বাঙালি চলেছে বাগানে। রিলকের ভাষায় মাধ্বী মহোৎসবে! দূরন্ত তাদের সাজ। কফ ও কলারওয়ালা কামিজ। রূপোর বকলস আঁটা শাইনিং লেদারে যেন মুখ দেখা যায়। রেস্ত যাদের কম, তাদের পায়ে ইন্ডিয়া রাবার ও চায়না কোট। এলবার্ট ফ্যাশানের বাঁকা টেরি তে কাটা সিঁথি। উত্তুরে হাওয়া যদি দেয় তবে ক্রেপ বা এন্ডির চাদরও।সদ্য পাশ হওয়া আইনের চুলোর দোরে আগুন। মদের দোকানের সদর দরজা সন্ধ্যের পর বন্ধ, তো হয়েছেটা কী? সেই দুঃখে বঙ্গপুঙ্গবেরা কি খালি হাতে ফিরবেন নিজ গৃহে? নিজ শয্যায়? নিজ স্ত্রী সান্নিধ্যে? এমন অলুক্ষুণে কাজ হয় নাকি বাপু! না, খদ্দেররা খালি হাতে ফিরছেন না। পাঠক এ সেই সুসময়, যার বর্ণনায়, টেকচাঁদ ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘কলিকাতার যেখানে যাওয়া যায়, সেইখানেই মদ খাওয়ার ঘটা। কি দুঃখী, কি বড় মানুষ, কি যুবা, কি বৃদ্ধ সকলেই মদ পাইলে অন্ন ত্যাগ করে’। জোড়াসাঁকোর ঠেকের দরজা খোলা অনেক রাত পর্যন্ত। মেছোবাজারেরও। সর্বত্র ফরফর করে ফুটছে ইংরেজি মিশেল বাংলার খই। ফুটছে রাতচরা হুল্লোড়, বটকেরা। শৌখিন কুঠিওয়ালা সাহেবরা একটু জলযোগ সেরে বসেছেন এস্রাজটি নিয়ে। রেস্তহীন গুলিখোর গেঁজেরল মাতালরা আর করে কী। লাঠি হাতে তাদের অনেকেই কানা সেজে ঘুরছে মৌতাতের সম্বলটুকু খুঁজতে। ‘অন্ধকে কিছু দান করো গো বাপ’ – তাদের সেই করূণ কন্ঠস্বর ছাপিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দুপাশের বাড়ীর কিছু খেমটার তালিমের আওয়াজে। তা তা ধিন তা। শনিবার মহারাত এগোচ্ছে রবিবার ভোরের দিকে। সুতানুটির পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসে মিলে মিশে গিয়েছে কোহল, বেলি আর আতরের গন্ধ। ... ...
মারাঠীতে নাকুশা মানে নাকি অবাঞ্ছিত বা অপয়া, বিনীতা বলেছিল। নাকুশার মা তখন ওদের ঘর ঝাড়ুপোছা আর বাসন সাফ করত। তারপর তো মা’টা মরেই গেল আর নাক্কিকে এলাকার এক কর্পোরেটার লাগিয়ে দিল পাহাড় পাতলা করার কাজে। চুপচাপ গিয়ে রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠে মাটি কেটে কেটে জমা করবে আর হপ্তায় একদিন কর্পোরেটারের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে জমা করা মাটি। এমনি করে করে পাহাড়টা যখন রোগা হয়ে যাবে, বেঁটে হয়ে যাবে, পাহাড় বলে আর চেনা যাবে না, তখন কর্পোরেটার এসে সেখানে মস্ত আলিশান সব বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। নাক্কিয়া তদ্দিনে বড়সড় হয়ে সেই সব বাড়িতে কামওয়ালি বাঈ হয়ে কাজে লেগে যেতে পারবে, চাই কি বিয়ে শাদিও হয়ে যেতে পারে। ... ...
ফড়িংচাঁদরা যেদেশে থাকতেন, বেস্পতি নামটা সেখানকার । এর সঙ্গে নির্দেশ করা হতো বিভিন্ন যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রচনায় খেলানো পৌরাণিক চরিত্রকে। সে দেশের সনাতন সাহিত্যমতে বেস্পতি তাদের বৈদিক যুগের একজন ঋষি, যিনি দেবতাদের পরামর্শ দিতেন। মধ্যযুগের বইতে এই বেস্পতি গ্রহকেও ইঙ্গিত করত। বৈদিক বইতে উনি হলেন বাগ্মিতার দেবতা, আর কখনও কখনও তাঁকে অগ্নিদেবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতো প্রাণবায়ুরা।ঋগবেদে লিখেছিল, কে যে লিখেছিল কে জানে, পৃথিবীর প্রথম উজ্জ্বল আর পবিত্র মহাআলোক থেকে বেস্পতির জন্ম যিনি সব অন্ধকার দূর করে দ্যান । কোথাও কোথাও তার মূর্তি দেখেছে ফড়িংচাঁদ, হাতে দন্ড ও পদ্ম আর জপমালা, আরেকটা পুরাণে প্রাণবায়ুরা লিখেছিল বেস্পতি তারাকে বিয়ে করেছিলেন আর সেই তারাকে নাকি চাঁদ কিডন্যাপ করে একটা ছেলে পয়দা করে তার নাম বুধ। ব্রহ্মা চাঁদের উপর চাপ দিয়ে তারাকে তাঁর স্বামী বেস্পতির কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন। ফড়িংচাঁদরা কুলকিনারা পান না যে এতো পাওয়ারফুল হয়েও বেস্পতি কেন বদলা নেয়নি । ... ...
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল সে। চোখের সামনে আকাশ ধীরে ধীরে বেগুনি হয়ে ওঠে। আলতা রঙের পোঁচ পড়ে তার উপর। শুধু জনারণ্যে কিছু ঘুড়ি, পাখিদের প্রতিনিধি। গঠন নয়, ঘুড়ি চেনা যায় তার উড্ডয়ন-কৌশলে। উদ্বাস্তু কলোনি থেকে চাক চাক ধোঁয়া, যেন নোয়াঠাকুমার আর্তি, খুঁজে নেয় আলপথ—ফরিদপুর। তাদের গতিপথ বিভ্রান্ত সরল, অর্থাৎ বক্র। গুলের আঁচ ওঠা উনুন—খানিক উপরে বুড়ির দু'টো চোখ আর ফুলে ওঠা টিকোলো নাক এক প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে, যা আকারে ক্রমশ বড় হতে থাকে। মাথার ভিতর শৃঙ্খলিত ধ্বনি, রঙ আর হঠাতই কালো হয়ে ওঠে আকাশ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু, সব সত্যি। সবচেয়ে বড় সত্য এই রাত, তার বেদনা, যা কেবল অনুবাদে সাবলীল... কুকুরেরা জেনে গেছে সব। সন্ধ্যার আজান আর মিলিটারি রুট মার্চ পরপর শুনে নমনীয় করে তোলে নিজেদের। স্থির হয়। সঙ্গম স্থগিত রাখে আজ। ... ...
আসলে কীভাবে শুরু করবো সেটা নিয়ে গড়িমসি হয়ে গেল বহুদিন। কিভাবে লিখলে লেখাটা চলবে...লোকে পড়বে...বলবে ভালো...তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য মাল মশলা মজুত করা নেই হাতে। তথ্য সন্ধানমূলক লেখার যে ব্যাপ্তি আশা করা যেত সেটাও পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। পড়া হয় না অনেক দিন অনেক কিছু...ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে সব... ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমকাল...আর কোথাও যেন সেঁধিয়ে থাকার মন্ত্রনা কানে এসে ফিস- ফিস, গুণ- গুণ করে। এলোমেলো পাতা উড়ে আসে...মোবাইলের রিং টোন...এস এম এসের বিপ বিপ...সূড়ঙ্গের অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে গন্ধ...মিলেমিশে একাকার কাব্যিক উত্থানের গলা টিপে ধরে। জলের তোড় এগিয়ে আসে...অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করা যায় না...কিন্তু জলের তোড় এগিয়ে আসে...। ... ...
দুর্গাপুজোর সময় থেকেই আপনারা নিশ্চই এরকম অনেক ছবি দেখেছেন যেখানে মডেলরা বিভিন্ন দেবীর সাজে ছবি তুলেছেন। সেরকম কিছু ছবি দেখে আপনারা নাক সিঁটকেছেন, কিছু দেখে ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন. কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এই লেখার সঙ্গে যে ছবিগুলি আছে সেরকম আপনারা আগে কোথাও দেখেননি। কেন বলুন তো? এই ছবিগুলোর যিনি মডেল তিনি কোনো মহিলা নন বরং একজন পুরুষ। তাঁর নাম সৌরভ গোস্বামী। কী, একটু চমকে গেলেন তো? চমকানোরই কথা! এই চমক, এই ব্যতিক্রম দিয়েই শেষ হল এবারের উৎসব সংখ্যা। ... ...
সুখী দিদি ঘাসের উপর দিয়ে ঝরা পাতার উপর দিয়ে ছায়ার উপর দিয়ে খণ্ড খণ্ড নৈশব্দের মধ্যে দিয়ে ছবির বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেছে। সাধু পরমানন্দের বাড়ির পিছনের বাড়িটিতে। ওই বাড়িটিতে সুখী দিদির ছোট একটি ঘর। জং ধরা চালে নীলমণি লতা। দুখীরাম সেই কবে এনেছিল। তাদের পুকুরটিতে গোহাটের গরুগুলি মুখ দেখে আর জল খায়। হাম্বা করে ডাক দেয়। সুখী দিদি এই ছবির বাগান থেকে এই বাড়িটিতে যেতে যেতে তার পায়ের ছাপটি ফেলে যাচ্ছে ঘাসের উপরে। সেখান থেকে জোনাকি পোকার মত মৃদু মৃদু আলো বেরুচ্ছে। আর এই দেখে লিকলিকে লোকটির দুচোখ বেরিয়ে এসেছে। গলা থেকে বেরুচ্ছে গর গর শব্দ। সাধু পরমানন্দের বৌ কমলা দিদিমণি রান্না বান্না ফেলে দৌড়ে এসেছে । লোকটিকে পেছন থেকে টেনে ধরল। লোকটির গলার রগ ফুলে উঠেছে। কপালে ঘাম। ছুটে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু সত্যি সত্যি যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সুখী দিদির নাম ধরে ডেকে যাওয়াই তার জন্য ভয়াবহ এবং একমাত্র নিয়তি। কমলা দিদিমণি বলছে, মথি উদয়। মথি উদয়। ঘরে আয়। ঘরে আয় বাবা। যেতে যেতে ফিরে ফিরে ছবির বাগানটিকে দেখতে লাগল মথি উদয় নামের এই মানুষটি । বাগানের মধ্যেকার নতমুখী মানুষটিকে। তার চলে যাওয়াটিকে। উড়তে থাকা কালো কাকটিকে। সাধু পরমানন্দ তখনো সুর করে বলছে- -- ‘ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক; এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।‘ ... ...
চলার গতি বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে কোমরের দুলুনি। ওই দুলুনি জল বাঁচানোর জন্য। জল, খাবার জল। এই সোঁদরবনের গাঁ গেরামে বড়ো মহার্ঘ এই জল। কেউ একফোঁটা খরচ করে না অকারণে। করতে নেই। কেননা জল এখানে মাথা কুটলেও মিলবে না কোথাও। কেমন মজা বোঝো! মজাটি নিয়ে শরিফা আর ওর মিতেনি জীবন ঢালির বউ নেকি এক সময় খুব হাসাহাসি করত। জলের দেশের মেয়ে ওরা। জলের অভাব ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। মুখে বলেও, ধুস তাই আবার হয় নিকি! ভাত নি, কাপড় নি সে তো বুঝি, তা বলে পানি নি! শরিফার স্বামী ময়জুদ্দি হেসে বলে, হয় হয়। এটাই তো মজা র্যা। সোঁদরবনে পানি আছে, তবে লোনা, খাবার পানি খুব কম। হ্যাঁ, দেখেছে শরিফা, উলার চকে আট-আটটা টিউকল বসল। পানি উঠল বালি গোলা। খাওয়া দূরে থাক, মুখে দিলে ওয়াক থুঃ। পুকুরের পানি! সে তো তিন-চার মাস। খেলে পেটে ঘা হয়। বলে আর্সেনিক। তবে পানি কোথায়! হুই ডাঁসা নদী পার হও। ভবানীপুরে ডিপ টিউকল করেছে পঞ্চায়েত। সেখান থে পানি নে এসো। কিন্তু যাবে কীভাবে? বড়ো বাধা যে নদী। ছোটো-বড়ো নাও যা আছে, সব মাছ মারতে যায় বাদায়, চালানি যায় হাসনাবাদে। দু-একখানা নাও যা আছে, সেখানে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। কলসি-বালতি পিছু এক টাকা, নগদা-নগদি। টাকা দাও আর পানি নাও। কার আছে পয়সা! উলার চকের মানুষের চাষবাসের উপর জীবন। ছ-মাস কাজ, বাকি সময় জোন খাটো, নাও চালাও নয়তো বিশপুরের হাটে মাল বও। না হলে উঞ্ছবৃত্তি করে চালাও। তাই পানি নিয়ে চলে টানাপোড়েন। কখনও মারপিট, মেয়ে হলে ইজ্জতের উপর হামলা। অনন্ত ঢালির বউ আয়না এক কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে শরীরের রং ঢং দেখিয়ে মাঝিদের বশ করে পানি আনত। কিন্তু রসিক মাঝি সেয়ানা খুব, সুযোগ বুঝে একদিন হামলে পড়ল ওর উপর। আর আয়নাও তেমনি৷ ইজ্জত বাঁচাতে দিল হালের বাড়ি কষিয়ে। এক ঘায়ে কাত রসিক। আয়না এখন জেলে। ওর রুগ্ন ছেলেটা মা মা বলে উলার চকের আকাশ বাতাস ভারী করে চলেছে। ... ...
কয়েক বছর পরের পুজোয় সাইকেলে এক ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছি। অর্ধচেনা আবাসন এক। সেখানকার ওই একটি মানুষ চিনি তখন। সে যদিও জানত না তা, সেই সুবাদে অর্ধচেনা। আবাসনের ছোট পুজো, ইতস্তত শূন্য চেয়ার চক্রাকারে শিশির মেখে আড্ডা মারে। এক কোণে এক টেবিল ফ্যানের সামনে রাখা ঢাকের পাশেই কাঁথায় মোড়া ঢাকি কাঁসি ঘুমিয়ে কাদা। আলো ফুটেছে, গান ছিল কি? হবে হয়ত। মূর্তি ছিল একচালাতেই। আশে পাশে কিছু জানলার একটা বোধ সেই মানুষের। কিছুক্ষণই অনন্তময় শিরশিরানি শরীর জুড়ে। কোনও একটা জানলা ধারে একমনে এক শিউলি গাছটি বিমুর্ত এক আলপনা দেয় ঘাসের ওপর। কেউ না যেন দেখে আমায়, যদি বা কেউ শুধোয় কিছু? গলা শুকনো, বলব না হয় তেষ্টা পেয়েছে। মিথ্যে হবে? শিরশিরানি। আরও কয়েক বছর পরে একটা ঘরে ডুমের আলো, হলদে আলো। সেই প্রথমই একলা শোনা গানের কথায় শিরশিরানি। গানের সুরে গায়কীর এক মায়ার টানে শিরশিরানি। কিছু পরে প্যান্ডেলে এক জনপ্রিয় হিন্দি গানের কথার সঙ্গে অনুরণণ - বেদম ঝটকা। সংজ্ঞা হারায় - শিরশিরানি। এই এখনও আবহাওয়া যেমন করে হালকা হ'ল হঠাৎ করে, ভোরের দিকে পাতলা গোছের চাদর লাগে। অনেক দূরের থেকে আসা ভেসে আসা গানের লাইন, ঢাকের শব্দ, ভিড়ের গন্ধ সেন্ট জিলিপি সঙ্গে মিশেল এগরোল চাউ শিরশিরানি নৌকা করে আসতে থাকে সুদূর থেকে। একে একে পা রাখছেন এক এক বয়স, এক এক মানুষ। কী আনন্দ। ... ...
সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে মানুষ একটা ছবি হাতে নেয়; ফ্রেম থেকে খুলে, হাতের মুঠোয় পাকিয়ে ফেললে গোটানো ক্যানভাসকে রিলে দৌড়ের ব্যাটনের মত লাগে । তারপর কোথাও হুইশল বাজে, ব্যাটন হাতে সে এবার এক পা দু পা করে পিছু হটতে শুরু করে; একটু থামে , হাতের ছবি খুলে কিছু দেখে, পিছোয় আবার; তারপর হাঁটার গতি বাড়ে, একটা সময় স্প্রিন্ট টানে সে , উল্কার বেগে সম্পর্ক থেকে বহু দূরে চলে যায়। প্রতিটি শেষ হওয়া সম্পর্কের সঙ্গে একটা করে ছবি থাকে - আমার এরকম মনে হয়; ফ্রেমহীন ছবি সব - হয়তো পুরোনো সম্পর্কের ওয়াটার কালার - লাল রঙে চুবিয়ে তোলা, কিম্বা পরের সম্পর্কের ঝকঝকে প্রিন্ট- গ্লসি ফিনিশ; অথবা হয়তো গোটাটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট - একটা অবয়ব হয়তো, আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয় নৃত্যরত মানুষ, ডানা ঝাপটানো রাজহাঁস, ছুটন্ত ঘোড়া - কেশর উড়ছে; অথবা জাস্ট অন্ধকার, পিচ ডার্ক শূন্যতা। ... ...
জ্ঞান হওয়া ইস্তক শ্যামাপিসিমা কে দেখে এসেছি। একমাত্র দাদু তাকে ডাকতেন "কই গ্যালা, শ্যামা? " বলে। আর কারো বোধহয় শুধু নাম ধরে ডাকার অধিকার ছিল না ... হিম্মতও নয়। ঠাকুমা, ছোট ঠাকুমা কোন অদ্ভুত কারণে তাকে বেশ সমীহ করেই ডাকতেনঃ 'স্যাকরা বৌ ' বলে। বাবা-কাকা-পিসিরা ডাকতো 'শ্যামা দি ' আর আমরা বলতাম - 'শ্যামা পিসিমা '। উনি ঠাকুমাদের ডাকতেন বড়-মা , ছোট-মা নামে, বাবা-পিসিদের সরাসরি নাম ধরে আর আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না। একেবারে নিজের ইচ্ছেমতো নাম দিতেন ... এবং ২০০% বাঙ্গাল অ্যাকসেণ্টে। যে কোন কারণেই হোক সেই নাম গুলিও হতো প্রাক স্বাধীনতা আমলের নেতৃবৃন্দের স্মরণে। ... ...
আমার মনে হয় ২০২০ দেখে আমরা বুঝতে পারি মানুষ ইচ্ছে করলে কঠিন সময়েও প্রায় সব কিছু করতে পারে। ... ...
চাঁদপানা মেয়েটি আজ হাওয়াইয়ান ব্রিজ ও ল্যাভেন্ডারের মিশ্র সুবাস পরে এসেছে। এই সুবাস তৈরি হয়েছে বহুদূরের এক সমুদ্রশহরে ... ...
এখন এসব কথাবার্তা থেকে কি আমন ধানের ক্রপিং ইনটেনসিটি ক্যালকুলেট করা যায়? বিঘা প্রতি ইনটারনাল রেট অব রিটার্ন হিসাব করা যায়? অপটিমাম কস্ট বের করা যায়? ল্যাসপেয়ার্স ইনডেক্স কষা যায়? কস্ট-আউটপুট রেশিও বের করা যায়? অথচ ভারত সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, আই এম এফ জানতে চাইছে। ভাল হল যে সর্বজনীন ভাইরাল ফিভারে আমিও আক্রান্ত হলুম। টানা ছুটি। দাড়ি গজিয়ে গেল। হাত বুলিয়ে দাড়ি আদর করি। এই ফাঁকে, মুখে তো অফুরন্ত হাই, ছেলেমেয়েকে ওদের ছোটবেলায় যে জুনিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া কিনে দিয়েছিলুম, তার ছবি দেখে টাইমপাস। হাই তুলতে-তুলে দাড়ি খুঁজি। নানারকম জ্ঞানবিজ্ঞানের দাড়ি। ... ...
Tame birds sing of freedom, wild birds fly.... হাওয়াবিহীন দিনগুলিতে আকাশকে চুপসানো বেলুনের খণ্ড মনে হয় - ফ্রেমে আটকানো; যেদিন বাতাস ওঠে, নীল বেলুনের টুকরো ঢাউস শামিয়ানা হয়ে উড়তে থাকে, মেঘ আর ডানারা মোটিফ তৈরি করে - সাদা কালো লাল নীল মেঘ ছেনে ছোটো ডিঙি, বড় বড় পালতোলা নৌকো, বিশাল সব দুর্গ, হাতি, উট আর বুড়ো মানুষ। তার ওপর ঘুড়িরা লাট খায়, জেট চলে যাওয়ার ঘন সাদা লাইন ফিকে হতে হতেই একগুঁয়ে উড়োজাহাজরা উড়ে যায় আচমকা। পাখিরা চক্কর কাটে আর চক্কর কাটে, শেপ ফর্ম করে - ভি, ওয়াই, এম, এ, ডব্লিউ; কখনও তারা মানুষের কাছাকাছি নেমে আসে এমন, যেন ডানার কথা ভুলেই গিয়েছে। ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি- ডান হাত মাথার নিচে, বাঁ হাত শুরু হয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে, কাঁধের খুব কাছেই চেটো- তাতে তিনটে আঙুল। যেন ডানা। আমি হৃদয়রাম, পঁয়ত্রিশ বছরের এক্ট্রোড্যাকটাইলি পেশেন্ট। উড়তে পারি না অথচ বাঁ কাঁধে কারো হাত ঠেকলে খাঁচায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় পাই। আসলে এ'সবই ডানার গল্প। ... ...
বাড়ির পেছন দিকে ছিল একটা এঁদো ডোবা। আর ঘন ঘাস। এই ঘাস শুকিয়ে হয়েছিল আমাদের প্রিয় বিছানা। এই নরম গরম বিছানায় আমরা জড়াজড়ি ঘুমাতাম। আবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখতাম। সে সময় আমাদের একটি ছোটো বোন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও স্বপ্ন দেখতে জানত না। ... ...
আপনি যদি বিশালকায় হোল্ড -অল আর স্যুটকেস নিয়ে নেমেছেন তো লালজামা লালগামছা কুলিদের শরণাপন্ন হতেই হবে। আজকের নীল বা সবুজ জামা কোথায়? হারিয়ে যাবার ভয় নেই , সবার হাতে তাবিজের মত করে বাঁধা পেল্লায় এক একটি পেতলের চাকতি, তাতে নম্বর লেখা। ওটা মনে রাখলেই হবে। ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথ বা স্ট্যান্ড কিস্যু নেই। মিটারে যায়, শেয়ারে যায় । কখনও সামান্য দরাদরি। দুই থেকে পাঁচটাকায় হাওড়া থেকে পার্কসার্কাস। ... ...
"ঘরে চল, এইখানেই দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি ছেমড়ি?" হানিফার ডাকে হুঁশ ফেরে সাকিনার। ব্যাগটা তুলে হানিফার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে সে। ঘরের ভিতরটা কিছুটা বদলেছে বটে। উঠোনের ওপারে আগে কাঁটাগাছের বেড়া ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা। ওখানটায় একটা ঘর উঠেছে। পাকঘরটা ছিল ডান দিকে, বাম দিকে খালপাড়ে খাটা পায়খানা। এখন ওখানে পাকা পায়খানা হয়েছে, রাস্তাটায় একটু সিমেন্ট দেওয়া। রান্না হচ্ছে এদিকের বারান্দার এক কোনে, সেখানে দুটি বউ কাজ করছে। সম্ভবতঃ জলিল আর খলিলের বিবি ওরা। ওদের আসতে দেখে একটু অবাক হয় দুজনেই। তাদের কাছে ডাকে হানিফা, "এই দেখ ছেমড়িরা, আমার একখান মাইয়া আছে কইছিলাম না? এই হইল সাকিনা বানু - আমার সই জারিনার মাইয়া। কিন্তু আসলে আমারই। ছালাম কর" ... ...
নীল কপোতাক্ষ। টলটলে। আলপাইন বন। সুইশ আল্পসের মাথায় বরফ জমে আছে। নির্ভেজাল সুন্দরী। সে সুন্দরী বসেছিল নন্দানো সোপ্রানোর জন্য। আমরা ব্যাগ মাটিতে ফেলে দৌড়ে তার কাছে চলে গেলাম। ছবিতে দুটো ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। ধুমসোটা আমার, ওর মধ্যে ওই ঘ্যাঁট থুড়ি স্ম্যাশড ইত্যাদি আছে। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ উঠছে জলে। মৃদু বাতাসে তিরতির করে সেই জল কাঁপছে। স্বর্গের হাঁসেরা মা সরস্বতীর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দু-দণ্ড খেলে বেড়াচ্ছে। আমরা কথা ভুলে গেছি। ... ...