আমরা এবারে দেখতে চাইব, সমাজ গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে মার্ক্সের কি ধারণা ছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে এসবের সংক্ষিপ্ত এবং প্রায়-পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আমরা জেনে নেব। পার্থ বলছেন – “ভারতবর্ষ নিয়ে পড়াশোনা কিংবা লেখার সময় মার্কস-এর চিন্তায় একটাই মূল প্রশ্ন ছিলঃ ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক অগ্রগতির সম্ভাবনা কী, কোন পথে সে অগ্রগতি সম্ভব, সে পথে বাধা কোথায়? বিশ্ব-ইতিহাসের ক্রমবিকাশের যে ছক তিনি ইউরোপের সমাজবিবর্তনের ধারা থেকে আবিষ্কার করতে চাইছিলেন, বলা বাহুল্য সেই ছকের সঙ্গে মিলিয়েই ভারতবর্ষ নিয়ে এই প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। ... ...
খেয়াল করলে বুঝবো, “caste” তথা জাত বিভাজন অক্ষত রইল। একে ছাত্রদের সংখ্যানুপাতে বিচার করে বার্ষিক রিপোর্টে পেশও করা হল। কিন্তু গ্রামীণ বা চলে-আসা ভারতীয় সমাজের ধরনে বিষয়টিকে উচ্চ-নীচ সামাজিক প্রভেদ হিসেবে আর বিচার করা হচ্ছেনা। এক নতুন “সেকুলার সোশ্যাল হায়েরার্কি” তৈরি হল। এর অভ্যন্তরে জাত বিষয়টি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল, কিন্তু একটি রোপিত আধুনিকতা বা “এনগ্র্যাফটেড মডার্নিটি”র চাদর একে পরিয়ে দেওয়া হল। মেডিক্যাল কলেজ সহ হিন্দু কলেজ বা হুগলী মহসিন কলেজের মতো উচ্চশিক্ষার যে নামী প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হল তার অঘোষিত বাতাবরণ রচিত হল যে জাত আর প্রধান পরিচয় নয়। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের বাইরে প্রশস্ত আঙ্গিনায় কাঠামোটি অটুট রইল। ... ...
কাজিদার আহ্বান তো আর ব্যর্থ হবে না, কয়েকদিন পরেই চিঠি লিখে কলকাতায় হাজির হয় পিংলা। স্বদেশীয়ানা, দেশপ্রেম – এইসব উত্তেজনাকর শব্দগুলোর কী আবেদন কাজিদার কাছে, তা পিংলার চেয়ে বেশি কে-ই বা জানে! কিন্তু যে উত্তেজনায় শুরু, কিছুদিন বা কয়েকবছর সেই উত্তেজনার বেগেই এগিয়ে চলা আর তারপর হঠাৎই একদিন উত্তেজনাতেই শেষ! কাজিদা যখন বহরমপুরের জেল-এ, তখন তাকে একটা চিঠি লিখেছিল পিংলা – তার স্পষ্ট মনে আছে সে চিঠির কথা – তাতে সে অভিযোগ করে বলেছিল স্পষ্ট কোন রাজনৈতিক আদর্শ কাজিদার জন্যে নয়, সে কখনও বিপ্লববাদী কখনও গান্ধীবাদী; মুজফ্ফর আহ্মদ সঙ্গে থাকলে সে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের কথা চিন্তা করে, জেলে-চাষা-শ্রমিক-কৃষকের জয়ধ্বনি তখন তার কথাবার্তায়, মিটিং-মিছিলে আর গানে-কবিতায়। ... ...
এই যাত্রা সম্পর্কে তৈরি হওয়া প্রশ্নের যেমন: কেন সরাসরি নির্বাচনী প্রচার করার পরিবর্তে যাত্রায় যাবেন? সবাই যখন রামমন্দিরের কথা বলছে তখন কেন ন্যায়ের কথা বলবেন? কেন উত্তর-পূর্বে এত সময় ব্যয় করা, যেখানে এত কম সংসদীয় আসন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে? এর সহজ উত্তর হল: যে আদর্শ বোধ বিজেপির রাজনৈতিক আখ্যানের টুটি চেপে ধরে বসে আছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে না হারিয়ে আপনি ভারতীয় জনতা পার্টিকে পরাজিত করতে পারবেন না । ন্যায় যাত্রার লক্ষ্যই হল তা অর্জন করা। ... ...
লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে সনাতনদা আর নির্মলের মা এলেন। নির্মল এখন বড় পুলিশ অফিসার। সনাতনদার নাম করে পিসি কাঁদলেন। আমার বাবা গুরুচরণকাকা সবাই মিশে গেল কান্নার জলে। গুরুচরণ কাকা আশ্চর্য বিষয়, আমাদের তুমি বলতেন এবং লালু কাকা বা গুরুচরণ কাকা কোনওদিন মদ বা হাঁড়িয়া খেতেন না। মদ খেতেন রাধুকাকা আর পণ্ডিতপাড়ার বাদল পণ্ডিত। বাদল পণ্ডিত বড় ভালো মনের মানুষ। ভালো কবিতা লিখতেন। যাত্রা করতেন। বাবার অকৃত্রিম সুহৃদ। আমাকে তুমি বলতেন। কী লিখেছো বাবা, শোনাও তো একবার। ... ...
তার পুব দিকের ঢালের উঁচুতে বড় বড় ওটের ঘাস জন্মেছে। ওই ঘাসবনের পরেই খাড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে কোশি নদীর পাড় অবধি। একদিন খাড়াই পাহাড়ের উত্তর দিকের গ্রাম থেকে একদল মেয়েবউ ওখানে ঘাস কাটছিল। হঠাৎ এক বাঘ তাদের মধ্যে এসে পড়ে, হুড়োহুড়িতে এক বয়স্কা মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঢাল বরাবর গড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঘটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনই চিৎকার চেঁচামেচিতে রহস্যময় তার পালানো। খানিকটা ভয় কাটলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে মেয়েরা আর ঘেসো জমির ঢাল ধরে খানিকটা নেমে এক সরু ধাপিতে ওনাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেল। মহিলা কোঁকাতে কোঁকাতে বলেন তিনি মারাত্মক চোট পেয়েছেন। ... ...
এই যে মানুষের হিমালয়কে দেখবার এত ইচ্ছা, সে তো শুধুই তীর্থ দর্শনের পুণ্যার্জনের জন্য নয়। ট্রেকিং করতে যাওয়া ভ্রমণেচ্ছুক মানুষের সংখ্যা কম নয়। পর্বতারোহণ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে স্পোর্টস হিসেবে। শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবী থেকে আগত ট্যুরিস্ট, পর্বতারোহী এদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে দিন দিন। হিমালয়ে পদে পদে এত বিপদ, সে কথা কি মানুষ জানে না? হয়তো এই বিপদের জন্যই হিমালয়ের আকর্ষণ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ... ...
পরের দিনেও আমরা ওখানেই ছিলাম, এখানে এত বিভিন্ন রকমের পশুর সমাবেশ যে শিকারের পিছনে ধাওয়া করার জন্য আমি খুবই উৎসুক। সকালের কফিপানের পর আমার বন্ধু সেই অ্যামোনিয়া-বোতল খ্যাত মামান্যারার জন্য উপহারসহ কয়েক জনকে পাঠানো হল। তারপরই আমি আরও একবার মাঠের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। শিবির থেকে পাঁচশো গজ দূরেও যাইনি, হঠাৎ আমি ও আমার দলবল খুব কাছেই, সম্ভবত পঞ্চাশ গজ বা তার চেয়েও কম দূরত্বে, একটা সমবেত গর্জন শুনে থেমে গেলাম। ... ...
আমাদের গ্রামে ১৯ মাঘ ওলাইচণ্ডী পূজার মেলা। এই মেলাতেই হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের মানুষ বাড়ি ফেরেন। ইদ বকরিদ বা পূজা অনুষ্ঠানে না ফিরলেও মেলায় ফেরা চাই। বহু মানুষ এভাবেই ঘরে ফেরেন। আমিও। ... ...
কথায় কথায় বাইরের কথা আসে। আজ বিকেলের পাওয়া গন্ধ নিয়ে রাজু কথা বাড়াচ্ছে না। এইসব গন্ধ ও একটু বেশি পায় আর পেলে গুটিয়ে যেতে থাকে। এটা কখনো কখনো ওকে ভয়ঙ্কর চুপ করে তোলে। তখন বাইরের সব অন্ধকার ওর মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। একজনের এরকম ডিপ্রেসড অবস্থা থাকলে অন্যরাও প্রভাবিত হয়। আজও রাজু কি সেরকমই আছে? আসলে অনেকটা পথযাত্রার ক্লান্তি আমাদের ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছিল। বিকেলের কথা , আদমখোরের কথা, রাজুর পাওয়া গন্ধের কথা কোন কথাটা যে কেন্দ্রে থাকবে তা ঠিক করতে পারছিলাম না কেউ। ... ...
আইনি মর্যাদার চেয়ে বড় প্রশ্ন সাংবিধানিক মর্যাদার। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী (বা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তি) কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতে পারেন? আমাদের সংবিধানের বিধান স্পষ্ট: সাংবিধানিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ভাবে যেমন খুশি ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশীলনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু একজন পদাধিকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তা করতে বাধা দেয়। সংবিধান এও বলে যে সরকারকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যে কোনও একটি ধর্মের প্রতি ঝোঁক সাংবিধানিক মর্যাদার লঙ্ঘন। ২২ জানুয়ারির আচার-অনুষ্ঠানে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন রেখা ঝাপসা হয়ে গেছে। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই দেশের অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে হিন্দু ধর্মকে। ... ...
প্যারিস, ১৮০৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। বিখ্যাত ফরাসি গণিতজ্ঞ এড্রিয়ান-মারি লেজানড্রার (Adrien-Marie Legendre) বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন অপরিচিত এক ব্যক্তি। লেজানড্রার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিয়ে আগন্তুক বললেন, ‘বইটা যদি একবার পড়ে দ্যাখেন’। খানিক অবাক হয়ে লেজানড্রা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি বই এটা?’ সসংকোচে আগন্তুক জানালেন, ‘আজ্ঞে, কাল্পনিক সংখ্যার (Imaginary number) উপর ... আমার নিজের কিছু মতামত’। ‘কাল্পনিক সংখ্যা!’ হালকা চমক লাগে লেজানড্রার। ‘বলে কি লোকটা! ... ...
ইতিহাসের বিশেষ সন্ধিক্ষণ ইতিহাসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরখ করার সৌভাগ্য হয় ক’জনের! বৃত্তের বাইরে থেকে নয়, একেবারে কেন্দ্রে থেকে পটপরিবর্তনের সাক্ষী থাকা এবং তাকে লিপিবদ্ধ করা গল্প বলার ছলে, এ নিতান্ত সহজ কাজ নয়। পাঠ্যবইয়ের ‘ইতিহাস’-এর বাইরে বেরিয়ে যে ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা লেখক নিজে পরখ করেছেন, তার অভিঘাত যা নিজে চোখে দেখেছেন এবং বিশ্লেষণী মন নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন, তা এই বইটিকে নিছক ভ্রমণ কাহিনী বা আত্মজৈবনিক অন্য কোনও রচনার থেকে পৃথক করেছে। এখানেই হীরেন সিংহ রায়ের পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি স্বতন্ত্র। গুরুচণ্ডালী-তে যে লেখা ইতিপূর্বে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত হত, তা-ই এ বার দু’মলাটের মধ্যে। ... ...
গাছের যে অংশ থাকে মাটির ওপরে তাই আমরা দেখি। অর্থাৎ কাণ্ড , শাখা, ডালপালা আর পাতা - ফুল - ফল। আর যা থাকে মাটির নীচে, সেটা অদৃশ্যগোচরই রয়ে যায়। যেমন, শিকড়। শিকড় সন্ধান করতে লাগে.... খুঁজলে পাওয়া যায়। আর না খুঁজলে, বিস্মৃতির অতলে। আমাদের আদত যাপন চিত্রের এক অনুপুঙ্খ ধারা - বিবরণ হিসেবে নয়, ধারণ করে রাখে যে সব পাতা, সে সব পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করলে হয় ইতিহাস। ইমানুল হকের লেখা 'কাদামাটির হাফলাইফ' সে অর্থে ইতিহাস। ... ...
বাবা বেঁচে থাকলে দিব্যেন্দুদার সঙ্গে জমতো ভালো। দিব্যেন্দুদাও বাবার মতো পার্টি পাগল, নাটক ও সংস্কৃতি পাগল মানুষ। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো স্বভাব। লোককে ধরে ধরে নাটক দেখান, ভালো গান শোনান আর ফল ফুলের চাষ করতে বলেন। বলেন, শুধু ধান চাষ করে বাঁচবে না। চাষিদের ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝান, আর্থিক স্বনির্ভরতার কথা। আমাদের মানিকতলা খালপাড়ের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝেও এসেছিলেন এটা বোঝাতেই। ... ...
নেনোরা ছিল বেশ কয়েকভাই। নেনোর ব্যবহার ছিল খুব মিষ্টি। সবসময় হেসে কথা বলতো। সেই নেনো অসুস্থ জেনে এবং কলকাতা নিয়ে গিয়ে ডায়ালিসিস না করালে ছেলেটা বাঁচবে না জেনে জোর ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম। পার্টি অফিসের মালেকদা চিঠি লিখে দিলেন। বললেন, কলকাতায় কার্তিকদাকে দিতে। ... ...
“আকণ্ঠ কুয়োয় ডুবে আছে যে মানুষ সে জানে তার আকাশ বৃত্তাকার। তাকে দিগন্তরেখার লোভ দেখিও না।” পড়ে খটকা লাগলো যে আমার আকাশও কি বৃত্তাকার দেখছি বহুদিন? যে চিন্তা এতদিন টনক নড়ায় নি! স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করি আকাশের অন্য কোন আকার দেখেছিলাম কি না! কিন্তু এই স্মৃতিও খুব সহজে মনে পড়ার নয়। এ গত জন্মের আচ্ছন্নতা নিয়ে ইহজন্মে মাতৃ-জঠরে ভাসমান থাকার স্মৃতি। যা স্মৃতি আর বিস্মৃতির মাঝের গোধূলি! যা হৃদয়েরও যে একটি মস্তিষ্ক আছে, হৃদয় যার খোঁজ রাখে না, তাকে মনে করিয়ে দেয়। ... ...
বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, আমিই সেই জার্মান সৈনিক। ডেভিড সেটা বুঝলেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। উনচল্লিশ বছর আগে ইলিনয়ের ডেভিড দে ফ্রিস অস্ত্র হাতে জার্মানির হেসেনের এক পরাস্ত জার্মানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। চারদিকে যখন খুন কা বদলা খুন হচ্ছে, সেখানে অস্ত্রহীন জার্মানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তার ওপরওয়ালার অফিসে। তার পরিচয়পত্র নাম ইত্যাদি নথিবদ্ধ করে, তাকে যুদ্ধবন্দির সম্মান দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের শেষে বিজেতারা ফিরেছেন শিকাগো ইলিনয়, আর বিজিত ফিরেছেন হেসেন, জার্মানি। জার্মান ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন প্রথমে। ডেভিডও ততক্ষণে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়েছেন। চার দশক আগের দুই শত্রু। একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। ... ...