দুজনে তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাইরে বেরোল। কাপড় পরার মানে এ নয় যে বদ্রী চুড়িদার পাজামা ও শেরওয়ানি পরেছে। ঢিলে লুঙিটা কষে বেঁধে খালি গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে, ব্যস্। রঙ্গনাথের এখনও ওর মত পরমহংস অবস্থা প্রাপ্ত হয়নি, তাই গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে নিল।দরজা অব্দি যেতে যেতে ওদের চাল এবং হৃৎস্পন্দন দুইই বেড়ে গেল। এতক্ষণে চারদিকে শোনা যাচ্ছে - চোর! চোর! চোর! ... ...
আমষ্টারডাম এমন একটা শহর যেখানে মানুষের থেকে সাইকেল বেশী – মোটামুটি আট লক্ষ লোক বাস করে এই শহরে, আর সেখানে সাইকেলের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ আশি হাজার মত (২০১৪ সালের হিসেব)। আর এই শহরের সবচেয়ে বেশী রিপোর্টেড ক্রাইম কি জানেন? সাইকেল চুরি। নানা বছরের গড় হিসেব বলছে আমষ্টারডামে বছরে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মত সাইকেল চুরি হয়! এবার এই সংখ্যাটা জানার পর আপনার সাইকেল চুরি হলে কি আপনি আর পুলিশের কাছে যাবেন? কি মনে হয়? এত পুলিশ গোটা হল্যান্ডে নেই যে বছরে ৮০ হাজার সাইকেল চুরির কিনারা করবে! ... ...
দাদাভাই বৌদিভাই-এর টানাপোড়েন টা আমাকেও মাঝে মাঝে ভাবাত। আমি জানতাম আমাদের এই সম্পর্কটাও সমাজের চোখে কোনওদিন স্বীকৃতি পাবে না। যেখানে দাদা ভাই আর বৌদির আইনি, ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এক লহমায় 'না' হয়ে যেতে পারে সেখানে আমার আর রণ’র ভালবাসা আমাদের, একান্তই নিজেদের। টুবাই, ওর দিদি, বৌদিভাই, রণ-র তুতো-বোনেরা বিষয়টা নিয়ে সকলের আড়ালে অল্প অল্প মজা করলে, আজকাল রণও সে মজাতে যোগ দেয়। একটা অলিখিত স্বীকৃতি, প্রচ্ছন্ন ভালবাসা, সব সময়ই আমাদের দুজনকে ঘিরে থাকে। ওটুকুই আমার পাওয়া। রণ তো শুধু আমার ভালবাসা না, রণ’র নাচও তো আসলে আমার ভালবাসা। রণ’র রেওয়াজ, রণ’র অনুষ্ঠান, রণ’র নাচের পোশাকের যত্ন সবই আসলে বড় বেশি আমার। আস্তে আস্তে রণ’র সাথে রণ’র প্রতিটা অনুষ্ঠানে আমি নিজের অজান্তেই রণ’র ছায়াসঙ্গী। ঘুঙুর আর সেতারের মিলমিশ আমায় এক অন্যরকম জগতে হারিয়ে নিয়ে যায়। পড়াশোনার সাথে সাথে এভাবেই শাস্ত্রীয় নৃত্য কত্থক হয়ে ওঠে আমার সংসার, আমার প্রেম আমার ভালবাসা। ... ...
বোম্বা্ই মেলে চড়ে বসেছি। গন্তব্য –– পুণে শহরের কলেজ অফ এগ্রিকালচারাল ব্যাংকিং। মাথায় নানান চিন্তা; অচেনা জায়গার অস্বস্তি, ঘরে ছেড়ে আসা বৌ–বাচ্চার ভাবনা, চিন্তার কি আর শেষ আছে? হাতের পেপারব্যাকে মন বসছে না।হঠাৎ চোখ গেল কয় জোড়া বিদেশি দম্পতির দিকে – কটা রং, বেড়ালচোখো, নীলচোখো,তামাটেচুলো, কিন্তু সবাই খুব ফরসা। লালচে, ফ্যাটফেটে, হলদেটে –– নানান কিসিমের। ... ...
আর এই ‘স’ এবং ‘হ’ এর মিলিত অবস্থাকে বলেছেন ‘সহজ’ অবস্থা। সহজানন্দ লাভের জন্য সহজযানী সাধকেরা ‘সহ জ’ অর্থাৎ জন্মের সহিত জাত দেহকেই আশ্রয় করে থাকেন। ... ...
প্রাচীন কাল থেকেই তন্ত্রসাধনায় কল্পিত হয়েছে মানব শরীরের দুটো নাড়ী। শরীরের বামদিকে যে নাড়ী থাকে তাকে বলে ‘ইড়া’, আর ডানদিকে যে নাড়ী থাকে তাকে বলে ‘পিঙ্গলা’। বৌদ্ধ সাধনায় এই দুটি যথাক্রমে শুন্যতা ও করুনার প্রতীক। ... ...
সুন্দর ব্যাপারটা আপেক্ষিক – কারণ আমার চোখে যা সুন্দর, তা আপনার কাছে লাগতে নাও পারে! তবে কিনা একটা ব্যাপার থাকে – যেমন ঐশ্চর্য্য রাই সুন্দর, এ নিয়ে মনে হয় না তেমন কেউ দ্বিমত হবেন। তাই যদি কেউ ভিয়েতনাম ঘুরে এসে থাকেন এবং এই শহরে সময় কাটিয়েছেন এমন থাকেন, তাহলে মনে হয় তাঁরা আমার সাথে একমত হবেন যে, ভিয়েতনামের সবথেকে সুন্দর শহর খুব সম্ভবত ‘হোই-আন’। ভিয়েতনামের দক্ষিণে হো-চি-মিন সিটি থেকে উত্তরে হ্যানয় যেতে পারেন বা ভাইস ভার্সা। কিন্তু ভিয়েতনামের মধ্যভাগটা যেন কোন ভাবেই মিস করবেন না – মধ্য ভিয়েতনামেই আছে, হুয়ে, মাই-সন, হোই-আন, ডা-নাং এই সব সুন্দর জায়গা গুলি। একে একে লিখব যদি সময় পাই বা উৎসাহ থাকে। আজকে একটু হোই-আন নিয়ে ফিরে দেখা যাক। ... ...
এই পঞ্চতন্ত্র রচনার পেছনেও সেই একই গল্প। আজ ভাইস প্রিন্সিপাল হতে চাইছে, কাল প্রিন্সিপাল হতে আবদার করবে। তার জন্যে পরিচালন সমিতির মেম্বারদের হাত করবে। মাস্টারদের মধ্যে নিজের একটা দল বানাবে। ছাত্রদের মারপিট করতে উসকে দেবে। উপর মহলে নালিশ করবে। ব্যাটা বজ্জাত হাড় বজ্জাত হবে। ... ...
জ্বরজারি, পেটখারাপ ও ডাক্তারবাবুরা; ক্যাপসুল বিপ্লব ও স্লাইস ব্রেড দাদুর দস্তানায় রায় পরিবারের এত জন সদস্য, কিন্তু সে হিসেবে অসুখ বিসুখ হত কম। সময়ে হামাদেওয়া শিশু এবং টলটল করে হাঁটা বাচ্চা প্রথমে দুই, পরে তিন হল। কয়েক বছর পরে আরো এক এবং দুই। কিন্তু ততদিনে পৃথিবী বিশেষ বদলায় নি। বাচ্চাদের হত জ্বর ও পেট খারাপ। বড়দের জ্বর; সম্ভবতঃ ওঁরা পৈটিক সমস্যা হলে নিজেরাই সমাধান খুঁজে নিতেন। ... ...
ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টার কলেজ স্থাপিত হয়েছিল যে উদ্দেশ্য নিয়ে তা’হল ‘দেশের নবীন নাগরিকদের মহান আদর্শের পথনির্দেশ এবং উত্তম শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উত্থান’। আপনি যদি চকচকে কাগজে কমলা রঙে ছাপা কলেজের ‘সংবিধান এবং নিয়মাবলী’ পড়েন তাহলে বাস্তব জগতের মলিনতায় আচ্ছন্ন আপনার মন সত্যি সত্যি নির্মল এবং পবিত্র হয়ে যাবে। অবশ্যি ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়টুকু পড়লেও আপনার একই অনুভূতি হয়। ... ...
- 'দ' য়ের হইল মাথায় ব্যথা। দাদু শ্লেটে চক পেনসিল দিয়ে একটা বড় করে 'দ' আঁকলেন। -- চন্দ্র আইলেন দেখতে। এবার দ'য়ের পাশে একটা চন্দ্রবিন্দু আঁকা হল। -- তাইন দিলেন বাইশ টাকা। দাদু দয়ের পেটের নীচে বিচ্ছিরি করে ২২ লিখলেন। ... ...
এই গাঁয়ে ‘কানা’ বোলে তো পন্ডিত রাধেলাল। ওর একটা চোখ অন্যটির চেয়ে ছোট, তাই ‘গঁজহা’র দল ওকে কানা বলে ডাকে। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য হল- এক হিসেবে আমাদের সবকিছুই প্রাচীন ঐতিহ্য — কেউ বাইরে, মানে অন্য রাজ্যে, যাবে তো কথায় কথায় বিয়ে করে নেবে। অর্জুনের সঙ্গে চিত্রাংগদা আদি উপাখ্যানে তাই হয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রবর্তক রাজা ভরতের পিতা দুষ্যন্তের সঙ্গেও তাই। যারা আজকাল ত্রিনিদাদ কি টোবাগো, বর্মা কি ব্যাংকক যাচ্ছে তাদের সঙ্গেও ঠিক ওইসব হচ্ছিল। এমনকি আমেরিকা বা ইউরোপে গেলেও একই হাল। সেই হাল হল পন্ডিত রাধেলালের। ... ...
আমাদের সেই পঞ্চাশের দশকে অক্ষর পরিচয় হতেই ধারাপাত নামের একটা লম্বাটে পাতলা বই খুলে এইসব শুভংকরের আর্যা আর কড়া-গন্ডা-পণ জোরে জোরে দুলে দুলে মুখস্থ করতে হত। "কুড়োবা কুড়োবা কুড়োবা লিজ্জে, / কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্জে। / কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ, / বিশগন্ডা হয় কাঠার সমান।" ... ...
আপনি নিজে একা বা ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে গিয়ে যখন কোন হোটেলে ওঠেন, তখন কোনদিন সেই হোটেলের ‘ফায়ার-এসকেপ’ ব্যবস্থা নিয়ে ভেবেছেন? মানে ধরুণ আপনি সেই হোটেলের পাঁচতলায় আছেন, হঠাৎ রাতের বেলা আগুন লেগে গেল কোন কারণে! কি করবেন আপনি? এটা আমরা সবাই জানি যে আগুন লাগলে লিফট ব্যবহার করা উচিত নয় (আর এমনিতেই আগুন লাগলে লিফট অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবার কথা) – তাহলে আপনি কিভাবে নামবেন নীচে? বেশী সময় নেই কিন্তু আপনার হাতে – আগে থেকে দেখে রেখেছেন কি সিঁড়িটা কোন দিকে যাতে বিপদের সময় আপনাকে খুঁজতে না হয়! ... ...
রণজয়ের বৌদি-ই প্রথম যে আমার আর রণর সম্পর্কটা আন্দাজ করেছিল, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি কোনও দিন। রণর তুতো বোনেরাও রণর সাথে সাথে আমাকে ভাইফোঁটা দিত।সবাই মিলে মাঝে মাঝে কখনওসখনও সকলের আড়ালে আমাকে রণর বৌ বলে মজা করতে ছাড়ত না, যা হয়তো আমাকে মনে মনে অন্যরকম সুখ দিত। মনে মনে আমিও যেহেতু রণর বৌ,তাই সংসারের মঙ্গলের দায় তো আমার ওপরেও কিছুটা বর্তায়।সম্পর্কটা শুধু আমরা দুজনের যাপনেই সীমাবদ্ধ থাকলেও অতগুলো বছর আগে তো ওটাই ছিল আসলে আমার সংসার। তথাকথিত ভাবে নিজেকে মেয়ে না ভাবলেও মনে মনে নিজেকে রণজয়ের বৌ ভাবতে কোথাও কোনো অসুবিধা ছিলোনা আমার। আসলে আজও তো অভিধানে অন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাইনা। ৩৭৭ পরবর্তী সমযে আজও তো সমকামী বিবাহের নেই কোনো আইনি স্বীকৃতি। আর অতগুলো বছর আগে সেসব তো কষ্টকল্পনা। ... ...
কোপারেটিভ ইউনিয়নের তবিল-তছরূপের ঘটনাটি বড্ড সাদামাটা ঢঙের, বড্ড সরল। রোজ রোজ চারদিকে যে শত শত তছরূপ হচ্ছে তার থেকে এ একেবারে আলাদা। এর সৌন্দর্য্য এর সরলতায়। এ একেবারে বিশুদ্ধ তছরূপ; কোন প্যাঁচ নেই। এতে কোন জাল দস্তখতের গল্প নেই, না কোন জালি হিসেব, না কোন নকল বিল দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে।এমন তছরূপ করতে বা ধরে ফেলতে কোন টেকনিক্যাল যোগ্যতার দরকার নেই। যা দরকার তা’হল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। ... ...
আমার মায়ের দাদু ছিলেন গ্রামের মোড়ল। আমার মায়ের প্রপিতামহী গঙ্গাযাত্রা থেকে বেঁচে ফেরার পর সন্তান লাভ করেছিলেন । আজ থেকে অতগুলো বছর আগে ঠিক কোন শারীরিক ব্যাধির কারণে তাঁকে গঙ্গাযাত্রায় পাঠানো হয়েছিল তা আমি জানতে পারিনি। মাকেও জিজ্ঞাসা করিনি কখনো তাই সেটুকু আমার অজানাই রয়ে গেছে। তবে গ্রামের লোক অনেক পরেও গঙ্গাপুত্রের বংশ বলে মোড়লদের অভিহিত করতো সেটুকু আমি ছেলেবেলায়ও দেখেছি। মায়ের সেই বড়ঠাকুমার দান ধ্যানের গল্প আজও শোনা যায়। অত বছর আগে গ্রামীণ পাঠশালা তৈরির জন্য জমিও তিনি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সে পাঠশালা আজ প্রাথমিক ইস্কুলে পরিণত হয়েছে। কালের নিয়মে আজ সে সব কথা হারিয়ে গেলেও আজও কান পাতলে শোনা যায়। ... ...