ফলস্বরূপ খুবই বাজে করি ক্লাস পরীক্ষায় এবং মাত্র চার নম্বর পাই দশে। যখন আমি আমার বাবার স্বাক্ষরের প্রয়োজনে খাতাটি দেখাই, বাবা মা'কে বলেন ওকে তাড়াহুড়ো করে বয়স বাড়িয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করাটা হয়ত উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমার মা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমি পরের পরীক্ষায় ভাল ফল করব, এবং আমি তাই করেছিলাম।পরের দিন স্কুলে, ক্লাস টিচার যখন আমাকে বাবার সাইন করা ক্লাস টেষ্টের খাতাটি জমা দিতে বললেন – আমার ঠোঁট ফুলে চোখে জল এসে গিয়েছিল। কারণ এর আগে আমি কোনোদিন এত বাজে নম্বর পাইনি, সেটা পাঠশালা হোক অথবা প্রাক-প্রাইমারি স্কুল হোক। আমার চোখে জল দেখে, ক্লাস টিচার ঘাবড়ে যান এবং আমার ... ...
আমাদের কোয়ার্টারের সামনে ছিল একটা ছোট খেলার মাঠ, তারপর একটি মসৃণ পিচের রাস্তা যার উপর অনায়াসে শুয়ে থাকা যায় জামাকাপড় একটুও নোংরা না করে। রাস্তাটি পেরিয়ে একটি বড় খেলার মাঠ আর নিউটন মার্কেট, যার ভিতরেই সব কিছুর দোকান। সবজি, মাছ-মাংসের দোকানগুলো আলাদা আলাদা এলাকাতে। বিক্রেতারা সব বসত সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু পাটাতনের উপর। মার্কেটটির পিছনে সারি দিয়ে মুদির, কাপড়ের, বইয়ের, মিষ্টির, ইত্যাদি দোকান। সাথে একটি বিরাট বড় খোলা জায়গা, যেখানে মাঝ মাঝেই হতো রামলীলা, কৃষ্ণলীলা। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাম দিকে একটু এগোলে যেখানে রাস্তাটি কোমর বেঁকিয়ে ডান দিকে মুড়েছে, সেই কোনায় ছিল নিউটন প্রাইমারি স্কুল। সুন্দর স্কুল বিল্ডিঙের সামনে একটি ... ...
ঠাম্মা আর কুট্টিপিসি তখন বাইরের বারান্দায় বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। হঠাৎ ধুপ করে একটা আওয়াজ শুনে ঘরে এসে দেখেন আমি মেঝেতে পড়ে আছি, প্রায় সেন্সলেস। ঠাম্মা তখনই আমার কাকুমণির অফিসে লোক পাঠিয়ে খবর পাঠান। হাসপাতালে এক্সরে করে জানা গেল, ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। প্লাস্টার করিয়ে কাকুমণি আমাকে নিয়ে চলে আসেন দমদমে, আমার মা-বাবার কাছে।একদিন মা এবং ফুলমাসি দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন বাইরের খাবার ঘরে, আর আমি তখন ভিতরের ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিলাম। যেটা বাইরের খাবার ঘর থেকে সোজাসুজি দেখা যায় না। আমি শুয়ে শুয়ে অস্থির বোধ করছি, এবং ভাবছি কী করা যায়। পাশের টেবিলে দেখি বাবার একটা লেক্স সিগারেটের প্যাকেট রাখা ... ...
আমি যখন ১০ / ১১ বছর বয়সে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম পড়ি কিংবা দ্বিতীয় / তৃতীয় বার তারও কিছুদিন পরে, আমি দৃশ্যায়ন করতাম উপলব্ধি করতাম সাদৃশ্য খুঁজে পেতাম ভিতর থেকে কোনো এক অদৃশ্য কারণে - আমার কয়েকমাসের বসবাস গেদে মফস্বল শহরটির সাথে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামটির যার উপর ভিত্তি করে 'পথের পাঁচালি' রচিত। সঠিক কারণটি আমি সত্যিই জানি না - হতে পারে অপুর প্রতি সর্বজয়ার স্নেহ-মমতা যেটা আমাকে আমার প্রতি আমার মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার উপলব্ধির সাথে সংযুক্ত করেছে, বা দুর্গা এবং অপুর মধ্যে বন্ধন যেটা আমাকে আমার দিদির সাথে যে একই বন্ধনের সূচনা শুরু হয়েছিল গেদেতে তার অনুভূতি তৈরি করেছে, কিংবা 'পথের পাঁচালী' ... ...
যদিও দাদাভাই বড় আমার থেকে সাত-আট বছরের, কিন্তু ছিল একটা আলাদা টান দাদা এবং ভাইয়ের দুজনের মধ্যে। দশমীর সকালে দুর্গামায়ের বিসর্জন অনুষ্ঠানের পর, দই-চিড়ে মাখা খেতে খেতে অপেক্ষা করতাম ওই মুহূর্তের জন্য, যখন দেবে দাদাভাই ইশারা আর আমি তুলে আনবো নারকেল-ডাব ঘট থেকে পূজারীর অনুপস্থিতিতে। বকাও খেতাম মা-পিসিদের থেকে। দাদাভাইকেও বকতেন পিসিমণি - আমাকে এই দুষ্টু-বুদ্ধি দেওয়াতে। কিন্তু এইগুলো ছিল আমাদের শৈশবের সবচেয়ে আনন্দ-ঘন মুহূর্ত।আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে। দশমীর দিন হয় নিরামিষ ভঙ্গ পুকুরের মাছ দিয়ে। সকাল থেকেই জেলেরা ধরতো মাছ জাল ফেলে, আর আমরা সব পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম জেলেদের মাছধরা উৎসব।দশমীতে মায়ের বিদায় দুঃখ মনে, সাথে ... ...
ঐ সময়ে জীবনে বেশি আড়ম্বর ছিল না, অহেতুক বাড়াবাড়িও ছিল না। ছিল সোজাসাপটা স্নেহ-ভালোবাসা-মঙ্গলকামনা, আর এমন একটা পরিবেশে কেটেছে আমার শৈশবকাল আমার দাদুভাইয়ের সাহচর্যে। তাঁর কাছে গেলে মনে হত, একটা শান্ত উন্নত পরিমণ্ডলে যেন প্রবেশ হলো। দাদুভাইকে আমি একটা আশ্রয়ের জায়গা, নির্ভরশীলতার জায়গা হিসেবে অনুভব করতাম । ****আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো ছাড়াও - প্রত্যেক শনিবার দাদুভাই করতেন শনিঠাকুরের পুজো। প্রত্যেক শনিবার আমার কাছে ছিল একটা উৎসবের মতো। আর মাঝে মাঝে করা হতো শনি-সত্যনারায়ণ পুজো। সেদিন দ্বিগুণ মজা, কারণ হবে দুটো সিন্নি। এছাড়াও মাঝ মাঝেই দাদুভাই দিতেন সন্ধ্যেবেলায় বাতাসার হরির লুট। সেদিন খোল-করতাল বাজিয়ে হতো হরির কীর্তন। আসত দাদুভাইয়ের চেনা-শুনা ... ...
মাঝমাঝেই দেখতে পেতাম বিদ্যুতের ঝিলিক, তারপরেই মেঘের গা কাঁপানো কড়কড় কড়াৎ ডাক। ভয়ে জড়িয়ে ধরতাম দাদুভাইকে।দাদুভাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন এবং তারপর যখন পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে থাকত তখন আমাকে সকালে হাঁটার জন্য নিয়ে যেতেন। শিখিয়েছিলেন সেই সময় সূর্য প্রণাম করা। তখন থেকেই আমার মধ্যে সকালে খুব ভোর থাকতে ওঠার অভ্যাস তৈরী হয়। সে সময় তিনি আমাকে মুখে মুখে গণিত টেবিল, যোগ, বিয়োগ ইত্যাদি শেখাতেন। তিনি সর্বদা বলতেন, ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক ঘন্টা অধ্যয়ন করা দিনের অন্যসময়ে তিন ঘন্টার সমতুল্য এবং আমি সারা জীবন ধরে এটি অনুসরণ করেছি।দাদুভাই ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং খুব দয়ালু মনের মানুষ। সকালবেলায় ... ...
দাদুভাই আমাকে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা শিখিয়েছিলেন। কীভাবে জাল ধরতে হয় এবং পুকুরের জলে ছড়িয়ে দিতে হয় শিখিয়েছিলেন। সেই বয়সেই আমি ওনার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে মাছ ধরার জাল বুনতে হয়।গ্রীষ্মের দুপুরে, আমি এবং দাদুভাই আমের মুকুলের দিকে নজর রাখার জন্য একটি মাদুরে আম বাগানের নীচে শুয়ে থাকতাম। তপ্ত দুপুরের দখিনা বাতাস, বয়ে আসত পুকুর থেকে। স্নিগ্ধ ও উৎফুল্লতায় ভরা সেই বাতাসের রেশ। ভেসে আসত বাতাসের সাথে কু-হু কু-হু কোকিলের ডাক। শুনতে পেতাম চড়ুই পাখির কিচিরমিচির। চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকতাম তাদের আনন্দ-উল্লাস। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেতাম নীল আকাশ। সাদা মেঘের দেখা নেই, শুধুই নীল আকাশ। পড়ন্ত বেলার ছায়ায় ... ...
শীতকালে এই শিউলিগাছের তলায় নরম হলুদ রোদ পিঠে লাগিয়ে খেতাম 'গাছি'র পেরে আনা খেজুর গাছের রস কলসি থেকে গ্লাসে ভরে কাঁপতে কাঁপতে, সাথ দিতেন কুট্টিপিসি-দিদি-ছোটকাকু-আরও অনেকে। পুকুরপাড়ে ছিল একটি কুলগাছ, জামরুল গাছ, নিমগাছ। কুলগাছটা আবার ওর কোমর বেঁকিয়ে নুয়ে পড়েছিল প্রায় পুকুরের উপর। ছোটকাকু আর পাড়ার কাকু-দাদারা মিলে স্নান করার সময়, বিছিয়ে দিত মাদুর জলের উপর। তারপর কয়েকজন মিলে ঝাঁকি গাছের উপর উঠে। টপাটপ করে পাকা কুলগুলো বর্ষণের ধারার মতো ভরিয়ে দিত মাদুরের প্রাঙ্গণ। পাড়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে আনন্দের তালি আমার। কী সুন্দর ও মায়াময় একটা শৈশবকাল ছিল আমার ! ঘাটলার তুলসীমঞ্চের ঠিক পিছনেই ছিল একটি পেয়ারা গাছ, বাবা লাগিয়েছিলেন। ... ...
মানুষ যত বড় হয়, যত বয়স বাড়তে থাকে, ধীরে ধীরে নিজের অগোচরে জীবনটাও ছোট হয়ে আসে। ফেলে আসা শৈশবকালটা মনের আকাশে তখন যেন বাড়তেই থাকে। টুক করে শৈশবকালটা পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। কত পুরোনো স্মৃতি মনে ভেসে আসে তখন। কত পুরোনো ছবি এসে ভিড় করে মনের আকাশে। তখন ইচ্ছে করে শৈশবকালের জগৎ থেকে ঘুরে আসতে, ডুব দিতে।সমরেশ মজুমদারের অনিমেষ সিরিজের প্রথম উপন্যাস 'উত্তরাধিকার'। পটভূমি স্বর্গছেঁড়ার চা-বাগান, জলপাইগুড়ি। প্রথম এই উপন্যাসটি পড়ি যখন আমি পড়তাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সম্প্রতি আবার পড়লাম। যতবারই পড়ি মনে আসে আমার দাদুভাইকে, গাছগাছালি ঘেরা বসতবাড়িটিকে, শুয়ে থাকা চৈত্রের দুপুরে দাদুভাইয়ের সাথে আমগাছের কিংবা নিমগাছের তলায় মাদুর ... ...