মকিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মইশা বলে কতো জল। আল্লাহ সাক্ষী রইল গো। দেখি কে কারে তাড়ায়।’ মাথা এত গরম হয়ে গেল সারা রাত্রি ঘুম হল না। তাঁর উপর ছাদ থেকে শুধু প্লাস্টার খসে পড়ছে। মশারির ভেতর দিয়ে সারা বিছানা বালি বালি হয়ে গেছে। মশারির উপরে একটা চাদর পেতে দিলে হয়। কিন্তু তাতে পাখার হাওয়া একটুও ভেতরে ঢুকবে না। কী করি ভাবতে ভাবতে লোডশেডিং হয়ে গেল। দুত্তোর বলে উঠে পড়লাম। ভাবলাম, কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করি। সাপের কথা ভেবে আবার মশারির ভেতরে ঢুকলাম। সারা গায়ে প্যাচপ্যাচে ঘাম। তার সাথে বিছানায় বালি ভর্তি। শুয়ে শুয়ে কান্না পাচ্ছিল। কাল আবার ভোর ছ’টা থেকে ডিউটি করতে হবে। ... ...
যখন উত্তরপাড়া স্টেশন এল আমি জানালা দিয়ে দেখলাম একটা লোক মাথায় হাঁড়ি করে ট্রেনে উঠছে। আমি ভাবতে লাগলাম এই হাঁড়ির মধ্যে কি খাবার আছে? ঠিক তখনই আমি শুনতে পেলাম লোকটা বলছে 'গরম ঘুগনি খাবে গরম ঘুগনি আছে'। এটা শুনে আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। ... ...
একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে তিনতলা। হাঁফাতে লাগলাম। অন্যদেরও মনে হয় একই অবস্থা। সৌভাগ্যই বলতে হবে তিনতলায় উঠে বাঁদিকে মোড় নিয়ে প্রথম ঘরটিতেই আমরা ঢুকলাম। বিছানায় চাদরসহ নারীটিকে নামিয়ে দিতে দিতে খেয়াল হল আমার মুখে মাস্ক নেই। মাস্কটি থুতনির নীচে বা গলায়ও নেই। কেমন করে সেটি খুলে পড়ে গেল জানি না। নার্স সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। অন্য দু-জন রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক্সপোজড শব্দটি মাথায় এল। এক্সপোজডই বটে, কিন্তু যে নার্সটি আমাকে ডেকেছিল সে আমার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর দুজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল রোগীকে নিয়ে। ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি ধরে নীচে নামলাম আমি। ল্যান্ডিং। মাস্কটিকে কোথাও দেখলাম না। ল্যান্ডিং-এর ডানদিকের ঘরে মা বসে আছে। কিন্তু সেই ঘরে ঢুকে দেখলাম মা নেই। মা কোথায় গেল? আমি যে সাংঘাতিক আতঙ্কিত হয়েছিলাম তা নয়, কারণ মা-র জন্য এই শহর খুব পরিচিত আর এইসব হাসপাতালে মা এর আগে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করেছেন। কিন্তু আমাকে ফেলে মা কোথায় যাবেন? হাসপাতালের ভেতরে যাবার কোনো সুবিধে নেই, সেখানে একজন গার্ড বসা, তাহলে কি বাইরে গেছেন? ... ...
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গোড়াপত্তনের প্রারম্ভ্রে বাঙালি জাতি সাময়িকভাবে এক বিভাজনের রাজনীতির শিকার হয় যা অবিভক্ত বাংলার ভৌগোলিক মানচিত্রকে আপামার জনসাধারণের মানসচিত্তে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ রূপে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিল। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রশাসনিকভাবে ১৯১১ তে রদ হলেও তা বাঙালি জাতিকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সামাজিক সীমারেখা দিয়ে ধর্মীয় (হিন্দু বাঙালি এবং মুসলমান বাঙালি) ও প্রাদেশিক (পূর্ববঙ্গনিবাসী 'বাঙাল' এবং পশ্চিমবঙ্গবাসী 'ঘটি') পরিচিতিতে ভাগ করে দেয়। অতএব বাঙালি জাতি ১৯১০ এর দশকের প্রেক্ষাপটে একদিকে ছিল বঙ্গভঙ্গের ক্ষতের সামাজিক অস্থিরতায় দোদুল্যমান এবং অন্যদিকে হয়ে উঠেছিল ফুটবলকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী আবেগে বিচ্ছুরিত। এই পটভূমিকায় পয়লা অগাস্ট ১৯২০তে ইস্টবেঙ্গলের আত্মপ্রকাশ সমগ্র বাঙালির কাছে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। সেই ইতিহাসে শুধু ফুটবল ছিল না, ছিল ফুটবলের প্রতিযোগিতাকে হাতিয়ার করে নব্য শুরু হওয়া সংকীর্ণমনা আন্তর্দেশীয় প্রাদেশিকতা ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ঘৃণ্য রাজনৈতিক অভিসন্ধিকে পরাস্ত করার শপথ। তাই বলাবাহুল্য যে ইস্টবেঙ্গলে যাত্রা শুরুই হয়েছিল লড়াইয়ের আহ্বানের মধ্যে দিয়ে। ... ...
আকাশ থেকে মনসুনের মেঘ সরলো তো বুভুক্ষু বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়লো পুজো নিয়ে। শারদীয়া পত্রিকা এখন সরতে সরতে বর্ষাকালেই বার হয়। একই নামের লেখক লেখিকা,একই অপকাশিত পত্রাবলী ও আঁকা ছবি। একটি ফরম্যাট মাত্র। তাও ও কিনতে হয়। কিনে খুব রাগতে হয়। "কিস্যু হসসে না" বলতে হয় কিন্তু বর্ষাকালের শারদীয়াগুলি কিনতে হয়। কিনতেই হয়।এটি পুজার নামতা। অত্যাচারী ও অত্যাচারিত, দু পক্ষেই মিলে জুলে এ খেলাটি খেলে চলেন প্রতি বছর। ... ...
শিল্পকলার অন্য ক্ষেত্রে, মানে ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া বা চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি কেউ এই ধরনের রেফারেন্স বা কোটেশন ব্যবহার করেন তাহলে কি সেটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে গন্য হবে ? আমার উত্তর হচ্ছে ‘না’। যদি কোন শিল্পী তাঁর পূর্বজ আরেকজন শিল্পীর কোন আইকনিক কাজকে অন্য ভাবে অন্য কনটেক্সটে বা অন্য মাধ্যমে ব্যবহার করে আলাদা কোন বার্তা দিতে চান, তাহলে সেটাও শিল্পের একটা ভ্যালিড পদ্ধতি বলেই ধরে নিতে হবে । এই পদ্ধতিতে সাধারণত শিল্পী তাঁর রেফারেন্স সোর্সকে গোপন রাখতে চান না বরং সেটাকেই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির একটা এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করবার চেষ্টা করেন । এ বিষয়ে সেরা উদাহরণ হচ্ছে পিকাসোর পঞ্চাশের দশকের বেশ কিছু ছবি, যেখানে তিনি ভেলাস্কেথ, গোইয়া, এদুয়ার মানে প্রমুখ শিল্পীর আঁকা কিছু বিখ্যাত মাস্টারপিস ছবির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন । ... ...
ছোটো থেকেই রবি আর শশী এমন করেই বড়ো হয়েছে। নিজেরাই জঙ্গলে ঘুরে খাবার জোগাড় করে, নিজেরাই রান্না করে আর বাবাকেও খাওয়ায়। কোনোদিন কিছু কিনতে গ্রামে গেলে সবাই কেমন থাকায়। ওরা বোঝে লোকে ওদের ভয় পায়। পছন্দ করে না একদম। ওরাও রেগে রেগে থাকে। শুধু বাবাকে ভালোবাসে। কারণ কোনো কোনোদিন বাবা ওদের সঙ্গে আদর করে কথা বলে। মায়ের কথা শোনায়। রবি আর শশী মায়ের কথা ভাবে আর ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের কেউ নেই তো! ... ...
সেদিন আমাদের সামনে, আমাদের তিন আপা—রিজিয়া, ফরিদা আর আমেনা খবরটি পেয়ে ঠিক উড়ে যাওয়ার মত করে ছুটে গিয়েছিল মডেল স্কুলের পুকুরের দিকে। তখন ভরা বর্ষা। জল থৈ থৈ করছে। আর মাঝখানে পদ্ম ফুটেছে। পদ্মের গায়ে ফড়িং উড়ছে। হাল্কা হাওয়ায় জল নড়ছে। এর মধ্যে কোথাও বাছেদ ভাই নেই। তিন বোনে সেই পুকুর পাড়ে বসে হাহাকার করে বাছেদ ভাইয়ে নাম ধরে ডেকে ডেকে ফিরল। সেই আর্তনাদে জলের মধ্যে একটা আলোড়ণ উঠল। একটি হাওয়াও ছুটে এলো দক্ষিণ থেকে। আর কারা কারা মিছিল নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল—তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। এবং আরো কয়েকটি লোক রাঁতে ইঁদুর ধরতে পারেনি বলে হায় হায় করছিল আর মাঝে কপাল চাপড়াচ্ছিল, এর মধ্যে কে জন বলছিল, আজি রজনীতে দীপালী অপেরায় অভিনীত হইবে একটি পয়সা দাও। মূল ভূমিকায় অভিনয় করিবেন—নট সম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস। আর কিছু ডানাকাটা পরী। এই পরী শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে জলের নীচ থেকে বাছেদ ভাই উঠে এলো। একটা বড় সড়ো মাছের মত। মাথাটি উপর দিকে। দুহাত দুদিকে তখনো ছড়ানো। ঠিক এই ভাবেই গাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে বলেছিল—আমি উড়ছি। ... ...
দীপকদা হলে কেমন ভাবে এই খেলাটা দেখাতেন ? তিনি প্রথমে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেন। নিজের নাম বলতেন। তারপর বলতেন-- ম্যাজিক ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, হস্তকৌশল বা চাতুরী। তারপর নিজের খালি-হাত দেখিয়ে বলতেন, এই যে আমার খালি-হাত, যেখান থেকে জাদুকরেরা বের করে আনেন টাকা, রুমাল বা সিগারেট। যেমন, এই মুহূর্তে আমার হাতে এসে গেছে ফুল। তেমনি আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা মুঠো থেকে বের করেন তাবিজ, কবচ, মাদুলি। আর সেসব সাধারণ মানুষের হাতে দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে পাশ করে যাবে, আপনার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরাও কিন্তু আমার মতই জাদুর কারবারি। কিন্তু এঁরা কিছুতেই তা স্বীকার করেন না। বদলে নিজেদের বাবা, যোগী বা গুরু বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। জাদুকর মাত্রেই জানেন, ব্লেন্ডো খেলাটি হল চারটে ছোটো রঙিন রুমালকে মিলিয়ে, একটি চাররঙা বড়ো রুমালে পরিণত করার ম্যাজিক। কিন্তু দীপকদা চারটি চাররঙা রুমালকে, একটি কাগজের রোলের মধ্যে ভরে দিয়ে ,যখন ম্যাজিক করে তাদের জুড়ে দিয়ে একটা মস্ত বড় রুমাল বের করেন, যাতে ওই সব রঙই রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের একজাতি-একপ্রাণ- একতার গান বেজে ওঠে। তাই এইসব ম্যাজিক মানুষ বহুকাল ভালবেসে মনে রাখেন। ... ...
শিল্পী ছিল সুজয়ের বোন। সুজয় তখন যুবা করত। যুব কংগ্রেস। পাড়ার বিরাট মস্তান আর শিল্পীর পিছনে পরে গ্যালো আমাদের রমেন। রমেনরা তখন সর্দারপাড়ার দিকে বস্তিতে থাকে। উদ্বাস্তু বাড়ির দুর্দশা যেরকম হয়– বাবা মারা গ্যাছেন, ভাইগুলো ইস্কুলেও বোধহয় যায় না, তিনটে বোন আর রমেন নাকি প্রেমে পড়ে গেল! সুজয়ের বাবা রমেনদের বস্তিতে এসে চোটপাট করে গেলেন। সেই বস্তি আবার তখন কমিউনিস্ট পার্টির বেস, উলটে সব রুখে দাঁড়াল। এরপর সুজয় কেসটা হাতে নেয়। সেদিন আমরা ফিরছিলাম ময়দানে খেলা দেখে। লিগ ম্যাচ, ফোকটে টিকিট জোগাড় করে দিয়েছিল কেউ। মেন লাইনের ট্রেনে বেলঘড়িয়া নেমে হেঁটে ফিরতাম আমরা। দু তিনদিন আগে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। বড় রাস্তায় বোধ হয় জল জমে থাকত, তাই নিমতা বাজারের থেকে ভেতরের পথ দিয়ে ফিরছিলাম। ব্যাপারটা যে পার্টির ঝামেলায় চলে গ্যাছে সেই ধারণাটাই ছিল না আমার। ... ...
এরপর কথা শুরু হতে গিয়ে দাগের ওপর দিয়ে আবার চলাচল করল। সুকুমারকে পাটা মারতে দেখা যায়। সব ঠিকঠাক থাকে। খালি পাটার আওয়াজ হয় ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ থ্যাস। আর কোদালের আওয়াজ হয় খ্যারর খ্যারর। কর্নিকের আওয়াজ থ্যাস থ্যাস থুপুস। সব আওয়াজ থেমে গেলে নিঃশব্দ হয়। চারদিক নিঃশব্দ না হলেও একটুখানি জায়গা যেখানে কাজকাম হচ্ছিল নিঃশব্দ হয়ে পড়ল তারপর সেটা হয়ে উঠল এমন এক নরম সরম জায়গা যেখানে খুব শিগ্গির শক্তপোক্ত এক আস্তরণ গড়ে উঠবে। সে রোদ আসুক আর না আসুক। দিনের শেষে বা রাতের শুরু আস্তে আস্তে নরম সরম জায়গার সিমেন্ট জমাট হয়ে যাবে। সেখানে তখন দাগের সম্ভবনা তৈরি করতে তিনটে কুকুর ঘোরাফেরা করতে করতে নানান দাগ সত্যিই তৈরি করছিল। সে সব ঘুরে ঘুরে নরম জায়গার আসপাশে তৈরি করা দাগেরা। ... ...
কালের নিয়মে একদিন বিয়ে করলাম। নতুন বৌকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। রাস্তায় দেখা লালি পিসির সঙ্গে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। দেখলাম কাল্টুদের বেড়ার ঘর পাকা হয়েছে, ছাদ হয়েছে। আমাদের দুজনকে বসিয়ে প্লেটে করে দুটি সন্দেশ আর জল দিলেন। তাকের ওপরের কৌটো থেকে একটা দোমড়ানো ময়লা কুড়ি টাকার নোট বার করে দিলেন আমায় বৌয়ের হাতে। বললেন, "বৌমা, কিছু কিনে খেও"। বৌকে নিয়ে গেলাম একদিন ইমাম সাহেবের ডেরায়। আমার স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। হাতে তুলে দিলেন একটি দশ টাকার নোট। চলে আসবার সময়ে বৃদ্ধ মানুষটার চোখের কোনাটা কি চিকচিক করছিল। ... ...
সময় হলে মৌলানাসায়েব নামাজ শুরু করবেন।নামাজে আমরা সবার জন্যে মঙ্গলকামনা করবো। আমাদের চলে যাওয়া সবার ভালো চাইবো। যে বৃদ্ধ মানুষটি ভয় পাচ্ছেন যে আগামী ঈদের নামাজে তিনি হয়ত থাকতে পারবেন না তিনি সবার কাছে কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা চাইবেন। আমরা তার দীর্ঘ জীবন চাইবো।মৌলানা প্রতিটি মানুষের মঙ্গল চাইবেন খোদাতলার কাছে।আপনি দেখবেন এইসময় আমাদের প্রবীণ মৌলানা মানুষটি কেঁদে ফেলেন।আমার মতন উদাসীন লোকেরও বুকের বাম দিকে কোথাও হাল্কা ব্যথা শুরু হয়। নামাজ শেষ। আসুন, এবার আমরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করি। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। সমস্ত বৈরিতা দূর হোক। আমার-আপনার সবার কুশল হোক। এবার চলুন বাড়ির দিকে হাঁটি।আব্বার জন্য দাঁড়াতে হবেনা। উনি সবার শেষে ঈদগাহ থেকে বের হবেন। প্রত্যেকটি মানুষের সাথে আলিঙ্গন ক'রে। ... ...
মহাশয়, আমাদিগের কপালে পাকিস্তান হইয়াছিল কেন তাহা লইয়া কত কথাই না শুনা যায়। শুনা যায় মোগলদিগের সহিত কোচবিহারের মহামান্য নৃপতির যুদ্ধ হইয়াছিল। মোগলের প্রতিনিধি রংপুর ঘোড়াঘাটের নবাব সৌলৎ জং এসে আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়নকে ঝাড় সিংহেশ্বরের প্রান্তরে লড়াই করে হারিয়ে দিল এক কালে। সেই যুদ্ধে আমাদিগের মহারাজার অন্দরমহলের বিভীষণ এক জ্ঞাতি ভাই দীনেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনের লোভে মোগলদিগের সহিত গোপনে যোগাযোগ করেন। এবং আমাদিগের মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণ পরাস্ত হন ঝাড় সিংহেশ্বরের যুদ্ধে। সেই লোভী জ্ঞাতিভাই দীনেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসনে বসায় মোগল সম্রাটের তরফে ঘোড়াঘাট-রংপুরের নবাব সৌলৎ জং। কিন্তু পরের বছরই আমাদিগের পরাজিত মহারাজা আবার যুদ্ধ করেন ভূটান রাজার সাহায্য লইয়া। এবং তাঁহার জয় হয়। জয় হয় বটে কিন্তু কিছু মৌজার প্রজা নাকি সাবেক শাসক মোগলদের প্রতি তাঁহাদের আনুগত্য বজায় রাখেন। কেন, না তাঁহারা নাকি মোগল সৈন্য ছিলেন। প্রথম যুদ্ধের পর মোগলের হাতে কোচবিহার গেলে এই সমস্ত অঞ্চলে বসবাস করিতে থাকে মোগল সৈন্যদের কিছু অংশ। মোগল প্রতিনিধি রংপুরের নবাবের নিকট তাঁহারা খাজনা দিতে থাকেন। কোচবিহারের মহারাজা তাঁহার উদারতায় এই বিষয়ে আর দৃকপাত করেন নাই। সামান্য কয়েকটি গ্রাম যদি খাজনা না দেয়, কী যায় আসে। আমাদিগের পূবর্পুরুষ মোগল সৈন্য ছিল কি না জানা নাই, কিন্তু কৃষিই ছিল তাঁহাদের মূল জীবিকা তা আমাদিগের অবগত। স্বাধীনতার পর রংপুরের নবাব যেহেতু পাকিস্তানে মত দান করেন, সেই কারণে ভারতে থাকিয়াও আমরা পাকিস্তানি হইয়া গেলাম। ইহাতে আমাদিগের দোষ কী? আমাদিগের কাহারো কাহারো নিকট রংপুরের নবাবের প্রজা হিসাবে খাজনার রসিদ রইয়াছে সত্য, কিন্তু তাহা স্বাধীনতার আগের কথা। স্বাধীনতার পর আমরা আর খাজনা দিই নাই রংপুরে গিয়া। আমরা কোচবিহার রাজাকেও খাজনা দিতে পারি নাই, কেন না রাজার প্রজার তালিকা হইতে আমরা বাদ ছিলাম সত্য। ... ...
কখনও ভেবেছেন কি সিংহ এদেশে গুজরাত ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না, আর বাঘ প্রায় সব রাজ্যে! অথচ প্রাচীন হিন্দু বা বৌদ্ধ ভাস্কর্যশিল্পে সিংহ সর্বব্যাপী আর বাঘ প্রায় অনুপস্থিত। ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভের শীর্ষভাগ- সেখানেও সিংহ। রাজারা বসতেন সিংহাসনে। বুদ্ধও শাক্যসিংহ। সিংহ থেকে সিংহল, সিংহ থেকে সিঙ্গাপুর। ... ...
শুন সবে ভক্তগণ, শুন দিয়া মন, দুঃখের কাহিনী এক করিব কথন-- অগ্রে দিব পরিচয় শুনে রাখো নাম, অতীব দুঃখী আমি বাঙালির রাম। ... ...
“জানি না”, অস্থির সীতাপ্রসাদ মাথার চুল খামচে ধরল। “কিন্তু গত বছরের সব কটা ঘটনা পর পর খেয়াল করে দেখো। মে মাসে প্রভুজির হুকুম আসল। আমরা ত্রিশূল নিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কবরখানায় হামলা চালালাম। এখানে, ঠিক এই জায়গাতে,” সীতাপ্রসাদ এলোমেলো হাত চালাল চারপাশে, “এখানে আমাদের গোটা দল এসে কবরগুলো একটার পর একটা খুঁড়লাম। এমনকি পচে গলে যাওয়া বডিগুলোকেও ছাড়িনি । যেসব জেনানারা কংকাল হয়ে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলাম শুধু। তারপর কাজ হয়ে গেলে লাশগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলাম যাতে সকলে দেখতে পায়। পরদিন থেকে টেনশন শুরু হল। বলা হল ওরা অ্যাটাক করবে, তাই পার্টি অফিস থেকে রাত্রিবেলা তলোয়ার আর ত্রিশূল বিলি হল। আমরা হামলা চালালাম। খুনখামারি যা হবার তা তো হল, ওদের সবাই চলে গেল রিফিউজি ক্যাম্পে। সব কিছুই জুন মাসের মধ্যে মিটে গেছে। ভোটার লিস্ট চেক করে দেখো, যে কয়খানা ঘর এখনো টিকে আছে তাদের একটাতেও কোনো জোয়ান মদ্দ নেই। আগাছা সাফ করে দেবার মত উপড়ে ফেলেছি। তাহলে এতদিন বাদে এই মার্চ মাসে এমন কাজ করল কে? কে এমনভাবে খুন করল তিনজনকে? আশেপাশের গাঁও গুলোর কেউ নয় কারণ এই কাজ করবার জন্য গায়ের যা শক্তি লাগে তা ওই কয়েকঘর বুড়োহাবড়াদের মধ্যে নেই। আর এমনভাবে বডিগুলো সাজিয়ে রাখল ঠিক যেভাবে আমরা ঐ লাশগুলোকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। ... ...