কিন্তু কাল রাতে একটা জব্বর নাম এসেছে মাথায়। সেটা নিনিকে বলতে হবে। আর দশটা কাজে জড়িয়ে পড়ার আগে। তাই অপেক্ষা করে পৃথা। মেপে মেপে ক্যারাফেতে জল ঢালে। বসিয়ে দেয় বার্নারে। তারপর গ্যাসের নব ঘোরায়। খোলা জানলা দিয়ে চুইয়ে আসে ভোরের তরল, পাতলা অন্ধকার। এক দৈবী আলোর মত গ্যাসের শিখারা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। হাইড্রোকার্বনের অণুগুলো ক্যারাফের তলা ছোঁয়। পৃথার মনে পড়ে যায়, ওর মায়ের কথা। প্রথম যেদিন ওকে কাঁচের ক্যারাফে গ্যাসের আগুনে বসাতে দেখেছিল, কি ভয়টাই না পেয়েছিল! যদি আগুনের শিখায় কাঁচ ফেটে যায়! ওই ভয়টা! ভয়টাও ওদের পোর্টফোলিওতে চাই। মনে মনে নোট করে পৃথা। হয়ত এক্ষুণি কাজে লাগবে না। কিন্তু ইটস ইউনিক। কিছুটা না-জানা, ফ্লেম প্রুফ ব্যাপারটাই মা বোঝে না, কিছুটা মেয়েকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া, সব কিছুর একটা পারফেক্ট পাঞ্চ। ... ...
আলমারিটা তোলার সময় সেরকম কোন তোড়ফোঁড় হয়নি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামানোর সময় আলমারির ধাক্কায় একতলার একটা দেওয়ালের গা থেকে কিছুটা সিমেন্টের চটা উঠে গেছিল। তবে ঠিক সেদিন ফাটলটা অবধেশদের চোখে পড়েনি। চোখে পড়লে দুচারটে খিস্তি অবশ্যই দিত মজুরগুলোকে। আগে খুব মুখ খারাপ করত অবধেশ। এখন ছেলে বড় হতে গালি দেবার অভ্যেসটা খানিক কমিয়েছে। ... ...
কিন্তু আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগেও কি পৌরুষ আর নারীত্ব আজকের মতো একইরকম বিপ্রতীপ মাপকাঠিতে নির্ধারিত হতো, নাকি এই দুই সমান্তরাল রেখা মিলেমিশে সেসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মানবের অন্যতর কোন পরিচয়? গত দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটানভিল কলেজের অধ্যাপিকা তথা শিল্প ঐতিহাসিক মেগান সিফারেলি। প্রাপ্ত যে কোন প্রাচীন দেহাবশেষকে নারী ও পুরুষ নামক দুটি লিঙ্গে দেগে দেওয়ার বাঁধা গতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন এক উত্তরের আশায় গবেষণার জন্য ইরানের মরু-মালভূমির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকেন্দ্র তথা লৌহ-ব্রোঞ্জযুগের বাণিজ্যনগরী টেপ হাসানলুর প্রাচীন সমাধিগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি এবং খুঁজে বেরও করেছিলেন মানব যৌনতার তৃতীয় স্বরের বেশ কিছু অসামান্য নিদর্শন। ... ...
পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখা সেই লাস্যময়ী নারীটির সাথে, যার নাগরটি গোপনে প্রণয়াবদ্ধ হয়েছে আমার দয়িতার সাথে। হ্যাঁ, এরকম তো হতেই পারে, তখন আমরা কি করবো? “কি করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই”। বাধনহীন যৌনকামনা আমাকে প্রতি মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে, কখনো বা ভাবি আমাদের দুজনের এই উভয়সঙ্কট বুঝি জন্ম দেবে এক মৌন অমর ভালবাসার। হয়তো কাল আমাদের ক্ষমা করে দেবে আমাদের মত এমন দুটি ব্যথিত হৃদয়ের গল্প শুনে সবাই হর্ষাবিষ্ট হবে। নিভৃত হৃদয় যুগলে লুকিয়ে থাকা বিষাদসিন্ধুর সন্ধান কারই বা জানা আছে? এমন দুটি ব্যকুল হৃদয়ের দৌর্মনস্য, নিবিড় গোপনীয়তা আবার আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে নতুন করে প্রেমের ইতিহাস লেখার যে ক্ষণস্থায়ী সুযোগ রচিত হয়েছিল Wong Kar-Wai এর 'In the Mood for the Love' ছবিতে, তা দেখে এক কথায় হতচকিত না হয়ে উপায় নেই। একজন অর্কেস্টার নির্দেশক যেমন, Wong Kar-Wai ও ঠিক তেমনভাবেই সেই ব্যথিত যুগলের মনের মণিকোঠা থেকে উদ্ধার করেছেন এক আবেগবিহ্বলতা, এক চেতনাময় সংগীত, যা ধরা পড়েছে ছবিটির পরতে পরতে, প্রত্যেকটি শটে। ... ...
অনেক সময় দহলিজে খাঁ সাহেবেদের রোজার ব্যবস্থা থাকত অবস্থাপন্নের যৎসামান্য ইফতার দেওয়ার মাধ্যমে। এইভাবেই চলত মাসভর। শেষ রোজায় গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলে পাড়াতে একসাথে ইফতারের মজলিসে তাদের আনা শহুরে নানা ফলের ডালি খানচায় নিয়ে দোওয়ার মজলিসে সমবেত হত, সব বাড়ির ছোট ছেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মজাই ছিল আলাদা। সেদিনে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনা করার অলিখিত ছুটি মঞ্জুর হতো দু-তিন দিন। ... ...
আকাশ থেকে মনসুনের মেঘ সরলো তো বুভুক্ষু বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়লো পুজো নিয়ে। শারদীয়া পত্রিকা এখন সরতে সরতে বর্ষাকালেই বার হয়। একই নামের লেখক লেখিকা,একই অপকাশিত পত্রাবলী ও আঁকা ছবি। একটি ফরম্যাট মাত্র। তাও ও কিনতে হয়। কিনে খুব রাগতে হয়। "কিস্যু হসসে না" বলতে হয় কিন্তু বর্ষাকালের শারদীয়াগুলি কিনতে হয়। কিনতেই হয়।এটি পুজার নামতা। অত্যাচারী ও অত্যাচারিত, দু পক্ষেই মিলে জুলে এ খেলাটি খেলে চলেন প্রতি বছর। ... ...
শিখা পায়েসের বাটিটা নিয়ে ছাদে উঠল। দোতলা বাড়ির ছাদ। চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে, একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, একবার পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে, সবদিক নজর করে শেষে পায়েসের বাটিটা সে ছাদের পাঁচিলে রাখল। তারপর গলার মঙ্গলসূত্রটা চেপে ধরে কি যেন ভাবা শুরু করল। পাশের বাড়ির ছাদে সপ্তর্ষি, বছর চোদ্দর ছেলে হবে, হাতে খাতা, মুখে পেন। খাতা উল্টেপাল্টে দেখছে আর পাশে বসে থাকা পায়রাটাকে কীসব পড়ে শোনাচ্ছে। ছেলেটি একঝলক শিখাকে দেখল, শিখা সেটা খেয়াল না করে তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এল। ... ...
হিন্দুরা বলেন লঙ্কা দ্বীপে রাবণের তোরণদ্বার খোলার সময় ঐ শব্দ হয়। মুসলমানেরা বলেন ইমাম মেহেদীর আগমন জনিত কারণেই ঐ শব্দ। হিস্ট্রী অব বাকেরগঞ্জের লেখক বেভারীজ সাহেব সিদ্ধান্তে এসেছেন যে জৈষ্ঠ্য আষাঢ় মাসে ঝড়ের সময় এই শব্দ চারবার শোনা যায়। উনি স্থির করেছেন এর পেছনে বায়ুমন্ডলের কোনো বৈদ্যুতিক ঘটনার যোগ রয়েছে। তবে প্রবল তরঙ্গাভিঘাতের জন্যও এই শব্দ হতে পারে। এ বিষয়ে আরো বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন। ক্রমশঃ আরো রাত ঘনায়। মোকাম আবাদী জুড়ে চলাফেরা বাড়ে। রুপোলী আঁশ মাখা জাল নিয়ে জেগে ওঠে চরমমতাজ। হোগলা কুটীর ছাওয়া ঘর দোর উঠোন আদুল গায়ে মাখে রাত। হাজার হাজার অশরীরী ছুটে চলে জলাভূমি, নদীঘাট, বর্ষা বাদল পেরিয়ে ভাটার সাগর। তারপর এ দ্বীপ ও দ্বীপ সে দ্বীপ… ... ...
ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয়। বন্দিদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর Death Wasn’t Painful বইটিতে। এই বইটির ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম "আয়েশা"। তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল। ... ...
শহরে যাওয়ার বাস একটাই। সেটাই যায় আসে সারাদিনে চারবার। জানালায় বসে ছোট্ট মেয়ে কুসুম অপেক্ষা করে বাবার ফেরার। কয়েক বছর হল পাইলট বাবা গেছে সীমান্তে যুদ্ধের মহড়ায়। তখন সে ভারী ছোট্টটি ছিল। বাবাকে মনেও পড়ে না সেভাবে। তার মা কল্যাণী তাকে ঘুম পাড়ায় তার বাবার গল্প বলে। বাস্তব আর কল্পনা সেখানে মিশে যায়। ... (কল্যাণীর কন্ঠ) এক যে ছিল ছোট্ট রাজপুত্র। সে এমন একটা গ্রহে বাস করত যেটা তার মতই ছোট এবং তার একজন বন্ধুর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল... কালো পর্দায় সিনেমাটির নাম ফুটে ওঠে- একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে Antoine de Saint-Exupéry এর The Little Prince দ্বারা প্রাণিত। সুমেরু মুখোপাধ্যায়ের গল্প “মলিন মর্ম মুছায়ে” অবলম্বনে। ... ...
রোজার শুরু মানেই স্মৃতির বই মেলে ধরে পড়তে শুরু করা। এ যেন নিজেকে আবিষ্কার করা আর শৈশব আর কৈশরে বিপণি বিতানগুলোতে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো এক কন্যার হাসি কান্না। ... ...
"আদ্যাশক্তি মহামায়া" বা "দুর্গা দুর্গতিনাশিনী" এইসব নামে ছবি হত এককালে। আরো অনেক ছবিতেই মা দুর্গা থাকতেন। মাটির মূর্তির পেছন থেকে জলজ্যান্ত মা দরকারে অদরকারে আসতেন। কিছুটা আবছা মনে আছে। কারণ সেইসময় আলেয়া সিনেমা নামে একটি হল ছিল আর দিদু ম্যাটিনি শো' তে নাতনীকে নিয়ে আদ্যাশক্তির শক্তি দেখতে যেতেন। আমার কিন্তু মনে আছে "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি"। তনুজা গরদ পরে বেশ বাংলার বধূ হয়ে পিদিম জ্বালাচ্ছেন, গ্রামের লোক ঘরে আগুন লাগাচ্ছে, অ্যান্টনি বাইরে বাইরে কবিগান করে বেড়াচ্ছেন। দুর্গাপূজা এইছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। একটা ইস্যু ছিল। যে ফিরিঙ্গির বাড়িতে তার একদা বাঈজী এখন বধূ দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারে। এটা, এখন মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা। দুর্গাপূজার একটা বিশাল সামাজিক দিক আছে। একটা প্রিজম যেন। অনেক অনেক আলোর বিচ্ছুরণ। তার কিছুটা অ্যান্টনি সাহেবের দুর্গাপূজার আয়োজনে ধরা পড়ে। তাও প্রায় একক আয়োজন। সেটা কতদূর সম্ভব জানি না। মানে কে তাঁকে প্রতিমা গড়ে দিল? কেই বা জোগাড় দিল এই বিশাল পূজার? তবু নাহয় গল্পের খাতিরে মানা গেল যে স্বামী স্ত্রী মিলে একটা যেন আনন্দোৎসব করছেন, ঘটনা তো আসলে উত্তমকুমার। ... ...
যত জোর ছুটতে পারে রাজু ছুটল, কিন্তু এক নুড়ির ওপর পা হড়কে পড়ে গেল। ডাইনোসর রাজুকে প্রায় চাপা দিয়ে দিচ্ছিল যখন…… ... ...
বন্ধুরা অনেকেই ভালো নেই। কারও কাজের সমস্যা তো কারও পরিবারের সদস্যের প্রয়াণ, কারও জটিল অফিস বা বাড়ির রাজনীতি-তবু এসবের মধ্যেও পুজো আসে। এখনও। এও কি এক রকম বিস্ময় না? যখন জীবনটা এখানেই শেষ ভেবে নিয়েছে অনেকে, তখনই অজানা সুন্দরের ডাক এসে জানায়, এখনও প্রেম আছে। শড়িপরা মেয়েটিকে দেখে ভালোলাগছে আবার..সে যখন কাফেতে চোখে চোখে যা বলার বলে মিলিয়ে গেল, বুকের ধুকপুক জানালো, পুজো আসছে..যখন আবার পাহাড়ের কুলকুল ঝর্ণাডাক এসে জানাচ্ছে, অনেকদিন কাজের চাপে কোথাও যাওয়া হয়নি এবার কিন্তু দুম করে কোথাও বেরিয়ে পড়তেই হবে..কাউকে না পেলে একাই রাক্স্যাক নিয়ে পাহাড়ে ক দিন বেরিয়ে পড়ার সাহস জানালো, পুজো আসছে, পুজো আসছে, বয়স হলেও পুজো আসেই। ... ...