"ঘরে চল, এইখানেই দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি ছেমড়ি?" হানিফার ডাকে হুঁশ ফেরে সাকিনার। ব্যাগটা তুলে হানিফার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে সে। ঘরের ভিতরটা কিছুটা বদলেছে বটে। উঠোনের ওপারে আগে কাঁটাগাছের বেড়া ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা। ওখানটায় একটা ঘর উঠেছে। পাকঘরটা ছিল ডান দিকে, বাম দিকে খালপাড়ে খাটা পায়খানা। এখন ওখানে পাকা পায়খানা হয়েছে, রাস্তাটায় একটু সিমেন্ট দেওয়া। রান্না হচ্ছে এদিকের বারান্দার এক কোনে, সেখানে দুটি বউ কাজ করছে। সম্ভবতঃ জলিল আর খলিলের বিবি ওরা। ওদের আসতে দেখে একটু অবাক হয় দুজনেই। তাদের কাছে ডাকে হানিফা, "এই দেখ ছেমড়িরা, আমার একখান মাইয়া আছে কইছিলাম না? এই হইল সাকিনা বানু - আমার সই জারিনার মাইয়া। কিন্তু আসলে আমারই। ছালাম কর" ... ...
রাস্তার ধারেই বাড়ি ছিল আমাদের। তখন গ্রামের কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় জঘন্য কাদা। গরমে এই ধুলো। আর হেমন্তে সে মাখামাখি থাকত শিশিরে। একদিন একটা লোক, সঙ্গে চটপটে লোকের দশজনের একটা টিম, যারা ফিতে দিয়ে রাস্তা মাপছিল। যারা সরকারি রাস্তার জায়গা দখল করে বাড়ি করেছে, তাদের বাড়ি ভেঙে রাস্তা বের করে নেবে সরকার। আমাদের মাটির ঘরের অর্ধেকটা ভাঙা পড়বে। কানে পেনসিল গোঁজা লোকটা জানিয়ে দিল। দাদু বলল, একশ বছর আগের এই আমাদের মাটির ঘর। এখন এই তুমি দুদিনের ছোকরা এসে বলছ ভেঙে দেবে? ব্রিটিশ আমলের ঘর কি এখন ভাঙা যায়? সরকারি লোক গম্ভীর মুখে বলে, মাপে যা বেরিয়েছে, সেটা আমি কেবল জানিয়ে গেলুম। এবার প্রশাসন বুঝবে। ... ...
পাড়ার দাদারা বলে চিনা শালারাই নাকি এ অসুখের ভাইরাস ছেড়েছে। নাক ফেটা হারামজাদা জাত। ভারতমাতার চরম শত্রু। টিভিতে চিনা মানুষদের ছবি দেখেছে হারু। ষ্টীলের থালার মত গোল চকচকে চেহারা। বাচ্চাকাচ্চা বুড়ো একরকমের দেখতে। বনগাঁর আকবর আলিদাদার দোকানে সাজানো থালার মত। কে জানে বাবা, মানুষ মেরে এদের কি সুখ ! আজকাল বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না হারুর। গোহালেই থাকে। যত্ন নেয় গরুগুলোর । প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবার তিরিশটা গরু আর ওদের খাবার দিয়ে যায় চন্দনবাবু । তখন গরুগুলোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করে। গাল দেখে , দাঁত দেখে , পেটে হাত বুলোও, গাভিদের ওলান ধরে পরীক্ষা করে। কোন গরুকে রোগা লাগলে জানতে চায়, কি রে হারু। খাবার দিসনি নাকি ? ... ...
চাঁদপানা মেয়েটি আজ হাওয়াইয়ান ব্রিজ ও ল্যাভেন্ডারের মিশ্র সুবাস পরে এসেছে। এই সুবাস তৈরি হয়েছে বহুদূরের এক সমুদ্রশহরে ... ...
শিল্পকলার অন্য ক্ষেত্রে, মানে ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া বা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি কেউ এই ধরনের রেফারেন্স বা কোটেশন ব্যবহার করেন তাহলে কি সেটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে গন্য হবে ? আমার উত্তর হচ্ছে ‘না’। যদি কোন শিল্পী তাঁর পূর্বজ আরেকজন শিল্পীর কোন আইকনিক কাজকে অন্য ভাবে অন্য কনটেক্সটে বা অন্য মাধ্যমে ব্যবহার করে আলাদা কোন বার্তা দিতে চান, তাহলে সেটাও শিল্পের একটা ভ্যালিড পদ্ধতি বলেই ধরে নিতে হবে । এই পদ্ধতিতে সাধারণত শিল্পী তাঁর রেফারেন্স সোর্সকে গোপন রাখতে চান না বরং সেটাকেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির একটা এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করবার চেষ্টা করেন । এ বিষয়ে সেরা উদাহরণ হচ্ছে পিকাসোর পঞ্চাশের দশকের বেশ কিছু ছবি, যেখানে তিনি ভেলাস্কেথ, গোইয়া, এদুয়ার মানে প্রমুখ শিল্পীর আঁকা কিছু বিখ্যাত মাস্টারপিস ছবির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন । ... ...
খুব বেশিদিন নয়, মাত্র অর্ধশতক আগের কথা এসব। কোন্ বিত্তে এই ফুলের শিশুদের অবস্থান তা বোঝার বয়স তাদের ছিলনা। তাদের পাপড়ি মেলে জীবনের দিকে প্রথমবার চোখ তুলে তাকানোর সেই মধুর কালপর্বে মুখে মুখে ছড়ার অবাধ গতায়াত ছিল। যে বাংলা ছড়ায় তাদের বর্ণপরিচয়ের হাতেখড়ি সেই অ-এ অজগর সত্যিই তেড়ে আসে কিনা বা আ-এ আমটি পেড়ে খাওয়া কতটা সহজলভ্য তা তাদের কল্পনা শক্তিকে উস্কে দিতে যথেষ্ট ছিল। যে কল্পনায় রং তুলির কাজটা অনায়াসে করে দিত তাদের ঠোঁটের ফাঁক আলগা হয়ে বেরোনো মরমী বাংলা ছড়া। বা, বাস্তবের হাটের যে অতুলনীয় রূপকল্প যেমন, উচ্ছে বেগুন পটল মুলো/ বেতের বোনা ধামা কুলো/ সর্ষে ছোলা ময়দা আটা / শীতের রাপার নক্শা কাটা.., তা কি সংসার যাপন সম্পর্কে শিশু হৃদয়ে এক আবিলতা এনে দেয় না ? জীবনের সহজিয়াকে বুঝতে কোমল হৃদয়কে কি ছড়ার এই ছবি যথেষ্ট উৎসাহ দেয় না ? যে ছড়াতে পল্লীবাংলার ঋতুবদলের ছবি শিশুমনকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে আসে তা তো স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকার কথা। আমরা কি কোনো দিন ভুলে যাবো- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে..। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ জড়িয়ে আছে যার পরতে পরতে। চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,/ একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। অথবা, আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। এ তো গেল রবীন্দ্রনাথ জানার সহজপাঠ। বাংলার শিশু সমাজ যাঁকে এক কথায় হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছিল। কে যেন ততক্ষণে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে অন্য কাড়ানাকাড়া। রিন্ রিন্ করে বেজে চলেছে সুকুমারের আবোল তাবোল। ... ...
ইদ মানে উৎসব। ইদ-উৎসবকে ঘিরে আনন্দ স্মৃতি, না বলা কথা, কিম্বা ভীষণ বলতে চাওয়া আখ্যান নিয়ে রইল এবারের ইদের কড়চা। এই কড়চার দুই কিস্তির প্রথমটি বেরোল আজ। ... ...
কারোর মনে হতে পারে কলকাতা শহরটি - উত্তর দক্ষিণে লম্বাটে, পূর্ব-পশ্চিমে কম চওড়া শহরটি তার জালিকাটা রাস্তা ও জায়গাগুলি সমেত - যেন একটি বৃহদাকার জাল যে জালের মধ্যে কোন মানুষ পড়ে যেতে পারে, পড়ে গিয়ে কলকাতা শহরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে! এরকম হয়ত পুরোটা নয় যে এই জালের কেন্দ্রে মিনোটরের মতো কেউ আছে যার কাজই হল এক এক করে কলকাতার মানুষদের শুধুই গ্রাস করে যাওয়া আর সেই কাজ থামানোর জন্য থিসিউসের ম্তো কারোর দরকার, শহরটা হয়ত অতখানি কুটিল বা বিভ্রান্তিকর নয়, বিভিন্ন মানুষ তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে কলকাতায় এসেছে, অনেকেই জন্মাবধিই এই শহরে থেকেছে যে শহর তাদের আশ্রয় দিয়েছে, ফলে সব চরিত্রই এই শহরের মধ্যে হারিয়ে যায়নি, কেউ নিশ্চয়ই সেখানে নিজেকে খুঁজেও পেয়েছে। কিন্তু এমনও বোধ হয়, এই শহরের এক কালো আত্মা আছে যাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা যায়নি, যে নিজেকেও ক্রমাগত বদল করেছে, যে এক কুহক তৈরী করে যার নিয়ন্ত্রণে চরিত্ররা থাকতে বাধ্য হয়; মূলতঃ এই শহর হয়ত ক্রীতদাস -ক্রীতদাসীদের শহর হয়েই রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই যেদিন থেকে গ্রামগুলো শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে, ফলে কিছু মানুষ ও মানুষী এই শহরের কালো আত্মার গ্রাস থেকে চেষ্টা করেও মুক্ত হতে পারেনি। ... ...
কুড়ি বছর আগের ঘটনা সেটা, আমি তখন প্যারিসে থাকি। ল্যাটিন কোয়ার্টারে খুব ছোট্ট একটা এপার্টমেন্টে থাকতাম তখন আমি। মোটামুটি দিন চলে যাবার মত উপার্জন ছিল আমার, একেবারেই বেশি কিছু না। আমার লেখা একটি বই পড়ে সেটি নিয়ে আমাকে উচ্ছ্বসিত চিঠি লিখেছিল সে, আমিও ভদ্রতাবশত ধন্যবাদ জানিয়ে তার উত্তর দিই। তারপরপরই আমি আবার একটা ফিরতি চিঠি পাই। তাতে লিখেছিল, ওই সময়েই প্যারিস হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে সে; এই সুযোগে আমাদের দেখা হয়ে গেলে খুবই খুশি হবে। কিন্তু একই সঙ্গে তার সময়েরও আবার খুব টানাটানি, পরের বৃহস্পতিবারে ছাড়া আর কোনোদিন সময় বের করা খুব মুশকিল হবে। তাই জানতে চেয়েছে সেই বৃহস্পতিবারেই আমি তাকে ফয়ট’স-এ লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করতে পারব কি না। ... ...
এটাই নাকি চিত্রকর গ্রাম। ভরতপুর। মোটে পনেরো ঘর চিত্রকর। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে গেলাম প্রথম বাড়িতেই। সঙ্গে দেবাশীষ মুখার্জি ভাই--- আগে এসেছে কিনা। বলল--দাঁড়ান ওই খানটায় , অনিলকে ফোন লাগাই। একটা পুরোনো গরীব কুয়ো --ডুমুর অশথ গাছের শেকড় জল ছোঁয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। ঝুঁকে দেখতে দেখতেই ডাক এল। গাঁয়ের একটি সিমেন্ট বাঁধানো দাওয়ায় ওরা ছবি বিছিয়ে দিচ্ছে। এটাই নিয়ম। বাইরের কেউ এলে পনেরো ঘরে কানাকানি করেই খবর পৌঁছে যায়--যার যেটুকু পুঁজি এনে সাজায় সেই দাওয়ায়। ... ...
পাঁঠার বদলে শসা বলি হলেও, সেই শসার জন্য তো আর আলাদা করে খাঁড়া কেউ বানাতো না! ফলে পাঁঠা কাটার খাঁড়া দিয়েই শসা বলি – মশা মারতে কামান দাগার মত! কামারের কাজ খুব সিম্পল ছিল – চোখ-টোখ লাল করে একটু হালকা টলতে টলতে নাকি কে জানে, সাইকেল নিয়ে হাজির হত। সে মদ খেয়ে এসেছে কি খায় নি, তা এক বড় গবেষণার ব্যাপার। তবে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। এই কামার এসে সামনের পুকুরে ডুব দিয়ে আমাদের দেওয়া নতুন কাপড়টা পরে আর হাতের খাঁড়াটা ধুয়ে নিয়ে এসে মা-দুর্গার সামনে বামুন ঠাকুরের পাশে রাখত। বামুন দাদু নানা বিধ মন্ত্র বলে সেই খাঁড়াকে পুজো করে দিত এবং তার পর উঠে এসে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা কামারের মাথায় মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে দিত। ব্যাস এবার রেডি বলির জন্য। ... ...
জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে মৃত্যুর মিছিল অনবরত যেখানে এসে থামে, সেই ‘উদ্ধারণপুরের বাতাসের সঙ্গে শ্মশান-ভস্মের মধুর মিতালি।... এপারে শিউড়ী, সাঁইথে, কাটোয়া কান্দী, ওপারে বেলডাঙা, বহরমপুর, লালগোলা, কৃষ্ণনগর -- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে উদ্ধারণপুরের চিতাভস্ম। নামে মানুষের মাথায়, নামে ক্ষেত মজুরের বুকে, নামে সকলের তৃষ্ণার জলের আধার দীঘি সরোবরে। মিশে যায় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে। সবার কাছে চিতাভস্মের সাদর আহবান পৌঁছে দেয় উদ্ধারণপুরের বাতাস। কেউ টের পায় না কবে কখন উদ্ধারণপুরের অমোঘ আহবান এসে পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডের মধ্যে। সেই নির্মম পরোয়ান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই কারও’। ... ...
ছেলের কথা পল্লবিত হয়েই হয়ত এল তার কাছে কিন্তু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকল প্রদীপ... তার কণ্ঠার হাড় দপদপ করে ওঠানামা করল... রোগা, আদ্ধেক শিরা বেরিয়ে ওঠা মুঠি দুবার জোরে মুঠো করল সে... এই ছেলেকে ত পিটিয়েও সিধে করা যাচ্ছে না। প্রদীপের স্ত্রী পুত্রের আরেক প্রস্থ শাসনের ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল... কিন্তু কুকীর্তিটা পুত্র ঘটিয়েছে তাদের শ্রদ্ধেয় কাকার বাড়িতে, বাড়িশুদ্ধ আত্মীয়কুটুমের সামনে তার স্বামীর মাথা হেঁট হয়ে গেল... প্রদীপের এই অপমানটাও তাকে বিদ্ধ করল চকিতে... ... ...
সরমা ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। এক পা বাড়িয়ে আবার ফিরে গিয়ে আঁট করল দরজার ছিটকিনি। অনাবশ্যক, কারণ গোটা বাড়িতে আর কেউ তো নেই। টাবুদির বিয়েতে গেছে সবাই। সামনে সরমার পরীক্ষা তাই ওর না যাওয়াই সাব্যস্ত হয়েছিল। সরমা অবশ্য এতসব কিছু ভাবছিল না, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। তার মধ্যেই দক্ষিণের জানালায় এসে জংলাসবুজ পর্দার স্প্রিং টেনে নাবিয়ে দেখল একবার বাইরেটা। আকাশে বেশ রং ধরেছে এখন, এই সময়টাকেই কি গোধূলি বলে? দূরে দূরে অনেক আলো জ্বলতে শুরু করেছে যদিও। সরমার চোখ গেল হাঁদুলের চায়ের দোকানে। ওরা কি এদিকেই তাকিয়ে আছে? এর পর কি প্যাঁচ কষবে তার হিসাব নিকাশ করছে? সরমা কি ভুল করল এইভাবে রিয়াক্ট করে? ... ...
আমার ঠিক সামনে দুটি চোখ। টানা টানা। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মতো। এ কার চোখ? শুনেছি। এই সামনের পোর্টেটটি রাজকুমারী রুক্মিণীদেবীর। যাঁর নামে এই কলেজ। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। চোখ দুটি জীবন্ত। কখনও এত স্পষ্ট করে দেখিনি। সোজাসাপটা শাড়ি। কাঁধে ব্রোচ। বছর কুড়ি বয়স মনে হয় ছবিতে। চোখ দুটি কী উজ্জ্বল। যেন টানছে। সামনে ওই চোখ। পায়ের নীচে সর্পিল বাঁধন। আমি ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকি। হাহাকারের মতো কুয়াশা যেন ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে কোনো ফাঁক দিয়ে। যত উঠে দাঁড়াতে চাই সর্পিল অদৃশ্য ফাঁস তত আঁটো হয়। রুক্মিণীদেবীর চোখ । কী মায়াময়। যেন চুম্বক। টানছে। আর তাকাতে পারি না। ... ...
"দরজার উল্টোপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ওরা ডাকছিল। “দরজা খুলে দে আমাদেরর না হলে ওটা ভেঙে ফেলব আমরা”। সে দরজা খুলেছিল। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনেক লোকজন ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ওদের মাথা ঢাকা। বাচ্চারা ভয়ে জেগে উঠতেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিল। রোসা বাচ্চাকে এক হাতে নিয়েছিল আর মেয়েটাকে দু পায়ের ফাঁকে। যে লোকটা আলো জ্বালিয়েছিল তার পরনে অন্যদের মতই কালো পোশাক। বুট জুতো পরা। কারো কারো মুখে লাল রঙের রুমাল বাঁধা আর কালো টুপি দিয়ে মুখ ঢাকা। " ... ...
বাপে আমার মন বুঝত মানুষের। আকবর প্রায়ই বাপের কাছ থেইকা পাখি কিনে। মনে মনে কিনে। বাপে বলে, আকবরের কাছে ম্যালা পাখি হইছে। অর বুকের ভিতর পাখিগুলা ফড়ফড়ায়.. সক্কালবেলা দ্যাশের পাখি জাগার আগে অর বুকের পাখি কিচিরমিচির করে। আমি বাপের কথা ধুন ধইরা শুনি। এমন আশ্চর্য কথা শুধু আমার বাপেই কইতে পারে। পাড়ার খালায় বলে, তোর বাপের মাথায় ছিট আছে। তুইও কি ওই রকম ছিটাহি হইবি? খাওন দাওনের ঠিক নাই। বয়স হইতাছে কত খিয়াল আছে? তর ফ্রকে যে উড়না দেওন লাগে সেই চোখও নাই কি তর বাপের? ... ...
বাংলা ভাষা একটি মিশ্র ভাষা। তার মধ্যে বৈদিক, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার অবদান যেমন আছে, তেমনি আছে খেরওয়াল বা সাঁওতালী সহ বেশ কিছু মুণ্ডা ভাষার অতি গুরূত্বপূর্ণ অবদান। বাংলা ভাষার ওপর বৈদিক, সংস্কৃত ও প্রাকৃতের মতো আর্য ভাষার প্রভাবের দিকটি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অস্ট্রো এশিয়াটিক, দ্রাবিড় ও সিনো টিবেটিয়ান ভাষারও যে কম বেশি প্রভাব আছে বাংলা ভাষার গঠনে – তাই নিয়ে আলোচনা তেমন দেখা যায় না। অথচ ভাষাপ্রকৃতির দিক থেকে বিচার করলে বাংলা ভাষার গঠনে মুণ্ডা সহ এসব ভাষার প্রভাবের দিকটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ... ...
দারিয়াবান্দা, কুতকুত (এইটা সম্ভবত আন্তর্জাতিক খেলা, অনেক বিদেশি সিনেমায় দেখছি তারাও কুতকুত খেলে! নিয়ম কানুনে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু খেলে।) ফুলটোকা বা গোলাপ টগর, রুমাল চোর, কানামাছি, মোরগ লড়াই, ইচিং বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ , আজকে আর কেউ খেলে না। এর মধ্যে দারিয়াবান্দা খুব জনপ্রিয় একটা খেলা। ব্যাডমিন্টন কোর্টের মত করে কোর্ট কাটা হত। একদল দাগে দাঁড়িয়ে থাকত অন্য দল ঘর গুলাতে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হবে। দাগে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দাগে পা রেখে ঘরের ভিতরে যারা আছে তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময়ও যদি ছোঁয়া যায় তাহলেও চলবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘর এভাবে পুরোটা যেতে হবে আবার আসতে হবে। সবাই মরে গেলে অন্য দলের সুযোগ। এই খেলার একটা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। দারিয়াবান্দা খেলা একটু নরম প্রকৃতির, মেয়েরাও অংশ নিতে পারত। এটার একটা পুরুষালি ধরণ ছিল। এতে হাত পা যেমন খুশি তেমন ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করা যেত। কেউ হয়ত লাফ দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করল, অন্য জন হয়ত সোজা লাথি মেরে ফেলে দিল! বেশ ভয়ংকর একটা ব্যাপার ছিল। এর নাম ছিল চিক। আমরা দারিয়াবান্দা খেললে কেউ কেউ মেয়েদের খেলা খেলছি বলে খেপানোর চেষ্টা করত। কিন্তু চিক খেলছি দেখলে! হুম, এবার হচ্ছে খেলা! কতদিন যে চিক খেলে হাত পায়ে ব্যথা পেয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। সেই ব্যথাও এখন সুখের মনে হয়। কী অদ্ভুত সময় পার করে এসেছি। এখন ভাবলে পরাবাস্তব কিছু বলে মনে হয়। ... ...