যেদিন খদ্দের থাকে না, আমরা অনেক অনেক গল্প করি। বরাবর এমনটাই হয়ে আসছে। আমাদের দেওয়ালে চারজনের ছবি লাগানো আছে। আমি চারজনকেই চিনি। একটা আদ্যা মা, একটা নেতাজি, একটা মাধুরী দীক্ষিত, আরেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীপালির ট্রাঙ্কে আরও একটা ছোট্ট মতো ছবি আছে। আমি জানি ওটা কার। পলাশের। আমাকে কেউ বলেনি। কিন্তু জানি। একদিন দুপুরবেলা খাটের ওপর ছবিটা পড়েছিল, আর আমি রাগ করে একটু চিবিয়ে ফেলেছিলাম। দীপালি কী মারই মেরেছিল। ওই একদিনই। আর কখখনও না। তারপর নিজেই একঘন্টা কাঁদলো। দীপালি ওর মা বাবার কথা একেবারে বলে না। গোমতীর কারো কথাই বলে না প্রায়। কেবল একজন দিদিমণির কথা বলে – তার নাম মায়া। উনি দীপালিকে খুব ভালোবাসতেন। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন, ঘি ভাত রান্না করে খাওয়াতেন। সেইসব গান দীপালি গায়। মাঝে মাঝে। বিশেষ করে ওই শুভাশিস এলে। শুভাশিসকে একটানা দু’বছর হলো দেখছি, মাসে সাধারণত একবার আসে। শুরুর দিকে, মাইনে পেয়ে। আমার জন্য ক্রিমবিস্কুট আনে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। আর টাকা দেওয়ার পর আমাদের একটা-দুটো করে কবিতা শুনিয়ে চলে যায়। আমি আর দীপালি তখন খুব হাসি। ... ...
আছড়ে পড়ার শব্দে মুখ তুলে তাকায় মনীষা। চিলের ছানা মনে হলো । নাকি পায়রা। রেস্টোরান্টের পুরু কাঁচের ওপাশে উড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে, সড়সড় নেবে গ্যালো। মনীষা কফিতে মন দেয়। কমলেশের দিকে চিনির প্যাকেট এগিয়ে, কফিতে এক চুমুক দিয়ে, শূন্য কাঁচের দিকে তাকায় আরেকবার। কোনো আঁচড়ের দাগ নেই। কফিকাপ নাবিয়ে রেখে স্পষ্ট তাকিয়ে বলে - না , কাকু । এই অনুরোধটা করবেন না । আমি যা সত্যি বলে জানি , তার বাইরে গিয়ে গল্প সাজানো সম্ভব নয় ... ...
পীরদিদি, কায়রুবুড়া, ধীরজুদাদা তিনজন হেঁটে আসছিল। তিনজন হাসছিল। তিনজনের হাতেই পাঁপড়ভাজা। পাঁপড়ভাজাগুলো হাতের চাপে ভেঙ্গে পড়ছিল, কিছু কিছু চলে যাচ্ছিল জিভের ডগায় সুস্বাদ জানিয়ে, যেন জীবনের সুখের দিনগুলো। মচমচে সহজেই ভাঙ্গে, অচিরেই গুঁড়িয়ে যায়। আজকে তলব বার। ভাষাতত্বের কি নিয়মে কে জানে সাপ্তাহিক বেতনকে বলে তলব। যে বারে সপ্তাহের বেতন হয় সেটা তলববার। খুশির দিন, সেদিন হাট বসে চা বাগানের মাঠে। মহানিমের ছায়ায় ছোট ছোট চালার নীচে কত কি রূপোর গয়না, গালার চুড়ি, পুঁতির মালা, মাছ, মাংস, সবজির পসরা। সবাই কিছু কিছু কিনবে। তারপর রাত হলে চাঁদের নিচে বা অন্ধকারের আঁচলের তলায় ভাতের পচুই কি মহুয়া। প্রথম নাচগান, তারপর মারপিট, কান্না, বিলাপ, শাপশাপান্ত, তারপর একঘুম, সব গ্লানি হজম। পরেরদিন ভরে আবার পাত্তিতোলা, ফ্যাকট্রিতে মেশিনের আওয়াজে আগুনের তাপে বিরাট কর্মযজ্ঞ ... ...
বুড়া ঠেসান দিয়ে বসে থাকে কুয়োর ধারে। চারদিকে মানুষের কথা বয়ে যাচ্ছে ফিসফিস ফিসফিস, কিছুই ধরতে পারছে না সে! হঠাৎ তার বাপের একটা কথা মনে পড় যায় বিজলিচমকের মত। যখন আঁধার নামে, তাজা লোমড়ির রক্ত খেয়ে জেগে ওঠেন মারী দেবী, তাঁকে খুশি করতে পারলে যা চাই তাই দেন মা । জরুরি কাজ মনে পড়ে যাবার মত করেই ধড়মড় করে উঠে বসে। “আমি যতক্ষণ না ফিরি, নিয়ে যাবি না ওদের” ব’লে খ্যাপা মোষের মত বেরিয়ে যায় বুড়া। জমায়েত একধারে সরে গিয়ে পথ করে দেয়, নিবারণ হাহুতাশ করে, পাগলে গেছে গো বুড়াটা। বুড়া ততক্ষণে পিছনের মাঠ পেরিয়ে সোজা খেত বরাবর নারান বাবুর মাঠে। লোমড়িটা ওদিকেই গেছে নিশ্চই খরগোশ ধরতে, এসময় এগুলো বেশ গায়ে গতরে হয়ে ওঠে। ... ...
এরপর একদিন পেঁচা কাকের জন্য একটা সাদা জামা বানাতে শুরু করল। কিন্তু জামাটা কাককে পরাতে গেলেই সে বড্ড লাফাত। এমনই একদিন কাককে জামাটা পরিয়ে দেখা হচ্চিল ফিট করেছে কিনা। যথারীতি কাক লাফাচ্ছিল। কাকের এই তিড়িং বিড়িং পেঁচার মোটেই পছন্দ ছিলনা। তাই সে চোখ পাকিয়ে বলল, "খবরদার! আমি কিন্তু লম্ফ হাতে উড়ছি। লাফাস না!' ... ...
কিন্তু রোজ বিকেলে পাড়ার ওই বাঁদরের দল খেলত এসে গলিটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাতিয়ে রাখে। বাঁদরের দল নামটা রায়দাদুই ওদের দিয়েছেন। বাঁদরের দল অর্থাৎ পাঁচটি ছেলেমেয়ের দল। রায়দাদু ছাড়া সকলে ডাক নাম ধরেই ডাকে ওদের ... রাজু, বিল্টু, রিয়া, রিম্পা এবং রনি। ওদের চেঁচামেচিতে রায়দাদু সর্বদাই বিরক্ত থাকতেন। কিন্তু আবার কোনোদিন ওরা খেলতে না এলে ওনার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। ... ...
নটেন হাঁ করে বড়ো ছেলেকে দেখতে থাকে, দেখতে থাকে নির্নিমেষ। সে একবার ভাবল বাকি ভাত ক'টি কি সত্যেনকে খাইবে দেবে? ফের ভাবে থাক, ভাতটা ঢাকা দিয়ে এখন ছেলেকে খাটে শুইয়ে দেবে? সত্যেন কি অসুস্থ? নাকি ক্ষুধায় মুমূর্ষুপ্রায়? সত্যেনের ওয়াক ওয়াক স্তিমিত হয়েছে। সাপের নিশ্বাসের মতো ফ্যাঁসফেসে শব্দ বেরোচ্ছে এখন মুখ দিয়ে। নটেন কুপি তুলে ধরে সত্যেনের মুখের কাছে ধরতে গেলে তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপির শিখার টুপ করে নিভে-যাওয়া নিপূণ অন্ধকার। ঘরের ভেতরের কুপিটির আলোয় মাটির দেয়ালে আবছা দেখা যাচ্ছে সত্যেনের মা আরতি মরার পর কাগজের ওপর নটেনের নেওয়া পদতলের আলতার জোড়াছাপের ফটো। আধো আলোয় অন্ধকারে দূর থেকে প্রাচীন মথের মতো দেওয়ালে সে পদচিহ্ন। ... ...
একটু বেলা পড়ার দিকে পদ্মপাতায় খাবার সময় ও জোরে জোরে নাক টানত, আর বলত, আঃ! কী সুন্দর গন্ধ গো বাবা! যেন ভোজ খাচ্ছি। অথচ গাছ কীই বা রাঁধতো তার পাতায়? আওতার গাছ, যতটুকু রোদ-জল রুক্ষ মাটি থেকে টেনে নিতে পারে, তা বইতো নয়? সেই তো শাক ডাঁটা, বিড়ির ডাল। বড্ড জোর চুনোমাছের চটচটে করে ঝাল। কোথাও জল ছিঁচে, নাহলে জাল টেনে ধরা। বিক্কিরি করার পর বাকিটা রান্না। বড্ড ভালো রান্না করতো। পদ্মপাতায় খেলে মনে হবেই ভোজবাড়িতে খাচ্ছো। ও আঙুল চেটে চেটে খেতো। পাত আঙুলের ডগায় পরিষ্কার হয়ে যেত। ওর খাওয়া দেখে ওরা দুজনে কী খুশিই না হতো! হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। তারপর তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠত। বড় সুন্দর ছিলো সেসব দিন। ... ...
ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে ঝন্টুর কড়া নজর। ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের সঙ্গে তার ওঠা বসা। তার ছেলে যদি ঠিকমতো লেখাপড়া না করে তবে চলবে কেন! প্রাইভেটে মাস্টার দিয়েছে সে প্রথম থেকেই। ছেলের জন্যই, আসলে ছেলের জন্যই ঝন্টু রাজি হয়ে গেল নেতার কথায়। এবার পুরিয়া রাখবে দোকানে। গাঁজার পুরিয়া। নেতা মানে কলেজ নেতা। সে ঝন্টুর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, আরে এতো ওপেন সিক্রেট, সবাই টানে। তোর রাখতে কী! তাহলে ছেলেপুলেকে আর মাঠ পেরিয়ে অতদূর যেতে হয় না। আর তোর ও কাটতি টা বল,লাল হয়ে যাবি,লাল। ... ...
মাঠে মাঠে সরষের ফুল এসেচে। উঁচু,নিচু টিলা জমি। সব ইখন হলুদ। ইখন তো ফুলেরই পরব। সরু লিকলিকে আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে মেলা দিখতে যাচ্ছে বুড়ো,বুড়ি,ছেলে-ছুকরা। কেউ কেউ লাল মোরাম রাস্তা ধরে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছুটচে। বনের পাশেই ডাঙা টিলা মাঠ,উখানেই মেলা বসেছে। মনোহারি জিনিসের দুকান,বাচ্চাদের বাঁশি,ডুগডুগি খেলনা। কত রকমের খাবার দাবার,তেলে ভাঁজা,ঝিলাপি। কুথাও বা গাছের তলায় মাটির হাঁড়ি-কুড়ি বিচছে। এক জায়গায় সাইকেল,পিক-আপ ভ্যান দাঁড় করানো সারি সারি। ইকটো সাঁওতাল বুড়হা ঘুরে ঘুরে আড়বাঁশি বিচছে। লিজেই সুর তুলচে মন গেলে। লাল ধুলো উড়ছে আকাশে। সেই ধুলো মেখেই মেয়ে মরদ হাত ধরাধরি করে ঘুরছে। আশপাশের সব গিরাম থিকেই ভিড় জমিয়েছে। শুধু কি সাঁওতাল? বাবুরাও মজা লুটতে আইচে। ... ...
ওর আঙুলগুলোর দিকে তাকাই। লম্বা,সরু,ফিকে প্রবাল রঙের। ওই আঙুল আমার হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিচ্ছে… কোথাও একটা প্রজাপতি আস্তে আস্তে ডানা ঝাপ্টাতে থাকে। কিম্বা দুটো? পাঁচটা? ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো। ভয়েডকে দেখতে পাইনা এসে। আজকাল মাঝেমাঝেই পাইনা। কোথায় যায় কে জানে?কখোনো জিজ্ঞেস করিনি। কোনো কোনোদিন অনেক রাত্রে আধোঘুমের মধ্যে গালের ওপর ওর নিঃশ্বাস টের পাই। ফিসফিস করে বলে “আই নো, ইউ হ্যাভ সামওয়ান এলস অন ইওর মাইন্ড”। আমি ওর কথার খেই ধরতে চাই – “আই নো…”, বাক্য শেষ হবার আগেই আধোচেতনা আমার জিভকে আচ্ছন্ন করে। আবল্লী আমাকে আস্তে আস্তে টেনে নিতে থাকে। যেন কেউ খুব নরম একটা কম্বল দিয়ে আমায় মুড়ে দিচ্ছে। বহুদিন হারিয়ে থাকা একটা কম্বল। আমি আবল্লীর মধ্যে তলিয়ে যাই। তলিয়ে যাওয়া বেশ ভালোই জিনিস। গভীরে। ... ...
এই অসুখের পোশাকি নাম মানডে ব্লুজ। কাজে যাবার অনীহা। বিশেষ করে রবিবার সন্ধ্যায় এই মহামারীর প্রকোপ বাড়ে। আর লোকে ভিড় জমায় এই ক্যাফেতে। বিয়ার আর বাংলা খেয়ে নিজেদের চাঙ্গা করার জন্য। টেবিলে-টেবিলে ধোঁয়া ওঠে। গজল্লায় গমগম করে চারদিক। ফুর্তির ফোয়ারা ছোটে। মেয়েরা প্রেমিকের কোলে উঠে বসে। ছেলেরা হেঁড়ে গলায় গান গায়। ... ...
এমনভাবে কয়েক গ্রীষ্ম শরৎ শীত কেটে গেল। টিনা বড় হয়েছে, তার বইয়ের বােঝাও বেড়েছে | কয়েক দিন আগে তার এগারােতম জন্মদিন সে উদযাপন করেছে। ছানাটি ও এখন খুব বড় হয়ে গেছে । তার অসাধারণ সুন্দর নীল পালকের কারণে টিনা তাকে আহ্বাদে নীলু বলে ডাকে। বাবার থেকে একটি বড় খাঁচা চেয়ে নীলুকে সেখানে রাখে | নীলু এবং টিনা কয়েক ঘন্টা একসাথে খেলা করতাে। মনে হতাে তাদের মধ্যে যেন অনেক কথা হচ্ছে। টিনার প্রশ্নে নীলু তাকে মৃদুস্বরে কিচিরমিচির করে উত্তর দিত। ... ...
মা আর শুনতে দিলেন না, “আজ অমাবস্যার রাত, বড্ড ভয় পাবে, ভূতের গল্প বলা বন্ধ করো”। কাজেই আর শোনা গেল না। রাত্তিরে শোয়ার সময় আমার বিছানাটা দুলছিল। নিচে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পাশ ফিরে শুই, দেখি রতনের ওপর একটা ইভিল স্পিরিট ভর করে আছে। কম্বলে আমি মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ... ...
রঙের খেলা, কথার মেলা ওদের কলমে, পেনসিলে। লেখার মুন্সীয়ানা হার মানাবে যে কোনও চন্ডালকে, আমাদের সাধ্যি কি তাতে কলম চালাই? আমরা শুধু লাইন টেনে দিতে পারি, আর পারি সব্বাইকে পড়ে শোনাতে। ... ...
একদিন অভীক, সময়, বিমান আর নবীন গ্রামের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। খেলতে খেলতে বলটা অভীক এত জোরে মারল যে সেটা মাঠের পাশের জঙ্গলে গিয়ে পড়ল। ... ...
সারাটা দাঙ্গার সময় খোকনের কলকাতায় কাটলো। কি আতঙ্ক, কি আতঙ্ক রে বাপ। রোজ অপেক্ষায় থাকে এই বোধহয় কেউ ছুরি হাতে বাসায় ঢুইক্যা আইলো। দাঙ্গা কি আর আগেও দ্যাখে নাই খোকন, ছোটখাটো কম হয় নাই দ্যাশেও।কিন্তু মাতব্বররা সালিসি করসে, কার দোষ ঠিক কইরা দিসে, থাইম্যা গেসে। ১৯৪৬ এর দাঙ্গার এক্কেরে আলাদা। কলুটোলা, রাজাবাজার,পার্কসার্কাস সব বেবাক চুপচাপ। লিচুবাগানের ঘটনার পর তো কলকাতা থম মাইর্যা গেলো। দ্যাশের খবরও খুব খারাপ। নোয়াখালি, আরও কত জায়গার খবর আসে। খোকন অস্থির হইয়া ওঠে, ভিতরে ভিতরে। দাঙ্গার আগুনে সব ছাড়খার।সন্ধ্যাবেলা পিসা আর পিসার বন্ধু অমলবাবু কত কথা কয়, খোকন শোনে একমনে।অমলবাবু বলেন " বুঝলে মিত্তির, লীগ আর হিন্দুমহাসভার নেতাদের বোঝানোই গেলো না, এ লড়াই হিন্দু মুসলমানের বিরুদ্ধে নয়, এ ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে" পিসা কয়,"স্বাধীনতা ও যেই ভাবে আইলো, তাতে লাভ কী হইল অমলবাবু? দ্যাশভাগ আর লাখে লাখে মানুষ আজ ভিটা মাটি ছাইড়া আইতাসে পূর্ব পাকিস্থান থিকা,দাঙ্গা কমলেও এই ভয় কী কমবো কোনোদিন! দুইটা জাতির বিশ্বাস, ভালোবাসা তলানিতে আইসা ঠেকলো ব্রিটিশের শয়তানি আর নেতাদের ভুল চালে।" অমলবাবু কন, ' দাঙ্গা সাধারণ হিন্দুও চায় না মুসলমানও চায় না।চায় শুধু দাঙ্গাবাজগুলো" খোকন ভাবে মামুদ, আনোয়ার তো তারে ভালোবাসে, চিঠি দেয়। খোকন কবে আইবি রে? খোকন তুই নাই তাই ফুটবল খেলা জমে না। তাদেরও অন্তরে বিষ? ... ...
বারে বারে সে নিজের মাউথ অর্গান তুলে নিয়েছে ঠোঁটে। যা যা সুর শুনছে, সেগুলোকে নকল করবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সবসময় পারেনি। কিন্তু কোনও কোনও মুহূর্তে তার সুর হুবহু টিলার মাথার সুরের সংগে মিলে গেছে। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে তার সারা শরীর। আর যখনই এটা হয়েছে, ডেসমন দেখেছে টিলার মাথায় লোকগুলো গান বাজনা থামিয়ে দিয়েছে। থামিয়ে দিয়ে তার দিকে যেন তাকিয়ে থেকেছে। ডেসমনের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। আপনা হতেই চুপ হয়ে গেছে তার মাউথ অর্গানও। তারপর সে দেখেছে, লোকগুলো সকলে যেন কোমরের ওপর থেকে শরীর একটু ঝুঁকিয়েছে তার দিকে। তারপর আবার শুরু করেছে গান। লোকগুলো কি তাকে অভিবাদন জানাল? ডেসমন ঠিক বোঝে না, তবে এরকম ভংগী সিনেমাতে দেখেছে। দেখেছে মাথায় টুপি কালো কোট আর মাছি গোঁফওয়ালা একটা লোকের সিনেমাতেও। কাউকে সম্মান জানাতে হলে মানুষ এমন ভাবে নুয়ে পড়ে। ডেসমনও মাথা ঝোঁকায়। প্রণাম করে মনে মনে। তারপর আবার মাউথ অর্গান তুলে নেয়। ... ...
আজকের পর্বটা ভালোই জমে উঠেছে। বিজ্ঞাপনসহ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের শো। প্রথম দুই পর্ব এরই মধ্যে শেষ। সুবহান আর লতা পাল্লা দিয়ে হেসেছে। সুবহান এমনিতেই খুব হাসতে পারে। এটা ওদের পারিবারিক রোগ। সুবহানের বাবা মাটিকাটার কাজ করত। অভাব অনটনের মধ্যেও লোকটা এত হাসত যে পাগলের মতো দেখাত। যেদিন ওর মা ইটভাটায় জ্বালানির সঙ্গে জ্বলেপুড়ে কয়লা হলো, সেদিন বিকালেও হেসেছে। তাও খুব সামান্য কারণে, একটা ছাগলের ছা লাফাতে গিয়ে দড়িতে বেঁধে উপুড় হয়ে পড়ে গেছে, তাতেই সে কী হাসি! শেষ পর্যন্ত পাগল বলে সকলে এক প্রকার মেনে নেয়। সুবহানের বাবারও মানতে অসুবিধা হয়নি। আশেপাশে কেউ পাগল বলে ডাকলেই দাঁত কেলিয়ে উত্তর নিত। আর পাগল বলেই কিনা দুজনের কাজ করে অর্ধেক মজুরি পেত। সেই থেকে সুবহানের ধারণা হাসাটা ওদের অসুখ। মেয়েকেও সেই অসুখে পেয়েছে দেখে সুবহানের কষ্ট হয়। ... ...
আব্দুল মজিদের এই কার্যক্রম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল এবং অস্বাভাবিক জিনিসের প্রতি মানুষ এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে সুতরাং কিছু মানুষ আব্দুল মজিদকে ঘিরে দাঁড়াল। আব্দুল মজিদ প্রচন্ড সূর্যের উত্তাপে গরম ভেজাল বিটুমিনের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত রাজপথে দাঁড়িয়ে তার চারপাশে জমে যাওয়া মুখগুলোকে দেখে ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করল। তার মনে হল অনেক অনেক দিন পরে রাশি রাশি পক্ষীকূল তার ভেতরের দুনিয়ায় একসাথে উড়াল দিয়েছে এবং তারা এক স্বর্গীয় ছন্দে একসাথে ডানা কাঁপিয়ে উড়ে চলেছে। আব্দুল মজিদের শরীরের ভেতরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল এবং সদ্য দৌড়াতে শেখা বাছুরের মত তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল অপার্থিব উচ্ছ্বলতাকে সঙ্গে নিয়ে। আব্দুল মজিদ এইসব অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল এবং চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসল। সে নিজের চোখকে উপস্থিত জনতার চোখের আড়াল করতে উত্তপ্ত রাজপথের দিকে তাকাল এবং সে দেখতে পেল স্থানে স্থানে চাকার ঘর্ষণের ফলে রাস্তার বিটুমিন উঠে গেছে। সেইসব জায়গা রাস্তার বুকের ক্ষত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর কোথাও কোথাও এইসব ক্ষত অগভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। আব্দুল মজিদ ঝাপসা চোখ দিয়ে দেখলেও অনুভব করতে এইসব ক্ষত এবং গর্ত আসলে নগরের নাগরিকদের বিবর্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার খারাপ লাগে এবং সে নিজেকে শক্ত করে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মুখ তুলে বলে, আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প। এইগল্প এই শহর এবং শহরে বসবাসকারী মানুষের গল্প। আপনাদের মনে হতে পারে এই গল্পের সাথে শহর এবং শহরবাসীদের কোন মিল নেই। কিন্তু এই মনে হওয়া ভুল হবে। কারণ আমি এই চারপাশের বাস্তব পৃথিবীর ভেতরের অবাস্তব জগতটাকে দেখেছি এবং সেইমত বুঝে নিয়েছি এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পটিকে। এখন আমার দায়িত্ব আপনাদের এই গল্প শোনানোর। আপনাদের কি এই গল্প শোনার সময় হবে? ... ...