বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, আমিই সেই জার্মান সৈনিক। ডেভিড সেটা বুঝলেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। উনচল্লিশ বছর আগে ইলিনয়ের ডেভিড দে ফ্রিস অস্ত্র হাতে জার্মানির হেসেনের এক পরাস্ত জার্মানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। চারদিকে যখন খুন কা বদলা খুন হচ্ছে, সেখানে অস্ত্রহীন জার্মানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তার ওপরওয়ালার অফিসে। তার পরিচয়পত্র নাম ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে, তাকে যুদ্ধবন্দির সম্মান দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের শেষে বিজেতারা ফিরেছেন শিকাগো ইলিনয়, আর বিজিত ফিরেছেন হেসেন, জার্মানি। জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন প্রথমে। ডেভিডও ততক্ষণে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়েছেন। চার দশক আগের দুই শত্রু। একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। ... ...
'কাদামাটির হাফলাইফ' -- একটি অনন্যসাধারণ রচনা। অনন্যতা নামকরণে। হৃদয়ে বিরাজ করা ভাবনা নির্বাচনে। অনবদ্য জীবনকথা উচ্চারণে। বৈঠকি মেজাজে সত্যোচ্চারণ করার অভূতপূর্ব ভঙ্গিমায়। ১১৬ পর্বে বিন্যস্ত জীবনে জীবন যোগ করার অবিস্মরণীয় সাহিত্যকর্ম 'কাদামাটির হাফলাইফ' সাহিত্যকর্ম তো বটেই, অন্তত আমার নিবিড় পাঠ অনুভবে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে ষোলআনা একাত্মতায়। আমরা জানি কোনো প্রচারধর্মী, রাজনৈতিক, সামাজিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে জাত হতেই পারে না প্রকৃত সাহিত্য। ভাবে ভাষায় ও রূপে তার নির্মাণ এক 'হয়ে ওঠার' বৃত্তান্ত। মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের কথায় : " A poem Should not mean / But be." ইমানুল হকের 'কাদামাটির হাফলাইফ' ঠিক তেমনই গ্রামবাংলার নির্ভেজাল ও 'কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা'-র সার্থক সাহিত্যরূপ। ... ...
কেন ঐ যুবকেরা সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে, ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ শ্লোগান তুলেছিলেন সেই প্রশ্নও সামনে চলে আসতে পারে। একদিকে বিজেপির ছোট বড় নেতারা, বিষয়টিকে বলছেন, শুধুমাত্র নিরাপত্তাজনিত খামতির ফলে এই ঘটনা ঘটেছে, অন্যদিকে যে যুবকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদি ধৃত যুবক-যুবতীদের মধ্যে কোনও একটি নামও সংখ্যালঘু মুসলমান হতো, তাহলে কি শাসকদল এবং তাঁদের পোষা গণমাধ্যম এই রকম চুপচাপ থাকতো? তখন কি এই আক্রমণকে সামনে রেখে, তাঁরা হিন্দু মুসলমানের মেরুকরণের রাজনীতি করতেন না? ... ...
কথায় কথায় ঝগড়া। কিন্তু আমারও বাবাকে ছাড়া চলে না। বাবারও আমাকে ছাড়া। আমাদের এলাকায় অঘ্রাণের নবান্নের দিন থেকে নানা জায়গায় মেলা আর যাত্রা শুরু হতো। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর একটা নতুন জিনিস শুরু হল। গ্রামে গ্রামে কবিতা ও গল্প পাঠের আসর। সঙ্গে গান। কখনও কারও বাড়িতে, কখনও মঞ্চ বেঁধে এ-সব চলতো। আজকের দিনে বিশ্বাস হবে না, মানুষের। নবম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৮০ সাধারণ অব্দ। সাহাজাপুর গ্রামে মঞ্চ বেঁধে কবিতা পাঠ ও গানের আসর। এরপর বোধহয় বাবাদের নাটকের দল এলএমজি বা লাইটম্যান গ্রুপের নাটক ছিল। কাকদ্বীপের এক মা। সে নাটক দেখে স্বয়ং স্রষ্টা উৎপল দত্ত প্রশংসা করেছিলেন। সিপিএমের বর্ধমান জেলার পরবর্তীকালের বহু দাপুটে নেতা ওই নাটকে অভিনয় করতেন। বাবাকে পার্টির লোকরা সবাই 'কাকু' বলতেন, আর পার্টির বাইরের লোকেরা এনামভাই, বা মাস্টারমশাই। ... ...
পানের রসের লাল রঙ ঠাকুমার ঠোঁটে রাঙিয়ে দিচ্ছে। গা থেকে হাকিমপুরি জর্দার মিষ্টি ঘ্রাণ। রান্নাঘরের বারান্দায় বসে আছে ঠাকুমা। আমি তাঁর কোলের ভেতর হাত লুকিয়ে পিসি ঠাকুমার নতুন পদ রান্না দেখছি, ও পিসি ঠাকুমা, আঁচ এত কম কেন উনুনের? ... ...
শিবপুজনজি সারা জীবন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বেশ কয়েকবার জেলে গিয়েছিলেন। তিনি আশির দশকে মহেন্দ্র সিং টিকাইতের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন। ১৯৮০ সালে খালে জলের জন্য আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি জামিন চাইবেন না। ফলস্বরূপ, ছাব্বিশ মাস তিনি সাসারাম জেলে ছিলেন। তাঁর মুক্তির জন্য তারই এলাকার কৃষকরা দিনারা থেকে সাসারাম পর্যন্ত চল্লিশ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছিল। একবার বিধায়ক হওয়ার পরে, শিবপুজনজি নিজেকে বড় দলগুলির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি আর কখনও নির্বাচনী রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি। কিন্তু শত প্রলোভন সত্ত্বেও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আপোষ করেননি। ... ...
খুবই গোলমেলে অ্যাসাইনমেন্ট। ‘আমার জার্মানি’ বইটার রিভিউ করতে বসেছি। গোদা বাংলায় পুনর্বার দেখা (Review) কি দেখব, কোনখান থেকে দেখব। শুধু জার্মানি হলে কথা ছিল। স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি ১৯৭২ সালে। জলপাইগুড়ি বহরমপুর শ্যামবাজার ব্রাঞ্চে কাজ শেখা। তিন বছর বাদে দু-বছরের জন্য জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট অফিসে বদলি। ফ্রাঙ্কফুটের প্রথমদিন একটি অসামান্য অবদান। পুরো লেখাটার মধ্যে ছড়িয়ে আছে রসিকতার মণিমুক্ত। যে লেখক নিজের দুঃখ নিয়ে নির্মল রসিকতা করতে পারে তার লেখনি কোন মার্গে উঠতে পারে এই অধম রিভিউ রাইটার তা কল্পনাও করতে পারেননি। আসার সময় হাতে ছিল ১২৫ ডলার তার মধ্যে ৫৫ ডলার নিজের সুটকেসের লাইনিংয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হাতে পেনসিলের মতো করে ধরা ছিল ৭০ ডলার। হীরেন পৌঁছে গেলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে কিন্তু সুটকেস পৌঁছলো না। নিজের অসহায় অবস্থার বিবরণে যে স্যাটায়ার লুকিয়ে আছে, তা এককথায় নান্দনিক। ... ...
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন। পরীক্ষার পাহারা দিচ্ছি ১০ নম্বর ঘরে। আমার সঙ্গে ডিউটি পড়েছিল শুভলক্ষ্মী পাণ্ডে দিদির। ইতিহাসের অধ্যাপিকা। প্রচুর বই পড়তেন। শুভদির হাতে সেদিন দেখি 'নির্বাস'। সুধীর চক্রবর্তীর লেখা। শুভলক্ষ্মীদি সুধীরবাবুর খুব প্রিয় জানতাম। শুভলক্ষ্মীদিকে বললাম, বইটা দাও। পড়ি। তোমার এখন থাকার দরকার নেই। আমি হলে আছি। তখন কড়া পাহারা দেওয়ার জন্য আমার খুব কুখ্যাতি। একটা ছেলে দেখি, দেখতে সুদর্শন, খুব বিরক্ত করছে। টুকলি উদ্ধার করলেও আবার ম্যানেজ করে ফেলছে। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওর পাশে গিয়ে বসে বই পড়তে শুরু করলাম। ... ...
আসলে তাঁতমাকুর খটাস খটাস শব্দহীন এই পাড়া সত্যিই খুব বেমানান। তাঁতমাকু থেমে যাওয়া মানেই তো সবকিছু থেমে যাওয়া নয়, তাই তো কদিন পরেই শূন্য তাঁতঘরে নতুন দোকানঘর হবে। সেখানে থাকবে নাবিস্কো বিস্কুট, ঝুরি ভাজা, কাঠি লজেন্স, গন্ধ সাবান আরও কত কী! শুধু থাকবে না নিথর দুপুরে তাঁতঘর থেকে ভেসে আসা পুরোনো কোনো গানের সুর অথবা বিরান বিকেলে ভেসে আসা বাঁশির কান্না, বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে… ... ...
বিজেপি সমর্থকরা ইতিমধ্যেই জয়ের উচ্ছ্বাসে মত্ত। অন্যদিকে বিরোধীরা হতাশ। কিন্তু কারও জিজ্ঞাসা করার সময় নেই: এই সারমর্ম কি আদপে সত্যি? এভাবেই বিজেপি মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলে এবং জিতে যায়। সত্যের একটি ছোট বেলুন এত বড় করে ফুলিয়ে তোলা হয় যে বিপরীত সত্যিটা লুকিয়ে পড়ে। লড়াই শুরুর আগেই প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে পড়লে ম্যাচ ওয়াক ওভার পেতে পারে। অতএব, আমাদের এই দাবিটি ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। ... ...
সংকলনটি দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া ছিন্নমূল প্রজন্মের নতুন দেশে বেড়ে ওঠার নতুন জনপদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এক জরুরী প্রয়াস। বইয়ের প্রচ্ছদে যেন দেখি - কালো বাংলা অক্ষরমালারা কাছাকাছি আসতে আসতে ধেবড়ে গেছে, তাদের গা বেয়ে গড়াচ্ছে রক্তের দাগ, সেই রক্ত আবার কালচে জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছে মানুষদের আবছা অবয়ব। বইয়ের ভূমিকাতেও সোমনাথ রায়ের মনে পড়েছে তার কলকাতার বাড়ির পাশের খলিসাকোটা কলোনির মানুষদের কথা, যারা বরিশালের খলিসাকোটা গ্রাম থেকে চলে এলেও নিজেদের গণস্মৃতি এবং গণশোক ছিন্ন হতে দেননি এবং কলোনির নামের মধ্যে দিয়ে নিজেদের গ্রামকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ... ...
তখন এক অতি অমানবিক প্রথা ছিল। দূরে পরীক্ষাকেন্দ্র। ২৬ কিমি দূরে বাড়ি থেকে। বর্ধমান শহরে। দিনে দুবার পরীক্ষা। তিন তিন ছয় ঘন্টা। আলাদা বিষয়। চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক। তখন বাসে বর্ধমান যেতে সময় লাগতো দু থেকে আড়াই ঘন্টা। বাস খারাপ হলে তো কথা নেই। পরীক্ষার আগের দিন অভিভাবকদের শহরে আসতে হতো ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকতে হতো রান্না করে খেতে হতো। ... ...
দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে! আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম। ... ...
আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর আগে, ১৯৫০ সালে, প্রোফেসর উইলিয়ম এস রবিনসন একটি যুগান্তকারী পেপারে (“Ecological Correlations and the Behavior of Individuals”) প্রমাণ করে দেখান, যে, দুটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক (অর্থাৎ কোরিলেশন) সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা দুরকম হতেই পারে, যদি একটি মাপা হয় সমষ্টির জন্য (অর্থাৎ এগ্রিগেট লেভেল) আর একটি ব্যক্তির পর্যায়ে (অর্থাৎ ইন্ডিভিজুয়াল লেভেলে)। রবিনসনের পেপারে ১৯৩০ সালের আমেরিকান জনগণনার—অর্থাৎ সেন্সাসের—ডেটা অ্যানালাইজ করে দেখানো হয়, যে ঐ সময়ের ৪৮টি স্টেটে যদি বিদেশে-জন্মানো (ফরেন-বর্ন) শতাংশ এবং সাক্ষর জনতার (আমেরিকান ইংলিশে সাক্ষর) শতাংশের মধ্যে কোরিলেশন পজিটিভ: ০.৫৩। এর থেকে ধারণা হতে পারে—যে রাজ্যে যত বিদেশ থেকে আসা লোক, সে রাজ্যে তত কম নিরক্ষর মানুষের শতাংশ, অথবা, তত বেশি সাক্ষরতার হার। আর একটু এগিয়ে ব্যক্তি-স্তরে নিয়ে গেলে, এমন মনে হতে পারে—যে, বিদেশে-জন্মানো মানুষের (আমেরিকান ইংলিশে) সাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা দেশে-জন্মানোদের থেকে বেশি। কিন্তু, এই সম্পর্ক-ই যদি ব্যক্তির স্তরে দেখেন, ঐ দুই রাশি—বিদেশে জন্ম আর সাক্ষরতা—এবার কিন্তু কোরিলেশন নেগেটিভ: —০.১১, অর্থাৎ সমষ্টি থেকে ব্যষ্টি-স্তরে আসতেই সম্পর্ক উল্টে গেলো। তবুও কখনো কখনো ব্যক্তির আচরণ আর সমষ্টির ব্যবহার এক-ই হয়, কখনো হয় এক্কেবারে উলটো। সেই গণ্ডগোলের নাম “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি”। “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি” শব্দবন্ধ অবিশ্যি রবিনসনের দেওয়া নাম নয়, সেটির আবির্ভাব কিছুদিন পর সেলভিনের ১৯৫৮ সালের পেপারে – ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসির সংজ্ঞা পেলাম আমরাঃ ‘the invalid transfer of aggregate results to individuals’! ... ...
রান্না প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, একবার, বোধহয় ১৯৭৭/৭৮, পাশের গ্রাম ধারানে ফুটবল ম্যাচ খেলা। সেমিফাইনাল। আমাদের গ্রামের হোমটিম বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সেমিফাইনালে গিয়েই আটকে যেত। এইজন্য বাইরে থেকে খেলি/ খেলোয়াড় হায়ার করে আনা হয়েছে। বর্ধমান শহর থেকে একদল। সঙ্গে এলাকার প্রসিদ্ধ খেলোয়াড় জিন্না। একমাথা কোঁকড়া চুল। ফর্সা রঙ। বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যেত। তখনকার দিনে ৫০ টাকা প্রতি ম্যাচ। আমাদের গ্রামকে টাকা দিতে হয়নি। গ্রামে বোনের বিয়ে হয়েছে। কী করে টাকা নেয়! গোলকিপারের নাম যতদূর মনে পড়ে রামু। বর্ধমানের খ্যাতিমান খেলোয়াড়। দাদা তখন রাজ কলেজের জিএস। তাঁর সুবাদে এসেছে। পয়সা লাগেনি। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার মোচ্ছব। আমাদের বৈঠকখানায় উঠেছে। গর্বে বুক ফুলে উঠছে। একবার খেলোয়াড়দের দেখছি আরেকবার ছুটছি চুলোশালে। ... ...
সুভাষদা, সুভাষ গাঙ্গুলিকে নিয়ে লিখতে গেলে এখন এই বয়সে এসে ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি ধূসর পাণ্ডুলিপির মত ভেসে চলে যায়। এই তো সেদিন এপিডিআরের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সাক্ষাতকার নিতে গেছিলাম সুভাষদা-ভারতীদির ফ্ল্যাটে। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত উষ্ণ গলায় সাদর ডাক। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত খাদির পাঞ্জাবী আর বড় ফাদের পাজামা। সেই প্রথমদিনের মত কদমছাঁট চুল, নাঃ সেবার ছিলো একমাথা কালো এবার পাক ধরেছে তাতে। সেই একই রকম ছিপছিপে অবয়ব, কালো ফ্রেমের চশমা। ... ...
যদিও উপরে বলা এইসব ভাল ভাল জিনিসের আমাদের অভাব ছিল, তবু আমাদের কাছেও লবণে-জারানো জিরাফ ও জেব্রার জিভের আচার ছিল; হালিমাহের বানানো উগালি ছিল; এছাড়া মিষ্টি আলু, চা, কফি, ড্যাম্পার বা স্ল্যাপজ্যাকও ছিল; কিন্তু সেসব খেয়ে খেয়ে মুখে চড়া পড়ে গিয়েছিল। আমার দুর্বল পেট, বিভিন্ন ওষুধ, ইপিকাপ, কোলোসিন্থ, টারটার-এমেরিক, কুইনাইন এইসব খেয়ে খেয়ে বিরক্ত, কাতর। এইসব হাবিজাবি খাবারের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করছিল। "ওহ, একটা গমের রুটি!" আমার মন কাঁদছিল। "একটা রুটির জন্য পাঁচশ ডলারও দিতে পারি!" ... ...
পাতালপুরী আর রানিগঞ্জ শব্দদুটো কাছাকাছি দেখে আন্দাজ করতে পারছিস সিনেমার গল্পটা কী বিষয়ে? কয়লাখনি। সেই কতদিন আগে হক সাহেবের নবযুগ পত্রিকায় – আরে, হক সাহেব বলছি কেন? তুই তো নিজেই ওই পত্রিকার সোল সেলিং এজেন্ট ছিলি, মনে নেই? – কয়লাখনির শ্রমিকদের শোষণের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছিলুম একটা। এখন আবার এসেছি ওদের সঙ্গে মিশতে; সারা দিনের ডিউটির পর ওদের বস্তিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কী ধরণের অবসর ওরা কাটায় তাই বুঝতে। এই সব বুঝে তারপর গান লিখব, সুর দেব তাতে। আরও কয়েকটা কাজ করব, শৈলজাকে বলা আছে। ... ...
প্রমোদ দাশগুপ্তের চুরুট খাওয়া তখন খুব বিখ্যাত গল্প। আমি এগার ক্লাসে পড়তে পড়তেই সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত মারা গেলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর সঙ্গে চীন গিয়েছিলেন। চীনেই মারা যান। তাঁর মরদেহ দেখবো বলে কলকাতা চলে এলাম। মৌলালিতে মাসতুতো দাদাদের কাছে থাকা। ওখানেই থাকতে এলেন খণ্ডঘোষের লড়াকু নেতা মহফুজ ভাই। বিরাট বিরাট লাইন পেরিয়ে প্রমোদ দাশগুপ্তকে দেখলাম।শেষযাত্রার মিছিলে হাঁটলাম। তারপর ব্রিগেডে শোকসভা। ... ...