মিসের হাই হিলের ঠক ঠক শব্দে তার চিন্তার জালটা ছিন্ন হলো। টেবিলের ওপর হাতের ফোল্ডারটা রেখে ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক করে মৃদু হেসে সমস্ত ছাত্রীদের ‘গুড মর্নিং’ বললেন তিনি। ব্যস্ত হাতে গাঢ় নীল রঙের ফোল্ডারের স্ট্র্যাপটা খুলে স্টেপল করা একতাড়া A4 সাইজের কাগজ বের করে রাখলেন টেবিলে । সামনের বছরেই সেকেন্ডারি স্কুলের শেষে GCSE পরীক্ষা, তাই পড়াশোনা এখন জোরদার। ওই একতাড়া কাগজগুলো হলো প্রতিটি ছাত্রীর জন্য তৈরি করা আজকের লেসন। ... ...
কূলের কিনার থেকে ডাক দেয় পরীবানু। মাঝির মতিগতি যেন কেমন কেমন লাগছে। এত কি কথা বলেশ্বরের সঙ্গে ! বাসুকীর মা মাসীমা এসেছিল গেল কাল সন্ধ্যায়। রোজা থেকে থেকে মিলনের মুখের রুচি চলে গেছে, খেতে স্বাদ পাচ্ছে না শুনে কলাপাতায় মুড়ে কতগুলো পুরনো টক তেঁতুল দিয়ে গেছে শরবত বানানোর জন্য। চোত বোশোখ মাসে রোজা করা মানে জাহান্নামের আগুনে সেদ্ধ হওয়ার সমান। জিভ শুকিয়ে খড়ি হয়ে যায়। খা খা করে শরীর। যাওয়ার সময় মাসী চুপিচুপি বলে গেছে, মাইয়েরে মাইয়ে, চক্ষু দুইহান চেতায়ে রাহিস। রোজার ধকল তাও সয়, সাগরের ডাক কিন্তুক মানানো যায় না রে মাইয়ে। ঢনঢন করে ওঠে পরীবানুর বুক। রাগে দুঃখে গাল পাড়ে, ঢ্যামনা বলেশ্বর। মাইয়ে পোলাপানগো লাগান ছেনাল হইছিস হারামাজাদা তুই। বলেশ্বর ঢেউ তুলে কতগুলো কচুরীপানা ভাসিয়ে দেয় কূলের কিনারে। মিলনের পেছনে দপদপিয়ে হেঁটে আসা পরীবানু কি বুঝে কে জানে। নিজের প্রৌঢ় চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে বার বার পেছনে তাকায়। কুলকুল করে হাসছে বলেশ্বর ! পানি ছিটোচ্ছে ওদের ফেলে আসা পদচিহ্নমাখা পথে। ... ...
ওই পুরোনো খবরটাতেই জানতে পারি মাণিক্যপুরে থাকতো দুরকম মানুষ, আঁখি আর নয়ন| প্রথমে সবাই বেশ মিলে মিশেই থাকতো, তারপর তাদের ধর্ম আলাদা হলো, এলো বিচ্ছেদরেখা | সেকি বাইরের মানুষের জন্য? কে জানে? আঁখি চা চাষ করে, নয়ন ধান। আঁখি ভেড়া পোষে, নয়ন গরু। আঁখি গাঁজা খায় তো নয়ন তামাক| রাত্রে নিজেদের বানানো নেশাটুকু খেয়ে আঁখি নাচ গান করে, নয়নও | আর তাদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে| সীমানা নিয়ে লড়াই, ধর্ম নিয়ে লড়াই,চাষের জমি, জল, মাণিক্যপুরে নতুন কি হবে সব কিছু নিয়ে লড়াই| ... ...
আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো বলে আমি কিচ্ছু ভুলিনা। রবীন্দ্র রচনাবলীর কোন খণ্ডে কথা ও কাহিনী, বাড়ির কোথায় ঝুলঝাড়া, কোন ড্রয়ারে মাংস কাটার ছুরি, আমার সব মনে থাকে। ফ্রিজারের পিছন থেকে এক চান্সে থান ইটের মতো পাঁঠার মাংস বার করে ধপ করে রান্নাঘরের সিমেন্টের স্ল্যাবে ফেলে কাটারির সাইজের ছুরি বাগিয়ে তরীকে বলি, আজকে মাংস করব বলেছিলাম না? কেমন মনে রেখেছি অ্যাঁ? হ্যাঁ, স্ল্যাবের উপর ফেলার আগে পাতলা প্লাস্টিক বিছিয়ে নিতেও আমি একদম ভুলিনি ... ...
তাদের মাঝখান থেকে তাপ্তী, তরুণকে এক হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলে টানতে টানতে আমাদের দিকে নিয়ে আসতে লাগল। এমন সময় দুই ডাইনোসরের যুদ্ধে একটা গোটা গাছ আমাদের চারজনের মাঝখানে এসে পড়ল। তরুণকে যখন এদিকে আনার চেষ্টা হচ্ছে তখন আমি হঠাৎ আমার পকেটে একটা দড়ি আবিষ্কার করলাম। একটা পাথর ঐ দড়ির মাথায় বেঁধে আমি তরুণদের দিকে ছুড়ে দিলাম। সেটা পড়ে যাওয়া গাছের ওদিকের একটা ডালে আটকাল। তরুণ দড়ি বেয়ে সহজেই এদিকে চলে এল। কিন্তু তাপ্তী যখন দড়ির কাছে যেতে যাবে, তখন ভয়ংকর এক চিৎকারে আমরা সবাই চমকে গেলাম। দেখা গেল যে, টি-রেক্স অ্যালোসরাসকে ঘোরতর যুদ্ধে পরাজিত করেছে। তাপ্তী ততক্ষণে দড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। ডাইনোসরটা এবার তাপ্তীর দিকে এগোতে শুরু করল। তাপ্তী গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে এক হ্যাঁচকা টানে দড়িটা ছাড়িয়ে ছুট দিল। ... ...
অহনা হাঁটতে আরম্ভ করে দিল। সে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের খাঁজে চলে গেল। দু পাহাড় যেখানে জোড় খেয়েছে আর দুটো দেশ তৈরি হয়েছে গাছেদের। হ্যাঁ, গাছেদের আর বৃষ্টিদের। সেখানে প্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইখানে অহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব বলে বলে ভাবছি আর দেখি সে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটা দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকটা পাহাড় দেখার মত এক দূরত্ব। মনে হয় কাছে কিন্তু দূরত্বটা বেশ। যত কাছে যাওয়া যায় ততো দূরত্বটা থেকে যেতে থাকে, থেকে যেতে থাক – দূরত্বটা শেষ হয় না। বোঝা যায় না পাহাড়টা দূরে, বোঝা যায় না পাহাড়টা কাছে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়। সে রকমই হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না জোরে কথা বলব না আস্তে কথা বলব। তাই দেখতে লাগলাম। প্রথমে গাছেদের এ ওর পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা ফুল দেয় না আর দিলেও দেখাতে চায় না যে ফুল দিয়েছে। ছোট ছোট গাছ না কিন্তু তাদের ছোট ছোট লাগে। পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। সেই গাছ দেখে আশ্বস্ত হয়েছি, সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গাছ কথা কইছে আর আওয়াজ হচ্ছে কথাদের। ... ...
পরনের ফতুয়াটি দুইমাসাধিক ধীরেও নয় ধৌতি, মাদনে গন্ধ, মাতনে নালকৃষ্ণ হে মাতঃ, তত্রাচ এই গোকুল সন্ধ্যা এই ঘিরি ঘিরি কর্দম মর্তম পালং জুড়িয়া বেডশিটে সমাসীনা কার্পাস কল্লকাগুলি, শ্রীলঙ্কার নিকট অই নিউ বেঙ্গল বস্ত্রালয় ব্লকছাপখানি, এ নেহাৎ ঘন্টাঘরের কেন্দ্ররূপ বৈ ত নয়। মনোময় সেই কেন্দ্রগতে দণ্ডবৎ হইবার পারে। তাহার হস্তের অঙ্গুলিমাল নখাগ্রে ওতপ্রোত, নখাগ্র টিউলাইটের ম্লানালোকে থিরকম্প্র। আজ দুইদিবস কেহ দরোজাকরে আঘাত করে নাই। আজি মাসাধিক দ্বারদ্রুম বন্ধ। ... ...
খোয়াবে তারা দেখতে পেয়েছে শওকত আলীর পরীর মতো মেয়েটিকে। শুনতে পেয়েছে পায়ে নূপুরেরও ঝুমঝুম শব্দ। সেই শব্দ করে মেয়েটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে কোনো ফটো স্টুডিওতে ঢুকতে গিয়েছে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার হোঁচট খাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে তার করুণ শঙ্খের মতো মুখটিও দেখে ফেলেছিল। সেই মুখ দেখে তারা অজান্তে গেয়ে উঠেছিল -- রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি…। এই গানটি গাইতে গাইতে তাদের গলা ধরে এসেছিল। সেটা মনে করে আজ এই ক্ষণে পাপবোধ ঘিরে ধরে। সেই পাপবোধ থেকেই তারা নিজ নিজ স্ত্রীদের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর প্রবল নদীর মতো কান্নার স্রোতধারা তাদের চোখ থেকে নেমে এসে ধুলোমাখা পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে লেগেছে। আর এই স্ত্রীগণ সহসা হাওয়া থেকে পদ্মঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে। সেই গন্ধে তাদের মনে হয় তারা আজ আর বহুগর্ভধারী শিথিল স্ত্রীগণ নয়। তারা সবাই অনাঘ্রাতা কিশোরীরত্নে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আর তাদের পদতলে নত হওয়া লজ্জিত কিশোরটির প্রতি স্নেহ মমতা এবং ভালোবাসা বোধ করতে করতে ছায়ার মতো নরম করে নিজেকে মেলে দেয়। কয়েকটি শিশুর জন্মসূচনাধ্বনি সব কিছু ভেদ করে চারিদিক প্লাবিত করেছে। ... ...
হ্যাঁ স্যার, আসলে ওটা তো হন্টেড হাউজ। আপনি দূর থেকে আর কীভাবে বুঝবেন আমার কী অবস্থা হচ্ছে। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি স্যার। নাক মুখ থেতো হয়ে গিয়েছে। যাকে বলে ঘাড়ে ধাক্কা। বিশ্বাস না হয় ছবি পাঠাব স্যার? ... ...
ফোন বেজে উঠতেই শ্যামশ্রীর গলা ভেসে এলো। ছটফটে, তরতরে শ্যামশ্রীর গলা নয়। রাগী, কড়া শ্যামশ্রীর গলাও নয়। চটপটে, স্মার্ট নয়। একটু ভেজা ভেজা। দরদী। নরম। ত্রিলোকেশের এখন ঠিক যেমন দরকার তেমনটি। যখন যেমন দরকার, তেমনটি। যখন খোলামেলা চাই তখন খোলামেলা। যখন লাজুক চাই তখন লাজুক। যখন লাস্য চাই তখন লাস্য। এইভাবেই। ঠিক এইভাবেই প্রোগ্রামড করা আছে। কন্ঠস্বর, চলাফেরা, ওঠাবসা, ফুড হ্যাবিট, যৌনতা , এমনকি পটি টাইমিং পর্যন্ত। শ্যামশ্রী না। শ্যামশ্রীর ক্লোন। শ্যামশ্রী দত্তগুপ্ত টু। হাইট পাঁচ পাঁচ। রঙ মাজা। চুল স্ট্রেইট। গোল্ডেন হাইলাইট। অবিকল ওরিজিনাল শ্যামশ্রী। ... ...
সবকিছু শেষ হয়ে আসছে শ্যামলী জানে। সুবিমলের মাথার ভেতরের ঐ আলোআঁধারি জগত একদিন ওকে গিলে নেবে; আর ফিরতে দেবে না এই ক্ষয়াটে শহরের বাস্তবতায়। সুবিমল টের পায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাসে উঠতে গিয়ে পা টলে যায়। ভুল রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আধঘন্টা পরে বুঝতে পারে ঠিকানা ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যায় যন্ত্রণায়। কোনোকিছুতে মন বসাতে পারে না। গভীর রাতে কী যেন অজানা ভয়ে জেগে উঠে শুনতে পায় সারা ঘরময় খুকির খেলনাগুলো, বাঁকুড়ার ঘোড়াগুলি ঠকঠক শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে একলা হয়ে যাচ্ছে ও। ... ...
বিরান ঘাটে সেই সময় নজর পড়লো ত্রপার ওপর। বুকের কাছে কয়েকটা বই, একটা লম্বা খাতা জড়ো করে দাড়িয়ে আছে। স্কুল ড্রেস পরণে ছিলো না। তাই অনুমান করা গেলো যে, কলেজ ছাত্রী। একবার ভেবেছিলাম, কথা শুরু করা যাক। কিন্তু সেটা বড্ড বেশী সিনেমাটিক হয়ে যেতো। তাই চুপ করে রইলাম। কথাটা শুরু হলো দূর্ঘটনাচক্রে। দূর্ঘটনা আমিই ঘটলাম। ... ...
অনীতার কথা এইবেলা বলে নেওয়া ভালো কেননা, অনীতা প্রেমে পড়েছে। সেটা খুব বড় কোনো ব্যাপার নয়, আকছার পৃথিবীর প্রতিটি কোণেই চৌদ্দ থেকে চব্বিশ বয়সী একগাদা মেয়ে কিশোরী মায় উদ্ভিন্নযৌবনা পর্যন্ত প্রেমে পড়ছে, শুধু পড়ছে না, বলা ভালো ধপাধপ আছাড় খাচ্ছে। প্রেমের মতো এমন একটা সঘন স-আবেগ তদুপরি সলজ্জ ব্যাপারের সাথে আছাড় খাওয়ার মতো অমন আনকুথ ক্রিয়াশীলতার কথা ভাবতেই কেমন যেন তেতো অনুভূতি হয় মুখের মধ্যে ওর, কিন্তু ব্যাপার টা ঠিক ঐ রকমই আনকুথ বলা যায় একেবারে বিশ্রী রকমের আনকুথ হয়ে গ্যাছে। কারণ অনীতা, আমাদের সুন্দরী ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া চোখে হাফ কাট রিডিং গ্লাস দেওয়া, লেয়ার কাট চুল, স্মুথ হেয়ার সিল্কি শাইনিং স্কিন অনীতা, টম ক্রুজ লুক আর রালফ লরেন পোলো টি শার্ট বিশেষজ্ঞ অনীতা, সর্বোপরি শোভা দে আর সিডনী শেলডন গোগ্রাসে গিলে খাওয়া অনীতা হঠাৎ করে আছাড় খেয়েছে, থুক্কু, মন প্রাণ সবই সঁপে বসে আছে এই দর্জিকে! ... ...
রইল পড়ে নড়বড়ে টুল, সাদা কাগজে লাল রঙের পোঁচ- আমরা ভাবতে বসলাম। কুমুদির গল্পে ভূষণদা বলত- "পচ্ছন্দ না হইলে চড়িবে না, অত বাক্য কীসের?" আমাদের সেই কথা মনে পড়ে গেল । একেই উল্টোপাল্টা প্রতিষ্ঠান- সকালের কথা বিকেলে পছন্দ হয় না, দুপুরের কথা সাঁঝের ঝোঁকে বদলে দিই । ওরিজিনাল গোলাপী হ্যান্ডবিলেই কাটাকুটি হয়েছে- সময়সীমা বদলে গেছে , বয়স অনুযায়ী নতুন বিভাগ যোগ হয়েছে। "পচ্ছন্দ না হইলে..." এইটাই আসল কথা- আমাদের মনে হল। ... ...
ফুটবল মাঠের গেটের কাছে দেখি চারটি কুকুর দাড়িয়ে আছে। চারটি কুকুরের মধ্যে দুটোর রঙ কালো এবং স্বাস্থ্যবান। আর দুটো ছিল মোটামুটি গেরুয়া রঙের হবে, মানে--যেগুলো সাধারনত রাস্তায় আমাদের চোখে পড়ে। তবে আমার চোখে সব সময় পড়ে, কারন আমি খুব ভয় পাই রাস্তার কুকুর দেখলে। আর আমার মা বলে ভয়ের কিছু নেই। ব্রেভ হও। কুকুরকে কিছু না বললে সেও কিছু নাকি বলে না। ... ...
ও চোখ দুটো বন্ধ করল। খুব আবছা হাসির টুকরো ঠোঁটের কোণে। মেনে নেওয়ার হাসি। একেবারে নিজস্ব। আর ঠিক তখনই আমার মনে ঝিলিক দিয়ে গেল, ও যা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে... এই মুহূর্তে তা আমাদের দু'জনের। দু'জনকেই ভাগ করে নিতে হবে। তা না হলে এই যে আলো ..দোদুল্যমান আলো .. আমাদের যাপনে এখন...তা নিভে যাবে। ফুসমন্তরে । আলো -আঁধারিতে দেখি ওর চোখের পাতা কেমন তিরতির করে কাঁপছে। নিজেকেই বুঝি স্তোক দিয়ে যাই, হয়ত অনেক করে চাওয়া এক দু'কণা সুখের কুচি এখনও পড়ে আছে কোথাও। ওর মনের কোণের বাইরে। মাথাটা একটু নামিয়ে একটা চুমু খেলাম । ওর বন্ধ চোখের পাতায়। ... ...
কিন্তু গোলুর মনকেমন যায় না। ক্রমশ বাড়ে। চোখের সামনে মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগছে না গোলুর। হঠাৎ আকাশ থেকে একটা শিউলিফুল এসে পড়ে। একটু বড়! গোলু যেই না হাতে নেয়, ফুলটা কথা বলতে শুরু করে। বলে, "গোলু, তোমার মনে আছে মেঘ দিদির কথা?" গোলু বলে, "হ্যাঁ। কেন বলো তো?" "ওই আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। তোমার দুঃখ মেটাতে। কি হয়েছে তোমার?" শিউলি ফুল বলে ওঠে। কিন্তু গোলু কিছু বলেনা। ওর মনে হয় স্বপ্ন দেখছে। গোলু বলে, "জানো তো, ওই যে মুখুজ্যেদের বাড়ির কাছে, একটা মেয়ে বসে আছে, পুরনো গোলাপি জামা পরে, ওর খুব কষ্ট। পুজোয় একটাও জামা হয়নি। খুব দুঃখ। এদিকে দেখো। ... ...
সারাটা দাঙ্গার সময় খোকনের কলকাতায় কাটলো। কি আতঙ্ক, কি আতঙ্ক রে বাপ। রোজ অপেক্ষায় থাকে এই বোধহয় কেউ ছুরি হাতে বাসায় ঢুইক্যা আইলো। দাঙ্গা কি আর আগেও দ্যাখে নাই খোকন, ছোটখাটো কম হয় নাই দ্যাশেও।কিন্তু মাতব্বররা সালিসি করসে, কার দোষ ঠিক কইরা দিসে, থাইম্যা গেসে। ১৯৪৬ এর দাঙ্গার এক্কেরে আলাদা। কলুটোলা, রাজাবাজার,পার্কসার্কাস সব বেবাক চুপচাপ। লিচুবাগানের ঘটনার পর তো কলকাতা থম মাইর্যা গেলো। দ্যাশের খবরও খুব খারাপ। নোয়াখালি, আরও কত জায়গার খবর আসে। খোকন অস্থির হইয়া ওঠে, ভিতরে ভিতরে। দাঙ্গার আগুনে সব ছাড়খার।সন্ধ্যাবেলা পিসা আর পিসার বন্ধু অমলবাবু কত কথা কয়, খোকন শোনে একমনে।অমলবাবু বলেন " বুঝলে মিত্তির, লীগ আর হিন্দুমহাসভার নেতাদের বোঝানোই গেলো না, এ লড়াই হিন্দু মুসলমানের বিরুদ্ধে নয়, এ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে" পিসা কয়,"স্বাধীনতা ও যেই ভাবে আইলো, তাতে লাভ কী হইল অমলবাবু? দ্যাশভাগ আর লাখে লাখে মানুষ আজ ভিটা মাটি ছাইড়া আইতাসে পূর্ব পাকিস্থান থিকা,দাঙ্গা কমলেও এই ভয় কী কমবো কোনোদিন! দুইটা জাতির বিশ্বাস, ভালোবাসা তলানিতে আইসা ঠেকলো ব্রিটিশের শয়তানি আর নেতাদের ভুল চালে।" অমলবাবু কন, ' দাঙ্গা সাধারণ হিন্দুও চায় না মুসলমানও চায় না।চায় শুধু দাঙ্গাবাজগুলো" খোকন ভাবে মামুদ, আনোয়ার তো তারে ভালোবাসে, চিঠি দেয়। খোকন কবে আইবি রে? খোকন তুই নাই তাই ফুটবল খেলা জমে না। তাদেরও অন্তরে বিষ? ... ...