‘আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করে কুসুমের সামনে দাঁড়াবো। কী করে সামলাবো কুসুমকে যখন ও মানিক'দার মরদেহ দেখবে। কিন্তু কুসুম আমার কাজ সরল করে দেয়। সেদিন ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো, ও যেন জানতোই এটা হবে। আমি কুসুমকে সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত্য এক বিন্দু চোখের জল ফেলতে দেখিনি। আমি সেইসময় কয়েকদিনের জন্য কুসুমের সাথে থাকবো বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু একদিন পর ও আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। বলে, আমার প্রয়োজন অনেক বেশি রণাঙ্গনে - আগরতলাতে নয়। জানায়, তোর অন্নপ্রাশনের তারিখ ঠিক হলে খবর পাঠিয়ে দেবে, যেন দু'দিনের জন্য আসি। কয়েকদিন পর থেকে কুসুমও শুরু করেন ত্রাণ শিবিরে যাওয়া। কিন্তু বকুল, আমি বুঝতে ... ...
রতন বোধহয় ভেবেছিলেন, ওনার বয়স হয়ে যাচ্ছে - কতদিন আর বাঁচবেন কোনো ঠিক নেই। মানিক'দার দেশের জন্য বলিদান হয়তো চিরকালের জন্য চাপা পড়ে থাকবে, উনি না বললে। রতন জানতেন, কুসুম এ ঘটনা কোনোদিন বকুলকে বলবে না। এবং কুসুম মানিক'দার অনেক কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখে রাখলেও - ঐ দিনের ঘটনা কোথাও লিখে রাখতে পারবে না। লিখতে গেলে কুসুমের চোখ ফেটে এতদিনের জমানো জল যে ফল্গুধারার মতো বেরিয়ে আসবে। রতন তো নিজে জানে এবং দেখেছে, বোন কুসুম ৩০ শে জুলাই থেকে একদিনের জন্যও চোখের জল ফেলেনি। মানিক'দার অনুপস্থিতিতে ওর ধ্যান-জ্ঞান শুধু ছিল বকুলের প্রতি। রতন মামা পরের দিন অনেক ভোরে বকুলকে ঘুম ... ...
(এগারো)বকুল ঘরের ভিতর শুয়ে আছে। বাইরে বারান্দায় মোড়াতে বসে কুসুম চা খাচ্ছেন কমলার সাথে। এখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। পুব আকাশে মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে সূর্যের আবছা রক্তিম আভা। এখন প্রায়ই ঝড়-বৃষ্টি হয়। গতকাল রাতেও ঝিরঝির করে কয়েক দানা পড়েছে। ভোরের বাতাসেও একটা আদ্রতার মিশ্রণ। মানিকরা চলে গেছেন, প্রায় একমাস হয়ে গেল। এর মধ্যে লোক মারফৎ খবর পাঠিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে, সবাই ঠিক আছেন। পুতুলের থেকেও খবর এসেছে। জানিয়েছে, রতন'দা এবার বাড়ি আসলে - ওকে নিয়ে চলে আসবে এখানে। রতন'দাও এখন আছেন আশুগঞ্জ, কসবা অঞ্চলে। মানিকের সাথে যোগাযোগ হয়েছে রতন'দার। সন্ধ্যেবেলায় এই এতবড়ো বাড়িতে ফিরে কুসুমের প্রাণটা কেঁদে ওঠে। জনমানবহীন দু'টো ঘর ... ...
ঝিনিকই প্রস্তাব দেয়, রাত্রিতে ওর বাপের বাড়ি চান্দিনাতে থেকে যেতে। চান্দিনা কুমিল্লা পৌঁছনোর একটু আগে। কুসুমেরও এটা ঠিক লাগে। বকুলকে কোলে নিয়ে আজ কোনোভাবেই সম্ভব নয় আগরতলা পৌঁছনোর। ঝিনিক ওর বাবার নামে একটি চিঠি লিখে কুসুমের হাতে দেয়। রোদের তেজ একটু কমলে কুসুমরা বেরিয়ে পরে। ঝিনিক বেরোনোর সময় কুসুমকে জড়িয়ে বলে, 'দিদিয়া, জানিনা কতদিন আমরা বেঁচে থাকবো। তবে যদি বেঁচে থাকি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত, আমাদের আবার দেখা নিশ্চয়ই হবে।'রাতে ঝিনিকের বাপের বাড়ি থেকে, পরেরদিন সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছান আগরতলাতে। এতদূর রাস্তা - কিছুটা ভ্যানরিক্সায়, তবে অধিকাংশটাই হেঁটে। মানিকের দেখা পান ন্যাপ পরিচালিত ত্রাণ শিবিরে। মানিক এই প্রথম প্রায় দেড় মাসের বকুল ... ...
এর মধ্যে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লোক মারফৎ খবর এলো, মানিক এখন আগরতলায় আছেন। উনি কুসুমদের ওখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। কুসুমের এখন কেরানীগঞ্জে থাকা ঠিক নয়, যে কোনো সময় হামলা হতে পারে কুসুমের ওপর - মানিকের হদিশ পাওয়ার জন্য। খবর পান বরিশালের বানারীপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয় শ্রমিক আন্দোলন এবং গঠন করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী। যা দখলমুক্ত করে পেয়ারা বাগানের খানিকটা। সেই মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করতে সিরাজ সিকদারকে প্রধান করে সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনামণ্ডলী গঠন করা হয়। বরিশালের যেসব ঠিকাদার পাক সেনানিবাসে তাজা রসদ অর্থাৎ মাছ, মাংস, সবজি ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে, তারা মানিকের পরামর্শে এক বৈঠকে বসে সেনানিবাসে তাজা রসদ সরবরাহ বন্ধ করার ... ...
বিছানায় শুয়ে বকুল ভাবে, মায়ের লেখা পাতাগুলির থেকে অনেক ঘটনা জানলেও শুনেছিলো পুতুল কাকির থেকে তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিনের কথা। বকুল যখনই নবারুণ ভট্টাচার্যর লেখা, ' ----- এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না / এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না। ----' কবিতাটি পড়ে - যেন আগুন লেগে যায় নিজের শরীরের রক্তে, আর তখনই মনে পড়ে যায় পুতুল কাকির, বাবার, মায়ের সবহারানোর কাহিনী। (আট)ঢাকার সিদ্ধেশরীর বাড়িতে তালা লাগিয়ে কুসুম ও পুতুলের শ্বশুরমশাই'রা গুলবাগে চলে গিয়েছিলেন। ওখানে পৌঁছে কুসুমের মা দেখেন বাড়ি প্রায় ভস্মীভূত। আশেপাশের প্রায় সবকটি বাড়িরই ... ...
প্রসবের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে ডাক্তার কুসুমকে ঘুমের ইনজেকশন দেন, প্রসবের পরপরই। সকালবেলায় কুসুমের জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান একটা ফুটফুটে বাচ্চা পাশের খাটে শুয়ে আছে, পাশে একজন নার্স চেয়ারে বসে। নার্সটি একটি বালিশ পিছনে দিয়ে কুসুমকে বসতে সাহায্য করে, কোলে দেয় ফুটফুটে কন্যা সন্তানটিকে। কুসুম পান একটি মিষ্টি সুবাস। মন বিভোর করে দিচ্ছে যেন। মনে হচ্ছে যেন একটি জ্বলজ্বলে তারা তার কোল আলো করে শুয়ে আছে। তখনই কুসুম ঠিক করেন মেয়ের নাম রাখবেন, বকুল। দুই হাত মুঠি পাকিয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে সে। নিষ্পাপ পবিত্র একটি মুখ। সমস্ত মানসিক কষ্ট দূর করে কুসুমের শরীরে মনে যেন একটি ... ...
হঠাৎ করে কুসুমের মনে আসে, গোপনে কিছু বাঙালি ছেলে চট্টগ্রাম কালুরঘাটে একটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুলেছিল। সেটা একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়। অনেক কসরৎ করে রেডিওর কাটা বারবার এদিক ওদিক করে একটি ক্ষীণ আওয়াজ পান। কানে রেডিওটা চেপে ধরে বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ।রেডিও থেকে শুনে যতটুকু বোধগম্য হোল, পুতুল এবং নার্সটিকে জানালেন। ওদের মুখ ভয়ে ত্রাসে শুকিয়ে প্রায় আমসির মতন। রান্নাঘরে যা আছে তাই ফুটিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। জানেন না, সামনের দিনগুলো কী দুরাবস্থায় কাটবে। আরেকটি দিন এবং রাত কাটে আতঙ্কের সাথে।(ছয়)পরদিন ২৭ শে মার্চ কয়েকঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। বাইরে তাকিয়ে ... ...
নিজের ঘরে বিছানার উপর বসতে না বসতেই, পুতুল হন্তদন্ত হয়ে মুখ ভার করে বলে, 'দিদিভাই, তুমি নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলে। বাড়িতে কাউকে কিছু বলে যাওনি। আমাকে তো সাথে নিতে পারতে।'কুসুম দু'হাতে জড়িয়ে ধরেন পুতুলকে, 'নারে বোনটি, আমার যাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। জানালা দিয়ে হঠাৎ দেখি মানুষের ঢল, সব চলেছে রমনা রেস কোর্সের দিকে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে পড়ি ... ...
কুসুম মেডিকেল কলেজে কাজ করেন বলে, সংসারের সমস্ত কাজ পুতুল একা খুড়শাশুড়িমার সাথে হাসিমুখে করে। কুসুমকে ঘরের কোনো কাজ প্রায় করতেই হয় না। কিন্তু কুসুম ভোগেন একাকিত্বে। মানিকের অনুপস্থিতিটা সবসময় বুকে একটা কাঁটার মতো চুবরে চুবরে বেঁধে। মানিক তখন শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।(চার)মানিকের সাথে কুসুম খাতুনের পরিচয় এই ঢাকা মেডিকেল কলেজেই। ১৯৭০ সালের মে মাসে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা ঢাকাতে অবস্থিত পাকিস্তান কাউন্সিল ... ...