- মা দেওয়ালে এত রাক্ষুসী কে আঁকে বল তো? - রাক্ষুসী? ও! ঐ ইন্দিরা গান্ধীকে আঁকে। - ই-ন্দি-রা গান্ধী! সে তো দারুণ দেখতে। দিল্লীতে থাকে। সিনেমার আগে, যার সিনেমা হয় – সে-ই তো? তার হাতে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে থাকে? রাক্ষুসীর পাশে আঁকা থাকে। - আমি ওসব বলতে পারব না। বাবাকে জিজ্ঞেস কর। বাবা ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিল। মাঠে ফুটবল খেলা হলে যেমন কয়েকটা দল থাকে, দেশ চালাতে গেলেও তেমন। ... যে জিতে যায়, সে দিল্লিতে থাকে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে থাকে, মানে জিতে গেছে। ... তবে কি বড় হলে ইন্দিরা গান্ধীই চিঠি দেবে আমাকে? কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম ইন্দিরা গান্ধী খেলায় হেরে গেছে। থমথমে মুখে ঘুরতে লাগলাম, আমার চিঠির কী হবে? ... ...
কখনও মনে পড়ে – সরস্বতী পুজো হচ্ছে, সদর দরজার কাছে বাঁদিকে প্রথম ঘরে ঠাকুর। ঘর জুড়ে অনেক কিছু সাজানো। দূরে ঠাকুরের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ওপরেরটা আমার। নীল মলাটের ওপর লাল আর সাদা দিয়ে লেখা। আমার বইটা নিয়ে নিয়েছে সবাই। এত জিনিস টপকে আমি যেতেও পারছি না যে তুলে আনব। মা সমানে বোঝাচ্ছে, যে, ঠাকুরের কাছ থেকে বই তুলে নিতে নেই। কিন্তু আমার ভবি ভোলার নয়। বারবার দরজা দিয়ে বইটা দেখছি, সদর দরজা অবধি দৌড়োচ্ছি আর প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কাঁদছি। আচ্ছা, কী বই ছিল ওটা? দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, মা কোলে করে ক্যালেন্ডারের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলছে, ‘এটা কে? আমি বলছি বিবেকান্দ-নন্দ।’ মা হাসছে, আমি হাততালি দিচ্ছি। ... ...
এমনি গোঁজ করে থাকা প্যাঁচা মুখ এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি আমি। অল্পবয়সে একবার পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি ছিলাম কয়েকদিন। একদিন গভীর রাতে দেখি ওয়ার্ডের সব আলো জ্বলে উঠল। ডাক্তার, নার্স – সব খুব ছোটাছুটি করে বেড রেডি করছেন। তারপর বেনারসী পরা এক সালঙ্কারা মেয়েকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হল। আনতে আনতে মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিল। বিশাল ওয়ার্ডের সেই অনন্ত সংখ্যক বেডে পড়ে আছি পেটকাটা মেয়ের দল। কিছুটা নির্বিকার উদাসীনতা, কিছুটা ক্রোধ, কিছুটা উদ্বেগ – সব খেলা করে মেয়েদের মনে। গরীব কিংবা বড়লোক, হিন্দু নাকি মুসলমান, বিয়েওলা বা অনূঢ়া, অল্পবয়সী না পাকাচুলো - সব ধরণের মেয়ে সাক্ষী রইল ঘটনার। চোখের পাতা এক হল না। এরপর সকাল হলে ... ... ...
রাস্তাগুলো দিয়ে খরস্রোতে বৃষ্টি আর জোয়ারের জল চলল খলবলিয়ে। চারিদিকে নদী আর মাঝখানে বাড়িগুলো যেন দ্বীপ। এমন জিনিস তো দেখিনি বাপের জন্মে। ল্যান্ডফোন বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। কেবল উপকূলের মানুষের অভিজ্ঞতার জোরে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম সকলে। বৃষ্টি একটু কমতে, রাস্তার ধারে গিয়ে দেখি চুনো মাছের স্রোত চলেছে রাস্তা দিয়ে। সবাই জলের স্রোতে ঝুড়ি আড় করে দাঁড়িয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। কয়েক মিনিট পরে পরে তুলে নিলে আধঝুড়ি করে মাছ উঠছে। আমিও ঝুড়ি পাতলাম। হঠাৎ দেখি সবাই চেঁচিয়ে কী একটা ইশারা করছে আমাকে। তাকিয়ে দেখি আমার খুব কাছে কিছু একটা গোল্লা পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি কি আর জানি ছাই যে ওটা চিংড়ি মাছের ঝাঁক। ... ...
‘চোদ্দ বছর বয়সে এ সংসারে এসেছি। তারপর চারপাশে কত মেয়ের যে না খেয়ে, মার খেয়ে মৃত্যু দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। যখন যেভাবে পারি, যতটা পারি এদের বাঁচানোর চেষ্টা করি, তবু অনেক লড়াই হেরে যেতে হয়। এইসব মেয়েগুলো যে বাড়ির লোকের কাছে মর্যাদা পায় না, তাদেরই কিছু সুরাহা করার জন্য রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে যায়। সবসময় চাইতে হয়তো মানে লাগে। তাই এদের কিছু বলতে পারি না। আজ দশটাকার জিরেগুঁড়ো নিয়ে যাকে বকব, কাল পরশু হয়তো সে কাঁচা বয়সের কাজল চোখে চিতেয় উঠবে। এমন আগে ঘটেছে, তাই কিছু বলতে পারি না। ওসব সংসারের খরচ হিসেবে ধরে নিই।’ শাশুড়ি-মার কথাগুলি মর্ম ভেদ করে আমার। ... ...
মেজ নন্দাই যখন শ্বশুর বাড়িতে আসতেন, আমাকে বক্সীবাজারে নিয়ে যেতেন। কতরকম যে নোনামাছ বাজারে, তাদের চেহারা, আকৃতি সব কিছু অদ্ভুত। আমি অবাক হয়ে যেতাম। মাছগুলো বেশ স্বাদু, কিন্তু দামে কম। কম তো হবেই, স্থানীয় সমুদ্রের মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। শহরের মানুষ তো খেতে জানে না, তাই দামও ওঠে না। কিন্তু এই মাছগুলো এখানকার মানুষের শরীরে সস্তা প্রোটিনের যোগানদার। আর দীঘা-মোহনায় ইলিশ উঠলে, বাড়িতে ফোন চলে আসে। তখন বর, দেওর, আরো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কাকভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। কারখানা থেকে থার্মোকলের বাক্স কিনে রেখেছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে টাটকা ইলিশ ঠেসে বরফ দিয়ে চওড়া সেলোটেপ দিয়ে সিল করে নিয়ে আসে। শহরেও এভাবে ইলিশ নিয়ে আসি আমরা। প্রতিবেশী, নিকটজন ইলিশ উপহার পেলে খুবই খুশি হয়। হাওড়া স্টেশনের পাশে ইলিশের নিলাম হয়। সেখানেও যাওয়া হয় কখনো-সখনো। ... ...
বাড়ি সাজানো ছাড়াও চাইনিজ নিউ ইয়ারের আরো দুই আবশ্যিক অঙ্গ ছিল ফায়ার-ক্র্যাকার এবং লাল রঙের এনভেলপ। এই নিউ ইয়ার সাধারণত জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসেই আসত বলে, আমাদের অনেক চাইনিজ বন্ধু ইংরাজি নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের সময় যে আতসবাজি বিক্রি হত, সেগুলি কিনে স্টক করে রেখে দিত। তবে চাইনিজ নিউ ইয়ারে চাইনিজ দোকানগুলিতে ফায়ার-ক্র্যাকার পাওয়া যেত কিনতে – সেখান থেকেও আমরা কিনে নিয়ে আসতাম। আর সেই লাল রঙের খামে থাকত ‘টাকা’ – এটা একটা ট্র্যাডিশন ওদের, যেখানে বাড়ির বড়রা ছোটদের এই টাকা গিফট করে, তবে ছোটদের ছাড়াও প্রিয়দের এই খাম দেওয়ারও ট্র্যাডিশন আছে। সেইমত আমরা আমাদের চাইনিজ বন্ধুদের থেকে পেতাম খুব সুন্দর হাতে নাম লেখা, চাইনিজ লিপিতে। ... ...
মাঝেমধ্যে দেখতাম, ঐ মেয়ে-বৌরা মশলাপাতি, আটা-ময়দা, চিনি কিছু কিছু নিয়ে যাচ্ছে আড়াল করে। শাশুড়ি মায়ের কানে তুললাম কথাটা। তিনি হাসলেন। বললেন কিছু বাসনও গেছে এভাবে। পুকুরে মাজা হয় তো। মাজার সময়ে ভাসিয়ে বা ডুবিয়ে দেয়। অন্ধকারে তুলে নিয়ে যায়। বললাম, সে কী, তুমি কিছু বল না? তিনি বললেন, সে অনেক কথা। বড় কিছু না হলে সব জিনিস দেখতে নেই। কথাটা শুনলাম, কিন্তু মানতে পারলাম না। কর্তার কানে তুললাম। কর্তা বললেন, খবরদার এসব ব্যাপারে নাক গলিও না। মা যেমন বলছে, তেমনিভাবে চল। আমরা এখানে থাকি না। দু’দিনের অতিথি। আমরা ওদের রাগিয়ে দিয়ে ঝামেলা করে চলে যাব, তারপর সারাবছর কী হবে? যার হাতে রান্নাঘর, তার হাতে জীবন। ওসব মায়ের হাতে ছেড়ে দাও। পরে অবশ্য অনেক দাম দিয়ে বুঝেছি, কেন শাশুড়ি মা বলেছিলেন, সব জিনিস দেখতে নেই। ... ...
তবে জাউ হলে দারুণ আনন্দ হত। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। শীতের সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি, খুব হৈ হৈ হচ্ছে। সবাই খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তড়বড়িয়ে খড়ের গাদাটা কাছ থেকে দেখতে গেলাম। দেখি, খড়ের গায়ে অনেক সাদা সাদা ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে, ঠিক যেন খড়ের ফুল। আর মাটির কাছের ছাতাগুলো লালচে। এগুলো দেখে সবাই আনন্দ করছে। এবার আমার সঙ্গে কর্তার যা কথোপকথন হল, তা এইরকম – - এগুলো কী? - ছাতু ফুটেছে, খড়-ছাতু। - মানে? মাশরুম? - হ্যাঁ, দারুণ খেতে। মাংসের মত। মাকে বলব আজ সকালে জাউ করতে। - ঝাউ করা কী? - আরে দূর! ঝাউ নয় জাউ। খেলে বুঝবে। ... ...
বিয়ের চারদিনের দিন এক ঘটনা ঘটল। এখানে বাসি বিয়ে হয় না। চৌথী হয়। ঐদিন রাতে শাড়ির আঁচলে পাঁচটা ফল বেঁধে ঘুমোতে হয়। ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভোররাতে বর ঘুম থেকে ডেকে বলে, নিচে কলটানার আওয়াজ। মা উঠে পড়েছে। তুমি উঠে পড়। আমার আর হুঁশ নেই। শেষে দরজায় ঠকঠক। নভেম্বরে বালির ঠান্ডা, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে খিল খুললাম। দেখি বাইরে মোটা শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি মা। পুকুরে নামা অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডায় শাল জড়িয়ে... বলির পাঁঠা হয়ে চললাম। পুকুরের সামনে শাশুড়ি বললেন, গাছের আড়ালে জামা বদলে নাও। বলে আমার পরনের শাড়িটা পুকুরে কেচে মেলে দিলেন। আর বললেন, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমার ওপরে যা চলেছে তা বৌয়ের ওপর হতে দেব না। মনে ভাবি, আড়বালিয়ায় যদি এমন হত, জ্যাঠাইমারা বলতেন – একটা দিন মানতে হয়। ওষুধ খেয়ে নেবে। রীতি-রেওয়াজ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে আমার প্রাণরক্ষা করলেন ইনি। না হলে হাসপাতালের শয্যা অপেক্ষায় ছিল। ... ...
ছেলেটি আগামীকাল “ভোর” চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে। ওর বাড়িতে নাকি ‘দুর্গো’ পুজো হয়। শুনেছিলাম দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন দুর্গা। তবে এমন সরাসরি দুর্গোপুজো করতে কাউকে দেখিনি। ওর কথাবার্তায় বাংলাটা অন্যরকম। ও ভোরে বেরোয় না, ভোর ভোর বেরোয় না, ‘ভোর’ বেরোয়। কচুরির দোকান থেকে খায় না। কচুরি দোকান, মিষ্টি দোকান, পান দোকান, মুদি দোকান থেকে জিনিস কেনে, ষষ্ঠী বিভক্তির অস্তিত্ব ওর বাংলায় নেই। ল্যাবে আড়ালে সবাই মজা করে। সে অবশ্য, জগাদার কথাও এরকম। ‘চলে গেলাম’ – বোঝাতে বলে, ‘পালিয়ে গেলাম’। চলে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া আমাদের কাছে আলাদা, ওদের কাছে এক। ... ...
কিছুদিন পরে ল্যাবের বড় দাদা মানে জগাদা আমাকে ডাকল – - কি রে! TUMPA-র সঙ্গে এত গল্প করছিস, ব্যাপার কী? - টুম্পার সঙ্গে গল্প মানে? আমার নাম তো টুম্পা। - কী! তোর ডাকনাম টুম্পা? তুই তাহলে টুম্পা ওয়ান। অমনি সবাই হো হো হা হা করে হাসতে লাগল। - কী ইনোসেন্ট রে, তুই TUMPA জানিস না?.... ... ...
সেদিনের আগে জানতাম না, যে এই রুটির মত জিনিসটাকে ওরা বলে ‘ইনজেরা’। এটা বেস করেই ওদের নানা খাবার গড়ে উঠেছে – আপনি নিরামিষ, আমিষ, ভাজাভুজি – যা-ই চান, এই রুটির উপর পরিবেশিত হবে। আর আমাদের ভারতীয় ক্যুজিন-এর মত ইথোপিয়ান ক্যুজিনেও ‘কারি’-র ব্যবহার প্রচুর, বেশ মশালাদার খাবার বানায় এরা। আমাদের মত এরাও ব্যবহার করে লঙ্কা, আদা, রসুন, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং জিরা। ... ...
.... এই পাতুরি ভাজার সব চেয়ে সুবিধে হল, কোনো সুতো, দড়ি কিচ্ছু লাগবে না। এমনিই সুন্দর মুড়ে থাকবে, কিন্তু মচমচে হবে। পরে আমার এক অধ্যাপিকা বন্ধু একটা খুব দরকারি পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেইমত বাড়িতে ইলিশের পাতুরি করতে গেলে আমি আর বাজারওলাদের পিছনে পড়ি না একটু কলাপাতার জন্য। আমার কর্তামশাইয়ের বাগানের শখ। ফ্ল্যাটের বারান্দায়, জানলায় মাচা বেঁধে শাকপাতি, শসা সব ফলান। তাই চালকুমড়ো, কুমড়ো, লাউ যখন যেমন পাই, টুক করে পাতা কেটে নিয়ে ওতেই পাতুরি বানাই। একেবারে পাতাসমেত খাওয়া যায়। শহরে কলাপাতা পাওয়া ভীষণ মুশকিল। তাই ইলিশ পাতুরির জন্য অন্তত আমার বাড়িতে এখন নো কলাপাতা বিজনেস। ... ...
সেদিন আমরা সকাল থেকে আরবিক/মিডল-ইস্টার্ন খেয়ে যাচ্ছিলাম বলে আমাদের হোস্ট বাছল ইতালিয়ান রেস্টুরান্ট। আমাকে আর মুখ খোলার অবকাশই দিল না – কারণ ইতালিয়ান ক্যুজিন আমার সবসময়ই ফেভারিট, অবশ্য যদি ভালো করে বানাতে পারে তবেই! রেস্টুরান্টে গিয়ে দেখা গেল, দুটো অপশন আছে – ভিতরে বসে খাওয়া এবং আউটডোর ডাইনিং। অবশ্যই আউটডোর ডাইনিং বেশি আকর্ষণীয়, বাইরে ১২ ডিগ্রি ঠান্ডা এবং হালকা বাতাস বইছে। এই অবস্থায় আউটডোর ডাইনিং করার কী মানে কে জানে! আমি মৃদুভাবে ভাবপ্রকাশ করলাম, দাদা, বাইরে কি খেতেই হবে? এদিকে আমার হোস্টের সেই রেস্টুরান্ট খুব ভালো লেগেছে আগের বার খেয়ে, তাই এইবারেও অতিথিসৎকার করতে বাইরেই বসা ঠিক হল। আমাকে আশ্বস্ত করা হল এই বলে, যে দেশে প্রচুর গ্যাস – তাই নাকি খেতে বসে ঠান্ডা লাগলে আমার পিছনে গ্যাসবাতি জ্বেলে দেবে! তাহলে আর ঠান্ডা লাগার চান্স নেই। ... ...
গাঁজা গাছের ডগার কচি পাতাগুলোকেই সিদ্ধি পাতা বলে। সেই পাতা সরবত করার আগে বারবার খুব চটকে চটকে ধুয়ে নিতে হয়। সব কষ বেরিয়ে গেলে পাতা ধোয়া জল একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন সেই পাতা বেটে সরবত বানানো হয়। পাতা বাটার সঙ্গে আরও কয়েকটা জিনিস বাটতে হয়, যেমন – গোলমরিচ, চারমগজ আর মৌরি। এই বাটাটা একেবারে চন্দনের মত মিহি করে বাটতে হয়, তারপর ছেঁকে নিতে হয়, যাতে কোনো দানা না থাকে। এখন মিক্সার গ্রাইন্ডারের যুগে মিহি করে বাটা খুব সহজ, তবে যে যুগের কথা বলছি, তখন তো যন্ত্রের ব্যাপার ছিল না। শিলনোড়ায় মেয়েদের হাতের জোরেই এসব কিছু করতে হত। এর সঙ্গে পরিমাণমত দুধ, চিনি আর জল মিশিয়ে পাতলা সরবত বানানো হত। এতে ওষধি গুণ আছে, ঘুম এসে যায়। দশমীতে এই সিদ্ধির সরবত বানানো খুব প্রাচীন প্রথা। কি জানি, আমার মনে হয়, .... ... ...
সে ছেলে দাবি করেছিল, যে তারা নাকি পরিবেশপন্থী, খুব সন্তর্পণে সব কিছু বাছাই করে। খুব ভালো লাগল শুনে – অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু যে ডিশ নামাল সামনে, তাই দেখে আমি সেই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম – “এই তোমাদের পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা?” বাঁধাকপিগুলোকে বাড়তে দেয়নি পর্যন্ত! কুঁড়ি ছিঁড়ে নিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে! আর সিদ্ধ বাঁধাকপি – সে কেমন খেতে? তা আর নাই বা বললাম! আমাদের কালো জার্সি গরুটা পর্যন্ত শেষ বয়েসে মুখ ঘুরিয়ে নিত এ জিনিস দেখে! ডিসক্লেমার: অনেকে আবার দাবি করেন, এগুলোকে বাঁধাকপির কুঁড়ি না, ব্রাসেলস্ স্প্রাউট বলে! চাষার ছেলে তো, অত কি আর বুঝি! ... ...
... - ভালো ভাজা হল কিনা, বুঝব কি করে? - আঁচ বাড়িয়ে প্রথমে নাড়বি, তারপর আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে দিবি। একটু পরে আবার খুন্তি দিয়ে নিচের আনাজ ওপরে করে দিবি। ভাজা হয়ে এলে দেখবি, একটা সুবাস পাবি। কড়ায় আনাজের পরিমাণ কম মনে হবে। মানে, আয়তন কমে আনাজগুলো জরে যাবে। আনাজ কড়ায় দেবার আগে হলুদ মাখিয়ে নেয় অনেকে। না নিলেও অসুবিধে নেই। হলুদ পরে দেওয়া যাবে। কাঁচা রাঁধুনির হাতে হলুদে পোড়া ধরে যেতে পারে। আর নুনটা প্রথমেই দিবি না। একটু ভাজা হবার পর দিবি। নুন দেবার পর আনাজ থেকে জল বেরিয়ে যায়। - বাবা! অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় দেখছি। - অনেক কিছুর ব্যাপার নয়। ধারণা হয়ে গেলে দেখবি থোড় বড়ি খাড়া। রান্নাও তো বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান। নিয়ম, সূত্র, পরিচ্ছন্নতা, শৈলী, ঘরানা সব মিশে আছে। ... ... ...
আমিও সেদিন তাই করলাম। পাশ দিয়ে ওয়েটার যাচ্ছিল, তাকে বললাম, “আচ্ছা ওমলেট পাব কোথায়”? সে বলল ওমলেট স্টেশনে চলে যান! ওমলেটের যে আবার স্টেশন হয়, তা কে জানত! তো যাই হোক, যেন বেমানান না লাগে – এমনভাবে দুলকি চালে ওমলেট স্টেশন খুঁজতে বেরুলাম। সেই প্রকাণ্ড জায়গা পাক দিয়ে, প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় দেখতে পেলাম, এক শেফ এক গাদা ডাঁই করে রাখা ডিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম এই সেই মোক্ষ স্থান! গিয়ে চাইলাম ওমলেট – ব্যস, প্রশ্নবাণে গেলাম ফেঁসে! প্রায় ৫ মিনিটের ইন্টারভিউ দিয়ে, ১০ মিনিট বাদে ওমলেট নিয়ে টেবিলে ফিরলাম। ... ...
কার্যত এখন দুয়ারে বাজার। বাড়ি থেকে বেরোলেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভ্যানে সবজি, ফল সবই সারি সারি। দু’পা এদিক ওদিক হাঁটলেই পথের পাশেও ছোটখাটো বাজার – মাছ, মাংস সবই মিলছে। মলে ঢুকলে অজস্র পণ্যের মধ্যেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেলোফেনে মোড়া থার্মোকলের পাত্রে টুকরো করে কাটা সবজি। ছোট পরিবারের উপযোগী শুক্তো রাঁধতে গেলে যে যে আনাজ প্রয়োজন সবই সাজানো রয়েছে তাতে। তবে সে সবজির সতেজতা, কোটার নিপুণতা – এসব যাচাই করার সূক্ষ্ম বিচারবোধসম্পন্ন দক্ষ বাজারু আজ আর কোথায়? গুছিয়ে বাজার বা রসিয়ে রান্না করার সেই মানসিকতা বা অবসর কোথায় আজকের অণু-পরিবারের ব্যস্ত জীবনে? ছেলেমেয়ের পড়াশুনো সামলে কর্তা-গিন্নি নাজেহাল কর্পোরেট যুগের চাকরি বাঁচাতে। আধুনিক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কবেই বিদায় নিয়েছে শিল-নোড়া। মডিউলার কিচেনে স্থান করে নিয়েছে মিক্সার-গ্রাইন্ডার বা ফুড প্রসেসর। আদা-বাটা, রসুন-বাটা তো পাউচেও হাজির। সর্ষের পাউডার প্যাকেট থেকে বের করে উষ্ণ জলে গুলে নিলে সর্ষেবাটাও রেডি। সাবেকি সিনেমা হলের নস্টালজিক সাদা-কালো ছবির জায়গায় এখনকার মাল্টিপ্লেক্স বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্যে যেমন বিশেষ ধরণের মুভির চল, ঠিক তেমনই খেয়াল করলে দেখা যাবে নোনা-ধরা, হলুদ দেওয়ালের রান্নাঘর থেকে বেরনো সেই সব অতুলনীয় পদগুলির জায়গা নিয়েছে আজকালকার ফিল-গুড ফ্যামিলির টিপটপ মডিউলার কিচেনের উপযোগী হালফিল ক্যুইজিন। ... ...