বাঙালি প্রশ্নে তথাকথিত 'সর্বভারতীয়' ন্যারেটিভ কেমন?
ঘটনা এক।
এ বছরের গোড়ার দিকে মোদী এবং সুভাষ বসুকে নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধন যা লিখেছিলেন, বঙ্গানুবাদে তা এরকমঃ "মোদী এবং আরএসএস কেন সুভাষ বসুকে ভালোবাসে, ভালো করে বুঝে নিন! সুভাষ যখন হিটলারের সঙ্গে নীতিগত বোঝাপড়ায়, তখন আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা তার সঙ্গে আদর্শগত বোঝাপড়া করে ফেলেছে। হিটলারের আশীর্বাদ নিয়ে সুভাষ আজাদ-হিন্দ-ফৌজে যাদের নিয়োগ করেন, তাদের বেশিরভাগটাই সেইসমস্ত ভারতীয় সেনাদের থেকে, যারা জার্মান, ইতালিয়ান, এবং জাপানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। হ্যাঁ, তাদের অনেকেই নাৎসিদের পক্ষে যুদ্ধ করে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আরও, আরও অনেক বেশি ভারতীয় সৈন্য মারা যায় নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।"
এতে তথ্য এবং বোঝাপড়াগত কিছু ভুল আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, এই লাইনে বললে, তার ফলাফল কী হবে। আজাদ-হিন্দ-ফৌজ নাৎসিদের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিল, সুভাষ-আরেসেসের একরকম করে বোঝাপড়া ছিল, এ কথা বললে, বঙ্গে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা নিঃসন্দেহে লাটে উঠবে। আর মোদীই "হুঁহু আমরাই বাবা প্রকৃত সুভাষপন্থী" বলে ক্ষীর খেয়ে বেরিয়ে যাবেন। কথাগুলো ঠিকও না, আমরা প্রতিনিয়ত বলি, সুভাষ কেমন বাটাম দিয়েছিলেন মহাসভাকে, সেটা বিশ্বাস করেই বলি। আনন্দবাবু ব্যাপারটা জানেন না, বা এড়িয়ে গেছেন, যাই হোক, এই ব্যাপারে তাঁর লাইন, বঙ্গীয় লাইন হতে পারেনা। হলে বিপর্যয় সমাসন্ন। প্রসঙ্গত, কাছাকাছি লাইন নিয়েই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভারত-ছাড়ো ইত্যাদির সময় যে জমি হারায়, তা খুব সম্ভবত কখনই আর ফেরত পায়নি। এমনকি লাইন বদলেও।
ঘটনা দুই।
২০১৯ সালে এন-আর-সি নিয়ে যখন প্রথম দফার হট্টগোল শুরু হয়েছে, তিস্তা শেতলবাদ, টেলিগ্রাফে একটা লেখায় তালিকা দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, এন-আর-সির কারণে ৫৮ জন শ্রমজীবি মানুষ মারা গেছেন আসামে। তার মধ্যে ২৮ জন হিন্দু, ২৭ জন মুসলমান, একজন বোড়ো, একজন গোর্খা, এবং একজন চা-উপজাতি। হিন্দু-মুসলমান-বোড়ো-গোর্খা-উপজাতি সবেরই হিসেব করেছিলেন, কেবল বাঙালি শব্দটা বাদ। অথচ আমরা সবাই জানি, বহু-বহুবার বলেছি, এন-আর-সি আস্ত বাঙালি জাতির পক্ষে চূড়ান্ত এক বিপদ। ধর্মনিরপেক্ষে।
ঘটনা তিন।
ওই বছরই, রবীশ কুমার আসেন কলকাতায়। বক্তৃতা দিতে। সেখানে তিনিও বাঙালি বাদ দিয়ে এন-আর-সিকে স্রেফ হিন্দু-মুসলমানে নামিয়ে আনেন। লম্বা বক্তৃতা। তার অংশবিশেষ এরকমঃ "বাংলার লোক, যা শুনি, যেন এখনই এক ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্ধ হয়ে গেছে, আর ক্যাম্পের দেয়ালে যা লেখা আছে, সেই ভাষাই বলতে শুরু করেছে। যখন আমাদের দেশের আদরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে, যারা হিন্দু, জৈন, শিখ, খ্রিষ্টান, তাদের এনআরসি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই, তখন তিনি একটা নাম বাদ দিয়ে যান। উনি বলতে পারতেন, যারা ভারতের মুসলমান, যারা এই দেশের মাটিতে জন্মেছে, খেলে বড় হয়েছে, এই মাটিতে শাহদত দিয়েছে, তাদের চিন্তা করার কারণ নেই। যারা বাংলাদেশের, তারা চিন্তা করতে পারে। ... আর আপনারা, পুরো বাংলা, বুঝতেই পারছেননা, এর প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেবেন, কারণ বাংলায় বিবেকের আকাল আসছে। আপনারা এই সংকটটা বুঝুন। আপনারা যদি দেখতে না পান, তার কারণ পরিষ্কার, আপনারা দেখতে চাননা। গান্ধী থাকলে এরকম হত? টেগোরের বাংলায় এরকম বলা সম্ভব ছিল, কেবল পাঁচটি ধর্মের লোকের চিন্তা করার কোনো কারণ নেই? ... মনে হয়, আপনারা কোনোদিন ইতিহাস পড়েননি, বা বই পড়েননি।"
এতেও নানারকম সমস্যা আছে। গোটা হিন্দু বাঙালি ইতিহাস বই পড়েনি, বা আস্ত বাংলা এন-আর-সির পক্ষে চলে গেছে, এসব তো নয়ই, বরং ফুঁসছে। এরপরই বড়বড় মিছিল হয় বাংলায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এন-আর-সি যে আস্ত বাঙালির সমস্যা, সেটা না আদৌ না বোঝা। স্রেফ হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নয়, সেটা না বোঝা। "বাংলাদেশী তাড়ালে ঠিক আছে" --এটা বলা মানে, সমস্ত বাঙালিই যে স্রেফ বাঙালি বলেই সন্দেহের তালিকায়, সেটাকে অস্বীকার করা। দেশভাগ থেকে শুরু করে উদ্বাস্তু হবার আস্ত ইতিহাসটাই ঘেঁটে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ করে মোদীর হাতে তাস তুলে দেওয়া। বস্তুত এরপর বাংলায় যে ভোট হয়, তার মূল মেরুকরণটা হিন্দু-মুসলমান লাইনে হয়নি, হয়েছিল বাঙালি-বহিরাগত লাইনে। অর্থাৎ রবীশ বা তিস্তার লাইন বাংলার ক্ষেত্রে ভুল ছিল, এটা আমরা সবাই জানি।
ঘটনা চার।
এই ২০২২ সালের শেষে পরেশ রাওয়াল গুজরাতে একটি মন্তব্য করেন, মাছ-খেকো বাঙালিদের নিয়ে। পরে বলেন, বাঙালি বলতে উনি রোহিঙ্গা বুঝিয়েছেন। বাঙালি-বাংলাদেশী-রোহিঙ্গা -- এসব যে ওঁদের কাছে একই, বাঙালি মাত্রেই সন্দেহযোগ্য, তার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয়না। ব্যাপারটা নতুনও না, অজানাও না, কৈলাশ বিজয়বর্গীও চিঁড়ে খাওয়া নিয়ে একই রকম কথা বলেছিলেন। বাঙালি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। মহম্মদ সেলিম তো এফআইআর করেন। এবং এই সময়েই 'ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা' মঞ্চ কলকাতায় একটি চলচ্চিত্রোৎসব করছিল। তার সূচিতে বাংলা সিনেমার অভাব, চোখে লাগার মতো। পরে উৎসবের প্রচারপত্র হাতে আসে, তাতে ফ্যাসিবাদের বিবরণে, বাঙালি শব্দটির উল্লেখমাত্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত নিয়ে একটি কথাও নেই। সংখ্যাগুরু, লঘু, নারী, শিক্ষা, নাগরিকপঞ্জি, জল-জঙ্গল জমি, সবই আছে, বাঙালি নেই।
ঘটনার পরে।
এখানে কাউকে খাটো করা হচ্ছেনা। আনন্দ, তিস্তা, রবীশ, সবাই তীব্রভাবে বিজেপির বিরোধিতা করে গেছেন। কেউ জেল খেটেছেন, কেউ চ্যানেল ছেড়েছেন। মঞ্চও তীব্রভাবেই বিজেপির বিরুদ্ধতা করেছে, যা যথেষ্ট কার্যকরীও হয়েছিল। কিন্তু তাতেও বক্তব্য বা ন্যারেটিভ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবেনা, তা তো না। সেটুকুই করা হচ্ছে। এবং ন্যারেটিভ প্রসঙ্গে যা দেখা যাচ্ছে, এই যে বাংলার অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া, বাংলাকে এড়িয়ে যাওয়া, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে এড়িয়ে যাওয়া, ভাষাকে এড়িয়ে যাওয়া, আগ্রাসনকে এড়িয়ে যাওয়া, এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটা রাজনীতি। যাকে সর্বভারতীয়ত্বের রাজনীতি বলা যায়, দিল্লিমুখীনতাও বলা যায়। এই রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পক্ষে যতটা সরব, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা বাংলা শব্দটা উচ্চারণে ততটাই নীরব। বঙ্গে এর একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল সংকটকালে, অর্থাৎ বিজেপি যখন বাংলায় ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। বাঙালিত্বকে তখন আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এখন প্রয়োজন মিটে গেছে।
উত্তর বা পশ্চিম ভারতের বুদ্ধিজীবীদের কাছে এ ব্যাপারে আদৌ কোনো প্রত্যাশা নেই। প্রত্যেকেরই সীমাবদ্ধতা থাকে, তাঁদের একটা ন্যারেটিভ আছে, বাস্তবতা আছে, তার বাইরে তাঁদের যাবার কথা না। কখনও যানও নি। কিন্তু বঙ্গীয় সচেতন মানুষদের কাছে অবশ্যই প্রত্যাশা আছে। যে, সর্বভারতীয় ন্যারেটিভকে তাঁরা প্রশ্ন করবেন। বাংলার প্রেক্ষিত যোগ করবেন। আলোচনা করবেন, তর্ক করবেন। নতমস্তকে মেনে নেবেননা। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখিনি আনন্দকে কেউ সমালোচনা করে কেউ বলেছেন, তাঁর অবস্থান আত্মঘাতী। রবীশের ন্যারেটিভে হাততালি পড়েছে প্রচুর। এবং বাংলার ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চও কার্যত সেই সর্বভারতীয় ন্যারেটিভই অনুসরণ করছেন, প্রচারপত্রে যা দেখলাম। বাঙালি জাতি, তার খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সবই যখন শনাক্তকরণের চিহ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন এই দিল্লিমুখীনতা বিপজ্জনকই মনে হয়। সেটা ফ্যাসিবাদবিরোধিতার পক্ষেই বিপজ্জনক। এঁদের ক্ষেত্রে তাই সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন জাগে।
১। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতটা এঁরা কি ফ্যাসিবাদের লক্ষণ বলে মনে করছেন না? না কি যথেষ্ট আঘাত হচ্ছে বলে মনে করছেননা?
২। এন-আর-সি জাতি হিসেবেই বাঙালিকে একটা প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে প্রতিটি বাঙালিই সম্ভাব্য বাংলাদেশী, এটা কি এঁরা মনে করেননা?
৩। ভাষা এবং সংস্কৃতির একটা আগ্রাসন আছে, হিন্দি এবং ইংরিজির, এবং সেটা যথেষ্ট বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কি এঁরা মনে করেন না?
৪। বাঙালি শব্দটা উচ্চারণ করা কি এঁরা অপ্রয়োজনীয় বা লজ্জাজনক সংকীর্ণতা বলে মনে করেন?
৫। বাংলার ফ্যাসিবাদী মঞ্চের ভোটপূর্ববর্তী প্রায় সমস্ত প্রচার বা বিষয়বস্তুই বাংলা ভাষায় ছিল, এখন কি ফোকাস বদলে মূলত ইংরিজি এবং হিন্দিমাধ্যমের দিকে এগোনো হচ্ছে, যার লক্ষ্যবস্তু 'সর্বভারতীয়' দর্শককূল?
এগুলো নেহাৎই যৌক্তিক প্রশ্ন। খাটো-টাটো করার ব্যাপারই না। রাজনৈতিক ন্যারেটিভ ঘিরে এরকম বিতর্ক, প্রশ্নোত্তর হয়। নানা লোকের নানা অবস্থান থাকে, মতবিরোধ হয়। ব্যক্তিগতভাবে নেবার মতো কিছু হয়নি। আগে একটা লেখা লিখেছিলাম, তার দু-একটা প্রতিক্রিয়া দেখে, এটা আরেকবার বলে দিলাম। বিতর্কে অনভিজ্ঞ লোকজন থাকতেই পারেন, আলোচনার অভ্যাসটাও হয়তো সকলের তৈরি হবার সুযোগ হয়নি। তাই আমার দিক থেকে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া রইল আর কি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।