মকিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মইশা বলে কতো জল। আল্লাহ সাক্ষী রইল গো। দেখি কে কারে তাড়ায়।’ মাথা এত গরম হয়ে গেল সারা রাত্রি ঘুম হল না। তাঁর উপর ছাদ থেকে শুধু প্লাস্টার খসে পড়ছে। মশারির ভেতর দিয়ে সারা বিছানা বালি বালি হয়ে গেছে। মশারির উপরে একটা চাদর পেতে দিলে হয়। কিন্তু তাতে পাখার হাওয়া একটুও ভেতরে ঢুকবে না। কী করি ভাবতে ভাবতে লোডশেডিং হয়ে গেল। দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। সাপের কথা ভেবে আবার মশারির ভেতরে ঢুকলাম। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। তার সাথে বিছানায় বালি ভর্তি। শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। কাল আবার ভোর ছ’টা থেকে ডিউটি করতে হবে। ... ...
চোখে পাখি গেঁথে থাকা একটা আলো হুড়মুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ল্যাংড়াবাড়ির ঘাসগুলোতে। এই সময় গাছের গায়ে লাঠা হয় খুব। সারি সারি লাল পিঁপড়া লাঠা পায়ে চলতে থাকে ঘাসের উপর। ঘাস চ্যাটচ্যাট হয়ে যায়। কেঁচো খেতে নামা পাখির ঠোঁট ঘাসে আটকে যায় কখনও, দু-এক সেকেন্ড। যুতসই মওকা বুঝে, উদবিড়াল পাখি মুখে গাছে চড়ে বসে। এইসব সময়েই আলো হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ল্যাংড়াবাড়ির ইতিউতি। যাদের কান ভালো তারা এসময় গাছেদের বাতচিত শুনতে পায় শুনশান আমের বাগান পেরোতে পেরোতে। আজ গাছেরা কথা বলছে না। কিংবা যে দুটি ছেলে, বাগানের ভিতর দিয়ে এমনভাবে পা ফেলছে যেন সাপের মতো বয়ে চলা সময়ের জিভ পার করে তারা আলজিভে ঢুকে পড়বে অন্য কোনো সময়ের, তাদের এখনও গাছেদের কথা শোনার কান পেতে বাকি আছে খানিক। উত্তর থেকে হাওয়া বওয়া বন্ধ হয়েছে দিন কয়েক আগে। দখিনা আর পছিয়ার আসতে আরও কয়েক দিন। এসময় গুড্ডি উড়াতে বেশ লাগে। ... ...
মেগামার্টের চত্বরে বাইকটা পার্ক করতে করতেই বৃষ্টি এসে গেল। এখানে বৃষ্টি, হয় আকাশ থেকে বালতি উপুড় করে জল ঢালে নয়ত জলের গুঁড়ো স্প্রে করে। দুটোর কোনওটাতেই ছাতা কোনও কাজে লাগে না।আজকে অবশ্য বৃষ্টি মাঝারি গতিতে একদম সোজা নেমে আসতে লাগল, ছাতা থাকলে কাজেই লাগত। জিতু অল্প দৌড়ে মিঠাসের ভেল কাউন্টারের শেডের নীচে উঠে দাঁড়াল। হেলমেট খুলে মাথায় পেঁচানো বড় কাপড়টা খুলে হাত ঘাড় মুছে পিঠের ব্যাগটায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে। হাতে চ্যাটচ্যাটে মত কি যেন লেগে যাচ্ছে। কাপড়ে ঘষে মুছে তাকিয়ে দেখে টমেটো কেচাপের মত রঙ আর গন্ধটা … গা গুলিয়ে ওঠা। ... ...
ছিয়াত্তরজন ড্রাগ অ্যাডিক্ট নর্দমার কাঁথে মুখ রেখে ঈশ্বর খুঁজছে; ফরফর করে আরশোলা উড়ে ধাক্কা মারছে তাদের চোখেনাকে — পুড়ে রবারের মতো নরম আর থকথকে হয়ে যাচ্ছে শিশুদের হৃৎপিন্ড; সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপে, কংক্রিটের হাড় বেরিয়ে-থাকা টাওয়ারে, পাখির বাসাতে বসে তিনজন স্নাইপার টার্গেট প্র্যাক্টিস করছে তাদের মেরুন খেলনাগুলির ওপর। হিরোশিমার হলদে পর্নোগ্রাফিক ফুটেজ থেকে গলে গড়িয়ে নামছে তেজস্ক্রিয় পাকস্থলী, দেখতে দেখতে ছিয়াত্তরজন কবি মাস্টারবেট করছে বিবর্ণ নীল বিন্দুটার গায়ে; আলের ধারে বসে জলের ওপর ঝুঁকে যে চাষী ফানুস দেখছে, আজ রাতে ফলিডল খাবে। ... ...
সর্বশেষ প্রশ্নপত্রটা বিলি করার পর পরীক্ষক যখন হলটির ডায়াসে এসে পৌঁছুলেন, চোখ পড়া মাত্রই দৌড়ে গেলেন দীপের দিকে, আর হাত থেকে বইটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে একটা প্রশ্নপত্র গুঁজে দিলেন। খাতা আগে থেকেই রাখা ছিল, সামনের পকেটটা অনেকক্ষণ ধরে কামড়ে থাকা জ্যামিতি বক্সটা কোনমতে বের করে দীপ তার জন্য নির্ধারিত আসনে সটান বসে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতেই এক ঝলক দেখে নিয়েছিল, এখন পুরো প্রশ্নপত্রটা দেখে তো সে আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলো। শতভাগ কমন! এমনকি ‘অথবা’ দেয়া বিকল্প প্রশ্নগুলোও তার ঝাড়া মুখস্ত। কোনটা রাখবে, আর কোনটা ছাড়বে, এ নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ভাবলো সে। পরে জ্যামিতি বক্সটা খুলে যুৎসই একটি কলম বেছে নিয়ে লিখতে শুরু করলো। ... ...
রাস্তার ধারে ঝুপসি গাছপালাগুলো অব্দি কুয়াশার কম্বল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু বাতাস বইলে দেখায় বিশাল দৈত্যের মাথা নাড়ার মতো। ধোঁয়া-ওঠা বুক নিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকা নদীর দিক থেকে কেমন একটা গোঁওওও শব্দ ভেসে আসে, যেন কেউ কাঁদে, কষ্টে গা মোচড়ায়, নিজের গলায় নিজের দশ আঙুল চেপে ধরে। তাতে গা শিরশির করলেও অষ্টমী ভালোই জানে আসল বিপদ লুকিয়ে আছে পেছন বাগে। সে বিপদ যে কখন বিদ্যুতের মতো ঘাড়ের ওপর অব্যর্থ লাফিয়ে পড়বে কেউ জানে না। সে এক আশ্চর্য হলদে আগুনের শিখা, তাকে দেখার আগেই নিজের কানেই শুনতে পাবে নিজের ঘেঁটি ভাঙার মট মট শব্দ, আর কিছু বোঝার আগেই এতো আলহাদের শরীরখানা তেনার কষে ঝুলতে থাকবে। যেন তুমি আর মানুষ নও হে, দাঁত বার করা মরা বেড়াল একটা। শিউরে উঠে অষ্টমী তার কালো ফাটা হাতখানি কোঁকড়া চুলে ঢাকা ঘাড়ের ওপর আলগোছে বুলিয়ে নেয়। রক্ষে কর সোনার বন্ন বনবিবি, মা আমার! ভয় তাকে পেড়ে ফেলে, হঠাৎ এমন কাঁপুনি দেয় যে শরীরের সমস্ত রোঁয়া খাড়া দাঁড়িয়ে ওঠে। ... ...
থকথক করে কেঁদে ফেলে ছেলেটি , আমি মোছলমান বলি মা আমারে বাঁচায় নাই স্যার— যাতি আসতি কতবার ভালো ভালো কলা দিছি দুগগা মার পায়ের তলায়—বলাইকাকার সাথি কতবার ডাকিছি মা, ওমা জগজ্জননী আমারে একটু বুদ্ধি দাও মা -- প্রাণ খুলে শ্বাস নেন নূরতাজ মন্ডল। যাক বলাই সাহা্রা তাহলে মিথ্যে বলেনি কাল মাঝরাতে। ছেলেটা সত্যি নিরীহ। বলাই সাহার বউ কি যেন বলেছিল, গোপাল। তা গোপালই বটে ! একটু বেশি ভালো মানুষ। সমাজের লোকেরা যাদের বোকা বলে তেমন সোজা সরল মানুষ। কৃস্টালের পেপার ওয়েটটা টেবিলের কাঁচের উপর ঘুরাতে ঘুরাতে নূরতাজ মন্ডল উপলব্ধি করেন, এই ছেলেটার ভালোমানুষি মনে এবার পাপ ঢুকে পড়বে। জেল বাস হয়ত তিনি রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ছেলেটা এবার সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে। ওর মনে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার সরলতা মুছে গিয়ে অন্যদের মত জেঁকে বসবে আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানকে ভাগ করে নেবার শিক্ষা। জন্ম নিবে ঘৃণা । মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে শিখে যাবে ছেলেটা। এক হাতের চেটো দিয়ে অন্য হাত মুছে নিয়ে তিনি মনে মনে হাসেন, এই তো এই জগতের বাস্তব শিক্ষা। ছেলেটার বুদ্ধির কমতি ছিল। এবার তা পূর্ণ হলো ... ...
সে কি আর নীতেশ রবিদাস জানে না? পৌরসভার নোটিশ পেয়ে কার কাছে না গিয়ে ধর্ণা দিয়েছে তারা। ব্রিটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তানি আমল, জয়বাংলা, কেউ তাদের ওঠাতে চায়নি। ফুলে ফেঁপে বড়ো হয়েছে তাদের পরিবার। বাঁশের বেড়া দিয়ে খোপ খোপ বিভক্ত হয়েছে পরিবার। চামড়া সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে রংমিস্ত্রি, রিকশা মিস্ত্রি, কত পেশায় ছিড়িয়ে গেছে তারা। কিন্তু সন্ত ঋষি সন্তানদের ওঠানোর চিন্তা করেনি কেউ। দ্য প্যারাগন হাউজিংই প্রথম এদের উৎখাতের প্রসঙ্গ ওঠায়। কেউ তখন পাশে দাঁড়ায়নি একা বদরুল ছাড়া। তাও নিশীথের কারণে। সব জানা আছে নীতেশের। মনে আছে তখন আর কেউ এগিয়ে আসেনি। এ নিয়ে সীতেশবাবুর সাথে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। সে এসেছে তারা এবার মা দুর্গার পূজা করবে এটা জানাতে। বাঙালি না হলেও দীর্ঘদিন এই বাঙালি সমাজে থেকে তারা মনেপ্রাণে বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। আর এ যেন সেই দুর্গোৎসব শুরুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খেয়ে পরে সবাই ভালো আছে তাই উদ্বৃত্ত টাকায় শারদীয় ঊৎসবের আয়োজন। মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা। ... ...
আমরা যে রকম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঠা বের করি, গাছটি নড়েও না, চড়েও না, এই অচেনা বৃদ্ধও সে রকম প্রাণ থেকেও জড়ের মতো পড়ে থাকে। গাছের মতো একটি বারও নিজে থেকে প্রাণের প্রমাণ দিতে যায় না। এক দল হতাশ হয়, অন্য দল নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করে। একটা পরিপূর্ণ শব্দ ওর মুখ থেকে যে বের করতে পারবে, সে যেন গ্রামে বীরের মর্যাদা পাবে! আমরা যখন একঘেয়ে দৃশ্যে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম, তখনই আমাদের মধ্য থেকে বোমাটা ফাটাল কেউ। স্পাই! দেখোগে ভারতের স্পাই। বোবা-পাগলের ছদ্মবেশে তথ্য নি’ পালাচ্ছি। কেউ একজন বলল ভিড়ের ভেতর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতা চাঙা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। মুহূর্তে সকলে যেন নিশ্চিত হয়ে গেল, লোকটি স্পাই ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। গ্রামের পশ্চিমে খাড়া মাইল ছয়েক হাঁটলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। আমাদের গোপন কোনো তথ্য নিয়ে সীমান্ত দিয়ে পালাচ্ছে বলে আমরা ধরে নিলাম। স্পাইদের নিয়ে গ্রামে অনেক গল্পের প্রচলন ছিল। একটা গল্পের কথা তখনই মনে পড়ল। এরা এমন কৌশলী ও নিবেদিত দেশপ্রেমিক হয় যে, কোনো দেশে স্পাইগিরি করতে গিয়ে বিয়ে-সংসার পর্যন্ত করে। তারপর মিশন শেষ হলে বিনা বাক্যে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে স্বদেশে ফিরে যায়। এমনভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে তাদের এই ছদ্মবেশ ধরাও যায় না। আমাদের ভেতর থেকে কেউ কেউ এরই মধ্যে পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। প্রথমেই একজন কঞ্চির মাথায় চুলগুলো পেঁচিয়ে টান মারল জোরে। নকল চুল হলে উঠে আসত। কিন্তু মাত্র কয়েকটা চুল ছিঁড়ে এল। বৃদ্ধের গায়ের রং আসল কি না, মুখে মেকআপ দেওয়া কি না, পরীক্ষা করার জন্য হাবু ভাই পেছনের গর্ত থেকে এক বালতি ঘোলা পানি তুলে ওর মাথায় ঢেলে দিল। গায়ের রং যেমন ছিল, তেমনই থাকল। মাঝখান থেকে সকলের সন্দেহটা থেকে গেল। ... ...
ছেলে বলেছিল আজ মায়ের হাতের রান্না খাবে।তাতেই নয়নতারার মাথাটা ধরেছিল। পার্টিশন! যত দোষ পার্টিশনের। না হলে এক গামলা ভাত রান্ধনের জন্য নয়নতারাকে ছেলে বৌ খোঁচা দিতে পারে? তাও যদি আরেকটা ছেলেপুলে হত। একটা মেয়ে নিয়ে দ্যাবাদেবী সারাক্ষণ আদিখ্যেতা করছে! মাণিকগণ্জের বাড়িতে নয়নতারা নিজের সাতটা ব্যাটা বেটির সঙ্গে কতগুলো ভাগ্নে ভাগ্নীও মানুষ করে ফেলেছেন। তবে ভাত রাঁধতে হত না। অতগুলো মানুষের ভাতের হাঁড়ি কি তেরো বছরের নতুন বউ সামলাতে পারে না মাড় গালতে পারে? বড় জা আর শাশুড়ি প্রায় সমবয়সী। তাঁরাই বলেছিলেন , এ বাড়িতে বউরা ভাতের মাড় গালে না। অত বড় হাঁড়ির ওজন বউ মানুষের নেওয়া নিষিদ্ধ। মাড় গালে মইনা নাগী। মণিভূষণ নিয়োগী।বাপ মা মরা ছেলে। ভাতের মাড় গালা থেকে শুরু করে তরতর করে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়া, সব পারে।এমনকী ইজারা নেওয়া পদ্মার বুকে জাল ফেলে যে কটি ইলিশ ওঠে, সবকটি ঘরে এনে তুলতে পারে মইনা নাগি। ... ...
তোমায় আমি লিখতে পারছি না, বাজার দোকান রান্নাবান্না বাসনকোসনের জঙ্গলে যেন এক বাঘ, বোঁটকা সোঁদা গন্ধের ভিতর এক নিভৃত অঞ্চল যাতে আমি শুয়ে শুয়ে বিছানায় নক্ষত্র শুঁকি, খেয়ে ফেলি তার মিষ্টি আর সুস্বাদ, টক সব গন্ধগুলো পিতলের পাত্রে রাখি,কল্পে যাবার কল্পিত... ... ...
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, কিন্তু পটলকে খুঁজে কোথাও পাচ্ছি না। এই ঘর, ওই ঘর, দোতলা, বাইরে—সব জায়গায় খুঁজলাম। “পটল! পটল!” কোনো সাড়া নেই। মনটা একটু খারাপ লাগতে শুরু করল। রাত বেড়েছে। কিন্তু পটলের কোনো খোঁজ নেই। সামনে একটা গাড়ি আসছে। নিশ্চয়ই আমার মাতাল বাপ। দরজা খুলে ঢুকল মাতাল বাপ, সঙ্গে আবার আর-একজন। জানি না আবার একে মা বলতে হবে কি না। লোকেরা মা-বাবার জন্য ছটফট করে আর আমি? আমার মা-বাবার অভাব নেই। নিজেকে কেমন যেন বিশ্বসন্তান বলে মনে হয়। জানলা দিয়ে দেখি টিয়া কী করছে। দেখি একটা সাদা কাপড়ে জড়িয়ে আছে। ওর ঘরে একটা গোল চাঁদের মতো লাইট আছে। টিমটিম করে জ্বলে রাতের বেলায়, কেমন যেন মুক্ত আকাশের খোঁজ দেয়। কোন্ এক সপ্নের দেশে নিয়ে যায়, যেখানে আমার টিয়া হয়তো তার সবুজ ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। ... ...
সইদুল তার ঘোড়াদের নিয়ে চলে যেতে যেতে একবার তাকাল ধ্রুবর দিকে। তারপর বলল, ‘আল্লার বল আর ভগমানেরই বল, দুনিয়া তো একটাই। কত জমি কেড়ে নেবে আমাদের কাছ থে? জমি থাকবে, মাঠও থাকবে। দৌড়ও থাকবে। দৌড় চললি তোর সাথে আমার মেলামেশাও চলবে। আমরা নড়বড়ে না হলিই হল।’ ঘোড়াগুলো যে পথে দৌড়ে আসবে তার দু’ধারে এখন ঘেঁষাঘেষি লোক। দূরে কলাগাছের সারির গায়ে গায়ে মানুষও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরপাড়ের উঁচু জমিতে জায়গা করে নিয়েছে অনেকে। যারা পেরেছে তারা চড়ে বসেছে আশপাশের গাছের মাথায়। দু-একটা পাকা বাড়ির ছাদেও উঠেছে। কাগজের ভেঁপু পোঁ পোঁ করে বাজছে নাগাড়ে। উত্তর দিকে, মাঠের শেষমাথায় দুটো বাঁশ দূরে দূরে খাড়া করে রাখা। তাদের মাঝখানের দড়িতে খিরীশ গাছের ছোট ছোট ভাঙা ডাল ঝোলানো পরপর। ওখানে পৌঁছতে পারলেই দৌড় শেষ। ধ্রুব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভিড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বউ, ছেলে-মেয়ে মাঠের উল্টোদিকে। দক্ষিণ দিক থেকে হইহই উঠল। দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই আওয়াজের ঢেউ ভেসে আসছে এদিকেও। ওই দেখা যাচ্ছে ঘোড়াদের। কেশর উড়ছে হাওয়ায়। খুরের দাপটে উড়ছে সাদা ধুলো আর কালো ছাই। ছিটকে যাচ্ছে ঘাস-পাতা-খড়ের কুচি। ধ্রুবর সামনে দিয়ে চলে গেল কয়েকটা ঘোড়া। তাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে যেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ধ্রুব দেখতে পেল সইদুলের মাদি ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে আসছে। তার থেকে অনেক দূরে বাচ্চাটা। এই যাঃ, পাগলি তো দাঁড়িয়ে পড়ল। আরে, সে তো উল্টোবাগে চলেছে। হলটা কী? ... ...
আমি ওর কিউরোসিটি আরও বাড়িয়ে দিয়ে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইটি খুলে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ চ্যাপ্টারটি পড়তে শরু করে দিলাম। দাদাজীর মৃত্যুর পর তার দেরাজ থেকে তরবারি হাতে জিন্নাহের একটি ছবি পাওয়া গেছিল। ছবিটি একটি প্রচারপত্র। তাতে কী লেখা ছিল তা ঠিক পড়া যাচ্ছিল না। তবে শিলা সেনের ‘মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল’ বইটিকে সূত্র হিসাবে ধরে নিলে এই প্রচারপত্রের ভাষা ছিল এই রকমঃ আশা ছেড়ো না। তলোয়ার তুলে নাও। ওহে কাফের, তোমার ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়। আমার ভাবতে বেশ অসুবিধা হয় আমার পূর্বপুরুষ কোনও একসময় এই স্লোগানটির সঙ্গে একাত্মবোধ করেছিল। কিংবা এমনও তো হতে পারে, সময়ের উত্তেজনা তাঁকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে তিনি তাঁর স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন! ‘সময়ের উত্তেজনা’ শব্দবন্ধটির প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া জরুরি। এই শব্দবন্ধটি অনেকটা মদের মতো। এই শব্দবন্ধটি এমন এক পরিসর সৃষ্টি করে যেখানে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রকে অনায়াসেই ঊহ্য রাখা সম্ভব। ‘সময়ের উত্তেজনা’ একটি নেশা, যেখানে এই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলির আচরণকে আমরা তাদের নিজেদের দ্বারা সজ্ঞানে নির্বাচিত আচরণ হিসাবে ভাবতে চাই না। যেন কোনও মাতাল সুনসান রাতে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরছে। ‘সময়ের উত্তেজনা’ লঘু হয়ে এলে, তাই, একটি নিরাপদ আস্তানার সন্ধান আমরা পেয়ে যাব, এটুকু আশা করে থাকি। কিন্তু দাদাজী কি শেষপর্যন্ত কোনও নিরাপদ আস্তানার সন্ধান পেয়েছিলেন? কেনই বা তিনি জিন্নাহের ছবিটি কুটি কুটি করে কেটে ছিঁড়ে ফেলে দেননি? ... ...