এই বক্তিয়াররা আরেকটি কাজ খুঁজে পেলেন। দেখা গেলো রাজা বা আমলাদের সামনে সকল নাগরিক নিজেদের কেস ঠিক ভাবে উপস্থিত করতে পারছেন না। বাদী বা বিবাদী তো আর্ট অফ পাবলিক স্পিকিং শেখেন নি। আন্তিফন নামক গরগিয়াসের এক চেলা পরামর্শ দিলেন দুই বিবদমান পক্ষের প্রয়োজন এমন একজন মানুষের যিনি মোটামুটি লেখাপড়া জানেন এবং আদালতে দাঁড়িয়ে কোন পক্ষের যথাযথ বয়ান দিতে পারেন।এই মানুষটি হবেন একজন নিঃস্বার্থ বন্ধু মাত্র যাঁদের কাজ অশিক্ষিত বাদী বিবাদীদের সহায়তা করা। অন্য অর্থে বলা যেতে পারে ইতস্তত ভ্রমণরত বাগ্মীরা একটা কাজের কাজ খুঁজে পেলেন! গ্রিকরা সেটি মেনে নিলেন কিন্তু সাব্যস্ত হলো মামলায় এই সহায়তার জন্য কোন পারিশ্রমিক দেওয়া বা নেওয়া চলবে না। বন্ধু রূপে যদি তাঁরা বিচারকের সামনে অবতীর্ণ হন, টাকা পয়সার প্রশ্ন ওঠে কোথা থেকে। মামলা জিতে কোন পক্ষ যদি সেই বক্তাকে আগোরার কোন শুঁড়ি খানায় দু পাত্তর সুরা পান করায় সেটাকে অবশ্য উকিলের ফি বলে ধরা হবে না। ... ...
লোকটা অদ্ভুত। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, বিশাল একজোড়া পালোয়ানী গোঁফ, মাথার চুলে একগাদা তেলে জবজব, হাতে বালা। হাতে বালা অনেকেই পরে শিখদের নকল করে, বিশেষতঃ একটু দাদাগিরি করার যাদের শখ। কিন্তু এর বালাগুলো, হ্যাঁ একটা নয়, প্রায় পাঁচ ছ’ টা, স্টীলের নয়, পেতলের। সবকটা এক হাতে পরা। অন্যহাতে মোটা মোটা লাল সুতো জড়ান। এরকম পাঁচ ছ’খানা পেতলের বালাওয়ালা লোক আমি আগে দেখিনি। লোকটার ভাষাও একটু কেমন যেন। কোলকাতায় পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় যে সব জেলা থেকে মানুষ এসেছে, তাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের ঐতিহ্য চাপিয়ে বাংলা বলে কিন্তু এর বাংলাটা কেমন যেন। প্রথমে শুনলে মনে হয় বিহারী কষ্ট করে বাংলা বলছে। একটু ঠাওর করলে বোঝা যায়, না এটা বাংলাই কিন্তু যেগুলো আমরা শুনে অভ্যস্ত, তাদের কোনওটাই নয়। আমার কেমন জানি মনে হ’ল, লোকটা মালদা জেলার। লোকটা এই ভাড়া করা সুভ্-গাড়িটার ড্রাইভার। বলল, মেসো, গাছ দেখছেন? ... ...
এই অগাস্টের পনেরো তারিখ আরো একটা দেশে একটা বিশেষ দিন। সে হলো চীন। এদিন ওখানে মস্ত উৎসব হবে। চাঁদের উৎসব। চাঁদের উদ্দেশ্যে নাচগান হবে। নানা রকম ভালো খাবার সাজিয়ে দেওয়া হবে। তার মধ্যে সবচেয়ে স্পেশ্যাল হলো 'মুনকেক'। এই উৎসবকে ওঁরা বলেন ‘মাঝ-শরতের চাঁদনী পরব’। ঠিক যে অগাস্ট মাসের পনেরো তারিখেই তা নয়। তবে আট নম্বর মাসের মাঝের দিনে ঠিকই। চীনের চাঁদ-সুর্য্যের ক্যালেন্ডার মেনে ঐ সময়ে যে পূর্ণিমা পড়ে সেইদিনেই চাঁদের পরব হবে। সেটা সেপ্টেম্বর মাসেও পড়তে পারে, কিম্বা অক্টোবরেও। কিন্তু এসব তারিখের কচকচানি নিয়ে কী হবে? আসল হলো এই উৎসবের পেছনে যে গল্পটা আছে সেটা । চীনে মাইথোলজির গল্প। বলছি। ... ...
কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, ব্যথিত বৃদ্ধ ঠিক করেন নোয়াখালির গ্রামে গ্রামে, বিহার-কলকাতা-দিল্লি-পাঞ্জাবের দাঙ্গা-বিদ্ধস্ত বস্তিতে তিনি শেষ চেষ্টা করে দেখবেন। তাঁর সারাজীবনের আদর্শ - অহিংসা দিয়ে হিংসাকে জয় করবেন। সঙ্গী তাঁর অক্ষয় সাহস আর হাতে-গোনা কয়েকজন অনুগামী। বিহারে হিন্দুরা তাঁদের আচরণ পরিবর্তন না করলে তিনি আমরণ অনশনের হুমকি দেন '৪৬-এর নভেম্বর মাসে। আর '৪৭ এর জানুয়ারি মাসে তিনি শুরু করেন তাঁর নোয়াখালি ভ্রমণ। দাঙ্গার শিকার নোয়াখালির সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মনোবল জোগানো আর সংখ্যাগুরু মুসলমানদের মন পরিবর্তনের জন্য এই তাঁর যাত্রা-সাত সপ্তাহের এই যাত্রায় ১১৬ মাইল তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। জল-কাদার মধ্য দিয়ে, ভাঙা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে, বিরুদ্ধ-ক্রুদ্ধ মানুষের ঘৃণা পেরিয়ে, সংশয়-অবিশ্বাস পেরিয়ে, মৃত্যুভয় পেরিয়ে খালিপায়ে তাঁর এই হাঁটা - এ হাঁটার তুলনীয় নজির পৃথিবীর মানুষ খুব বেশি একটা দেখে নি। তাঁর পথে ক্রুদ্ধ মুসলমানদের ছড়ানো ময়লা তিনি একবার নিজের হাতে পরিষ্কার করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে তাঁর যাত্রা শুরু হত রবীন্দ্রনাথের 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে' গান দিয়ে। সুমিত চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন - 'সেটি হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় স্তোত্র।' শুরুতে কিছু প্রতিরোধ ছিল - সাংবাদিক শৈলেন চ্যাটার্জি লিখেছেন - মুসলমানরা তাঁকে বিশ্বাস করত না; পরে তারা বুঝতে শুরু করল - এই মানুষটি সাধারণ একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু নয়, এ অন্য কিছু। লাইন দিয়ে মানুষ তাঁকে দেখতে আসত, তাঁর চলার পথে ভিড় করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকত তারা - তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে পীড়িত মানুষজনকে সান্তনা দিতেন, প্রার্থনা করতেন, সম্প্রীতির কথা বলতেন। ... ...
স্নানের আগে মাথায় ঢালা হবে তেল। সর্ষের তেল। একটা ছোট নোড়া দিয়ে গড়িয়ে সেই তেল পড়বে সিঁথিতে সেখানে ঠেকানো থাকে পান পাতা। সেই পাতা দিয়ে তেল পড়বে কুলোয়। কুলোয় রাখা থাকে চাল আর বিউলির ডাল। বর বা কনে তেল দিয়ে তা মাখাতে হয়। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েই এই রীতি। গায়ে হলুদের আগে হিন্দু মুসলিম দুই বাড়িতে বর বা কনে পক্ষ থেকে তত্ত্ব আসে। তত্ত্ব নিয়ে আসা লোক হয় ধুরন্ধর। আসলে গোয়েন্দাও। বুঝে নিয়ে যায় আসল হালচাল। বন্দোবস্ত। নাপিতদের পাঠানো হতো বেশিরভাগ জায়গায়। মুসলমানদের বেলায় হাজাম। রঙ্গ রসিকতায় চাপান উতোরে এই লগ্নযাত্রীরা মাত করে দিতেন। বিকেল হলে মেয়ে বঊদের দল আসতো লগন দেখতে। কী কী দিয়েছে--কী কী দেয়নি তার বিদেন বা টীকা ও ব্যাখ্যান চলতো। ... ...
রোহার অফিস ঘরের অর্ধেকটা জুড়েই ট্রোফি ক্যাবিনেট। বছর ষাটের ভদ্রমহিলা। গোলগাল, সাদা ফুরফুরে চুল। দেখে মনে হয় মিষ্টি দিদিমাটি। কিন্তু বাপ রে কী মেজাজ তাঁর! আর কথার ধার! কিন্তু ওঁর কাছেই আমাদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। উনি আমাদের শপ-লিফটিং এর ঘাঁতঘোঁত শেখাবেন। ... ...
শ্যামলবাবুর সঙ্গে মেশা আমার জীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি। তা ছিল অম্ল এবং মধুরতায় মেশানো। প্রথমে শ্যামলবাবু ধরেই নিয়েছিলেন আমার দ্বারা তেমন লেখা হবে না। বন্ধুরাই বলে। আর শৈবাল বলে। একদিন তো আমাকে বলেই বসলেন, লেখা অভ্যাস করো, প্রতিদিন লেখো, তবে তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ভয় করতাম খুব। একদিন তুষার সমীরের সঙ্গে সন্ধ্যায় গিয়েছি শ্যামলদার বাড়ি। ওরাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পান করা হল। শ্যামলদা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার কাছে কুলটিকরির খবরাখবর নিলেন। হাটের খবর, চালের দর, সবজির দর ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা এবং ডুলং নদীর কথা শুনলেন। তিনি বললেন বিদ্যাধরীর মৃত্যুর কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা দেখেছিলেন। তাঁর রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় ইত্যাদি গল্পে আর কুবেরের বিষয়আশয় উপন্যাসে যা আছে। ... ...
শুক্রবার দোল। শনিবার হোলি। এবার শুক্রবার দোলের রঙের সঙ্গে পড়েছে শবে বরাত। চলে যাওয়া মানুষদের স্মরণে দান ধ্যান করেন মানুষ। এছাড়া বাড়িতে তৈরি করা হয় চালের আটার রুটি, পোলাও (বিরিয়ানি হতো না এভাবে ঢালাও আকারে)। নানা রকম হালুয়া, ছোলার ডালের হালুয়া, গাজরের হালুয়া ছিল বিখ্যাত। হতো ফিরনি। এ-রকম শহুরে টাইপ না। ... ...
পিপলস বুক সোসাইটি আমাকে বলেছিল, অতিবৃষ্টিতে বাঁধাইখানায় জল ঢুকে ফর্মা নষ্ট হয়ে গেছে। যারা নতুন লিখতে এসেছিলেন, তাঁরা বইটি পড়তে চান, পি বি এস-এ গিয়ে খুঁজে পান না। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর সরকার বদলেছে। ২০১৩ সালে বইমেলায় আমাকে পি বি এস-এর একজন ডাকলেন, আসুন আসুন। আমি পি বি এস-এ যেতাম না বই নিয়ে ঐ ব্যাপার হয়ে যাওয়ার পর। বিরক্ত হয়েই ওঁদের প্যাভিলিয়নে ঢুকে দেখি নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান স্বমহিমায় বিরাজমান। সেই চল্লিশ টাকা দাম। দশ বছর আগের দাম। ঝকঝকে ফর্মা। সেই পুরোন ছাপা। কী হয়েছিল এতদিন? তাঁরা বললেন ফর্মা হারিয়ে গিয়েছিল, খুঁজে পেয়েছেন আবার। ভুল জায়গায় রক্ষিত হয়েছিল। মিসপ্লেসড। এমন হয় আমি শুনিনি আগে। না কি বইটি তাঁরাই বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলেন অদৃশ্য চাপে। কিন্তু পি বি এস-এর মানুষগুলি আমার প্রিয়জন। প্রত্যেকে আদর্শবাদী। ত্যাগী। আমি অনীক পত্রিকায় তিরিশ বছর এক নাগাড়ে লিখেছি। দীপঙ্কর চক্রবর্তী এবং রতন খাসনবিশ পরম শ্রদ্ধার মানুষ। অনীকের সঙ্গে পি বি এস সরাসরি যুক্ত না হলেও অনীক পত্রিকা পি বি এস থেকেই বিক্রি হয়। ওঁদের ভিতরে বন্ধুতার সম্পর্ক। অনীক এবং পি বি এস-কে আমি আলাদা করে দেখতাম না। এই ঘটনায় সব গোল পাকিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা, যাঁরা পার্টি করেন, তাঁদের কাছে সাহিত্য শিল্পের চেয়ে দলের মূল্য বেশি। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান উপন্যাস কিন্তু এক দলের নিন্দা করে অন্য দলের সমর্থনে লেখা তথাকথিত পার্টির লেখা নয়। এই উপন্যাস বামপন্থী দলের প্রতি বিষোদ্গারের নয়। কিন্তু ভিখারী পাশোয়ানের নিরুদ্দেশের ঘটনা সেই সময় হিমালয়ের চেয়ে ভারি হয়ে উঠেছিল সরকারের কাছে। পার্টির কাছে। একটি মানুষ যে কত তুচ্ছ, কত অবহেলার-- প্রশাসন, পুলিশ এবং বিত্তবানের কাছে, সেই লেখাই এই লেখা। উপন্যাসটি মুখে মুখে রটেছিল। এক সংবাদপত্রে এর আলোচনা করেছিলেন বিখ্যাত এক লেখক। মুখে আমাকে বলেছিলেন অনেক কথা, মা লিখ। ২৫০/৩০০ শব্দ কোনোরকমে লিখেছিলেন। এই রিভিউ নিয়ে সেই ভবিষৎবাণীই করেছিলেন পি বি এস কর্ণধার প্রশান্তবাবু। মৃণালবাবুর ছবি করা নিয়েও তিনি বলেছিলেন, হবে না। ... ...
“শুনুন, এটা অনুসন্ধানের ইসরায়েলি কায়দা ! প্রথম জন আপনার সঙ্গে কথা বলে দ্বিতীয় জনকে পাঠাবার আগে রিপোর্ট দিয়েছে, আপনি কি বললেন। সেই লিস্টি মিলিয়ে দ্বিতীয় জন আপনাকে চেক করে। থিওরি হচ্ছে আপনি সত্যি বললে প্রতিবার তাই বলবেন, কোন ক্রিয়া পদ বিশেষ্য বিশেষণ একটু ওদিক হতে পারে,আপনার কণ্ঠস্বরে উষ্মা দেখা দিতে পারে। কিন্তু পর পর তিন বার ধারাবাহিক ভাবে মিথ্যে বলাটা শক্ত কাজ। নিরাপত্তার লোকেদের মনে সন্দেহ হলে আপনাকে পাঁচবারও প্রশ্ন করতে পারে। হিথরোতে আপনি ক্লিন চিট পেয়েছেন। যখন বেন গুরিওন হাওয়াই আড্ডায় নামলেন, আপনি একেবারে কোশার মানুষ ! এখন আপনি আমাদের অফিস কেন, এই উলটোদিকের পার্লামেন্টে গিয়ে একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসুন না !” ... ...
অন্যদিকে ফ্রান্সের পুরনো ইহুদি বিদ্বেষ তার কণ্ঠ খুঁজে পেলো। কট্টর জাতীয়তাবাদী ফরাসিরা জেগে উঠলেন - ইহুদিদের জন্য ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা, ফরাসি সভ্যতা বিপন্ন । সে ক্রোধ এমনি রুদ্র রূপ নিয়েছিল যে এমিল জোলা আনাতোল ফ্রাঁসের মত মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি । একশোর বেশি জেলায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ , তাদের সম্পত্তির বিনাশ চলল -পুলিস নির্বাক দর্শক মাত্র ( হিটলারের বয়েস তখন ন বছর , গোয়েরিঙের ছয় : আইখমানের জন্মাতে আট বছর দেরি আছে )। কোন প্রমাণ ছাড়াই পুনর্বিচারে দ্রাইফুসের সাজা আরও দশ বছর বাড়ানো হল । তাঁকে জানানো হল তিনি মুক্তি পাবেন যদি অপরাধ স্বীকার করেন। পাঁচ বছর ডেভিলস আইল্যান্ডের কঠোর জীবনে ক্লান্ত দ্রাইফুস তাতেই সই করে মুক্ত হলেন ( ডাসটিন হফমান অভিনীত পাপিলন ছবিতে ডেভিলস আইল্যান্ড চিত্রায়িত হয়েছে)। সামরিক বাহিনীতে পুনর্বাসন হল দ্রাইফুসের। তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। । ... ...
দীঘায় ছিলাম একটি হোটেলে। মালিকের নাম শ্রীনাথ জানা। তাঁর তিনটি ঘর। সামনে খাওয়ার ব্যবস্থা। শস্তার হোটেলে। ঘরের মাসিক ভাড়া ৬৫ টাকা। তো সেই হোটেলওয়ালা ছিল গাঁজাখোর। আর তার ছিল একটি টাট্টু ঘোড়া। সেই ঘোড়ার ছিল একটি পালক। তার নাম ভানু। ভানু ছিল সবহারা এক মানুষ। উঞ্ছবৃত্তি করে দিন কাটত তার। আর সেই ঘোড়া সে পালাত মাঝে মাঝে, তাকে তখন খুঁজতে বের হতো সে। আসলে খোঁজার নাম করে ঘোড়ার মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই ছিল যেন কাজ। আমি শীতে যখন যাই, জানালার পাশে সেই শাদা ঘোড়া নিঃঝুম দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর একদিন সে উধাও। ... ...
বরং বলি সেই অমাবস্যার আগের এক গোধুলির কথা যার সঙ্গে এ জীবন সংপৃক্ত হয়ে আছে। সেদিন ছিল চতুর্দশী কিংবা অমাবস্যা। কখন যে এক তিথি শেষ হয়ে অন্য তিথির আবির্ভাব হয়, তা পঞ্জিকাকাররা বলতে পারেন। বলতে পারেন মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্র চেনা মানুষজন। জ্যোতির্বিদরা। সেদিন ছিল পিতৃপক্ষের শেষের আগের দিন। পরের দিন অমাবস্যা, কৃষ্ণপক্ষ শেষ হবে। তার পরের দিন থেকে আশ্বিনের শুক্লপক্ষ, দেবীপক্ষ আরম্ভ। আমার বাবা ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে পিতৃতর্পণ আরম্ভ করতেন। অমাবস্যার দিনে, মহালয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সেই তর্পণ শেষ হতো। মহালয়ার সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। দেশভাগের পর এপারে এসে আমাদের পরিবার যে প্রথম মৃত্যুকে দ্যাখে, তা এই অমাবস্যা কিংবা চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে। ... ...
ভট্টাচার্য মশাই ভেতর থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে আসেন। খুব ধারালো। খুব পুরোনো। তাতে প্রার্থনা খোদাই করা আছে। মিরকাশিমের তলোয়ার নাকি? কে জানে! এই ভাঙা মহল, ওই তীব্র বুনো গন্ধ, নেতিয়ে পড়া শিমুল, এলিয়ে থাকা সাপের খোলস, তার মধ্যেই উনি এনে দেখান এক সুন্দর বৌদ্ধ তারা মূর্তি। সন্ধে ঘন হচ্ছে জঙ্গলের মাথায়। হাতের কবজিতে তখনও লেগে আছে সকালের আতরের মৃদু গন্ধ। পথে ছোটে নবাবের সঙ্গে দেখা। বর্তমান নবারের ভাই। দুর্গা পুজো কমিটির সভাপতি। ভাগীরথীর ভরসন্ধ্যার বাতাস, পুরোনো হাভেলির সামনে চওড়া মাঠ। ... ...
উনি বললেন, শুনুন তবে। আমাদের ডিভিশনের এক কাস্টমার ভুটান বাম্পার লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। টিকিটটা সে আমাদের দিয়ে গেছে, প্রোসীড্স কালেক্ট করতে। এদিকে ইনসিয়োর্ড পোস্ট করতে গিয়ে জিপিও বলছে, দেশের বাইরে ইনসিওর হয়না। আমি বললাম, হ্যাঁ, তাও তো বটে, ভুটান তো অন্য দেশ। গাঙ্গুলী সাহেব বললেন, তখন সবাই আলোচনা করে ঠিক হল, আমাদেরই একজন চলে যাবে টিকিট নিয়ে। তখন দত্ত যাবে বলে ঠিক হ’ল, তার প্লেনের টিকিট ফিকিটও কাটা হয়ে গেল, তারপর শুরু হ’ল ঝামেলা। ঘোষ এসে বলল, ও কেন যাবে? আমাদের কাডারের কেউ যাবে। দত্তই বা ছাড়বে কেন, এই নিয়ে তুলকালাম। দুটো দল হয়ে গেল ডিভিশনে। যত বোঝাই, মশাই, এটা প্লেজার ট্রিপ নয়, সোজা গিয়ে কাজ ফুরোলেই চেক নিয়ে রিটার্ন। এতে এক দিনও বাড়তি নেই, যে একটু ঘুরেঘারে দেখবেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আসলে দু পক্ষেরই জেদ চেপে গেছে, কেউ ছাড়বেনা। ব্যাপারটা এমন হ’ল, যে বাইরে বেরোলে দেখে নেব টাইপের জায়গায় চলে গেল। এদিকে আমারও জেদ চাপতে শুরু করল, তবেরে, দুদলের কাউকেই পাঠাবনা। এদিকে দিন তো বসে থাকবেনা, সোমবার হচ্ছে টিকিটের প্রাইজ মানি ক্লেম করার শেষ দিন। তাই তো বলি, এবার রামনাম জপতে জপতে কোনও রকমে আপনি প্লেনে চেপে- আমি বললাম, দাঁড়ান স্যার, সবই তো বুঝলাম কিন্তু এর মধ্যে আমি এলাম কোত্থেকে? আমি তো আপনাদের এপাড়ার লোক নই, এই দু দলের কোনওটাতেই বিলং করিনা, তবে? ... ...
‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ ছাপার জন্য আমি ঝাড়গ্রাম কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ দুবছর কয়েক মাস ধরে সুদসহ শোধ করেছিলাম। তখন মাইনে পেতাম শ’পাঁচেক টাকা। আমি তখন একেবারেই অচেনা এক নবীন লেখক। অমৃত পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়েছি সদ্য। গল্প যা বেরিয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনে। কবিপত্র, অনুক্ত, পরিচয়, সংক্রান্তি---ইত্যাদি পত্রিকায়। লিখে উপার্জন হয়ই না প্রায়। বই ছিল ৭ ফর্মা মানে ১১২ পাতার। অ্যান্টিক নামের একটি মূল্যবান কাগজে লেটার প্রেসে ছেপে বেরিয়েছিল সেই বই। খুব সম্ভবত সুকিয়া স্ট্রিটের হরিপদ পাত্রের ছাপাখানা সত্যনারায়ন প্রেসে কম্পোজ হয়েছিল। আমি এইসব কথা বলছি এই কারণে যে সেই লেটার প্রেস, অ্যান্টিক কাগজ, সীসের অক্ষর, কাঠের গালি এখন হারিয়ে গেছে। এক একটি খোপে এক এক অক্ষর। ই-কার, আ-কার, উ-কার, এ-কার সব আলাদা আলাদা খোপে। কম্পোজিটরের সব মুখস্ত থাকত। কী দ্রুতই না সিসের অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে গোটা বই নির্মাণ করে ফেলতেন। হ্যাঁ, সেই লেটার প্রেস, সেই ছাপাখানা উঠে গেছে। ... ...
আমি ওর প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। আমার কাজ শুরুর সময় থেকে জানি। ১৯ বছরের মেয়ে। তিনটি বাচ্চা। বয়স তিন বছর, দু বছর, আট মাস। তৃতীয় বাচ্চা হবার আগের দিনও আমি ওকে রাস্তায় দেখেছি দুহাতে দু’ গ্যালন দুধের বোতল, সঙ্গে আরো কিছু বড় বড় ব্যাগ। এর মধ্যে ডিমের বাক্সও উঁকি দিচ্ছে। সঙ্গে দুই বাচ্চা। পেটে আরেকজন, যে আগামিকাল পৃথিবীর আলো দেখবে (পরে জেনেছি)। আমি ওকে দেখলাম ওর বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে। ... ...
বাবা ঠিক করলেন একটা সংগঠন করবেন। যেখানে কেউ মারা গেলে ২০ টাকা করে সংগঠনে নাম লেখান পরিবারগুলো চাঁদা দেবে। সবার এক চাঁদা। বড়লোক বলে বেশি দিতে পারবে না। এ থেকেই মাছ ভাত ডাল তরকারি হবে। সবার ক্ষেত্রে এক নিয়ম গরিব ধনী সবাই। মুখে মার্কসবাদী কথা বলা আর বাস্তব জীবনে তা পালন করা কঠিন। ... ...
আমাকে মোটামুটি ঠেলে গুঁতিয়েই পাঠিয়ে দিল। ক্যাশ মেমো কাটার পর বলল, মনে কর না স্কুলতুতো এক দাদা তোর সিক্সটিফাইভ মেরে দিল। ওটা জলে গেছে ধরে নে। তবে যাওয়ার আগে আসল কথাটা শুনে যা। বাটা কিছু জুতো এক্সপোর্ট করে। তাদের কোয়ালিটি আমাদের দেশের দোকানে রাখা জুতোর থেকে অনেক ভাল। কতটা ভাল, পরে বুঝবি। তারই কিছু সারপ্লাস এখানে মাঝে মাঝে আসে। ভারতের কোনও শহরের অন্য কোনও বাটার দোকানে এগুলো পাবি না। এখানেও সব সময়ে পাবি না। ইস্কুলের ছেলে বলে ডেকে গছালাম। বাড়ি গিয়ে গালি দিস। ... ...
গতবারে করোনার কারণে গাজন হয় নি, সব লকডাউন ছিল। কেবল মাত্র টিম টিম করে দুজন সন্ন্যাসী হতে হয় বলে হয়েছিল – এটা নাকি নিয়ম, যাদের বলা হল নীলে আর মূলে। তো গতবার গাজনের চারদিনের দুদিন রাতে বিশাল ঝড়ে কারেন্ট ইত্যাদি ছিল না, আর এদিকে জমকালো উৎসব হচ্ছে না বলে জেনারেটর ভাড়া করা হয় নি। ফলে ওই দুই সন্ন্যাসী, বিটু আর উদয় ঘুটঘুটি অন্ধকারে শিবতলায় শুয়ে ছিল প্রবল গরমে আর বিশাল মশার কামড় খেয়ে। মশার কামড় খেয়ে এত খিস্তি দিচ্ছিল দুজনে শিবদুয়ারে যে সেই খিস্তি রাতের বেলায় নিঃস্তব্ধতার জন্য বহুদূর শোনা যাচ্ছিল। কোন এক গুরুজন থাকতে না পেরে নাকি বলতে এসেছিল, “এই তোরা সন্ন্যাসী হয়ে ঠাকুর দুয়ারে বসে এত মুখ খারাপ করছিস, এই চারটে দিন মুখ খারাপ না করলেই কি নয়! ... ...