পরীক্ষকের মুখে কোন বাক্যি নেই, পাতা ওলটাচ্ছেন। আমি বললাম আমার ইসরায়েলি ভিসার কাগজটা ওর ভেতরেই আছে আর যদি ব্রিটিশ ভিসা খুঁজছেন আমি সেই পাতাটা খুলে দেখাতে পারি। নিরুত্তরে চোখ তুলে তাকিয়েই আবার পাসপোর্টে মনোনিবেশ করলেন। এতো মন দিয়ে আমি দস্যু মোহন বা দীপক চ্যাটারজির বিশ্বচক্র সিরিজের বই পড়ি নি। পিছনের ভদ্রমহিলাকে আমার সুটকেসটি দিয়েছিলাম আমার অনুমতির অপেক্ষা না রেখে তিনি সেটি খুলে দেখেছেন। ... ...
“শুনুন, এটা অনুসন্ধানের ইসরায়েলি কায়দা ! প্রথম জন আপনার সঙ্গে কথা বলে দ্বিতীয় জনকে পাঠাবার আগে রিপোর্ট দিয়েছে, আপনি কি বললেন। সেই লিস্টি মিলিয়ে দ্বিতীয় জন আপনাকে চেক করে। থিওরি হচ্ছে আপনি সত্যি বললে প্রতিবার তাই বলবেন, কোন ক্রিয়া পদ বিশেষ্য বিশেষণ একটু ওদিক হতে পারে,আপনার কণ্ঠস্বরে উষ্মা দেখা দিতে পারে। কিন্তু পর পর তিন বার ধারাবাহিক ভাবে মিথ্যে বলাটা শক্ত কাজ। নিরাপত্তার লোকেদের মনে সন্দেহ হলে আপনাকে পাঁচবারও প্রশ্ন করতে পারে। হিথরোতে আপনি ক্লিন চিট পেয়েছেন। যখন বেন গুরিওন হাওয়াই আড্ডায় নামলেন, আপনি একেবারে কোশার মানুষ ! এখন আপনি আমাদের অফিস কেন, এই উলটোদিকের পার্লামেন্টে গিয়ে একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসুন না !” ... ...
গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ ইউরোপে মশা পেয়েছি, মশারি পাইনি। তবে তাদের আক্রমণাত্মক মনে হয়নি। এখানেও কিছু গুঞ্জন শুনে ঘুমিয়ে পড়ি। পরের দিন ব্রেকফাস্টের সময়ে রজার বললে রাতে সে কিছু আরশোলার সম্মুখীন হয়েছিল। রিসেপশনে ফোন করে সঙ্কটের কারণ জানালে দু-জন মুশকো প্রহরীর আবির্ভাব হয়। তাকে খাটের ওপরে পা তুলে বসে থাকার আদেশ দিয়ে ঘরের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো একটা ছোটো চাপ জালের মতো বস্তু নিয়ে তাঁরা সেই প্রাণীদের পিছনে ধাওয়া করে তাদের গ্রেপ্তার করেন। অতঃপর প্রহরীদ্বয় বিজয়ীর হাসি হেসে ইঙ্গিতে দুয়োর বন্ধ করতে বলে বিদায় নিয়েছেন। ... ...
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় গো.. প্রেম নিবেদন করায় সু.. জুতো খুলে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করেছিল। সে তো রাধাও কৃষ্ণকে মারতে বাকি রেখেছিল প্রথম প্রস্তাবে। সেহারাবাজারে প্রেম মানে তো কোন দোকান বা পার্কে বসা নয়। ওই স্কুলে যাওয়ার সময় রিটায়ারিং রুমের যাত্রীদের সামনেই একটু আলাদা কথা বলা। চিঠি আদান-প্রদান। সেহারাবাজারে ছিল জংশন স্টেশন। বিডিআর ট্রেন। মিটার গেজ নয় একটু উন্নত। ধিকিধিকি চলে। দিনে দুবার ক্রশিং। সকাল দশটায়। বেলা সাড়ে তিনটায়। বাঁকুড়া থেকে ছেড়ে রায়না যায়। রায়না থেকে ছেড়ে বাঁকুড়া। সেহারাবাজার জমজমাট এই জংশনের কারণে। বহু লোক এসে দুড়দাড় করে নামে। ছুটে এসে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ওঠে। দুটো বাস দাঁড়াত। ... ...
অনেক দূরের যে দুর্গ সেদিন দেখা হয়নি, জুন মাসের এক সূর্যকরোজ্বল দিনে তার প্রাকারে দাঁড়িয়ে ওলেঙ্কা আমাকে ব্লেদ লেকের আখ্যান শোনাচ্ছিলেন। ব্লেদের দুর্গ হাজার বছর আগে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় হাইনরিখের বানানো। ‘আহা, ১৮৭১ সালের আগে জার্মানদের কোনো দেশ ছিল না গো’ এই গল্প আমরা করে থাকি, কিন্তু ভুলে যাই যে তথাকথিত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য আসলে ছিল একটি বিশাল জার্মান জমিদারি – সেখানে দাগ ও খতিয়ান নম্বর আলাদা করা ছিল না এই মাত্র। প্রত্যেক সম্রাট জার্মান। তারা সুন্দর জায়গা পেলে মহল বানান, উঁচু জায়গা পেলে প্রতিরক্ষার জন্য দুর্গ। ব্লেদ এই দুইয়ের আশ্চর্য সমন্বয়। ... ...
ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে সদস্য করতে বা ক্লাস ডায়াসিংয়ে গেলে গভীর চোখে তাকাত শোভা। ২৫ পয়সা দিয়ে এসএফআই-য়ের সদস্য পদ নিয়েছিল সবার আগে। সে সময় ২৫ পয়সা অনেক। তিনটে চপ বা পাঁচটা আইসক্রিম হতে পারতো। একটা পাঁউরুটির দাম তখন ১৫ পয়সা। বাপুজী কেক তখন বাজারে আসেনি। আরামবাগের পপুলার বা কোহিনূর কেকের দাম ২০ পয়সা। শোভা এখন ঝাড়া হাত পা। বর অবসরে। বন্ধুদের গ্রুপে কবিতা লেখে আর সবাইকে তাগাদা দেয়, চলো দেখা করি। সে এক্কেবারে তিনদিনের দীঘা ট্যুর ফেঁদেছে। কয়েকজন জুটেও গেছে। প্রসেনজিৎ রায়, সস্ত্রীক নবকুমার, সস্ত্রীক রমেশ, সস্ত্রীক আজম, সস্ত্রীক পীযূষ, নন্দিনী, মালা। প্রসেনজিৎ চুপচাপ ছেলে। পুনর্মিলনে বিরাট ভুমিকা নেয় অনন্তদা, জ্যোতির্ময়, সুবীর রক্ষিতদের সঙ্গে। ... ...
ভদ্রলোকের নাম সৈয়দ আমীর মির্জা,বয়স ৮৬ বছর। থাকেন কেল্লা নিজামতের ভেতরে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সন্নিকটে একটি বাড়িতে। ভদ্রলোকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১৯ সালে, পরে আরও বহুবার দেখা হয়েছে। বর্তমানে অধিক বয়সের ভারে ও নানান শারীরিক সমস্যা জনিত কারণে ভদ্রলোক এখন ঠিক মতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না, তবুও তাঁর সাথে কথা বললে ভদ্রলোকের আচার-আচরণ ও মার্জিত ব্যবহারই বুঝিয়ে দেয় তাঁর শরীরে আজও নীল রক্ত বইছে। ... ...
আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ''ক্যা সচ হ্যায়? '' দোকানদার কোন উত্তর দিল না। আমাদের মালপত্র গুছিয়ে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের কাগজের ব্যাগে ভরল। তারপর টাকার হিসেব করছিল। লোকটা মাঝবয়সী আর মাঝবয়সীদের প্রত্যয় ওর ছিল আরো নানা কিছু ছিল যা দোকানটার আনাচে কানাচে ভরা তাকে মালপত্রের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো। তার গন্ধ কি সারা দোকানটায় ছড়িয়ে রয়েছে? সেই গন্ধ আশপাশের জঙ্গলের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই আমাদের লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। বাঘ আসল না নকল বাঘ, আদমখোরের গল্পটা লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা গল্প না আসল কথা, সে সব দোকানদাররের কাছ থেকে যাচিয়ে নেবার কোন অবকাশ না পেয়ে আমরা আবার মালপত্র নিয়ে রিসর্টের দিকে রওনা দিলাম। ঠিক যে ভাবে এসেছিলাম সেভাবে রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আবার রাজ বাতাস শুখতে থাকে। বারবার শোখে । আমি জিজ্ঞেস করি, বাঘা জিজ্ঞেস করে, 'কিছু পেলি?' রাজু কোন উত্তর দেয় না। তারপর ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা কালভার্টের ওপর জলেদের যাতায়াত দেখে। একটু পেছনে থাকি আমি আর পার্থ। ... ...
আপনি যে একদিন বিখ্যাত হবেন তা আমার জানা ছিল, আমি মুজফ্ফর সাহেবকে বলছিলুম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন দেশবিখ্যাত এক লেটোশিল্পী হবেন। এখন তো দেখছি আপনি একজন দেশবিখ্যাত লেখক কবি এবং গায়ক, প্রায় ঠিকই ছিল আমার ধারণাটা। কিন্তু আপনি কি জানেন, ছেলেবেলায় আলাপ না হওয়া সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে মনে রেখেছি? আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম আমি নাকি এক ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছিলুম। ফকির মানে কী, আমি জানতুম না তখন। কিন্তু আপনার বাবা তো অজয়ের দুপারেই বিখ্যাত ছিলেন। আমি যখন শুনলুম তাঁর নাম ফকির আহ্মদ, কেউ না বলা সত্ত্বেও আমি ধরে নিলুম, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ফকির, এঁর আশীর্বাদেই আমি জন্মেছি। ... ...
সবটাই দামোদর নদের বালি উত্তোলন নিয়ে। ও হলো সোনার খনি। তিনি এক ব্যবসায়ীকে নিষিদ্ধ করেছেন চিঠি দিয়ে, সেই ব্যবসায়ী দিন পনের বাদে গাড়ি হাঁকিয়ে আমাকে এসে বলছেন, স্যার বলে পাঠালেন, কাগজপত্র, চালানে সই করে আমার কাজ শুরু করিয়ে দিতে। বললাম, স্যার চিঠি দিয়ে বন্ধ করেছেন, স্যার চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা রহিত না করলে তো আমি কোনো চালানে স্বাক্ষর করতে পারব না, লিজ অর্ডার দিতে পারব না। যাদব মশায় জোরাজুরি করতে লাগলেন। তিনি আমাকে হঠাৎ বলেছিলেন, আপনার বই কী বেরুলো স্যার, কত কপি ছাপা হয়, আমি কিনিয়ে নিবো। অপমানিত লেগেছিল। স্যরি। আপনি নিজেই তো বাংলা পড়তে পারেন না, আমি অফিসে বই বেচতে বসি না। তিনি না পেরে আবার জেলা সদরে ছুটলেন। বলে দিলাম, লিখিত অর্ডার যেন তিনি না নিয়ে আসেন। অফিসিয়াল চিঠি যেভাবে আসে, সেই ভাবেই আসে যেন। স্যার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর পাঠানো ব্যবসায়ীকে আমি প্রত্যাখ্যান করায়। ... ...
বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা। ... ...
প্রকাশন জগতের মানুষ, নজরুল বিস্ময় দেখায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী জাহানারাকে চোখে দেখেননি! বলেন কী! গল্প লেখেন, সেই গল্প ছাপানোর জন্যে কোন পত্রিকার সম্পাদককে ধরাধরি করেন না, নিজেরই পত্রিকা আছে। অসাধারণ সুন্দরী সে তো বললুমই, ধনীর দুলালী; মালদা থেকে বাংলার সমস্ত উত্তর দিক হয়ে পশ্চিমে বিহারের মিথিলা পর্যন্ত যে ভূমি, তার প্রধানতম জমিদার বংশ – জমিদার না বলে রাজবংশই বলা উচিত – তার সন্তান। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের কল্লোলের লেখকগোষ্ঠীর অনেক লেখকের সঙ্গেই এঁর যোগাযোগ। সাধারণত থাকেন কলকাতায়। আপনার মতো আমিও চিনতুম না গত বছর পর্যন্ত। ... ...
দারিদ্রের অনেকগুলো অবস্থা পেরিয়ে আজ যেখানে পৌঁচেছে কাজি, কোন হঠকারিতায় সেখান থেকে আগের অবস্থায় সে ফিরে যেতে চায় না। বুলবুল আর ইহজগতে নেই, কিন্তু এখন আছে সানি, কাজি সব্যসাচি বা কাজি সানিয়াৎসেন যার অপর নাম। এক বছর পাঁচ মাস তার বয়েস। তাকে তো বড় করে তুলতেই হবে। তার জীবনে যেন স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব না হয়। কাজি তাই তার এখনকার রুটিন বদলাতে চায় না। রোজ সকালে প্রতিদিনের মতো সে পৌঁছিয়ে যায় গ্রামোফোনের রিহার্স্যাল রূমে। ... ...
অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী—এই আপ্তবাক্যকে অবহেলা করে বাহাদুরি দেখাবার চিরাচরিত বাঙালি অভ্যাস কখনও ত্যাগ করিনি। লিলিয়ানার কাছে শোনা জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার এই সুযোগ। বললাম, ভিটেক, যতটুকু জানি – পোলিশ, চেক, স্লোভেনিয়ান একই স্লাভিক ভাষা পরিবারের সদস্য। তফাৎ আছে ব্যাকরণে, বাক্য বিন্যাসে, কিন্তু নিত্যদিনের ব্যবহারের শব্দ প্রায় এক। পোলিশে তোমরা গোনো ইয়েদনা দ্ভা ত্রি, স্লোভেনিয়ানরা গোনে এনা দ্বা ত্রি; পোলিশে কেনা হলো কুপিচ, এরা বলে কুপিতি। কার্ড কেনা নিয়ে কথা। তুমি তো আর দোকানদারের সঙ্গে ব্লেদ শহরের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা বিষয়ে কোনো আলোচনায় বসছ না! ... ...
এইভাবে অসংখ্য বন বাংলোর কথা ভাবতে ভাবতে বুকিং করা বাংলোটার কথা গুলিয়ে গেল এরকম সমস্ত এফ আর এইচ-য়ের ক্ষেত্রেই হয়। এসব জায়গা সাহেবরা খুঁজে, পেতে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে, হেঁটে ঘুরে ঘুরে আবিষ্কার করেছে তারপর জঙ্গল চিহ্নিত করে, দখল করে, সুরক্ষিত করে বানিয়েছে আর প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় করে তুলেছে—জঙ্গলের প্রতিনিধি হল বনবাংলো বা এফ আর এইচ, এরকমই চেয়ে এসেছে বৃটিশ সাহেবরা। যাদের স্থান মাহাত্ম্য বুঝতে হত যুদ্ধের কারণে। ... ...
ভদ্রলোকের বয়স প্রায় ৮৩ বছর। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইনিই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর পদের বৈধ উত্তরাধিকারী। মুর্শিদাবাদ শহরবাসী তাঁকে নবাব বাহাদুর হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করেন। ভদ্রলোকের নাম নবাব সৈয়দ মুহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা। তিনি থাকেন কেল্লা নিজামতের ভেতরে দক্ষিণ দরজার পাশে অবস্থিত একটি পুরনো বাড়িতে। তবে নবাব সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল, অনেকেই তাঁর সাথে দেখা করতে চান কিন্তু তিনি খুব একটা দেখা দিতে চান না। এতে অবশ্য কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, কারণ আজ যদি নবাবী আমল হতো আর উনি যদি নবাব হতেন তবে তো নবাব সাহেবের সাথে দেখা করা মোটেই সহজ সাধ্য হতো না। আজ হয়তো নবাবী আমল নেই ঠিকই কিন্তু নবাব সাহেবের শরীরের মধ্যে তো এখনও তাঁর পূর্ব পুরুষদের রাজকীয় রক্ত বইছে।ফলে তাঁর কিছুটা প্রভাব তাঁর আচরণে দেখা দেওয়া দোষের কিছু নয়। ... ...
সত্যি কথা বলি কাজীদা, আস্তে আস্তে কেমন ভালই লেগে গেল শিবপুরকে। ননী জেঠুর অনুমতি নিয়ে আরও দুয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই, হাতখরচের টাকা উঠে যায়। নানা মানুষের সঙ্গে মিশি, সাহিত্য সভায় যাই, লাইব্রেরিতে কিছু কাজের দায়িত্ব পাই, গান্ধি বিফল হলে যে লড়াই লড়তে হবে, তার আঁচ গায়ে লাগে, মিছিল-মিটিংয়েও যাই। পিংলার সঙ্গে তো সেইভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিন। করাচির কথা, আপনার কথা সব শুনেছি। একদিন বলল আপনার ‘নবযুগ’-এর কথা। মাঝেমধ্যে গঙ্গা পেরিয়ে ‘নবযুগ’ কিনেও আনে। সেই ‘নবযুগ’ পড়িয়েছি একজনকে। আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন। কাল আসবেন একবার? ... ...
কাজী উত্তর দেবার আগেই উঠে দাঁড়ান ডঃ শহীদুল্লাহ্, বলেন, আমার এবার যাবার সময় হল। যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলি কাজী। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখন তোমার পরিচয় হওয়া দরকার। সুধাকান্তবাবু বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কবে যে ওঁকে পাওয়া যাবে আমি ঠিক জানি না। শুনেছি, বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে ফিরেছেন। ইদানীং প্রায়ই বিদেশে যাচ্ছেন, কাজেই এর পরের বিদেশ যাত্রার আগেই ধরতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, এক-দেড় মাসের মধ্যেই ধরতে চাই। জোড়াসাঁকোয় নয়, চেষ্টা করব শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করতে, সেখানে উনি অনেক খোলামেলা। তুমি আমার সঙ্গে আসবে তো? ... ...
পার্থ গাছ আঁকছিল। এক বিশেষ আলোয় সে দেখেছে গাছকে যার তলায় রাতের বেলা হরিণ ঘুরছিল। রাতের বেলা বলে তখন গাছকে দেখা যায়নি, রান্নাঘরের জানলার পাতলা জালের ওপাশে দলে দলে হরিণ দেখা গেছে — চিতল হরিণ। ছবি আঁকছে দেখে বাঘা তাকে বলল,“সূর্যের আলোয় তোর মাথা ধরে যাবে। ছাওয়ায় বস।” পার্থ বলল,“ হ্যাঁ রোদে আমার মাথা ধরে যাবে। সরে যাচ্ছি। ” বাঘা বলল,“ সূর্যের আলো পড়লেই রোদ হয় আর গরম চেপে আসে তখনই তোর মাথা ধরবে। এই জঙ্গলের মধ্যে মাথা ধরে গেলে রোদ লেগে গেলে বড় মুশকিল।” একটা বিশেষ কোণ থেকে পার্থ গাছটা দেখতে পেল আর আলো এসে তাতে এমনভাবে পড়ল যে সে থাকতে না পেরে ছবি আঁকছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বাঁদর হেঁটে হেঁটে আসছিল, কুমু মালানি বনবাংলোর চাতালে বসে বসে দেখছিল বাঁদরের হাঁটা — রাস্তা দিয়ে। ... ...
খবর শুনে মা কাঁদল না, তবে পরের দিন আমাদের বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। পেট পুরে খেল ওই দুজন লোক, তারপর চলে গেল। আমি ততদিনে সেকেণ্ড ক্লাশ, মানে ক্লাশ নাইন-এ উঠেছি। মা আমাকে বলল, আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর যেতে হবে মেসপটমা না কী বলে, সেই আরব দেশেই। শুধু আমাকে বলেই ক্ষান্ত হল না মা, বস্তির সবাই জানল পিংলাকে তার মা যুদ্ধে পাঠাবে। আমাদেরই বস্তির মাতব্বর গোছের একজন শুধু মাকে সাবধান করে দিল, এখনই কিছু কোরো না, কেউ যদি বলে দু পয়সা খরচ করলেই সে তোমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে, বিশ্বাস কোরো না তাকে। আঠের বছর অন্তত বয়েস না হলে যুদ্ধে নেয় না। আর তা ছাড়া সাহেবরা সব দেশের ছেলেদের নেয়, কিন্তু বাঙালিদের নেয় না যুদ্ধে। বাঙালিদের জন্যে শুধু ইশকুল আপিস আর কোর্টের কাজ, সাহেবরা বাঙালির হাতে বন্দুক দেবে না। ... ...