ যোগ হল আমার ঝুলিতে, সবগুলো শব্দই যৌনতায় মাখামাখি। কিন্তু সাহিত্যের ছাত্তর হয়েও এমন ভাষার কথা কোনদিনও শুনিনি। ভাবলাম হবে হয়তো কোনও আঞ্চলিক ভাষা। ওরা আমাকেও "কতি" বলতেই রিয়্যাক্ট করে উঠলাম, "আমি কতি নয়"। তখনও জানতাম না এই মানুষ গুলোই একদিন আমার ভবিষ্যতের হাসিকান্নার সাথী হতে চলেছে। ... ...
দুর্গোপূজো শেষ, বিজয়াদশমীর বিসর্জন সবে শুরু। বিকেল পাঁচটা নাগাদ অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সময় দূর থেকে কোথাও অবাঙালী পাড়ায় রাবণ জ্বলছে, বাজি পুড়ছে। তার দূরাগত গুরুগুরু ধ্বনি মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ঘড়ি ধরে দরজায় কড়া নড়ে উঠত। বাচ্চারা টের পেতাম ঢাকুরিয়া থেকে দুই জোড়া পিসিমা-পিসেমশায়রা এসেছেন! যাঁদের পদবি ছিল মজুমদার, বাঙাল উচ্চারণে মন্দার!দরজা খুলতেই ধোপদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবি পরা বিপুলবপু... ... ...
এতো শুধু বেড়াতে যাওয়া নয়, মনের মধ্যে কুড়কুড়িও। অনেকটা সময় বিপ্রদাসকে নিজের মত করে পাওয়া, অনেকরকম ভাবনা, উত্তেজনাও। আমার কাছে ডায়মন্ড হারবার বা বকখালি মানেই তখন বইয়ে পড়া জগত, "সপ্তপদী" সিনেমার এই পথ যদি না শেষ হয়। রাস্তায় যেতে যেতে অনর্গল বকবক। কথায় কথায় বেড়িয়ে গেল আমি সাঁতার জানিনা। শুরু হল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিপ্রদাসের ভয় দেখানো। বকখালি যেতে হলে পার হতে হয় হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী, আর সেটা নাকি পার হতে হয় ডিঙি নৌকাতে। এ নদীতে কামঠের প্রকোপ অনেক বেশি। যদিও কার্যক্ষেত্রে দেখলাম নদীটা অত চওড়া না তবে গভীরতা বেশি। আর ডিঙি নৌকা না সাধারণ দাঁড় টানা নৌকায় পারাপার। যদিও ভেসেলে করে বাস বা গাড়ী সমেত পার হওয়া যায়। তবে তার নির্ধারিত সময় আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে গেছি। এরপর আঁধার নামতেই শুরু হল লোডশেডিং, গ্রাম্য রাস্তায় সাপখোপ আর তেনাদের গল্প। এ যেন নতুন করে ইন্দ্রনাথের সাথে শ্রীকান্তর অ্যডভেঞ্চারে যাওয়া ... ...
একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে বসে অনেক ভাবলাম, মনে হল, আচ্ছা ছোটবেলা থেকে শেখা মুল্যবোধ আর সংস্কারের বিসর্জনও তো আত্মহত্যারই নামান্তর। তাহলে আর সতীত্বের সংস্কারে নিজেকে বেঁধে, বেঁচে থেকে কি লাভ! তাই একগামিতা-সতীত্ব-সংস্কার বিসর্জন দিয়ে শুরু করলাম সেক্স ওয়ার্ক। ম্যাসাজ পার্লার, টয়লেট, হাইওয়ে যা এতদিন দূরে ছিল সেই সব জায়গায় যাওয়াও শুরু হল আমার। ভাষা ভাষা ধারণা ছিল "বহুজনের সাথে সেক্স করলে এডস হয় আর এডস হলে মানুষ মরে যায়।' আর তাই এই সহজ ও পেইনলেস আত্মহত্যার এই রাস্তাই বেছে নিয়েছিলাম সেদিন।তখনও এত ম্যাসাজপার্লারের ছড়াছড়ি কোলকাতা শহরে হয়নি। দক্ষিণ কোলকাতার সদ্যগজানো সেসব পার্লারে পয়সা ওয়ালা অভিজাত লোকেদের আসর।যদিও আজন্মলালিত সংস্কার বিসর্জন দেব বললেই দেওয়া যায় না। আর তাই একদুদিন যেতে না যেতেই ম্যাসাজ পার্লারের ম্যাসিওর কাম পুরুষ যৌনকর্মী হওয়া মোটেই শান্তি দিচ্ছিল না আমাকে। ... ...
কৈশোরে গড়ের মাঠে (তখন মনুমেন্ট ময়দান নয়, গড়ের মাঠই বলা হত) ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে মাউন্টেড পুলিশের তাড়া খেয়ে (ঘোড়সওয়ার পুলিশ) গ্যালারিতে বসার পর টের পেলাম — এটা ঘটিদের, থুড়ি মোহনবাগান সাপোর্টারদের এলাকা। মুখে কুলুপ এঁটে ওদের কথোপকথন শুনতে গিয়ে জানলাম — খেলার মাঠে বাঙালদের কোড নেম ‘জার্মান’! কেন? কে জানে! ... ...
এইসময় আমি আস্তে আস্তে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম নাচ কে। দিদি মানে আমার নাচের গুরু শিখিয়েছিলেন পি.সি. সরকারের বলা সাফল্যের তিনটি মন্ত্র প্র্যকটিস, প্র্যাকটিস,আর প্র্যাকটিস। তাই দিদির ক্লাসের আর এক ছাত্র এগিয়ে এল তালিম দিতে। সপ্তাহে আরও একটা দিন করে বাড়ল প্রথাগত অভ্যেস। শুরু হল তার বাড়ীতে আলাদা করে যাওয়া। কোনও একদিন দিদির নাচের অনুষ্ঠানের শেষে বেশ রাত হওয়ায় তার বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাম। আর রাতের বেলা আমার শরীরে উঠে এসেছিল সে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম তাকে। হিসহিসিয়ে উঠেছিল, "তোমার রণ তো তোমায় এর আগেই এতদিন ধরে ভোগ করেছে। আর আমার বেলায় এত সতীপনা!" ঘেন্নায় কুঁকড়ে উঠেছিলাম। এখানেই শেষ হয়নি টলিউডি সংলাপ! হিসহিসিয়ে বলে উঠেছিল, "কি মনে করিস আমরা কেউ কিছু বুঝিনা, দিদির ওখানে আমরা সবাই তোকে নিয়ে আলোচনা করি, বেশী নাটক করিস না। এরপর তুই ওখানে কি করে মুখ দেখাস দেখবো।" লজ্জায় কুঁকড়ে গেছিলাম সেরাতে, ভোর হতেই বেড়িয়ে এসেছিলাম। সেদিন কেন জানিনা মনে হয়েছিল "নাচ শেখা" আমার জন্য না। ওদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নিজের কেরিয়ার নিয়ে ভাবাটাই ভাল বলে মেনে নিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে নিজের নাচ নিয়ে স্বপ্ন আর দেখিনি। আজকাল টিভির চ্যানেলে চানেলে নাচের রিয়েলিটি শো, কত সুন্দর সুন্দর কোরিওগ্রাফি। আমার বাবা মা ভাই সবাই দেখে। শুধু আমিই দেখিনা... ... ...
রণকে ভালবেসে ওর কাছে বারবার দৌড়ে গেলেও ওর বিয়ের পর থেকে পারতপক্ষে শারীরিক সম্পর্কটা আমি এড়িয়ে চলতাম৷ খালি মনে হত আমি রণ-র কেউ না। আমি কি রণ-র রক্ষিতা না ভালবাসা ! রণ বোঝাতে চাইত সমাজ না মানলেও আমিই আসলে রণ-র সব। বিশ্বাস করতে পারতাম না কিছুতেই। বিয়ের আগে কোনও একদিন মজা করে রণ সিঁদুর পড়িয়ে দেখতে চেয়েছিল আমায় কেমন লাগে। এ মজায় সেদিন সাধ দিইনি। ঠাসিয়ে একটা চড় মেরে বলেছিলাম," আমি তো তথাকথিত বৌ হতে পারব না তবে কেন এ প্রহসন ! " অথচ মনে মনে কতবার নিজেকে সিঁদুর পড়ে দেখতে চেয়েছি সে তো কেবল আমিই জানি। আজন্ম লালিত সংস্কারের সিঁদুর আসলে যে মর্যাদার পরিচয় বহন করে সে মর্যাদা পেতে চেয়েছিলাম মনে মনেই... ... ...
নিজেকে নিয়ে তখন হাজার রকম প্রশ্ন আমার। মনে মনে সেদিনও জানতাম ছেলে হয়েও আর একটা ছেলেকে ভালবাসা অন্যায় নয়।তবুও বুঝতে পারিনা, কি করব। কি করা উচিত? এসব ভাবতে ভাবতে একদিন মনে হল "কাউন্সেল ক্লাব" এ ফোন করলে হয়। এই সংস্হা তখন কোলকাতায় সমকামী মানুষদের নিয়ে কাজ করছে জানতাম । কাউন্সেল ক্লাবের কথা শুনেছিলাম ‘তারাবাংলায়’ রঞ্জনের সমকামিতার ওপর সাক্ষাতকার শুনতে শুনতে। তারও পরে আমার কলেজ যাতায়াতসুত্রে হয়ে ওঠা বিভিন্ন বন্ধু দের সুত্রে তখন হাতে এসেছে " বোম্বে দোস্ত", "নয়া প্রবর্ত্তক" পত্রিকা। সমকামিতা নিয়ে কিছু তথ্য পেলেও আমার প্রশ্নের উত্তর সেখানে মেলেনি। একদিন ফোন করলাম কাউন্সেল ক্লাবের হেল্পলাইনে... ... ...
দাদু আমাকে বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নিজে মুখে মুখে শেখাতে লাগলেনঃ “তিরিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর, / সেইরূপ এপ্রিল, জুন আর নভেম্বর। / আটাশ দিনেতে সবে ফেব্রুয়ারি ধরে, / বাড়ে তার একদিন চারিবর্ষ পরে। ... ...
আজও মনে করি যে কোনও সম্পর্কের ভিত হল বিশ্বাস, আর সেই বিশ্বাসটাই যদি কখনও টলে যায় তার ওপর দাঁড়িয়ে প্রেমের ইমারত টেঁকে না, যত ভালবাসার চুন সুড়কিই সেখানে দেওয়া হোক না কেন...! মজার বিষয় আজও আমার বিশ্বাসের ভিত কেউ আর তৈরী করতে পারল না। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যখনই কাউকে ভালবেসেছি সেইই ঘটিয়েছে আমার জীবনে। একবার না বহু বহুবার... ... ...
দাদাভাই বৌদিভাই-এর টানাপোড়েন টা আমাকেও মাঝে মাঝে ভাবাত। আমি জানতাম আমাদের এই সম্পর্কটাও সমাজের চোখে কোনওদিন স্বীকৃতি পাবে না। যেখানে দাদা ভাই আর বৌদির আইনি, ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এক লহমায় 'না' হয়ে যেতে পারে সেখানে আমার আর রণ’র ভালবাসা আমাদের, একান্তই নিজেদের। টুবাই, ওর দিদি, বৌদিভাই, রণ-র তুতো-বোনেরা বিষয়টা নিয়ে সকলের আড়ালে অল্প অল্প মজা করলে, আজকাল রণও সে মজাতে যোগ দেয়। একটা অলিখিত স্বীকৃতি, প্রচ্ছন্ন ভালবাসা, সব সময়ই আমাদের দুজনকে ঘিরে থাকে। ওটুকুই আমার পাওয়া। রণ তো শুধু আমার ভালবাসা না, রণ’র নাচও তো আসলে আমার ভালবাসা। রণ’র রেওয়াজ, রণ’র অনুষ্ঠান, রণ’র নাচের পোশাকের যত্ন সবই আসলে বড় বেশি আমার। আস্তে আস্তে রণ’র সাথে রণ’র প্রতিটা অনুষ্ঠানে আমি নিজের অজান্তেই রণ’র ছায়াসঙ্গী। ঘুঙুর আর সেতারের মিলমিশ আমায় এক অন্যরকম জগতে হারিয়ে নিয়ে যায়। পড়াশোনার সাথে সাথে এভাবেই শাস্ত্রীয় নৃত্য কত্থক হয়ে ওঠে আমার সংসার, আমার প্রেম আমার ভালবাসা। ... ...
বোম্বা্ই মেলে চড়ে বসেছি। গন্তব্য –– পুণে শহরের কলেজ অফ এগ্রিকালচারাল ব্যাংকিং। মাথায় নানান চিন্তা; অচেনা জায়গার অস্বস্তি, ঘরে ছেড়ে আসা বৌ–বাচ্চার ভাবনা, চিন্তার কি আর শেষ আছে? হাতের পেপারব্যাকে মন বসছে না।হঠাৎ চোখ গেল কয় জোড়া বিদেশি দম্পতির দিকে – কটা রং, বেড়ালচোখো, নীলচোখো,তামাটেচুলো, কিন্তু সবাই খুব ফরসা। লালচে, ফ্যাটফেটে, হলদেটে –– নানান কিসিমের। ... ...