মানুষটির গানের কোনও ঠিকঠিকানা নেই -- কখনও শিবের স্তোত্র, কখনও মীরার ভজন, গঙ্গাকে নিয়ে একটা ছোট্ট গান, কখনও আচার্য শঙ্করের 'ভজ গোবিন্দম', এমনকি রামপ্রসাদী সুরে একটা হিন্দি গানও শুনলাম তাঁর কণ্ঠে। তিনি সম্ভবত বিশেষ কোথাও ডাক না পাওয়া গায়ক; কিন্তু ডাক পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে তিনি খুব বিচলিত, এমনও মনে হলো না। নিজের গান নিজেকে শুনিয়েই মানুষটি কী খুশি! ... ...
ঘটনা এখন এক্সপ্রেস নয়, রাজধানীর স্পীডে দৌড়ুচ্ছে। দু’দিনের পর আজ ফুরসৎ পেলাম, তাই লিখে রাখছি। আগেই বলেছি, গতকাল আমাদের বুড়ার যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে বোম্বাগড়ের যুবরাজের শ্রাদ্ধ। ... ...
ঝড় বয়ে গেল। এ’বছরের প্রথম কালবোশেখি। আঁধি মানে ধুলোর ঘূর্ণি, কিন্তু এটা ছিল অন্যরকম। এতে আমগাছের বৌর বা মুকুল ঝরে যায়, কাঁচা ঘরের চাল ওড়ে আর বৃষ্টির সঙ্গে ‘ওলে’ বা শিল পড়ে। তারপর কয়েকদিনের জন্য টেম্পারেচার নামে, লোকের মুখে হাসি ফোটে। ক’দিনের জন্য লু’ বা গরম হাওয়ার হলকার থেকে নিস্তার পাওয়া। সে সবই হোল। ... ...
সেটা বোধহয় ১৯৫৭ সাল। শিশু বিদ্যাপীঠস্কুলে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম দশক পূর্ণ হওয়া নিয়ে বড় দিদিমণি অনেক কিছু বললেন। আর কমিউনিস্ট পার্টি তখন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ শ্লোগান ছেড়ে দিয়ে বেশ কোমরবেঁধে ইলেকশনে নেমেছে। ... ...
এই সমস্ত, সবই আসলে পাঠ্য। বাতাস তাদের সবার মলাট সরিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন, শনশন শব্দে আমাদের কানে এসে বলছে, “পড়ো, পড়ো”। ... ...
আঁধার ছাতে চুল এলোমেলো করা হাওয়া দেয়। এখানে আকাশে আজ মেঘ কম। কৃষ্ণপক্ষের মৃদু চাঁদ আর অজস্র তারার মেলা। কন্যা হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমায়, ওপরে আঙ্গুল দেখিয়ে নতুন শেখা কবিতা বলে - দেখো মা - হাওয়া বয় শনশন তারারা কাঁপে হৃদয়ে কি জং ধরে পুরোনো খাপে কি বললি বাবু! মনে হঠাৎ একটা ফুলঝুরি জ্বলে ওঠে। মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ওর কাঁধে চিবুক রেখে আকাশে চোখ পেতে দিই। ওগো প্রেমেন বাবু আজ নতুন করে তোমার কথার মানে বুঝেছি আমি। হাসিখেলা দুখমেলা স্মৃতির বাঁকে, আঁখিতারা তারা জুড়ে মাকেই আঁকে। হৃদপাতে সরোবর - হোথা মায়েরা থাকে। ... ...
তারপর দুজোড়া লবকুশকে নিয়ে সীতা নয় লাবণ্য এগিয়ে যায় অশোক বন নয় তপোবন মানে অশোক নগরের দিকে। পায়ে পায়ে চলতে চলতে মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল আমার - ১৯৮৭ সাল। ফলও বেরোল। মাধ্যমিকে যে ইস্কুল থেকে ফার্স্ট হয়, সে একটা চ্যালেঞ্জ কাপ পায়। কুড়ি বছর আগে ওটা মঞ্চে উঠে মায়ের নেওয়ার কথা ছিল। বিধির বিধানে হয়নি। কুড়ি বছর পরে কাপটা আমি পেলাম।নিবেদিতা ইস্কুলের যেসব দিদিরা মাকে আর আমাকে, দুজনকেই পড়িয়েছেন, তাঁরা আমাকে উপলক্ষ করে ওটা মাকেই দিলেন। অন্তত তাঁদের শরীরী ভাষায় সে কথাটা প্রকাশ পাচ্ছিল। ... ...
দিনগুলি কুড়োতে কত কি তো হারালো। সেই রবিবার বি টি রোড ধরে, ডানলপ ফেলে, সুখচর গীর্জার পাশ দিয়ে গেলাম বড়মামার বাড়ি। মা হারমোনিয়ামটা দেখে উচ্ছল হয়ে ওঠে। নিজের মনে নানা স্কেলে হরেক রকম সারেগামা বাজাতে থাকে। দেখে অবাক হয়ে যাই। মা শিখল কোথায়? আমাদের বাড়িতে তো হারমোনিয়াম নেই। - মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি। - গান জানিনা তো। - তাহলে বাজাচ্ছো কি করে? - আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা। ... ...
লম্বাটে পুরোনো নকশার জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম আনমনে। এমন সময়ে কাক ভেজা, হেলমেট পরা লম্বা চওড়া হুঁকুজ মামা ঢুকলেন ঘরে। আমি খাটে পা ঝুলিয়ে বসা। চোখাচোখি হয়ে গেল। হেলমেট খোলা থমকে গেল। আমার দিকে কয়েক মূহূর্ত তাকিয়ে বললেন, মাইমা! পাশ থেকে মায়ের হাসির শব্দ শুনলাম। এ মাইমার নাতনি গো হুঁকুজদা, আমার মেয়ে। মায়ের গলা শুনে সম্বিৎ ফিরে হুঁকুজ মামা বললেন, রাজকুমারী, তুমি! এ তোমার মেয়ে? তারপর কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিক হয়ে বললেন, হঠাৎ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এতদিন পরে লাবণ্য মাইমা কোথা থেকে এল? সেদিনই জানতে পারলাম, আমি আমার দিদিমা লাবণ্যপ্রভার দ্বিতীয় সংস্করণ। মুখ, চুল, গায়ের রং সবই এক। আমার নিজের তো স্মৃতি নেই। যাঁরা দুজনকেই দেখেছিলেন, তাঁরা বলতেন। তখন থেকেই লাবণ্যর কথা জানতে ইচ্ছে করতো। ... ...
অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে। কাকামণির বুক পিঠ জুড়ে ব্যান্ডেজ; ভালরকম লাঠির ঘা খেয়েছে। ঘরে ডেটলের গন্ধ। ছোটকারা নাকি পার্কাসার্কাস বাজারের এক কোনে ফার্স্ট এইডের ক্যাম্প খুলে অনেক আহত চাষির শুশ্রুষা করেছে। তাঁদের ফুল সার্ভিস দিয়েছেন আসাদ মেডিকেল হলের ডাক্তার গণি। ছোটকা ঠাকুমাকে বলছিল – পুলিশ ভিড় ছত্রভঙ্গ করার জন্যে লাঠিচার্জ করেনি, পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্যে করেছে। একেবারে রাস্তায় ফেলে থেঁতো হওয়া অব্দি মেরেছে। ... ...
MistBorn-এর লেখক Brandon Sanderson-কে নিয়ে পরে বিশদে আলোচনা হবে (প্রচণ্ড ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার মশাই – লালমোহন থাকলে হয়তো ‘হাইলি সাসপিশাস’-ও বলতেন), কিন্তু ওঁর একটা ক্ষমতা নিয়ে অল্প-কথা এই জায়গায় বলতেই হচ্ছে – তা হল ওঁর অসাধারণ ম্যাজিক-সিস্টেম তৈরি করার ক্ষমতা। এই বিশেষ বইটিতে যে সিস্টেমটা ব্র্যান্ডনবাবু বানিয়েছেন, তার নাম অ্যালোমেন্সি। ব্যাপারটা ঠিক কি, তা নিয়ে একটি শব্দও আমার খরচ করার দরকার নেই – বইয়ে বিশদে আছে। এতটাই ডিটেলে, যে এই ধরণের সিস্টেমের অন্তর্গত সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ ঠিকঠাক আছে কিনা, তা নিয়ে এদের জন্যে নিবেদিত রেডিট-পাতায় মাইলের পর মাইল তক্কো চলে। ... ...
লিখবটা কি? অনেক ভেবে মাথায় এল – ‘ফ্যান্টাসি’। ওসব ‘কুয়াশানগরীর উপাখ্যান’-মার্কা কবিতা-কবিতা গপ্পো নয় (লেখার এমন বেগ – কি না কি বলে চলেছি), গভীর Genre-fiction, বিশেষ করে – হাই-ফ্যান্টাসি। আপনি যদি কেবলমাত্র ওই চন্দ্রিলবাবুর ‘কিছু Dystopia’ দেখে সায়েন্স-ফিকশন সম্পর্কে, আর গেম অব থ্রোন্স/লর্ড অব দ্য রিংস দেখে ফ্যান্টাসি সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে থাকেন, তা হ’লে হবে না – ঐসব রোগের উপসর্গ মাত্র। এই ছড়ানো জঁরাগুলির বিস্তৃতি বহুদূর। সেই বিখ্যাত কুম্ভকার-সন্তান, যিনি পেশাদার জাদুকর হওয়ার চেষ্টায় বংশের মুখে চুন-কালি লেপেছিলেন, আর যাঁর কৈশোর-অ্যাডভেঞ্চারগুলি লিখে ফেলে ওই বয়স্কা, আপাত-trans-phobic মহিলা এখন টাকার স্তূপের ওপর ‘রোলিং’, তাঁর গপ্পোগুলিও পড়ে এর আওতায়। আরও কত কি-ই না আছে এই জঁরায়! ... ...
সহকর্মীর থেকে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির পাশ নিয়ে গেছে, এমন নেশা। চেষ্টা করেও মোহনবাগান গ্যালারির পাশ যোগাড় করতে পারেনি। খেলা চলছে। সাবধানে চেপেচুপে বসেছিল। হঠাৎ মোহনবাগান গোল মিস করাতে অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, ইশশ। ব্যাস, আর যায় কোথা। গ্যালারিতে রব উঠল, ওরে ছারপোকা ঢুকেছে। বাবাকে মেরে ধরে গ্যালারির নিচে ফেলে দিল। হায় ভগবান। ছোটোবেলায় বাবা একবার কালশিটে নিয়ে কাদা মেখে বাড়ি ফিরেছিল, আর বলেছিল পড়ে গেছি। ... ...
আমার নতুন কাজের জায়গায় এসে একসময় অনুভব করলাম আরও অনেক বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা দরকার। শুধু ক্যুইয়ার নয় সাধারণ মানুষেরও এইচ আই ভি নিয়ে ভুল ভাঙা দরকার। এইচ আই ভি নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক থাকা যায় সেটা লোকে যত জানবে তত এইচ আই ভি পরীক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। এই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন একটা পোস্টার ডিজাইনের।এই পোস্টারটা সমস্ত সরকারী হাসপাতালে এইচ আই ভি নির্ণয় কেন্দ্র বা আই সি টি সি বিভাগে আছে। যখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ফোনে কেউ বলে "দাদা আপনি সত্যি সত্যি এইচ আই ভি পজিটিভ!এইচ আই ভি নিয়ে সত্যিই ভাল থাকা যায়? একটু আগেই জানতে পারলাম আমিও এইচ আই ভি পজিটিভ।" আর তখন আমাকেই কাউন্সেলিং করতে হয়। এইচ আই ভি নিয়েও সুস্থ স্বাভাবিক থাকা যায় অ্যন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপির মাধ্যমে। শুধু নিয়মিত ওষুধ আর চিকিৎসকের পরামর্শ মত চলতে হয়। তখন বুঝতে পারি পোস্টারে সেদিন আমার মুখ দেখানোর সিদ্ধান্তটা একদম সঠিক ছিল। ... ...
আর স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর আবহেই দেশে তখন চলছিল কংগ্রেস ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০ - ২২)। আর ঐ সময়ে ১৯২০ তেই বাংলায় আর একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী দল ইস্টবেঙ্গলের জন্ম হয় - যার সঙ্গে মোহনবাগানের দ্বৈরথ একদিন অমরত্ব লাভ করবে। প্রিয়নাথ মিত্র রাজা রাজবল্লভ স্ট্রিটে তৈরি করেছিলেন অ্যাশক্রফ্ট হল। ... ...
সুবীর কুমার বসুকে কেউই চিনবেন না। সুবীর বসু কখনো কখনো আমার সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন। শেষ বয়সের কুঁচকে যাওয়া, চকচকে চামড়া, টলোমলো পা। হাত ধরে ধরে কিছুটা নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনতাম আবার। যাওয়াতেও যে তাঁর খুব আপত্তি ছিল, এমন নয়; আবার ফিরেও আসতেন লক্ষ্মী হয়ে, কিচ্ছুটি না বলে। ... ...
মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে - মোহনবাগান একটা আদর্শ, আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে গড়া যখের ধন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক, আমাদের অস্তিত্ব। মোহনবাগানের হারজিত, আর আমাদের জেতা হারা এক। সেদিন না বুঝলেও, এবারে একটু একটু বুঝতে পারছি। মোহনবাগানের প্রথম দিকের দলের একটি নাম নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী। ইনি কে? সেই নামটি হল দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু। ... ...
বিলাসপুর সেন্ট্রাল জেল। দুটো রাত কেটে গেছে। ঘুম হয় নি। দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিলাম। দিদি আমার কাঁধে মাথা রেখে একটু ঝিম মেরে রয়েছিল। আমরা খুনি নই, নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেছি -- এটা সত্যি না ব্যাড ড্রিম। আনফরচুনেটলি সত্যি। একেবারে কাফকা মার্কা। পিজি ক্লাসে কাফকার ‘দি ট্রায়াল’ পড়াই। কখনও ভেবেছি এইরকম কাফকেস্ক অভিজ্ঞতা আমাদের দু’বোনের কপালে জুটবে? আমরা দুই বোন, সংস্কৃত সাহিত্য ও ইংলিশ লিটারেচারে ডক্টরেট, তাও শান্তিনিকেতন থেকে — আমরা আজ ছত্তিশগড়ের জেলে আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনারদের সেকশনে বন্দী! খুনের দায়ে, ভাবা যায়? আমাদের মোবাইল পর্য্যন্ত চালাকি করে বুড়ারে সেই মোটা মত লোকটা পরীক্ষা করার অজুহাতে সীজ করে নিয়েছে। ... ...
একদিন বিবিসিতে দেখলাম, দুটো প্লেন মিলে ১১০ তলার দুটো বাড়িকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। লো-অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা রাখা। তাতে বারবার ধরা পড়ছে, কালো আর ছাই-ছাই ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে আমেরিকা, বিল্ডিংদুটো রংমশালের ফুরিয়ে আসার মতো নেমে আসছে। ... ...