মন দিয়ে শুনছেন যে শ্রোতা তিনি হয়তো এই কবিতায় দুটি বিসংবাদী সুর শুনে চমকে উঠছেন! আজ্ঞার সুর যে এখানে বড়ো বেশি প্রকট এবং সুতীব্র, আবার কাতর কণ্ঠের কোমল সুরও। পরস্পরবিরোধী সুর সব, কবি শঙ্খ ঘোষের এমনই কাব্যরীতি যে এই দুই অতি ভিন্ন সুরের মেলবন্ধনেই তিনি রচনা করে চলেছেন এক অনবদ্য রাগিণী— যেন পাঠকের কাছে পেশ করছেন কোনো সিম্ফনি। ... ...
কুঁদলি/কুঁদরি/তলি, নোনা এইসব ছিল প্রান্তিক মানুষ, কুড়ানিদের খাবার। এখানে ওখানে যারা অস্থায়ী সংসার পেতে থাকত। কয়েকজন বা একা। চট বা মাদুরে জড়ান সংসার পাতত, মাটির ছোট উনুন তুলে কদিন রেঁধে বেড়ে খেত, আবার চলে যেত। হাট থেকে কুড়ানো সবজি ফল, ছাঁট। এখান ওখান থেকে সংগ্রহ করা মেটে আলু, ডুমুর, ওল, নোনা, কচু, হরেক রকম শাক, গুগলি, কাঁকড়া এসব দিয়ে তাদের খাবার তৈরি হতো। ভাতে ভাত সেদ্ধ অথবা সব মিলিয়ে একটা ঝোল। ... ...
কেন, দূরত্বের প্রশ্নে এতো বিস্ময় সৃষ্টি হলো কেন? মার্কনির পরীক্ষায় বিস্ময় উদ্রেক হওয়ার পিছনে নিহিত ছিল আর একটা কারণ। মার্কনির সমসময়ে আলোর সরলরৈখিক গতি, আলোর প্রতিফলন, আলোর প্রতিসরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানতেন আলো হলো এক বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্য সম্পন্ন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। তারা জানতেন সমস্ত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গই আলোর মতো সরলরেখায় চলে। রেডিও ওয়েভ যেহেতু তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তাই সেই ওয়েভও সরলরেখায় চলে। কোনও প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ৫-৬ কিমি দূরের কোনও আলো যেমন স্পষ্ট দেখা যায়, তেমনই ৫-৬ কিমি দূরে রেডিও ওয়েভ প্রেরণ করাটা কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু তাই বলে ইংলন্ডে আলো জ্বালালে কি তা কানাডা থেকে দেখা সম্ভব? ঠিক তেমনই ইংলন্ড থেকে রেডিও ওয়েভ প্রেরণ করলে তা কি কানাডায় পৌঁছন সম্ভব? তাছাড়া পৃথিবী পৃষ্ঠ হলো গোলকাকার। আর রেডিও ওয়েভ চলে সরলরেখায়। তাহলে বক্রপৃষ্ঠ বেয়ে সেই তরঙ্গ কি ভাবে পৌঁছল কানাডায়? স্থম্ভিত বিজ্ঞান মহল। ... ...
এই লেখা যখন লিখছি, ইন্টারনেট তখন উত্তপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত। তিরিশে নভেম্বর, দুহাজার ষোলোর যুগান্তকারী রায়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভারতবর্ষের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে ছবি শুরুর আগে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় সংগীত শোনানো হবে। সত্যিই তো, ক্ষতি কি? এতে যখন ক্ষতি কিছু নেই, তাহলে আলোচনাতেও ক্ষতি নেই। মূল আলোচনা শুরু করবার আগে দু-চার বাজে কথা বলে রাখা যেকোনো ভালো লেখার লক্ষণ। যেমন ধরুন, শোনা যায়, চীন-ভারত যুদ্ধ চলাকালীন, ভারতবর্ষের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহে, নিয়ম করে জাতীয় সংগীত শোনানো হতো। এই নিয়মের চল নাকি ছিল সত্তর দশকেও। না, এ ধরণের কোনো রায় এর আগে কোনো আদালত না দিয়ে থাকলেও, সরকারবাহাদুর মাঝে মধ্যেই এজাতীয় নীতি বা নিয়ম তৈরি করে থাকে। বস্তুত, এই নীতি নির্ধারণের কাজ সরকারেরই, বা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আইন সভার। নীতি নির্ধারণে কোনো ভুল হচ্ছেনা কিনা, এবং, নির্ধারিত নীতি না মানবার শাস্তি দেয়ার কাজ আদালতের। ... ...
রেবা রায়চৌধুরীর নাম কতো জনপ্রিয়, তাঁর কাজকর্ম কোন মাত্রার ছিল, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। তবে বলে রাখা ভালো যে রেবা গৌতম ঘোষের "পার"-ছবিতে নাসিরুদ্দিনের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর লেখা বই পড়ে, আপাদমস্তক এক আধুনিক মানুষকে আবিষ্কার করলাম। যার অন্য নাম সপ্রতিভতা। তাঁর জীবনসঙ্গী সজল রায়চৌধুরী। তিনি "পার"-ছবিতে নাসিরুদ্দিনের বাবার ভূমিকাতে ছিলেন। রেবা অভিনয় করেছেন মৃণাল সেনের "পরশুরাম" এবং অজয় দত্তগুপ্তর "দেবীগর্জনের" মতো ছবিতে। ... ...
শিল্পী যখন তাঁর ছবির নাম দেন এক্সিকিউশন - ঠিক কোন অর্থে নেব এই শব্দটিকে? এমনিতেই ছবির নামকরণের বিষয়টি কিছু গোলমেলে। নামকরণের মাধ্যমে শিল্পী নিজের ভিশনটিকে দর্শকের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন - এবং, সেই সুবাদে ছবিটি কোনো এক জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এমন প্রশ্ন বারবার উঠেছে। সম্ভবত এই কারণেই অজস্র ছবির তলায় আমরা আনটাইটেলড, অর্থাৎ অনামা, শব্দটি দেখে থাকি, কেননা আঁকিয়ে নামকরণের ঝামেলায় যান নি - দর্শকের সামনে ছবির আকাশটি উন্মুক্ত রেখেছেন। এ তো জানাই কথা, যেকোনো ছবির অর্ধেকটি আঁকেন শিল্পী, আর বাকি অর্ধেকটি সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিবিষ্ট দর্শকের। সেইখানে, শিল্পীর স্বাধীনতাকে স্বীকার করলে, দর্শকের স্বাধীনতাকে নামকরণের মাধ্যমে সীমায়িত করে দেওয়া তো কোনো কাজের কথা নয়। ... ...
আসামের চা বাগানে শতাব্দীকাল আগে কাজ করতে যাওয়া মধ্য ভারতের আদিবাসী মানুষদেরও স্থানীয়রা 'বঙ্গালী'ই বলে! কেননা আসামে বাইরে থেকে আসা সবাইকেই বঙ্গালী বলা হত। সাহেবরা ছিল 'গোরা বঙ্গালী'! অসমীয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঙালি মানুষদের আগমনের দীর্ঘ ও নিবিড় ইতিহাস এর থেকে বোঝা যায়। এবং অবশ্যই প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক কাজে বাঙালিদের আধিপত্য স্থানীয় মানুষদের চোখে এক বিদ্বেষের ভাবনা তৈরী করতে করতে গেছে বিগত শতাব্দীগুলোর ইতিহাস জুড়ে। মিলেমিশে থাকার ইতিহাসও ছিল অবশ্যই। বাহ্যিক উস্কানি ছাড়া মানুষ এক জায়গায় থাকলে যেভাবে মিলেমিশে থাকে, সেরকম। সেই থাকার মধ্যে জীবন সংগ্রাম ছিল, জীবনের গানও ছিল। ভুপেন হাজারিকা, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা যখন একসাথে মিলে মানুষের গান গাইছেন, তখন সেই সমষ্টিযাপন আর সংগ্রামের ইতিহাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ... ...
শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বৃত্তরৈখিক’ উপন্যাসটি, এক অর্থে, সেই প্রাচীন প্যারাবলের আধুনিক রূপ। এই ধারাবাহিক উপন্যাস ৫৮টি পর্বে বিধৃত। ছোটখাট এপিকের মত এই উপন্যাসটির কালখণ্ডের বিস্তারও কয়েক দশক ধরে। প্রাক-স্বাধীনতা থেকে নব্বইয়ের দশক। দুটো এলাকার মধ্যে পাঠক ঘোরাফেরা করবেন—রাঢ়বাংলায় ঝাড়খণ্ডের সীমান্তের আদিবাসীবহুল এলাকার বনভূমি, সেখানকার বান্দোয়ান ব্লকের একটি অবহেলিত বনগ্রাম খুশিঝোরা, এবং মহানগর কোলকাতা। ... ...
ইতিহাসের কোন বিশেষ ক্ষণে এসে ব্যক্তির কণ্ঠের প্রসঙ্গ কি আলাদা গুরুত্ব পায়? কোন বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ব্যক্তির স্বর কি চাপা পড়ে যায় কৌম কিংবা সমষ্টির কণ্ঠের আড়ালে? রাজনৈতিক ইতিহাসের কোন বাঁকে এসে ব্যক্তির উন্মেষের “discrete identity” একটি “concrete reality” হয়ে ওঠে? উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে – “আধুনিকতা” যখন মধ্যগগনে – তখন অন্তত দুটি বিষয় বৌদ্ধিক স্তরে আলোচ্য বিষয়ের তালিকাভুক্ত হল। ... ...
শাড়ির খসখসানি শুনে মেয়েমানুষ সেটা ওমর আলী আগেই বুঝেছিলো। তা মেয়েমানুষ হলেই তাকে হুট করে ঘরে বসতে দিতে হবে নাকি! ওমর আলী হানিফকে বকাঝকা করতে লাগল। দিনকাল বড় খারাপ। ৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কাল সন্ধ্যাবেলাও মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গুলি ফুটিয়ে জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিয়েছে স্কুল ঘরের মাঠে। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে তাদের দেখার জন্য। ঐ দলের পালের গোদা সেন্টু আজকাল কি রকম ঠেস মেরে মেরে কথা বলে। ছোকরার মাথায় কেউ ঢুকায় দিছে মেলিটারি আইসা ওমর আলীর বাড়িতেই বসছিল। খানাপিনা করছে। ওমর আলী ভাল উর্দু জানে। বাতচিৎ তার মাধ্যমেই হয়েছে। সেন্টু যে মুক্তিবাহিনীতে গেছে এইটা যদি মেজর সাবরে বলে ওদের বাড়িঘর সে জ্বালাই দিতে বলত, কি পারত না তখন ওমর আলী? গ্রামের মাইনষের উপকার করছে ওমর আলী। বাড়ি-ঘর জ্বালাইতে দেয় নাই। হিন্দু জেনানাদের নিজের ঘরে আশ্রয় দিছে। রাতের আন্দারে তাগো বর্ডার পার হইতে সাহায্য করছে। অহন যদি সেদিনকার চেংরা পুলাপান কান্দে মেশিনগান নিয়া চোখ গরম দেখায় কেমুন লাগে? ... ...
যে দেশে এক্কেবারে চলতি ভাষাতেই টুরিস্টকে বলা হয় ‘মুসাফির’ তার রোদ্দুর তো আলাদা হবেই। অন্ধকার আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে সবার আগে সেই কথাটাই মনে হল। আমার ভাঙাচোরা ফারসিই আমাকে বুঝতে দিয়েছে, সৈয়দ তার স্ত্রী তহমিনেহকে মোবাইলে জানাচ্ছে, ‘হিন্দ-এর মুসাফির এসে গিয়েছে। আমরা শিগগির বাড়ি পৌছাচ্ছি’। ‘মুসাফির!’ সে কি সহজ কথা! চকিতে মাথায় খেলে যায়– দিল-এ-ম্যান, মুসাফির-এ-ম্যান! ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর ফারসি শিরোনামের সেই কবিতার গোড়ার পঙক্তিগুলি—‘প্রাণ আমার, মুসাফির আমার/হয়েছে যে আদেশ আবার/দেশ ছাড়ি, তুমি-আমি, আরও একবার।... ইরান শেষে আমাকে মুসাফির করলে! ... ...
ইউভাল নোয়াহ হারারির দুটি বিখ্যাত বই 'স্যাপিয়েন্স' এবং 'হোমো দিউস' যথাক্রমে মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের ওপর আধারিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বই 'টুয়েন্টি ওয়ান লেসন্স টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি'তে তিনি বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি তাঁর মতামতের একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করব কয়েকটি পর্বে। ... ...
আজ অবধি কোথাও কোনো চেষ্টাই হয়নি মালদা জিকেসিআইইটি-র ঘটনাপরম্পরা লিপিবদ্ধ করে রাখার। এদিকে আন্দোলন শুরু হয়ে ২ বছরের ওপর ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। এর মধ্যে নানান ঘটনা ঘটে গেছে। এইসব ঘটনার সংখ্যা এতই বেশি যে বর্তমানে আন্দোলনরত ছাত্ররাও সঠিকভাবে দিনক্ষণ, তারিখ বা নাম উল্লেখ করতে পারছে না। সমস্তটাই "ওই ঘটনাটা ঘটার ৬ দিন পর মোটামুটিভাবে ধরা যায়" জাতীয় বাক্য হিসেবে আসছে। সেখান থেকে সঠিক তথ্য ছেঁকে তোলার জন্য দরকার নির্ভরযোগ্য প্রমান। অর্থাৎ কিনা, সেই সময়কার ফেসবুক পোস্ট, কলেজ কর্তৃপক্ষের তারিখ নির্দেশ করা চিঠি (যার কিনা সূত্র পুনরায় ফেসবুক পোস্টই) অথবা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। এই দু'বছরে বেশ কিছু প্রতিবেদন আবার হারিয়েও গিয়ে থাকতে পারে অ্যালগোরিদম-এর দৌলতে। ... ...
অন্ত্যেষ্টিশিল্পের আলোচনা এখানেই শেষ। অনেক দেশ এবং অনেক সময়কালের কাহিনী বাকী রইল। আশা করি সেগুলি তুলে ধরার জন্য কখনও এই ধারাবাহিকের দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে ফিরে আসব। যাবার আগে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই- কেন এই ধারাবাহিক শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন সমাজের সামাজিক গঠন, তাদের ভিতরকার উঁচু-নিচুর শ্রেণীভেদ, লিঙ্গবৈষম্য, সাজপোশাক, খাদ্যাভ্যাস এগুলো তাদের সমাধি ও অন্যান্য বিদায়-উপহার দেখে বোঝা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বনাম গোষ্ঠীবোধ- কোন সমাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটারও আভাস পাওয়া যায়। পরলোক বিষয়টিকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ কীভাবে কল্পনা করে এসেছে তার ধারণা পাওয়া যায়। বোঝা যায় সমাজগুলির শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন। পাওয়া যায় সামরিক অভিযানের কাহিনী, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিষয়ে অনেক তথ্য। পাওয়া যায় কিছু প্রেমকাহিনী, কিছু সমাধিলেখ, কিছু কবিতা। সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার লিপিবদ্ধ ইতিহাসের অভাবকে অনেকটাই পুষিয়ে দেয়- অন্ত্যেষ্টিশিল্প। ... ...
প্রতিবাদে বাবাও বোধহয় কাঁসার থালাতেই খেতেন। 'হিন্দু' বাড়িতে কাঁসার থালা সম্মানসূচক হলেও আমাদের বাড়িতে যতদিন ঠাকুমার শাসন ছিল, কাঁসার থালা ছিল সংরক্ষিত। গেলাম। খেলাম। কাঁসার থালায় চুড়ো করে ভাত। পাশে আলু ভাজা, একটা সব্জি, ডাল আর হাঁসের মাংস। হাঁসের মাংস ততো মশলাদার নয়। খেলাম তো বটে, মনে মনে খচখচ করতে লাগল, ভাতটা কি পাথর হয়ে পেটে থেকে যাবে। রাত কাটলে, দিব্যি সব, পায়খানা হয়ে বেরিয়ে গেল। তা অনেকেই বোধহয়, এখনো আমার ঠাকুমার মতো হয়ে আছেন। ... ...
এই শহরে সবাই তেতে আছে সনতের মত- যেন প্রতিটি লোক জুয়াড়ি , যেন প্রতিটি লোক একটা হেরো ঘোড়ার ওপর নিজের জীবন বাজি ধরেছে,আর সেহেতু প্রতিটি সেকন্ডে নিজের নাড়ি ধরে হার্টবীট মাপছে, তারপর তেড়েফুঁড়ে শ্বাস নিচ্ছে যেন এই শেষবার। সবার ঘোলাটে চোখ, ছুঁচোলো ঠোঁট, নিঃশ্বাস নেয় ঘন ঘন- সনৎএর নিজেকে কানেকটেড মনে হয়। আজ সকালের বাসে লোকটা এনারসি, সি এ এ নিয়ে খুব চোপা করছিল, সনৎ কিছু বলে নি- জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দেখছিল আপাতনিস্পৃহ, অথচ কান ছিল সজাগ- যেন লোকটার রেসের ঘোড়াকে চিনে নিতে চাইছে। মালটা হঠাৎ টপিক চেঞ্জ করে বিক্রম আর প্রজ্ঞান তুলতে ওর মাথা গরম হয়ে গেল। যেন লোকটা নিয়ম ভেঙে দুটো ঘোড়ার ওপর বাজি ফেলেছে - যার মধ্যে একটা সনতের -যার ওপর বাজি ধরার আর কারোর এক্তিয়ার নেই। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে লোকটার হাত সরাতে মরিয়া হ'ল সনৎ-“মহাকাশের তুই কী বুঝিস?” ... ...
গোলেনূর দাদীর বাড়ির পেছনে ঝোপ-জঙ্গল থেকে ঘুঘু পাখি থেমে থেমে ডেকে উঠছে। আর গোলেনূর দাদীর ছায়াঘেরা উঠোন একটু পরপর চঞ্চল হয়ে উঠছে রান্নার ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দে। কড়াইয়ে এবার থেঁতলানো রসুন পড়লো। একটু নাড়তেই তা বাদামী হয়ে আসলো। এরপর অনেকটা পেঁয়াজ কুঁচি আর বুকচেরা কাঁচামরিচ যোগ হলো তাতে। গনগনে আঁচে তেতে থাকা কড়াইয়ে তা পড়তেই ঝাঁঝ ছড়িয়ে পড়লো উঠোনে। দমকে কেশে উঠলাম আমি। ... ...
অসময়ের বৃষ্টি ফুরিয়েছে। ভেজা বারান্দার জল টেনে নিয়েছে সকালের রোদ। মা কেরোসিনের স্টোভে আগুন দিয়েছে। নীল আঁচে বসেছে লোহার কড়াই। তাতে সর্ষের তেল। তেজপাতা ফোড়নে পড়ল। আগে থেকে মিহি করে বেটে রাখা মৌরি বাটায় মাংসগুলো হাতে মাখিয়ে নিল মা। সাথে শুকনো মরিচ আর আদা বাটা। কুচানো পেঁয়াজ পড়লো কড়াইয়ে। খানিকটা লবণ আর হলুদ গুড়ো। পেঁয়াজের রঙ বদল হতেই মা মাখানো মাংস আর কেটে রাখা লম্বাটে পেঁপের টুকরো ঢেলে দিল কড়াইয়ে। মৌরি মাখানো মাংস তেলে পড়তেই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। নেড়েচেড়ে কড়াইয়ে ঢাকনা দিল মা। ... ...
টিভিতে সিরিয়াল দেখা বন্ধ রেখে এক দুই তিন করে ছায়াপিণ্ডরা সব পাশের বাড়ির ছাদে উঠে আসছিল। অন্ধকারে লাল বিন্দু দেখতে পেল বিপ্লব- সিগারেট ধরিয়ে মজা দেখছে সুধীন। এই সময় বাড়ির সামনে বলাইএর রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছিল।মিঠুকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল বলাই। টেনে টেনে প্যাডেল করছিল। কমজোরি আলোয় এ'পাড়ার প্যাঁচালো গলি আবার তার সমস্ত রহস্যময় বাঁক নিয়ে উপস্থিত। অসম্পূর্ণ এক্কাগাড়ির মত লাগছিল বলাইএর রিক্সাকে। ভৌ ভৌ করল কালু। রিক্সার পিছনে দৌড়োলো খানিকক্ষণ। ছন্দা দ্রুত নামছিল সিঁড়ি বেয়ে - দরজা খুলে দেবে। বিপ্লব ওর পিছনে। মিঠু ঘরে ঢুকে ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলল সোফায়- সকালের পারফিউমের গন্ধ উবে গিয়ে অদ্ভূত গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে- অচেনা আর অস্বস্তিকর। ... ...
সোনাগাছি এলাকায় দুর্বার ও আপনে আপের সৌজন্যে বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ডক্টর স্মরজিত জানা বা টিংকু খান্নার সঙ্গে যৌন কর্মীদের মাতৃত্বসংক্রান্ত সুবিধে অসুবিধে নিয়ে তেমন কথা হয়নি কখনো। তাই ওই এলাকায় যাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা হয়েছে সেইরকম মা ও সন্তানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই এই লেখার ভিত্তি। বিশেষ করে মায়েরা, কারণ মা হবার দীর্ঘ সময়কালে নিজেদের প্রয়োজন ও ঝুঁকির কথা তাদের থেকে বেশি কে আর জানে ! ... ...