আমার একটা বিশ্বাস আছে। তাকে আমি সত্য মনে করি। সত্য আপেক্ষিক হলেও, এই সত্যে পৌঁছতে পেরেছি আমি। একে ধরে থাকি। ক্ষমতাকে মনে করি অন্ধকারের পথে যাত্রা। ছিল না, তাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছি হয়ত। সিভিল সার্ভিসে না যাওয়াও তাই হয়ত। ধ্রুবপুত্র উপন্যাস এই কথাই বলেছে শেষ পর্যন্ত। বুদ্ধের দর্শন তাইই ছিল। নিজেকে নিঃশেষ করতে করতে, শূন্যের কাছে আত্মসমর্পণ। ‘হে নবীন সন্ন্যাসী’ উপন্যাসটি সেই কথা বলতে চেয়েছে। আমি কলহ করি। সুনাম আছে। কিন্তু যখন বুঝি ভুল হয়েছে, আবার এগিয়ে যাই। হে বন্ধু, কাছে এস, হাত ধরো। বন্ধুদের অনেকে ফেরে। ফেরেও না দেখেছি। না ফিরে অপমানও করেছে সত্য। ... ...
দিন যায়, কাল যায়। ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে। চোখের ভুল সবটাই। কেউই যায়না কোত্থাও। দিন, মাস, বছর, জীবন, জোয়ার, ভাঁটা। সবকিছু চোখের ভুল। মনের ভুল। অন্ধ মানুষ কী দেখে কী ভাবে। হয় এক, মানুষগুলো বোঝে আরেক। বোকা মানুষ সব। বোকা নাহলে কেউ সুখ খোঁজে? সুখ জিনিষটা কিনতে প্রচুর দাম দিতে হয়। এমনি এমনিইই পাওয়া যাবেনা কিছুতেই। অ-নে-ক দাম। অথচ মজা এমন, যা দিয়ে তুমি দাম দেবে সেই জিনিষটা মিনিমাগনায় সারাক্ষণ এসে পড়ছে তোমার কাছে। সুখ কিনতে হয় দুঃখ দিয়ে। যন্ত্রনা দিয়েও পাওয়া যায়। কান্না দিয়ে। সেগুলো বিনি পয়সায় ঢের করে পাবে তুমি। নিয়ে যেও সুখ কিনতে। যদি সে বাজারের ঠিকানা জানা থাকে। দুঃখ এসে ওর সব কিছু উজাড় করে দেয় আমার কাছে। নিঃশেষে। আমার শরীর, মন, সত্বা, তারও আড়ালে আরো যা কিছু অদেখা হয়ে রয়েছে, সব কানায় কানায় ভরিয়ে দেয় দুঃখ। অকূল দুঃখ। আকূল। ... ...
রবিবুড়োর ডাকঘর থেকে একটা ছোট অংশ ছিল আমাদের পাঠ্যবইয়ে, অমল ও দইওআলা শিরোনামে। দিদিমণিরা সেটাই বেছে নিলেন মঞ্চস্থ করার জন্য। সম্ভবত: প্রচুর পটর-পটর করার যোগ্যতায় আমি মনোনীত হলাম অমল-এর ভূমিকায়। চতুর্থ শ্রেণীর এক শ্রীমান হল দইওআলা।সেই প্রথম জেনেছিলাম রিহার্সাল কাকে বলে। শেষ ক্লাস-এর পরে শুরু হত। ভাল লাগত, তবে একটু ক্লান্ত হয়ে যেতাম – আমার তো কবে সব মুখস্ত হয়ে গেছে, ভাব ভঙ্গী সহ! দিদিমণিরা মাঝে মাঝে আলোচনা করতেন কেমন করে মঞ্চসজ্জা করলে বা আর কি কি করলে নাটকটা একেবারে সত্যির মত করে তোলা যায়। সেই সব কিছু কিছু শুনে আমার ধারণা হয়েছিল যে আসল অনুষ্ঠানের দিন আমাকে দইওআলা ছেলেটির হাত দিয়ে একটা সত্যি দই-য়ের ভাঁড় দেওয়া হবে। আমার কাছে নাটকের আসল আকর্ষণ ছিল সেটা এবং সেই নিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব উৎফুল্ল থাকতাম। ... ...
দানিশ বারবার বলেন, জীবন বিপন্ন করে তিনি ছবি তুলতে চান না। এমনকি আহত হওয়ার বিনিময়েও একটা ভালো ছবি তুলতে চান না। বলেন, একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাংবাদিক জানেন কীভাবে কনফ্লিক্ট জোন কভার করতে হয় নিজেকে বাঁচিয়ে। বন্দুক তাক করা উগ্র হিন্দুত্ববাদীর সামনে অনভিজ্ঞ সাংবাদিকরা ভুল করে চলে গেলে তিনি তাদের সরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন, অসাধারণ এবং আর এস এস সন্ত্রাসের মুখ হয়ে ওঠা সেই ছবিটি তোলার থেকেও অক্ষত থাকা ও রাখাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি সবসময় নিজেকে ভয় পেতে শেখান, নইলে কখন এমন কিছু করে ফেলবেন যাতে শারীরীক ক্ষতি হবে। বলেছেন, তিনি যে অতিমানব নন, এটা নিজেকে ভুলতে দেননি কোনদিন। তাহলে কি ধরে নেব যে গড়পড়তা স্বার্থপর সংসারী মানুষের থেকে দানিশ সিদ্দিকি আলাদা কেউ নন? কিন্তু তাহলে দানিশের কর্মজীবনের প্রধান অ্যাসাইনমেন্টগুলো হিসেবে আঁটানো যাবেনা, যার মধ্যে মোসুলের যুদ্ধ, রোহিঙ্গা ক্রাইসিস, দিল্লির মব লিঞ্চিং, শ্রীলংকার বিস্ফোরণ এবং আফগানিস্তানের তালিবান আর আফগান সেনা সংঘর্ষ আছে। ... ...
মস্কোর বয়েস ন’শ’ বছর। মাত্তর ১৮ শতকে জার পিটার দি গ্রেট এই ভুঁইফোড় শহরটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম নাম সাঙট-পিটার-বুর্খ (ডাচ)। জার্মান প্রভাবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় সাঙট পেটার্সবুর্গ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান শব্দ ব্যবহার জনবিরোধী বিবেচিত হল। নাম বদলে পেত্রগ্রাদ – পিটারের গড়! এই সময় ব্রিটেনেও দু’টি নামের পরিবর্তন হয় একই কারণে। লর্ড বাটেনবের্গ (ফ্রাঙ্কফুর্টের অনতিদূরের গ্রাম) হলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন (বের্গ = পাহাড় = মাউন্ট: বাটেন হল ব্যাটেন)। ব্রিটিশ রাজপরিবারের পরিচয় হাউস অফ হানোভার (জার্মান শহর, যেখান থেকে রাজা জর্জকে খুঁজে এনে সিংহাসনে বসানো হয় ১৮ শতাব্দীতে – পরবর্তী ছয় রাজার ধমনিতে ছিল জার্মান রাজরক্ত, প্রত্যেকে জার্মান বলেছেন) বদলে হাউস অফ উইনডসর। সহজ ব্যবস্থা। জার্মানির সঙ্গে যখন লড়াই চলছে, পিতৃপুরুষের নাম বদলে ইংরেজ সাজাটাই তো বাঞ্ছনীয়। ... ...
গোলেনুর দাদীর ডাকে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই নাকে ধাক্কা দেয় বেশ অপরিচিত একটি ঘ্রাণ। উনুনের গনগনে আগুনের পাশে গোলেনুর দাদীর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কালো লোহাড় কড়াইয়ের বলক আসা জলে ডুমো করা কাটা ওলকচু ফেলেই গোলেনুর দাদী আমার দিকে এগিয়ে আসে। ঠাকুমার জন্য কয়েকটা কাঁচামিঠা আম রাখছি, নিইয়্যা যাস। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে গোলেনুর দাদীর ঘর লাগোয়া আমগাছটার দিকে তাকাই। আমার চোখ আটকে যায় বারান্দায় জলচৌকিতে বসে থাকা মানুষটার সাথে। লম্বা জোব্বা পড়া মানুষটির দাড়িগুলো কী সুন্দর মেহেদী রঙা। লোকটির পাশে বসে সুমী পোড়াদহের গল্প শুনছে, জানো বু' পোড়াদহে কত্ত বড় মেলা হয়? কত্তরকমের মিষ্টি পাওয়া যায়, জানো? সেসব মিষ্টি কত্ত বড় হয় দেখবা? দু'হাত প্রসারিত করে মানুষটি দেখায় মিষ্টির বিশালতা। দাদাজান, পুতুল পাওয়া যায় না? বড়-কনে পুতুল? ... ...
এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়। সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। ... ...
২০১৪ সালের অক্টোবর নাগাদ তুরস্কে যখন যাই তখনও ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠেনি। যদিও দক্ষিণ পূর্ব সীমায় অবস্থিত নিমরুত পাহাড় থেকে পাঁচ ছ ঘন্টার মধ্যে এসে পড়েছে আইসিস, সীমান্তে জোর যুদ্ধ চলছে। আমাদের শেষ পর্যন্ত আর নিমরুত অবধি যাওয়া হয়নি, যুদ্ধ কাঁটাতার টপকে এদিকে চলে আসতে পারে এই আশঙ্কায়। উষ্ণ প্রশ্রবণ আর চোখ ধাঁধানো পুরাতত্ত্বের পামুক্কালে থেকে দিনভর গাড়িতে মৌলানা জালালুদ্দীন রুমির স্মৃতিবিজড়িত কোনিয়া যাওয়ার পথে এক গ্রামে গাড়ি দাঁড়ালে হঠাৎ করেই চোখে পড়েছিলো পথের পাশে বইয়ের দোকান। সেখানে মোল্লা নাসিরুদ্দীন (তূর্কীতে নাসিরুদ্দীন হোজা) তাঁর প্রিয় গাধার পিঠে চেপে বইয়ের মলাটে হাজির। আকসাহির বলে যে ছোট শহরে তাঁর মৃত্যু হয় ও সমাধি, তার খুব কাছে এসে পড়েছি আমরা। নাসিরুদ্দীন এমন এক চরিত্র, যাঁর মধ্যে ইতিহাস ও কিংবদন্তী মিলেমিশে এমনভাবে জট পাকিয়ে আছে যে একটার থেকে অন্যটা আলাদা করা যায়্না। ... ...
এই চ্যানেলেও তাঁর টেকার এটাই রহস্য। এই যে তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমে তাতে তাঁর মাথা বন্ধ নেই। ঘুমের মধ্যেও তিনি দেখে চলেছেন যে ওপরের কোনো একটা ঘরে মিটিং হচ্ছে। সেখানে বসে নিত্যপ্রিয় তাঁকে খুব খিস্তি করছে। বলা বাহুল্য নিত্যপ্রিয়ই তাঁকে ‘সমকাল’ পত্রিকা থেকে এখানে এনেছিল। সেখানে থাকাকালীন নিত্যপ্রিয় ও তিনি একই লবিতেও ছিলেন। সম্পাদক-মালিক ছিল বীতশোক ঘোষ। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর, বীতশোক আর নিত্যপ্রিয়র। বীতশোক যত যত মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তত তত তাঁদের দূরত্ব বেড়েছে। বীতশোক অবশ্য যখন আজকের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তখন তিনি মন্ত্রীসভায় এক সদস্য মাত্র এবং কোণঠাসা। তার কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবেন মন্ত্রীত্ব। তারপরে একদিন ফিরেও আসবেন। আবার মন্ত্রী হবেন। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী যত অসুস্থ হতে থাকবেন, এনার গুরুত্ব বাড়তে থাকবে। বীতশোকও রাজ্য-রাজনীতিতে মাতব্বর হবেন। ভুলে যাবেন এককালে তিনি, নিত্যপ্রিয় ও অমানিশ একসঙ্গে রাত্রে ফিরতেন এক গাড়িতে। তখন অবশ্য নিত্যপ্রিয় আর বীতশোক দুজনই বেকার। নিত্যপ্রিয় বৌ-এর স্কুল মাস্টারির টাকায় মদ খেয়ে বেড়ায়। কিন্তু স্কুল মাস্টারির টাকা কম বলে নিত্যর সঙ্গী তখন বাংলা। বীতশোকের স্ত্রী অধ্যাপিকা। ফলে বীতশোক বিদেশী মদ তখনো খেতেন। এবং নানা সময়েই নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির হতেন সন্ধেটা কোনো রকমে কাটাতে। প্রতিদিন পাবে গেলে অনেকটা টাকা যায়। এমনই এক অনুষ্ঠানে নিত্যপ্রিয়র সঙ্গে নতুন করে সখ্যতা। বীতশোককে মদ খাওয়ার পরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা নিতে নিত্যপ্রিয়র কোনো সমস্যা ছিল না। বিদেশী মদ এবং সঙ্গের চাট জুটলে সে জুতোও পরিয়ে দিতে পারে। প্রেস ক্লাবে মদ সস্তা এবং সেই খেতে ও আরো নানা জটিল ইক্যুয়েশন কশতে দুজনেই যেতেন সেখানে। প্রেস ক্লাব থেকে অমানিশের পত্রিকার রাত্রের গাড়িতে তিনজনে ফিরতেন বেশিরভাগ দিন। ... ...
আগাথা ক্রিস্টির মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার নান—যা থেকে হিন্দি ছবি গুমনাম—এর পরেই সবচেয়ে জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস) যাঁরা পড়েছেন, অবিলম্বে এই দৃশ্যটি চিনতে পারবেন। প্রথম চলচ্চিত্র ভার্শনটি (১৯৭৪) দেখেছিলাম—তাতে মেগাস্টার কাস্ট: আলবার্ট ফিনি (যাঁকে আগাথা ক্রিস্টি এরকিউল পোয়ারোর চরিত্রে একেবারে পছন্দ করেননি), শন কোনারি, জন গিয়েলগুড, ইনগ্রিড বেরগমান, ভেনেসা রেডগ্রেভ, জ্যাকেলিন বিসে এবং আরও অনেকে। পরে জেনেছি গার দে লেস্ত, প্যারিস থেকে বাইশশো কিলোমিটার দূরের ইস্তানবুলগামী ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ইউরোপের পয়লা দূরপাল্লার ট্রেন। সময় লাগত তিন দিন। সেকালে খুব কম ট্রেন তার আপন দেশের গণ্ডির বাইরে গিয়ে স্টিমের ধোঁয়া ছেড়েছে। ... ...
জামুকে দেখলে টুনুর মনে হয় ইতিহাস বইয়ের খানিক টুকরো যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। কতরকম অজানা সব গল্প যে বলে। সরলা নেমে দেখেন ছেলে বেশ পরিস্কার শার্ট প্যান্ট পরে ভব্যিযুক্ত হয়ে এসেছে। খাবার বেড়ে সামনে বসে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলেন এও আজ একটু অন্যমনস্ক। হুঁ, হাঞ্জি আর ঘাড় নেড়েই কাজ চালাচ্ছে। ওর হিন্দিবাংলা মেশানো তড়বড়ে কথা আজ নেই। খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে, থালা গেলাস মেজে ধুয়ে রেখে কিছু কাজ আছে কিনা জিগ্যেস করে তারপর ইতস্তত ভাবে জানায় ওর একটা আর্জি আছে মা’জির কাছে। ঢোলা শার্টের পকেটে হাত গলিয়ে তুলে আনে একটা কাগজে মোড়া পাতলা কি যেন। ঐ জিনিষটা সে সরলার কাছে রেখে যেতে চায়, ওর থাকার কোন ঠিক নেই, এটা আরেকজনের জিম্মা করা জিনিষ, চুরি হয়ে গেলে উপরওলার কাছে অপরাধী হয়ে যাবে জামু। সরলা বলেন যার জিনিষ তাকেই দিয়ে দিলে তো হয়। জামু নাকি জানেই না সে মানুষ কোথায়। আবার ওর মুখ থমথমে হয়ে যায়, চোখদুটো কেমন অচেনা। ... ...
আমরা তো কাজ করতাম কোম্পানি থেকে দূরে। জঙ্গল পাহাড়ের ভিতর। ওইসব কোম্পানির ব্যাপার। কোম্পানি বডি নিয়ে কি করবে, বডি পাঠাবে কিনা, সেসব খবর আমাদের কাছে আসত না। কে খবর দেবে! আমরা তো বোরিং করার জন্য ঘুরছি। শ্মশান মশান কোনও বাছাবাছি নেই। গু মুত যা থাক! যেইখানে বোরিং করে বোম ফাটিয়ে তেল আছে জানতে পারবে আমাদের সেইখানেই থাকতে হবে। কোম্পানির লোক যেখানে থাকতে হবে বলেছে, সেইখানে একটু পরিষ্কার করে জঙ্গল কেটে সাপ কোপ মেরে তাম্বু টানিয়ে থেকে গেছি। দু হাজার কুড়ির বাইশে মার্চ ওরা শ্মশানে জঙ্গলে পাহাড়ের ঠিক কোন খাঁড়াইতে ছিল সে জায়গার নাম ওদের জানা হয়নি। ওই জঙ্গল পাহাড় থেকে দূরে টি ভি চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা গেল। ঘোষণা হল লকডাউন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, যে যেখানে আছেন সে সেখানেই থাকুন। খবর হল সারা দেশের ট্রেন বাস বর্ডার সবকিছু বন্ধ হল একুশ দিনের জন্য। ... ...
সেই ছোট থেকেই একটা রেটরিকাল প্রশ্ন শুনে আসছি - ন্যাড়া বেলতলায় যায় কবার? এসক্যাম্ব্রিয়ন সমুদ্রতটে পৌঁছে প্রশ্নটা মর্মে এসে বিঁধলো। বিশাল সমুদ্রতট, সাদা বালি দিয়ে ঢাকা। সমুদ্র যত নয়নাভিরাম, ততই ভীতিপ্রদ। জায়গায় জায়গায় বেজায় ঢেউ, দুয়েকজন সার্ফিং করছেও দেখা গেল। তার ওপরে দেখলাম বিস্তর লোক, প্রায় কার্নিভ্যালের মত আবহাওয়া। দিনটা শুক্র বা শনিবার নয়, সম্ভবত বুধবার। এত লোকের কি কোন কাজ নেই, কি জ্বালা ! মনটা দমে গেল, মানসচক্ষে দেখতে পেলাম আমায় খাবি খাওয়া অবস্থায় জল থেকে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে, তীরের লোকেরা হেসে খুন। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দেখলাম স্নরকেলিং এর বাকি সদস্যদের। ... ...
তাঁদের বড় আনন্দের দিন আজ। তাঁদের হাসির দমকে রাস্তার গাছপালা কেঁপে ওঠে। বাসায় ঘুমন্ত পাখি চমকে জেগে ডানা ঝাপ্টায়। একা তাঈর শুধু চুপচাপ। তাঁর মুখে আজ হাসি ফুটছে না। ডানহাত খুইয়েছেন বটে, কিন্তু যুদ্ধের দেবতা অঙ্গহানির পরোয়া করেন না। হাতের থেকে অনেক গভীরে আরো বড় এক ক্ষত থেকে অবিরত তাঁর রক্ত ঝরছে। তাঈরের গলার কাছে ব্যথা করতে থাকে। ... ...
শাসককুল? আচ্ছা, এ নিয়ে তাঁর কেন মাথাব্যথা হবে? তিনি কে? তিনি তো সামান্য রাজভৃত্য মাত্র! মাতা সত্যবতী যখন যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন কি তাঁকে বলেছেন যাওয়া উচিত হবে কিনা? তাঁকে ডেকে শুধু যাবার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে মাত্র। ব্যাস! তাহলে? তিনি এবং প্রাসাদের কঞ্চুকী প্রধানের মধ্যে পার্থক্য কি? ক্লান্ত, শ্রান্ত একজন মানুষ তিনি। লোকে বলে এই প্রাসাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম আনুগত্য। না। এটা লোকের ভুল ধারণা। তাঁর আনুগত্য তাঁর শপথের কাছে। এই বংশকে তিনি অনেককাল আগেই ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বোধ তাঁকে বাধা দিয়েছে। একের পর এক বিপর্যয় সঙ্গী হয়েছে কুরুবংশের। কোনো সময়েই শাসনকে স্থায়ী এবং বিপর্যয়মুক্ত দেখেননি তিনি। চলে যেতেই পারতেন! কিন্তু মন বলেছে এভাবে চলে গেলে লোকে বলবে দেবব্রত রাজ্য শাসন করার সুযোগ পায়নি বলে চলে গেল। পিতার জন্য স্বার্থত্যাগ করা থেকে যে ফাঁদ শুরু হয়েছে সেই ফাঁদেই তিনি বন্দী হয়ে পড়েছেন। কোনোদিন ভাবতেই পারেননি কি এই লোকসমাজ? কী ভূমিকা আছে এর? তাঁর জীবন কেমন করে চলবে তা এ নির্ধারণ করার সাহস পায় কোথা থেকে? এসব কিছুই তিনি কখনো ভেবে উঠতেই পারেননি। অথচ তিনি যেমন শান্তনুর সন্তান তেমনই তিনি তো গঙ্গারও সন্তান। তাহলে মায়ের চরিত্রের স্বাধীনতা বোধ কেন তাঁর এল না? এ প্রশ্ন আজ এতবছর পরে এসেছে তাঁর মনে! আবারও যখন ব্যাস তাঁর সাহয্য চাইছেন কুরুবংশকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তখন তিনি ভাবতে বসেছেন। ... ...
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরো টুকরো হয়েছে। একদা এই পনেরোটি রিপাবলিকের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল রাশিয়ান। কালিনিনগ্রাদে যখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, পুবে দিওমেদ দ্বীপে তখন পরের দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা – সর্বত্র ভাষা এক। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া থেকে কাজাখ অবদি সবার নিজস্ব ভাষা আছে, ছিল। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় রাশিয়ান। নইলে রাজ্য শাসন অসম্ভব। যেমন আমাদের শাসকরা চাপিয়েছিলেন ইংরেজি, সেটিকে আমরা আঁকড়ে ধরেছি। বাইরের জগতের পাসপোর্ট এটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে রবার্ট ক্লাইভকে হারাতে পারলে ফরাসি আমাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হত! ... ...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুরমানসকের ভূমিকা বিশাল। জার্মানদের রাশিয়া আক্রমণের পর এই বন্দর দিয়েই মিত্র শক্তি সাহায্য পাঠাতে থাকেন। লেনিনগ্রাদ ও স্টালিনগ্রাদের মত মুরমানসক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি হিরো সিটি বা বীর শহর নামে পরিচিত। শহরের প্রায় চুড়োয় একটি বিশাল মূর্তি আছে, তার নাম আলইশা। সেটি সেই সংগ্রামের স্মারক। নিচের কোলা উপসাগরে বরফ ভেঙে সমুদ্রপথ পরিষ্কার করার প্রথম আণবিক শক্তি চালিত জাহাজ “লেনিন” বন্দরে নোঙর করা আছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অনেক বরফের দেয়াল খনন করে ১৯৮৯ সালে লেনিন এখানে বিশ্রান্তি গ্রহণ করেছে। এতটা উত্তরে এলে সারা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন মনে হয়! সেটি হয়তো সঠিক নয়। আলইশা স্ট্যাচুর পদতলে দাঁড়িয়ে কল্পনাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলে মনে মনে হয়তো অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় – এই তো সামনে কোলা উপসাগর, সেটি গিয়ে মিশেছে বারেনট সাগরে। সেখান থেকে একটু বাঁয়ে ঘুরলেই কানাডার সমুদ্রপথ। বছরে অন্তত পাঁচ মাস খোলা থাকে। এর নাম সুমেরু সেতু। মালবাহী জাহাজ যেতে পারে চার হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ম্যানিটোবার চার্চিল বন্দরে। আর খাড়া উত্তরে গেলে মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে উত্তর মেরু। পা আরেকটু বাড়ালেই তো খাঁটি উত্তর বা ট্রু নর্থ! ... ...
পুরকাইতদার স্কুলের দোতালায় আড্ডা জমে উঠলো। দেশ, সমাজ, নোটবাতিল, গোরক্ষার পাশাপাশি ফেসবুকের বিভিন্ন মানুষ আলোচনায় উঠে আসতে লাগলেন। পুরকাইতদা শুধু ভোজনরসিক নন, কিংবা চরম অতিথিবৎসল বললেই তাঁর মূল্যায়ন সম্পূর্ণ হয় না। ক্রমশ ‘সামসুদ্দিন পুরকাইত’ সাহেবের কর্মকান্ডের আঁচ পাওয়া গেলো। বেশ কিছু বছর আগে বাচ্চাদের স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন পুরকাইতদা। কিন্তু পর্যাপ্ত পয়সার অভাবে তা বাস্তবায়িত হতে পারছিলো না। এমন সময় দেবী লক্ষ্মীর মতো নিজের বিয়ের গহনা বন্ধক দিয়ে স্বামীর হাতে পয়সা তুলে দিয়েছিলেন পুরকাইতভাবী। সেই সুমহান সিদ্ধান্তের ফসল এই স্কুল। স্কুলঘরের দোতালায় বসে কথাগুলো বলতে বলতে পুরকাইতদার চোখে কিছু করতে পারার পরম তৃপ্তির জলকণা চিকচিক করে উঠছিলো। আচমকা ফ্যাকাসে হাসি সহযোগে বলে উঠলেন - “এই যে স্কুল, আপনাদের ভাবী ছাড়া সম্ভব হতো না। ... ...
বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা। ... ...