রাস্তার দু'ধারে ভয়ে-ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারগুলো । একটা বিল্ডিং কত তলার পর ওপরে উঠে টাওয়ার হয় ? টাওয়ার হয়ে উঠলেই তাদের ভয় করতে থাকে । আমার মনে হয় উনিশতলা পর্যন্ত তারা টিন এজার থাকে । টাওয়ারগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে এই জন্য যে কখন কোন গৃহবধু কোনো বিশাল কাচের জানলা বা বারান্দা বা ছাদে গিয়ে হাওয়ায় দুহাত ভাসিয়ে দেবেন। এরকমই ঘটছে কয়েক মাস যাবত । এক গৃহবধু তার দুই ছেলেকে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আর তারপর নিজে লাফ মারলেন। কারণ ? শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দুর্ব্যবহার । আরকটি গৃহবধু কোলে ছেলেকে নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন । কারন সেই একই । কিন্তু একজন গৃহবধু, সংবাদপত্র অনুযায়ী, ছেলেপুলে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সুখেই ছিলেন , লাফ মারলেন হঠাৎই । সবাই ডাইনিং টেবিল ঘিরে খেতে বসেছিলেন । তিনি উঠে গেলেন, কাচের জানালা খুললেন । পরিবারের সদস্যরা ভাবলেন তিনি একটু সামুদ্রিক বাতাস উপভোগ করতে চাইছেন । কেউ বোঝার আগেই তিনি হাওয়ায় দুহাত ভাসিয়ে দিলেন । টাওয়ারগুলো তাই ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , সামুদ্রিক বর্ষার প্রচণ্ড ঝড়েজলেও । ... ...
না এত সব করেও কিছু ত্রুটি বেরল না বিদিশার। কিন্তু তার থেকে কি ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে বিদিশা সুস্থ্? না, তা না এসে তারা উল্টে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে ওর অসুখটা আসলে মানসিক অসুখ। এবং রেফার করে দিলেন মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে। সেখানে গিয়ে কী বলবে বিদিশা? বুকের মধ্যে দিব দিব করছে অতনুর। কী এমন করেছে অতনু? একটা কাজ কি ঠিক ভাবে করতে পারত বিদিশা! নিজের ব্যাঙ্কের আকাউন্ট নাম্বারটা পর্যন্ত ঠিক করে জানেনা সে, তাকে কোন কাজ ছেড়ে দেওয়া যায়? তুমি পারবে না বলে সব কাজ হাত থেকে টেনে নিয়ে করে দিয়েছে অতনু, সেটাই তার দোষ হয়ে গেল! ছেলেকে পড়ানো থেকে রান্নাবান্না সব কাজে সে উদাস, ছন্নছাড়া। তাই হয়ত অতনু তুমি পারবে না বলে একটু ধমকে উঠেছে, হয়ত একটু বেশিই ধমকেছে তাই বলে এমন প্রতিশোধ নেবে বিদিশা! ... ...
বনের ধারে রাখালি দোচালাখানি, বড় নিজের মনে হয় বুনোলতা, বুনোলতানো ফুল গাছ উঠে গেছে চালার উপরে নিদাঘের ভিতর এই ছায়াকুঞ্জ ... ...
এখন এই এক ঝামেলা হয়েছে। শীতটা পড়ার মুখে কেবল আকাশ ঢেকে যায় গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর চাদরে।কেউ বলে দেওয়ালির চটরপটর আতসবাজির কারণে এই ধোঁয়াশা। আবার কেউ বলে ভিন রাজ্যের গ্রামের কিষানরা শস্য কেটে নিয়ে শুকনো গোড়া নাকি পুড়িয়ে দেয়। সেখান থেকেই শহরে উড়ে আসে এই ধোঁয়া ধোঁয়া ছাই; সেই কারণেই এই দূষিত বাষ্পের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠে শহরবাসীর। ... ...
আমাদের কুচোরা পুজোর শতেক ব্যস্ততার মাঝেও বানিয়ে দিয়েছে গুরুর পুজো প্যান্ডেল। আসুন, বসুন, পেসাদ খান। দুগগি দেখুন। ... ...
পালানোর আরো জায়গা আছে। রিমঝিম নিজেদের ভাড়াফ্ল্যাটের বারান্দায় পালায় । বারান্দার গ্রিলের ফুটোগুলো বড় বড়। বাইরে গাছ, টুকরো আকাশ। তারে তারে মেলা কত না রঙের কাপড়, ওবাড়ির, সেবাড়ির। গাছে গাছে কতরকমের শেডের সবুজ পাতা, এলোমেলো, লাট খায়। তেমনি সব বারান্দাগুলো থেকে নিচে ঝুলিয়ে রাখা তারে শার্ট, প্যান্ট, ম্যাক্সি, এমনকি শীতের দিনে শাল কম্বলও, রঙ্গিন। ওখানে একবার গিয়ে পড়লে পালানো সোজা। কেউ বুঝতে পারবে না। দেখবে রিমঝিম বাড়িতেই আছে, বারান্দায় কাপড় মেলছে। অনেকক্ষণ ধরে কাপড় মেলছে তো মেলছেই । কেউ কিচ্ছু বুঝবে না। দেখবে রিমঝিম টুকরো, ফ্যাকাশে আকাশটার দিকে তাকিয়ে, নিভু নিভু শীর্ণ ডালটায় কচি সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে চুল মুছছে, চুল ঝাড়ছে, ঝাড়ছে তো ঝাড়ছেই। আসলে তো তখন রিমঝিম পালাচ্ছে। বাথরুমে স্নানে ঢুকে রিমঝিম বড় করে কল খুলে দিয়ে পালায়। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে পালায়। ঝর ঝর করে গায়ের উপরে ঝরতে থাকে জল, আর রিমঝিম তখন কোথায় হারিয়েছে। বড় বড় পাহাড় আর ঝরনার সামনে , সেই এক সবুজ, নরম পৃথিবীতে পালিয়ে গেছে। ছোট্টবেলায় দেখা লিরিল সাবানের বিজ্ঞাপনের মেয়েটার মত হয়ে। ... ...
সেদিন থেকেই শুরু। রাতের বেলায় উপর নীচ করতে থাকা ঘামাচি ভরা পিঠে হাত রেখে মালতী ভাবে উত্তমকুমারের পিঠে হাত রেখেছে। স্তনের মোচড়েও ব্যথা লাগে না আর। বরং শরীর গলে গলে পড়ে। সব থেমে গেলে তেলচিটে বালিশে মাথা রেখে বচ্চন মুখ হাঁ করে ঘুমায়। মুখের গড়ানো লালে বালিশ ভেজে। পাশে শুয়ে মালতীর কিছুই চোখে পড়ে না। ঠোঁটের উপর ঘামের বিন্দু জমে। আঙুলের ডগা দিয়ে আলতো হাতে মুছে দেয়। উত্তমকুমারের নরম ছোঁয়ার মত । ঘরে অলীক সুবাস ঘোরে। ইচ্ছে করেই বুকে কাপড় টানে না। একটুকরো চাঁদের আলো এসে পড়ে গলায়, পেটে, স্তনবৃন্তে। যেন ওই পুরু ঠোঁট ঘুরে বেড়ায় তার শরীরে। কল্পসুখে সে শিউরে শিউরে উঠে। তারপর কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। স্বপ্নে সুচিত্রাকে সরিয়ে দেয় মালতী, ঢুকে পড়ে উত্তমকুমারের বাহুর মধ্যে। উত্তমকুমারই অবশ্য থেকে যান। মাত্র দেড় বছরের মাথায় লাথি মেরে মেরে বচ্চন একদিন ঘর থেকে বার করে দেয়। ততদিনে ভাইরা ডাগর হয়েছে। নিজের নিজের কাজ-কর্ম শুরু করেছে। তারা দিদির পাশে দাঁড়ায়। বলে, “বাড়িতে এসে কদিন বসে থাক। দেখবি, সুড়সুড় করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আবার এসে তোকে নিয়ে যাবে।” প্রথম প্রথম মালতীও তাই ভাবে। কিন্তু দেখে বচ্চন ফেরত নিতে এলে, বাড়ির সকলের বিগলিত মুখ। আর শোনে, “মায়ের শরীর খারাপ, রান্নাবান্না নিয়ে বহুত ক্যাচাল। রোজ রোজ ভাল লাগে না। নাহলে কোন শ্লা ...।” আবার বচ্চনের হাত ধরে নদী পেরোয়, শ্বশুরবাড়ি যায়। শরীরের ঘা এতদিনে শুকিয়েছে। আরেকবার উত্তমকুমারকে আঁকড়ে ধরে হাত । ... ...
আই প্রোটেকশন কপালের ওপর ঠেলে তোলা, চোখ অ্যান্ড্রয়েডের স্ক্রীনে। হাই স্টুলে বসে টেক্সট পাঠাচ্ছিল টিনা। বাঁ পা নাচাচ্ছিল । ওর সামনে রিয়াকটর, অ্যাসিড ডোসিম্যাট। রিয়াকটারে মেটাল ওর আর জল। লিচিং চলছিল। টিনা অপারেটর। আট নম্বর টেক্সটটা পাঠানোর পর কম্পিউটারে চোখ যেতে খেয়াল হল টার্গেট পিএইচ সেট করা হয় নি । লগ শীট পড়েই দেখে নি । অনেক বেশি অ্যাসিড চলে গেছে রিয়াকটরে। আনামারিয়া প্রচন্ড ঝাড়বে । এই স্টেজে এত বেশি অ্যাসিড যাওয়া মানে টেস্ট ইজ কিলড। আনামারিয়াকে তো জবাবদিহি করতে হবে ওর বসের কাছে। বসকে ক্লায়েন্টের কাছে। জি এমএর কাছে। ডোসিম্যাটের রীডিং মুছে দিয়ে রিসেট করল টিনা, চোখ বুজে মনের মধ্যে একটা সংখ্যা খুঁজল। তারপর সেটাই বসিয়ে দিল লগশীটে। ধুলো আর জলই তো আফটার অল। তারপর আবার খুটখাট শুরু করল মোবাইলে। এই সময়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ল্যাবে ঢুকল আনামারিয়া। গলার সঙ্গে লেগে থাকা ক্রশ। সটান রিয়াকটারের সামনে এসে দাঁড়াল। বাঁদিকে সামান্য হেলে হাঁটে আনামারিয়া; কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ডোসিম্যাটের দিকে। ভুরু কোঁচকালো। ওর কোঁচকানো ভুরু শুঁয়োপোকার মত দেখায়। টিনার দিকে ফিরে বলল, এক ঘন্টা হয়ে গেছে রিয়াকশনের আর মাত্র এইটুকু অ্যাসিড গেছে? ... ...
নাহ্...আর ভাবিবে না দুলালী বেওয়া! আর কিছু মনে করিবে না! টোকানি তখন ছয় বছরের। টোকানির হাত ধরে সে, রঞ্জিতা মুর্মু আর ধিরতুর বউ শান্তি কুমারী বর্মন মিলে ছুটেছিল চোদ্দ মাইল মূল সড়কের সামনে। সেখানে তার বড় বেটি কুড়ানী যে ছিল। ভ্যানগাড়ির উপর হাত-পা মেলে। মুখে রক্ত। টোকানি হাতে তালি দিয়ে বলেছিল, ‘বুবু- বুবু এ্যাংকা ঘুমায় রছে, মাও!’ আর তখন মেয়ের সদ্য ওঠা দুই কিশোরী বুকের মাঝে মুখ গুঁজে সে যেমন চিৎকার করেছিল, তেমন চিৎকারই কি ভেসে আসছে বর্মন পাড়া থেকে? কার্তিকের দুপুরে চিল ছানা হারিয়ে ফেলা সোনালী রঙা মা চিলের আর্তনাদের মত? টোকানি ঘুমে কাদা। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে মা-মেয়ে এক সাথে ছুটবে নাকি দুলালী একাই যাবে? আল্লা চাহে ত’ টোকানির কোন ক্ষতি হবে না। কোন বাঘডাঁশ এসে তার এই হাঁসের ছানার মত মেয়ের পালকে কামড় দেবে না! আল্লাহ চাহে তো? বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে সেই মাঝ রাতে সে ছুটেছিল শান্তি-ধিরতুদের বাড়ি। শান্তি দুলালীর ছোট বেলার সই। মাটির শিব গড়ে ভাল বরের পূজা করতে করতেই ধিরতুকে তার ভাল লেগেছিল। শান্তির বিবাহ ঠিক হয়েছিল অংপুর শহরে ‘নিউ লক্ষ্মী বস্ত্রভান্ডার’-এর আড়তদার লক্ষ্মীনারায়ণ বর্মনের সাথে। কিন্তু অন্ধ হলেও দারুণ ফর্সা ধিরতুর কম্পনহীন সবুজাভ-নীলচে চোখের মণি, একহারা দীর্ঘ গড়ন টেনেছিল শান্তিকে। গায়ে হলুদের সন্ধ্যায় হবু শাশুড়ি সন্ধ্যামালতী মাসীর পায়ে পড়ে সে কেঁদেছিল। পাজি দুলালীরা এ নিয়ে শান্তি কুমারীকেও কম কথা শুনায় নি, ‘তুই এ্যালা গান্ধারির মতো চোখে একখান কাপড় বান্ধিব্যি শান্তি? তোর বরের যে চক্ষু নাই! গান্ধারির মত একশ’ চ্যাংড়ার মা হবি?’ শান্তি কুমারী এ কথার উত্তরে হাত জোড়া করে কপালের কাছে নমস্কার করে বলতো, ‘ওনারা স্বর্গের দেবী।’ ... ...
সকালগুলো মনোরম এ সময়। বাতাসের গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করে। উৎসবের ফুল শিশিরভেজা ঘাসে ছড়িয়ে দেয় গাছ, একটা মনকেমনের সুগন্ধ শরীরময় আনচান করে। এসময় সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়তেও আলস্যি নেই। গ্রামের বাড়িতে থাকলে পুকুরঘাটের ভাঙা পাথরের ধাপে বসে জলে ভাসা কুয়াশা দেখতাম। সেই কুয়াশা কেমন মৃদু বাতাসে ধোঁয়া কেটে কেটে উড়ে গিয়ে স্থির হত ওপারে শুরু হওয়া হৈমন্তী ধান-জমির এক মাথায়। রাতের জল লেগে আছে ধানের শিষের আনত শিরে, যেন ঘুমভার জড়িয়ে আছে সারা খেতে । কবে পড়া ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’-র লাইনগুলি মনে পড়ে, ‘কোলে ধান, কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা চুঁইয়ে শিশিরের একেকটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরও গাঢ় হয়।’ সদ্য কচি ধানে দুধ আসার সময় ধানের ভারী ঘুম হয়। তার আগে দীর্ঘ শ্রমের ইতিবৃত্ত। মাটি তৈরি হবে বলে কৃষক তার ভাঙা গাল নিয়ে নীচে নয় আকাশের দিকে তাকায়। শুরুতে কয়েক পশলা বৃষ্টি পেলে মাটির কঠোর বুক ভেজে, নরম হয়। লাঙল দিতে সহজ তখন। এক ফসল তুলে নিয়ে আর-এক বোনার আগে জমিতে থেকে যায় কেটে নেওয়া ফসলের অবশেষ। খড়ের নড়ার গোড়ায় জল পেলে সে মাটি চষতে কষ্ট নেই। তবু এক-এক শীতের সন্ধ্যায় জমির পর জমিতে ধু ধু আগুন জ্বলে, নড়ায় ধরানো আগুন। চাষির অন্ধবিশ্বাসে নড়ার ছাই জমিতে মিশে উর্বর হয়! সন্ধে-নামা বাতাসে তার ধোঁয়া কুয়াশার মতোই স্থির হয়ে থাকে বহুক্ষণ। ... ...
ইদের দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ যেটা, মানে নামাজটা পড়ার পরে যখন ইদের আর কোন আইনকানুন থাকে না তখন যা থেকে যায় তা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া! এক মাস রোজা রাখার পরে মুখ খুলে গেল, এবার খাও। এই খাওয়ার নানা তরিকা আছে, নানা রঙের আছে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গেলেই চেহারা ভিন্ন হয়ে যায়। ... ...
দেড়শো বছরের পুরোনো অশথ তলা এসে গেল। পুরোহিত মশাই-- সইত্য পুরোইত -- এসে গুছিয়ে নিয়েছেন। এবার পূজো শুরু। বেশ ঘটাপটা করে মন্ত্র ফলমূলের নৈবিদ্য দিয়ে সময়সাপেক্ষ পূজো। প্রতিবারই কেউ না কেউ সংক্ষেপ করার আবেদন জানায় এবং " সইত্য ঠাকুর " সেটি মঞ্জুরও করেন। ছেলেদের কপালে হলুদ ছুঁইয়ে, হলুদ রঙের ষাট সুতো তাদের হাতে বেঁধে দেন। মেয়েদের বাঁহাতে তাগা বাঁধা হয়। উলু আর শাঁখ ঘনঘন বেজে ওঠে। এবার শুরু হবে ব্রতকথা। ... ...
আলমারিটা তোলার সময় সেরকম কোন তোড়ফোঁড় হয়নি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামানোর সময় আলমারির ধাক্কায় একতলার একটা দেওয়ালের গা থেকে কিছুটা সিমেন্টের চটা উঠে গেছিল। তবে ঠিক সেদিন ফাটলটা অবধেশদের চোখে পড়েনি। চোখে পড়লে দুচারটে খিস্তি অবশ্যই দিত মজুরগুলোকে। আগে খুব মুখ খারাপ করত অবধেশ। এখন ছেলে বড় হতে গালি দেবার অভ্যেসটা খানিক কমিয়েছে। ... ...
মেধাবী ছাত্র চঞ্চলকে এভাবে বছর বছর ফেল করতে দেখে তার বাবা চিন্তিত হলেন। তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ফলে রোগ নির্নয় করতে ভুল করলেন না। তিনি রাগা রাগী করলেন না। পঞ্চমীদের বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এলেন না। শুধু মেডিকেল কলেজের হোস্টেল সুপারের সাথে আলোচনা করে মেন হোস্টেলে চঞ্চলের জন্য একটি বেডের বন্দবস্ত করলেন। নিজে গাড়ি করে বিছানা পত্তর আর বই খাতা সমেত চঞ্চলকে হোস্টেলে রেখে এলেন। ... ...
প্রথমদিন তোমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে লেগেছিল হার্ডলি সাঁইত্রিশ সেকেন্ড, কিন্তু মাথার অ্যালবামে পজ বাটনের প্রিভিলেজ আছে। কারও রসিকতায় হেসে ওঠার মুহূর্তটায় তোমাকে স্থির করে দিই। ঠোঁট নয়, গলা নয়, শরীরের ভরকেন্দ্র থেকে ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে এসেছে তোমার হাসি যেমন আসে, কক্ষপথ থেকে ছিটকে দেয়, পতন সামলাতে তোমাকে আশেপাশের কাউকে বা কিছুকে আঁকড়ে ধরতে হয়। এগিয়ে যাই। এত কাছে যাতে আমার নিঃশ্বাসে তোমার ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল উড়তে পারে। প্রদক্ষিণ করি। মনোযোগ দিই গ্রীবার বাঁকে। বোজা চোখের পলকে। দাঁতের সুসংবদ্ধ শুভ্রতায়। জিভের গোলাপি আভায়। কাঁপুনি ধরে প্রতিটি রোমকূপে। শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর জাগে। জানালার ওপারে আমগাছের মাথায় গনগনে চাঁদ। পূর্ণিমা আসন্ন, বা সদ্য গত। সে গলন্ত সোনার আঁচে শুয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ছাই হয়ে যাই। ... ...
নাজমা বিকেল হলে দোতলার ছাতে আসবে। তারিক একথা জানে। তিতুও। এছাড়াও তারিক জানে, নাজমা স্কুলে কখন বেরুবে, আর, সেই সময়ে তার গায়ে থাকবে একটা অব্যর্থ লালচে টিউনিক। ওই সময়ে, নাজমা, তিতুকে সে বলেছে, একদম নীলমের মাফিক। নীলম, নীলম। চাংকি পান্ডের হিরোইন। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো পরিহিত হিলহিলে চাংকি। ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে হাসতে হাসতে নাচে নীলম। উজ্জ্বল নীলম। লাল ফিতে চুলে বাঁধা থাকে তার। গায়ে লাল ফ্রক। পায়ে যেমন জুতো থাকে সেরকম জুতো সে যদিও নাজমার পায়ে দেখেনি। সত্য বোসের বেটি পরে অমন হিলতোলা জুতা, অমন ফ্রক। কিন্তু, দশটায় টিউনিক গায়ে যখন নাজমা বেরুবে, তখন সে আদতে নীলম। ওই সময় তার পথের একপাশে বসে থাকবেই তারিক, হয় হরলালের পুকুরের ধারে, নয় রাস্তাটা যেখানে বাঁক নেয়, সেই তুঁতগাছের নীচে, কোনোদিন তিতু সঙ্গে থাকবে, কোনোদিন সে একা, কিন্তু ওই সময়ে নাজমার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য দেখবেই তারিক। একই দৃশ্য, তবুও কেন যে নতুন মনে হয়! তার যাওয়ার পরে সঙ্গে তিতু থাকলে তারিক বলবেই, কেমন দেখলি, আজ? আর হয়ত এমনই চাপাগলায় কথাবার্তা হবে তার ও তিতুর: ... ...
শ্রীধর তো মানুষই না। সে তো তার থেকে হায়ারার্কিতে অনেক অনেক নীচে। মধ্যিখানে আছে নাজির টাকলুবাবু, মানে শ্রী নিশিকান্ত পরিজা, যিনি রঙিন পর্দা থেকে রেফ্রিজারেটর নাজিরিপনা করে ম্যাডামের সামনে দাখিল করবেন। বিশাল চুনকাম করা বাংলোর প্রতি ঘরে তীব্র চুনকামের গন্ধে মাথা ধরে যায়। তিনটে বাথরুম-পায়খানার একটা পায়খানায় এক-একদিন হেগে দেখা যায় তিনটের মধ্যে দুটোরই নিকাশি নালা বন্ধ হয়ে আছে। ফ্লাশ করলে মল যাচ্ছে না। সে কী ট্রমা, আবার ফোন করে পারিজাকে ঝাড়ে সু। প্লাম্বার ডাকে পারিজাবাবু। ওভারহেড ট্যাংকি থেকে জল ঝরছে তো ঝরছেই। বেওয়ারিশ কুকুরে বেড়ালে বাড়িতে এসে যেখানে সেখানে বসে থাকছে। ইঁদুরেরা সোফার ভেতরে বাসা করে সমস্ত স্পঞ্জ গদি কুটিকুটি করে ফেলছে। ... ...
চেম্বারটির সাথেই একটা জানালা ছিল, সে জানালাটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মোরসালিন। শম্পা চলে যাওয়ার পর ফাইলগুলো নিয়ে বসেছিল, এর মধ্যে তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, একটি বিশাল বিজনেস প্লান, কোম্পানির এই শাখা অফিসটার চেহারা একাই বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কিছুদূর যেয়ে মাথাটা গুলিয়ে গিয়েছিল! এত দিন ধরে মেহনত করেছে যার জন্য, যার পুরো রূপরেখাটা তার দেয়া, সেই কাঠামোটাই যেন খুব অচেনা লেগেছিল, আর মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছিল। জানালাটার বাইরে তখন চলচ্চিত্রের রিলের মত ছুটে চলেছিল মানুষ, যানবাহন। এমনকি একটা নেড়ি কুকুরকেও রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ুতে দেখা গেল, কি এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে রয়েছে যেন সে, কিসের যেন এক তাড়া! এমনই এক তীব্র চলার স্রোত জানালার নীচের রাস্তাটিতে যে মনে হয়, জড় দোকানপাট ও বিপনিবিতানগুলোরও চাকা গজিয়েছে! ... ...
তা হলে, শ্রীরাম কি শরতে যুদ্ধ করেন নি? এই নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে৷ কারণ, বিন্ধ্যের দক্ষিণে এই পুজো করলেও তার আগে অযোধ্যায় দুর্গাপুজোর উল্লেখ কোনও রামায়ণে নেই৷ বাল্মিকী রামায়নে অকালবোধনই নেই৷ এমন কি, বনবাসের আগে বা পরেও কখনও তিনি অযোদ্ধায় দুর্গা পুজো করেছেন বলে কোনো উল্লেখ নেই। ... ...