ছোটে নবাব সাহেবের সাথে বিশাল আকৃতির জরাজীর্ণ বালাখানার সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রাসাদের ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময় নবাব সাহেব জানালেন, বর্তমানে এই বালাখানাই নাকি কেল্লা নিজামতের সব থেকে পুরনো প্রাসাদ। এই প্রাসাদ নিয়ে একটি গল্পও শোনালেন, বালাখানা প্রাসাদের নির্মাণকাজ চলাকালীন, কোনো এক জরুরি কাজে নবাব হুমায়ুন জা-কে নাকি ইংল্যান্ড যেতে হয়েছিল। ইংল্যান্ডে তিনি উঠেছিলেন মহারাণী ভিক্টোরিয়ার বাকিংহাম প্যালেসে। অল্পবয়সী নবাব প্যালেস দেখে মুগ্ধ হয়ে যান, এবং মুর্শিদাবাদে বাকিংহাম প্যালেসের মত একটি প্রাসাদ নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হুমায়ুন জা তাঁর সেই ইচ্ছের কথা একদিন সময় সুযোগ বুঝে রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছেও প্রকাশ করেন, এবং সেই মর্মে মহারাণীর কাছ থেকে একটি লিখিত অনুমতিও চেয়ে নিয়ে আসেন। মুর্শিদাবাদে ফিরেই তিনি বালাখানা প্রাসাদের নির্মাণকার্য বন্ধ করে, বাকিংহাম প্যালেসের আদলে একটি নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করার আদেশ দেন। সেদিনের সেই প্রাসাদটিই নাকি আজকের হাজারদুয়ারি। ... ...
একটা সময় ছিল যখন এই নবাবি কেল্লার জৌলুশ ছিল দেখার মত। কেল্লার প্রধান ফটক থাকত উচ্চ নিরাপত্তায় মোড়া। সেই নিরাপত্তা ভেদ করে কোনও মাছিরও কেল্লার ভেতরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। কেল্লার সেই প্রধান ফটকের পাশেই ছিল নবাবি সেপাইদের বসবাস করার ঘর। ভাগ্যের পরিহাসে আজ সেই ঘরে বসবাস করেন মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুর সৈয়দ মহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা ও তার পরিবার পরিজন। নবাবি আমলে কেল্লায় প্রধান ফটক ‘দক্ষিণ দরজার’ মাথায় থাকত নহবৎখানা। সেখানে নবাবের শাহি বাদকরা সকাল-সন্ধ্যা সানাই বাজাত। সানাই-এর সেই সুর কেল্লা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত দূর-দূরান্তে। আজ সেই দক্ষিণ দরজা অক্ষুণ্ণ থাকলেও, নেই সেই বাদকেরা। শোনা যায় না সানাইয়ের মন মাতানো সেই সুর। ... ...
এই সমাজকে পাল্টাতে হবে। এই শোষণের সাম্রাজ্যকে পাল্টাতে রাজনীতি হচ্ছে পথ। আর কবিতাও এই পাল্টানোর জন্য আমার অন্যতম হাতিয়ার। আর তাছাড়া রাজনীতিকে বাদ দিয়ে ‘মানুষের কবিতা’ লেখা যায় না। মানুষের কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন দ্রোণাচার্যের মত অনেকেই। যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তিমিরের মাস্টারমশাই। ‘আদিমলতা গুল্মময়’ ও ‘বাবরের প্রার্থনা’র কবিতায় এই সব দিনের আভাস আছে। 'কবিতার মুহূর্ত'। সেখানেও শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন— আটষট্টিতে তিমিরের মুখের রেখায় অনেক বদল হয়ে গেছে। শুধু তিমির নয়, অনেক যুবকেরই তখন পাল্টে গেছে আদল, অনেকেরই তখন মনে হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ দেশের মুক্তির পথ, সে-পথে মেতে উঠেছে অনেকের মতো তিমিরও। তারপর একদিন গ্রামে চলে গেছে সে... যাদবপুরের বসতি এলাকার শ্রমিকদের মধ্যে নকশালবাড়ি রাজনীতির আগুন মশালের মতো করে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিমির। তারপর একদিন মালদার গ্রামে চলে যান ভূমিহীন গরিব কৃষকদের কাছে। ... ...
জেরুসালেম থেকে ছড়িয়ে পড়া ইহুদি ইউরোপে এলেন স্পেন পর্তুগালে (সেফারদি) এবং রাইন নদী ধরে আরেক দল (আশকেনাজি) গেলেন উত্তরে। নাগরিক অধিকার বস্তুটি মেলে না। পশ্চিম ইউরোপের নানা দেশের দরজা তাঁদের জন্য বন্ধ। এমন সময়ে পোলিশ রাজা পুণ্যবান বলেস্লাভ আমন্ত্রণ জানালেন - ইহুদিদের দিলেন ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, আপন বিচার ব্যবস্থা, জোর করে ধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধে আইনি সমর্থন (কালিস ঘোষণা ১২৬৪)। পরবর্তী চারশ বছরের পোলিশ লিথুয়ানিয়ান রাজত্বে সকল শাসক ইহুদিদের সে অধিকার সসম্মানে রক্ষা করেছেন। ১৫শ শতকে স্পেনে যখন রাজা ফারদিনান্দ ও রানি ইসাবেলার সাদর উৎসাহে কলম্বাসের কল্পিত ভারত আবিষ্কার আর তার সঙ্গে ইহুদি ধর্মান্তর, সংহার ও বিদায় উৎসব চলছে, নরওয়ে সুইডেনের মতো আলোকিত দেশ গুলি অবধি তাদের প্রবেশাধিকার দেয় নি। পোল্যান্ড লিথুয়ানিয়া তাদের স্বাগত জানিয়েছে। স্বাধীনতা ছিল সীমিত, জীবন ধারণ অত্যন্ত কঠিন কিন্তু এই প্রথম ইউরোপ তাদের খানিকটা মানুষের মর্যাদা দিলো। ... ...
কী আছে নগ্ন নারীদেহে ? সেই আদ্দিকালে লুকাস ক্র্যানাস দ এল্ডার থেকে শুরু করে, টিশিয়ান, এল গ্রেকো, বত্তিচেল্লি, রাফায়েল, দা ভিঞ্চি, মিচেলেঞ্জেলো, সবাই। ভ্যানগগ, মনে, পিকাসো, আমাদের হুসেন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সনাতন দিন্ডা, কে আঁকেননি ন্যুড ? কিন্তু কেন ? সবই কি ঈস্থেটিক ? রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি। যদিও তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে ছবি আঁকাটাকে গায়ের জোরে ঢোকানো হয়েছে। এবার কিছু ব্যোমকেশ ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারা বলল, ছবিটার পোজিশন দেখে প্রত্যয় হচ্ছে, এটা জানলার বাইরে থেকে আঁকা এবং ছবির মডেল ঘরের মধ্যে মাটিতে শুয়ে ছিলেন। এ কাদম্বরী দেবী ছাড়া কেউনা। মডেল ছাড়া ন্যুড হয়না ? ভারতে একজন বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন, কে এইচ আরা। তিনি ন্যুড আঁকতেন, একেবারে রগরগে ন্যুড। বহু পুরষ্কার পেয়েছেন, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রদর্শনী হয়েছে, অথচ তিনি প্রথাগত আঁকার শিক্ষা পাননি, ছিলেন একজন মোটর মেকানিক। একটা ইন্টারভিউ পড়েছিলাম, তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আচ্ছা এত যে ন্যুড আঁকেন, আপনার মডেল হয় কে ? তিনি বললেন, ওমা, এতে আবার মডেল লাগে নাকি, আমি তো চোখ বুজলেই পষ্টো এদের দেখতে পাই। ... ...
মহামারীর প্রাদুর্ভাব নতুন কিছু নয়। বেদ-বাইবেল-পুরাণের যুগ থেকে শুরু করে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে নানান কালান্তক রোগের সংক্রমণ পীড়িত করেছে মানব সভ্যতাকে। দেশ-বিদেশের সমাজ রোগের অভিঘাত মোকাবিলা করেছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি ঘটেছে, তবে তারই পাশাপাশি এলিজাবেথান ইংল্যান্ড বা ঔপনিবেশিক বঙ্গে রোগকে ঘিরে উৎপত্তি হয়েছে কৌতুককর ঘটনার, পাখা মেলেছে মানুষের অন্ধবিশ্বাস, আধিপত্য বিস্তার করতে, চলেছে কৌশলী রাজনীতির খেলা। আর নিরুপায় সাধারণ মানুষ আশ্রয় খুঁজেছে দৈব নির্ভরতায়। পাঁচ পর্বের এই লেখাটিতে মহামারীকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে পাঁচটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। কোথাও যেমন সমকালীন সাহিত্যে তার প্রতিফলন খোঁজা হয়েছে, তেমনি কোথাও আবার উঠে এসেছে রোগের বিচিত্র চিকিৎসা-পদ্ধতি এবং মারী -কেন্দ্রিক রঙ্গ-রসিকতা। ঔপনিবেশিক বঙ্গে জাতীয়তাবোধের উন্মেষের সন্ধান করতে গেলে তারও একটি সূত্র মিলবে দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার আগ্রাসী ছায়া বিস্তারে। আবার কলেরার হানায় ব্রিটিশদের আতঙ্ক প্রকাশ পেয়েছে তিনশ বছর আগে হাওড়া ও কলকাতায় খোদ ব্রিটিশ সওদাগরের অর্থে ওলাবিবির মন্দির গড়ে ওঠার ঘটনায়। আর করোনা আতঙ্ক থেকে বাঁচতে এই একুশ শতকে লৌকিক দেবদেবীর তালিকায় নবতম সংযোজন করোনা মাতা। ... ...
প্রধানমন্ত্রী তখন গুজরাটে। বরাবরের মতোই তিনি দারুন ভাষণ দিচ্ছিলেন। তার আট বছর ধরে করে যাওয়া জাতির সেবাকার্যের প্রশংসা করছিলেন। তিনি বলেন, "আমি আট বছরে ভুল করেও এমন কিছু হতে দিইনি, এমন কিছু করিনি যা আপনাকে বা দেশের কোনো নাগরিকের মাথা নত করাবে"। প্রধানমন্ত্রীর এই মিথ্যেটা আগের সবকটাকে ছাড়িয়ে গেছে। কথাটা শুনে গত আট বছরের আটটি ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ... ...
আমাদের আরো একটি প্রোগ্রাম হল “কম্যুনিটি হেল্থ প্রমোটার”। রেফিউজি হতে হবে। সিটিজেন হলেও রেফিউজি হিসেবে এ দেশে এসেছে এমন মহিলা ইংরেজী পড়তে লিখতে আর বলতে পারলে এই প্রোগ্রামে ঢোকা যায়। ১৮ বছর হতে হবে। ওদেরকে বেসিক ট্রেনিং দেওয়া হয় আর অনেক সাপোর্টিভ কাগজপত্র। মূল উদ্দেশ্য হল কম্যুনিটিকে স্বাস্থ্য সচেতনতার উপকারিতা নিয়ে বলা আর পরামর্শ দেওয়া। এই প্রোগ্রাম আমার হাত দিয়েই শুরু। কঠিন কাজ - কারণ, প্রথমত: ট্রেনিং এর জন্য উপযুক্ত স্পিকার খুঁজে বার করা, ওদের রেজ্যুমে জমা দিয়ে আ্যাপ্রুভ করা, এবং স্পিকাররা কোন সান্মানিক পাবে না। পুরোটাই স্বেচ্ছায় নিজের মূল্যবান সময় কম্যুনিটিকে উৎসর্গ করা। দ্বিতীয়ত: কারা কারা এই প্রোগ্রামের জন্য এলিজেবল। তৃতীয়ত: প্রত্যেক ভাষার একজনকে খুঁজে বের করে রাজী করানো- অনেক কাজ। যথারীতি কোন রোহিঙ্গা মহিলা পেলাম না। ... ...
বিজেপি মানেই পার্মানেন্ট অশান্তি। সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে শ্রেণি চেতনা, মহিলাদের ক্ষমতায়ণ, প্রকৃত ইতিহাসবোধ, বাংলার উদার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। চাকরির সুযোগ সৃষ্টিতে চাই ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের প্রসার, কৃষিনির্ভর গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন। জানালেন সিপিআই(এম-এল)-লিবারেশন দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
মনে পড়ে গেল পরের কথা। বলেই নিই। এখন ফেব্রুয়ারি চলছে। ২১ আসছে। আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা দিবস। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার আগে যত না বাংলাচর্চা ছিল, এখন তা কমেছে। ক্রমশ কমেছে। বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব কম আমাদের এখানে যত সরকার এসেছে, সকলের। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, বা বর্তমান সরকার কেউ বাংলা ভাষাকে আলাদা ভাবে মর্যাদা দেয়নি। ১৯৯৩ সাল ছিল বাংলা ১৪০০ সালের আরম্ভ। নতুন শতাব্দী। আমরা একটি আন্দোলন করেছিলাম, সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার, কলকাতা সহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা স্কুলশিক্ষায় আবশ্যিক করা, বাংলা ভাষাকে দূরদর্শনে হিন্দি ও অন্য ভাষার সম-মর্যাদা দেওয়া। তখন কেবল টিভি আসেনি। দূরদর্শন ভরসা। দূ্রদর্শনে বাংলার সময় কমিয়ে দিয়ে হিন্দির আধিপত্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই আন্দোলনের কথা লিখিত থাকা উচিত। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক আশিস ঘোষ, এবং সমাজকর্মী রতন বসু মজুমদার ছিলেন আন্দোলনের নেতৃত্বে। আমি ছিলাম, আফসার আমেদ ছিলেন, প্রবুদ্ধ মিত্র, কবি গৌতম চৌধুরী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সব নাম এখন আর মনে নেই। ভাষা শহিদ স্মারক সমিতির উদ্যোগে এই আন্দোলন। আমরা দূরদর্শনের সামনে ধর্না দিয়েছিলাম মঞ্চ বেঁধে। স্মারকলিপি প্রদান করেছিলাম। দুই বাংলার শিল্পীদের নিয়ে একটি অপূর্ব অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেখানে আমজাদ আলি সরোদে ‘আজি বাংলা দেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…’ বাজিয়ে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। এই আন্দোলন সমস্ত কলকাতায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমি শিয়ালদা স্টেশনে পথসভায় বক্তৃতা করেছিলাম। আমাদের আন্দোলনের চাপে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তখন আমি আলিপুরে চাকরি করি সদর মহকুমা ভূমিসংস্কার আধিকারিকের দপ্তরে। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (বর্তমান মুখ্যসচিব) ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক, অতিরিক্ত জেলা শাসক ( ভূমি সংস্কার )। । তাঁর একটি অসামান্য গুণ, এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেও একটিও ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করবেন না। তাঁকে দেওয়া হয়েছিল এই কাজের দায়িত্ব। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাঁর সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হতে চাই কি না। যুক্ত হয়েছিলাম। আমাদের প্রথম কাজ ছিল পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্লক অফিসে কত বাংলা টাইপ রাইটার লাগতে পারে এই কাজের জন্য, তা হিসেব করা। কম্পিউটার আসেনি তখন। তারপর পরিভাষা তৈরি। বাংলাদেশে পরিভাষা তৈরি আছে, তার সাহায্য আমরা নিতে পারি। কত মিটিং করেছি আমরা। তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরেও গিয়েছি। তারাপদ রায় তখন ডিরেকটর অফ কালচার। তিনিও পরামর্শ দিতেন। কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজে আমাকে যুক্ত করে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে আদেশনামা বের করতে উদ্যোগী হলেন। এক সকালে অফিসে গিয়ে শুনি এডিএম (এলআর) আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এডিএম (জেলা পরিষদ) করে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ... ...
য়োখেন আমার গভীর সংশয়ের আখ্যান শুনে বললে, জ্ঞান দিও না। .... এই যেমন তোমরা সিটি ব্যাঙ্ক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যোগাড় করে আফ্রিকার ঘানা কোকো বোর্ডকে ধার দিচ্ছ, আর সেটা ফেরত পাচ্ছ কোকো বোর্ডের নেসলে প্রমুখ খ্যাতনামা ইউরোপীয় চকোলেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ঘানা কোকো বোর্ডকে চেনে দুনিয়ার কোন বান্দা? কিন্তু এক বিলিয়ন ডলার দিতে বাজার পিছপা হচ্ছে না – কারণ তারা চেনে নেসলেকে, যারা কোকো থেকে চকোলেট বানায়। কোকো গেছে নেসলের ঘরে। তোমার আমার ছেলেমেয়ের দাঁতের সর্বনাশকারী চকোলেট বেচে তারা ঠিক টাকা দেবে। আমরা সেরকম একটা কিছু করতে চাইছি। ... ...
এই গুলিয়ে ফেলা থেকে আরো বড় বিভ্রান্তি জন্ম নেয়। মধ্য যৌনতায় (খেয়াল করবেন, ‘মধ্যলিঙ্গ’ বলি নি) অবস্থানকারী মানুষরা যেহেতু ‘ট্রান্সজেণ্ডার’ এর অংশ, তাই কেউ কেউ সমকামিতা আর অন্তর্বর্তী লিঙ্গকে একসূত্রে ফেলে দেয়। এদের উৎপাতেই ফেসবুকে ‘গে শি-মেল হিজড়ে’ নামের একাধিক পেজ অবস্থান করছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সমানাধিকার বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা থাকে, কিন্তু সাইটটাকে সাজানো হয় অন্তর্লিঙ্গ মানুষদের ছবি দিয়ে। অন্তর্লিঙ্গ ও সমপ্রেম দুটোই যেহেতু গোঁড়াদের বক্রদৃষ্টির আওতায়, তাই উদারপন্থীরা হিজড়ে ও সমকামীদের এক মঞ্চে বসিয়ে তাঁদের পক্ষে সওয়াল করেন। চেতনা উদযাপক লেখায় অনেকে রূপান্তরিত, রূপান্তরকামী, ইউনাক, অ্যাণ্ড্রোজিনাস, বৃহন্নলা সব্বার কথা লিখে যান। বুঝি যে, তাঁরা দরদ দিয়ে লিখছেন, সমবেদনাও জাগাচ্ছেন পাঠকদের মধ্যে, কিন্তু উল্লিখিত নামগুলোর মধ্যে একের সাথে আরেকের পার্থক্য কিছুই বোঝাতে পারছেন না। ফলে ঠেলাগাড়ির ঠেলা খেয়ে সবাই গিয়ে পড়ছে ‘ট্রান্স’ বর্গে। ... ...
বুড়ি জানে হাতে একটু টাকা রাখতে হয়। এদিকটা না দেখলে হবেনা। গঞ্জনা জুটবে, না খেয়েও মরতে হতে পারে। ক্রয়ক্ষমতাই তো ক্ষমতা এখন! বুড়ি বোঝে। এদিকটা না সামলালে চলবেনা, অরণ্যের জীবন তো আজ আর পাওয়া যাবেনা। তাই সে এটুকু করে। বাদবাকি সবসময় তুমি দেখো, বুড়ি আর প্রকৃতি। বুড়ি যেনো কথা বলে, "কীগো কেমন আছ তোমরা সবাই? আমার মন ভালো নেই। বাঁশবাগানে চ্যাং মাছ নেই। খালে শাল মাছ নেই। প্যাঁচার ডাক শুনতে পাইনা। শেয়ালরা কেউ নেই।" ... ...
টাসমানরা দুটো জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন, একটার নাম জিহান আর অন্যটার নাম হিমসকার্ক যেখানে টাসমান স্বয়ং ছিলেন। এর মধ্যে জিহান নামে জাহাজটি থেকে একটি ছোট নৌকো ডাচরা সমুদ্রে নামিয়ে হিমসকারক জাহাজে নিয়ে এসেছিল, এবার সেটি জিহানের দিকে ফেরত যাবে, এমন সময় আরো তেরো জন মাওরি সম্বলিত আরেকটি নৌকো করে এগিয়ে এসে সজোরে ডাচ নৌকোটিকে ধাক্কা মারে | এর ফলে তিন-চারজন ডাচ নাবিকের মৃত্যু হয়। ডাচরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ গুলি গোলা ছোঁড়ে, তবে তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। মাওরিরা একটি মৃতদেহ নৌকোয় তুলে ফেরৎ যায়। মাইকেল কিং পেঙ্গুইন হিস্ট্রি অফ নিউজিল্যাণ্ডে লিখেছেন মাওরিরা তাদের মানা অনুযায়ী, যেকালে পরাজিত সৈনিকদের মেরে ফেলে খেয়ে নেওয়াই তাদের রীতি রেওয়াজ, খুব সম্ভবত এই মৃত ডাচটিকে রান্না করে তাই খেয়ে ফেলে থাকবে। ... ...
চৌমাথার মোড়ে কে আগে দাঁড়াবে মেঘ না বাস- মনে মনে বাজি রাখতে রাখতে সিগ্নাল লাল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল পঙ্কজ । সেই সময় উল্টো দিক থেকে জোর হাওয়া উঠল- ধুলো, ভাজা সসেজের গন্ধ, টিউব রেল স্টেশনের চত্ত্বরের চিনে বৃদ্ধর ছড় টানা যন্ত্রের সুর শঙ্কুর মত পাক খেতে খেতে পঙ্কজকে ঘিরে নিল; মেঘের পাল টার্ন নিল সম্পূর্ণ বিপরীতে। বাসগুলো আচমকা ওয়াক ওভার পেয়ে সিগন্যালে পা ছেতরে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর ম্যাজিক শব্দটা মুহূর্তে পঙ্কজের মনে ঢুকে তার শাখাপ্রশাখা ছড়াল; এই ক্রসিং থেকে যেমন একটা রাস্তা ডাউনে গিয়েছে, অন্যটা আপে; পঙ্কজের মগজের মধ্যে মুহূর্তে একটা রাস্তা বহু বছর আগের সাহেবগলিতে বাঁক নিয়ে ঢুকল। ... ...
অনেক রোগী খুপরিতে ঢুকে প্রথমেই স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু-চার ফোঁটা তরল বসার চেয়ার, আমার টেবিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আজ এক ভদ্রমহিলা গঙ্গাজল এর মত আমার গায়ে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলেন। মানে চেয়ার-টেবিলের সাথে তিনি ডাক্তারকেও স্যানিটাইজ করে নিলেন। ওদিকে রোগীর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। জ্বর আসলেই এখন অনেকে গন্ধ শুঁকছেন। একজন বললেন, 'ডাক্তারবাবু, খাবার-দাবারের গন্ধ পাচ্ছি না। কিন্তু ডেটলের গন্ধ, ডেনড্রাইটের গন্ধ এগুলো দিব্যি পাচ্ছি।' একজন রোগী দুদিন আগেই দেখিয়ে গেছেন। জ্বর কমছে না। আবার এসেছেন। তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন পুরো সাদা। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'এ কি? আমি কোন ওষুধপত্র লিখিনি নাকি?' উনি বিব্রত মুখে জানালেন, 'হ্যাঁ লিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করতেই সব লেখা উবে গেছে।' ... ...
তাদের রান্নাঘরেও আম ঢুকে পড়ল। কাচ্চে আমকা ক্ষীর তার মধ্যে একটি। আমের মরশুমে সকাল সন্ধে রাত সবসময় আম খেতে কোনো আপত্তি নেই তাদের। শেহেরয়ালি রন্ধন খুবই জমকালো। নিরামিষ। শুদ্ধ শাকাহারী। বৈচিত্র্যে ভরপুর। জাফরান, গোলাপজল, বাদাম পেস্তার দরাজ ব্যবহার। গোলাপজলের মিঠে সুবাস জড়িয়ে থাকবে প্রায় সব খাবারেই। আর হ্যাঁ, ওদের রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল বাংলার পাঁচফোড়ন। আর পিঠা। বাংলার পিঠে। পেটে খেলে পিঠে সয়! ওদের পেটে সয়ে গিয়েছিল মোচা আর কদবেলও। শেহেরওয়ালিরা রাজস্থানি উর্দু হিন্দি ভাঙা বাংলা মিশিয়ে কথা বলত। জল বই গাছ তরকারি এইসব বাংলা শব্দ ওদের কথায় পাওয়া যাবে। ... ...
অভিবাদন করে বিদুর বেরিয়ে যান। বাইরে রাত গভীর হয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় কিছুক্ষণ আপন ভাবনার মধ্যে ডুবে গেছিলেন। চটক ভাঙলো কতগুলো পাখির ডাকে। সম্ভবত তারা আক্রান্ত। হয় বাসায় সাপ উঠেছে অথবা প্যাঁচা। কান পাতলেন তিনি। না, পেঁচা না। কারণ তার কোনো শব্দ শোনেননি তিনি। তাহলে সাপ। এখানে অজগরের উপদ্রব বেশি তা তিনি জানেন। শব্দহীন অমেরুদন্ডীটি আততায়ী হিসেবে অত্যন্ত নির্মম। একদম সামনে হাজির না হলে সে যে এসেছে তাই জানা যায় না। প্রকৃতিগতভাবে পাখিগুলি দুর্বল, আর অজগর শক্তিমান। পাখীদের কলরব বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত হচ্ছে। একবার ইচ্ছে হল বাইরে বেরিয়ে দ্যাখেন যদি কিছু করতে পারেন। তারপরে গাভালগণ চলে এলেন জানালা থেকে। প্রকৃতি নিত্য নির্মমতার রাজ্য। তিনি মাথা নাড়লেন। যার যার জীবনের নিরাপত্তা মূলত তার তার হাতেই। তাকেই শিখতে হবে নিরাপদ হতে। নতুবা...! ... ...
কয়েকশ বছর সুখে কাটল, তৈরি হল সলমনের মন্দির। কপালে শান্তি নেই, মন্দির ভাঙলেন নতুন রাজা, ইহুদিরা নির্বাসিত হলেন ব্যাবিলনে (আজকের ইরাক)। ঘরে ফেরার অনুমতি পেলেন আরেক সহৃদয় পারসিক রাজার কাছ থেকে। আবার গড়লেন দ্বিতীয় মন্দির। তারপরে জুডিয়াতে রোমান রাজত্ব, বিদ্রোহ। পুনর্বার বিধ্বস্ত হল মন্দির যার পশ্চিম দেয়ালটুকু এখনো দাঁড়িয়ে আছে, যার নাম ক্রন্দনের প্রাচীর (ওয়েলিং ওয়াল / ক্লাগে মাউয়ার)। জেরুসালেমে ইহুদির প্রবেশ নিষিদ্ধ। অতএব আবার পোঁটলা বাঁধো। পথে এবার নামো সাথী। ... ...
সেই শুরু। তারপরে দীর্ঘ্য সময় গর্গ ভ্রমণ করেছেন মথুরা রাজ্যের প্রতিটি অংশ। যাদবদের রাজনীতি কেন্দ্রীভূত ছিল গণসভার অস্তিত্বের মধ্যে। সেই অস্তিত্বকে যখন কংস উপড়ে ফেলে দিল, রাজা উগ্রসেনকে বন্দী করলো, বন্দী করলো নিজ ভগিনী দেবকী এবং বান্ধব বসুদেবকে তখন মথুরা নগরে কোনো বিরোধী কেন্দ্র রইলো না। কংস ভেবেছিল বসুদেব তাকে সমর্থন করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়। এই সূত্রটা ধরলেন গর্গ। বসুদেবের মিত্রতা ছিল গোপেদের সঙ্গেও। সে বৈষ্ণবদের ‘বাসুদেব’ হতে চলেছে তখন এবং গোপেরা মূলত বৈষ্ণব। তাছাড়া সে স্বভাব বশতই মিষ্টভাষী। শ্বশুর উগ্রসেন রাজা থাকাকালীন গোপেদের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রতিনিধিত্ব সেই করতো মথুরাপুরে। প্রথমে গর্গ গোপেদের মধ্যে নিজের অবস্থান শক্ত করলেন। কণাদের পরমাণুবাদ ছাড়লেন। নিজেকে রূপান্তরিত করলেন বৈষ্ণবে। একমাত্র ধর্মই সমাজকে চালনাকারী রাজশক্তির সমকক্ষ হতে পারে। আর সেই ধর্ম বেদ, ন্যায়, সাংখ্য এ সব দিয়ে চললে হবে না। ধর্মের জনপ্রিয়তা ও শক্তির মূল ভিত্তি যে মানুষ তার কাছে সহজ হতে হবে ধর্মকে। বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে আছে সে বীজ। তাই পরিবর্তিত গর্গ বৈষ্ণব হলেন। তারপরে মথুরাপুরে খুঁজে বের করলেন কংস বিরোধী গণসভ্যদের। দ্বিতীয় কাজে তাঁর সাহায্য করেছেন কদম। যেহেতু কংসের নজর বেশী থাকবে গর্গের উপরে, তাই তিনি রাজধানীতে আসতেন না। আসতো কদম। অক্রুর, পৌল সাত্যকীরা ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছেন একমাত্র উপায় অভ্যুত্থান। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান হওয়া অসম্ভব। কংস নিজের হাতে রেখেছে সৈন্যবাহিনীকে। তাদের প্রতিপালনে সে যথেষ্ট মনোযোগীও। সাধারণ মানুষ সেই বাহিনীর সঙ্গে সমরবিদ্যায় পেরে উঠবে না। তাহলে? রাস্তা ছিল একটাই। কংসের দম্ভকে কাজে লাগানো। ঠিক সেই কাজটাই হয়েছে। ... ...