আচ্ছা জেঠিমা, আমরা তিনজন যে মোহনবাগানের মেয়ে হলাম, সেটা কি ধোপে টিকবে? কেন? টিকবে না কেন? আমরা যে খুব ইলিশ খাই। তাতে কী? মোহনবাগানীরাও ইলিশ খায়, ইস্টবেঙ্গলীরাও চিংড়ি খায়। তাতে ভালবাসা কমে না। লাবণ্যর হাতের একটা রেসিপি করতে পারি, খাবি? কৃষ্ণার কাছে শিখেছি, কাঁচা ইলিশের ঝাল। মা, রান্নাটা কিন্তু দেখব, কীভাবে কর। কুমুদিনী-লাবণ্য-কৃষ্ণা-শারদা – আর একটা নাম জুড়ে যাবে রঞ্জাবতী। মানুষ থাকবে না, রান্নার ঘরানা চলতে থাকবে। কাল কাঁচা ইলিশের ঝাল করলে পরশু ডাব চিংড়ি করবে জেঠিমা। ঠিক হ্যায়, করতেই হবে। আজ ইস্টবেঙ্গলী ইলিশ রান্না হলে কাল তো মোহনবাগানী চিংড়ি রান্না হতেই হবে। তাহলে আমি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিচ্ছি, কাল, পরশু বাড়িতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের নামে ফুটবল – খাদ্য উৎসব হবে, অরগানাইজড বাই আওয়ার টু প্রিন্সেসেস। ... ...
গোটা সকালটা ফেরিঘাটে ক্যানোর মালিকদের সঙ্গে ফালতু কথায় নষ্ট হল। অবশেষে বেলা পাঁচটায় আমরা মালাগারাজি নদীর বাম তীরে ইহাতা দ্বীপের সামনে পৌছালাম। কিয়ালার পশ্চিমে, দেড় ঘণ্টা দূরে ইহাতা দ্বীপ। ফেরি পারাপারের জন্য শেষমেষ রফা হল আট গজ কাপড় ও চার ফান্ডো সামি-সামি বা লাল পুঁতি, তখনই সেটা দিয়ে দেওয়া হল। এই ছোট, বেঢপ, টলমলে ক্যানোতে মালপত্র-সহ চারজন নদী পার করতে পারে। যাত্রী আর মালপত্র বোঝাই নৌকাগুলোর মাঝিরা যখন তাদের নৌকা নিয়ে রওনা হল, তখন তাদের অন্যদিকেই থেমে থাকার নির্দেশ দেওয়া হল, আর আমাকে অবাক করে, আরও দাবি জানানো হল। মাঝিরা দেখেছিল, যে এর মধ্যে দু’টি ফান্ডো মাপে খাটো, তাই আরও দুটো ফান্ডো অবশ্যই দিতে হবে, আর নাহলে নদী পারাপারের চুক্তি বাতিল। অগত্যা আরও দুটো ফান্ডো দিতে হল, তবে কিনা প্রভূত প্রতিবাদ, বাকবিতন্ডার পরে – এই দেশের যা নিয়ম। ... ...
ঈর্ষান্বিত হলেন কিছু মানুষ। নজরুলের উল্কার মত উত্থান তাঁরা মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। কোথাকার কোন ভুঁইফোঁড় ছোকরা, পল্টন থেকে ফিরেই সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে জনপ্রিয় কবি হয়ে গেল? প্রতিষ্ঠিত কবি মোহিতলাল মজুমদার বললেন, নজরুল নাকি তাঁর 'আমি' নামে একটি লেখার ভাব চুরি করেছেন। একবছর আগে ‘মানসী’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় বেরিয়েছিল তাঁর 'আমি' লেখাটি। সে যুক্তি ধোপে টিঁকল না। লোকে হেসেই উড়িয়ে দিল, মোহিতলাল কি 'আমি' কথাটার পেটেন্ট নিয়েছেন? আর কেউ 'আমি' ব্যবহার করে কিছু লিখতে পারবে না? হাস্যকর দাবি সন্দেহ নেই। 'ভবকুমার প্রধান' ছদ্মনামে সজনীকান্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি লিখলেন কামস্কাটকীয় ছন্দে।'ব্যাঙ' কবিতাটি ভূমিকাসহ শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হল এবং বেশ জনপ্রিয়ও হল। বিশেষ করে কবি মোহিতলাল মজুমদার ‘ব্যাঙ’ কবিতাটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন এবং জনে জনে শুনিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ঈর্ষার কী বিচিত্র রূপ! ষড়রিপুর ষষ্ঠ রিপুটি অনেককেই জ্বালাতন করেছিল, সন্দেহ নেই। ... ...
কাহিনীর সারাংশ হচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকল্প যত এগোচ্ছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা ততো বিঘ্নিত হচ্ছে। মুসলিমরা সব সময়ই টপ টার্গেট, নানা ফন্দি করে তাঁদের টাইট দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত। বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে কে কত এই সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করতে পারে। কেউ সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে দিচ্ছে, কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়া বা মসজিদের মাইক লাগানো নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে, কেউ কসাইখানা বন্ধ করে গোশালা খুলছে... ... ...
আসামের বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলায় “ডলু চা বাগান” রাজ্য সরকার আংশিকভাবে অধিগ্রহণ করেছে। ১২ই মে ২০২২-এর কাকভোরে ২৫০০ বিঘা জমি, প্রায় ত্রিশ লক্ষ চা গাছের ঝোপ এবং কয়েক সহস্র ছায়া গাছ উপড়ে ফেলে জমি পরিষ্কার করা হয়েছে। অবশ্য বিজেপি সাংসদ বলেছেন, ডলুতে কোনও উচ্ছেদ হয়নি, যা হয়েছে জমি অধিগ্রহণ। এদিকে দুই হাজার চা শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। স্থানীয়, রাজ্য এবং জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলি এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। কিন্তু তারপর থেকে সেখানে নেমে এসেছে এক শ্মশানের স্তব্ধতা। কোনও সংবাদ বাইরে বেরোচ্ছে না। কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না ... তথাকথিত উন্নয়নবিরোধীর তকমা যাদের গায়ে সেঁটে দেবার চেষ্টা হয়েছিল, তাদেরই কয়েকজন ... কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – কেন ডলু? কেন পাশের বিশাল খালি জমি খরিল নয়? ... ...
এফএম প্রচার তরঙ্গে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য সেই সময়, নয়ের দশকের মাঝামাঝি, ডেকে নেওয়া হল কলকাতা বেতারে ড্রামা অডিশন পাশ করা শিল্পীদের। প্রাথমিকভাবে কর্তৃপক্ষ ধরে নিলেন, যাঁরা আকাশবাণীতে শ্রুতিনাটক বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁদের সঠিক বাংলা উচ্চারণ আর কণ্ঠস্বর নিয়ে কোনও দ্বিধা বা সংশয়ের কারণ নেই। এই প্রসঙ্গে জানাই, রেডিওর নাটক বিভাগে যাঁরা পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন – বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্য হয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক অবলীলায় ছুঁয়ে যেতে হয় এই পরীক্ষায়। বিভিন্ন বাংলা শব্দের সঠিক উচ্চারণ শোনার জন্য চোখা কান পেতে থাকেন পরীক্ষকরা। আজও এই পরীক্ষা দুরূহ। এই পরীক্ষা-পারাবার পার হয়েও অবশ্য তারপরে অনেকে আর সেভাবে সুযোগ পান না অভিনয়ের খামতির জন্য, তবে সে প্রসঙ্গ এখানে গৌণ। এখানে মূল উপজীব্য, কণ্ঠস্বর, পরিবেশনা, উপস্থাপনা। .... শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার মত বিষয় ভাবতে হবে, কথার মধ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার গর্হিত অপরাধ, ইংরেজির ঝোঁকে বাংলা বলা অমার্জনীয়। অনুষ্ঠানের নাম ‘টক শো’। অবশ্যই ‘লাইভ’। তাকে নানান চেহারায় ‘কণ্ঠদান’ করতে এগিয়ে এলেন বাংলা ভাষার দক্ষ ‘কথাশিল্পী’রা। ইংরেজিতে তাঁরা ‘টক শো প্রেজেন্টার’, বাংলায় ‘অনুষ্ঠান উপস্থাপক’। হে পাঠক, লক্ষ্য করুন, ‘আর জে’ বা ‘রেডিও জকি’রা তখনও ঝাঁপিয়ে পড়েনি বাংলা সংস্কৃতিতে। ... ...
সোমনাথ রায়ের 'অরূপ বৃন্দাবন ও অন্যান্য পদ' পড়লাম। শুরুতেই 'প্রথম দর্শনে দেখি' পদে দর্শন-অদর্শনের আনন্দ - বিষাদের ঘনঘটা। শেষ পর্যন্ত সোমনাথ থামেন, 'প্রথম স্পর্শ তাই গরলবিলাসী' - স্পর্শন আর গরল বিলাসিতায় কোথায় সমাপতন খোঁজেন সোমনাথ সেটা স্পষ্ট হল না। সমগ্র পদে যতিচিহ্নের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ভাবের প্রকাশে হেরফের হয় না। ... ...
একথা নিশ্চিত, রাজলক্ষ্মী দেবী মূলত ভালোবাসারই কবি। তাঁর কবিতার প্রধান ভরকেন্দ্র অন্তর্নিহিত এক গোপন ভালোবাসা। তার যন্ত্রণা আছে কিন্তু আশাতীত কোনো নিরাপত্তা নেই। কখনও সে অযাচিত কড়া নাড়ে জীবনের দুয়ারে। তবু বরণের দুঃসাহস নেই। ... ...
মজাটা আসলে এখানেই। আমরা যে দুর্নীতিটা দেখতে পাচ্ছি এবং তা নিয়ে ধিক্কার ও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠছে, তা আসলেই একতরফা। দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারী আধিকারিকদের প্রত্যেকের কঠোর শাস্তির দাবিতে তো সকলেই সরব। সমাজমাধ্যমে আমজনতা থেকে শুরু করে বিকাশভবনের সামনে বিরোধী রাজনৈতিক দল – সকলেই বিক্ষোভে সামিল। এবং সে দাবি অত্যন্ত ন্যায্যও বটে। কিন্তু পাশাপাশি যারা ঘুষ দিয়ে অথবা অন্য অনৈতিক যোগাযোগ খাটিয়ে চাকরি হাসিল করেছেন, তাদেরও যে একইরকম শাস্তি পাওয়া দরকার – তেমন কোনো দাবি কিন্তু গণমাধ্যমে বা সমাজমাধ্যমে কোথাও চোখে পড়ছে না। ... ...
শালপ্রাংশু চেহারার নানাজি এসে আমার ছোট্ট খাট্টো চেহারার নানিকে এসে বহু ডাকলেন, সম্মান থাকবে না। এমন করো না, সালমা। চিরকাল বলেন অমুকের মা। মানে বড়মেয়ের মা বলে ডাকেন। আজ স্ত্রীকে সন্তান হওয়ার আগের ডাকে ডাকলেন। দরজা ঈষৎ ফাঁক করে সালমা উত্তর দিলেন, ওঁদের ভালো করে খাইয়ে ফেরৎ পাঠাও। ওই ছেলের সঙ্গে আমার সোনার মেয়ের বিয়ে দেবুনি। অনড় স্ত্রী। কন্যা। বড় আদরের মেয়ে। সুন্দরী। বিদূষী। ভালো ছড়া লেখে। এমন মেয়েকে ওই পাত্রের হাতে দিতে তাঁরও মন চায় না। দেখতে কালো। কিন্তু পয়সা আছে। পড়ালেখা জানে। ভালো পরিবার। কিন্তু মা মেয়ে অনড়। ... ...
“ও মনি, শহরে কিরাম করে থাকিস তুই? ঠাকুমা ছাড়া দিন কাটাতি কষ্ট হয় নারে?”, কড়াইয়ের ফুটন্ত জলে কুমড়ো শাক ছেড়ে দিতে দিতে বলল গোলেনূর দাদি। গরম জলে শাক পড়তেই সবুজ রঙ আরও গাঢ় হয়। শাকের সেই রঙের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলি, “দিন তো কাটে গোলেনূর দাদি, কিন্তু রাতে ঠাকুমার কোল ঘেঁষে ঘুমাতে পারি না বলে ঘুমের ভেতর স্বপ্নে বারবার কেঁদে উঠি।” তবে সেসব কথা লুকিয়ে আমি একমনে গোলেনূর দাদির উনুনে ভাপানো গাঢ় সবুজ শাকের দিকে তাকিয়ে থাকি। ... ...
টকে তরিবত বলতে শেষে একটু ভাজা মশলার গুঁড়ো দেওয়া যায়। আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো হয়। আসলে মাছ কাটার সময়ে বলে দিতে হয়, ক’পিস হবে। তোর বাবা বাজার এনেই খালাস। কিছু দেখে না। তুই শিখে নে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে দেখবি হেঁশেলের কন্ট্রোল হাতে চলে এসেছে। আর এখানেও অনেক লোক তো। বড় পিস করে ভাপা করা মুশকিল। তাই এখানেও ছোট পিস কাটা হয়। তবে আমি তোর সঙ্গে একমত। ইলিশ না খেলে না খাব। একদিন খাব তো বড় টুকরো খাব। ... ...
পাথুরে জলখাত ধরে নিচে নামছি তো নামছি। গোটা জায়গাটাই নুড়ি পাথরের ভরা। শেষে আমরা এসে পৌঁছলাম একটা শুষ্ক, পাথুরে উপত্যকায়। আমাদের চারদিকে হাজার ফুট উঁচু সব পাহাড়ের রাজত্ব। যে গিরিখাতটা ধরে আমরা চলছি, সেটা চারদিকে পাক খেতে খেতে নামছে, ধীরে ধীরে আরও চওড়া হচ্ছে আর শেষে এটা ছড়ানো সমভূমিতে পরিণত হয়েছে, তার ঢাল পশ্চিমে। রাস্তাটা, খাত ছেড়ে, উত্তরদিকে একটি নিচু গিরীষিরায় গিয়ে পৌঁছেছে। সেখান থেকে একটা পরিত্যক্ত জনবসতি দেখা যায়। ... ...
ইদ মানে উৎসব। ইদ-উৎসবকে ঘিরে আনন্দ স্মৃতি, না বলা কথা, কিম্বা ভীষণ বলতে চাওয়া আখ্যান নিয়ে রইল এবারের ইদের কড়চা। এই কড়চার দুই কিস্তির প্রথমটি বেরোল আজ। ... ...
নটেন হাঁ করে বড়ো ছেলেকে দেখতে থাকে, দেখতে থাকে নির্নিমেষ। সে একবার ভাবল বাকি ভাত ক'টি কি সত্যেনকে খাইবে দেবে? ফের ভাবে থাক, ভাতটা ঢাকা দিয়ে এখন ছেলেকে খাটে শুইয়ে দেবে? সত্যেন কি অসুস্থ? নাকি ক্ষুধায় মুমূর্ষুপ্রায়? সত্যেনের ওয়াক ওয়াক স্তিমিত হয়েছে। সাপের নিশ্বাসের মতো ফ্যাঁসফেসে শব্দ বেরোচ্ছে এখন মুখ দিয়ে। নটেন কুপি তুলে ধরে সত্যেনের মুখের কাছে ধরতে গেলে তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপির শিখার টুপ করে নিভে-যাওয়া নিপূণ অন্ধকার। ঘরের ভেতরের কুপিটির আলোয় মাটির দেয়ালে আবছা দেখা যাচ্ছে সত্যেনের মা আরতি মরার পর কাগজের ওপর নটেনের নেওয়া পদতলের আলতার জোড়াছাপের ফটো। আধো আলোয় অন্ধকারে দূর থেকে প্রাচীন মথের মতো দেওয়ালে সে পদচিহ্ন। ... ...
কিন্তু, আমরা দেখি আকাদেমির সদস্যদের মধ্যে ভাষাবিদ কেউই নেই। সকলেই প্রায় সাহিত্যিক, কয়েকজন আমলা বা প্রকাশক এবং সাহিত্যিকদের মধ্যেও মাত্র একজন এইমুহূর্তে সরাসরি অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, ভাষাচর্চার লোক প্রায় কেউই নেই। সাহিত্যিকরা ভাষাকে দিশা দেখাতে পারেন, কিন্তু ভাষার সংস্কার বিশারদদের কাজ। এবং বাংলাভাষা যেহেতু বহুভাষার থেকে পুষ্টিগ্রহণ করে, বিবিধ ভাষার এক্সপার্টদের আকাদেমির প্রথমসারির নিয়ামকের ভূমিকায় থাকার দরকার তা নেই। তাহলে কারা আছেন? যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় সাহিত্যিক, তদুপরি তাঁরা সকলেই শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। আকাদেমির চেয়ারম্যান বাংলার বিশিষ্ট নাট্যকার, কিন্তু তিনি তো মন্ত্রীও। তিনি নিরলসভাবে রাজনীতিটিও করেন। আকাদেমির আরেকজন প্রভাবশালী সদস্যের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তিনি কবি। ২০১৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান, উৎপলকুমার বসু তখনও সাহিত্য আকাদেমি পান নি। ... ...
অজিত রায় দেখছেন কীভাবে ভদ্দরলোকের ভাষা আসলে ক্ষমতার ভাষা, এবং তারাই স্ল্যাংকে ছোটলোকের ভাষা বলে মুটেমজুর কুলিকামিন ,চাষি জেলে ও বেশ্যাদের মুখের ভাষাকে অপাংক্তেয় করে দেয়। দাগিয়ে দেয় নিকৃষ্ট, অপকৃষ্ট, ইতরদের ভাষা বা ছোটলোকদের ভাষা বলে। আমরা জানি, পাওলো ফ্রেরি তাঁর ‘পেডাগজি অফ অপ্রেসড্’ এ দেখিয়েছেন কীভাবে অভিজাতকুলের ভাষা আসলে ক্ষমতাকে ধরে রাখার হাতিয়ার হয় এবং বঞ্চিতেরা ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে, ভুগতে বাধ্য করা হয়। ... ...
কূলের কিনার থেকে ডাক দেয় পরীবানু। মাঝির মতিগতি যেন কেমন কেমন লাগছে। এত কি কথা বলেশ্বরের সঙ্গে ! বাসুকীর মা মাসীমা এসেছিল গেল কাল সন্ধ্যায়। রোজা থেকে থেকে মিলনের মুখের রুচি চলে গেছে, খেতে স্বাদ পাচ্ছে না শুনে কলাপাতায় মুড়ে কতগুলো পুরনো টক তেঁতুল দিয়ে গেছে শরবত বানানোর জন্য। চোত বোশোখ মাসে রোজা করা মানে জাহান্নামের আগুনে সেদ্ধ হওয়ার সমান। জিভ শুকিয়ে খড়ি হয়ে যায়। খা খা করে শরীর। যাওয়ার সময় মাসী চুপিচুপি বলে গেছে, মাইয়েরে মাইয়ে, চক্ষু দুইহান চেতায়ে রাহিস। রোজার ধকল তাও সয়, সাগরের ডাক কিন্তুক মানানো যায় না রে মাইয়ে। ঢনঢন করে ওঠে পরীবানুর বুক। রাগে দুঃখে গাল পাড়ে, ঢ্যামনা বলেশ্বর। মাইয়ে পোলাপানগো লাগান ছেনাল হইছিস হারামাজাদা তুই। বলেশ্বর ঢেউ তুলে কতগুলো কচুরীপানা ভাসিয়ে দেয় কূলের কিনারে। মিলনের পেছনে দপদপিয়ে হেঁটে আসা পরীবানু কি বুঝে কে জানে। নিজের প্রৌঢ় চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে বার বার পেছনে তাকায়। কুলকুল করে হাসছে বলেশ্বর ! পানি ছিটোচ্ছে ওদের ফেলে আসা পদচিহ্নমাখা পথে। ... ...
আমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবার প্রধান আনন্দ ছিল মাঘ মাসের ওলাইচণ্ডী পূজার মেলায়। দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা আছে-- আছে ইদ বকরিদ মহরম--- কিন্তু মাঘ মাসের মেলাই আসল মিলবার জায়গা। সেটা হলেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ। আত্মীয় স্বজন কুটুম আসার এই তো আসল সময়। দুর্গাপূজার সময় অনেকের ঘরেই অভাব। ইদ বকরিদ ধান ঝাড়ার সময় কবার আর হয়? পৌষ মাসে ধান কাটা শেষ। মাঘ মাসের ১৯ তারিখ মেলা। হাতে পয়সাও ম্যালা। ফলে আনন্দের অর্থই আলাদা। কাঠের নাগরদোলা, পাঁপড় চপ বেগুনি পেঁয়াজি ঘুগনি, জিভে গজা পান্তুয়া লেডিকেনির দোকান বসে মেলায়। দুর্গাপূজা বা ইদে তো সেসব অনুপস্থিত। বাঁশি কেনা, ঘড়ি কেনা, টিকটক কেনা, লাট্টু কেনা, রঙিন চশমা-- সেতো ইদ বকরিদ দুর্গাপূজায় সবার সম্ভব নয়। ... ...