পড়াশুনা যারা টুকটাক করেছেন, তারা অনুভব করেছেন যে ইহা মূলতঃ দুই প্রকার - ডিরেক্ট রিডিং এবং ইনডিরেক্ট রিডিং। ডিরেক্ট রিডিং অর্থাৎ যে বই আমি নিজে পড়েছি এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণ করেছি। যেমন শার্লক হোমস অমনিবাস, দা ভিঞ্চি কোড ইত্যাদি। ইনডিরেক্ট রিডিং অর্থাৎ যা আমি নিজে পড়িনি কিন্তু আমার বন্ধুরা পড়েছে বা পড়েছেন, তা থেকে জ্ঞান আহরণ করেছেন এবং সেই লব্ধ জ্ঞান ইতিউতি বিতরণ করেছেন এবং আমি সেই বিতরিত জ্ঞান আহরণ করে বইটির মূল বিষয়বস্তু এবং বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্বন্ধে জেনেছি। যেমন বোদলেয়ারের দর্শন, দান্তের কাব্য ইত্যাদি। জ্ঞান আহরণের এই দুটি সর্বজনমান্য পদ্ধতিকে আদি যুগে স্মৃতি ও শ্রুতি নামে অভিহিত করা হত। ... ...
পেদ্রো পারামোর দেশ থেকে আলো আসে, যদি তারে নাই চিনি, আমার সদর পুরো খুলবে না আর! অচিন ডানায় মেলা প্রেমের আহার, নেশা, রণের আহার তুমি কাছে টেনে নাও, শিস দাও মধ্যরাতে মেধার মাতাল, অপরিচয়ের ক্ষতে আলিঙ্গন রাখো, ... ...
কিন্তু আমার যাদবপুরে এম.এ. পড়তে আসাই হত না যদি না সেই গ্রীষ্মশেষের বিকেলে, কফিহাউসে গিয়ে টেবিল দখলের আগে, প্রেসিডেন্সির সিড়ির তলায় অপেক্ষারত প্রদ্যুম্ন ও আমার কাছে রীতিমত উদয় হয়ে, মানব বার্তা দিত, শহরে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বসেছে এবং তাতে তুলনামূলক সাহিত্য নামে এক নূতন বিদ্যা চালু হচ্ছে। আমাদের অনার্সের ফল বেরিয়ে গেছে, আমরা স্নাতকোত্তরের দরজায়। মানব জানাল, সে কলকাতায় বাংলা না পড়ে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য পড়বে। সেই বিভাগের প্রধান, বুদ্ধদেব বসুকে সে চেনে; তিনি তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। ... ...
আর সেই বন্ধুত্ব অটুট ছিল বলেই ১৯৭০-এর দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে, আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলন থেকে যে বিপুল লেখাপত্তর উঠে আসছিল, তার সঙ্গে আমায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল মানবই। আমি তো তখন একেবারে মূলধারার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম। আর মানব কোনোদিন মেনস্ট্রিম ছিল না। মানব আমাকে, মিকিকে আর তিন্নিকে শত শত বই কিনে দিয়েছে। এই সম্পর্কটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকবে কিন্তু এটাই মানবের সঙ্গে ছিল শেষদিন পর্যন্ত। আসলে সেসময়টাও অদ্ভুত ছিল—সেই সত্তরের দশক। চারপাশে আন্দোলন, বিরাট নারী-মু্ক্তি আন্দোলন হচ্ছে। সেসময় আমি আর মানব দুজনেই বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম যে একটা কাগজ দিয়ে কোনো সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায় না। আমরা সকলে একটা স্লোগান খুব ব্যবহার করতাম— The personal is political। ... ...
তুলনামূলক সাহিত্যের সঙ্গে তরজমার যে আত্মীয়তা তা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করে আর কেউ সম্ভবত দেখাননি। শুধুমাত্র ঘরের জানালা খুলে দিয়ে একটা মুক্ত এলাকা তৈরি করে তিনি সন্তুষ্ট থাকেননি। চেয়েছিলেন মননে স্বরাজ আনতে, তৃতীয় বিশ্ব বা এখনকার ভাষায় দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্বের নানা স্তরীয় সমৃদ্ধ মায়াময় বাস্তবের আর পৃথিবীর অবদমিত মানুষের সংগ্রামের কাহিনি বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। বিশ্বসাহিত্যের দরজায় এসে তিনি প্রশ্ন করলেন, কার বিশ্ব, কোন্ সাহিত্য? ... ...
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্য, আমার অন্তত মনে হয়, একটু অন্যরকম। তরজমাকারীকে আমার নদী পারাপারের বড়ো মাঝি মনে হয়। অনবরত দুই ভাষানদী পারাপারের অভিজ্ঞতা প্রকৃতপক্ষে লেখকের ‘আত্ম’-কে লুপ্ত করারই অনুশীলন। মানববাবু সেকথা বুঝতেন। এই ‘মিডিয়াম’ হিসেবে কাজ করতে করতে কণ্ঠস্বর বদলে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেটা মানববাবুর সম্ভবত অভিপ্রেত ছিল না। তিনি সর্বদা চাইতেন ‘নিজস্ব’ কণ্ঠস্বর নিয়ে কবিতায় ফিরে আসতে। হয়তো সেই জন্যই এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতেন, প্রস্তুতি নিতেন। ... ...
এবার আমরা নজর দেব মানবেন্দ্রের নিজের লেখার দিকে—বিশেষ করে তাঁর কবিতার দিকে। আমি বলছি না যে অনুবাদগুলো তার নিজের লেখার বাইরে। তবু এটা ঠিক যে অনুবাদক হিসেবে তার খ্যাতির জন্য তার কবিতা যতটা চোখে পড়ার ছিল ততটা পড়েনি। তা ছাড়া অন্য কারণও আছে যা হচ্ছে আমাদের মানসিক অভ্যাস সবকিছুকেই খোপে খোপে গুছিয়ে রাখার। ভাসকো পোপার ভাষায় আমরা কেবলই ছোটো ছোটো বাক্স তৈরি করি ও জগৎটাকে ভাগ ভাগ করে তাতে পুরে রাখি। এই অভ্যাস যদি ছাড়ি তাহলে দেখব যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় চুপিসারেই অনেক কবিতা, গল্প ও ছোটো উপন্যাস লিখেছেন। যদিও তাদের প্রভাব কিছুটা পড়েছে তবু মানবেন্দ্রর অনূদিত সাহিত্য তার কবিতার নিজস্ব চরিত্র কেড়ে নেয়নি বরং তাকে সমৃদ্ধ করেছে। ... ...
কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি সবসময়ই ভারতীয় সাহিত্যের কথা মনে রেখেছেন এবং বাঙালির কাছে বিভিন্ন ভাষার ভারতীয় সাহিত্যকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি ছিলেন পুরোপুরি সচেতন। পাঁচ খণ্ডে ভারতীয় গল্পের অনুবাদ সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এ ছাড়া দুই খণ্ডে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ভারতীয় গল্পের সংকলন তাঁর আর একটি স্মরণীয় কাজ। ভারতীয় সাহিত্য নিয়ে সারাজীবন ভেবেছেন ও কাজ করেছেন মানবেন্দ্র। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাঙালিরা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রতি যত আকর্ষণ বোধ করে, ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি ততটাই উদাসীন। তাঁদের চোখে ভারতীয় সাহিত্যও একটি প্রান্তিক সাহিত্য। তাই ভৈকম মহম্মদ বশিরের মতো দিক্পাল ভারতীয় লেখকের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। ... ...
কোনো পাঠক যদি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত জুল ভের্নের অনুবাদ গল্পগুলি পড়েন, তিনি বুঝবেন এই অনুবাদ আসলে কতখানি রূপতৃষ্ণা নিয়ে ওই বিখ্যাত লেখকটির রচনার প্রত্যেক শব্দকে নিজের জন্যই যেন সাজাচ্ছে, যেন জুল ভের্নের মধ্যে আছে এক আশ্চর্য জগতের চাবিকাঠি এবং মানবেন্দ্র প্রত্যেক দুটি শব্দের মধ্যবর্তী ফাঁকে সেই চাবিকাঠিকেই খুঁজছেন, আর সঙ্গে নিয়েছেন নিজের পাঠককে, যে পাঠকের মধ্যে ঠিক তাঁর মতোই এক বিস্ময়পাগল চিরকিশোর লুকিয়ে আছে। ... ...
একবার সাত আটদিন এ ঠেক ও ঠেকে কাটিয়ে সোজা ইউনিভার্সিটি গেছি। চুল-দাড়ি জট পাকিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে আমাকে দেখেই খপাত করে পাকড়াও করলেন। “খালাশিটোলাতেই গড়াগড়ি খাওয়া হচ্ছিল বুঝি!” সঙ্গের বান্ধবীটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওর বাপ কী করে? এত পয়সা পায় কোত্থেকে মাল খাওয়ার?” তারপর ট্যাঁক খালি শুনে পয়সা দিয়ে পাঠালেন চুল-দাড়ি কাটতে। নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন—আমি শ্মশ্রুগুম্ফহীন হয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে খুব খুশি হয়ে বাড়ি গেলেন। আমাকে কোনোদিন একবারের তরেও বলেননি খালাশিটোলায় যেও না। বরং হিজলিতে চাকরি করার সময় কবি শক্তি চাটুজ্জে একবার কেমন ওঁর বুকে চেপে বসে গলা টিপে মাল খাওয়ার পয়সা আদায় করেছিলেন সে গল্প শোনাতেন রসিয়ে। ... ...
উনি শেষ পর্যন্ত যখন ‘দ্য মেটামরফোসিস' পাঠটিতে এলেন আমি তখন এটুকু জেনে গেছি যে কিছুই আগে জানা হয়নি আমার। যত দূর মনে হয়, এই ছোটোগল্প পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই বোধহয় কাফকার উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’-ও পড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওটা পাঠ্য ছিল না বলে পড়বার দরকার নেই এমন তো না। এ যুগের স্যারেদের মতো বেশি তথ্য দিলাম ফলে সব জমিয়ে রাখা জ্ঞানটুকু খরচ হয়ে গেল সেই ভয় ওনার ছিল না। জীবনদর্শনই ছিল জানা ও জানানোর। সিলেবাসে যা আছে, যতটা পড়ানোর কথা, তার থেকে সবসময় বেশি পড়িয়ে দিতেন। অনেক পরে দেখেছিলাম মেপে কাজ করা, মিতব্যয়িতা ও যৌক্তিকতা এইসব সামান্য খোপের মধ্যে আটকে পড়ে থাকার মতো মানুষ উনি নন। ... ...
স্মৃতিরোমন্থনের এই মুহূর্তে মনে আসছে তায়েব সালিহ্-র ‘A season of Migration to the North’ বা ‘উত্তরে দেশান্তরিত হবার মরশুম’ নামের ছোটো উপন্যাসটির কথা, মানববাবুর কথায়, “উত্তরে দেশান্তরিত হবার মরশুম প্রধানত সন্ধানের কাহিনি: অন্য একজন মানুষের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে কী করে একজন শেষপর্যন্ত, নিজেকেই খুঁজে পেল।” এই উপন্যাসের শেষে উপন্যাসের কথক নদীর জলে ডুবতে গিয়েও, জীবনকে বেছে নেয়, সাহায্যের জন্য আর্তনাদ করে ওঠে। তায়েব সালিহ্-র এই কথকের মতোই আমরা অনেকে নিজেকে খুঁজতে থাকি মানববাবুর লেখার মধ্যে। অনুবাদের জন্য যে টেক্সটকে নির্বাচন করেছেন, তার সঙ্গে আমরাও ঘুরেছি—উত্তর থেকে দক্ষিণে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তে বা বলা যায় বিভিন্ন জানা-অজানা প্রান্তে। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘোরার এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, ভাষার বহুত্বকে অনুভব করলে বোঝা সম্ভব মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ডের স্বরূপকে। ... ...
অনুবাদের পাশাপাশি এইসমস্ত অসামান্য প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেখাতে থাকেন লাতিন আমেরিকার রক্তাক্ত ইতিহাস ও তার থেকে নতুন এক লাতিন আমেরিকাকে গড়ে তোলার স্বপ্ন কীভাবে সেখানকার সাহিত্যে ভাষা পাচ্ছে। লাতিন আমেরিকার বিদ্রোহী কবি কথাকারেরা ইউরোপীয় আখ্যান জগৎ থেকে সচেতনভাবে স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন। সেটা রচনার বিষয় ও প্রকৃতি উভয় দিক থেকেই। তাঁদের লেখায় রয়েছে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিকতা, যা তাদের লেখার বিষয়বস্তু ও রীতিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তাঁরা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস জুড়ে যে শোষণ চলেছে ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক যুগে, তাকে ও তার প্রতিক্রিয়াকে নানাভাবে ধারণ করতে চান তাঁদের গল্প উপন্যাসে। সম্পদের লুঠতরাজ, শ্রম শোষণ, স্বৈরতন্ত্র এবং সে সবের প্রতিক্রিয়াজাত দ্রোহ রাজনীতির ব্যাপারটি লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে কীভাবে উঠে আসছে অনুবাদ ও প্রবন্ধের মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে তার সাথে নিরন্তর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মানববাবু। ... ...
তখন আমি সবে মাধ্যমিক, কিন্তু বাংলা আকাডেমিতে দিব্য যাতায়াত, লাইব্রেরির থেকে Esperanto-র ওপর একটা বই নিয়ে বাবার ঘরে বসে বসে পড়ছি। বাবার সঙ্গে তখন একজন ঝকঝকে মানুষ তরতর করে অনেক গল্প করছেন, আমি কিছু শুনছি, কিছু বইতে মন। যাই হোক, একটা ছটফটে বাচ্চা মেয়েকে এস্পেরান্তো পড়তে দেখে তাঁর আমাকে খুব মজাদার লেগেছিল, সেদিনই প্রথম তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্প্যানিশরা J কে খ বলে, আর উনি তার মানে খাদবপুরের অধ্যাপক! ... ...
আমাদের তথ্যানুসন্ধানের কাজ শুরু হয় ২০১৮-র এমন এক সময়, যখন ভাটপাড়ার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবন আগুন আর ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়েছিল। ভাটপাড়া নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সহায়তায় আমরা বিভিন্ন সময়ে কিছু ফিল্ড সার্ভে-ও করেছিলাম। বছরখানেক পেরিয়ে এসে আমরা যখন পুরোনো বিবৃতিগুলির পর্যালোচনায় বসেছি, ঠিক তখনই কিছু নতুন শব্দকে কেন্দ্র করে নতুন করে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি রূপ নিতে শুরু করেছে—‘নিজামউদ্দিন-মুসলিম-করোনা’। ইতিমধ্যে তেলিনিপাড়াতেও দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, এবং ফলস্বরূপ হুগলি নদীর দু-পারেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ... ...
পাইলটের আকাশবাণী হল আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা ক্রাইস্টচার্চের বিমানবন্দরে অবতরণ করব, ঠিক এই সময়ে নজরে এলেন দক্ষিণ আল্পস, পাহাড়চূড়ায় তুষার, যেন সদ্য স্নান করে গায়ে ট্যালকম পাউডার মেখে স্থাণুবৎ গা এলিয়েছেন পশ্চিমতটরেখা বরাবর। তরঙ্গের মতন সাদা বরফের চূড়া, তার অনতিগভীরে কোথাও বা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ ছোট হ্রদ, তারপরেই ক্যান্টারবেরির প্রশস্ত প্রান্তর জুড়ে এঁকেবেঁকে চলা অজস্র শিরা উপশিরার মতন নদী, দেখতে দেখতে ক্রাইস্টচার্চ ঘিরে আকাশপাখি গোল করে ঘুরতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল দিগন্তে ম্যাজিক। ... ...
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে যখন আফ্রিকায় ইউরোপিয়ানরা কলোনি গড়ে তুলছে, তখন তাদের মধ্যে সিফিলিস মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। পেনিসিলিন আবিষ্কার হবে আরও দেড়শো বছর পরে। ইউরোপিয়ান সৈনিকরা খেয়াল করেছিল যাদের ম্যালেরিয়া হচ্ছে এবং বরাত জোরে ম্যালেরিয়ার থেকে বেঁচে ফিরছে তাদের সিফিলিস সেরে যাচ্ছে। একাধিক সৈনিকের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রকৃত কারণ বলা মুশকিল। তবে একটা কারণ হতে পারে সিফিলিসের জীবাণু ট্রিপোনেমা প্যালিডাম বেশি উষ্ণতায় বাঁচে না। ম্যালেরিয়া জ্বরের সময় দেহের উষ্ণতা মাঝে মাঝেই ৪০ – ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। সেই যুগে ম্যালেরিয়ারও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা ছিল না। ফলে জ্বর চলতো দীর্ঘদিন ধরে। শরীরের মধ্যে থাকা সিফিলিসের জীবাণু এই উচ্চ তাপমাত্রায় মারা পড়ত। ... ...
এক সুফি পীর বলেছিল ছেলেকে "রাত কি রানি” ফুলের কাছে নিয়ে যেও না যেন। তাহলে তাকে আর বেঁধে রাখতে পারবে না। রাত কি রানি, শিউলি ফুল। নিশিরাত জুড়ে সে কান্নার মত ঝরে পড়ে। অজস্র কান্নার ফোঁটা। সেই উদাসী - গন্ধ ওকে ঘর ছাড়া করবে। সেই থেকে মা, রাত কি রানি ফুল থেকে ছেলেকে দূরে রাখে ! আজমেঢ় শরিফে মাথা কুটে এই ছেলের জন্ম। বাবার অকাল মৃত্যুর পরে চিরাগ এ দিল্লির আঙিনায় খেলে বেড়ানো এক খ্যাপা ছেলেকে দেখে মায়ের চিন্তা হয়। পীর বলে, রাজার দুয়ারে মাথা কুটলে রাজার জন্ম হয়, নিদেন পক্ষে মন্ত্রীর । ফকিরের দরগায় মাথা কুটলে ফকির হবে না তো কি শাহেনশা হবে? ... ...
মহামারীর আবহে মামুলি এক মাস্ককে ঘিরে যে বহুমাত্রিক তাৎপর্য সেটিও আমাদের কাছে ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। শতবর্ষ আগের নিছক গজ আর কাপড়ের মাস্ক আজ বিপণনের অমূল্য সামগ্রী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তাবড় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া আর সর্বজ্ঞ হিতৈষীদের প্রতিনিয়ত উপদেশ ও পরামর্শের ঠেলায় এবং 'ইনফরমেশন প্যানডেমিকে'র দাপটে সাধারণ মানুষ আজ দৃশ্যতই বিভ্রান্ত। আর মানুষের মনের এই বিভ্রান্তি ও আতঙ্ককে মূলধন করেই দুনিয়া জুড়ে পসরা বসেছে নানা ধরনের মাস্কের। শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার তাগিদে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের চাহিদা, প্রয়োজন, মর্যাদা, ও মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে রকমারি মাস্ককে অনবরত বাণিজ্যিক ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে 'কালচারাল' বা 'ফ্যাশন স্টেটমেন্ট' হিসেবেও। ... ...
আমরা বরং, এই দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে, পপুলিজম কেন বিপজ্জনক সেটা বোঝার চেষ্টা করি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে পপুলিজম ব্যাপারটা মোটেই খুব একটা খারাপ বলে মনে হয়না। হাজার হোক, গণতন্ত্রের তো উদ্দেশ্যই মানুষের কথা আরো বেশি করে তুলে আনা, তাঁদের অভাব অভিযোগ গুরুত্বসহকারে ভাবা। একরকমভাবে এলিট শাসকদলের এইসব অভাব অভিযোগ সম্পর্কে ঔদাসীন্যই তো পপুলিস্ট বা তোষণের রাজনীতির কারণ। কিন্তু বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট দল বা নেতৃত্বের উত্থান এবং ঘটনাপরম্পরা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় বিপদটা কোথায়। আরো স্পষ্ট হয় ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে। সেখানে একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন আছে। ... ...