এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • তেলেনিপাড়া তথ্যানুসন্ধান, ২০২০ - পর্ব ৩

    আমরা এক সচেতন প্রয়াস
    ধারাবাহিক | সমাজ | ২৮ নভেম্বর ২০২০ | ২৮৫৬ বার পঠিত
  • ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিগত চার বছরে রামনবমী উত্তর পর্বে সাম্প্রদায়িক হিংসার স্বরূপ বুঝতে বিভিন্ন জনপদে তথ্যায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮-২০২০ এই তিন বছর আমরা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভাটপাড়ায় ক্ষেত্র গবেষণা চালিয়েছি, ইতিমধ্যে তার প্রতিবেদন প্রকাশিত। সেই ধারাবাহিকতায় তেলেনিপাড়া হল দ্বিতীয় প্রতিবেদন।


    দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-১


    শাস্ত্রী হিন্দি হাই স্কুল, গোন্দলপাড়া

    তেলেনিপাড়া ও গোন্দলপাড়া পাশাপাশি দুটি জনপদ। গোন্দলপাড়াতে এই হিন্দি মিডিয়াম স্কুলটি। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা এখানে আশ্রয় নেয়। সবমিলিয়ে ২৫ টি পরিবার তখন ছিলেন। ৩ জুন, ২০২৯০ তারিখে আমরা যখন পৌঁছয় তখন সকাল ১১ টা। ক্যাম্পে তখন কয়েকজন মহিলা। বাকিরা বাড়িতে। পুরুষরাও বাড়িতে, যেহেতু পৌরসভার অর্থে মেরামতির কাজ চলছে। মেরামতির জায়গায় এবং শাস্ত্রী স্কুলে আমাদের দেখা হয় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি ওয়ার্ড কমিশনার পান্নালাল সাহুর সঙ্গে। পৌরসভার অর্থেই এই মেরামতির কাজ চলছে, তিনি জানান। রাজ্য সরকারের প্রদেয় ত্রাণ এই শিবিরে দেওয়া হচ্ছে, তিনি জানান। তবে সরকার এই শিবির বেশি দিন চালাবে না তাও জানান। কেন তা মনে হচ্ছে, জানতে চাইলে উনি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসেন। উনি এর বেশি কিছু বলতে চাননি।

    মুসলিম পাড়া, কালি মন্দির ইত্যাদি স্থান থেকে দাঙ্গাপীড়িতরা এখানে আসেন। মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা বছর ষাটের সাবিত্রী দেবী বলেন,

    সাবিত্রী- এই স্কুলে এসে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। না হলে মুসলমানরা আমাদের যে কি করতো?
    আমরা- হঠাৎ এই রকম হলো না আগে থাকতে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন?
    সাবিত্রী- না, বেটা। আগে কখনও এইরকম হয়নি।
    আমরা- কেন হলো?
    সাবিত্রী- ওরা আমাদের তাড়াতে চাইছে।
    আমরা- কেন?
    সাবিত্রী- আমাদের অনেকে ভাড়া ঘরে থাকে, তাড়াতে পারলে মুসলিম ভাড়াটে রাখতে পারবে। বা...।
    আমরা- বা?
    সাবিত্রী- বড় মকান বানাতে পারবে।

    উল্লেখ্য, ‘আমরা’ তথ্যানুসন্ধান দলের মহিলা সদস্যা এখানের (এবং পরবর্তী দিনে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলের)মহিলাদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। মহিলারা অন্তর্বাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পরিধানের সমস্যার কথা জানান। ১১ জুন দুটি স্কুলেই মহিলাদের হাতে উক্ত দ্রব্যগুলি দেওয়া হয়। সঙ্গে আশ্রয় শিবিরে থাকা শিশুদের জন্য খেলনা।

    দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-২


    ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুল, তেলেনিপাড়া, ভদ্রেশ্বর

    ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পরিবারগুলো আশ্রয় নেয়। গত ৩ জুন, ২০২৯০ তারিখে আমরা প্রথমবার তাঁদের সঙ্গে মিলিত হই। ইস্কুলের এক ক্লাস রুমে আমাদের কথাবার্তা হয় দাঙ্গাদুর্গতদের সঙ্গে। সকলের নাম আমরা জানতে চাইনি, যারা নিজে থেকে নাম বলেছিলেন এবং প্রকাশিতব্য রিপোর্টে তাঁদের নাম রাখতে আপত্তি নেই জানিয়েছিলেন তাঁদের নাম এখানে রাখা হল। অন্যরা ‘জনৈক ব্যক্তি’ হিসাবে এই আলোচনায় থাকছেন। এখানে সেই কথোপকথনের নির্যাস।

    সেলিম খান- আমি গোন্দালপাড়া জুট মিলে কাজ করি। মিল বন্ধ আছে ২ বছর ধরে।এইখানে গোন্দালপাড়া গড়ের ধারের ৬১ টা পরিবার আছে, আর নেহেরু স্কুল এলাকার ১২ টা ফ্যামিলি আছে, এফ জি স্ট্রিট-এর ফ্যামিলি আছে, আগওয়াতলা’র ফ্যামিলি আছে, টোটাল লোক এখানে আছে ৩৫০ জন। সব থেকে বেশি লোক গোন্দালপাড়া গড়ের ধার এর লোক, ২৫০ জনের বেশি লোক আছে ওখানের। সব ঘর পুড়ে গেছে, সেই জন্য সরকার আমাদের এই ক্যাম্প এ জায়গা দিয়েছে, এই ক্যাম্প এ আছি, সরকার এর কাছে আমাদের একটা নিবেদন আছে যে আমাদের ঘর তৈরি করে দেওয়া হোক। প্রাণ ছাড়া সব কিছু, সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে।
    আমরা- ক্যাম্প এ কবে এসেছেন আপনারা?
    সেলিম খান- যেই দিন ঘটনা টা ঘটেছে, তার ২ দিন পরে এসেছি আমরা।
    আমরা- ঘটনা টা ঘটেছে কবে?
    সেলিম খান- ১২ জুন, ২০২০।
    আমরা- সময়টা যদি বলেন।
    সেলিম খান- ওই ধরুন দুপুর ১২ টা ৩০।
    আমরা- একটু যদি ১২ তারিখের দুপুর ১২ টা ৩০-এর ঘটনাটা একটু আমাদের বলেন।
    সেলিম খান- হঠাৎ সব আগে তো ১০ জুনে কিছু অল্প রাত্রির বেলায় ৮ টার সময়, ইট, পাথর চালিয়ে ছিল মোড়ের মাথায়, তখন আমরা সব ঘরেই ছিলাম, রোজা চলছিল আমরা বাড়িতে সবাই নামাজ পড়ছিলাম, হটাৎ দেখছি বোমা ফাটছে, ইট পাথর ছুড়ছে, অবাক হয়ে গেলুম, লোক সব পালাচ্ছে। তারপর সেদিনের ঘটনার পর শান্তি হয়ে গেল, ১১ তারিখও শান্তি ছিল। সেই সব লোক এইদিক ঐদিক চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে ফিরে বাস করছিল। তারপর ১২ তারিখ ১২ টার সময় হঠাৎ চারদিক থেকে ঘিরে বোমা পড়তে লাগলো; ইট, পাথর আমাদের বাড়ির ওপর পড়তে লাগলো, আমাদের তো হাতে...কিছুই ছিল...না, আমরা তো কোনোদিনও ঝুট ঝামেলা করিনি আজ পর্যন্ত, রেকর্ড আছে আমাদের। এখানে আপনারা জিজ্ঞেস করে নেবেন, গড়ের ধার-এ (যেখানে উনি থাকেন) আজ পর্যন্ত কোনো ঝুট ঝামেলার লোক নেই। হঠাৎ চারদিক থেকে বোমা ছোড়াছুড়ি। ওই কোম্পানির গ্রাউন্ডে হাজারে হাজারে লোক, বোম নিয়ে, পিস্তল সব নিয়ে আমাদের ঘরের ওপর, যখন বোমা মেরেছে, আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে সব এইদিকে চলে আসি। বাড়িঘর সব ফাঁকা হয়ে যেতেই, সব পেট্রোল ছিটিয়ে ঘর পুড়িয়ে দিলো, কিছু বাঁচেনি আমাদের।
    আমরা- এই ঘটনা কতক্ষণ ধরে হয়েছিল?
    সেলিম খান- টানা ৮ ঘণ্টা ধরে এই লুঠ, আগুন লাগানো চলেছিল সারা তেলেনিপাড়া জুড়ে। প্রশাসন পুলিশ কেউ আসেনি।
    আমরা- সাহায্য চেয়ে আপনারা নিশ্চয়ই ফোন করেছিলেন প্রশাসনকে?
    সমস্বরে- অনেক ফোন করা হয়েছিল, সব জায়গা থেকে ফোন করা হয়েছে যে ঘটনা তা ঘটছে আসুন, তাও আসেনি।
    আমরা- আসেনি কেন? কি বলছিল পুলিশ?
    সেলিম খান- শুধু বলছিল আসছি, আসছি! প্রায় ৪ ঘন্টার পর পুলিশ এসেছিল, তারপর মোটামুটি একটু কন্ট্রোল হলো।
    আলি- ব্যারাকপুরের এমপি অর্জুন সিংহকে দেখা গেছে আমাদের হুগলি জেলায়, উনি লকেট চ্যাটার্জির সঙ্গে মিলে যত বাইরের লোক ঢুকিয়েছেন। অর্জুন সিংহ ছাড়া কেউ করতে পারবে না, একটা দুটো লোক ছাড়া বেশি ভাগ বাইরের লোক, একদম নতুন চেহারা, আমরা চিনি না তাদের...। আর এই বিকেল ৪ থেকে ৪:৩০ ঘন্টার মধ্যে আমরা অনেকবার পুলিশকে ইনফর্ম করেছি, পুলিশ বলতে পারবে না যে আমরা করিনি, পুলিশ আসতে পারেনি, এটাও...হতে পারে পুলিশ কন্ট্রোল করতে পারেনি, তারপর যখন ফোর্স এলো ৪ টে নাগাদ তখন একটু ঝামেলা শান্ত হলো।
    আমরা- আপনি কি এখন এই হাইস্কুলেই থাকছেন? মানে, আপনি ও আপনার পরিবার?
    আলি- হাঁ এখানেই থাকি, আমারও বাড়ি গড়ের ধারেই।
    জনৈক ব্যক্তি- সব একই পাড়া থেকে এসেছি, সব ঘর জ্বলে গেছে তো ! কোথায় থাকবো আমরা? তাই ডি এম সাহেব এবং কিছু সংস্থা মিলে এইখানে রিলিফ ক্যাম্পের মত অর্গানাইজ করে রেখেছে।
    আমরা- খরচ সরকার বহন করছে?
    আলি- হ্যাঁ।
    আমরা- সরকার মানে স্থানীয় সরকার, ভদ্রেশ্বর মিউনিসিপ্যালিটি, তাই তো?
    সেলিম খান- হ্যাঁ, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে। আমাদের দুই বেলার খাবার দাবার মিউনিসিপ্যালিটির মারফতেই চলছে, ডি এম সাহেবের অর্ডারে এই কাজ হচ্ছে।
    আমরা- আচ্ছা, সেলিম ভাই এই যে আপনারা এত গুলো পরিবার এখানে এসেছেন, তেলেনিপাড়ার কোন কোন এলাকা থেকে আপনারা এসেছেন? কতজন এসেছেন, পরিবার হিসাবে কটা পরিবার বা মোট কতজন মানুষ? সরকার থেকে যখন রিলিফ দেওয়া হচ্ছে তখন তালিকা তো থাকবে? নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকবে। প্রথমে আপনারা বলেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট তালিকা কিভাবে পাবো?
    সেলিম খান- হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আপনাকে তালিকা এই স্কুল কর্তৃপক্ষও দিয়ে দেবে।
    আমরা- আমরা জানি যে তেলেনিপাড়া হোক বা পাশের চাঁপদানি বহুবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, হিংসা দেখেছে। আপনাদের সকলের কাছেই জানতে চাইছি এবারের আর আগেরবারের মধ্যে পার্থক্য কি বা ফারাক কোথায় ?
    সেলিম খান- অনেক ফারাক। আমরা কোনো দিন ভাবিনি যে এরম হঠাৎ ঘটনা ঘটবে, আমরা তো সব নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নামাজ পড়ছি বা অন্য কিছু করছি। লকডাউনে সব লোক ঘরের ভিতরে আছে। হঠাৎ! কি করে হয়ে গেল, কেউ ভাবতে পারিনি। ওরা আমাদের যত ঘর ছিল জ্বালিয়ে দিলো। এতটা কোনোদিন হয়নি এখানে।
    জনৈক ব্যক্তি- আমাদের ছেলে আর মেয়েদের সব ডকুমেন্টস পুড়ে গেছে। যত বছর আমরা পড়াশোনা করেছি সব , আমি ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পাস করেছি, ১৯৯৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক। আমার সব ডকুমেন্টস বাড়ি সমেত পুড়ে গেছে, একটা জিনিসও বাঁচে নি।
    আমরা- আপনারা এই ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কি প্রশাসনকে জানিয়েছেন ? ওনারা কি কোনো কাজ আরম্ভ করেছে?
    সেলিম খান- কাজ আরম্ভ হয়েছিল মোটামুটি ১০-১২ দিন কাজ হলো, এখন কাজ বন্ধ আছে। কর্পোরেশনে মনে হয় কিছু হয়েছে কি না জানি না, আমরা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
    আমরা- আপনারা যে থাকেন আপনাদের কি নিজেদের বাড়ি ? নাকি কেউ কেউ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
    সেলিম খান- সব নিজেদের বাড়ি, কিছু ভাড়াটিয়া আছে , কিন্তু আমাদের নিজেদের বাড়ি, আমরা বাড়িওয়ালা।
    আমরা- আর আপনারা যারা জুট মিলে কাজ করেন তারা তো অনেকেই লাইনে (শ্রমিক কলোনি) থাকেন ।
    সেলিম খান- না না আমাদের ম্যাক্সিমাম মানুষ এইখানেই থাকে। আমরা কিছু গোন্দালপাড়া জুট মিলে কাজ করি আর কিছু লোক তেলিনিপাড়া জুট মিলে কাজ করি। বেশিরভাগ মানুষের গড়ের ধারেই বাড়ি। ( সেলিম খান )
    আলি- কিছু বাইরেও কাজ করে ।
    জনৈক ব্যক্তি- যাদের এখানে বাড়ি নেই তারা কোয়ার্টারে থাকে, আর যাদের বাড়ি আছে তারা এখানে মিলে কাজ করে যদিও নিজের বাড়িতে থাকে।
    আমরা- আপনাদের কি আশঙ্কা, যে আবার হতে পারে? নাকি এই অশান্তি সাময়িক?
    জনৈক ব্যক্তি- আমরা খুবই আতঙ্কিত, মানে কখন কি হবে ভেবে আমরা খুবই আতঙ্কিত।

    দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-৩


    হাজি মোহম্মদ মহসিন উর্দু প্রাইমারি স্কুল (বালিকা), পাইকপাড়া, ভদ্রেশ্বর

    এখানে দুটি প্রাইমারি স্কুল আছে, সমাজ সংস্কারক হাজি মোহম্মদ মহসিনের নামে, একটি বালকদের জন্য, অন্যটি বালিকাদের জন্য। উর্দু মিডিয়াম। বালিকাদের স্কুলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম মহিলারা ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে, বালকদের স্কুলে পুরুষরা। গত ১০ এবং ১৭ জুন আমরা যখন সেখানে যাই তখন পুরুষরা অনেকেই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। আমরা কথা বলি বালিকা বিদ্যালয়ে, মহিলাদের সঙ্গে। তখন স্কুলে নির্মাণের কাজ হচ্ছিল। চারিদিকে বালি, সিমেন্ট। বাচ্চা ও মহিলারা তার মধ্যেই ছিল। অপরিস্কার।

    হালিমা বিবি (নাম পরিবর্তিত) বছর ৩৫-এর, সঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা, ইস্কুলের দোতলার ঘরে তখন রান্না হচ্ছিল। জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতা।

    হালিমা- হঠাৎ ওরা (হিন্দুরা) আমাদের পাড়া আক্রমণ করলো।
    আমরা- কবে?
    হালিমা- (পাশে দাঁড়ানো স্বামীকে তারিখ জিজ্ঞেস করে) ১২ মে, সন্ধ্যের সময়।
    আমরা- তারপর কি হলো?
    হালিমা- হাতে তলোয়ার নিয়ে একদল এলো। আমাদের লাইনে।
    আমরা- সেটা কোথায়?
    হালিমা- ৯ নম্বর লাইন। ওরা ১০ নম্বর লাইনেও আক্রমণ চালায়। চিৎকার চেঁচামেচি, বোম পড়লো।
    আমরা- আপনার বাচ্চা (বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে) ওরা কোথায় ছিল?
    হালিমা- ওরা ঘরেই ছিল। আমরা প্রাণভয়ে ঘরের মধ্যে। রাত্রেই এখানে এই স্কুলে চলে আসি। এখনও বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে থাকে।
    আমরা- শিশু মনে ক্ষত থেকে যায়, কিভাবে ভোলান?
    হালিমা’র স্বামী- আমরা’ই ভুলতে পারছি না, ওদের কিভাবে ভোলাবো?

    (৩) যারা আগুন লাগালো


    (ক) ভাটপাড়া-তেলেনিপাড়া আঁতাত

    গঙ্গার ওপার থেকে অর্থাৎ ভাটপাড়া থেকে দাঙ্গাবাজদের আনা হয়েছে ১১ মে রাত্রের অন্ধকারে, এসেছে নৌকোয় চেপে, কয়েকটি বাড়িতে রাখা হয়েছে, ১২ মে তারা দাঙ্গা চালিয়েছে- এইরকম খবর তেলেনিপাড়ায় শোনা গেছে। বিশেষ সূত্রে আমরা কয়েকটি ভিডিও (এর সত্যতা আমরা যাচাই করিনি), ছবি পেয়েছি। আমাদের নিজস্ব তদন্তে যা জানতে পেরেছি-
    ভাটপাড়ার কয়েকটি আঘাটা ব্যবহার করেছিল অর্জুন সিংহের বাহিনী। ভাটপাড়া পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত আতপুর ফেরিঘাট (ইন্ডিয়া জুটমিল ঘাট)ও তারা ব্যবহার করেছিল বলে জানা যাচ্ছে। রাত্রে ২টো থেকে ৩টে ছিল তাদের পারাপারের সময়। আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা ছিল যথেষ্ট তবে তলোয়ার ছিল বেশি। মোট ৮ থেকে ১০ টি নৌকো বা ট্রিপ ব্যবহার করা হয়।

    ভাটপাড়ায় ঘাট সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন প্রতক্ষ্যদর্শী জানাচ্ছেন, ৮ থেকে ১০ জন যুবকের দল যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির একজন জানলা থেকে উঁকি মারলে বলা হয়, ‘ভিতরে রহিয়ে’, আধা বাংলা-আধা হিন্দি শব্দ।

    তেলেনিপাড়ায় আমরা একটি বাড়ি চিহ্নিত করি যেখানে কথিত দাঙ্গাবাজরা রাত্রে ছিল। বাড়িটি নদী সংলগ্ন। তেলেনিপাড়ার হিন্দুরা এই বিষয়ে মুখ খুলতে চায়নি। একজন মুসলিম মহিলা নির্দিষ্টভাবে বাড়িটির প্রসঙ্গ তোলেন। বাড়িটি......।

    (খ) স্থানীয় বিজেপি ও আর এস এস নেতৃত্ব

    গোপাল চন্দ্র উপাধ্যায়, এই এলাকার আর এস এস-এর পরিচিত মুখ। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ আমরা ওনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। ওনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে ওনার সময় চাওয়া হয়। উনি সময় দিয়েও, পরে জানান উনি ‘বিজেপি’তে যোগদান করেছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ জনসংযোগের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। এর পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও উনি ফোন তোলেন না। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

    ফিরোজ খান, কাউন্সিলর, তৃণমূল কংগ্রেস

    তেলেনিপাড়া দাঙ্গার তথ্যানুসন্ধান পর্বের প্রথম দিন থেকেই আমরা ফিরোজ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু অসফল থাকি। ওনার ফোন ‘সুইচ অফ’ বলে, একনাগাড়ে। শেষপর্যন্ত গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ আমরা ওনার সঙ্গে কথা বলি। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ওনার কথিত অফিসে বসে কথা বলতে পারি। দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তার প্রতি। ছিল মোবাইলে মোবাইলে ঘুরতে থাকা উস্কানির ভিডিও।

    ফিরোজ- ১০ মে যা হয়েছিল, তা ‘ঘটনা’ ছিল, কিন্তু পরে যেটা হলো সেটা অর্গানাইজড ছিল। করোনা নিয়ে হয়েছিল প্রথম ঘটনা।
    আমরা- আমরা শুনছিলাম অনেক দোকান বিশেষত মুসলিমরা আক্রান্ত হয়েছে?
    ফিরোজ- না না দেখুন, কমবেশি দুই পক্ষেই লোকসান হয়েছে। আমি মুসলমান বলে বলবো মুসলমানদের লোকসান হয়েছে তা নয়। হিন্দুদের ক্ষতি হয়নি তা নয়। ঝামেলা হলে কারও বেশি কারও কম হয়।
    আমরা- ১০ মে’তে যা হয়েছিল তা ঘটনা ছিল বলছেন কেন?
    ফিরোজ- দেখুন এখানে করোনার চেক আপ হয়। তিনজনের পজিটিভ বেরোয়। তিনজনেই মুসলমান। একজন ইমরান, একজন নাজির, আর এক জন কাউন্সিলরের হাসবেন্ড। কাউন্সিলর হলেন রেশমা খাতুন। চারিদিকে মুসলমানদের করোনা হয়েছে বলে প্রচার হতে থাকলো। হিন্দুরা কমন জায়গা থেকে মুসলমানদের জল আনতে বাধা দিল। একজন মহিলা প্যাকেট বিক্রি করছিল তাকে বলল মুসলিম পাড়ায় যাওয়া যাবে না। রোজার মাস, ইফতার চলছিল। ইফতারের সময় আমরা সবাই ব্যস্ত থাকি জানেন, সেই সময় অর্জুন সিং বলে একজন এবং আরও কয়েকজন বাঁশের ব্যারিকেড দিতে থাকলো। এর ফলে উত্তেজনা হলো, ১০ তারিখের ঘটনা হলো।
    আমরা- হিন্দুদের দোকান আক্রান্ত হলো?
    ফিরোজ- দেখুন আমি মাইনরিটির মধ্যে আছি। আমার নাম হয়েছে। যার নাম হয়, তার বদনামও হয়। যেমন বিদ্যাসাগরের। ওনাকে একবার কেউ বলে, ওই পাড়ার লোক আপনার খুব বদনাম করছে। উনি উত্তর দেন, ওই পাড়ায় তো আমি কোন কাজ করিনি, কাজ না করলে বদনাম কি করে হবে?
    আমরা- মিলের কোন শ্রমিকের কি করোনা পজিটিভ এসেছিল?
    ফিরোজ- হ্যাঁ, হয়েছিল। মিল মালিকরা তাদের ১৪ দিন আসতে মানা করেছিল।
    এই সময়ে একজন আসেন, যার বাড়ির ঢালাই হয়েছে বলে কাউন্সিলরকে মিষ্টির প্যাকেট দিতে। ফিরোজ খান বলেন, এই দেখুন আমি ঘুষ খাই না, ওর কিছু ফাইন হয়, আমি মুকুব করে দিই তাই ও মিষ্টি খাওয়াতে এসেছে।
    আমরা- বাঃ, বেশ ভালোই তো! আপনার তো বেশ জনপ্রিয়তা আছে দেখছি, তো সেই যে বদনামের কথা বলছিলেন, কিভাবে তা হলো?
    ফিরোজ- ঘটনার তিনদিন আগে (১০ মে, ২০২০), পাইকপাড়ার কথা। ওখানে মুসলিম কম আছে। ওখানে বিহারী হিন্দুরা ফাঁড়ি ঘেরাও করেছিল, বলছিল পাবলিক টয়লেট মুসলিমদের ব্যবহার করতে দেবো না। সেখানে আমি পৌঁছালে আমাকে একজন হাত দিয়ে আটকে দেয়। আমি তখন সেন্টিমেন্টে নিয়ে নিই, আমি উল্টোপাল্টা বলেছিলাম, আমি বলি, এখানে আমরা কম আছি, এখানে আটকাচ্ছিস, যেখানে আমরা বেশি আছি সেখানে তোদের যেতে দেবো না। এখানে এইসব ঝামেলা করছিস, ওখানে বড় ঝামেলায় পড়বি, এটা আমি বলি। এইটাই মোবাইলে ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রচার হয়ে গেলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে খালি করিয়ে দেবো, এটা করিয়ে দিল।
    আমরা- এটা আপনি বলেন নি?
    ফিরোজ- ওই যে মোবাইলে বানিয়ে দিল।
    আমরা- কিন্তু এই বিষয়ে আপনার বয়ান ভিডিওতে অনেকেই দেখেছে।
    উত্তরে উনি নিশ্চুপ থাকেন।
    আমরা- আপনি যা বলছেন বলে স্বীকার করছেন, তাও তো বেশ আক্রমণাত্মক।

    এবারেও উনি কোন উত্তর দেন না।

    আমরা- একজন কাউন্সিলর হিসাবে বা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে কি মনে হয় আবার কি এইরকম উত্তেজনা, হিংসা হতে পারে?
    ফিরোজ- ২০২১ সাল পর্যন্ত এইরকম হবে। আমি দুবার কাউন্সিলর হয়েছি, প্রথমবার কংগ্রেস থেকে, এখন তৃণমূলে। ২০২১ পর্যন্ত সারা পশ্চিমবঙ্গেই এইরকম হতে থাকবে, এই যা তেলিনিপাড়ার দাঙ্গা নিয়ে একটা বদনাম হয়ে গেলো। যেখানে বিহারী, উত্তর ভারতীয়রা আছে, যেমন এই তেলেনিপাড়া, চাঁপদানি, নৈহাটির ওখানে হাজিনগর, ভাটপাড়া এইসব জায়গায় হতেই থাকবে। এখন দেখলে বুঝতে পারবেন না। ওপরে ছাই আছে, ভিতরে আগুন। দেখুন, আমি স্পষ্টভাবে একটা কথা বলছি, যে কোন সময় আবার আগুন জ্বলে উঠবে।
    আমরা- তেলেনিপাড়ার এই দাঙ্গায় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানরাও যুক্ত ছিল, যারা আবার তৃণমূলের সমর্থকও। এই বিষয়ে কিছু বলুন।
    ফিরোজ- দেখুন, প্রথম দিন যে ঝামেলা হয়েছিল সেটা এক্সিডেন্ট ছিল। দ্বিতীয় দিনেরটা পরিকল্পিত।
    আমরা- এফ আই আর হয়েছে নিশ্চয়ই, স্থানীয় মানুষজনের নাম এসেছে?
    ফিরোজ- আমার নাম আসেনি। ৫০ জনের মত মানুষের নাম এসেছে। ৫ জন ঝামেলা করেছে, তো হাজার জনকে পরেশানি করেছে।
    আমরা- কেন এমন হচ্ছে? অনেক নিরপরাধ মানুষ, মহিলাদের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, আমরা শুনেছি।
    ফিরোজ- পুলিশ এইরকম করছে। কি করবো বলুন?
    আমরা- পুলিশ তো আপনার সরকারের অধীন?
    ফিরোজ- দেখুন ওরা বদলে গেছে। ঘরের লোক যখন বদলে যায় না, যেমন অর্জুন সিং, এতদিন তৃণমূলে ছিল, ও তো দলের হালহকিকত সব জানে।
    আমরা- অর্জুন সিং যখন তৃণমূলে ছিল তখনও তো দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
    ফিরোজ- দেখুন এই ঘরে আমরা ২০ জন আছি, ১ জন বেরিয়ে গেলো, সে তো জেনে গেলো কে কোথায় আছে। প্রথমে মুকুল রায় গেলো, ও তো ছিল গ্রাস লেভেলের নেতা। তেমনই শুভেন্দু অধিকারী।
    আমরা- যাচ্ছেন নাকি বিজেপিতে? প্রতিদিনই তো ‘খবর’ হচ্ছে।
    ফিরোজ- হ্যাঁ ওকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
    আমরা- সেতো সৌরভ গাঙ্গুলির কথাও ভেসে আসছে।
    ফিরোজ- শুভেন্দুর কথা আলাদা ওর জনভিত্তি আছে।
    আমরা- আপনি বলছিলেন, প্রথম দিন যা হয়েছে তা এক্সিডেন্ট।
    ফিরোজ- হ্যাঁ তাই তো।
    আমরা- সেইদিন কাদের দোকান ভাঙচুর হয়?
    ফিরোজ- হিন্দুদের। একদম ১০০ % ওদেরই। দেখুন, আমি মিথ্যা কথা বলিনা।
    আমরা- সংঘর্ষ কি মুখোমুখি হয়েছিল?
    ফিরোজ- না। বিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
    আমরা- আর এর জন্যই আপনার বদনাম, তাই তো?
    ফিরোজ- হ্যাঁ।
    আমরা- পার্টি আপনার কাছে কিছু জানতে চায়নি?

    কিছুক্ষণ চুপ থেকে।

    ফিরোজ- হ্যাঁ, আমরা কথা বলে নিয়েছি।

    যাদের হাতে জল ছিল



    পাইকপাড়ার অদূরে গোয়ালা বস্তি। ৫০-৬০ ঘর যাদব, মূলত বিহার থেকে আসা গরু ও মহিষ পালন ও দুগ্ধ ব্যবসায়ে সঙ্গে যুক্ত এঁরা। দাঙ্গার কালো আগুনে যখন অন্ধকার চারিদিক ঠিক সেই সময় ‘জল’ হাতে দাঁড়িয়েছিলেন এঁরা। মুসলমান পরিবারগুলির পাশে থেকে দাঙ্গাবাজদের ঠেকিয়েছেন, সদর্পে। আমরা কথা বলি এনাদের সঙ্গে, খাটালে। কৃষ্ণ কুমার যাদব, বছর ৫৫-র, নির্মেদ শরীর, ঋজু কণ্ঠস্বর। ছিলেন মুকেশ রাই (৬০ বছর), দিলীপ যাদব (৪১ বছর)।

    কৃষ্ণ- ৪০-৫০ বছর ধরে আমরা এখানে আছি। সবার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। চাচা ভাতিজা, ভাই দাদার মতো সম্পর্ক। আমাদের সুখ দুঃখের সঙ্গে ওরা জড়িয়ে আছে। ওদেরও সুখ দুঃখের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে আছি। আমাদের কোন সমস্যা হলে ওরা এগিয়ে আসে। ওদের ক্ষেত্রে আমরা। অনেকদিন পাশাপাশি থাকলে এমনই হয়।
    আমরা- ১২ মে, ২০২০ হিন্দু দাঙ্গাবাজরা এদিকে এসেছিল, মুসলিম পাড়া আক্রমণ করতে। এমনিতেই হাজি মুহম্মদ মহসিন স্কুলে অনেক ঘর ছাড়া মুসলমান পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল, এখনও আছে। সেইদিনের ঘটনা আমাদের বলুন।
    কৃষ্ণ- অনেক লোক এসেছিল। সব অস্ত্র নিয়ে। আমরা যাদবরা এখানে রুখে দাঁড়াই। ওদের ঢুকতে দিইনি।
    আমরা- কতজন আছেন আপনারা?
    কৃষ্ণ- আছে প্রায় ৫০-৬০ টি পরিবার। অনেকে দেশে আছে, লকডাউনের জন্য আসতে পারেনি। প্রায় ১৫০ জন মানুষের বসবাস। আমরা আমাদের পাড়ার মুসলিমদের জিম্মায় রেখে দিয়েছিলাম। এহি বাত হ্যায়। এই রাজ্যে প্রায় ১০০ বছর ধরে আমরা আছি, যাদবরা। আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার সময় থেকে। আমি নিজে, ১৯৬৫ থেকে এখানে।
    আমরা- এর আগে এইরকম দাঙ্গা কি হয়েছিল। আপনাদের অভিজ্ঞতা কি বলে?
    কৃষ্ণ- এত বড় দাঙ্গা কখনও হয়নি। আমাদের বাবাদের আমলে টুকটাক কিছু ঘটনা হয়। আমার বাবা ও তার বন্ধুরা সে সময় সেগুলো রুখে দিয়েছিলেন। জাত ধর্মের ভেদাভেদ আমাদের কাছে কখনও ফ্যাক্টর ছিল না, এখনও নয়। মানবতাই আমাদের মূল কথা। আমাদের অনেকের জন্ম, বড় হওয়া এখানে। আমার জন্ম হয়ত এখানে নয়। কিন্তু পড়াশোনা, বড় হওয়া সবই তো এখানে। আমার মুসলিম বন্ধু নেই? আছে। থাকাটাই তো স্বাভাবিক। সব মানুষ একরকম হয়না। আমরা কৃষ্ণের সাথী, প্রেম ও সদ্ভাবে বিশ্বাসী।
    আমরা- আবার যদি এইরকম হয়?’
    কৃষ্ণ- আমরা রুখবই।
    মুকেশ- আবারও রুখবো। আমাদের না জানা থাকলে, হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে অন্য কথা। কিন্তু আমাদের জ্ঞাতসারে এখানে দাঙ্গা হবার নেই। সবার জানের দাম আছে, সবার বালবাচ্চা আছে।

    এই কথোপকথনের শেষে আমরা পার্শ্ববর্তী মুসলিম মহল্লায় যাই, শেখ আজমল (৩০ বছর) আমাদের নিয়ে যান এক অশ্বত্থ গাছের নিচে। খাটিয়ায় তাঁদের বাৎচিত চলছিল। কথা হয় বয়স্ক কয়েকজন মুসলিম মুরুব্বীর সাথে। সেই কথার সংক্ষিপ্ত রূপ-

    ‘মসিহা হ্যায় ইয়ে লোগ। আমাদের বাঁচিয়েছে। আমাদের মহিলাদের ইজ্জত বাঁচিয়েছে। আমাদের বাচ্চাদের শৈশব। আমাদের চাচা বলে কৃষ্ণ, ওর বাপের বন্ধু ছিলাম আমরা। আমাদের বাঁচিয়েছে বলে আমার বন্ধু ওই আকাশ থেকে ওকে, আর অন্য যাদবদের দোয়া করবে।’

    আমরা- কিন্তু আজমল (আজমলকে) এই সংবাদ তো ব্রাত্য থেকেছে, শুধু হিংসা আর আগুনের কথাই আমরা জেনেছি।
    আজমল- হ্যাঁ, বাস্তবিক এখানে কোন পার্টিই কিছু করেনি। করেনি পুলিশ। অনেক জায়গায় যাদবরা দাঙ্গায় হয়তো যোগ দিয়ে থাকবে, কিন্তু এখানের চিত্র আলাদা।
    আমরা- কেন?
    আজমল- আমি ওই কৃষ্ণকে বড়ে ভাইয়া বলি, বড় দাদাই হচ্ছে সে আমার। বিপদে আপদে একে অন্যের কাছে ছুটে যাই। এখানের তৃণমূলের মুসলিম নেতার ভূমিকা ঠিক নয়। এখন অনেকে মুসলিমদের পাশে আছি, এটা দেখাতে চাইছে। উস্কানিও আছে।
    আমরা- আর?
    আজমল- আর এস এস তো আছেই, এতো পরিকল্পিত আক্রমণ হলো, ওরা ছাড়া কিভাবে হবে?
    আমরা- কিন্তু অন্য পাড়াতেও তে এইরকম একসাথে থাকার বহু স্মৃতি, বহু গল্প আছে। সেখানে ফাটল হলো কেন?
    বয়স্ক একজন- বাত কৃষ্ণ অউর নবীকা নেহি হ্যায় বেটা, বাত দুসরা হ্যায়।
    আমরা- বাত ক্যা হ্যায় নানা?
    বয়স্ক অন্যজন- বাত কুর্সি কা হ্যায়।

    সকলে একসাথে হেসে উঠলেন। সে হাসিতে বিকেলের রোদ এসে থেমেছিল।

    (ক্রমশ…পরের পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার)




    থাম্বনেল গ্রাফিক্স: স্মিতা দাশগুপ্ত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৮ নভেম্বর ২০২০ | ২৮৫৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    নবীন - Suvasri Roy
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.196.12 | ২৯ নভেম্বর ২০২০ ১৯:৪৯100755
  • শেষটা পড়ে ভালো লাগলো। এখনো এই দেশে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। 

  • Govind | 2409:4052:2408:61bd:772a:f62d:c190:8ab7 | ০১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৮:৩৩100829
  • নাইস পোস্ট  https://www.missiongovtexam.com

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন