অলংকার দিয়ে লেখে কবিতা বিস্মৃতির অতলে যাওয়া গপ্পো ফাঁদে তবু তোমার নাম উল্লেখ করে না। প্যালেস্তাইন আমার এই পাহাড়ের গায়ের খুপরি থেকে কত দূরে আমার বুকে বসে খণ্ড খণ্ড করে টুকরো করার কতখানি কাছে। । ... ...
একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা। হাঁফাতে লাগলাম। অন্যদেরও মনে হয় একই অবস্থা। সৌভাগ্যই বলতে হবে তিনতলায় উঠে বাঁদিকে মোড় নিয়ে প্রথম ঘরটিতেই আমরা ঢুকলাম। বিছানায় চাদরসহ নারীটিকে নামিয়ে দিতে দিতে খেয়াল হল আমার মুখে মাস্ক নেই। মাস্কটি থুতনির নীচে বা গলায়ও নেই। কেমন করে সেটি খুলে পড়ে গেল জানি না। নার্স সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। অন্য দু-জন রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক্সপোজড শব্দটি মাথায় এল। এক্সপোজডই বটে, কিন্তু যে নার্সটি আমাকে ডেকেছিল সে আমার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর দুজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল রোগীকে নিয়ে। ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি ধরে নীচে নামলাম আমি। ল্যান্ডিং। মাস্কটিকে কোথাও দেখলাম না। ল্যান্ডিং-এর ডানদিকের ঘরে মা বসে আছে। কিন্তু সেই ঘরে ঢুকে দেখলাম মা নেই। মা কোথায় গেল? আমি যে সাংঘাতিক আতঙ্কিত হয়েছিলাম তা নয়, কারণ মা-র জন্য এই শহর খুব পরিচিত আর এইসব হাসপাতালে মা এর আগে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করেছেন। কিন্তু আমাকে ফেলে মা কোথায় যাবেন? হাসপাতালের ভেতরে যাবার কোনো সুবিধে নেই, সেখানে একজন গার্ড বসা, তাহলে কি বাইরে গেছেন? ... ...
একদিন হঠাৎ তিতি জানালা দিয়ে দেখতে পেল ওদের পাশের বাড়ির বাগানের গাছপালা কাটার তোড়জোড় চলছে। তিতি খুব ভয় পেয়ে গেল...."জাম গাছটা কেটে ফেলা হবে না তো, ওখানে যে আমার পাখি বন্ধুরা থাকে।" এক ছুটে ও বাবার কাছে গিয়ে বলল, সেন কাকুদের বাড়ির বাগানের গাছ কাটা বন্ধ করতে বলার জন্য। বাবা তিতিকে অনেক বোঝালেন, কিন্তু কিছুতেই তিতির কান্না থামানো গেল না। ... ...
দীপকদা হলে কেমন ভাবে এই খেলাটা দেখাতেন ? তিনি প্রথমে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেন। নিজের নাম বলতেন। তারপর বলতেন-- ম্যাজিক ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, হস্তকৌশল বা চাতুরী। তারপর নিজের খালি-হাত দেখিয়ে বলতেন, এই যে আমার খালি-হাত, যেখান থেকে জাদুকরেরা বের করে আনেন টাকা, রুমাল বা সিগারেট। যেমন, এই মুহূর্তে আমার হাতে এসে গেছে ফুল। তেমনি আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা মুঠো থেকে বের করেন তাবিজ, কবচ, মাদুলি। আর সেসব সাধারণ মানুষের হাতে দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে পাশ করে যাবে, আপনার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরাও কিন্তু আমার মতই জাদুর কারবারি। কিন্তু এঁরা কিছুতেই তা স্বীকার করেন না। বদলে নিজেদের বাবা, যোগী বা গুরু বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। জাদুকর মাত্রেই জানেন, ব্লেন্ডো খেলাটি হল চারটে ছোটো রঙিন রুমালকে মিলিয়ে, একটি চাররঙা বড়ো রুমালে পরিণত করার ম্যাজিক। কিন্তু দীপকদা চারটি চাররঙা রুমালকে, একটি কাগজের রোলের মধ্যে ভরে দিয়ে ,যখন ম্যাজিক করে তাদের জুড়ে দিয়ে একটা মস্ত বড় রুমাল বের করেন, যাতে ওই সব রঙই রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের একজাতি-একপ্রাণ- একতার গান বেজে ওঠে। তাই এইসব ম্যাজিক মানুষ বহুকাল ভালবেসে মনে রাখেন। ... ...
ভিড়ভাট্টা যে হয়না তা নয় তবে ‘উত্তেজিত মাতাল’ সবিশেষ আসে না। এদের অনুশাসন কড়া। আর চাট বলতে মিলবে শুধুই ফল। তবে এ স্থানটি সঙ্গীত মুখর। মূলত মহঃ রফির গানে এই ঠেক ভরে থাকে। এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটু পেছনো যাক। যদিও এ সব রচনা মাতলদের পদক্ষেপের মতোই। এগিয়ে পিছিয়ে চলে। একটা সময় খালাসিটোলায় আসতো জন। ফর্সা টুকটুকে চেহারা। নিজেই রফির গান গাইতো। সঙ্গে নাচতো। সে নাচ ছিল দেবদর্শন দুর্লভ। মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত বাংলা গান গাইত – ‘ আমার এল না এল শ্যাম/আমার হলো না মালা গাঁথা’। আর ছিল যাদব। গোটা ঠেকটা ঘুরে বেড়াতো। ... ...
আমার মনে হয় ২০২০ দেখে আমরা বুঝতে পারি মানুষ ইচ্ছে করলে কঠিন সময়েও প্রায় সব কিছু করতে পারে। ... ...
সেদিন কবুতর দুটো উড়তে পারছিল না। একটার মাথা থেকে ময়ূর-পেখমের মতো নীল পালক ক্রমান্বয়ে হালকা হতে হতে লেজ অবধি সাদা। গলার কাছে ফোলা ফোলা গাঢ় নীল পালক। আরেকটা কবুতর ছিল দুধসাদা। দুটো কবুতরের ডানাতেই লাল স্কচটেপ আটকানো ছিল। কবুতর জোড়া ফরিদ ভাইয়ের কাছ থেকে কিনেছিলাম আমি। দাম ছিল আশি টাকা। ফরিদ ভাই কিছুতেই দাম কমাচ্ছিল না। আমার সৎ মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সেদিন সকালে একশ টাকা সরিয়ে ছিলাম আমি। ফেরার সময় লাতু কাকার ‘দি হাতেখড়ি বুকস্টোর’ থেকে একটা স্কচটেপও কিনেছিলাম। ... ...
প্রথমদিন তোমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে লেগেছিল হার্ডলি সাঁইত্রিশ সেকেন্ড, কিন্তু মাথার অ্যালবামে পজ বাটনের প্রিভিলেজ আছে। কারও রসিকতায় হেসে ওঠার মুহূর্তটায় তোমাকে স্থির করে দিই। ঠোঁট নয়, গলা নয়, শরীরের ভরকেন্দ্র থেকে ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে এসেছে তোমার হাসি যেমন আসে, কক্ষপথ থেকে ছিটকে দেয়, পতন সামলাতে তোমাকে আশেপাশের কাউকে বা কিছুকে আঁকড়ে ধরতে হয়। এগিয়ে যাই। এত কাছে যাতে আমার নিঃশ্বাসে তোমার ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল উড়তে পারে। প্রদক্ষিণ করি। মনোযোগ দিই গ্রীবার বাঁকে। বোজা চোখের পলকে। দাঁতের সুসংবদ্ধ শুভ্রতায়। জিভের গোলাপি আভায়। কাঁপুনি ধরে প্রতিটি রোমকূপে। শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর জাগে। জানালার ওপারে আমগাছের মাথায় গনগনে চাঁদ। পূর্ণিমা আসন্ন, বা সদ্য গত। সে গলন্ত সোনার আঁচে শুয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ছাই হয়ে যাই। ... ...
পায়ের তলে পদ্মরেণু, মুঠোয় গহন দীঘি চোখের ভিতর উড়ছে আকাশপ্রদীপ আফ্রোদাইতি,ম্যাজিক ছিলো,তোমার গ্রীবাস্থলে ... ...
"ওই দ্যাখ, খাল পরিষ্কার করার একটা লোক পাঁকে পড়ে আর উঠতে পারছে না," কে যেন চিৎকার করে উঠল। সদ্য ঘুম ভাঙা মুখগুলো অমনি একসঙ্গে ঘুরে গেল কাদাজলে ভরা খালটার দিকে। দু'দিন তুমুল বৃষ্টির পর যেটা কানায় কানায় ভরা আর ময়রার দোকানে সদ্য তৈরি গরম রাবড়ির ট্রে-র ওপর থেকে ওঠা অল্প সাদা ধোঁয়ার মতো যার পুরোটা জুড়ে উঠছে তীব্র দুর্গন্ধের ভাপ। এমনিতেই কেষ্টপুর খালের ধারের বস্তিগুলোর ঘুম ভাঙে অনেক সকালে, কল আর পায়খানার দখল নিয়ে মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ঢালু পারে জায়গা প্রচুর, কিন্তু আব্রু নেই। তাই ওখানে কেবল বাচ্চা আর পুরুষ মানুষের ভিড়। ঝগড়াঝাঁটি ক্যালোর ব্যালোর লেগেই আছে। তার ওপর আবার একটা জলজ্যান্ত মানুষ খালে নেমে দ্রুত পাঁকে ডুবে যাচ্ছে, এই নতুন উত্তেজনায় গোটা বস্তি ভেঙে পড়ল খালের ধারে। কারও হাতে নিমডালের আধ খাওয়া দাঁতন, কেউ সেফটিপিন আটকান ব্লাউজের ফাঁকে ঝুলে পড়া মাই চোষা বাচ্চা কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে, সোমত্ত মেয়েরা নজর আটকাবে বলে ব্রা হীন নাইটির বুকের ওপর আলগোছে গামছা ফেলে রেখে ঝুঁকে পড়ে ডুবন্ত লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই আবার ঘরের খেয়ে বনের মোষ-চরানেরা দৌড়ে গেল পুজো প্যান্ডালের পাশে রাস্তা আটকে ফেলে রাখা লম্বা বাঁশ আনতে। ... ...
বাড়ি ফিরে আরেক প্রস্থ ঝামেলা। ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায়ই বিজনবাবু। সব্য তখনও গাড়ি থেকে নামেনি, ভালো করে নাকি পার্ক করছে। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে শমিতা, তখনই বিজনবাবু। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। বয়স্ক মানুষ, ওদিকের ফ্ল্যাটে থাকেন। খুব যে দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়, তা নয়। কিন্তু আজ শমিতাকে দেখে কীরকম আশ্বস্ত হন মনে হয়। - আপনি বাড়ি ছিলেননা না? শমিতা বলে, না, এই তো ফিরছি। - ও। আসলে আমি একটু গিয়েছিলাম। - কোথায়? - আপনাদের ফ্ল্যাটে। আপনারা কেউই ছিলেননা না? শমিতা একটু অবাক হয়ে বলে, এই সময় তো কোনোদিনই আমরা থাকিনা। - সে তো জানি। বিজনবাবু চিন্তিত গলায় বলেন। - আসলে ওদিকে একটা আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম চোর-ডাকাত নাকি। একবার নক করে দেখি। যা দিনকাল। ... ...
এর এক সপ্তাহ পরে ক-র বাড়ি গিয়েছিলাম। ওনার স্ত্রী, যিনি আমাকে নিকট আত্মীয় ও আপনজনের মতো দেখতেন, তাঁকে বললাম হোমিওপ্যাথির বাক্সদুটো দেখব। উনি বাক্স নিয়ে এলে পরে ডালা খুলে দেখলাম এখনো প্রতিটি বাক্সে দুটো করে চিরকুট রয়ে গেছে। চারটে চিরকুটেই লেখা ‘বিয়ে নয়’। ক-র দর্শন নিয়ে যে গবেষণা বন্ধ করেছি তা নিয়ে আর ক্ষোভ হল না, ভাবলাম ক আসলে ভাল দার্শনিক ছিলেনই না। উনি বলতেন স্বাধীন চিন্তা ও অদৃষ্টবাদ দুটিই বিভ্রম, কিন্তু সেটা যে বিভ্রম নয় তা প্রমাণ করতেই হয়তো আমি রেবাকে বিয়ে করেছিলাম। আমার স্বাধীন চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করতে যে আমি যে এটা করব সেটা ওনার বোঝা উচিত ছিল। ক নিজের দর্শনে বিশ্বাস না করে নিম্নমানের এক পদ্ধতিতে আমাকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন, যৌন-নিপীড়করা বোধহয় তাদের বৌদ্ধিক দর্শন জীবনে আরোপ করতে পারে না। ফিরে এসে রেবাকে কথাটা বলতে ও বলল, “তাহলে ক সবকটা চিরকুটে ‘বিয়ে’ লিখলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে না – শুধুমাত্র তোমার স্বাধীন ইচ্ছার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে?” ... ...
আমি শহরের এই বিশেষ ট্রাফিক সিগ্ন্যালে নিজের নাম রেখেছি উদার মহিলা কারণ বাকি সব্বাই এমনিই ভিক্ষা দেয় আমি দিতে পারলে কপালে হাত ঠুকি দিতে না পারলে মুখে একটা চুক শব্দ করি রাধা নির্বিরোধে সরে যান যেন অপারগতা বোঝেন স্টিয়ারিং থেকে হাত সরাবার আলস্য আমার এই উদারতা শস্তা মাত্র পাঁচ ছ টাকায় এই ট্রাফিক সিগন্যালে যেখানে মূত্রশালা ও গন্ধ প্রবল যখনই একটা লম্বা সিগন্যাল পড়ে আর গাড়ি আটকে যায় আমার উদারতা লেখা থাকে ... ...
রাজুর সাথে দু মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে নষ্ট হয়েছে তাতে রাজুর উপর পূরবীর পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। অনেক বার গোপনে আলোচনা হয়েছে মা মেয়েদের ভেতর। পূরবী ছাড় দিতে চাইলেও ওরা ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পূরবী প্রশ্ন তুলেছে, তোরা কেন এখন কনজারভেটিভ হচ্ছিস ? তোদের বাবার কি অধিকার নেই স্বাভাবিক জীবন যাপনের ? একজন পঙ্গু, খোঁড়া স্ত্রীর সাথে আর কতকাল সে থাকবে? এটা জোর অন্যায় হচ্ছে। তোদের বাস্তবতা বোঝা উচিত। ... ...
জাবেদা, রুমেলা, ফতিমা মেয়েটাকে ছেঁকে ধল্লো। পতমত একুন তো হিঁদু মেয়েছেলে মোসলমান মেয়েচেলে আলেদা করা যায় না। বড়ঘরের হিঁদু মেয়েচেলেরাও সিঁদুর পরেনা, শাকা পরে না। আর গরিবঘরে নিয়মমতো হিঁদু মোসলমান মেয়েচেলে আলাদা করাই যায় বটে কিন্ত একুন সবার মুকে ত্যানা। মাতায় মোসলমান মেয়েমানুষের মত কাপড়জড়ানো। এ মেয়েটার হাত ফাঁকা। এমনিতেই হিঁদু না মোসলমান? জাবেদা হাত ধরে জোরে ঝাঁকালো। ... ...
কৌশিক বাজারীর চারটি কবিতা ... ...