অতএব ততদিনে “রাজা মানে রাজাই, তাঁর আবার বর্ণ বিচারের প্রয়োজন কি?” এমন ধারণা চলে এসেছে। এটাই হিন্দু ধর্মের লক্ষণ - হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ তখনও ছিল, আজও আছে, কিন্তু রাজা, রাষ্ট্রীয় প্রধান, উচ্চবিত্ত এবং উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের বর্ণ বিচার করবে কোন নির্বোধ? ... ...
[ তখন ছেলেটি প্রস্তুত হচ্ছে নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হবে বলে। সেসবের জন্যে এখানে ওর কোচিং ক্লাস শুরু হয়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন অলোক দেখে যে ছেলে কোচিং থেকে আগেভাগেই বাড়ি চলে আসে জ্বর আর হাত-পায়ে ব্যথার কারণে। হাত আর পা ফুলে ওঠায় স্থানীয় ডাক্তারবাবুদের শরণাপন্ন হতেই হয়। দুতিনবার ডাক্তার দেখানোর পরেও জ্বর আর কমে না ছেলের। ফোলাটাও বাড়তেই থাকে। এরমধ্যে রাজপুর অঞ্চলের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি দেখেবুঝে স্টেরয়েড দিতে শুরু করেন।] ... ...
আজ থেকে মাত্র কয়েকশ’ বছর আগে (১৭৫৬-৫৭ সি.ই.), নবাব সিরাজদ্দৌলাকে সরিয়ে ক্লাইভ ও তাঁর অনুগত মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাতে বণিক মহতাব চাঁদ ও স্বরূপ চাঁদের (ইতিহাসে যাঁরা “জগৎ শেঠ” (Banker of the World) উপাধিতে বিখ্যাত) ভূমিকা এবং তাঁদের বিপুল অর্থব্যয়ের হিসেব জানলে চমকে উঠতে হয়। অতএব রাজাকে রাজা বানিয়ে তুলতে (king-maker) বণিকসম্প্রদায়ের প্রভাব আজও যেমন আছে, সে সময়েও ছিল – এমন অনুমান করাই যায়। ... ...
[ সেই চুরাশি’র ডিসেম্বরের সকাল নটায় উঠেছিলাম করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের সাধারণ স্লিপার ক্লাস এস থ্রি-তেই। হারাধনের দশটি ছেলেমেয়ে। মাঝের স্লিপারগুলোর ভাঁজ খোলা হতো রাতের বেলায়। অবরে সবরে দুপুরের ভাতঘুমের জন্যে লাঞ্চের পরেও। ওঙ্গলে—বিজয়ওয়ারা জং—ইলুরু পেরিয়ে সাঁইসাঁই ছুটে চলা করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের পরবর্তি স্টপেজ রাজামুন্দ্রী আসবো আসবো করছে। প্রায় বিকেল হয় হয়। হঠাৎ আমার মা-র অস্বস্তি শুরু। বুকজ্বালা দিয়ে শুরু হয়ে চোখ উলটে প্রায় যায় যায় অবস্থা ! ] ... ...
[ আমার চোখে দেখা আর হৃদয়ে্র অনুভবে জারিত এই ছোট্ট ছোট্ট চিকিৎসা সংক্রান্ত ঘটনাগুলি এখনো মোছেনি আমার মাথার স্মৃতিকোষগুলোর থেকে। তার থেকে তুলে আনা এই মণি-কাঞ্চনগুলোয় যেমন পেয়েছি সাক্ষাৎ ভগবানদের, তেমনি কিছু কিছু সাংঘাতিক ঘটনা নেহাৎ-ই সহ্য করেছি উপায়ান্তরহীন যাপনে। ক্রোধে ফেটে পড়েছি মননে। রক্তচাপ বাড়িয়েছি বারংবার – মধ্যবিত্ত মনোভাবনায়। পেয়েছি আচম্বিত বাড়ানো হাত - অকাতর অকৃপন স্পর্শে। কৃতজ্ঞতাও হয়তো অব্যক্ত ছিল আমার পক্ষে সে সময়। তো এইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন ঘটনার কিছু রেশ গ্রন্থিত করছি প্রাণের আনন্দে। এখনো বেঁচে আছি, বেঁচে আছে আমার প্রজন্ম। তাই ভগবানের নামকীর্তন যেমন করেছি অক্লেশে, আবার সেই ‘আতঙ্ক’ চলচিত্রের মতো যেন কিছুই দেখিনি আমি হয়ে পাল্টেছি চরিত্র কিম্বা স্থান-নাম। মহাবীর-বুদ্ধ-নানক-রামকৃষ্ণের পুণ্যভুমিতে আজ হিংসা পৌনঃপুনিকতায় ছড়াচ্ছে বিদ্বেষের লাল আগুন। যে আগুন শুধুই ভস্ম-জন্ম আহ্বান করে। নিরুপায় আমি করজোড়ে মার্জনা চাইছি আমার এটুকু অপৌরুষেয়তার।] ... ...
[ বাচ্চা মেয়েটি তখন সদ্যই সন্তানসম্ভাবা। মেয়েটির গোটা শরীর জুড়ে শুরু হ’ল অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণা। এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতে পারে না সে এমন প্রলয়ঙ্করী ব্যথা। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার ব্যানার্জি, মুখার্জি, পাল, চৌধুরী ইত্যাদি নামী নামী ডাক্তারবাবুদের চেম্বারে ছুটোছুটি শুরু হ’ল। কিন্তু ব্যথা আর কমেই না। বরং অযথা ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে খেয়ে সে মেয়ে প্রায় নিস্তেজ। কিছুদিনের মধ্যেই বিছানা হ’ল তার আশ্রয়।] ... ...
তাঁর নির্দেশের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষ, অতএব তিনি মাগধী প্রাকৃত এবং আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষাই ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নির্দেশগুলিতে। এর অপরিসীম গুরুত্ব বুঝে সংস্কৃতর পাশাপাশি গড়ে উঠতে লাগল প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা এবং তাদের নিজস্ব লিপি। অর্থাৎ আজ আমি বাংলাভাষায় এই যে লেখাটি লিখছি এবং আপনি যে সেটি পড়ছেন, তার পিছনে সম্রাট অশোকের অসাধারণ এই অবদান স্বীকার করে আমরা যেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় প্রণত থাকি। ... ...
মানুষের শৈশব ও বাল্য চেতনায় যে শিক্ষার বীজ রোপিত হয় – কৈশোর ও তারুণ্যে নিজের মস্তিষ্কের রসায়নে সেই শিক্ষাতেই সে তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথ খুঁজতে থাকে। কেউ হয় অত্যাচারী এবং বিলাসী রাজা, কেউ মানবদরদী সমাজ-সংগঠক, কেউ দার্শনিক, কেউ দারুণ যুদ্ধবাজ, আর অধিকাংশ হয়, আমাদের মতো থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনের অধিকারী। মস্তিষ্কের এই বিশেষ রসায়নের ফর্মুলাটি আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ... ...
চেনা মানুষ অচেনা গল্প ... ...
শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, নন্দরাজারা সেচ ব্যবস্থার জন্যেও বহু ক্যানাল এবং জলাধার নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজ্যের সমস্ত ভূমি এবং ভূসম্পদ ও জলসম্পদের অধিকারী যে রাষ্ট্র এবং সেই যাবতীয় সম্পদই যে করযোগ্য ভারতবর্ষে সে ধারণারও প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন নন্দরাজারাই। ... ...
এতদিনের গতানুগতিক জীবনে যে মস্তিষ্ক আর পাঁচটা পশুর মতোই জীবনধারণের কাজে সদা ব্যাপৃত ছিল, তার ভেতরে আসছে নতুন এক আবেগের জোয়ার। সেদিন ওই আদিম মানুষগুলি প্রথম যে অনুভবে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের বহু প্রজন্ম পরে, এই অনুভূতির নাম দেওয়া হবে, প্রেম, ভালোবাসা। ছেলে ও মেয়ের ভালোবাসার এই অনুভূতি নিয়ে অজস্র কাব্য, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা হবে। খুলে যাবে মানব সংস্কৃতির আরেকটি দিক – যার নাম সাহিত্য। ... ...
দীক্ষিতের প্রথম পাঠ নির্দিষ্ট মাপের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে লোকালয়ে ভিক্ষা করা। ভিক্ষাপাত্র একবার পূর্ণ হলেই লোকালয় থেকে আশ্রমে ফিরতে হত। সেখানে সকলের সঙ্গে বসে সেই ভিক্ষালব্ধ খাদ্য নিবিষ্ট মনে আহার করতে হত। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিক্ষা গ্রহণের এই প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু হত দীক্ষিতদের সাধনা। এই সাধনায় দীক্ষিতের অহংকার, লোভ ও ঔদ্ধত্য বিনাশ হয়, বাড়ে ধৈর্য এবং মানসিক স্থিতি। ... ...
স্বস্তি জোড় হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে গেল, নিচু হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল, “গুরুদেব, আজকে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন?” গৌতম আরও এগিয়ে স্বস্তিকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাই? ঠিক কী রকম লাগছে বল তো?” স্বস্তি গৌতমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক কী বলতে পারব না, তবে একদম অন্যরকম। আপনি যেন কোন নক্ষত্রের মতো। সবে ফুটে ওঠা পদ্মফুলের মতো। কিংবা... কিংবা... গয়াশীর্ষ পাহাড়চূড়ার ওপরে পূর্ণিমার চাঁদের মতো”। ... ...