এরপর পিনাকীর বয়ান– দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি একতালার বারান্দায় পাঞ্জাবী পরা লম্বা সাদা দাড়ি, টুপি মাথায় এক বুড়া লোক বসে পেপার পড়ছে। সেটা দেখে তো আমার ভয় বেড়ে গেল আরও। ভাবি এই হুজুর যদি এখন দেখে এক ধুতি পরা লোক তার বাড়িতে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাহলে না জানি কোন ঝামেলা বাঁধায়? আমি সাহস করে লোহার গেটে ধাক্কা দিই। দাড়ি, টুপি ভদ্রলোক পেপার হাতে নিয়েই বাগান পার হয়ে লোহার গেট খোলেন। আমাদের দেখে একটু কপাল কুচকান। আমি তাকে লম্বা করে একটা সালাম দেই– ‘আসসালামালাইকুম চাচা। উনি কোলকাতা থেকে এসেছেন, একসময় এই বাড়িটা উনার বাবার ছিল, বাড়িটা জাস্ট একটু দেখতে এসেছেন।’ বলেই আমি বেশ নার্ভাস থাকি। কে জানে ভদ্রলোক এই নিউইয়র্ক কিন্ডারগার্ডেনের দীনিয়াতের টিচার কিনা। ছুটির দিনে হয়তো একটু আরাম করে বসছেন পেপার পড়তে, সেইখানে এক লোক কোলকাতা থেকে এসে যদি বলে এই বাড়ি আমার ছিল, তাহলে তার ভালো লাগার কথা না। পুরা ব্যাপারটায় একটা গ্যাঞ্জাম লেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। ... ...
জানলাটার কাঠের ফ্রেমটা এবড়ো-খেবড়ো, কোনওকালে রং চড়েছিল তার গায়ে, আজ রং-চটা। ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো কাচটাও নোংরা। খুবই নোংরা। গভীর কালচে ছোপ ধরেছে। জানলার একটা পাল্লা খোলা। অন্য পাল্লাটা আঁটা। খোলা যায় না। বন্ধ পাল্লার কাচের উপর এসে বসেছে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের বোলতা। তার থেকে খানিকটা নীচে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে একটা প্রজাপতি। ধূসর রংয়ের একটা বড় ছিটে। আর দুয়ের থেকে প্রায় সমদূরত্বে উড়ে এসে বসল একটা চকচকে সবুজ স্বচ্ছ-ডানার ফড়িং। নীলি সকৌতূহলে এই রঙ্গিন ত্রিভুজ দেখছিল। কান ছিল রেহানার কথার দিকে। রেহানা এসেছে ঘরের পাশের দিকটা দিয়ে। রেহানা আর নীলির মাঝখানে জানলার ওপারের একফালি ঘাসের জঙ্গল। তারপর সার দিয়ে রাংচিতার ঝোপ। সেই ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রেহানা। ইস্কুলের গল্প। ... ...
আছড়ে পড়ার শব্দে মুখ তুলে তাকায় মনীষা। চিলের ছানা মনে হলো । নাকি পায়রা। রেস্টোরান্টের পুরু কাঁচের ওপাশে উড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে, সড়সড় নেবে গ্যালো। মনীষা কফিতে মন দেয়। কমলেশের দিকে চিনির প্যাকেট এগিয়ে, কফিতে এক চুমুক দিয়ে, শূন্য কাঁচের দিকে তাকায় আরেকবার। কোনো আঁচড়ের দাগ নেই। কফিকাপ নাবিয়ে রেখে স্পষ্ট তাকিয়ে বলে - না , কাকু । এই অনুরোধটা করবেন না । আমি যা সত্যি বলে জানি , তার বাইরে গিয়ে গল্প সাজানো সম্ভব নয় ... ...
অনিমেষ সচরাচর রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে আসে। গোপাল বহুদূর থেকে ওর গন্ধ পেয়ে ডেকে উঠত। সেই ডাক শুনে ভৌ ভৌ করে দৌড়োদৌড়ি করত গলির কুকুর, তারপর বড় রাস্তার কুকুররা ডেকে উঠত -মেক্সিকান ওয়েভের মত কুকুরের ডাক পৌঁছত অনিমেষের কানে। গলি টুকু প্রায় দৌড়ে ঢুকত বাড়িতে। গোপাল দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মুখ চাটত অনিমেষের। লিপি ততক্ষণে ভাত বসিয়েছে। আজ পাড়া নিশ্চূপ, গলি শুনশান -শুধু আলোর তলায় লিপি একলা দাঁড়িয়ে । লিপির দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওর কান মুখ ঢাকা শাল, ওর দীর্ঘ ছায়া, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে আসা মশা অনিমেষকে যেন সমস্ত বলে দিল এক মুহূর্তে। এমনকি অনিমেষ যেন লিপির হাতের হাতের ছেঁড়া শিকলিও দেখতে পেল যাতে গোপালের বকলশ ঝুলে রয়েছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অনিমেষ বলল- -'কখন? কষ্ট পেয়েছিল?' -'ঘরে চলো'। লিপি বলেছিল শুধু। ... ...
শূন্যতা আসলে নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি। সক্রিয় জীবনযাপনে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য লাগে। ধরা যাক, যে লোকটা মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে, খাড়া বরফের উল্লম্ব দেওয়ালে চেপে গেঁথে নিচ্ছে স্নো বুট, সে জানে এখানে তার অক্সিজেন সীমিত, মেপে পা ফেলতে হয়, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ। এখানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে একটা তুমুল এভালান্স, এখানে এমনকী তার মৃত্যুর পরে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই এতসব ঝুঁকি তাকে এমন একটা জিগীষা দিয়েছে, যা তাকে পৃথিবীর উচ্চতমে নিয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ, তার মৃত্যু আশঙ্কা বেশী, কিন্তু ওই ঝুঁকি আছে বলে তার জীবন সুন্দর। এমনকী, এই আরোহীর মৃত্যুও, আহা, কত দুঃসাহসিক-লিরিক্যাল। ... ...
সূর্যের আদর গায়ে মেখে, পাখির মতো দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়ালাম। আমার শরীরে খোদিত শব্দগুলোকে স্বাধীন করে দিলাম। প্রত্যেকটা শব্দ আমার শরীর থেকে প্রজাপতির মতন পাখনা মেলে উড়ে চলল। উড়তে উড়তে তারা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত উপত্যকায়। কেউ বসল কৃষকের হালে, কেউ বসল কুমোরের চাকায়, কেউ বসল শ্রমিকের কবজিতে, কেউ গেল ছাত্র-ছাত্রীর পাঠ্যপুস্তকের উপর। কেউ বসল দোকানদারের তুলাদণ্ডে। কেউ আবার ভিক্ষুকের ভিক্ষাভাণ্ডে, কেউ উড়তে উড়তে গিয়ে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন প্যাড গিয়ে বসল। কেউ আবার উকিলের কালো কোটে, কেউ শিক্ষকের চশমাতে, কেউ প্রবেশ করল কবি-লেখকদের হৃদয়ে। কিছু শব্দ মায়েদের মুখ থেকে শুনল তাদের গর্ভজাত সন্তানরা। কিছু শব্দ নারীর ঠোঁটে অবয়ব ধারণ করল। ... ...
যোনি কাকে বলে জানিস ? জানি-জানি, বললো অমিত, রোজ একঘেয়ে লেকচার শুনে-শুনে ওসব আংরেজি তাকিয়া-কালাম মুখস্হ হয়ে গেছে, ইসকুলে যদি রোজ কেউ অমন লেকচার দিতো তাহলে দেখতে, সব সাবজেক্টে চৌয়া-ছক্কা পেটাতুম । বল তাহলে, কাকে যোনি বলে ? ... ...
বেশ দূর। বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর। যখন পুলিশ স্টেশনে গেলাম দেখলাম বকুল বসে আছে। তার মুখ ফ্যাকাশে। নিজের নাম বলতেই পুলিশি স্টাইলে অফিসার কিছু প্রশ্ন করলেন আমাকে। তারপর একটা চিরকুট বের করে দেখালেন- দেখেন। সুইসাইড নোটে আপনাদের দুজনের নাম আর ফোন নম্বর লেখা আছে। অবশ্য তেমন কিছু না। শুধু লেখা আপনাদের সাথে যেন যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু আপনারাতো কোনো রিলেটিভ নন। স্রেফ বন্ধু। অবশ্য তার এক চাচাকেও ফোন করা হয়েছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে। তিনি দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বেন। তাকে বলা হয়েছে তিনি যেন ছেলের বাবাকেও খবর দেন। তিনিও হয়ত এসে পড়বেন বিকেলের মধ্যে। ...কিন্তু ঘটনা হলো কেন সে সুইসাইড করল? আপনারা কী জানেন এ ব্যাপারে? ...অত মানুষ থাকতে আপনাদের নাম কেন সে লিখে গেলো সুইসাইড নোটে? বিষয়টা পুলিশ হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে... ... ...
একদিন একটা ভূত ছিল। ভূতটার অন্নপ্রাশন ছিল, মাংস আর খিচুড়ি রান্না করেছিল। ভূতের মা বলল, "তুঁই কিঁ চঁকলেঁট খেঁয়েঁছিঁস?' ভূত বলল, "হ্যাঁ, খেঁয়েঁছি।' ... ...
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, আর বাউন্ডুলে ফ্রান্স গেলেও ঘুরেই বেড়ায়। আমারও তাই দশা। ছুটিছাটা পেলেই প্যারিসের লং ডিসটেন্স বাস ডিপো থেকে কোনো একটা বসে উঠে অজানা জায়গায় যাই। কদিন আরামে নিজের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে আসি। এবারে ভাবলুম, ট্রেন ব্যবহার করি। বাসওয়ালাগুলোও বোধয় এতো দিনে চিনে গেছে আমাকে। তাছাড়া ট্রেনের ভাড়া বাসের থেকে বেশ কম শুনেছি। আমার তখন সম্বল বলতে ফ্রান্স সরকারের দেওয়া কটা ইউরো আর এক বাংলাদেশী মাইয়ারে বাংলা পড়াইয়া যা কিছু পাই, তাই। তার অর্ধেক তো চলে যায় ওরই বাপের রেস্তোরাঁতে ইলিশ ভাত, মাংস ভাত খেতে। কত আর পাউরুটি চিবোবো। বইটি হস্তগত করে, একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম। দেখি চোখ কোন দিকে যায়, আমিও সেই দিকগামী হবো। তবে দুগ্গার কৃপাকে এইভাবে abuse করলে মাও যে আর বেশিদিন রক্ষে করবেননে সেটা বুঝি। কোথায় যাচ্ছি ঠিক করার একটা দারুণ উপায় মাথায় এলো। ট্রেন স্টেশনে মানচিত্র দেখে যে অজানা নামটা বেশ সুন্দর লাগলো, সেটার একটা টিকেট কেটে উঠে বসলাম। ... ...
বলাই বাহুল্য, আমাদের নবতিপর ঠাকুমার ভালো নাম সুষমা হলেও শাকপাল্হার নামেই ডাক নাম ছিল ‘শুশনি’। বয়সে ছোট ছিল বলেই আমরা ‘ন্যাঙটা ভুটুঙ সাধের কুটুম’ তার ছোট বোনকে ‘ছুটকী ঠাকুমা’ বলেই হাঁকাহাঁকি করতাম। আমাদের দলে ভিড়ে বড়ঠাকুমাও সময় সময় তার ছোটবোনকে ‘ছুটকী' নামেই সম্বোধন করত। তা, ঘাসের ডগায় ‘কাঁকর-পড়া’ শুরু হলে, ‘বিরি বাইগন’ গাছে মাকড়শার জালের উপর হিলঝিল করে ‘কাঁকর’ পড়লে – সুবর্ণরেখা নদীধারে কারিকুরি পাখিরা এসে মেলা বসালে, হি-হি ঠান্ডা হাওয়া চালালে – আমাদের নবতিপর ঠাকুমাও কেমন যেন আনচান করে – - এই বুঝি সে আসে – আসে – - কে? কে ঠাকুমা? - কে আবার! তোদের ছুটকী ঠাকুমা। অ্যাই! অ্যাই ললিন! অ্যাই অ্যাই ছিমন্ত! যা না রে! টিক্কে আগেই যা, দেখবু ‘ধঁচা-বঁধা’ গাড়ি করি ছুটকি আসেটে। ... ...
আব্দুল মজিদের এই কার্যক্রম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল এবং অস্বাভাবিক জিনিসের প্রতি মানুষ এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে সুতরাং কিছু মানুষ আব্দুল মজিদকে ঘিরে দাঁড়াল। আব্দুল মজিদ প্রচন্ড সূর্যের উত্তাপে গরম ভেজাল বিটুমিনের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত রাজপথে দাঁড়িয়ে তার চারপাশে জমে যাওয়া মুখগুলোকে দেখে ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করল। তার মনে হল অনেক অনেক দিন পরে রাশি রাশি পক্ষীকূল তার ভেতরের দুনিয়ায় একসাথে উড়াল দিয়েছে এবং তারা এক স্বর্গীয় ছন্দে একসাথে ডানা কাঁপিয়ে উড়ে চলেছে। আব্দুল মজিদের শরীরের ভেতরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল এবং সদ্য দৌড়াতে শেখা বাছুরের মত তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল অপার্থিব উচ্ছ্বলতাকে সঙ্গে নিয়ে। আব্দুল মজিদ এইসব অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল এবং চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসল। সে নিজের চোখকে উপস্থিত জনতার চোখের আড়াল করতে উত্তপ্ত রাজপথের দিকে তাকাল এবং সে দেখতে পেল স্থানে স্থানে চাকার ঘর্ষণের ফলে রাস্তার বিটুমিন উঠে গেছে। সেইসব জায়গা রাস্তার বুকের ক্ষত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর কোথাও কোথাও এইসব ক্ষত অগভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। আব্দুল মজিদ ঝাপসা চোখ দিয়ে দেখলেও অনুভব করতে এইসব ক্ষত এবং গর্ত আসলে নগরের নাগরিকদের বিবর্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার খারাপ লাগে এবং সে নিজেকে শক্ত করে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মুখ তুলে বলে, আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প। এইগল্প এই শহর এবং শহরে বসবাসকারী মানুষের গল্প। আপনাদের মনে হতে পারে এই গল্পের সাথে শহর এবং শহরবাসীদের কোন মিল নেই। কিন্তু এই মনে হওয়া ভুল হবে। কারণ আমি এই চারপাশের বাস্তব পৃথিবীর ভেতরের অবাস্তব জগতটাকে দেখেছি এবং সেইমত বুঝে নিয়েছি এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পটিকে। এখন আমার দায়িত্ব আপনাদের এই গল্প শোনানোর। আপনাদের কি এই গল্প শোনার সময় হবে? ... ...
- সাল সত্তরের শুরুও হতে পারে, আবার ওয়াইটুকেও হতে পারে। তুমি কোনটা চাও? তুমি পরে আছো খুব হালকা নীলচে জামা, ছাই রঙের ট্রাউজার। ফুলশার্ট, পাড়ার দর্জি হারুদা বানিয়েছে। সন দুহাজার হলে জামাটা গোঁজা। চশমা সত্তর হলে নেই, নয়ত আছে। তোমার হাইট পাঁচ ফুট আট, গায়ের রং প্রায় ফরসা, গাল একটু বসা। কথা না বাড়িয়ে সোমনাথ হাঁটছিলো। গরম হাওয়া বইছে রাশবিহারী অ্যাভেনিউ বরাবর, ট্রামলাইন পেরিয়ে সে হাওয়া ঘুপচি দোকানগুলোয় ঝাপটা মারছিলো। - ক্যালিফোর্নিয়া গ্যাছেন? ওখানে এমনি হাওয়া দেয় গরমে ... ...
আমার মা দিনের পর দিন আমার জন্য অপেক্ষা করত। কেবল, জন্মদিনগুলো মায়ের সঙ্গে কাটাতাম প্রত্যেক বছর। রুচিরাও কোনও কোনওবার আসত। আমার মেয়েও আসত। নাতনিকে চোখে হারাত মা। ঠাকুমা মারা যাবার পর, পিসি মারা যাবার পর ওই ভূতগ্রস্ত বাড়িতে কেবল মা একলা। বহুবার বলেছি আমাদের সঙ্গে এসে থাকো। সামান্য দু-একদিন এসে থাকলেও ওই বাড়ি ছেড়ে আসতে চাইত না মা। হয়তো শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চাইত। গোটা জীবনই একা হাতে আমাদের বড়ো করে তুলেছিল মা। নার্সিং হোম থেকে বলল, প্রায় একলাখ টাকা বাকি। কোভিড পেশেন্টের বডি ওরা বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেবে না। কর্পোরেশনের গাড়ি আসবে। ওরাই যোগাযোগ করবে। ... ...
—না কিছু করতে পারবে না ওরা। বাড়ি গিয়েই আমার ফেসবুকে পোস্ট করব প্রমাণটা। সবাই দেখবে, জানবে। তখন ওরা বাধ্য হবে আমাদের, মানুষদের গণিতের সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দিতে। উচ্চকোটির গণিত যে শুধু ওরাই একচেটিয়া পারে সেই ভুল ভাঙবে। এবং সাথে সাথে সমস্ত গণিতের দরজা আমাদের জন্যও খুলে দেবে। ন্যায্য অধিকার হিসেবেই দিতে বাধ্য হবে। —এইটা তোমার মহান প্ল্যান? —এইটাই আমার মহান প্ল্যান। ... ...
রুমেলার আকাশকে নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা আকাশের বন্ধুর ফ্যামিলিকে নিয়ে। ঐ মেয়েটা একমাত্র চাকুরে নয়, ও গৃহবধূ। বাকি সবাই বিশাল বিশাল আই টি ক্যাট। কিন্তু সবচেয়ে জিতে গেছে যেন আকাশ আর নিশান্তের চোখে সুন্দরী ওই মেয়েটাই, এত ভাল সাজতে জানে। কী প্রপার ও। কী সুন্দর ওর পা, হাত। গাল, নাক। তা ছাড়া ও ভীষণ গোছানো। আকাশের বন্ধু নিশান্ত ওর বউকে নিয়ে পাগল। প্রশংসা শুরু করলে থামতে পারেনা। ... ...
আমি সপ্তাহে দু-দিন উপোস রাখি—মঙ্গলবার বজরংবলির উপোস, শনিবার শংকর ভগবানের। তবে এই সব উপোসে চা এবং ফল খাওয়া যায়; অন্ন, মানে ভাত-রুটি-তরকারি, না খেলেই হল। সাধারণতঃ আমি কাঠগোড়া বাসস্ট্যান্ডে সিন্ধি ভদ্রলোকের একটা বড় ফলের দোকান থেকেই কিছু কলা, আপেল, সফেদা ও মুসম্বি কিনে নেই। আজ সেটা হতে পারে নি। ওখানে বিলাসপুর কোরবার বাস অন্ততঃ দশ মিনিট দাঁড়ায়। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, খালাসিরা চা-জলখাবার খায়। কিছু যাত্রীও বাদ যায় না। ফলের দোকানের পাশেই গুপ্তা হোটেল। সেখানে চা খেয়ে সবাই পাশের গলিতে যায় তলপেটের চাপ হালকা করতে। ... ...
বুচকুনের নাকে শিকনি দেখলে বৌমনি ভীষণ রেগে যায়।আর মা রেগে যায় মাফিনের কাগজ খেতে দেখলে।কিন্ত একমাত্র বুচকুন জানে ঐ কাগজ খাবার কী সুখ! চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে বানিয়ে দেয় কাগজটাকে। তারপর পারলে পাপোষের নিচে ঢুকিয়ে দেয়। কুলসুম দেখতে পেলে পিঠের চামড়া তুলে দেবে। বুচকুন এইবাড়িতেই ভালোমন্দ খাবার পায়। চাউ মিন। চপ। মিষ্টি। পোলাও। কিন্ত এইসব খাবারে কোন কাগজ নেই যে খাবার শেষ হবার পরেও চিবিয়ে সুখ হবে। তাই বুচকুন মাফিনের জন্য হাঁ করে থাকে। এমনকী মা যেদিন তাকে নিয়ে যায় না, সেদিনও। ... ...
একদিন খাবার টেবিলে আলাপ হল পেটার এবং ডাগমারের সঙ্গে, তারা হামবুর্গ থেকে এসেছে। এমনি ছুটিতে কতজনের সঙ্গেই তো পরিচয় হয় কিন্তু এরা একটু অন্য রকম। ডিনারে পেটার আসে স্যুট পরে, ডাগমার ককটেল ড্রেসে। পরে দেখা গেলো বিচেও তারা রীতিমত ব্রানডেড পোশাক পরে। যুদ্ধের পরে ইয়েন্সের বাবা মা প্রায় এক বস্ত্রে লাইপজিগ থেকে মিউনিক আসেন, অনেক কষ্টে সৃষ্টে একমাত্র ছেলেকে পালন পোষণ করেছেন। ইয়েন্স আঠার বছর বয়েসে ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশি (আউসবিলদুং), তারপর ব্যাঙ্কে কাজ। ইয়েন্স কাজের বাইরে কদাচিৎ স্যুট পরে -মনে প্রশ্ন জাগল এখানে এই ক্রোয়েশিয়ার রেসরটে পেটার স্যুট পরে কেন? আনেলিজে লক্ষ্য করেছে তাদের কথা বার্তার স্টাইল উঁচু মাপের, কেতা দুরুস্ত। সকলকে আপনি বলে, করমর্দন করার কালে ঠিকমত মাথাটি ঝুঁকিয়ে দেয়। ... ...
-"শুনেছিস?" -"হুঁ, শুনলাম।" -"কখন? কে বলল?" -"এই তো একটু আগে। মিসেস চৌবে ফোন করেছিল। অনুপমকেও কে জানি ফোন করেছিল।" -"ছি: ছি:, কী লজ্জা বলতো? আমরা বাঙালীরা আর কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব? সবাই তো মওকা পেয়ে নিন্দের বন্যা বইয়ে দেবে। বলবে "বঙ্গালীলোগ এয়সে হী হোতে হ্যায়"। ছি:" রুমেলা বিরক্ত হল। যা হয়েছে তা খুবই বাজে ঘটনা, শুনে অবধি তার মেজাজ খারাপ, তবু এসময়ে দেবযানীর এইসব টীকাটিপ্পণী সহ বক্তব্য আর নেওয়া যাচ্ছেনা। সে ফোনপর্ব শেষ করার ইঙ্গিত দেয়, -"ওসব ভেবে কী লাভ। যাদের যা বলার তারা এমনিতেও বলবে, অমনিতেও বলবে। ওতে কান না দেওয়াই ভালো। যাক শোন, অনুপম অফিস বেরোবে। ব্রেকফাস্ট রেডি হয়নি এখনো। এখন রাখ, সারাদিন পড়ে আছে। এসব আলোচনা পরে হবে।" ... ...