সেকালে সপ্তম শ্রেণিতে উঠলেই ছেলেরা ক্লাব বানাতো।এখন কী করে? আর কেউ কেউ কবিতা লিখতো। ১৯৭৮-এ আমি সপ্তম শ্রেণি। আমরা গ্রামের ছেলেরা একটা ছোটোদের ক্লাব করে ফেললাম। নাম অরুণোদয় সংঘ। বাড়ি বাড়ি বই চেয়ে একটা ছোটো লাইব্রেরি গড়া হল। আমাদের বৈঠকখানা ঘরের আলমারি হলো সেই বইঘরের ঠিকানা। ক্লাবের দপ্তর আমাদের বৈঠকখানা। বাবাকে বলতেই রাজি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হৈহৈ করে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন হতো। জুনিয়র হাইস্কুলে ছুটিই থাকে। আমরা ১৫ আগস্ট পতাকা তুলে গোটা গ্রাম ঘুরে মাতিয়ে দিলাম। ... ...
মানুষের ভয়ের প্রতি এক আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। সেই আকর্ষণ থেকেই শিশুরা ভূত বা জুজুবুড়ির গল্প শুনে ভয় পায় এবং বারবার সেই ভূত ও জুজুবুড়ির গল্প শুনতে চায়। বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশের এক বড় বাধা এই ভূত পেত্নী ও জুজুর গল্প। ... ...
কেমন করে সময় দেখতাম আমরা? সত্তর দশকে? বাড়িতে প্রথমে একটাই ঘড়ি। যে ঘড়ি বাবা ষাট বছরের বেশি সময় পরেছেন। পরে দাদার একটা ঘড়ি হয়। কিন্তু দাদাও তো বাইরে থাকেন। আমরা সময় মেলাতাম নানা পদ্ধতিতে। একটা ছিল পাশের বাড়িতে একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল হরিণের শিংয়ের পাশে। কাঠের পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি। সবসময় যেতে ইচ্ছে হতো না। একটা তো মায়ের ওঠা। মা কী করে উঠতেন মা-ই জানেন। এছাড়া ভোর চার ১৫ মিনিটে ফজরের আজান। সবসময় শুনতে পেতাম না। দুই, সকালে গুঁড়ুভাইয়ের হাঁক ডাক করে আসা। ঠিক ছটায়। কই, শাশুড়ি চা কই? তিন, নোটনমণি ফুলের ফোটা। ঠিক নটায়। চার, ঝাঁটার কাঠির ছায়া মেপে। পাঁচ, বালি ঘড়ি করে। ... ...
রাইটার্সের সামান্য কেরাণী প্রমদাকান্ত, বড় দুই মেয়ের বিয়ের ভাবনাতেই কাহিল হয়ে থাকেন, আবার একটা মেয়ে৷ একটাও কি পাশে দাঁড়াবার মত কেউ জন্মাতে নেই! আর এই তো দেশের অবস্থা! যখন তখন স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে! আরে তোরা পারবি ঐ শক্তিশালী ইংরেজদের সাথে? আর সত্যি তো ইংরেজরা না দেখলে এই দেশটার কি হাল ছিল সে তো জানাই আছে৷ এইসব ভাবনার মধ্যে মানদার চাঁছাছোলা গলা ভেসে আসে ‘অ রুনু মায়ের কাছে একটু বোস দিকি, আমি খুকীটারে একটু পোস্কার করে নিই’৷ জলের স্পর্শে নবজাতিকা তীক্ষ্ণকন্ঠে কেঁদে ওঠে আর মানদার গজগজ চলতে থাকে ‘থাক থাক আর কাঁদে না – ঐ তো মেয়ের ঢিপি – তার আবার অত আদিখ্যেতা কিসের’? সাড়ে ছ বছরের রুনু ঠিক বুঝে যায় এই বোনটা একেবারেই অবাঞ্ছিত৷ ৩ বছরের ঝুনু অতশত বোঝে না, বোনকে দেখতে চায়, হাত বাড়াতে যায় – মানদার ঝঙ্কারে ভয় পেয়ে সেও বোধহয় নিজের মত করে বুঝেই যায় যে বোনটা এমনকি তার চেয়েও বেশিঅনাকাঙ্খিত৷ সরলাবালার জ্ঞান আছে কিনা বোঝা যায় না, চুপচাপ পড়ে থাকেন৷শুধু অনিলাবালা বলতে থাকেন ভগবান যা দেন তাই হাত পেতে নিতে হয়৷ অশ্রদ্ধা করতে নেই৷ তবে বাড়িতে জামাই আছে, তাই গলা তেমন চড়ে না৷ ... ...
তিনতলার ঘরে মস্ত বড় পালঙ্কের এক কোনায় বসে যুঁই আপনমনে সরু সরু দুটো কাঁটা আর খুব শক্ত আর সরু একলাছি সুতো দিয়ে নক্সা বুনছিল; একে বলে কুরুশের কাজ, নতুন শিখেছে ও নমিতা, ছোটমাসীমার দেওরের মেয়ের কাছে, বেশ দিব্বি ছোট ছোট কয়েকটা কাপডিশ বসাবার নকশাদার ঢাকনি বানিয়েও ফেলেছে। পুর্ববঙ্গে থাকতে ওরা জানত শুধু উলবোনা, চটের আসন বোনা আর টুকটাক রুমালে সুতো দিয়ে নকশা করা। ছোটমাসীমার নিজের চারটিই ছেলে কিন্তু তাঁর দেওর ভাসুরদের বেশ ক’টি মেয়ে, সকলের সাথেই যুঁইয়ের বেশ ভাব হয়ে গেছে এই কয়দিনে। মাঝে একবার খবর পেয়ে সাঁতরাগাছি থেকে সেজমাসীমা তাঁর বড়ছেলেকে নিয়ে এসে দেখে গেছেন যুঁইকে। কিন্তু তাঁকে কেমন অচেনা লাগে ওর, কিরকম অদ্ভুত ভাষায় কথা বলেন উনি। ছোটমাসীমাদের ভাষাও যুঁইদের থেকে খানিকটা আলাদা, কিন্তু তাও অনেকটাই মিল আছে, কিন্তু সেজমাসীমার ভাষা, উচ্চারণ সব কেমন আলাদা হয়ে গেছে। সেজমাসীমা আসবেন তাই দিদিমণিও এসেছিলেন খড়দা থেকে। দিদিমণি বলেন ‘তুই অ্যাক্করে এদেশী হইয়া গেছস শেফালী, তর কথাবার্তা আর আমরার দ্যাশের নাই’ সেজমাসীমা দিব্বি হেসে কেমন করে বলেন ‘যা বোলোচো মা। অ্যাগদম তোমার জামাইয়ের ভাষায় কতা কইচি।’ ... ...
এইসময় তো বাবার ব্যাঙ্কে অনেক কাজ থাকে, চেয়ার থেকে ওঠার সময়ই থাকে না , এইসময় হঠাৎ বাবা বাড়ী এল কেন --- এইসব ভাবতে ভাবতেই যুঁইয়ের স্নান সারা হয়, গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে ঘুরে অন্দরের ঘরে এসে ঢুকে চুল আঁচড়ায়, কাজল দিয়ে কপালে একটা টিপ পরে ছোট্ট – আধা অন্ধকার ঘরের দেরাজ আয়নায় নিজেকে দেখে একবার এপাশ ফিরে, একবার ওপাশ ফিরে। মা ঘরে ঢোকে বাচ্চুকে কোলে নিয়ে, ওকে দেখেই চাপা গলায় একবার বাইরের বৈঠকখানার ভেতরদিকের দাওয়ায় আসতে বলে। যুঁই ভারী অবাক হয়, বাইরের লোক থাকলে বৈঠকখানার দিকে ওর যাওয়া মানা তো, মা’কে প্রশ্ন করার সাহস ওর নেই, যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মা’র চোখ পড়ে ওর কপালের টিপের দিকে, চাপা গলায় প্রায় ধমকে মা ওকে টিপটা মুছে বাইরে যেতে বলে। যুঁইয়ের চোখে জল আসে – কোথাও তো একটু বাইরে যায় না কতদিন হল, ইস্কুলে যাওয়াও বন্ধ, বাড়ীর মধ্যে একটা ছোট্ট মুসুর দানার মত টিপ – তাও মুছতে হবে! মা ততক্ষণে অধৈর্য্য হয়ে এগিয়ে এসে নিজের আঁচল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দেয় টিপটা – একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখে নেয় কপালে টিপের কোনও চিহ্ন থেকে গেল কিনা – বাচ্চু হাত বাড়ায় যুঁইয়ের কোলে আসবে – মা হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে বাচ্চুকে কোলে চেপে ধরে হাঁটা দেয়। যুঁই কেমন আবছামত বুঝতে পারে কোথাও একটা কিছু গোলমাল হয়েছে, বড় গোলমাল। ... ...
সৌম্য বলল, “এটাকে আসলে বলে ইন্টার্নালাইজড হোমোফোবিয়া। অনেক হোমোফোবিক মানুষ আসলে নিজেরাই গে বা লেসবিয়ান। নিজেদের ওরিয়েন্টেশনকে ঢাকতে এরা ওভার কম্পেনসেশন করে আরো বেশি বেশি হোমোফোবিক হয়ে যায়। এরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যে যদি এরা কুইয়ার মানুষজনকে সাপোর্ট করে, তবে লোকে এদের কুইয়ার ভাববে। তুষারবাবুও তাদের মধ্যে একজন। তার সাথেই ছিল কনজারভেটিভ ভোটব্যাংক হারানোর ভয়। সব মিলিয়ে উনি ওই রকম হোমোফোবিক হয়ে উঠেছিলেন। তবে শুধু তুষারবাবু নন, মনে রাখিস আমাদের পলিটিশিয়ানদের অনেকেই এর শিকার। আমি ধরে ধরে এরকম বেশ কয়েকজন পলিটিশিয়ানের নাম বলে দিতে পারি। বিশেষত দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরের। আর আনন্দের মত এরকম অল্পবয়সী, আকর্ষক ছেলেরা এইসব হাই এন্ড ক্লায়েন্টদের গোপনে সার্ভিস দেয়, ফর সাম ক্যুইক ক্যাশ। অল গোজ ওয়েল যতক্ষণ না কোনও গোপন ক্যামেরায় কিছু রেকর্ড হয়ে যায়।” ... ...
য়োখেন আমার গভীর সংশয়ের আখ্যান শুনে বললে, জ্ঞান দিও না। .... এই যেমন তোমরা সিটি ব্যাঙ্ক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যোগাড় করে আফ্রিকার ঘানা কোকো বোর্ডকে ধার দিচ্ছ, আর সেটা ফেরত পাচ্ছ কোকো বোর্ডের নেসলে প্রমুখ খ্যাতনামা ইউরোপীয় চকোলেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ঘানা কোকো বোর্ডকে চেনে দুনিয়ার কোন বান্দা? কিন্তু এক বিলিয়ন ডলার দিতে বাজার পিছপা হচ্ছে না – কারণ তারা চেনে নেসলেকে, যারা কোকো থেকে চকোলেট বানায়। কোকো গেছে নেসলের ঘরে। তোমার আমার ছেলেমেয়ের দাঁতের সর্বনাশকারী চকোলেট বেচে তারা ঠিক টাকা দেবে। আমরা সেরকম একটা কিছু করতে চাইছি। ... ...
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'লালসালু' পড়লেও বোঝা যায়, মানুষের আসল ধর্ম বেঁচে থাকা। ধর্মব্যবসায়ীরা তাকে বদলে ধর্মান্ধ করে তুলতে চায় ধান্দায়। গ্রামে ধর্ম ছিল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না। ১৯৭০ এ গ্রামে কোনো মসজিদ ছিল না। ২০২০র আগে গ্রামে আলাদা করে কোনো স্থায়ী দুর্গামন্দির ছিল না। গ্রামে একটা ছোট্ট শিবমন্দির ছিল। গাজন বা চড়কে হিন্দু মুসলমান সবাই অংশ নিত। বারোয়ারি পুজো একটা ছিল। দুর্গা নয় ওলাইচণ্ডী পূজা। তাকে ঘিরে মেলা যাত্রা হতো। হিন্দু মুসলমানের মিলিত উৎসব। তালবড়া, তালের ফুলুরি জেলার খাওয়া হতো তার সঙ্গে কৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক আছে কলকাতা না এলে জানতে পারতাম না। গরিব মানুষ তো ভাদর আশ্বিন মাসে তাল খেয়েই বেঁচে থাকতেন। তাল আর শাকপাতা। ভাত, আলু ডাল তো দূরের কথা জুটতো কতজনের? সামান্য জাও বা ফ্যানভাত জুটলেই তাকে উৎসব বলে মনে হতো অনেকের। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোয় খাওয়ার কষ্ট পাইনি। কিন্তু অনেকের তো দেখেছি। ... ...
সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে রজত বলতে থাকল, “পৃথাদেবীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে আমি ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম। সেটা করতে গিয়েই ইনস্টাগ্রামে দেখতে পেলাম তুহিন আর পৃথার মানালি বেড়াতে যাওয়ার ছবি। খুব আনন্দে ভরা ছবি সব। আর সেই সব ছবির মধ্যেই আমার চোখে পড়ল আরেকটা জিনিস। চৌঠা নভেম্বরের ছবিতে পৃথার হাতে ছিল ওদের বিয়ের আংটি, যে আংটির ছবি এই ঘরে টাঙানো ছবিতে রয়েছে। পাঁচই নভেম্বর আঙুল খালি। ছয় নভেম্বর ওই আঙুলে আবার আংটি ফেরত এল। কিন্তু এবার অন্য আংটি। তবে দেখতে অনেকটা আগেরটার মতনই। ফলে খুঁটিয়ে না দেখলে সবার চোখে চট করে ধরা পড়বে না। কী মহেশবাবু, ওই দিনই তো আপনাদের ইনফর্ম্যাল এনগেজমেন্ট ছিল, তাই না?” ... ...
যতদূর শুনেছি গলা (গোলাস) খোলার অধিকার বা বাক স্বাধীনতার নাম গ্লাসনস্ত এবং পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণের নাম পেরিসত্রইকা। অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে ছিল সাধু – কেন্দ্রীয় নির্দেশ দ্বারা ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সমষ্টির শুভ সাধনা করার যে আপাত প্রয়াস চলে এসেছিল স্তালিনের সময় থেকে, সেটির ব্যর্থতা স্বীকার করলেন গরবাচভ। লক্ষ্য – এক স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের নবনির্মাণ ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এবার ব্যক্তি তার মত প্রকাশের অধিকার পেল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মতান্তরে কেজিবি নিরুদ্দেশ। অন্ধের নগরী, চৌপট রাজা। বাজার থেকে অদৃশ্য হল খাবার। ১৯৯০-এর আগে লাইন দিলে কিছু জুটত। যদিও মস্কোর বাজারে একটা রসিকতা চালু ছিল – কোথাও লাইন দেখলেই মানুষ দাঁড়িয়ে পড়তেন, পরে জানতে চাইতেন এটা কিসের লাইন। জনজীবন বিপর্যস্ত, তার কিছুটা আগেই দেখেছি সেন্ট পিটার্সবুর্গে। ... ...
সৌম্য বলল, “ওয়েট ওয়েট। একটু ধৈর্য ধরুন। বলছি। তবে তার আগে বলি, আমন মানে হল শান্তি। তুহিন ওর ধাঁধায় আমাদের বলেছে যে যদি কখনো তদন্তের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা যেন আমনকে খুঁজি। খুঁজব কোথায়? সেটারও ক্লু ও দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল জীবনে শান্তি খুঁজতে। আনন্দ শর্মা ওরফে আমন উঠেছিল জীবন লজেই। তুহিনের কোনও কারণে মনে হয়েছিল যে আমাদের হয়তো যখন তদন্তের প্রয়োজন হবে তখন আমাদের ক্লু দিতে ও আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু ও সেই ব্যাপারে সিওর ছিল না। তাই পৃথাকে সব কিছু খুলে বলে নি ওকে মিছিমিছি চিন্তায় ফেলবে না বলে। কিন্তু ও যদি নিজের বিপদ বুঝেই ছিল তাহলে জীবন লজে গেল কেন?” ... ...
গ্রামে কিছু মানুষ থাকতেন যাঁরা বই পড়তে পারতেন না, কিন্তু অঙ্কের ধাঁধা জানতেন আর বুদ্ধির খেলা বাঘবন্দীতে ছিলেন ওস্তাদ। আমি ফুটবল ক্রিকেট হাডুডু কবাডি নুনচিক বুড়ি বসন্তি ভলিবল একটু হকি --সব খেলতাম, কিন্তু বাঘবন্দি চাইনিজ চেকার দাবায় ওস্তাদ হয়ে উঠি। ক্যারাম তাসে সুবিধা করতে পারি নি। তা বাঘবন্দি খেলছি এক ওস্তাদ খেলুড়ের সঙ্গে। সংকল্প হারাতেই হবে। এমন সময় দেখি একটা সিংহের মতো দেখতে বিশাল কুকুর হেলতে দুলতে আমাদের খামারে হাজির। সোনালী ঝালর কেশর। বুকের কাছে বেশ চওড়া। কোমর সরু। এমন কুকুর কেবল সিনেমায় দেখেছি আগে। পরে বাস্তবেও এতো সুন্দর কুকুর দেখিনি। সংকর প্রজাতি। দেশি আর বিদেশি মিশেল। ... ...
বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে। কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়। ৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে। ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো। আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না। চুপ করে শুয়ে আছি। এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত। খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন। বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক। আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না। বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না। এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির। আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে। ধুলোটুলো ঝেড়ে। স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন। এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ... ...
আমার ভাবনা ছোটো চাষীদের নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে তাদের এখনো কিছু স্বাধীনতা আছে জানো। তারা চাষবাস এখনো অনেকটা বৈচিত্র্যময়। ফসলচক্র মেনে চলে মোটামুটি। সার বিষের ব্যবহার খুব কম করে। এরকম চাষীর সংখ্যা অবশ্য কম। অনেকেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে কৃষি পাঠশালায় ডেকে এনে সকলে মিলে বুঝতে চাইছি যে সার বিষ ছাড়া চাষ সম্ভব। তাতে খাবার খরচ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ অনেক কমে যাবে। চাষীরা অনেকটাই বোঝেন। সমস্যা তাদের অন্য জায়গায়। তাদের একটু আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন কারণ মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হলে ঠিক হতে সময় লাগে। সেসময় ফলনে সমস্যা হতে পারে। রোজগার কমে যাবে। সেই সময়টুকু তাদেরকে কে সাহায্য করবে? পুরো বাজারটাই তো উৎপাদক বিরোধী। ... ...
দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে। যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে। রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা। ... ...
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে। ... ...
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে। ... ...
ওলায় বসে জানলার কাচটা নামিয়ে দিল সৌম্য। এমনিতেই এসি ওর পছন্দ নয়, তার ওপর এই প্যানডেমিকের সময় মনে হয় একটু খোলামেলা থাকাই ভাল। সৌম্য ভেবেছিল তুহিনদের বাড়ি যেতে যেতে ও রজতের সাথে মায়ের এখানে আসার ব্যপারটা নিয়ে একটু কথা বলে নেবে। সোহিনীদেবী রজতকে চেনেন সৌম্যর বন্ধু এবং ওদের ডিটেক্টিভ এজেন্সি সৌরলোকের পার্টনার হিসেবে। তিনি জানেন, যে কাজের প্রয়োজনে রজতকে প্রায়ই সৌম্যর বাড়ি থেকে যেতে হয়। তাই সৌম্যর বাড়িতে সব সময়ই রজতের জন্য স্পেয়ার টুথব্রাশ, জামাকাপড়, ঘরে পরার পায়জামা, চপ্পল ইত্যাদি থাকে। কিন্তু রজত আর সৌম্য যে কাজের পার্টনারের থেকেও বেশি কিছু, সেটা ওঁর জানা নেই। ফলে, সোহিনীদেবী কলকাতায় এলেই রজতকে কিছু দিনের জন্য পাততাড়ি গোটাতে হয়। এবং প্রতিবারই এই নিয়ে একটা মন কষাকষি হয়। ... ...
যে পানীয় প্রস্তুত করার গৌরবে এ দেশ অমরত্বের দাবি রাখে, অকস্মাৎ ছোট ছোট গ্লাসে রাশিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ পানীয় আমার সামনে উপনীত হল। গ্লাসের আকৃতি দেখে ভাবলাম, ভদকা তুমি এত ছোট কেনে? সকলেই সেটি দ্রুত পান করলেন। গ্লাসগুলি টেবিল থেকে অদৃশ্য হল মুহূর্তের মধ্যে। গরুর ঘাস থেকে মানুষের স্টেজে উঠলাম। এবার আগমন আলুসেদ্ধ গোছের কিছু, তার সঙ্গে বাঁধাকপি। সেগুলো টেবিলে রাখা হয়েছে কি হয়নি, কে বা কারা আবার আমার সামনে হাজির করলেন ভদকার ছোট গ্লাস। মানে কী? এঁরা কি এইভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে ভদকা পান করেন? প্রশ্নটা ডাক্তার সাহেবের জন্যে জমিয়ে রাখলাম। ... ...