চলার গতি বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে কোমরের দুলুনি। ওই দুলুনি জল বাঁচানোর জন্য। জল, খাবার জল। এই সোঁদরবনের গাঁ গেরামে বড়ো মহার্ঘ এই জল। কেউ একফোঁটা খরচ করে না অকারণে। করতে নেই। কেননা জল এখানে মাথা কুটলেও মিলবে না কোথাও। কেমন মজা বোঝো! মজাটি নিয়ে শরিফা আর ওর মিতেনি জীবন ঢালির বউ নেকি এক সময় খুব হাসাহাসি করত। জলের দেশের মেয়ে ওরা। জলের অভাব ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। মুখে বলেও, ধুস তাই আবার হয় নিকি! ভাত নি, কাপড় নি সে তো বুঝি, তা বলে পানি নি! শরিফার স্বামী ময়জুদ্দি হেসে বলে, হয় হয়। এটাই তো মজা র্যা। সোঁদরবনে পানি আছে, তবে লোনা, খাবার পানি খুব কম। হ্যাঁ, দেখেছে শরিফা, উলার চকে আট-আটটা টিউকল বসল। পানি উঠল বালি গোলা। খাওয়া দূরে থাক, মুখে দিলে ওয়াক থুঃ। পুকুরের পানি! সে তো তিন-চার মাস। খেলে পেটে ঘা হয়। বলে আর্সেনিক। তবে পানি কোথায়! হুই ডাঁসা নদী পার হও। ভবানীপুরে ডিপ টিউকল করেছে পঞ্চায়েত। সেখান থে পানি নে এসো। কিন্তু যাবে কীভাবে? বড়ো বাধা যে নদী। ছোটো-বড়ো নাও যা আছে, সব মাছ মারতে যায় বাদায়, চালানি যায় হাসনাবাদে। দু-একখানা নাও যা আছে, সেখানে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। কলসি-বালতি পিছু এক টাকা, নগদা-নগদি। টাকা দাও আর পানি নাও। কার আছে পয়সা! উলার চকের মানুষের চাষবাসের উপর জীবন। ছ-মাস কাজ, বাকি সময় জোন খাটো, নাও চালাও নয়তো বিশপুরের হাটে মাল বও। না হলে উঞ্ছবৃত্তি করে চালাও। তাই পানি নিয়ে চলে টানাপোড়েন। কখনও মারপিট, মেয়ে হলে ইজ্জতের উপর হামলা। অনন্ত ঢালির বউ আয়না এক কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে শরীরের রং ঢং দেখিয়ে মাঝিদের বশ করে পানি আনত। কিন্তু রসিক মাঝি সেয়ানা খুব, সুযোগ বুঝে একদিন হামলে পড়ল ওর উপর। আর আয়নাও তেমনি৷ ইজ্জত বাঁচাতে দিল হালের বাড়ি কষিয়ে। এক ঘায়ে কাত রসিক। আয়না এখন জেলে। ওর রুগ্ন ছেলেটা মা মা বলে উলার চকের আকাশ বাতাস ভারী করে চলেছে। ... ...
গোপন কথাটি রবে না গোপনে এমন তো নয় যে আমেরিকা সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার ইজারা নিয়েছিল কোনোদিন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল তখনও আমেরিকা একবারও মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদের ধার কাছ দিয়েও যায়নি কেন? সামান্য হিপোক্রেসিও কি আশা করা যেত না? লেখক বাস তিনটি কারণ বলেছেন। প্রথম দুটি গৌণ। প্রথমত, নিকসন আর ইয়াহিয়া, দুজনের কেউই যখন নিজের নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তখন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা ছিল। নিকসনের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের যে টেপ পাওয়া যায় তাতে দুজনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে একাধিক বার। দ্বিতীয়ত, নিকসন, ইন্দিরা গান্ধিকে রীতিমতন অপছন্দ করতেন। রাশিয়ার সাথে মাখামাখি, ইন্দিরা সোস্যালিস্ট ঝোঁক—শুধু এগুলিই নয়। মানুষ হিসেবেই ইন্দিরাকে নিকসন পছন্দ করতেন না। এর আগে একবার দুজনের মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে মিনিট কুড়ির জন্য। ইন্দিরা নাকি যথেষ্ট উৎসাহ তো দেখানইনি, তায় তাঁর এক সহকর্মীকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, “এ আরও কতক্ষণ টাইম নেবে?” নিকসনের আর-এক পরামর্শদাতার মতে নিকসন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো মহিলাকে হজম করতে পারতেন না। তো সে কথা বলতে কী, নিকসন গোটা ভারতীয় জাতিকেই অপছন্দ করতেন, বলেছিলেন ভারতীয়রা ‘Slippery and treachorous’। পাকিস্তান ও তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশংসাই বরাদ্দ ছিল। ... ...
ছড়া মূলত গ্রাম্য সাহিত্য, মানুষ তাদের বাচিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ছন্দোবদ্ধ ভাবে কথা বা মনের ভাব প্রকাশ করে এই ছড়ার মাধ্যমে। আবার এই ছড়াগুলি পরম্পরায় প্রচলিত ও প্রচারিত। আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এইসব ছড়ার পাঠভেদও দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইসব ছড়া গুলি কে, কবে রচনা করলেন তা কেও জানে না, কিন্তু সমাজে এগুলি চিরকাল ধরে প্রচলিত। ব্যক্তিক সৃষ্টির এরকম সার্বিক স্বীকৃতি খুবই বিরল। এই ছড়ার রূপরেখা দেখলে বোঝা যায় প্রায় সব এলাকাতেই ছড়া মূলত দু’রকম- ছেলে ভুলানো ছড়া ও সর্বজনীন ছড়া। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছেলে ভুলানো ছড়া, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় পুরুলিয়াতে প্রচলিত ছেলে ভুলানো ছড়া। ... ...
নাজমা বিকেল হলে দোতলার ছাতে আসবে। তারিক একথা জানে। তিতুও। এছাড়াও তারিক জানে, নাজমা স্কুলে কখন বেরুবে, আর, সেই সময়ে তার গায়ে থাকবে একটা অব্যর্থ লালচে টিউনিক। ওই সময়ে, নাজমা, তিতুকে সে বলেছে, একদম নীলমের মাফিক। নীলম, নীলম। চাংকি পান্ডের হিরোইন। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো পরিহিত হিলহিলে চাংকি। ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে হাসতে হাসতে নাচে নীলম। উজ্জ্বল নীলম। লাল ফিতে চুলে বাঁধা থাকে তার। গায়ে লাল ফ্রক। পায়ে যেমন জুতো থাকে সেরকম জুতো সে যদিও নাজমার পায়ে দেখেনি। সত্য বোসের বেটি পরে অমন হিলতোলা জুতা, অমন ফ্রক। কিন্তু, দশটায় টিউনিক গায়ে যখন নাজমা বেরুবে, তখন সে আদতে নীলম। ওই সময় তার পথের একপাশে বসে থাকবেই তারিক, হয় হরলালের পুকুরের ধারে, নয় রাস্তাটা যেখানে বাঁক নেয়, সেই তুঁতগাছের নীচে, কোনোদিন তিতু সঙ্গে থাকবে, কোনোদিন সে একা, কিন্তু ওই সময়ে নাজমার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখবেই তারিক। একই দৃশ্য, তবুও কেন যে নতুন মনে হয়! তার যাওয়ার পরে সঙ্গে তিতু থাকলে তারিক বলবেই, কেমন দেখলি, আজ? আর হয়ত এমনই চাপাগলায় কথাবার্তা হবে তার ও তিতুর: ... ...
দুর্গাপুজোর সময় থেকেই আপনারা নিশ্চই এরকম অনেক ছবি দেখেছেন যেখানে মডেলরা বিভিন্ন দেবীর সাজে ছবি তুলেছেন। সেরকম কিছু ছবি দেখে আপনারা নাক সিঁটকেছেন, কিছু দেখে ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন. কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এই লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলি আছে সেরকম আপনারা আগে কোথাও দেখেননি। কেন বলুন তো? এই ছবিগুলোর যিনি মডেল তিনি কোনো মহিলা নন বরং একজন পুরুষ। তাঁর নাম সৌরভ গোস্বামী। কী, একটু চমকে গেলেন তো? চমকানোরই কথা! এই চমক, এই ব্যতিক্রম দিয়েই শেষ হল এবারের উৎসব সংখ্যা। ... ...
গত শতকের শেষ আর চলতি শতকের শুরুর দিকে কলকাতা ও আশপাশের মফস্সলে রাতারাতি প্রায় স্ক্র্যাপের দরে বিক্রি হয়ে যেতে থাকল লেটারপ্রেসগুলি, তার জায়গায় ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে উঠল ডিটিপি ইউনিট। আপাতভাবে মনে হবে, তাতে তো ভালোই হল। ঠিক, কিছু ভালো হলও। মুদ্রণের শ্রম কমল, সময় কমল, হয়তো খরচও খানিক কমল। প্রযুক্তির যে ব্যবহারিক সুফলগুলি অবশ্যকাম্য। কিন্তু এই যে মুদ্রণ ব্যাপারটিকে ‘আপাতভাবে’ বেশ সহজ মনে হতে লাগল, মনে হতে লাগল চাইলেই ছাপাছাপির ছোটোখাটো ব্যাবসা শুরু করে ফেলা যায়, এমনকী পাঞ্জাবি পরে সম্পাদক বা প্রকাশকও হয়ে ওঠা যায় বেমালুম, তাতে ঠিক কী কী ক্ষতি হল বাংলা বাজারে, তা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো একটু অশ্লীলই হবে। সে-প্রসঙ্গ থাক বরং। তবে, গ্রুমড হওয়ার, শিক্ষানবিশি করার, হাতে-কলমে কাজ শেখার প্রসঙ্গ যে একপ্রকার উঠেই গেল, তা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা যায়। ... ...
“আপনার ভূতের ভয় নেই?” প্রশ্ন করল মায়া। “না, আমার কোনদিন-ই ভূত প্রেতের ভয় নেই। আমি বরং খুশি হতাম ওর ভূত যদি এসে বলে যেত ও আত্মহত্যাটা করল কেন।” হালকা সুরে বলল অনন্ত। কাণ্ডটা দেখো, ভাবল সত্যার্থী, গল্প শুরু হতেই সেই ত্রিদিব সামন্তর কথা এসে পড়ল। না কি মায়াই সূক্ষ্ম কৌশলে গল্পকে সেই পথে ঠেলে দিচ্ছে! "সেই, ওনার ভূতই সম্ভবতঃ বলতে পারবে কেন করেছিলেন ঐ কাণ্ড,” বলল অপালা, “সাধারণ মানুষের ব্যাখ্যার অতীত।" "হ্যাঁ, ওটা আর কোনদিন জানা যাবে না। বহুবার আলোচনা করেও এ ঘটনাটার কোন ব্যাখ্যাই আমরা কখনো খুঁজে পাই নি। একেবারে ব্যাখ্যার অতীত যাকে বলে।" - হাত পা নেড়ে প্রবল ভাবে নিজের মত জানালেন সমর। "তাই ভাবছেন?" উস্কে দিল মায়া। "ভাবাভাবির কিছু নেই আর।” বলল সমর, “পুরো ঘটনাটাই অভাবনীয়। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল একটি লোক, সাফল্যের চূড়ান্তে রয়েছে, পুরনো বন্ধুরা মিলে দিব্যি গল্প-গুজব করছি সবাই, হ্যাঁ অন্তত পাঁচ-ছজন ছিলাম আমরা সেই রাতে। ভবিষ্যতে কী কী করতে চলেছে তাই নিয়ে তার কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। সেই লোক ডিনার টেবিল থেকে উঠে তিনতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিসের জন্য? খোলা বারান্দা টপকে নীচে লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে মরে যাওয়ার জন্য! কেন? কিসের জন্য? কোনদিন আর সেটা জানা যাবে না। কোনদিন না।" "কোনদিন জানা যাবে না কথাটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না, সমরবাবু?" হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল মায়া। সমর অবাক হয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে। "বুঝলাম না। কী বলতে চাইছেন আপনি?" "একটি সমস্যা এক সময় সমাধান করা যায়নি মানে কি কোনদিনই আর সমধান করা যাবে না?" "হাঃ! দেখুন মিস মূর্তি, যে সমাধান সেইদিন বের করা যায়নি, আজকে, দশ বছর বাদে সেই সমাধান আপনি খুঁজে বার করবেন?" মায়ার মুখের মৃদু হাসি একটু ছড়িয়ে, কৌতূকী বাঁক নিয়ে আবার আগের অবস্থানে ফিরে এলো। “ইতিহাস কিন্তু তাই বলে সমরবাবু। আমাদের দেখাগুলো একান্তই আপেক্ষিক। ঘটনাকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার দরকার পরে। তিনটে মাত্রায় ঘটনাকে পুরো দেখা যায় না। চতুর্থ মাত্রাটিকে জুড়তে লাগে – সময়। চার মাত্রার ক্যানভাসে সমস্ত উপাদানগুলো ঠিকঠাক মতন বসে পুরো ছবিটা ফুটিয়ে তোলে।” অলক সেন এই সময় সামনের দিকে ঝুঁকে এল, যেন বিলাপ করে গলা ভেঙ্গে গেছে এমন হাহাকারের স্বরে বলে উঠল - ... ...
মারাঠীতে নাকুশা মানে নাকি অবাঞ্ছিত বা অপয়া, বিনীতা বলেছিল। নাকুশার মা তখন ওদের ঘর ঝাড়ুপোছা আর বাসন সাফ করত। তারপর তো মা’টা মরেই গেল আর নাক্কিকে এলাকার এক কর্পোরেটার লাগিয়ে দিল পাহাড় পাতলা করার কাজে। চুপচাপ গিয়ে রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠে মাটি কেটে কেটে জমা করবে আর হপ্তায় একদিন কর্পোরেটারের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে জমা করা মাটি। এমনি করে করে পাহাড়টা যখন রোগা হয়ে যাবে, বেঁটে হয়ে যাবে, পাহাড় বলে আর চেনা যাবে না, তখন কর্পোরেটার এসে সেখানে মস্ত আলিশান সব বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। নাক্কিয়া তদ্দিনে বড়সড় হয়ে সেই সব বাড়িতে কামওয়ালি বাঈ হয়ে কাজে লেগে যেতে পারবে, চাই কি বিয়ে শাদিও হয়ে যেতে পারে। ... ...
শিউলিকে বোঝাতে পারি না, যা দেখি তা নয়—সত্য তাই যা আমরা দেখি না। সে তখন হো হো করে হাসে। বলে, তুমি সেই তেমনি রয়ে গেলে—আগের মতই। পাল্টালে না, বদলালে না—এমন লোককে নিয়ে আর পারি না। ওকে বলি, এমন কথা তো ছিল না শিউলি। কথা ছিল, তোমাকে একটি নদী উপহার দেব। সঙ্গে একটি নৌকা। নদীতে ভেসে যাবে নৌকা, জলের উপর সূর্যাস্তের আলো—এমতাবস্থায় কত পাখি উড়ে যেতে পারে আকাশ দিয়ে—কল্পনা করে দ্যাখো একবার। ও বলে, আমি কল্পনা করতে পারি না। তুমি যা তোমাকে আমি তাই দেখি। দেখি শুনি, একা-একা কথা বলি। তার মধ্যে নদী নেই, সূর্যাস্ত নেই, নৌকা নেই। মাটির দোতলাবাড়ি’র পিছনে আমাদের চাষজমি। আমরা সেখানে মৌরি চাষ করি। ধনে আর জিরে। এই যে চাষজমি, এই যে চাষজন্ম—যেন তা আমাদের হাতে আছে অনন্তকাল। চাষ করতে করতে আমরা যখন সেই মাটির নীচে চলে যাই—দেখি সেখানে প্রাচীন জ্যোৎস্নাসকল পড়ে আছে। আর আমি অবাক হয়ে যাই শিউলির কথায়। এই তো কী সুন্দর কবিতার মত কথা বলে সে, কবিতার মতন চলন তার—কবিতার মত জীবন। অথচ সে বলে, আমি কবিতা লিখতে পারি না, কারণ আমি তা লিখিনি কখনও। কবিই সত্য আর জগত মিথ্যে—একথা তাকে বোঝাতে পারি না। সে একপাক ঘুরে গিয়ে বলে, ওসব হল তোমার কল্পনা। কবি হয়েই হয়েছে তোমার মুসকিল। জানো তো, কবিরা গজদন্তমিনারে বাস করে? আবোলতাবোল লেখে—আসলে ওসব কোনো কবিতাই নয়! অবাক হয়ে বলি, এসব কী বলছ তুমি শিউলি? জানো আমি কী ঠিক করেছি? এই গোটা ডিসেম্বর মাসটা তোমাকে উপহার দিতে চাই। একী কম কথা হল? হাত উল্টে শিউলি বলে, ঠিক আছে, দিলে না-হয়—কিন্তু তার পর? এই গোটা ডিসেম্বর নিয়ে আমি কী করব? ডিসেম্বরের সমস্ত শিশির আমার গায়ের উপর ঝরবে। সমস্ত শীত আমাকে কাঁপাবে। প্রজাপতিরা আমার গায়ে বসবে। বলো, তখন আমি কী করব? ... ...
বাঙালির ব্যবসার ইতিহাসে প্রথম যে বিদেশীরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বর্ধিষ্ণু বাংলার বিখ্যাত বন্দর চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে গ্রামে ব্যবসা করতে আসে, তারা হল পর্তুগীজ। পর্তুগীজরা বাংলায় এসেছিল ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তারও বছর কুড়ি আগে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে এদেশে অর্থাৎ ভারতবর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল ভাস্কো-ডা-গামা। যদিও এর অনেককাল আগে থেকেই বাংলার বণিকেরা পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপে। তা হলে বাঙালির ব্যবসার বিমুখতার কথাটা চালু হলো কবে? মোটামুটি ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে কথাটার সূত্রপাত অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে। এর প্রধান কারণ বিদেশী বণিকদের কুচক্র। বাঙালি বণিকের জয় গান শোনা গিয়েছিল গুপ্ত যুগেরও আগে, ফা-হিয়েন এর ভ্রমণকালে, অর্থাৎ ৩৯৯ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দের সময়ে। সমুদ্রবন্দর তাম্রলিপ্তের রমরমা তারও আগে। কালিদাস, পাল যুগের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্য, মনসামঙ্গল, কবিকঙ্কণ, ডাক ও খনার বচনে বাণিজ্যনিপুণ বাঙালির জয় গান শোনা গেছে। সবই তো আর কবির কল্পনা নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, বাঙালি কোনোকালেই ব্যবসাবিমুখ, অলস বা ফাঁকিবাজ ছিলনা। ফা-হিয়েন এর লেখা থেকে জানা যায়, তাম্রলিপ্ত থেকে ১৪ দিনের পথে সিংহল পৌঁছে যেত বাঙালি বণিকের দল। মুক্ত ব্যবসায়ী বণিকেরা, তেজপাতা পিপুল মসলিনের সওদাগরেরা এই বন্দর থেকেই বিদেশ রওনা হতেন। পান সুপারি ও নারকেলের চাহিদাও ছিল প্রচুর। তখন থেকেই 'সোনার বাংলা' কথাটা চালু। সোনার বাংলা এমনি এমনি বিনা পরিশ্রমে গড়ে ওঠেনি। যুগ যুগ ধরে বাংলায় ব্যবসা করতে বিদেশীরা বিনা কারণে আসেনি। ‘সোনার বাংলা’র কথা তারা জেনেছিল বাংলার বণিকদের কাছ থেকেই। ... ...
না এত সব করেও কিছু ত্রুটি বেরল না বিদিশার। কিন্তু তার থেকে কি ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে বিদিশা সুস্থ্? না, তা না এসে তারা উল্টে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে ওর অসুখটা আসলে মানসিক অসুখ। এবং রেফার করে দিলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে। সেখানে গিয়ে কী বলবে বিদিশা? বুকের মধ্যে দিব দিব করছে অতনুর। কী এমন করেছে অতনু? একটা কাজ কি ঠিক ভাবে করতে পারত বিদিশা! নিজের ব্যাঙ্কের আকাউন্ট নাম্বারটা পর্যন্ত ঠিক করে জানেনা সে, তাকে কোন কাজ ছেড়ে দেওয়া যায়? তুমি পারবে না বলে সব কাজ হাত থেকে টেনে নিয়ে করে দিয়েছে অতনু, সেটাই তার দোষ হয়ে গেল! ছেলেকে পড়ানো থেকে রান্নাবান্না সব কাজে সে উদাস, ছন্নছাড়া। তাই হয়ত অতনু তুমি পারবে না বলে একটু ধমকে উঠেছে, হয়ত একটু বেশিই ধমকেছে তাই বলে এমন প্রতিশোধ নেবে বিদিশা! ... ...
শাহজাহানের জমানাতেই আমি অন্তত প্রথম বাকরখানির মোটামুটি প্রামাণ্য রেসিপি পাচ্ছি। নুসখা-ই-শাহজাহানি-র ১২৬৩ হিজরি অর্থাৎ ১৮৪৬ সাধারণাব্দের একটি অনুলিপি বা কপি থেকে। মনে রাখা দরকার, এটি মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন পুথির ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। মূল কেতাবটি যুগে যুগে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের জন্য কপি করা হত, এবং প্রায়শই প্রথম কপিটি হারিয়ে যেত। তাই আজকের দক্ষ সম্পাদককে তার বিভিন্ন কপি অনুসরণ করে একটি গ্রহণযোগ্য রূপ তৈরি করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু তাতে তো নামের উৎসের ধাঁধার সমাধান হল না। ময়দা, দুধ, ঘি, ডিম দিয়ে তৈয়ার এ রুটির নাম বাকরখানি কেন?শাহজাহানের জমানাতেই আমি অন্তত প্রথম বাকরখানির মোটামুটি প্রামাণ্য রেসিপি পাচ্ছি। নুসখা-ই-শাহজাহানি-র ১২৬৩ হিজরি অর্থাৎ ১৮৪৬ সাধারণাব্দের একটি অনুলিপি বা কপি থেকে। মনে রাখা দরকার, এটি মধ্যযুগীয় বা প্রাচীন পুথির ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। মূল কেতাবটি যুগে যুগে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের জন্য কপি করা হত, এবং প্রায়শই প্রথম কপিটি হারিয়ে যেত। তাই আজকের দক্ষ সম্পাদককে তার বিভিন্ন কপি অনুসরণ করে একটি গ্রহণযোগ্য রূপ তৈরি করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু তাতে তো নামের উৎসের ধাঁধার সমাধান হল না। ময়দা, দুধ, ঘি, ডিম দিয়ে তৈয়ার এ রুটির নাম বাকরখানি কেন? ... ...
টিভির সিরিয়ালের তো শেষ নেই। একটার পর একটা শুরু হয়। আমার শাশুড়ির মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই ওনার পাশ থেকে উঠে রিডিংরুমে চলে যাই। সে শুধু নামেই রিডিংরুম। মূলত কম্পিউটারে কাজ করতেই সেই রিডিংরুমে যাওয়া হয় বেশি। তাই বলে রিডিংরুমে বই নেই তা কিন্তু নয়। তবে এক আলমারি বইয়ের ধুলা শেষ কবে ঝেড়েছি তা অবশ্য ভুলে গেছি। আমি এরপর অভ্যাস মতোই গিয়ে কম্পিউটার অন করি। এরপর অফিসের কিছু পুরাতন ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে স্মৃতি রোমন্থন করি। গা গোলানো ভাব তখন একটু কমে এসেছে। আমি জীবনে সেসময় সদ্যআগত ফেসবুকে আয়েশি ভঙ্গিতে লগইন করি। তখনও ফেসবুকের প্রতি খুব একটা আগ্রহ তৈরি হয়নি। সেসময় পর্যন্ত মনে হয় কেউই ফেসবুকের অতল জগতের আহ্বান বুঝে উঠতে পারেনি। ... ...
বিজু স্কুলে এসে জানতে পারলো হেডস্যার আসতে পারেনি। তার নাকি জ্বর। কাল কোন এক স্যার চাল বিলির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজ তারা খাবে কী? রান্না হবে কি দিয়ে? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজু যখন বাড়ি ফিরলো বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। বাবা দাড়ি কামিয়ে, চান করে, আলমারী থেকে জামা কাপড় বের করে, পরে, রেডি হয়ে বসে আছে। বিজুকে দেখতেই বাবা বললো তাড়াতাড়ি চান করে নে বিজু। একটু পরেই আমরা বেরিয়ে যাবো। গনেশ কাকু গাড়ি নিয়ে আসবে। বিজু তো অবাক। কোথায় যাবো আমরা বাবা? বাবা বলে সেও জানে না। কোন একটা জায়গা। শ্যুটিং দেখবো। বিজুর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফিল্মের শ্যুটিং বাবা? বাবা ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁরে ফিল্মের শ্যুটিং। বলেছে নাকি শ্যুটিং দেখাবে। খেতে দেবে। চল চল দেরি করিস না। ... ...
যদিও সব কাঠই চালান যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে, যদিও সব করাতই সরবরাহ করে শহর, যদিও শহুরে মুনাফা কোনোদিনই সংগত করে না এখানকার সস্তা শ্রমের, তা বলে কোনো শহরকে তো কাঠচোর শহর বলা যায় না! কেন-না শহর মানেই সভ্যতা। সভ্যতা মানেই বিপ্লব। বিপ্লব মানেই অগ্রগতি। অগ্রগতি মানেই মানুষের ক্রমমুক্তি। তাকে তো আর যা-ই হোক কাঠচোর উপাধি দেয়া যায় না। দিলে নিজের মুখেই থুতু পড়ে, উত্তর পুরুষের বাড়া ভাতে ছাই পড়ে, পূর্ব পুরুষের কথাসাগর নিমিষে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে, শিক্ষা, সংস্কার, মূল্যবোধ, সংস্কার, স্বাস্থ্যসূচি, গণতান্ত্রিক বাতাবরণ, মেহনতি ঐক্য, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সূর্য অভিযান, ইত্যাদি প্রভৃতি যাবতীয় শব্দ হয়ে পড়ে মূল্যহীন। ... ...
ভারতীয় জাতি-ব্যবস্থায় শুদ্রের (দলিত) স্থান সবচেয়ে নিচে ও এঁরা সব থেকে কম সামাজিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। বহু প্রাচীন এই সমস্যা। উচ্চবর্ণের মানুষের কাছে অশুচী এই মানুষরা ব্রাত্য ছিলেন বাড়ি বা মন্দির থেকে শুরু করে যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। তার ওপর ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ। ... ...
শ্রীধর তো মানুষই না। সে তো তার থেকে হায়ারার্কিতে অনেক অনেক নীচে। মধ্যিখানে আছে নাজির টাকলুবাবু, মানে শ্রী নিশিকান্ত পরিজা, যিনি রঙিন পর্দা থেকে রেফ্রিজারেটর নাজিরিপনা করে ম্যাডামের সামনে দাখিল করবেন। বিশাল চুনকাম করা বাংলোর প্রতি ঘরে তীব্র চুনকামের গন্ধে মাথা ধরে যায়। তিনটে বাথরুম-পায়খানার একটা পায়খানায় এক-একদিন হেগে দেখা যায় তিনটের মধ্যে দুটোরই নিকাশি নালা বন্ধ হয়ে আছে। ফ্লাশ করলে মল যাচ্ছে না। সে কী ট্রমা, আবার ফোন করে পারিজাকে ঝাড়ে সু। প্লাম্বার ডাকে পারিজাবাবু। ওভারহেড ট্যাংকি থেকে জল ঝরছে তো ঝরছেই। বেওয়ারিশ কুকুরে বেড়ালে বাড়িতে এসে যেখানে সেখানে বসে থাকছে। ইঁদুরেরা সোফার ভেতরে বাসা করে সমস্ত স্পঞ্জ গদি কুটিকুটি করে ফেলছে। ... ...
এইসব অনেক দিন ধরে মিলিয়ে দেখে দেখে তবে ফুলমণি বুঝেছে মানুষের মতোই জঙ্গলের রূপের কোনো ঠিক নাই। সে খালি পালটায়। ঠা ঠা রোদ্দুরে সে একরকম, তো কালো মেঘের নিচে একেবারেই অন্যরকম। রহস্যময়, গহন। আবার শীতের ভোর ভোর খেতখামার, চাষের মাঠে মাকড়সার জালে বিন্দু বিন্দু শিশির আটকা পড়লে জঙ্গল বড় শান্ত, যেন মাহাতো বাড়ির বিয়ার যুগ্যি বড় মেয়েটা। ... ...