এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    ক্যালিডোস্কোপে দেখি - মন বসানো - অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়কুচবিহারে সবচেয়ে আনন্দের দ্মৃতি ছিল বিভিন্ন মেলায় যাওয়ার। প্রত্যেক মেলাতেই কিছু না কিছু খেলনা কেনা হত। একবার কর্কের ছিপির গুলি ছোঁড়ার একটা এয়ারগান কেনা হল। ঠিক মত ব্যবহার করতে না পারলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় হিসাবে এই ধরণের খেলনাগুলোয় আমার অগ্রাধিকার থাকত। আমার পরেই মেজভাইও প্রায় সমান সমান খেলার সু্যোগ পেত। সমস্যা হত সবচেয়ে ছোটটিকে নিয়ে। তাকে কি করে আমাদের সমান যোগ্যতার ভাবা যায়! অথচ, ঠিক সেইটিই তার দাবি। এবং, অবশেষে সমঝোতা করতেই হত। তা না হলে তিনজনেরই ক্ষতি।এই রকমই এক মেলায় গিয়ে কিনেছিলাম তিন আয়নাভরা নলের ক্যালিডোস্কোপ। খেলনাটা একটু করে ঘোরালেই তার ভিতরের অপূর্ব নক্সাদার ছবিটা টুক করে পাল্টে যায়, ক্রমাগত পাল্টে যেতে থাকে। পুরানো ছবি আর ফিরত না। জীবনের ক্যালিডোস্কোপেও ফেরে না। নানা টুকরো ছবির গড়ে ওঠা নকশায় পার হয়ে আসা জীবনকে দেখে নিই, যতটা পারি, যতটা মনে পড়ে। দমদম ক্যান্টনমেন্টের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ছিল দত্তপুকুরে মামাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। বেশির ভাগ সময় মায়ের সাথে আমরা তিন ভাই, কখনও কখনও বাবাও থাকত সাথে। মাত্রই কয়েকটা স্টেশান, কিন্তু আমার মনে হত, চলেছি ত চলেইছি। সেই যাত্রার যে কয়েকটি ছবি মনে পড়ে, গাড়ি ফাঁকা হোক কি ভীড়, মা সবচেয়ে ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মনে হয় সীট ফাঁকা না থাকলে কেউ না কেউ উঠে গিয়ে মাকে জায়গা ছেড়ে দিতেন। আমরা বড় আর মেজ দুই ভাই দুই সারি সীটের মাঝখান দিয়ে জানালার পাশে চলে যেতাম। বসে থাকা যাত্রীরা জায়গা করে দিতেন। বিনিময়ে তাদের কেউ না কেউ কথাবার্তা শুরু করে দিতেন। আমাদের কাছে কেউ অপরিচিত ছিলেন না। ‘স্ট্রেঞ্জার’-ধারণাটির সাথে আমাদের বা আমাদের অভিভাবকদের তখনও পরিচয় ঘটেনি। বিপরীতে যেই বাগধারাগুলিকে আমি শৈশবের দূরতম বিন্দুটি পর্যন্ত দেখতে পাই, তার একটি হচ্ছে, বসুধৈব কুটুম্বকম, এই দুনিয়ার সবাই আমার আত্মীয়। সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে করতে, মানে তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে, একটা-দুটো ছড়া শোনাতে শোনাতে দত্তপুকুর স্টেশান এসে যেত। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশানের বাইরে এসে যেমন দরকার, একটি বা দুটি রিক্সায় সওয়ার হয়ে যেতাম। স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা একটি আধা-শহর, আধা-গ্রাম জীবনের দিকে এগিয়ে যেতাম। পরবর্তীকালে পরিচিত হওয়া কল্পবিজ্ঞানের ধারণায় যেন বা একটি ছবির ভিতর দিয়ে একটু অন্য রকমের একটি জগতে ঢুকে যাওয়া। তারপর কয়েকটি দিন আনন্দের জোয়ারে কাটিয়ে আবার রিক্সা-ট্রেন, নিজের পাড়া, রোজকার জগৎ।উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝে গেলাম এইবারে এক সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়ায় এসে হাজির হয়েছি। এবং এখান থেকে আর আগের জগতে ফিরে যাওয়ার কথা বড়োরা কেউ ভাবছে না। মন বসাতে সময় লেগেছিল। তারপর একটু একটু করে সেই নতুন জগৎ আমায় ঘিরে নিল।আমাদের পাশের বাড়িতে একটি চমৎকার কুল গাছ ছিল। দুই বাড়ির মাঝে যে বেড়া ছিল, বাড়ির বাচ্চাদের সুকীর্তির ফলে মাঝে মাঝেই সেটার বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বলে কিছু থাকত না। একদিন বেড়ার ফাঁক গলে ওপারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফলভরা কুল গাছ। গাছের সামনে মানুষ-জন। আমায় যে প্রশ্ন করা হল আমি তার অর্থ বুঝলেও নিশ্চিত হতে পারলাম না, চুপ করে থাকলাম। তারা আর আমায় বিব্রত না করে আঁজলা ভরে কুল দিয়ে দিল। আমি বাড়ি ফিরে এসে ঠাকুমার কাছে হাজির হতেই ঠাকুমা বলল– হাতে কি আনছ, কুল?– মনে ত হয়। কিন্তু, ওরা বলল বড়ই।ঠাকুমা একগাল হেসে বলল,– একঅই কথা।বুঝতে পারলাম না ‘বড়ই’ শব্দটা ঠাকুমার আগেই জানা ছিল কি না। নাকি প্রতিবেশীদের সাথে গপ্পো-গাছা করার সময় জেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি শব্দটা শিখে গেলাম।একদিন ঠাকুমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম এক পাড়ায়। সমস্ত বাড়িগুলি মাটির উঁচু ভিতের উপর টালির চাল মাথায় ধরা মাটির দেয়ালে গড়া। আমার প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার সেই ভিতে থাক কেটে বানানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঠাকুমা গল্প জুড়ে বসল। আমার জন্য মুড়ি এল। ঠাকুমা এবং সমবেত মহিলারা আসর জমালেন পান-খয়ের-সুপারির। কিন্তু সেই সুপারি আমাদের বাড়িতে দেখা শুকনো সুপারি নয়। কাঁচা সুপারি। আর তাকে সুপারি বলেও না তারা, বলে – গুয়া। এক বিশেষ গন্ধ আছে তার। ছোটদের খেতে নেই তবে আমি চাইলে এই এত্তটুকু এক কুচি মুখে নিয়ে দেখতে পারি, রস গেলা চলবে না। আমি একবার দাঁতে কেটে আর মুখে রাখার উৎসাহ পাইনি। সেদিনের সেই আড্ডায় অংশ নেওয়া মহিলারা বাংলা ভাষাতেই গল্প করেছিলেন, কিন্তু ঠাকুমার একেবারে গা ঘেঁষে বসেও সেই সব আলাপের বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারিনি, বেশ কিছু অচেনা শব্দ ছিল আর চেনা কথারও সুর অচেনা ছিল। আস্তে আস্তে এই রকমের অনেক শব্দের সাথে পরিচয় ঘটে গিয়েছিল যাদের অনেককেই আজ আর মনে পড়ে না। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর আমার জীবনচর্যা থেকে এরা হারিয়ে গিয়েছে। বছর দশেক আগে সেই সময়ে অনলাইন লেখকদের জমজমাট সাহিত্য আড্ডার সমাবেশ ‘সচলায়তন’-এ, জনাব আব্দুল্লাহ এ.এম.-এর পোস্ট “আমাদের ভোটবর্মী ঋণ”-এ এই শব্দদের অনেককে ফিরে পেয়েছিলাম। অনেক কৃতজ্ঞতা তাঁকে। এই লেখাটির মধ্যে কোচদের থেকে আসা শব্দগুলিকে পড়ে মনে হয়েছিল পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ঠাকুমাও হয়ত এই উত্তরবঙ্গের জীবনে ফিরে পেয়েছিলেন পুরনো বন্ধুকে, তাঁর আবাল্য পরিচিত ভাষাকে। বহুকাল বাদে তিনি যেন কথা বলার স্ফুর্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। এমনিতে আমার বাবা এবং ঠাকুমা বেশী কথা বলার মানুষ ছিলেন না। কিন্তু কোচবিহার বসবাসের ঐ তিন বছরে ঠাকুমাকে তার চারপাশের মানুষদের সাথে অনেক বেশী গল্প করতে দেখেছি। এমন হতে পারে যে সেখানে তিনি বেশ কিছু মানুষ পেয়েছিলেন যাঁদের সাথে তাঁর প্রাক-উদ্বাস্তুজীবনের মানুষদের জীবনচর্যার নানা মিল ছিল। আত্মীয়তার একটা টান অনুভব করেছিলেন তিনি। আর সেই টানের মধ্যে ভাষার টান-ও হয়ত একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।টান এক মজার অনুভূতি। যে তিন বছর উত্তরবঙ্গে ছিলাম, যখন তখন ভাবতাম কবে আমাদের দমদম ক্যান্টনমেন্টের ভাড়াবাড়ির ঘরে ফিরব। আর উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর থেকে কি যে এক চোরাটান ছেয়ে থেকে অস্তিত্ব জুড়ে – সেই তোর্সাতীর-এর জন্য!অরণ্যষষ্ঠীর সকালে মা, আরো প্রতিবেশী কাকি-পিসী-মাসীরা দলবেঁধে নাইতে যেত তোর্সা নদীতে। সাথে নূতন কেনা তালপাতার পাখা, নানা রকম গোটা ফল, দুর্বা। আমি আর মেজভাইও যেতাম সাথে। আমরা জলে নামতাম না। মা-মাসীরা সবাই নামত। স্মৃতিজলে নানা ছবি থেকে থেকে ভেসে যায়, খুঁটিনাটি ডুবে যায় হামেশাই। তাই নিশ্চিত করে বলবার দাবি নেই কোন। কেউ কেউ স্নান করার সময়, না কি স্নান শেষে, গোটা আম, হয়ত অন্য ফলও, ছুঁড়ে দিত তোর্সার জলে। আমাদের-ই বয়সী কিছু দামাল ছেলে যারা ঐ সময় সর্বক্ষণ জলেই রয়েছে, ঝাঁপিয়ে ডুব দিয়ে তুলে নিত সেই সব ফল। নদীর সন্তান তারা, নদীতে উৎসর্গের ফলে তাদেরই অধিকার।স্নান সেরে ঘরে ফিরে মা এক এক করে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইয়ের মাথায়, গায়ে ভেজা পাখা দিয়ে বাতাস করে দিত। সে পাখা ধরারও রীতি ছিল। ডাঁটিতে ধরা নয়। পাখা যেন থালা, তাতে ধান, দুর্বা আর গোটা গোটা ফলেরা বসে আছে। মা এক হাতে আঙ্গুলের চাপে সেই ঢেউখেলানো থালাকে ধারণ করে আছে নীচে থেকে, আরেক হাত রেখেছে ফলেদের উপরে যাতে তারা গড়িয়ে না যায়। তারপর সেই থালা উঠছে, নামছে, উঠছে, নামছে, আর বারি-বিন্দু-সিঞ্চিত আশীর্বাদী বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের শরীরে, মননে, শুদ্ধ হয়ে উঠছে তার সন্তানেরা, পূর্ণ হয়ে উঠছে। এই ছবি কি ঠিক এই রকম-ই ছিল? কি এসে যায়! আমার মনে এ ছবি এ ভাবেই আঁকা আছে। সকল আশীর্বাদ-এ আমাদের ভুবন ভরিয়ে দিয়ে জীবন নদীর পাড় ছেড়ে মা চলে গেছে একদিন। আমার কোন ঈশ্বর নেই, কোন প্রার্থনা নেই। শুধু আকাঙ্ক্ষা আছে, মা’র হাতের ঐ ঠান্ডা বাতাস যেন আমায় ঘিরে রাখে, যতদিন আমার স্মৃতি থাকে, যতদিন চেতনা থাকে। যেন শুনতে পাই, প্রায় নিজের ভিতর, নিজের অন্তরাত্মাকে শুনিয়ে আমাদের জন্য বিড়বিড় করছে, ‘বাঁইচ্যা থাকো, বড় হও, মানুষ হও’। বেঁচে আছি, বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে আজকের যুগের মানুষের গড় আয়ুর থেকে এক দশকেরও কম দূরত্বে এসে গেছি। শুধু, কতটুকু যে মানুষ হতে পারলাম! কুচবিহারে আমাদের জীবন আজকের প্রেক্ষিতে বিচিত্র সব, হয়ত বা প্রান্তিক হতে হতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিল। বিবিধ চর্চার সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ, নাচুনী এবং সাদামাটা ভিখারী নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের সাধ্যমত প্রণামী/সিধে/প্রাপ্য/ভিক্ষে নিয়ে যেত। তাদের প্রত্যেকের কাছে নিশ্চয়ই মানুষ হওয়ার, মানুষ হিসাবে সফল হওয়ার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বোঝাত। তোমার ছেলে ফুলুস হবে মা। ফুলুস মানে পুলিশ। এই ছিল এক নাচুনীর কাছে মানুষের সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য আকাঙ্খার রূপ। কিছুদিন বাদ দিয়ে দিয়ে আসত সে। এসেই মাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিত। মা এসে দরজা ধরে দাঁড়াত। আমরা ভাইয়েরা মা’র পাশ ঘেঁষে। তারপর সে কয়েক পাক ঘুরে ঘুরে তার নাচ দেখাত। চেহারায়, সাজ-পোষাকে কিছু অন্যরকম ছিল সে। তার নাচও ছিল এমন কিছু রকম যা আগে কখনো দেখিনি, অবশ্য কতটুকুই বা এ দুনিয়ার দেখেছি তখন! পরেও চাক্ষুষ দেখার সুযোগ ঘটেনি। প্রথমবার এই লেখা লিখতে বসে মনে হয়েছিল প্রযুক্তির সাহায্য নিলে কেমন হয়! ইউটিউবে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় পেয়ে গেলাম সেই নাচের ধারার দেখা। রাজবংশী। সে মেয়ে কি তবে নাচত সাইটোল নাচ, আমাদের জন্য ষষ্ঠী ঠাকরুণ কি মনসা দেবীর আশীর্বাদ আবাহন করে? নাচ শেষে মার কাছ থেকে কিছু পেয়ে বারে বারে দু’হাত তুলে সে প্রার্থনা জানাত তার ঈশ্বরের কাছে মা’র সন্তানদের সাফল্য কামনা করে। কিন্তু কেন সে পুলিশকেই জানত সর্বোচ্চ ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু হিসেবে? পুলিশ কি তাদের জীবনে ছিল কোন ভয়ানক নিয়ন্তার ভূমিকায়, তাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত নিয়ামক? হয়ত সমাজ তখনো অনেক সরল ছিল, ক্ষমতার আরো আধুনিক দাবীদার-রা হাজির হয়নি তখনো, অন্তত তাদের রোজকার জীবনে তাদের ছায়া এসে পড়েনি। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব হাঁক-ডাক-সুর ছিল তাদের অস্তিত্বের, তাদের উপস্থিতির জানান দেওয়ার জন্য। নিয়মিত সময়ে এদের কারো কারো দেখা না পেলে মা-ঠাকুমা-পাড়ার বয়স্করা উদ্বিগ্ন হত, কিছু হল কিনা কে জানে! ফিরে এলে খোঁজ নিত, আসেনি কেন এতদিন? আমাদের ছোটদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের ছিল ডুগডুগি আর বাঁশির আওয়াজ। প্রথমটি যার কাছ থেকে শোনা যেত তার সঙ্গে থাকত গলায় বা কোমরে দড়ি বাঁধা অন্তত দুটি বাঁদর এবং অনেক সময় আরেকটি বাঁদর বা টিয়া অথবা একটি ছোট ভালুক। আর দ্বিতীয় জনের সাথে থাকত বাঁকের দুপাশে ঝোলান, ঢাকনা-বন্ধ সাত-আটটি নানা মাপের বেতের ঝুড়ি, যাদের ভিতরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে ফণাধর ও ফণাহীন সাপেরা। অসহায় প্রাণীগুলির বন্দিত্বের বিনিময়ে আমাদের বিনোদনে যে নিষ্ঠুরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেটা বোঝার মত বয়স তখনো আসেনি। আমরা বড় হতে হতে এই পেশাগুলি যে বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষ হয়ে ওঠার সামাজিক প্রক্রিয়ায় তার অংশভাগী হতে পেরে, ভালো লাগে। আবার ঐ পেশাগুলিতে যুক্ত মানুষেরা পাল্টে যাওয়া দিনে নিজের এবং পরিবার পরিজনদের বাঁচিয়ে রাখার কোন সুষ্ঠু উপায় পেয়েছিলেন এমন নিশ্চয়তার সন্ধান না থাকায় বিষণ্ণ বোধ করি। তার কাজে তার জেলার উচ্চ আধিকারিক হিসাবে উত্তরবঙ্গের সেই দিনগুলোতে বাবার জীবন অনেক জটীলতার আবর্তে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা তিন ভাই তার আঁচ তেমন করে টের পাইনি। আমরা আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছিলাম সেই না-শহর-না-গ্রাম-এর সহজ জীবনে। কলার ঝাড় কি কচুর বন কি ছাইয়ের গাদা – টপকে টপকে আমরা চলে যেতাম পাড়ার এ মাথা থেকে ও মাথা, এ বাড়ি ও বাড়ির উঠান পেরিয়ে। কোন উঠানে ধানের মরাই, ধান মাড়ানোর ঢেঁকি, আচার শুকাচ্ছে কোথাও, লম্বা কাপড়ের টুকরাতে বড়ি। কোন উঠানে শসার মাচা, কারো ঘরের টালির চালে পুরুষ্টু লাউয়ের ভরা সংসার, কারো ঘরের পাশটিতে সর্ষে গাছের ফুলে হলুদের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।নিজের হাতে, নিজের বাড়িতে ফুল ফোটানো, ফল ফলানোর আবহে আমাদের বাসার উঠানেও কত কি যে হত! কোথাও নরম হলুদ রং-এর অতসী ফুল। আবার কোথাও ফুটে আছে নীল অপরাজিতা কি লাল রং-এর জবা। আর, গাঁদা ফুল-এর দিনে বারান্দার ধার ধরে ধরে উঠান জুড়ে রকমারী গাঁদাফুলের সমারোহে রং-এর বন্যা বইত! কখনো কোন এলাকায় ছোট ছোট, সর্বদা আকাশমুখী চকচকে কাঁচা লংকা, কখনো আবার কোথাও ধনে শাক, সর্ষে। লম্বা লম্বা ঢেঁড়স গাছে কচি কচি ঢেঁড়স। পেঁয়াজকলি এসেছে কোথাও। বিশেষ যত্ন নেওয়া জমিতে লাউ কি কুমড়োর বীজ থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে। সে যে কি উত্তেজনার ঘটনা! তারপর সে গাছ যত্ন করে বড় করা। একসময় তাকে এগিয়ে দেওয়া রান্না ঘরের চালে। যাও বাছা, এবার ছড়িয়ে পড়ো মনের আনন্দে। তারপর তাতে ফল ধরে। ফল কাটা হয়, রান্না হয়। কি স্বাদ তার! এ বাড়ির লাউ ও বাড়ি যায়। ও বাড়ির কুমড়ো এ বাড়ি আসে। কোন একটা কি দুটো ফল আবার পাকানো হয় পুরোপুরি যাতে তার থেকে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় বীজ – পরের ঋতুর জন্য। দু’বাড়ির বেড়ার গায়ে বইছে সীমের লতা, প্রতিবেশীর লাগানো, বইছে দু’পাশেই। ও পাশের ফল তাদের, এ পাশের ফল আমাদের।প্রথম অঘ্রাণের প্রথম রবিবার সন্ধ্যায় আমাদের পাশের বাড়ির উঠানে গিয়ে জড় হয়েছি। উঠানের মাঝখানে পূজার আয়োজন, নাটাই ব্রত। মেয়েরাই আয়োজক। এ বাড়ি ও বাড়ির কাকি, পিসী, মাসীমারা আর, আমরা – কুচোকাচারা। ব্রতকথা পড়া শুরু হত একসময়। চুপ করে শুনত সবাই। কি ছিল গল্প, এখন মনে পড়ে না। সম্ভবতঃ ফসলের কি জমির দেবতার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে কোন গ্রামীণ লোককথা। ভারী মজার এক খাবার ছিল সে পূজার প্রসাদ-এ। ছোট ছোট পিঠা, চালের। নুন দেওয়া এবং নুন না দেওয়া। পরের রবিবারে আবার ব্রতকথায় হাজির। আজ অন্য ব্রত, সম্ভবতঃ সত্যনারায়ণের। গোটা অঘ্রাণ মাস জুড়ে প্রত্যেক রবিবারে পাল্টে পাল্টে নাটাই আর সত্যনারায়ণ। উত্তরবঙ্গ ছেড়ে আসার পর সত্যনারায়ণের দেখা মিললেও নাটাই ব্রতকথার আর দেখা মেলেনি।আর একটি ব্রতকথাও সামনে থেকে বসে শোনা হয়েছিল সেই সময়, পরবর্তীকালে পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোথাও তার দেখা মেলেনি আমার – মনসাব্রত। আমাদের বাড়ি থেকে একটি কি দুটি বাড়ি পরের প্রতিবেশীর বাড়িতে সাপের দেবির পূজার আয়োজন হয়েছিল। দেবীমূর্তির মাথার চারপাশে একাধিক সাপের ফণার উপস্থিতি মনে ভালই ভয় ধরিয়েছিল। আমাদের নিজেদের বাড়িতে একটিই পূজা আমার একেবারে ছোটবেলা থেকে মনে করতে পারি – লক্ষ্মীপূজা, প্রতি বৃহস্পতিবার এবং শরতের কোজাগরী পূর্ণিমায়। দ্বিতীয়টি বাবার পৌরহিত্যে হলেও প্রতি সপ্তাহের পূজাটি মা করত এবং সেটি ঐ ব্রতকথাগুলির মতই পাঁচালী পাঠ করে। সব কটি ব্রতকথাতেই একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল, দেবতাদের যার যতই ক্ষমতা থাক, মানুষের পূজা না পেলে তাদের মর্যাদা নেই। বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন কিছু পেলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু নিয়মিত পূজা করতে না চাওয়া বা ভুলে যাওয়া মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণ বিপদে না ফেলে এবং পূজা করা লোকেদের যাকে যতটুকু দিলে চলবে সেই মত পুরস্কার না দিলে তাদের থেকে ঐ পূজা পাওয়া নিশ্চিত হয় না। বয়স বাড়তে বাড়তে জানতে পারব, ক্ষমতা ধরে রাখার এইটিই মূল পদ্ধতি, দেবতা কি মানুষ যিনিই সেই ক্ষমতা ভোগ করুন। আর এইভাবেই আমাদের, সাধারণ মানুষদের জীবন গড়িয়ে চলে, এক বিপন্নতা থেকে আরেক বিপন্নতা, সাধ্যে কুলোলে কিছু নৈবেদ্য ধরে দেওয়া, যেই দেবতা, যেই ক্ষমতাধর যেমন পূজা দাবি করেন, কিছু প্রাপ্তি, প্রাপ্তির আশা …ক্রমশ...
    কাদামাটির হাফলাইফ - ইট পাথরের জীবন - ইমানুল হক | নামাঙ্কনঃ ইমানুল হক। ছবিঃ র২হকথা - ২৭আজ আর শৈশব বা কৈশোর নয় যৌবনের কাহিনি বলতে হচ্ছে, এই দুই মানুষের জন্য। আমার শরীরটাও আজকাল সাথ দেয় না। বলেই নিই।কামাল আহমেদ এবং রণো ভাই।কামাল আহমেদ বেড়ে উঠেছেন কলকাতায় পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা। দেশভাগের পর চলে গেছেন ঢাকায়। শিল্পী মানুষ। চাকরি বাকরি করেন নি। পোস্টার ডিজাইন করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। সচেতন বামপন্থী।পাঠান চেহারা। মন তেমনি উদার।তিনটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন তিনজন মানুষ। আমার প্রথমবার ঢাকা যাওয়ার সময়।পত্রলেখক সাংবাদিক সুধীর চৌধুরী ও কবি সাংবাদিক জিয়াদ আলী। প্রাপক একজনই। কামাল আহমেদ।১৯৯১। ফোনের যুগ নয়। চিঠিটি ভরসা। সস্তায় কোথাও থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। আরেকটি লিখেছিলেন গড়পাড় রোডের অনিলবাবু। তাঁর এক বন্ধু নজরুল ইসলামকে।২০ ফেব্রুয়ারি যাই। ঢাকায় পৌঁছাই মাঝরাতে। চুরি ছিনতাই নাকি খুব হয়। তাই ভোর পর্যন্ত গুলিস্তানে এলাকায় বাসডিপোয় বসে থাকা।রাস্তায় আসার সময় দেখেছি শীতের রাতে খালি পায়ে হাতে ফুল নিয়ে চলেছেন কোথাও। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সবাই যাচ্ছেন শহিদ মিনার।‌ ২০ কিমি দূরে।অবাক।অবাক হওয়ার আরো অনেক বাকি ছিল।বয়স কম। চিরকাল ভয়ডর বেশি নয়।সম্বল কিছু ডলার। ২০ ডলার ভাঙিয়ে পেয়েছি ৮০০ টাকা।‌ ২০ ডলার কিনতে ভারতে লেগেছে ৩২০ টাকা। বাংলাদেশে পেলাম ৮০০ টাকা। ৪৮০ টাকা বেশি।রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বা এম এন দস্তুর থেকে ডলার নিতে হতো।রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনে ১৫ পয়সায় প্রচুর খাইয়েছেন সুদীপ্তদা । মাছ মাংস দই মিষ্টি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্যান্টিন তখন এমন সস্তা। এর আগে একবার সরস্বতী প্রেসের ক্যান্টিনে 'নতুন চিঠি' র জন্য সিসার তৈরি লাইনো ( !) টাইপ কিনতে এসে খেয়েছি সাত পয়সায়। রাজকীয় খাবার।সারাদিন অবশ্য কাটাতে হয়েছিল ডলারের জন্য।তো ভোর ভোর পৌঁছে গেলাম তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টি দপ্তরে। সেখানে পরিচয় দিয়ে ব্যাগ রেখে গেলাম শহিদ মিনার। দুপুরে খেলাম তোপখানা রোডের এক হোটেলে। এখন দেখি সেটি নেই। কলকাতায় তখন মুসলিম হোটেলে মাংস ভাত তিন থেকে চার টাকা। ঢাকায় লাগলো ১৮ টাকা। এর আগে বেবি ট্যাক্সি/ মিশুক ভাড়া দিয়েছি দরাদরি করে ৬০ টাকা।বুঝলাম, খরচের শহর। কলকাতা নয়।দুপুর পর্যন্ত বিস্ময়ে কাটলো শহিদ মিনারে। আওয়ামি লিগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় দল, জাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি-- সব দলের ছাত্র যুব মহিলা শাখা আসছে গান গাইতে গাইতে বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে। সঙ্গে আবেগি শ্লোগান।হাঁটে না মিছিল। ছোটে।হাসিনা, খালেদা জিয়া তাঁদের দেখলাম।এ তো কলকাতায় কখনও দেখিনি।সব প্রতিপক্ষ একজায়গায়! এক অনুষ্ঠানে!রাস্তায় দেওয়ালে ছবি আলপনা।রাস্তায় আলপনা আগে এ-ভাবে দেখিনি।আমরা সরস্বতী পূজায় রাজ কলেজে দু' রাত জেগে ১০০ ফুটের আলপনা বানাতাম। ১৯৮৫-৮৮।ভাবতাম, কী না কী করেছি।এখানে ঘোর লেগে গেল। কিলোমিটারব্যাপী আলপনা দেখে।দুপুরে ওয়ার্কাস পার্টি দপ্তরে জিজ্ঞেস করলাম, কামাল ভাইকে পাবো কোথায়? একজন, শুনেই, বললেন, কামাল ভাই এখানেই আসবেন।অপেক্ষা করুন।কামাল ভাই এলেন। চিঠিটি একটু পড়লেন।তারপর জানতে চাইলেন কলকাতার খবর।জ্যোতি বাবু কেমন চালাচ্ছেন।আগেই বলেছি , যিনি বলেছিলেন, অপেক্ষা করুন, তিনি রণোভাই।খুব আড্ডা হলো।বিকেলে বের হলেন। বললেন, ব্যাগপত্তর এখানেই থাক। পাসপোর্ট সঙ্গে রাখুন।মনে মনে ভাবছি, কোথায় থাকবো, তাই তো ঠিক করা হলো না।কামাল ভাই কিছু একটা বুঝলেন, বললেন, চলেন, বাংলা একাডেমি ঘুরে আসি। বইমেলা চলছে।রাস্তায় দেখি কামাল ভাই এগোতে পারেন না।অজস্র চেনা মুখ।ঠেকা খেয়ে খেয়ে যাই।বই দেখি। গান শুনি অজিত রায়ের।হাজার হাজার মানুষ গণসঙ্গীত শুনছেন।ফিরে আসি ওয়ার্কার্স পার্টি অফিসে। আপনি বলছেন দেখে আমার খারাপ লাগছিলো। আপত্তি করলাম।ইতিমধ্যেই তুমি বলেছেন।চলো।কোথায়?আরে চলো না।রিক্সায় এলাম দুজনে মহম্মদপুর তাজমহল রোডে।বললেন, এটা আমার বাসা। এখানেই থাকবে।‌ সকালে খেয়ে বেরোবে। দুপুরে এখানে খেতে আসবে। কিন্তু এলে ছগুণ বেশি টাকা যাবে রিক্সায়। তার চেয়ে বাইরে খেয়ে নেবে। রাতে দুজনে একসঙ্গে ফিরবো।কোনোদিন কামাল লোহানীর শিল্পকলা একাডেমি, কোনদিন ওয়ার্কার্স পার্টি দপ্তর, কোনোদিন বইমেলা। এভাবেই ঠিক থাকে।রাস্তায় দেখি হরেক পোস্টার। কামাল ভাই দেখান কোনগুলো তাঁর ডিজাইন করা।আমি বেশ কিছু পোস্টার এনেছিলাম। এ-বাড়ি সে-বাড়ি করতে করতে হারিয়েছে সে-সব।কামাল ভাই দেখলাম অজাতশত্রু মানুষ। সব পক্ষের সঙ্গে মিত্রতা।ছোটো বড়ো সবার সঙ্গে মিত্রতা।প্রায় দিন রাতে কামাল লোহানী বা রণো ভাই গাড়ি করে এসে নামিয়ে দিয়ে যান।কামাল ভাই ২৭ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন ব্যবস্থা করে দিলেন একটা স্কুটারের। ঘুরতে সুবিধা হবে। চালক পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া এক যুবক।ভাগ্যান্বেষণে ঢাকা গেছেন।লোকে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা যায়--সেই জানলাম।এ-রকম চার পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ হলো।কামাল ভাই তাঁদের জন্য কাজ খুঁজে দেন একে ওকে বলে।রিক্সাচালকরা ঢাকায় প্রচুর পয়সা চাইতো।কামাল ভাই রসিকতা করতেন।এই টাকা রিক্সাসমেত তো?রিক্সাচালকরাও রসিক।বাবু আমারেও লন।খাইখরচা দেবেন বিবি বাচ্চার।কামাল ভাইয়ের কাছে আশ্চর্য সব মানুষের আশ্রয় ছিল।এমন একজন আনিস।যে খালি পায়ে ঘুরতো। রিক্সা বা মিশুক চাপতে চাইলে বলতো, তুমি কি মেয়ে মানুষ? রিক্সা চাপতে চাও।আনিস ছিল নামী আবৃত্তিকার।খেয়ালি।স্বপ্নপ্রবণ।বাংলাদেশের রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে পরিচয় কামাল ভাই মারফৎ আর তরুণ শিল্পী সাহিত্যিকদের দলে মেশা হলো আনিসের মাধ্যমে।আগের দিন রাতে কামাল ভাই পরিকল্পনা করে দিতেন কোথায় কীভাবে যাবো।রাতে একসঙ্গে না খেলে রাগ করতেন।একবার কবি মজিদ মাহমুদের পাল্লায় এক কবিতার আড্ডায় সারারাত কেটে গেল।পরদিন বুঝলাম, কামাল ভাই অভিমান করেছেন।এত আপন করে নিতে পারতেন।ভাবিও ছিলেন রসিক মানুষ। কাজ করতেন ভোয়ায়।রিঙ্কি কামাল ভাইয়ের ছোটো মেয়ে।বাবার মতোই দিলদার।দুই ছেলে। তিন মেয়ে।কামাল ভাই মাঝে ফোন করেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি যদি প্রকাশ করা যায় কলকাতা থেকে। তাঁর স্বপ্ন ছিল, একটা তথ্য চিত্র বানাবেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর।আমার কুড়েমিতে হলো না।মাফ করবেন কামাল ভাই‌।হায়দার আকবর খান রনো ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী এবং লেখক। হায়দার আকবর খান রণোর জন্মও কলকাতায়। ১৯৪২ এর ৩১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। রনোর পৈতৃক নিবাস অবশ্য পূর্ববঙ্গ। নড়াইলের বরাশুলা গ্রামে। তাঁর মা কানিজ ফাতেমা মোহসীনা বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সৈয়দ নওশের আলী তাঁর নানা। বাবা ছিলেন দেশের প্রধান প্রকৌশলী।রণোভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ জমে গেল। আমার বাবার মতো দিলদরিয়া গোছের মানুষ। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, কাল বাসায় আসুন ১২ টা নাগাদ। ধানমন্ডিতে বাড়ি। দেখলাম সবাই চেনেন বাড়িটি। কথা শেষ ঊঠছি। বললেন, আরে যাবেন কোথায়? খেয়ে যাবেন। একসঙ্গে বের হবো।তাঁর মা, স্ত্রী, ভাই, ভাইয়ের বৌ, মেয়ে রাণা, ভাইঝি পুতুল--সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়ে রাণা তখন দশম শ্রেণিতে পড়েন। আস্তে আস্তে অনুচ্চস্বরে টেলিফোনে কথা বলতেন। খাওয়ার টেবিল দেখি নানান খাবারে ভর্তি। এটা কিন্তু ঘোষিত দাওয়াত না। এত খাবার বাড়ির টেবিলে আগে দেখিনি। আমাদের এখানে তখন তো জামাইকেও আট দশ পদের বেশি খাওয়াতে দেখিনি। আইবুড়ো ভাত হলে আলাদা। ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি, ইলিশ, কাঁচকি--সব আছে। এই প্রথম আমার কাঁচকি খাওয়া। খেতে ভালোবাসি। তাও সংকোচ হচ্ছিল। বললেন, আরে এই বয়সে এত ভেবেচিন্তে খেলে হবে, খান। আমার লেখা একটা উপন্যাস তাঁকে দিই। কলেজে ম্যাগাজিনে লেখা। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতির হাল হকিকত খানিকটা টের পাওয়া যেত সেই লেখায়। নাম 'উত্তরণ'। তখন তো আমি কবিতা গল্প আর উপন্যাসিকা লিখতাম।এরপর যেটা হল। রণোভাইয়ের বাসায় প্রায় দিন আমার উপস্থিতি। রণোভাই আমাকে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বাঙ্গালদেশের চিত্র সম্যকভাবে বুঝিয়ে ছিলেন। একই সঙ্গে এরশাদ সম্পর্কে একটা বিচিত্র তথ্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটা অন্যরকম তথ্য তিনি দেন।তাঁর কথা, বঙ্গবন্ধু বাকশাল গড়ছেন। এতে রেগে গিয়ে আমি আর রাশেদ খান মেনন একদিন অ্যাপ্যেণত্মেণত ছাড়াই তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে হাজির হই। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়বেন না। আমরাও নাছোড়বান্দা। দেখা করবোই। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে বঙ্গবন্ধু নিজেই নেমে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। নিরাপত্তারক্ষীকে বললেন, রণো আমার পাড়ার ছেলে। ওঁর আভার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কী?বললেন, বল কী বলবি?আমি আর মেনন বললাম, আপনি যে বাকশাল গ্রছেন, এতে কি গণতন্ত্র থাবে?বঙ্গবন্ধু বললেন, শোন, আমি একটা বিপ্লবী স্মাজতান্ত্রিক দল গড়তে চাই। আমার দলে বহু খারাপ লোক ঢুকে গেছে। তোরা আয়। আমার সঙ্গে যোগ দে। আমাদের কাজের সুবিধা হবে। আমরা আমাদের অক্ষমতা জানিয়ে চলে এলাম। তার কিছুদিন পর তো তাঁকে হত্যা করা হল।এরশাদ সম্পর্কে একটা অদ্ভুত তথ্য দেন তিনি। বলেন, এরশাদের আমলে আমরা সবচেয়ে বেশি 'গণতন্ত্র' ভোগ করেছি। সেটা অদ্ভুত ধরনের। দুপুরে ডাকলেন আমাদের। কিছু কাজ নিয়ে আলোচনার জন্য। বিরিয়ানি খাওয়ালেন। গল্পগুজব করলেন। সন্ধ্যায় ফোন করে বললেন, আপনাদের জেলে যেতে হবে। যান ঘুরে আসুন।এরশাদের বেশিরভাগ কাজের সমালোচক ছিলেন। বিশেষ করে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণার। দুটি কাজের প্রশ্নগসা করেন।এক, ওষুধনীতি। বাংলাদেশে আগে ব্রান্ড নেমে ওষূধ পাওয়া যেত। উনি চালু করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের সহায়তায় জাতীয় ওষুধ নীতি। তাতে জেনেরিক নামে ওষুধ পাওয়া যেতে লাগল। ওষুধের দাম কমল। পরে আমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি তখন আত্মগোপন করে থাকছিলেন।এরশাদের আরেকটা ভালো কাজ। তাঁর মতে ৬৪ জেলা গঠন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন রণো-মেনন জুটি।কিন্তু একজন মার্কসবাদী হিসেবে তাঁর এই দ্বান্দ্বিক মূল্যায়ন আমার ভালো লাগে।আমরা দল করতে গিয়ে একপেশে মুলযায়ন শিখতাম। এটা আমাকে তার থেকে বের হতে সাহায্য করে। রণোভাইয়ের ছিল বিপুল পড়াশোনা। কিছু পেলেই পড়ে ফেলতেন। আমার উপন্যাসটিও পড়েন। না পড়লেই ভাল হতো।রণোভাইয়ের সঙ্গে মাঝে যোগাযোগ ছিল না। ১৯৯০এর মাঝামাঝি শেষবার যাই। তারপর ২০১৪। সেবার দেখা করতে যেতে পারিনি। ২০১৫তে দেখা হল। ২০১৮তে নিজেই চলে এলেন ফোন করে, বললেন, আজ বিকেলে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। আমি তখন একটা রেস্তোরাঁয় দাওয়াত খাচ্ছি। একগাদা বই দিলেন। তার মধ্যে স্মরণীয়, শতাব্দী পেরিয়ে। রাস্তাতেই দেখা হল।শেষ দেখা ২০২২। বাড়িতে গেলাম। পুরানো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন ফ্ল্যাট। বললেন, এবার আমার এখানেই উঠবেন। জমিয়ে আড্ডা হবে। আজকাল তো শরীরের জন্য তেমন বের হতে পারি না।ঘটনাচক্রে আমার খুব প্রিয় একটা খাবার জুটে গেল। চারাপোণা মাছের ঝোল। বললেন, রোগীর পথ্য। আপনার কেমন লাগবে জানি না।আমি বললাম, ঢাকায় এইতা কখনও খাইনি। শুনে খুশি হলেন। কলকাতার মানুষদের খবর নিলেন। বিমান বসু, শান্তনু দে, বিক্রমজিৎদের খবর নিলেন। বললেন, আমাকে তো আর ভিসা দেয় না। মাওবাদীদের সমর্থক ভেবে। কলকাতায় জন্ম, সেখানেই যেতে পারি না। **************************************উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন হায়দার আকবর খান রণো গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনীতি শুরু। তিনি ১৯৬৯এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রণাঙ্গনের সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। ১৯৭২ সালে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে দলের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নামকরণ করা হয়। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৮২-১৯৯০ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাকে চারবার কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল এবং সাতবার আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল।তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ২০১২ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হন'।(ক্রমশঃ)
    সীমানা - ৪৭ - শেখরনাথ মুখোপাধ্যায় | ছবি: সুনন্দ পাত্র ৪৭নবযুগের দপ্তরেগিরিবালা দেবী আর প্রমীলা দুজনেই বললেন, নজরুলের সঙ্গে অরবিন্দর সূক্ষ্মদেহে দেখা হবার কথা নজরুল আগেও অনেকবার বলেছে। শুধু তাঁদেরই নয়, বলেছে আরও অনেককেই। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। তাতে কিছুই আসে-যায়নি নজরুলের, তবে এবারের মতো এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েনি আগে।এবার এতটাই অসুস্থ নজরুল যে অফিসে যেতে পারল না বেশ কয়েকদিন। এদিকে কলকাতার য়্যুনিভার্সিটি থেকে ইন্টারমীডিয়েট পরীক্ষায় বাংলার পরীক্ষক নির্বাচিত করে তার কাছে একরাশ উত্তরপত্র আর পরীক্ষকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী পাঠিয়ে দিয়েছে য়্যুনিভার্সিটি। নবযুগে নজরুলের সহকারী কালীপদ গুহ ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরীক্ষকের কাজ করেছে আগে। সে-ই উত্তরপত্র পরীক্ষায় নজরুলকে সাহায্য করতে শুরু করল। ফজলুল হক সাহেব নজরুলকে জানিয়েছেন, শরীর যতদিন সম্পূর্ণ ভালো না হয় ততদিন তার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই। অমলেন্দু বা কালীপদদের ডাকিয়ে এনে বাড়িতে বসেই পত্রিকা সম্পাদনার কাজও চালিয়ে যেতে পারে সে। এই সুযোগে কালীপদ থাকতেই শুরু করল নজরুলের বাড়িতে, এখন নজরুলের যে অবস্থা তাতে ঘড়ি-ধরে কাজ করা তো সম্ভব নয় তার পক্ষে। চব্বিশ-ঘন্টায় যখনই কাজের মূড আসবে তখনই কাজ! সেই সময় কালীপদ সঙ্গে না-থাকলে কি চলবে?জানতে পেরে আপত্তি করেননি হকসাহেব, লীগ-হক মন্ত্রীসভা ভেঙে যাবার পর নজরুলের প্রয়োজন অনেকটাই বোধ হয় এখন কমে গেছে তাঁর কাছে। আসল কথা এই যে, যতই নবযুগের সম্পাদকীয়তে লীগ-হক মন্ত্রীসভার পতনের ব্যাপারে হক সাহেবের সমর্থনে নজরুল মুসলিম লীগের সমালোচনা করে থাকুক, ওই মুসলিম লীগেরই তরুণ কর্মীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার জন্যেই মূলত হক সাহেবের তাকে প্রয়োজন হয়েছিল। অফিসে বসে এক দঙ্গল ছাত্র-লীগের কর্মীদের সঙ্গে তার আড্ডা এখন আর তেমন পছন্দও হচ্ছে না হক সাহেবের। শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা এখন তো চলছে ভালোই। কাজি না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে নবযুগ। আর, এমনকি নবযুগ না-থাকলেও এখন দিব্যি চলবে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার!কিন্তু তবুও, এমন অসুস্থতার সময় কোন একটা বিকল্প ব্যবস্থা না-করে নজরুলকে নবযুগ থেকে সরিয়ে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না হক সাহেব। একটা সুযোগ এসে গেল। সেই সময় অল ইণ্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর-জেনারাল ছিলেন আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী, নজরুলের প্রতিভার পরম ভক্ত তিনি। যুদ্ধের সময় সরকারি প্রচারের স্বার্থে সং পাবলিসিটি অর্গানাইজেশন নামের একটা সংগঠন তৈরির উদ্যোগ চলছিল তখন। স্বাভাবিক ভাবেই আহ্‌মদ শাহ্‌বুখারী সাহেবের মতামত মূল্যবান ছিল এ-ব্যাপারে। হক সাহেবও বুখারী সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন। লোক-সঙ্গীতের কাজ; নজরুলকে নেওয়া হবে গীতিকার-সুরকার-পরিচালক হিসেবে, আর তাঁর সহকারী হবেন আব্বাসউদ্দীন। চাকরিটা কেন্দ্রীয় সরকারের, কিন্তু কলকাতার অফিস রাইটার্স বিল্ডিঙে। কাজটা পাওয়া এতটাই পাকা যে সরকারি দপ্তরের নানা লোকজন বাড়িতে এসে অসুস্থ কবিকে দিয়ে অনেকগুলো ফর্ম পূরণ করিয়েও নিয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে রাইটার্সে অফিসেও গেল নজরুল; নিজে অফিসে বসে সারাদিন ধরে উশখুশ করল সে, কারো সঙ্গে একটাও কথা পর্যন্ত বলল না। প্রথম দিনের কাজই হল শেষ দিনের কাজ!কিন্তু এমনটা করল কেন নজরুল? তাহলে কি সরকারি পয়সায় সরকারের প্রচারের চাকরি তার পছন্দের নয়? যুদ্ধ চলছে, দখলদার ব্রিটিশ সরকার ভারতের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সেই সরকারের অপকর্মের গুণপণা প্রচারের চাকরি? যে যুদ্ধ চলছে এখন, সে কি ভারতবাসীর যুদ্ধ? নজরুলের মনে পড়ে যায় সে একবার প্রচারমূলক একটা গান রচনা করে, তাতে সুরসংযোগ করে, শিল্পীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সেই গান রেডিওতে প্রচার করিয়েছিল। একেবারেই শিল্পকর্ম হয়ে ওঠেনিসে-গান। সে জানতও তা। বন্ধুবান্ধব-পরিচিতদের মধ্যে হাসাহাসিও হয়েছিল সেই গান নিয়ে। নজরুল পাত্তা দেয়নি সেই সমালোচনাকে। ও জানত, শিল্পী হিসেবে ওর যে প্রতিষ্ঠা, হয়তো তারই ওজনে – শিল্প হিসেবে যতই নিম্নমানের হোক – এই গান গাওয়ার উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত বুঝবে রেডিওর শ্রোতারা। ম্যালেরিয়া-পোষক কচুরিপানার বিরুদ্ধে এই গানের প্রচার একেবারেই উদ্বিগ্ন করেনি তাকে :       ধ্বংস করো এই কচুরিপানাএরা   লতা নয় পরদেশি অসুর-ছানা।।       ইহাদের সবংশে করো করো নাশ       এদের দগ্ধ করে করো ছাইপাঁশএরা   জীবনের দুশমন গলার ফাঁসএরা   দৈত্যের দাঁত রাক্ষসের ডানা।।এরা   ম্যালেরিয়া আনে আনে অভাব নরকএরা   অমঙ্গলের দূত ভীষণ মড়কএরা   একে একে গ্রাস করে নদী ও নালাযত   বিল ঝিল মাঠঘাট ডোবা ও খানা।।বন্ধুদের ঠাট্টার জবাবে তখন নজরুল বলেছে, আমার এই গান যদি কোন-একটা গ্রামের একটা মানুষকেও কচুরিপানার হাত থেকে তার গ্রামকে মুক্ত করার চেষ্টাতে এমনকি একটুও উদ্বুদ্ধ করে তাহলে আমি শ'য়ে শ'য়ে এরকম গান গাইতে রাজি আছি।আর, শেষ পর্যন্ত বাস্তব পৃথিবীর আক্কেলও ফিরল নজরুলের; অফিসে না-গিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। নজরুলের প্রয়োজন হয়তো প্রাথমিকভাবে ফুরিয়েইছে হক-সাহেবের; তাই সাময়িক ছুটি নয়, ভদ্রভাবে বোধ হয় তাকে তাড়াবারই মতলব করছেন তিনি। তাই কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা না-করে হঠাৎই পরের দিন নজরুল দুপুর বেলা হাজির অফিসে। সাধারণত এই সময় রাইটার্সে থাকেন হক সাহেব, নজরুলকে দেখে বললেন, আরে কাজি যে, আছ কেমন? আপিসে আইলে ক্যান, ঘরে মন লাগে না?ঘর কেন, দেশেই তো মন লাগে না এখন, বলে নজরুল, রেডিও খুললেই এখন কেমন যেন সুভাষবাবুর গলা শুনছি বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি তো ঘরের বাইরে, দেশের বাইরে। তবুও রেডিও খুললেই এখন তাঁরই কথা মনে পড়ে, মনে হয় যাই চলে এক ছুটে তাঁর কাছে।তা করে, তা করাডাই তো স্বাভাবিক, বলেন হক সাহেব, আমার এই বুরা-হারেও যে করে না তা কইতে পারি না। আর তোমরা তো প্রায় সমবয়েসীই হব, কে বড়? তুমি, না হ্যায়?উনিই বোধ হয় একটু বড়, নজরুল বলে, আমার জন্ম আঠেরশো নিরানব্বই-এর মে মাসে, আর সুভাষবাবুর বোধ হয় সাতানব্বই-এর জানুয়ারি।তাই কই, যে কষ্টডা হ্যায় করল, আর যে বীরত্ব আর বুদ্ধিডা দেখাইল এলগিন রোডের বাড়ি থেইক্যা পুলিশের চক্ষে ধুলা দিয়া দ্যাশের পর দ্যাশ পার হইয়া! কও, এক্কেরে বার্লিন! আরও কয়েকখান সুভাষের প্রয়োজন ছিল আমাগো এই দ্যাশের। তা, আজ আসছ যখন নিজের ডেস্কে গিয়া কাম কর, আমিও যাই রাইটার্সে। হক সাহেব বেরিয়ে যাবার পর নিজের সম্পাদকীয় দপ্তরে যায় নজরুল, সেখানে আরও কয়েকজনের সঙ্গে বসে কাজ করছিল অখিল নিয়োগী আর দেবনারায়ণ গুপ্ত। কাজিদার অফিসে আসার কোন খবর ছিল না তাদের কাছে, হঠাৎ কাজিদাকে দেখবে আশাও করেনি তারা, অশেষ কৌতূহল নিয়ে কাজিদার পেছন পেছন তার নির্দিষ্ট ঘরে ঢোকে ওরাও।বসতে বসতে কাজি বলে, তারপর, কী খবর, হালচাল কেমন দেখছ?দেবনারায়ণ বলে, কী আর দেখব কাজিদা, এখন তো এই-যুদ্ধ-লাগল এই-যুদ্ধ-লাগল ভাব চারদিকে। একদল রিফিউজি আসছে বার্মা-মালয় থেকে কলকাতায় রোজ, আর তার ঠিক উল্টোটা হচ্ছে কলকাতার লোকদের; দলে দলে এখান থেকে পালাচ্ছে লোকে। চারধারে ট্রেঞ্চ, রাস্তাঘাটের সব ল্যাম্পপোস্টে কালো ঠোঙা, টিমটিম-করা আলোয় শহরটাকে কেমন যেন ভুতুড়ে লাগে! আমরাও অফিসে এসে কত তাড়াতাড়ি পালাব সেই চিন্তাই করি শুধু। কেউ মুখে তেমন কিছু না-বললেও সবাইকেই মনে হয় আতঙ্কগ্রস্ত। আপনিও তো অফিসে এলেন না কতদিন, মাঝে মাঝে কালীপদদা কিছু এডিটোরিয়াল নিয়ে এসে প্রেসে দিয়েই চলে যায়, শুনি, আপনিই লিখে দিয়েছেন। সব মিলে, আমরা ভালো নেই কেউ।হুঁ, খবরের কাগজের অফিসে যদি আড্ডাই না বসে নিয়মিত, হেসে বলে কাজি, তাহলে আর অফিস কিসের! যাই হোক, আমি তো শেষ অফিসে এসেছিলুম সেই ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে, সুভাষবাবুর জার্মানী থেকে প্রথম রেডিও-বক্তৃতার পর বড় জোর আরও সপ্তাখানেক। তার পর থেকে তো বাড়িতেই বসে আছি। এক মাস হতে চলল প্রায়, এখন তো খবর পাই এতদিনে বার্মায় শুধু নয়, সাউদ-ঈস্ট এশিয়ায় কতো শহরই যে জাপানীদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে তার হিসেব ঠিকঠাক জানেনা বোধ হয় কেউই। এই-যে রোজ রোজ কলকাতায় রিফিউজিদের এত আগমনের ঘটা, সে তো আর এমনি-এমনি নয়। ব্রিটিশের হয়ে এত যে ভারতীয় লড়াই করছিল এতদিন, এখন যত ভারতীয় যুদ্ধে মরছে আর বন্দী হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যুদ্ধটা আমাদের দেশের ভেতরেই ঢুকে পড়ছে হুড়মুড় করে।আপনি তা-ই ভাবছেন কাজিদা, এবার কথা বলে অখিল, কিন্তু আমি তো একজনের কাছে শুনলাম যে এই যুদ্ধে সুভাষবাবুর বাংলাকেই উৎসর্গ করে দেবার মতলব সাহেবদের।বাংলাকেই উৎসর্গ? তার মানে? উৎসর্গ মানে কী? বাংলা মানেই সুভাষবাবুর বাংলা, এতে তো কোন তক্কো নেই, কিন্তু উৎসর্গ কথাটার মানে কী হল?মানেটা সহজ, বলে অখিল, এই উনিশশো বেয়াল্লিশে জাপানীরা যে অঞ্চলে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে নাস্তানাবুদ করছে ওদের, সেখান থেকে পালাবে যারা তারা আর আসবে কোথায়? বাংলা ছাড়া? পরাক্রমী জাপান যদি ওদের মারতে মারতে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এগোতে এগোতে ওরা আর আসবে কোথায়? বাংলাতেই শেষ পর্যন্ত, তাই না? তাহলে এখন যদি বাংলা ছেড়ে আরও পশ্চিমে পিছিয়ে যায় আমাদের প্রভু ব্রিটিশ সরকার উইদ ব্যাগ অ্যাণ্ড ব্যাগেজ, বীরবিক্রমে পশ্চাদ্ধাবনই করে যদি, তাদের তাহলে গন্তব্যস্থল তো বাংলা থেকে আরও পশ্চিমেই হবে, তাই না? তার মানে কী হল? ইংরেজের পক্ষে? বাংলাকে জাপানের হাতে উৎসর্গ করে দিয়ে বাকি ভারতে রাজত্ব চালানো, তাই না? বাকি ভারতে তো আর সুভাষবাবু নেই, নেই তাঁর চেলারাও। অতএব শান্তি, পরম শান্তি!নজরুল বলে, তা যা বলেছ। এই সুভাষবাবুর মতো মানুষ কী ভুলে যে এই ভীতু কর্তাভজাদের বাংলায় জন্ম নিলেন তারই কোন কিনারা পাই না। সুভাষবাবুকে কংগ্রেস-ছাড়া করবার পর অ্যাড-হক কংগ্রেস আর সুভাষপন্থী কংগ্রেসের নানা বচসা মারামারি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যখন বড় বড় কাগজে অনেক লেখালিখি চলছে, সেই সময় হঠাৎ গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে ওই যে বেলঘরিয়া না সোদপুরে কী যে এক আশ্রম আছে, সেই আশ্রম থেকে গান্ধীর এক চেলা রবীন্দ্রনাথকে সুভাষবাবুর সমর্থক ধরে নিয়ে এমন কদর্য ভাষায় এক চিঠি লিখলেন যে পড়ে আমরা সবাই হতবাক। গুরুদেব অবিশ্যি এই চিঠিকে কোনই গুরুত্ব দিলেন না! তাই মাঝে মাঝে ভাবি অকৃতজ্ঞ বাঙালিজ ডু নট ডিসার্ভ আ রিয়েল হীরো লাইক সুভাষ!খানিকটা উত্তেজিতই হয়ে পড়ে নজরুল এই সব আলোচনায়। এর কিছুদিন পরেই ষোলই এপ্রিলের নবযুগে সম্পাদকীয় স্তম্ভের ঠিক নীচে প্রকাশিত হল তার প্রবন্ধ, বাঙালির বাংলা। প্রবন্ধের প্রথম লাইনই “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে – “বাঙালির বাঙলা” সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।”সেইদিনই অফিসে এসে নজরুল সকালবেলার কাগজে তার নিজের সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধটাই পড়ছে, এমন সময় হাতে সেই দিনেরই রোল-করা কাগজখানা নিয়ে সোজা তার ঘরে ঢুকলেন হক সাহেব, তারপর নিজস্ব ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন, কী কর, নিজের লেহাডাই পড় নাকি?চেয়ারে বসতে বসতেই হক সাহেব বোঝালেন নজরুলের এই প্রবন্ধখানা তিনি মন দিয়েই পড়েছেন, এবং এইরকম তৎসমশব্দবহুল রচনাটা পড়ে প্রথমেই তাঁর মনে যে প্রশ্নটি এসেছে তা হল – অন্তত তা-ই তিনি বললেন – ও কাজি নজরুল, তুমি আবার ব্রাহ্মণ হইলে কবে? বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের লাগসই প্রয়োগের জন্যে যে বিশেষভাবে পরিচিত সেই নজরুলের এই দীর্ঘ প্রবন্ধে একবার মাত্র পানি, আজান একবার, এবং আল্লাহ্‌-র উল্লেখও ওই একটিইবার! তা ছাড়া পুরোটাই, যাকে বলা চলে বঙ্কিমী বাংলা খানিকটা আধুনিক বেশে! তা-ও, আল্লাহ্‌-র নাম এসেছে ধর্মবোধ প্রসঙ্গে ভগবানের নামের সঙ্গে একসঙ্গে, এবং আজানের কথা বলা হয়েছে যে বাক্যে সেই বাক্যটি হল – হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খঘন্টার ধ্বনি! হস্তধৃত কাগজখানা টেবিলে মেলে ধরেন হক সাহেব এবং নজরুল লক্ষ করে, মুদ্রিত রচনাটি রক্তিমনিম্নরেখায় প্রায় সম্পূর্ণ রঞ্জিত! দুয়েকটি বাক্য বেশ জোর গলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে হকসাহেব পড়েনও, যেমন, “এই হিমালয়ের গভীর হৃদয়-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদীরূপে আমাদের মাঠে ঘাটে ঝরে পড়েছে”, অথবা “যাদের মাথায় নিত্য স্নিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চরণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় স্নিগ্ধ-শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে ওঠে, – হায় তারা এই অপমান, এই দাসত্ব, বিদেশী দস্যুদের এই উপদ্রব, নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে?” – পড়েই উচ্চকিত হো হো হাসিতে ছোট ঘরখানা ভরিয়ে তোলেন হক সাহেব, এ কি মুসলমানের লেখা হল, এতো শ্রীমৎ নজরুলানন্দ সাহিত্যসরস্বতীর রচনা!হাসে নজরুল, বলে, বাংলা ভাষার লেখককে তো একই সঙ্গে সাহিত্যসরস্বতী আর ডক্টর শহীদুল্লা হতে হয়। আর তার সঙ্গে ইংরিজি ফরাসী ওলন্দাজী ছাড়াও একটু-আধটু বৌদ্ধ দোহা – তা ছাড়াও আরও কতো রকমের যে মিশেল দিতে পারলে তবে দাঁড়ায় আমাদের বাংলা ভাষা! এ তো আমাদের কবির ভাষায় দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে। কিছু একটা লিখি যখন এই ভাষায়, তখন তো আর মাপ করে – এতটুকু যখন সংস্কৃত এসেছে, অতটুকু তাহলে আরবী বা ফারসি আসুক – এই ভেবে তো সাহিত্য করা চলে না। বাংলা ভাষা বাংলাই, তার চলনে তো সারা পৃথিবীর সুর। আর তারই মধ্যে তার নিজস্বতাও। লিখি যখন, তখন অবিশ্যি এত কিছু ভেবে লিখতে বসি না। যা স্বাভাবিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আসে কলমের ডগায় তা-ই লিখি।তোমার কলমের ডগায় যা আসে, লেখক তুমি লেখ তা-ই – এ কথা তো আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আমরা যারা লেখক নই, সেই আমরা যে কথা বলি সেও তো ওই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই; এই কথাটা ক'জন বোঝে বলতো। যে মুসলিম লীগ পার্টিটাই তৈরি হল বাংলায়, আজ তার ওয়র্কিং কমিটিতে একটা বাঙালিকেও রাখা গেল না, এভাবে কি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে?আমরা তো তখনই প্রতিবাদ করেছিলুম আমাদের নবযুগে, বলে নজরুল, মনে আছে আপনার?মনে তো আছেই, হক সাহেব বলেন, তোমার সেই তিন লাইনের হেডলাইনখানা, বড় বড় হরফে পাঁচের পৃষ্ঠায়, বাঙালি মুসলমানের অবমাননা/ মিঃ হকের পরিবর্তে/ অবাঙালি মিঃ ইস্‌পাহানি লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত – মনে নাই আবার? অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের খবর ছেপেছিলে তুমি, ভাষা ঠিক মনে নাই, তবে খানিকটা এইরকম: নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি মিঃ জিন্নাহ্‌ ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি মিঃ ফজলুল হকের নাম কাটিয়া তাঁর স্থলে কলিকাতা হইতে মিঃ এইচ ইস্‌পাহানিকে লীগ ওয়র্কিং কমিটির সদস্য মনোনীত করিয়া বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি নিয়োগ করিয়াছেন। কী, ঠিক বললাম? আর এই একজনকে বিয়োগ আর অন্য একজনের নিয়োগের ফলটাও, যতদূর আমার মনে পড়ছে, ওই লেখাতেই ব্যাখ্যা করেছিলে তুমি। মুখে না-বললেও মনে মনে হক সাহেব ভাবেন, নজরুলকে ছাড়া চলবে না। জিন্নাহ্‌-র মনোভাবটা সাধারণ বাঙালি মুসলমানকে বোঝাতে পারবে এক নজরুলের কলমই।কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ নজরুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন হক সাহেব। তার পর বলতে থাকেন, সেই সময় কলকাতার কর্পোরেশনেও ওই একই ইস্‌পাহানি নির্বাচিত হয়েছিল ডেপুটি মেয়র। তুমি লিখেছিলে, ইস্‌পাহানির বদলে কোন বাঙালি মুসলমানকে দাঁড় করালে সেই বাঙালি মুসলমানটি কিন্তু ডেপুটি নয়, পুরোপুরি মেয়রই হতে পারত। আমি বুঝি না কাজি, বলেই চলেন হক সাহেব, কেন যে এরা মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালির ভাগাভাগিটা কমাবার চেষ্টা না-করে আরও বাড়িয়েই চলছে। একে তো ক্যাবিনেটে শ্যামাপ্রসাদ, আমাদের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ, আছেই। গতবছর শুধু ঢাকা নয়, পুব বাংলার আরও কয়েকটা জেলায় গিয়ে সেন্‌সাসে মাথা গলিয়ে সে যে দাঙ্গার অবস্থা তৈরি করে এল, তাতেও সাবধান হলাম না আমরা মুসলমানরা। এখন যদি আমরাও চালে ভুল করে বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে রাখি, সেটা কি এই বাংলার পক্ষে ভালো হবে? নাকি মুসলমান-প্রধান বাংলার মন্দ হলে সারা ভারতের মুসলমানদের পক্ষে সেটাই ভালো?আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানেন হক সাহেব, নজরুল বলে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনটা শেষ পর্যন্ত নাহিন্দু-মুসলমানের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, আর সাহেবরা তারই সুযোগ নিয়ে দেশটাকে লুটপাট করে। এখন তো শুনতে পাই জাপানীদের কাছে সব জায়গায় হেরে গিয়ে বাংলাকে নাকি জাপানের হাতে ছেড়ে দিয়ে দেশটাকে অ্যাবান্‌ডন করে চলে যাবে ইংরেজ।কও কী, বাংলারে অ্যাবান্‌ডন! আরে না না! আসলে এই বেঙ্গল প্রভিন্সডা অগো কাছে গরম আণ্ডা; কামড়ানোও যায় না, ওগরানোও হেই একই জ্বালা। হেই কার্জনের আমল থেইক্যা শুরু। স্বদেশী আন্দোলন, আর তারপর বোমা-পিস্তলে আজ ফাঁসি তো পরের দিন আন্দামান! নিজে যাই নাই, তবে শুনছি অগো সেল্যুলার জেল-এর সব সেলই রিজার্ভ্‌ড্‌ ফর বেঙ্গলীজ। নো এন্ট্রী ফর ইণ্ডিয়ান্‌স্‌ ফ্রম আদার প্রভিন্সেস! কিন্তু তবুও, প্রভিন্সটা তো সোনার খনি, কইলকাতা শহরখানা সেকেণ্ড সিটি অব দি এম্পায়ার! কী আর করে কও। অ্যাবান্‌ডনের কোন কথাই নাই, ইংরাজের লোভ! ওরা ছাইরবে কইলকাতা!আসলে, বলতে থাকেন হক সাহেব, জাপানীরা টাইট তো দিসেই অগো। সিঙ্গাপুরের টাইটটা বড়ই চোট দিল। এই মার্চেই তো, জাপান বার্মা ইনভেড করার আগেই অগো পিটটানের প্ল্যান সারা। কয়, উইদ্‌ড্রয়াল। রেঙ্গুনে পৌঁছাইয়াই জাপান দ্যাহে রেঙ্গুন ফাঁকা, তহন এট্টু-আধটু বম্বিং কইরল কি না-ই কইরল, ও তেমন কিছু বড় কথা নয়। আর ব্রিটিশ বাহিনী? নিজগো খান দুই-চার অফিসার আর এক পাল ভারতীয় সেনা লইয়া ব্রিটিশ বাহিনী পেট্রল-খনিতে আগুন লাগাইতে লাগাইতে রাস্তাঘাটে-জলাশয়ে বিষ মিশাইতে মিশাইতে, ধান-চালের দফা শ্যাষ কইর‍্যা যঃ পলায়তি সঃ জীবতি! আসামে, নানা ট্রাইবাল এরিয়ায়, আর আমাগো বেঙ্গলে!তবে হ, ক্ষতি করছে আমাগো উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে। ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল-চট্টগ্রাম-নোয়াখালি। আর তা-ই বা কই ক্যান, পুরা পুব-বাংলাই ধর। কয়, ডিনায়াল। ধান-চালের বাজারে আর কিছু নাই। দশ-বারো লক্ষ মণ চাল অলরেডি কলেক্টেড। অ্যাতো কলেকশন ক্যান? সব মিলিটারির খাদ্য – ভবিষ্যতের, বুঝ? তুমি কও অ্যাবান্‌ডনিং বেঙ্গল। অ্যাবান্‌ডনিং বাই হু? এই লোভী ইংরেজরা? হঃ!এক দিকে ডিনায়াল, চেয়ারে একটু নড়ে চড়ে তারপর হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসে বলেন হক সাহেব, আর অন্য দিকে যাকে বলে স্কর্চড আর্থ পলিসি, পোড়ামাটি নীতি। জাপানীরা যদি ফিরে আক্রমণ করতে চায়ও আবার, তাহলে আসবে কোন্‌ রাস্তায়? সব শেষ, পেট্রলের খনিতে আগুন লাগানো হয়েই গেছে, যানবাহনের তেল পাবে না। পুব বাংলায় জলপথে আসবে? স্টীমার-জাহাজেও তেল লাগে। দাঁড়-বাওয়া নৌকো? পাবে না। আমি প্রভিন্সের প্রধানমন্ত্রী। আমার কথা শোন। শুধু বাখরগঞ্জেই বার হাজার নৌকো পোড়ানো হয়ে গেছে এর মধ্যে, আরও হবে। যা ছিল, সাইকেল ঠেলাগাড়ি সব শেষ। এই যে কলকাতায় রোজ এত রিফিউজি দেখ, এত ভিখিরি বাড়ছে, এরা কারা? সব ওই পুব বাংলার মানুষ, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। কারো কোন আয়ের রাস্তা থাকবে না, এখনই নাই। কাদের আশ্রয়ে আর সহযোগিতায় থাকবে জাপানী শত্রু? অথবা ওদের বিবরণে, পঞ্চম বাহিনী?তোমাকে একটা কথা বলি, কাজি। আমাদের এই প্রোগেসিভ পার্টির দিন তো শেষ হতে চলল। বেয়াল্লিশেই আবার ইলেকশন। আমাদের প্রসপেক্ট ভালো নয়। মাঝে যতগুলো বাই-ইলেকশন হল সবকটাতে হেরেছি আমরা। বাঙালি মুসলমান এখন থরোলি মিসগাইডেড। কাজেই তোমার-আমার অনেক কাজ। নতুন উদ্যমে নামতে হবে ময়দানে। কিন্তু ইদানিং লক্ষ করছি তোমার যেন সবসময়ই মন খারাপ। কী যে কারণ আমি জানিনা। এই ইলেকশনে তোমার একটা বড় দায়িত্ব আছে।প্রায় ফিসফিস করে বলেন হক সাহেব, বঙ্গীয় মুসলমানের কিলার ইনস্টিঙ্কটা একটু নাড়াচাড়া দিতে লাগব, বাড়াইতে হব। আমার ওই একডাই চিন্তা, একডাই ভয়। বাঙালি মুসলমান ঠকেই যাব বোধ হয়। এখন চাই, তোমার ওই ওজস্বী ভাষা। তা নইলে, এবার যদি ঠকে, কয়েক জেনারেশন যাব হেই ভুল শোধরাইতে।হঠাৎ-আবার-জেগে-ওঠা এক লাইনের বরিশাইল্যা ডাইলেক্টের থেকে ফের সর্বমান্য বাংলায় ফিরে আসেন হক সাহেব। রেডিওতে মাঝে-মাঝেই হারামণি নামে একটা গানের প্রোগ্রাম তুমি কর। তুমি জান কিনা আমি জানিনা তোমার এই প্রোগ্রামটার আমি কিন্তু একজন ভক্ত। আর, আমি ভক্ত হলে অন্ধ ভক্ত যে হই না তাও তুমি জান। আগে থেকে খেয়াল থাকে যেদিনই, একটু অবসর পেলে সেদিনই তোমার এই প্রোগ্রামটা আমি শুনি। যখন শুনি, মন দিয়ে শুনি। তোমার গানের কথাগুলাও মনে রাখি। ইদানিং কিন্তু বেশ কিছুদিন হল এই প্রোগ্রামটা আর হচ্ছে না। শুরু কর না কেন আবার? ওই যে হারিয়ে-যাওয়া কোন রাগ নতুন করে উদ্ধার করে তার নাম দেওয়া, আর সেই নামটাই ওই রাগে তোমারনতুন-লেখা কোন গানের একটা কলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে রাগটা চিনিয়ে দেওয়া; ধর, ওই যে মীনাক্ষী নাম দিয়েছ নতুন-করে উদ্ধার করা যে রাগটার, সেই রাগে তোমার লেখা-গানের প্রথম কলিই হল, কী জানি, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে – চপল আঁখির ভাষায় হে মীনাক্ষী কয়ে যাও – আর এসব নিয়ে সেদিনের প্রোগ্রামে যখন আলোচনায় মেতে গেলে তুমি আর তোমাদের রেডিওর ওই ভদ্রলোক – বোধ হয় সুরেশ চক্রবর্তী নাম – তাই না?– আহা! গানটা গাইয়েছিলে কাকে দিয়ে? বিজনবালা ঘোষ, ঠিক? ভারি জমে গিয়েছিল।আমি তাই একটা উপদেশ তোমাকে দিই কাজি। নবযুগের অফিসে আসাটা তোমার ইচ্ছাধীন, যেদিন মন কয় একবার অফিসে যাই, আসবে। কবিতা-টবিতা লেখা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় যখন যা ইচ্ছে হবে, সব লেখ। কিন্তু রেডিওতে নিয়মিত আবার যাওয়াটা আর একবার চালু কর তো দেখি। ক্রিয়েটিভ কাজ করবে, দেখবে, মন তোমার ভালো হয়ে গেছে। তুমি তো বেসিকালি ক্রিয়েটিভ কাজেরই মানুষ, শুধুই খবরের কাগজে লিখলে কি তোমার মন ভালো থাকে? আর, মন ভালো না-হলে আবার লড়াই করবে কী করে, কাজি? সুভাষ তিন বছর আগেই বলেছিল এই যুদ্ধের ডামাডোলে চারদিকের চাপে বিধ্বস্ত ইংরেজকে ঠিক ঠিক চাপ দিতে পারলে স্বাধীনতার আর দেরি নাই। কংগ্রেস তখন বুঝল না, কিন্তু আজ গান্ধী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পারছেন। সকলের কাছে সোজাসুজি তা স্বীকার করবার সাহস তাঁর নাই, কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের কাগজেও সেই কথাই তিনি বারবার বলছেন। ব্রিটিশকে বলছেন তোমরা আজই আমাদের দেশ ছেড়ে পালাও নিজের দেশে, আমাদের দেশ আমাদের ফিরিয়ে দাও, তারপর তোমাদের যুদ্ধে কতটা কী করা যায় আমরা দেখব। তার আগে নয়। জওহরলাল-আজাদ-প্যাটেল সব বুঝেও বুঝছে না। জওহরলালের বন্ধু ক্রিপসকেও গান্ধী ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। দেখ, আমার মন বলে, স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নাই। বাঙালি মুসলমানকে যদি বাঁচাতে চাও, আর নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নাই।কথাগুলো শেষ করে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান হক সাহেব। বলেন, তাহলে এই কথাই রইল কাজি, আমার অনেক কাজ আছে, এখন আমি যাই। যে চেয়ারে তিনি বসেছিলেন, তার ঠিক পেছনেই এই ঘরে ঢোকবার দরজাটা। হাট করে খোলা সেটা। কাজি বুঝতে পারে হন হন করে হক সাহেব বেরিয়ে গেলেন। খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে এতক্ষণ বাইরের ঘরটা থেকে কোন শব্দ আসছিল না, দরজাটা যে এতক্ষণ খোলা ছিল তা-ই বোঝা যাচ্ছিল না। এবার মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায় কাজি। অর্থাৎ, হক সাহেবের সঙ্গে কাজির কথোপকথন এতক্ষণ ধরে এই-ঘরের-সঙ্গে-লাগোয়া-ঘরে বসে যারা শুনছিল – সম্ভবত মন দিয়েই শুনছিল যারা – তাদের মন্তব্য এখন শোনা যাচ্ছে। এটাই হক সাহেবের স্টাইল। খুব গুরুত্বপূর্ণ জরুরি বার্তা সহজে ছড়িয়ে দেবার জন্যে মীটিং ডাকবার প্রয়োজন হয় না তাঁর। এবং ছড়িয়ে দেবার দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয় না!নজরুল উঠে দাঁড়ায়। বাইরে বসে আছে চার-পাঁচ জন। তাদের একজনকে সে বলে, গত তিন-চার মাসের গান্ধীজির হরিজন পত্রিকাগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা কোরো তো।বেরিয়ে যায় নজরুল।ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট - অন্তিম গণনা ?  - সমরেশ মুখার্জী | আমার হপা‌র পাতায় ভোটুৎসবে ভাট সিরিজে নামিয়ে যাচ্ছি নানা বিক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন হ‍্যাজ। ডাইভার্সনের জন‍্য। এমতাবস্থায় গুরুর মূল ভাটে চোখে পড়লো এটা:  তার একটু আগে শুনছি‌লাম বহুবার শোনা একটি ঝকাস গান। উপরোক্ত “থান কতা” দেখে বহু‌বার শোনা গানটি‌র কথাগুলো অন‍্যরকম লাগতে শুরু করলো মনে : We're living together,Why bid farewell to others?And invite the doom for usWho can tell?HE is leaving the normsBut whom to blame?'Cause all are sameWill things ever be the same again?It's the final countdown.Oh! The final countdownWe're heading for NadirSo we need to stand tallElse HE will crush us allAnd send us to hell, yeah.Many hurdles to crossTo set right the grossElse we will lose IT soonIt's the final countdownThe final countdownThe final countdown…কেন যতো‌ই এসকেপিস্টের মতো এড়িয়ে থাকতে চাই অনেক কিছু তবু কিছু হানা দেয় মনে অজান্তে?অরিজিনাল লিরিকটাও র‌ইলো:We're leaving together,But still it's farewell.And maybe we'll come backTo earth, who can tell?I guess there is no one to blameWe're leaving ground.Will things ever be the same again?It's the final countdown.Oh! The final countdownWe're heading for VenusAnd still we stand tall'Cause maybe they've seen usAnd welcome us all, yeah.With so many light years to goAnd things to be found I'm sure that we'll all miss her so.It's the final countdownThe final countdownThe final countdown… 
    বৈঠকি আড্ডায় ১৬ - হীরেন সিংহরায় | লাল নীল হলুদের খেলা ১ RISE TO VOTE SIR  রাত্তির নটা বাজে । আমাদের পাশের গ্রাম  ব্রুকউডের কনট এভিনিউর  বাড়িতে বাড়িতে বেল বাজিয়ে চলেছি  গৃহ কর্তা বা গৃহ কর্ত্রী ভোট দিয়েছেন কিনা জানতে ।  বহু  কাল আগে পড়া শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বা দাদা ঠাকুরের সেই বিখ্যাত প্যালিনড্রমটি মনে পড়ল -রাইজ টু ভোট সার! উলটো দিক থেকে পড়লেও সেটা রাইজ টু ভোট সার থেকে যায় ! সকাল সাতটায় পোলিং স্টেশনের দরোজা খুলেছে , আমাদের ন্যাপহিল পাড়ার বুথে  যে কাজটা দিয়ে শুভ মহরত করে এসেছি তার নাম টেলিং। মতদান করে ভোটার যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিটি দলের প্রতিনিধির অধিকার আছে সেই ভোটারের লিস্ট নম্বর জেনে নথিবদ্ধ করবার। প্রায় সকলেই সেটা জানিয়ে দেন , অনেকে তাঁদের ভোটার  কার্ডটাও আমাদের হাতে দিয়ে দেন ।  ন্যাপহিলে আমি সকাল সাতটায় হাজির হয়েছি;  প্রিসাইডিঙ অফিসার একটা প্লাস্টিকের থলি দিয়ে গেলেন, সেই কার্ড সংগ্রহ করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের সুবিধার্থে।  এখন সন্ধ্যে বা রাত নটা বাজে, বুথ বন্ধ হতে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি; পথ ঘাট  অন্ধকার, সুনসান।  এমতাবস্থায়  কাউকে ঠিক রাইজ টু ভোট বলা যায় না , অন্তত চোদ্দ ঘণ্টা আগে এঁরা  সপরিবারে রাইজ করেছেন, দিনের কাজ সম্পন্ন করে এখন একটু আরাম করে টেলিভিশনে ব্রিটেন হ্যাজ গট ট্যালেন্ট দেখছেন , ফেসবুকে লাইক দিচ্ছেন অথবা গভীর মনোযোগ সহকারে   হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনের হোম ওয়ার্ক করছেন।  এমন সময়ে তাঁদের নাগরিক কর্তব্য বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা যে খুব ফলপ্রসূ হবে ভাবার কোন সঙ্গত কারণ হয়ত  নেই।  কিন্তু আমাদের ইলেকশন ড্রাইভের নেত্রী লুইজার বিচারে আরেকটি ধাক্কা  / ফাইনাল পুশ দেওয়া প্রয়োজন- অলস , কুঁড়ে , আনডিসাইডেড ভোটারকে ঘরছাড়া করে পোলিং স্টেশনের  দিকে ভাগানো দরকার, আধমরাদের আরেকটা ঘা মারা। । একটা বিপরীত সম্ভাবনাকেও যে ঠিক  উড়িয়ে দেওয়া যায় না সে কথাটা লুইজাকে বলে গেলো না- এই সন্ধ্যে রাতে   লিবারাল ডেমোক্র্যাট দলের এশিয়ান চেহারার এক দাড়ি ওলা লোক পার্টির হলুদ ঝাণ্ডা দেখিয়ে কড়া নেড়ে তাঁর শান্তি  বিঘ্নিত করেছে  বলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে দু পা হেঁটে পোলিং বুথে ভোটের বাকসোয় কনজারভেটিভ দলের পক্ষে ভোট দিয়ে আসতেই  পারেন।  লুইজা,  পাভ ও আমার এই সান্ধ্য অভিযানের সম্মুখীন হয়ে প্রায় সকলেই  বললেন ভোট দিয়ে এসেছেন ।  এমন কাউকে পেলাম না যিনি কাচু মাচু মুখে বললেন ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধানে প্রদত্ত এই মহান নাগরিক অধিকারটির সম্যক প্রয়োগ করেন নি বলে তিনি  যারপরনাই লজ্জিত বোধ করছেন এবং আমাদের আশ্বাস দিচ্ছেন তৎক্ষণাৎ  গায়ে জামা গলিয়ে  ভোট দেবার জন্য পথে বেরুবেন।  কেউ যদি তা বলতেন, লুইজার পরবর্তী আদেশ হতো  ,  চলো গলির  মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখি  লোকটা বেরুলো কিনা , নাহলে  আবার বেল বাজাও! সাড়ে নটায় লুইজা রণে  ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে। পার্টি লিফলেট  উওকিং কাউনসিলে দশটি ওয়ার্ড (বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিট ,কানাল সাইড, গোল্ডসওয়ারথ পার্ক, হিথল্যান্ডস, হো ভ্যালি, হরসেল ,ন্যাপহিল, মাউনট হারমন,  পিরফোরড ,সেন্ট জনস)  মোট ভোটার সংখ্যা সব ওয়ার্ডে প্রায় সমান , টোটাল আশি হাজার ; তিরিশ জন পৌরপিতা ও মাতা , প্রতি বছর দশজন করে নির্বাচিত হন। চার বছরের কার্যকাল,  চতুর্থ বছরে ভোট হয় না।  যদিও কারো বাড়ি থেকে মতদান কেন্দ্র ৫০০ মিটারের বেশি দূরে নয় , শতকরা চল্লিশ জন কষ্ট করে পোলিং স্টেশনে আসেন কিনা সন্দেহ ।  ইউরোপের একমাত্র এই দেশ যেখানে  ভোট হয় কাজের দিনে, বৃহস্পতিবারে। কাগুজে ক্যান্ডিডেট হিসেবে পার্টি মায়াকে দাঁড় করিয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে দূরের কেন্দ্রে ছ মাইল পশ্চিমে  বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিটে।  সেখানে তার একমাত্র কাজ ভোট ভাঙ্গানো -  কনজারভেটিভ প্রার্থীকে হারিয়ে আমাদের  সমর্থিত এক নির্দলীয় প্রার্থীকে জেতানো । দু বছর আগে আমাদের ওয়ার্ড ন্যাপহিলে মায়া সাফল্যের সঙ্গে ঠিক এই কাণ্ডটি করে নাম কামিয়েছে ।  আমি তাকে  বললাম , তোমার জেতার কোন আশংকা নেই জানি তবু সৌজন্যের খাতিরে এই ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু ইস্তেহার বিলি, ভোটারদের সঙ্গে বাক্যালাপ করাটাও উচিত । ন্যাপহিলে বড়ো হয়েছ,  চেনা পাড়া, দু বছর আগে সেখানে তোমার পুরনো স্কুলের ছেলে মেয়েরা  কিছু ভোট দিয়েছে।  এখানে দেবে কে ? মায়াকে সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্ব নিলেন অশীতিপর এক মহিলা , অ্যান রবার্টস । এক সময়ে বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিটের প্রতিনিধি ছিলেন, দু বার ডেপুটি মেয়র । আশ্চর্য তাঁর উদ্যোগ ও কর্মশক্তি; অত্যন্ত কড়া ডিসিপ্লিন আরোপ করেন। কানাডা , নিউ জিল্যানড,  দক্ষিণ আফ্রিকা , মালায়েসিয়াতে একদা বসবাস করেছেন ,ট্রাভেল এজেন্টের কাজে দুনিয়া ঘুরেছেন ,তিনটে ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ । ষাট বছর এ পাড়ায় আছেন , নানান অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভাণ্ডার । অ্যান আমাদের নিয়ে ঘুরলেন লিফলেট বিলির কাজে ।  দিনের বেলায় কেউ বাড়ি থাকেন না , ড্রাইভে গাড়ি পার্ক করা আছে দেখে উৎসাহিত হবার কোন কারণ নেই;  তাঁরা সরকারি পরিবহনে অফিস কাছারি  গেছেন । এই পরিক্রমায়  লক্ষ করলাম , প্রায় নব্বুই শতাংশ বাড়ির দরোজার  লেটার বকসের আকার প্রকার একই রকম,  তার ভেতরে চিঠি গুঁজতে গেলে ব্রাশের মতন কিছু একটা বাধা দেয়। কোন কোন বাড়িতে লেটার বকসের অবস্থান এতো নিচুতে যে সেখান দিয়ে লিফলেট ঢোকাতে পিঠে ব্যথা হয়ে যায়। দরোজায় ওয়েলকাম লেখা মাদুরের চল উঠে গেছে বললেই হয়। লিবারাল ডেমোক্র্যাট পার্টির জাতীয় নেতা সার এড ডেভি এলেন দলের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে । একটি লেজার সেন্টারের রেস্তোরাঁয় দাঁড়িয়ে বললেন একশ বছরের টু পার্টি সিস্টেম মেনে নিতে মানুষ আর রাজি নয়, তাঁরা বিকল্প খোঁজেন।  উদাহরণ উওকিং কাউনসিল , কয়েক দশক ধরে ছিল কনজারভেটিভ পার্টির হাতে, এখন আমাদের দলের মেজরিটি,  এই নির্বাচনে চাই ক্লিন সুইপ !   ছবি - সার ডেভি, ফয়জল মুমতাজ উইল ফরস্টার এবং অন্যান্যরা  এবারের ভোটে দশজন প্রার্থী এবং উওকিঙ্গের পারলামেনটারি ক্যান্ডিডেট উইল ফরস্টার  দাঁড়িয়ে আছেন সার ডেভিকে ঘিরে। শুভেচ্ছা জানিয়ে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন সার ডেভি।  অন্য প্রার্থীদের গড়পড়তা বয়েস অন্তত পঞ্চাশ সেখানে সদ্য কলেজের গণ্ডী পেরুনো মায়াকে দেখে তিনি খানিকটা বিভ্রান্ত হলেন মনে হলো । শঙ্কিত মুখে মায়ার  দিকে চাইলাম - কেন যে রাজি হয়েছিলাম? এই নেতা কি জানেন মায়া  নামেই ক্যান্ডিডেট , তার কোন চান্স নেই ? লন্ডনের কিংস কলেজ তাকে দয়া করে মাষ্টারস করবার সুযোগ দিয়েছে , সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্লাস শুরু!  মায়ার মিশন সম্পূর্ণ আলাদা । উইল ফরস্টার কি তাঁকে বুঝিয়েছে সে সব ? বেশির ভাগ প্রার্থীর পিতা মাতা এ ধরণের অনুষ্ঠান কেন ধরা ধামেই  হয়তো উপস্থিত থাকেন না ; সম্ভবত  সার ডেভির মনে বল সঞ্চারের প্রয়াসে উইল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো , মিট মায়া’স ড্যাড ! সার ডেভি বললেন আসুন আপনার সঙ্গেও করমর্দন করি। সার ডেভির সঙ্গে   এই উষ্ণ অভ্যর্থনার ফলটি পেলাম হাতে হাতে। উওকিঙ্গের কানালসাইড ওয়ার্ডে অধিক সংখ্যক এশিয়ান মানুষের বাস। সেখানে আমাদের লড়াই  কনজারভেটিভ নয় , লেবার পার্টির বিরুদ্ধে।  তিরিশ বছর যাবত লেবার জিতেছে । ঐতিহাসিক ভাবে ব্রিটেনে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি মূলের মানুষ লেবারকে ভোট দিয়ে এসেছেন – মনে করেছেন সে দল আছে মাটির কাছাকাছি,  কনজারভেটিভ বড়ো লোকেদের পার্টি ।  এটি একটি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ধারণা মাত্র, আদতে টোনি ব্লেয়ারের আমল থেকেই ( ১৯৯৭)  লেবার অন্য দিকে মোড় নিয়েছে , যেখান থেকে তার জন্ম, তার পার্টির নাম সেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে লেবারের যোগসূত্র আজ বিচ্ছিন্ন। আমার মতে আমেরিকায় রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাট এবং ব্রিটেনের লেবার ও টোরি পার্টির কোন মৌলিক ব্যবধান নেই,তফাৎ কেবল তাদের পতাকার রঙে । লর্ড কর্নওয়ালিস যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে পূর্ব ভারতে জমি জমার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন চালু করছেন (১৭৯৩) ঠিক সেই সময়ে সারের ওয়েব্রিজ থেকে হ্যাম্পশায়ারের বেসিংস্টোক শহর অবধি তিরিশ মাইলের একটি কানাল খোঁড়া হয়। সেটি  ওয়ে নদীকে টেমসের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মাল বহনের কাজটা সহজ করে ( রেললাইন আসতে আরও চল্লিশ বছর কেটে যাবে) সেই কানালের অংশবিশেষ উওকিং শহরের ভেতর দিয়ে যায় , তাই এই ওয়ার্ডের নাম কানালসাইড। লেবার প্রার্থী আজিজ তাহির সেথা জিতছেন দশ বছর যাবত,  এবারের প্রতিদ্বন্দ্বী  আমাদের ফয়জল মুমতাজ । এখানে জনসংযোগ  করতে গেলে উপ মহাদেশের ভাষাগুলি কাজে লাগে।  এমন জব ডেসক্রিপশনের সঙ্গে মানানসই কর্মী লিব ডেম উওকিঙ্গে বিরল ।  অনুরোধটা এলো আমার মেয়ের কাছ থেকেই । মায়া বললে  আমি তো ভোটের তিনদিন আগেই  ইস্টার পরবে মায়ের সঙ্গে রোমানিয়া যাব ।  এখন তুমি ফয়জলকে একটু সাহায্য করতে পারো না?  বাংলা তোমার ভাষা । হিন্দি  জানো আর তুমিই তো বলেছ সেটা জানলে উর্দুতে চালিয়ে দেওয়া যায় । কতো দেশে উবার  ড্রাইভারের সঙ্গে তোমাকে গালগল্প করতে দেখেছি ! এখন হিন্দি উর্দু বাংলা দিয়ে দু দিন ক্যানভাসিং করো ! তোমার সঙ্গে সাইমন থাকবে ঘাঁতঘোত গুলো সেই বুঝিয়ে দেবে । এই প্রথম জানলাম  নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ইনফরমেশন টেকনোলজি কোন লেভেল পৌঁছে গেছে ! লিব ডেমের তৎপর স্টিভ জবেরা একটি অ্যাপ বানিয়েছেন তার নাম মিনিভ্যান , যা খুললেই পাওয়া যাবে ওয়ার্ড অনুযায়ী প্রত্যেক রেজিস্টার্ড ভোটারের নাম।  এর সঙ্গে আছে একটি প্রশ্ন তালিকা – কি কি জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, তার ডিগ্রি মাপ করা  আছে – ইনি কি সফট টোরি বা লেবার ? এটা লোকাল কাউন্সিল ভোট কিন্তু কাল যদি দেশের সাধারণ নির্বাচন হয়,  ভোট কোন দলকে দেবেন , গতবারে কাকে দিয়েছিলেন,  এমনি প্রায় পনেরোটা হিন্ট।  বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সামনে  কতজন এই প্রশ্নোত্তরের সম্মুখীন হতে চাইবেন ? আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দেখলাম অতি সামান্য । তবে ভোটারের নাম তালিকা দেখে সেই গৃহকর্তার দ্যাশ কোথায় ছিল অগ্রিম  অনুমান করে নিতে কোন অসুবিধে হয় না , গল্পের সূত্র মেলে সহজেই। একজনের পদবি শ্রেষ্ঠা, তিনি অবাক ও একই সঙ্গে প্রসন্ন হলেন যখন  জিজ্ঞেস করলাম নেপালের কোন শহরে তাঁর আদি বাড়ি (ব্রিটিশ আর্মির দুটি ছাউনি অলডারশট ও ক্যাম্বারলি আমাদের প্রতিবেশী শহর, অনেক গুর্খা সৈন্য ও তাদের পরিবার এসেছিলেন এবং থেকে গেছেন)। সিলেট রাওয়ালপিণ্ডির জনতার পাশেই পেলাম একজনকে যার প্রথম নাম উইজডম । বাহাদুরি দেখানোর  চান্স ছাড়া যায় না , টকিং পয়েন্ট পেয়ে গেছি ।  জিম্বাবোয়ের কোথায় আপনার বাড়ি ( আফ্রিকার এই একটি দেশ চিনি যেখানে ছেলে মেয়ের নাম রাখা হয় কোন চারিত্রিক গুণ অনুযায়ী ) ?  জানালেন তাঁর বাড়ি বুলওইয়াও (আক্ষরিক অর্থ  ‘  মৃত্যু ভূমি ,’ ‘কিলিং ফিল্ড ‘ ) । শনিবারের বিকেল , অর্ধেক গেরস্থালী  জনমানব শূন্য ।  মুখের ওপরে কেউ দরোজা বন্ধ করেন নি , যারা খুললেন  তাঁরা কিছু সমস্যার  কথা জানালেন , মৎ কৃত অনুবাদ শুনে নিয়ে সাইমন তৎক্ষণাৎ অ্যাপের ভেতরে সেই সব জবাব সাজিয়ে ফেলে। আমাদের ক্যান্ডিডেট  ফয়জল জিতলে  অবশ্যই আমরা দেখব ( সারা দুনিয়াতে ভোটের জন্যে এই গুল দেওয়া হয়ে থাকে, হম দেখেঙ্গে , সোচেঙ্গে )। একটি মাত্র  বেয়াড়া অভিজ্ঞতা হলো সেদিন : বেল শুনে ভেতর থেকেই এক মহিলা ( নামটা পর্তুগিজ, রিবেরা) প্রশ্ন করে জেনে নিলেন কোন দল , বললেন বাক্যালাপের  কোন প্রয়োজন নেই, আমি টোরি পার্টিকে ভোট দিই । এক  সময়ে লক্ষ করলাম এই মিনিভ্যান অ্যাপে যদিও সব ভোটারের নাম পাতা লেখা আছে , আমরা  সব বাড়ির বেল বাজাচ্ছি  না , মাঝে মধ্যে একটা দুটো দরোজা বাদ। সাইমন বললে আমাদের সার্ভে মাফিক এঁরা লিব ডেমকে সমর্থন করেন না , তাই কড়া নাড়া বেকার। ভাবলাম বলি তবু কথা কওয়া  যায় না কি ? এমন বুঝিয়ে দেবো , শুনে হয়তো বলবেন, ভুল করেছিনু,  ভুল ভেঙ্গেছে ! লাভ নেই। আমার ভূমিকা পার্টি ক্যাডারের , মার্গ দর্শকের নয় ! ফেলে রেখে আমাকে বন্ধনে ভোটের তিন দিন আগে  মেয়ে  গেলো মাতুলালয়ে , ইস্টার পরবে, প্রভুর পুনরুথানে।  লিব ডেম প্রার্থীরা সবাই একসাথেক্রমশ
    ভোটুৎসবে ভাট - সাদা ঘুঁটে - পুনশ্চ  - সমরেশ মুখার্জী | প্রাককথন:  পুনশ্চ‌র প্রাককথন! সেটা আবার কী মশায়? গেঞ্জির বুকপকেট? নাকি বাইকের সীটবেল্ট? আহা ব‍্যঙ্গ করেন কেন? মানছি সাধারণত তা হয় না। তবু করতে হচ্ছে। কারণ -  পুনশ্চ সচরাচর মূল লেখার থেকে বড় হয় না। তবে যা সচরাচর হয় না তাও তো কখনো হতে পারে। তাই তো বারো হাত কাঁকুড়ে‌র তেরোহাত … বা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় গোছের প্রবাদ চালু বাজারে।ছয় ইঞ্জিন - তিনশো ওয়াগন - সাড়ে তিন কিমি লম্বা সুপার বাসুকি মালগাড়ির মতো আপনার দীর্ঘ পুনশ্চ পড়বো‌ই বা কেন? কী লাভ? তা অবশ‍্য ঠিক, তবে বিগত ৭৭ বছর ধরে এতোবার লাইন দিয়ে তর্জনীতে কালি লাগিয়ে‌‌ই বা কী লাভ হয়েছে?  যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ (অথবা পূতানা) মেগা সিরিয়াল তো হয়ে‌ই চলছে। তবু তো অনেকে যায় আঙ্গুলে কালি লাগাতে। উঠতি লেখক‌কে উৎসাহ দিতে না হয় দেখলেন একটু পড়ে। ভালো লাগলে এগোবেন। না হলে ছেড়ে দেবেন।হিমশৈলের দশ শতাংশ দৃশ‍্যমান, নব্বই শতাংশ অদৃশ‍্য। ধ্রুপদী প্রতীকী রচনা এই গোত্রের। কিছু পাতি উপমা ছাড়া প্রতীক, ট্রতীক আমার মাথায় আসে না। আমি গাছ, মাছ, বেড়াল, কুকুর নিয়ে যা লিখি তা ওল্টানো হিমশৈল। তবু অদৃশ‍্য দশ শতাংশে অনুক্ত কিছু তাৎপর্য খুঁজে পেলে সে কৃতিত্ব পাঠকের। শরতের নীলাম্বরে শোনপাপড়ি‌র মতো ভেসে বেড়ানো ফিনফিনে মেঘ উত্তমের শ‍্যাম্পূ‌করা ফাঁপানো চুলের মতো নিছক দৃষ্টি‌লোভন। তাতে না আছে জল না ছায়া। এ‌ই পুনশ্চ‌টি‌‌ও তেমনি। হাওয়া বালিশের মতো ‘মূঢ়মুড়ে’ প‍্যাকেট। খাদ‍্যগুণ নেই তবে খেতে মন্দ নয়। এর ব্র‍্যান্ড এ্যামবাসাডর হাস‍্যমুখী বিগতযৌবনা বলিতারকা জেসমিন কফিওলা। এর টুকরো বারো বার চিবিয়ে‌ও বোঝা যায় না কি দিয়ে তৈরি। সোশ‍্যাল মিডিয়া গবেষণা মতে - কিছুটা প্লাস্টিক দিয়ে। তবু পাবলিক খাচ্ছে। ভাঁড়ে মা ভবানী রেলদপ্তর নানা বিচিত্র উপায়ে রোজগার বাড়াতে চালু করেছে কয়েকটি ‘মূঢ়মুড়ে এক্সপ্রেস’। গোটা ট্রেনের দুপাশে চিপকানো প‍্যাকেট হাতে জেসমিনের পোস্টার। এসব যদি হতে পারে দীর্ঘ পুনশ্চ হতে পারে না?        ****************************************মূল প্রসঙ্গ ১৬.৫.২৪ পোষ্টানো - সাদা ঘুঁটে। সেদিন আটসকালে বৌমণির ঝঙ্কৃত সম্ভাষণে মটকা মারা ঘুম চটকে মন ম‍্যাজম‍্যাজ করছিল। চারটে সাদা ঘুঁটে সাঁটিয়ে, তার মহিমায় কাব‍্যচর্চা করে চোখ প‍্যাঁ-প‍্যাঁ করতে শুরু করলো। তাই বারোটা নাগাদ বডি ফেললাম ডাইনিং হলের খাটে যার বৈশিষ্ট্য‌ বর্ণিত হয়েছে - ১৪.৫.২৪ - “কে তুমি তন্দ্রাহরণী” লেখা‌য়। পূনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। ঐ বারোয়ারী খাটে একটি বালিশ মন্দিরের সামনে দানপেটির মতো পাতা থাকে। চোখ প‍্যাঁ প‍্যাঁ করলে ওতেই মাথা পাতি। চোখে ডলার ছাপ তিরিশ টাকার আইপ‍্যাড দিলে ভরদুপুরে‌ও অমাবস‍্যা। পয়সা‌কড়ি পাওয়ার স্বপ্ন বোনাস। একাকী ভ্রমণে এটা আমার অবশ‍্যসঙ্গী। ট্রেনে গভীর রাতে‌ আলো জ্বললে বা দুপুরে কোনো পার্কে গাছের ছায়ায় প্লাস্টিক বিছিয়ে ঝপকি নিতে কোনো অসুবিধা নেই।ঘুমোলেই আমি স্বপ্ন দেখি। নয়তো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নানা চিন্তা মনে আইস-বাইস খেলে বেড়ায়। বিশ্রামান্তে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা, বিশেষ স্বপ্ন চলভাষে দানা বাঁধে। নিঃসঙ্গ শিশু যেমন মেঝেতে খেলনা ছড়িয়ে একা একা খেলে তেমনি দ্বিতীয় শৈশবে আমায় মজিয়ে রাখে অবান্তর শব্দক্রীড়া।সেদিন ঐ খাটে শুয়ে দিবাস্বপ্নে বসে ছিলাম স্বর্গের উদ‍্যানে। সবুজ লনে বিশাল শিরীষের ছায়ায় কয়েকটি বেঞ্চ। সেখানে অতীতের কিছু মহান সাহিত‍্যিক গল্প করছেন। এই রম‍্য পুনশ্চে তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই। তবু ভেবে নিলাম চারটি কল্পিত চরিত্র। আলোচনা হচ্ছিল নিম্নরূপ:    *********************************মধ‍্য পঞ্চাশের বক্রেন্দু চক্রবর্তী পায়চারি করতে করতে গম্ভীর স্বরে স্বগোতোক্তি করেন, এযুগে মর্তের কিছু মূঢ় মানবের মনোবাসনা অনুধাবন দূর্বোধ‍্য হ‌ইয়া উঠিতেছে।তাঁর থেকে তিন বছর পরে মর্তে ল‍্যান্ড করে মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে নন্দনকাননে মাইগ্ৰেট করেছেন ফাজিল যুবক তারাপ্রসন্ন সিনহা। তিনি বক্রেন্দু বাবু‌কে বলেন, বাঁকাদা, এখানে‌ও সাধুভাষায় কথা না বললে‌ই নয়? এখানে সুন্দরী অপ্সরাদের মুখে‌ও অনর্গল দেবভাষা শুনে কান পচে গেছে। একটু বিশ্রম্ভালাপ করবো তার‌ উপায় নেই। মর্তে সহজ ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব‍্য অনুবাদের উদ‍্যোগ নিলেও দেবভাষায় সিডাকশনের ফান্ডা আমার অজানা। আপনি নীচে জজগিরির অবসরে‌ই যা লিখে এসেছেন তার গুঁতোতে‌‌ই কিছু ডেন্টিস্ট করে খেয়েছে। সোজাসুজি বলুন না দাদা, চাপটা কিসের?আপদলম্বিত আলখাল্লা পরে পায়চারী করছিলেন দীর্ঘদেহী আচার্য‌সদৃশ সৌম‍্য বৃদ্ধ - সূর্যনারায়ন শর্বদেব। আবক্ষ বিস্তৃত শ্মশ্রুতে হাত বুলিয়ে তিনি বক্রেন্দুবাবুকে বলেন, আসিয়া মোরা উরধ গগনে ত‍্যাগিয়া ধরায় সকল দ্বেষহেথায় হেরিয়া অসীম শান্তি ছিলেম ভুলিয়া সকল ক্লেশএখন এ কোন তুচ্ছ পীড়ায়তব মনে ছায় বিষাদ রেশ?যুবক (স্বর্গে আসার পর কারুর আর বয়স বাড়ে না, সেটা‌ই দস্তূর) তারাপ্রসন্ন হাঁসফাঁস করে বলেন, সূর্য‌দাদু, তোমার সাধারণ কথাও হাজিরকাব‍্য করে বলার চিরকেলে অভ‍্যাস। এসো না আমরা মর্তের স্বকীয় সাহিত‍্যচর্চার ভাষা ছেড়ে এখানে সোজা সাপটা ভাষায় কথা বলি।শ্মশ্রুগুম্ফহীন ধারালো মুখ, একমাথা পক্ককেশ, রেলস্টেশনে সাঁটা সময়সারণীর মতো মুখভাবে স্থায়ী বিষন্নতা। নাম তাঁর শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়। তূষের চাদর গায়ে চুপ করে বসেছিলেন। অনেক ওপরে বলে স্বর্গে ঝকঝকে সকালে‌ও বারোমাস শীত। জীবদ্দশায় তিনি‌ সহজ ভাষায় গদ‍্যচর্চা করেছেন। তিনি তারুর কথায় সায় দিতে বাকি দুজনে‌ও সম্মতি জানালেন। উৎফুল্ল মুখে তারু বলেন, এবার বলুন তো বাঁকাদা, কেস‌টা কি?তবলার বিড়ের মতো ডোরাকাটা পাগড়ি‌টা একটু হেলে গেছিল। সেটা ঠিক করে বক্রেন্দুবাবু বলেন, তারু তোমায় কতোবার বলেছি আমায় বাঁকাদা বলবে না, এই শেষবার বলছি,  নাহলে কিন্তু...তারু লজ্জিত হয়ে বলেন, আচ্ছা, এবার থেকে ইন্দুদা বলবো। কিন্তু “নাহলে কিন্তু” বলে কি বলতে চাইছিলেন? নীচে ব্রিটিশ আমলে তো পান থেকে চূণ খসলে জজ ম‍্যাজিস্ট্রেটরা লোকজনকে জেলে পাঠাতো। এখানে‌‌ও কি আপনি আদালত‌হীন বিচারক অবমাননার দায়ে আমায় শাস্তি দেবেন?আরে না, না, সে যুগ‌ আর নেই। এখন তো নীচে সর্বোচ্চ আদালতের রায়‌ও পছন্দ না হলে লোকজন প্রখর সমালোচনা করে। ব্রিটিশ‌রাজে জজগিরির গুমোর আর নেই। আমি বলতে চাইছিলাম নাহলে কিন্তু আমি আর তোমার সাথে কথাই বলবো না।আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ করবেন না। এখন বলুন না, হয়েছেটা কি?জানো তারু, একদা আমি মর্তে সাধুভাষায় এক বিশেষ বাংলা গদ‍্যরীতি‌র প্রচলন করেছিলাম। মানছি আমার আঙ্গিক ছিল আলংকারিক‌। আমার লেখা এখন আর অনেকেই পড়ে না। তবু কিছু প্রকৃত সাহিত‍্যরসিক আমায় বাংলা উপন‍্যাসের জনক বলে মানে। কিন্তু কার্তিক নামক এক অর্বাচীন, শখের লেখালেখি করে। সে‌ও দেখি সাধুভাষায় আমার শৈলী অনুকরন করতে গেছে। আর তা ক‍রতে গিয়ে, প্রকৃত জ্ঞান না থাকলে যা হয়, তাই হয়েছে। অজগরের মতো লম্বা প‍্যাঁচালো বাক‍্যবিন‍্যাস করেছে। আমি এই ঐতিহ্য রেখে এলাম মর্তে? এহেন ধৃষ্টতা কি সহ‍্য করা যায়? অর্বাচীন কার্তিকের ধৃষ্টতায় মর্মাহত ইন্দুবাবুর হাঁচি, কাশি, হেঁচকি, হাই, দীর্ঘশ্বাস, ঢেঁকুর উপর্যুপরি হতে, উঠতে বা পড়তে লাগলো। তারু দ্রুত তাম্রপাত্রে জল এনে (ইন্দ্রের ফরমানে স্বর্গে প্লাস্টিক অচল) ইন্দুদাকে দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, জল খান, জল খান।ইন্দুবাবু কিঞ্চিৎ সুস্থ বোধ করতে সূর্যবাবু বলেন, আপনার আঙ্গিকে আজকের দিনে রচনা সহজ নয়। কার্তিকের মতো অর্বাচীন ছেলে ছোকড়া তার একটু হনুকরন করতে পারে মাত্র। এতে মর্মপীড়ার কোনো কারণ দেখি না। উপেক্ষা‌ই এক্ষেত্রে কাম‍্য।সূর্য‌বাবু, কার্তিক ছোকড়া নয়, প্রবীণ। ছাত্রজীবনে সে ব‍্যাকরণ পড়েনি। বাংলায় পেয়েছে ৩৭%, আর সে কিনা শখ করে আমায় নকল করতে যায়। অমন শখের ক‍্যাঁতায় আগুন।মর্তে তাঁর নামের আগে ঋষি লেখা হতো। কিন্তু মর্মপীড়ায় তাঁর ভাষ‍্যে প্রাকৃত ভঙ্গিতে প্রকৃত মর্মবেদনা ফুটে বেরিয়েছে। পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ‌ হয়ে সামলে নিয়েছেন।  সূর্য‌বাবু বলেন, শান্ত হোন। বৃথা কষ্ট পাবেন না। এসব‌ কালের অমোঘ লিখন। যুগধর্ম। আমার কথাই ধরুন। এখানে চলে আসার পর আমার সব রচনা সরকার সাতাশ খন্ডে আঠারো হাজার ছশো পাতায় ছাপলেন। কিন্ত কী লাভ হলো? ছৌ মুখোশের মতো ঘর সাজাতে সূর্য রচনাবলী‌ও সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচায়ক। তাই ড্রয়িং‌রুমে বুককেসে শোভা পায়। কিন্তু পড়ে কজন? তাই তো আমি মর্তে‌ই লিখেছিলাম:যখন পড়বে না মোর গল্প গাথা কেউ পরেতবে জন্ম দিনে আসবে তারা ছল করে সেথায় গাইবে নানা সূর্য‌গীতি ভুল সুরেআমার স্থাপিত তালপুর ‘প্রশান্তি নিলয়’ আশ্রম মহাবিদ্যালয়ের কিছু লবঙ্গ‌লতিকা‌সদৃশ মেয়ে আজ‌ও আমার ‘অন্তিম পদ‍্য’ অনুসরণে সুমিতকে ‘সুমিতো’ উচ্চারণ করে দয়িতকে প্রেম নিবেদন করে। তবে ওসব ঐ তালপুরে‌ই চলে। কলকাতার কালচার অন‍্য। তুই তোকারি করা -  বীয়ার হাগ দেওয়া -  হটপ‍্যান্ট পরে বিড়িফোঁকা মেয়েরা ওসব বলে না। তবে যখন দেখি রাত্রিবেলা‌ও মঞ্চে কালোচশমা পরে, ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে, AK47 এর মতো গীটার নাচিয়ে, স্ট‍্যান্ড থেকে মাইক্রোফোন উপড়ে আমার‌ গান জগঝম্প স্টাইলে গাইছে তখন অদ্ভুত লাগে। শুনলাম এমন রক শৈলী‌র Gunকে নাকি বলে ‘সূর্যালো ফিউসন’। বেশ অর্থবহ নাম। মূল থেকে সরা সুর, উজ্জ্বল নাচুনে আলো, উদ্দাম চিৎকার - মনে হয় রক‌ ছোঁড়াছুঁড়ি‌ই হচ্ছে। ফিউশন টিউশন আমাদের কালে ছিল না বলে বুঝি‌ না। ওপর থেকে দেখে লাগলো - টোটাল কনফিউশন‌। তবু আমি কিছু মনে করি না। কেন জানেন? এসব যুগধর্ম। কেউ খন্ডাতে পারবে না।ইন্দুবাবু বললেন, আপনি এক জীবনে অতলান্তিক সাহিত্য‌চর্চা ছাড়াও আরো এতো কিছু করেছেন যা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। মর্তের মানুষ আজ‌ও আপনার টাইম ম‍্যানেজমেন্ট নিয়ে গবেষণা করে। বার্মিংহাম অফ দ‍্য ইস্টের নানা নামী কারখানা যখন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন‌ও আপনি বাংলায় ‘ওয়ান ম‍্যান ইন্ডাস্ট্রি’। বহু মানুষ আপনাকে ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছে। এমন ডিউরেবল ব্র‍্যান্ড বাঙালি সহজে ভুলবে না নিজে‌র গরজে। সূদুর ভবিষ্যতে‌ও মর্তে আপনার আসন পাকা।  যদি কিছু মনে না করেন তো একটা ব‍্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলি? সূর্যবাবু বলেন, বিখ‍্যাত মানুষের ব‍্যক্তিগত বলে কিছু হয় না। প্রিয়জনের সাথে নিভৃত আলাপচারিতা বা চিঠিপত্রে প্রকাশিত মনোভাব‌ও সূর্য‌গবেষকরা প‍্যাঁটরা হাঁটকে, সাক্ষাৎ‌কার নিয়ে খুঁজে বার করেছে।  তা নিয়ে কাগজে, পত্রিকায়, গ্ৰন্থে, টিভিতে, সমাজমাধ‍্যমে কাটাছেঁড়া করেছে। এসব খ‍্যাতি‌র বিড়ম্বনা। মর্তে রবি ঠাকুরের একটি গান মনে পড়ছে। গান তো নয়, যেন হৃদ‍য় নিংড়ানো আকুতি, একটু গাইবো? ইন্দু‌বাবু বোঝেন সূর্য‌বাবু একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছে‌ন, তাই সাগ্ৰহে বললেন, নিশ্চ‌ই গান না, আমরাও শুনি।সূর্য‌বাবু চোখ বুঁজে তন্ময় ভাবে ধরলেন:নিভৃত প্রাণের দেবতা  যেখানে জাগেন একা,ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার আজ লব তাঁর দেখা।সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে,সন্ধ্যা‌বেলার আরতি হয় নি আমার শেখা।তব জীবনের আলোতে জীবনপ্রদীপ জ্বালিহে পূজারি, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি।যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনাসেথায় আমি‌ও ধরিব একটি জ‍্যোতির রেখা।সেই প্রার্থনা সংগীতের কথা, সুর, গায়কী‌র মাধূর্যে স্বর্গের মনোরম সকালে‌ও সবাই স্তব্ধ‌বাক। লঘুচিত্তের তারুর চোখ দিয়ে‌ও গড়িয়ে পড়ছে  অশ্রু। শরদিন্দু‌বাবু চাদরে চোখ মুছছেন। ইন্দুবাবু তাকিয়ে আকাশপানে। সূর্য‌বাবু মর্তে প্রিয় সন্তান‌কে শ্মশানে দাহ করে এসে‌ পূর্বনির্ধারিত সভায় যোগ দিয়ে বক্তব‍্য রেখেছেন। মর্তে তাঁর কর্তব্যজ্ঞান ও নশ্বরতাবোধের দার্শনিক প্রজ্ঞায় লালিত নির্লিপ্ততা কিংবদন্তি‌প্রায়। স্বর্গে সেই মুখোশ পরার প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই কখনো একটু আবেগের প্রকাশ হয়ে যায়। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলেন, আচ্ছা  আপনি কি বলছি‌লেন যেন?আপনার বৌদি ভারতী দেবী সম্পর্কে। আমরা শুনেছি আপনাদের মধ‍্যে প্রীতির সম্পর্ক ছিল। তাঁর আত্মহত্যার কারণ যাই হোক, সেটা আপনাদের পারিবারিক ব‍্যাপার। তবু মনোরঞ্জন বটব‍্যাল নামক এক চলচ্চিত্র সমালোচক কাম টিভি সঞ্চালক ঐ প্রসঙ্গে ‘ভারতী দেবীর শেষ পত্র’ শিরোনামে একটি ব‌ই লিখে তাতে নানা কাল্পনিক মেলোড্রামাটিক গালগল্প ফাঁদলেন কেন? ঋষিসূলভ অবিচলতায় সূর্য‌বাবু বলেন, প্রসঙ্গটি স্পর্শকাতর। তবু সত‍্যভাষন করছি। দেখুন নারী পুরুষের সম্পর্ক জটিল দৈবিক রসায়ন। তার চর্চা আপনার উপন্যাসে‌ও এসেছে। এই সম্পর্ক যে কোনো নিয়ম, নীতি, হিসাবের গণ্ডিতে বাঁধা থাকে না তা আমরা এখানে দেবতাদের মধ‍্যেও দেখছি। বৌদিকে আমি খুব ভালোবাসতাম। তিনি তার যোগ‍্যা। আমার থেকে মাত্র দু বছরের বড়। তাই সখার মত‌ সম্পর্ক ছিল আমাদের।  আমার লেখার প্রথম পাঠিকা ছিলেন তিনি। তাঁর কাছে পেয়েছি নানা পরামর্শ, সৃজনশীল অনুপ্রেরণা। লেখকের কাছে বৌদ্ধিক পাঠকের সুচিন্তিত মতামতের গুরুত্ব আপনি‌ও লেখক হিসেবে নিশ্চিত বোঝেন। ইন্দুবাবু নীরবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।কাব‍্যচর্চা‌র মোহে তখন আমার মন মানব সম্পর্কে‌র নানা আলোছায়াময় প্রাঙ্গনে আবিস্কারের নেশায় ঘোরাফেরা করছে। তখন ওনার নারীত্বের মাধূর্য, আচরণের কমনীয়‌তা, স্বামী সঙ্গহীনতার একাকীত্ব, অনায়াস নৈকট‍্য, আমার চব্বিশ বসন্তের বয়সধর্ম - এহেন নানা অণুঘটক প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে কিভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে তা আমরা সজ্ঞানে অনুধাবন করতে পারিনি। আমার বিবাহের অনতিপরে উনি আত্মঘাতী হতে আমি‌ নিদারুণ মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম। আমি জানিনা কি কারণে  উনি ঐ চরম পথ বেছে নিলেন। আমার বিবাহের ফলে ওনাকে আগের মতো সাহচর্য দিতে পারিনি। ক্রমশ বহির্জগতে আমার ক্রমবর্ধমান পদার্পনের ফলে উনি পুনরায় নিঃসঙ্গ বোধ ক‍রতে শুরু করেছিলেন। তখন তাঁর একটি সন্তান থাকলে হয়তো মাতৃত্বের আনন্দে খুঁজে পেতেন বেঁচে থাকার সার্থকতা। তাহলে হয়তো তিনি ঐ চরমপন্থা অবলম্বন করতেন না।লেখিকা আনাই নিন তাঁর অতি অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি প্রকাশ করে বলেছিলেন "The role of a writer is not to say what we all can say, but what we are unable to say." এটা ওনার অভিমত। আমার অভিমত, কেউ নিজে প্রকাশ করতে না চাইলে, কারুর একান্ত ব‍্যক্তিগত প্রসঙ্গ, অনুভব বিপণন‌যোগ‍্য নয়। তাই বৌদির যে চিঠি, ডায়েরি‌ পাওয়া যায়নি সেই নাম দিয়ে একটি ব‌ই লিখে তাতে উপন‍্যাসের আঙ্গিকে কল্পনার জাল বোনা আমার অমানবিক লেগেছে। মৃত মানুষের সম্মান রক্ষার্থে এমন কল্পিত আখ‍্যান না লেখা‌ই উচিত ছিল।সেই তুলনায় দূর্বলভাবে আপনার আঙ্গিক অনুকরণ করে কার্তিকের সাধু ভাষায় কিছু লিখতে চাওয়া নির্দোষ প্রয়াস। তার জন‍্য আপনার বিমর্ষ হ‌ওয়া উচিত নয়। তাহলে আমার জায়গায় থাকলে আপনার কেমন লাগতো?তারু‌ বলেন, ইন্দুদা আপনাকে কেউ নকল করতে চাইছে মানে তো লোকে আপনাকে মনে রেখেছে। এতে তো আপনার কিছু মনে করা উচিত নয়। আমাকে‌‌ দেখুন। আমি ‘তোতাপাখির তামাশা’ নামে কথ‍্য ভাষায় - বলচে, কচ্চে, করে কিছু নকশাবাজি করেছিলাম। এখন কী আর কেউ ওভাবে লেখে? আমি আপনার থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে এখানে চলে না এসে মর্তে আরো অনেকদিন থাকলে হয়তো আপনার প্রভাবে আমি‌ও সাধু ভাষায় লিখতে যেতাম।ইন্দু‌বাবু বললেন, না হে তারু, সাহিত‍্যচর্চা করতে সবাইকে যে এক‌ই ঘাটে জল খেতে হবে তার কোনো মানে নেই। যে যার মতো লিখবে। নাহলে তো সবাই ঝাঁকের ক‌ই হয়ে যাবে। তাতে বৈচিত্র্য থাকবে না। দীর্ঘজীবী হলে‌ই যে সাহিত্য‌চর্চার মান‌ বাড়বে তার‌ কোনো মানে নেই। অনেকের‌ লেখাতে পরে বয়সের ছাপ পড়ে যায়। শ্রীকুমার মাত্র ছত্রিশ বছরে এখানে চলে এলো। কিন্তু ঐটুকু সময়ে যে অনন‍্য ধারার সাহিত‍্যসৃষ্টি সে করে এলো, তার আবেদন আজ‌ও অমলিন।তারু প্রফুল্ল মনে বলে, সত‍্যি বলতে কি ইন্দু‌দা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছিল বলে তখন বেশ  খারাপ‌ই লেগেছিল। আর কিছুদিন বাঁচলে মর্তে আর একটু তামাশা করা যেতো। কিন্তু আজ আপনার সাট্টিপিটি পেয়ে বেশ লাগলো। আমাদের শরদিন্দুবাবুকে‌ই দেখুন। আজ না হয় মর্তে "আমি‌ও" আন্দোলন করে নানা হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু অতীতেও তো মেয়েদের ওপর অনেক অত‍্যাচার, অবিচার হয়েছিল। তবু তখন তাদের এমন আন্দোলন করার উপায় ছিল‌না। তখন শরদিন্দু‌দা পথের দাবী মিটিয়ে, চরিত্রে কলঙ্কের পরোয়া না করে অসহায় নারীদের চোখের জল তাঁর লেখার কাগজে মুছেছেন। আজ তা‍ঁর লেখা‌ও বিশেষ কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। যাদের কথা এতো লিখেছেন সেই মেয়েরা‌ও বোধহয় না।স্বর্গের ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের ঘন্টা পড়লো। রম্ভা, মেনকা, উর্বশী‌ প্রসাধন করে, রেশমি ঘাগরা, চূমকী বসানো কাঁচূলী পরে, খোঁপায় পারিজাত গুঁজে সবাইকে রিনরিনে কণ্ঠে খেতে ডাকছে। সেদিকে তাকিয়ে তারু বয়সধর্মে একটু উচাটন হয়ে পড়লো। তার আর সাহিত্য আলোচনা‌য় মন নেই। তবে নানা সভায় সভাপতি‌ত্ব করে, আশ্রমে আচার্য‌গিরি করে সূর্যনারায়ন শর্বদেব আলোচনা অসমাপ্ত রেখে খেতে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। তিনি গলা খাঁকড়ে তারুর মনযোগ পুনরায় এদিকে আকর্ষণ করে ছোট্ট সমাপ্তি ভাষণ দিলেন।বললেন, আজ সকালে‌ আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল ইন্দু‌বাবুর মৃদু ক্ষুব্ধ মন্তব্য দিয়ে। পরে নানা আলোচনা‌য় আমরা অনুধাবন করলাম সাহিত‍্যসৃষ্টি নিয়ে আমাদের যত‌ই আত্মগরিমা থাকুক, কালের নিয়মে তার অভিঘাত অধিকাংশের কাছে ক্ষীণ হয়ে যেতেই পারে। তাতে মর্মাহত হ‌ওয়া‌র কিছু নেই। ধীমান মানুষ চিরকাল সংখ্যালঘু। তবু তাদের চর্চার মাধ‍্যমে‌ই ললিতকলা বেঁচে থাকে। তার সাথে যদি কার্তিকের মতো কিছু অর্বাচীন‌ মাতৃভাষা চর্চার আনন্দে ইন্দু‌বাবুর শৈলী অনুকরণের অক্ষম প্রয়াস করে - তাতে ক্ষতি কী? অধিকাংশ মর্তের মানুষের যখন আজকাল প্রয়োজন ছাড়া লেখার অভ‍্যাস চলে যাচ্ছে তখন প্রকৃত জ্ঞানী লেখকের সাথে কার্তিকের মতো কেউ যদি শখের লেখালেখি‌ও করে, তাতে‌ তো আমাদের খুশি হবার‌ই কথা। তাই না? সূর্য‌বাবুর এহেন গোছালো বক্তব‍্যে তিনজন একবাক‍্যে সম্মত হলেন। তার‌পর সবাই চললেন প্রাতরাশ করতে। আমি‌ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শোনা সেই আলোচনা খাট থেকে উঠে, মুখেচোখে জল দিয়ে, ভুলে যাওয়ায় আগে লিখে ফেললাম।
  • জনতার খেরোর খাতা...
    যারা বকে বেশি তাদের কথা শুনবেন না কেন ! - Debasis Sarkar | আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের বোলসেনারো, তুরস্কে এরডোগান, চিনেশি জিনপিং, রাশিয়ায় পুতিনের মতোই আমাদের উনি! লৌহদৃঢ় রাষ্ট্রনায়ক! পুঁজিবাদের নতুন অভিষেকে তাঁরা সকলেই বাতেলাবাজ এবং এক একজন কল্পিত শত্রুর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের দেশের জনসাধারণকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন। সেই সব দেশের জনগণ ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গায়ে ব্যথা তৈরী করছে আর সেই সুযোগে পুঁজিবাদ নিজেকে পুনর্গঠিত করে নিচ্ছে। মোদি আমাদের চেনালেন পাকিস্তান আমাদের এক নম্বরের শত্রু, মুসলমান সম্প্রদায় আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে ক্ষতিকর। তার কথার তোড়ে, ' মন কি বাঁতে' র ফোয়ারায় আমরা জানতেও পারলাম না ------(১) কর্মজগৎ থেকে একটা বড় অংশকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে !(২) দেশের সমস্ত কিছুই এখন কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে !(৩) পেশাগত ভাবে কর্মহীন ভারতবাসীর একটা বড় অংশকেই 'ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম' নামক অনুদানের মুখাপেক্ষী করে রাখা হয়েছে ।(৪) লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে প্রায় ন' কোটি বেকার যুবক গিগ শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে ।(৫) সরকারি ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।(৬) ব্যাংক থেকে নেওয়া কোটি কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে বিদেশে পালিয়ে দিব্যি বেঁচে রাজার হালে থাকা যায়, এক দু বছর বাদে রাষ্ট্রই সেই ঋণ তামাদি (written off) ঘোষণা করে!(৭) খনি এবং জঙ্গলকেও কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া যায় ! কৃষিকেও !(৮) দীর্ঘদিন আলোচনা তর্ক-বিতর্কের পরে শ্রমিক স্বার্থে যে শ্রম আইন বানানো হয়েছিল সেটিকেও ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া যায় !(৯) খাদ্য ওষুধ এবং অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রও এখন কিনতে হবে কর্পোরেটের বানানো বহুতল দোকানে!(১০) ব্যক্তিগত বা ব্যক্তি ইচ্ছা বলে কিছু থাকবে না, শাসিতবর্গের রুচি, চর্চা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক সমস্ত কিছুই থাকবে কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে !
    একদিন, বৈজয়ন্তী  - Aritra De | একদিন, বৈজয়ন্তী- - - - - - - - -৩১-০১-২০২৪যাবতীয় বৃক্ষের কাছে ফিরে এসেছি খালি হাতেফুলফল অথবা বীজ নয়, অন্য কোনো প্রত্যাশায় বৈজয়ন্তী, একদিন তোমার চোখের কাছে নিচু হয়েবসে থাকবো সারাটা দিন আর হাওয়ায় উড়ে যাবেতোমার চুলনখঠোঁটকানবৃষ্টির শেষে তোমাকে ডেকে নেব ঘন মেঘের ভিতরএরপর চূড়ান্ত বাষ্পের মতোফুরিয়ে যাবে আমাদের সময়আমাদের নিজস্ব নদী ফুরিয়ে যাবেএইসব জগঝম্প শেষ হলেগানের স্কুলের শেষে উঠবে নিচু চাঁদ একদিন হলুদ ট্যাক্সিআমাদেরকে আর কোথাও নামিয়ে দিয়ে যাবে না একদিন মাথায় ভায়োলিন বেঁধে শুয়ে থাকবো আমি একদিন, বৈজয়ন্তী, তোমার চোখের কাছে নিচু হয়ে...
    জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৫ - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ  পর্ব ৩৫নয়নের কোলকাতাতেই পোস্টিং। জয়েন করার জন্য কোন সময় লেখা ছিল না। নয়ন বাবার সাথেই   খাওয়া দাওয়া করে ট্রেন ধরল। দশটা বাজার কিছু আগেই অফিসে পৌঁছে গেল। সরকারি দফতর হলেও মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। লোকজন তখনো আসেনি। মেন গেট থেকে একটু ভেতরে ঢুকে দেখে একজন মেঝে মুছছে। নয়নকে দেখে এগিয়ে এসে জানতে চাইল কি চায়। নয়ন নতুন জয়েন করবে শুনে সামনে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল—আপনি এখানে একটু বসুন, আমি এই দিকটা  মুছে নিয়ে আসছি।কাজ শেষ হলে  নয়নের সামনে এসে বলল—আমার নাম রত্নাকর সাহু, আমি এখানে সুইপারের কাজ করি। চলুন, আপনাকে হরেন বাবু যেখানে বসেন নিয়ে যাই। উনিই নতুন জয়েনের কেসগুলো দেখেন।রত্নাকর নয়নকে দোতলায় হরেনবাবুর টেবিলের সামনে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল—এখানে  বসুন, উনি একটু বাদেই এসে যাবেন।  দশটা দশ নাগাদ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নয়নের সামনের টেবিলে এসে বসলেন।নয়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কি চাই?নয়ন বিনয়ের সঙ্গে বলল—আজ্ঞে আমি এই অফিসে জয়েন করতে এসেছি।--ক্লেরিকাল না সাবোর্ডিনেট স্টাফ?--আমি ডবলিউ বি সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি।লোকটার হাবভাবই পাল্টে গেল।--কিছু মনে করবেন না ভাই। আসলে আমাদের এই অফিসে এখন বেশ কিছু নতুন ক্লেরিকাল আর সাাবোর্ডিনেট স্টাফ জয়েন করছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।--নানা মনে করার কি আছে।--আপনি মিস্টার নয়ন দে?--আজ্ঞে হ্যাঁ।নয়ন নিয়োগপত্রটা হরেন বাবুর দিকে এগিয়ে দিল। এর মধ্যে নয়নের জন্য চা এসে গেল। দু একটা কাগজপত্রে সই সাবুদ করাবার পর, হরেন বাবু নয়নকে নিয়ে তিন তলায় যে  ডিপার্টমেন্টে ওর জয়েন করার কথা, সেখানে পৌঁছে দিয়ে এলেন।ডিপার্টমেন্টের বস অভিজিৎ সামন্ত ঘরে  ছিলেন না।হরেন বাবু নয়নকে সামন্ত স্যারের চেম্বারে বসিয়ে বললেন—স্যার মনে হয় অন্য কোন ডিপার্টমেন্টে গেছেন। আপনি এখানে বসুন।একটু পরে বছর পঁয়তাল্লিশের দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে নয়নের সামনে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। নয়ন আন্দাজ করে উঠে দাঁড়িয়েছিল।গম্ভীর গলা ভেসে এল—বস। নয়ন দে, তাই ত?--আজ্ঞে হ্যাঁ।--কোথায় থাকা হয়?--আজ্ঞে রহড়ায়।-- এই ফর্মগুলো এক এক করে ভরো। কাছে পেন আছে?--আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।--তিনবার হয়ে গেছে, আর ব্যবহার না করলেই খুশি হব।--কি স্যার?--‘আজ্ঞে’ শব্দটা।  বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করে এসেছ, নাকি প্রথম দিন বলে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছ?--ভাত খেয়ে এসেছি স্যার। -গুড।নয়ন ফর্ম ভরা শুরু করল। অনেক কটা ছিল, একটু সময় লাগল।  লেখালিখি শেষ হওয়ার পর ওগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে অভিজিৎ সামন্ত অফিসের কাজকর্মের ধরণ ধারণ নিয়ে  মুল্যবান কিছু পরামর্শ দিলেন। ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। নয়ন এত ঘন ঘন চা খায় না, কিন্তু না করার সাধ্য নেই। চা খাওয়ার পর সামন্ত স্যার নয়নকে সাথে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টে এলেন।  মোটামুটি বড় ঘর, দশ বার জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তখন ভরা অফিস। দু একটা বাদে সব টেবিলেই লোক রয়েছে।সামন্ত স্যার গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—ইনি নয়ন দে, এই  ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার অফিসার, আজকেই জয়েন করেছেন। রমেনবাবু, আপনি এঁকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন।কথাগুলো শেষ করে সামন্ত স্যার নিজের চেম্বারে ফিরে গেলেন। রমেন বাবু নিজের পরিচয় সেরে নিয়ে এক এক করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্ব সারা হলে আমাকে আমার বসার জায়গায় নিয়ে এলেন। রমেন বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে নয়ন নিজের চেয়ারে এসে বসল।  গদি লাগান চেয়ার, বিরাট টেবিল, টেবিলের ওপর টেলিফোন,  সে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তি। টেবিলে বসেই নয়নের মনে পড়ল ঈজার খচ্চর মামাটার কথাগুলো....বেকার, ভ্যাগাবন্ড, জেনারাল লাইনে পড়ে কিচ্ছু হবে না। কোনদিন দেখতে পেলে বলবে—আয় শালা দেখে যা, কিছু হয়েছি কিনা। শকুনের সাপে গরু মরে নারে শালা।  রমেনবাবু মানুষটা ভাল। অনেক সিনিয়র। কাজকর্ম সব একটু একটু করে কয়েকদিনে বুঝিয়ে  দিলেন। ওনার কাছেই নয়ন জানল যে, ডিপার্টমেন্টে অভিজিৎ সামন্ত  আর ও, এই দুজন  অফিসার।  এখানে আগে একজন ছিলেন, তিনি অন্যত্র  বদলি হয়ে যাওয়ার পর মাস দুয়েক টেবিলটা ফাঁকাই ছিল।সামন্ত স্যারকে  প্রথমদিকে রাগী ধরণের অফিসার মনে হত। চাকরিতে জুনিয়ার অফিসার হিসেবে জয়েন করার কয়েক  মাস পরেই একদিন নয়নকে চেম্বারে ডেকে আদেশ দিলেন- কাল থেকে তুমি ডিপার্টমেন্টের অ্যাটেন্ডেন্সটা দেখবে।নয়ন আমতা আমতা করে বলল- স্যার, আমি তো নতুন, এ কাজটা আমি না করলেই নয়!--অফিসার হয়ে ঢুকেছ, দায়িত্ব নিতে শেখ।অগত্যা সব থেকে অপ্রিয় আর অশান্তির কাজটা নয়নের ঘাড়ে চাপল। দু এক দিনের মধ্যেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল। একটা সময়ের পরে লেট মারকিং করতে হত। সেদিনও করেছে। কিছু নিত্য লেটকামারের সাথে ট্রেনের গণ্ডগোলের জন্য অশেষেরও অফিসে আসতে দেরী হয়েছিল। ও রোজই সময়ে আসে। খাতায় দাগ দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে নয়নের সাথে কথা বলল। নয়ন  ওকে সামন্ত স্যারের সাথে দেখা করতে বললে ও কোন কথা না শুনে হনহন করে অফিস থেকে বেরিয়ে চলে গেল। সময়ের সাথে সাথে নয়ন অফিসের হাল হকিকতের সঙ্গে ধীরে  ধীরে পরিচিত হয়ে গেল। শিখল কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হবে, কোন সমস্যা কিভাবে মেটাতে হবে। এই অভিজ্ঞতা অর্জনের পর্বে সামন্ত স্যারই ছিলেন নয়নের পথপ্রদর্শক।    ঘটনার দু এক দিন পরে ওর সেদিনের আচরণের জন্য অশেষ নয়নের কাছে এসে দুঃখপ্রকাশ করেছিল। সেদিন থেকেই অশেষের সাথে একটা মধুর  সম্পর্ক গড়ে ওঠে।  কাজ করতে করতে ব্যবহারের গুণে কেবল অশেষই নয়, অন্য সহকর্মীদের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল।অফিসে জয়েন করার ঠিক বারো দিনের মাথায় ঘটল নয়নের জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা।  সেদিন অফিসে আসার কিছুটা পরে নয়ন দেখে, ঈজার মামা ওদের অফিসে ঢুকে কোনার দিকে  একটা টেবিলে গিয়ে বসল। নয়নকে তখনো দেখতে পাইনি। লোকটাকে দেখিয়ে নয়ন অশেষকে জিজ্ঞেস করল—উনি কি কারো সাথে দেখা করতে  এসেছেন?অশেষ হেসে বলল—নানা, উনি কুণাল বাবু। কয়েক দিন ছুটিতে ছিলেন, আজ জয়েন করেছে্ন।জিজ্ঞেস করলাম—লোকটা কেমন?-- ব্যাচেলার লোক। বিয়ে থা না করলে সাধারণত যেমন হয়, রসকষহীন। দাঁড়ান, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।অশেষ পরিচয় করাবার সময় কুণাল নয়নকে দেখে চমকে উঠল। অশেষের নজর এড়ায়নি।জিজ্ঞেস করল—কুণাল বাবু বাবু কি স্যারকে চেনেন নাকি?-- হ্যাঁ, না মানে হঠাৎ  মনে হয়েছিল।  কোন রকমে পরিচয় সেরেই কুণাল চলে গেল। একেই বলে বিধাতার পরিহাস। যাকে নিজের চাকরির আভিজাত্য দেখিয়ে সবথেকে বেশী তৃপ্তি পাবে, সেই আজ নয়নের অধস্তন কর্মচারী।   দুপুরবেলা কুণাল কতগুলো ফাইল নয়নকে দেখাতে এল। আশেপাশে কেউ নেই দেখে খুব  আস্তে করে জিজ্ঞেস করল—ভাল আছ ভাই?নয়ন  বেশ রুঢ়ভাবে বলল—আপনার অপমানকর কথাগুলো আমি ভুলিনি। চেষ্টা থাকলে জেনারাল লাইনে পড়াশোনা করেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। একটা কথা আপনাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখছি। অফিসে যে সম্পর্ক আমাদের  দুজনের চেয়ারের মধ্যে হওয়া  উচিৎ সেটা মেন্টেন করার চেষ্টা করবেন। আগে যা করেছেন করেছেন, এখন থেকে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সামান্যতম উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আর অফিসের কাজ ছাড়া অন্য কোন কথা আমার সাথে বলার চেষ্টা করবেন না। সেই বেকার, ভ্যাগাবন্ড, কিন্তু এখন আপনার অফিসার এটা সবসময় মনে রাখবেন।সবটা শোনার পর, কোন উত্তর না দিয়ে, কুণাল  মাথা নিচু করে চলে গেল।  মনের মত করে  অনেকটা  উগরোতে পেরে নয়নের ভেতরটা জুড়িয়ে গেল। এর পর থেকে কুণাল খুব গুটিয়ে থাকত আর নয়নের নির্দেশগুলোও যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করত।  চলবে
  • ভাট...
    commentlcm | থ্যাংকু। এটা পড়ব। অ্যাকটিভিটি পাব এর ব্যাপারটা একবার দেখেছিলাম, ভালো করে দেখতে হবে।
    commentঅরিন | গুরু যদি ফেডারেটেড হত, তাহলে যারা গুরুতে লিখতে চাইবেন, তাঁদের একটা আইডেনটিটি করতে হবে, যেমন অমুক@গুরুচণ্ডালী, এবার সেই আআডেন্টিটি থেকে তিনি অন্যত্র প্রকাশিত মেসেজ পড়তে পারবেন, বা গুরুর মেম্বারদের ফলো করতে পারবেন। এবার তাঁর অন্যত্র আইডেনটিটি থাকতে পারে, সেখান থেকেও তিনি গুরুতে পোস্ট করতে পারেন, গুরু বহু সাইটের সঙ্গে ফেডারেটেড হল । এটা দেখুন, 
    এতে করে ট্রোলদের নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধে হয়। 
    commentlcm | "গুরু ফেডারেটেড নয়, ফেডারেটেড হলে এই সমস্যাটা হত না" এটা একটু গুছিয়ে বলুন, এটা নিয়ে লিখুন। ফেডারেটেড বললে আমার যেমন মনে হয় ফেডারেটেড অথিন্টিকেশন টাইপের জিনিসের কথা, যে জিনিসটা এসএসও (সিঙ্গল সাইন অন) এ ব্যবহার হয়, একটাই ফেডারেটেড আইডেন্টিটি, সেটা দিয়ে এক জায়গায় লগইন করলে বাকি অন্য অ্যাপে বা সাইটে লগইন করা যায়।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত