এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ১১

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫৬ বার পঠিত
  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ১১

    অমিত

    আর্থিকভাবে  একটু গুছিয়ে নেওয়ার পর বাসা বদল করে সিঁথিতে চলে এলাম। আমার এক সহকর্মী ব্যবস্থা করে  দিয়েছিল। আগেরটার তুলনায় অনেকটা বড় ফ্ল্যাট। দুটো বড় আর একটা ছোট ঘর, মাঝারি ড্রইং রুম, দুটো টয়লেট, একটা কিচেন আর দুটো ঘরের সাথেই আছে ঝুল বারান্দা। দোতলায় পুব আর দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট। এক কথায় সর্বাঙ্গসুন্দর, তাই ভাড়াটা একটু বেশি হলেও চলে এলাম। বাবা, মা ভাই বোনেরা কলকাতায় এলে একটু আরাম করে থাকতে পারবে। বাড়িওয়ালা দোতলাতেই একেবারে আমার সামনা সামনি ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক থাকেন। ওনাদের ছেলে বাইরে কোথাও চাকরি করে। কমল বাবুরা দুজনেই মানুষ খুব ভাল। কমল বাবু শিক্ষিত লোক, এক বেসরকারি কোম্পানির উঁচু পদে ছিলেন। বছর দশেক হল রিটায়ার করেছেন। প্রথম দিকে বাবু সম্বোধন করলেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিক নিয়মেই ওনারা হয়ে গেলেন আমার কমল কাকু আর বীণা কাকিমা। সম্পর্কটা পরে  বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের ছিল না, ওনারা আমাকে সন্তান তুল্য স্নেহ করতেন। বিয়ের আগে ছুটিছাটার দিনে  আমার খাওয়াটা ওনাদের ওখানেই বরাদ্দ ছিল। প্রথমে মাঝে সাঝে  এক আধ দিন খেতাম, পরে তা নিত্যকার ঘটনা হয়ে  দাঁড়াল। সঙ্কোচের কারণে পাশ কাটাতে চাইলে দুঃখ পেতেন, অভিমান করতেন।  আমি চেষ্টা করতাম ওনাদের অসুখ বিসুখ করলে সাধ্যমত পাশে থাকতে। যদিও এই লেনদেনে পাওয়ার পাল্লাটা সবসময়ে আমার দিকেই ঝুলে থাকত। ছেলের কথা দু একবার সৌজন্যবশত জিজ্ঞেস করাতে ওনাদের দুজনকেই একটু বিচলিত আর বিমর্ষ মনে হয়েছে। ফলে ওই প্রসঙ্গ আর উত্থাপন করিনি।

    একটা ছুটির দিন কমল কাকুর ফ্ল্যাটে  গল্প করছি, কাকিমা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না।  দিলখোলা রসিক মানুষ, কথা বলে সুখ আছে।  গল্প করতে করতে কমল কাকু সেদিন নিজের খেয়ালেই   ছেলের কথা বলে ফেললেন---তোমাকে একটা মিথ্যে কথা আমরা বলেছি। ছেলে আমার বাইরে থাকে ঠিকই তবে তা  চাকরির কারণে নয়।  উত্তম আমাদের একমাত্র সন্তান, তাই  স্বাভাবিক ভাবে বেশি আদর যত্নে মানুষ। ওই যাকে প্যাম্পার্ড চাইল্ড বলে আর কি। বয়সে ও তোমার থেকে কিছুটা বড়। ছোটবেলা থেকেই আঁকার হাতটা খুব ভাল ছিল। আঁকার জন্য নানা জায়গা থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছে।   লেখাপড়ায় না ভাল না মন্দ। মিশুকে না হওয়ার জন্য বন্ধু বান্ধবও  তেমন একটা ছিল না।  মোটামুটি একটা রেজাল্ট করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার  পর বেশ কিছু অর্থ গুঁজে ছেলেকে একটা  ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দিই। বাড়ি থেকেই যাতায়াত করত। বছর দুয়েক পর  থেকে ছেলের আচার আচরণে ধীরে ধীরে কেমন একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল। সময়ে বাড়ি ফেরে না। কোন কোনদিন তো বাড়ি ফেরেই না, কলেজের  হোস্টেলে থেকে যায়। জিজ্ঞেস করলে এলোমেলো  উত্তর দেয়। আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এদিক ওদিক থেকে খবর নিয়ে ভাসা ভাসা কানে এল যে উত্তম কোন অতি বামপন্থী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। একদিন আমি অনেক বোঝালাম, ওর মাও  কান্নাকাটি করে ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ওর মাথায় তখন বাপ মায়ের কাতর আবেদনকে অ্যাকোমোডেট করার মত জায়গা ছিল না। একদিন আমাদের কিছু না বলে লেখাপড়া ছেড়ে, আমাদের  ছেড়ে, হারিয়ে গেল  অনির্দিষ্টের পথে। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে পুলিস এল, কড়া ভাবে জেরা করল। মনোমত উত্তর না পেয়ে হুমকি দিয়ে আর অনেক কুকথা শুনিয়ে চলে গেল। হজম করলাম। যেন অমিত, সত্তর দশকে  আমার সমসাময়িক পরিচিত দুজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রকে সেই সময়ের উত্তাল বামপন্থী আন্দোলনের শরিক হয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় শামিল হতে দেখেছিলাম। তাদেরকে অনুসরণ করে আরো অনেক সাধারণ ছাত্র ছাত্রী যোগ দিয়েছিল সেই আন্দোলনে। আজ তাদের একজন  বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নামি প্রতিষ্ঠানে   প্রথিতযশা অধ্যাপক। ঘরণীও এসেছে এক উচ্চবিত্ত ঘর থেকে। আর অপরজন এক নামি তথাকথিত বুর্জোয়া সংবাদপত্রের উচ্চপদ অলংকৃত করে রয়েছে। এঁরা এখনও বক্তব্য রাখেন, ওজনদার লেখালিখি করেন। যে ব্যবস্থা নির্মূল করতে একসময় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আজ আয়েশ করে বসে আছেন তারই সিংহাসনে।  এরা মেধাবী, চিন্তা ভাবনার পরিবর্তনের সাথে সাথে নীতি আর পথ পরিবর্তন করতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু এদের যারা ফলোয়ার ছিল, জীবনের অনেকটা দুর্মূল্য সময় কেটে যাওয়ার পর সাধারণ মেধা নিয়ে  সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে ফিরে এসে  সমাজের খরস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে রাখাটা তাদের পক্ষে  প্রায় দুঃসাধ্য ছিল। আমার ছেলে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর, তাই ভয়টা ছিল আরো বেশি। নিজের অজ্ঞাতবাস থেকে উত্তম একবার মাত্র ফোন করেছিল। আর বার দুয়েক ওদের দলের একজন  যোগাযোগ করেছিল ওর কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে জিনিসপত্রের সাথে বেশ কিছু টাকাও ছেলেটির হাতে দিয়েছিলাম। যাই হয়ে থাকুক না কেন সন্তানের অনাহার কোন মা বাপই সহ্য করতে পারে না। এর পরেও বেশ কিছুদিন পুলিশের লোকজন এসে হম্বিতম্বি করে গেছে। এখন অনেক দিন আর তারা আসে না। অনেক খারাপের মধ্যেও কিছু আশা লুকিয়ে থাকে। ছেলেটা যে আমার বেঁচে আছে সেটা নিশ্চিত করত পুলিশের  ওই চোখ রাঙ্গানি। আজ হয়ত প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাই ওরা  আর আসে না।
    তাকিয়ে দেখি কাকুর চোখে জল। কষ্ট হল, কাছে গিয়ে শান্ত্বনা দিলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু স্বাভাবিক হয়ে বললেন, “দেখ দিখি, তোমার ছুটির দিনের সকালটা নষ্ট করে দিলাম। এইসব দুঃখ কষ্ট নিরন্তর ভেতরে পাক খায়। মনের ব্যাথা উগরোতে পারলে সাময়িক কিছুটা উপশম হয়। তুমি আমার আপন জন তাই শেয়ার করলাম, তা না হলে এ কথা তো লোকের কাছে গল্প করার  নয়।”
    অল্প সময়েই ফিরে এলেন চেনা ছন্দে। হাসিখুশি সুন্দর মানুষটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার ভেতরে এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট।
    বিয়ের আগে প্রথমবার যেদিন  অর্চনা এই বাড়িতে এসেছিল কাকু কাকিমার সাথে ওর সঠিক  পরিচয়  দিয়েই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।  ওনারা ওকে দেখে খুব খুশি। সারাদিন ভালমন্দ খাইয়ে, গল্পগাছা করে, ওকে নিজেদের কাছে আটকে রেখে  দিয়েছিলেন। অর্চনা ফিরে যাওয়ার আগে কাকু একদম আদেশের সুরে বললেন, “ছুটিছাটার দিনে সময় সুযোগ পেলেই  সক্কাল সক্কাল  চলে আসবে। মাকেও সঙ্গে নিয়ে আসবে। সারাদিন সকলে গুছিয়ে আড্ডা দেব। অবশ্য আমি না বললেও তুমি আসবে, ওই ছোকরার টানেই আসবে। তবু এই বুড়ো বুড়ি দুটোকেও একটু সময়  দিও।”
    --কি যে  বলেন কাকু! এত আদর-যত্ন ভালবাসা আর কাকিমার অমন মুখরোচক রান্না, এর   টানেই বার বার আসতে হবে। 
    সেদিন আমাদের খুনসুটির  জন্য সময়ে টান পড়লেও অর্চনা  ওনাদের সঙ্গ খুব উপভোগ করেছিল।
    দেশের বাড়িতে মাসে দুবার যেতাম। একটাই  ছুটির দিন, নানা কাজ থাকে তাই প্রতি রবিবার যাওয়া হয়ে উঠত না। কিন্তু তিয়াসার বিয়ের দিন  ঠিক হবার পর যত কাজই থাক প্রতি রবিবার এমনকি উইক ডে তেও বাড়িতে গিয়েছি। আমি না গেলে বাবার একার ওপর চাপ পড়ে যেত। বাবা হিসেবি লোক। তিয়াসার বিয়ের জন্য সাধ্যমত টাকা পয়সার  ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আমিও বোনের বিয়ের জন্য কিছু সঞ্চয় করেছিলাম। টাকাটা বাবার হাতে দিতে প্রথমে নিতে চাইছিল না, একটু সেন্টুতে হাওয়া দিতে আর না করেনি। অভিষেক কলেজে পড়ায়, ভাল ছেলে। স্কুলে বাবার ছাত্র ছিল। বাড়ি বর্ধমানে। এক ভাই এক বোন, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ভাব ভালবাসা করে বিয়ে, তবে কোন বাড়িতেই কোন আপত্তি নেই। ছেলে আর মেয়ে দুজনেই সব দিক থেকে ভাল ফলে আপত্তি থাকার কথাও নয়। প্রেম করেছে বলেই বাগড়া মারব টাইপের বাড়ির লোক হলে অবশ্য আলাদা কথা। দু বাড়ির কেউওই এ ব্যাপারে অর্থোডক্স নয় তাই কোন সমস্যা হয়নি। বিয়ের কেনাকাটা অধিকাংশ কলকাতা থেকেই হল।  আমার বাড়ির লোকের সাথে যোগ হল অর্চনা আর বীণা কাকিমা। এই বিরাট টিম কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন দোকানে  ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা সারল। কেনাকাটার সময় আমি খুব একটা যেতে পারিনি কারণ  এলাকার নেমন্তন্নগুলো বাবা আর তাপস ভাগাভাগি করে  করলেও বাইরেরগুলো সব আমি করেছি। বেশ ধুমধাম করেই বোনের বিয়ে হল। কলকাতা থেকে অর্চনা, ওর মা, কমল কাকু, বীণা কাকিমা, বিদিশার বোন মায়া আর আমার দুজন সহকর্মী বন্ধু বিয়েতে গিয়েছিল। বিদিশার তখন সাত মাস চলছে ফলে যায়নি, আর বিদিশাকে একা ছেড়ে পিসিও যেতে চায়নি। তন্ময়কে আমার বলার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু অর্চনার জোরাল আপত্তি থাকায় বলতে পারিনি। বিয়ের দিনের অনেকটা দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে  কমল কাকু বাবাকে টেনশন ফ্রি রেখেছিলেন। কাকু কাকিমা আমার তো কাছের মানুষ ছিলেনই, তিয়াসার বিয়ের সময় থেকে ওনারা নিজগুণে আমার বাড়ির লোকেরও পরমাত্মীয় হয়ে গেলেন।
    সেদিন ডিউটি থেকে ফিরে নিজের ঘরে না ঢুকে সোজা চলে গিয়েছি কমল কাকুদের দিকে। আসলে জোর খিদে পেয়ে গিয়েছিল, আর আমার ঘরে রেডিমেড তেমন কিছু ছিল না। জানি ওদিকে গেলে কিছু না কিছু ঠিক জুটবে। মুখ হাত ধুয়ে বসতে না বসতেই বীণা কাকিমা  পরোটা আর আলু চচ্চড়ি নিয়ে এলেন। গোগ্রাসে খেতে খেতে বললাম, “কাকিমা, আমি তো কিছু বলিনি। বুঝলেন কি করে যে আমার খিদে পেয়েছে?”
    --বলতে হয় না, মায়েরা সন্তানকে দেখলেই সব কিছু বুঝতে পারে বাবা। খাও, আমি গরম গরম  আরো ভেজে নিয়ে আসছি।
    আমাকে পেলেই কমল কাকু গল্পে মেতে ওঠেন। এঁদের সাথে গল্প করে সুখ আছে, আলোচনা নানা প্রসঙ্গে ঘোরাফেরা করে, বোর হতে হয়  না। পেটপুরে খেয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প চলছে।
    --অমিত, বাবা ক’দিন থেকেই একটা কথা তোমায় বলব বলে ভাবছিলাম। একটা প্রোপোসাল বলতে পার। অবশ্য জানি না তাতে তোমার সায় থাকবে কি না।
    --কাকু এত কিন্তু কিন্তু না করে কি বলতে চান  বলে ফেলুন তো।
    --আমার ইচ্ছে তোমার ওই ফ্ল্যাটটা তুমি নিয়ে নাও।
    আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় আহা এত সুন্দর ফ্ল্যাটটায় যদি পাকাপাকিভাবে থাকতে পারতাম কত ভালোই না হত। কিন্তু এখন অত টাকা পাব কোথায়? তাই চিন্তাতে লাগাম দিতাম।
    আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কাকু বললেন—কি তোমার ইচ্ছে নেই?
    আমি বললাম, “না না কাকু, এত সুন্দর ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছে কার না থাকে। কিন্তু আমার কাছে তো অত টাকা নেই, সেইজন্যেই চুপ করে ছিলাম।”  
    --টাকার জন্য তোমায় অত ভাবতে হবে না, যা পারবে দিও। না পারলেও ক্ষতি নেই। তুমি রাজি থাকলে তোমার নামে রেজিস্ট্রিটা করিয়ে দিই।
    মহা সমস্যায় পড়ে গেলাম। বোনের বিয়েতে অনেকগুলো টাকা খরচ করেছি। নিজের বিয়ের  জন্যও বেশ কিছু টাকা  লাগবে। একমাত্র উপায় ব্যাংক থেকে লোন করা। একবার অর্চনার সাথেও কথা বলা দরকার। ভদ্রলোকের ধারণা তাঁর সন্তান আর জীবিত নেই। আমার মধ্যে খুঁজে পেতে চাইছিলেন তাঁর সন্তানকে। কিন্তু এভাবে বাড়ি রেজিস্ট্রি  করাতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না। সেটা পরিস্থিতির ফায়দা তোলা হয়ে যাবে।
    বললাম, “কাকু আমায় দু একটা দিন সময় দিন, একটু ভেবে আপনাকে জানাচ্ছি।”
    --তোমার সংকোচের কোন কারণ নেই। ভেব না আমি নিঃস্বার্থে এই অফার দিচ্ছি। শেষ জীবনে ছেলেকে সব সময় কাছে পাওয়া কোন বাবা মার কাছে এক  অসীম প্রাপ্তি। একবার থেকেই দেখ না, পুরো সুদে আসলে অসুল করে নেব।
    হাসতে হাসতে কথা গুলো বললেও এ ছিল এক দুঃখী মানুষের করুণ আবেদন। অর্চনাও শোনার পর ব্যাপারটায় খুব আগ্রহী। একটা ব্যাঙ্কে গিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা বললাম। অর্চনা তার মত করে  খুব সহজ সমাধানও বাৎলে দিল। বলল, “তোমার রোজগারে সংসার চলবে আর আমার রোজগারে লোন শোধ হবে।” দুদিনের মধ্যেই কাকুকে আমাদের সম্মতির কথা  জানিয়ে দিলাম।  এরপর দাম নিয়ে আলোচনা হল। কাকু যে দাম চাইলেন সুন্দরবনেও ওই দামে ঘর পাওয়া যাবে না। সেদিন অর্চনাও ওখানে উপস্থিত ছিল। দুজনেই ফ্ল্যাটটার একটা ন্যায্য দাম বলতে অনুরোধ করলাম। কাকু সেন্টিমেন্টাল হয়ে বললেন, “তোমার বাবার সাথেও কি এইভাবে দরদাম করতে?”
    আমি বুঝিয়ে বললাম—কাকু, আপনি আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করেন এবং আপনার একান্ত ইচ্ছে আমরা এখানে থাকি। আমরাও  আপনাদের খুব ভালবাসি এবং এখানে থাকলে আমাদেরও খুবই ভাল লাগবে। কিন্তু আপনি একবার আমাদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখুন, আপনার প্রতিক্রিয়াও আলাদা কিছু হবে না।
    আমি ওই অঞ্চলে ওইরকম ফ্ল্যাটের যা দাম হয় সেটা দেওয়ার কথা বলতেই ছেলেমানুষের মত রাগ করে বললেন—বুঝতে পেরেছি। আসলে তোমরা এখানে থাকতে চাও না তাই অমন আচরণ  করছ।
    বাধ্য হয়েই অনেক কম দামেই রাজি হতে হল। পরের মাসেই ভাড়া বাড়িটা রেজিস্ট্রি করে হয়ে গেল আমার নিজের বাড়ি। সেদিন আমাদের থেকেও সন্তানবৎ কাউকে স্নেহের বাঁধনে আটকে রাখতে পেরে   কাকুর  আনন্দ ছিল অনেক  বেশি। ফ্ল্যাট কেনায় বাড়ির সকলে খুশি হলেও মার মুখে আনন্দের প্রকাশ তেমন একটা দেখিনি। আন্দাজ করলাম, বাড়ি কেনাতে মার আশঙ্কা ছেলে হয়ত এবার ভিন্ন হয়ে যাবে। আমি আর বাবা বুঝিয়ে বললাম যে  চাকরির কারণে আমার এবং আরো নানা কারণে আমাদের পুরো পরিবারের কলকাতায় একটা পাকাপাকি ঠেক দরকার ছিল। ফ্ল্যাটটা বাড়ির সকলের নানা সময় নানা কাজে লাগবে। মা বুঝে ছিল আর সেবারে বাড়ি থেকে ফেরার সময় মাকে কলকাতায় নিয়ে এসে দিন সাতেক আমার কাছে রেখেছিলাম। এতদিন বাড়ি ছেড়ে, সংসার ছেড়ে, মা কখনো বাইরে থাকেনি। বাড়ির জন্য একটু উসখুস করলেও ক’টা দিন খুব  আনন্দে কাটিয়েছিল। যাওয়ার দিন বলেছিল, “বাবু ফ্ল্যাটটা খুব ভাল রে। এত সুন্দর আলো হাওয়া শহরে ভাবাই যায় না।  কিনে ভালোই করেছিস, আমাদের অনেকের অনেক কাজেই লাগবে।”
    ফ্ল্যাট কেনার পরেই বাড়ির লোকজন আমদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিল। আমরাও এবার বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছিলাম। পাশে কাকু কাকিমারা থাকলেও নিজের ফ্ল্যাটে আর একা একা থাকতে ভাল লাগছিল না। কিন্তু ভাবনা আর ভবিতব্য কখনো কখনো বিপরীতমুখী হয়ে যায়।
    ফ্ল্যাটটা  যে অত তাড়াতাড়ি আমার  বাড়ির লোকের কাজে লাগতে চলেছে তা তখন ধারণার বাইরে ছিল। বাবার রিটায়ারমেন্টের তখন আর বেশি দেরী নেই। চাকরির শেষ দিকে অনেকের একটা গা ছাড়া ভাব এসে যায়, বাবার মধ্যে সেটা একেবারেই চিল না। নিয়মিতই স্কুলে যেত  আর নিজের পেশাকে আগের মত একই রকম উপভোগ করত। কোন বিরক্তি বা ক্লান্তি কখনো কারো চোখে পড়েনি। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। বাবা রোজ যেমন বেরোয় তেমনই  স্কুলে যাবে বলে বেরিয়েছিল। একটু বাদে খবর এল বাবা স্টেশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভাগ্য ভাল তখন তাপস বাড়িতে ছিল। গিয়ে দেখে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে। পিঠের দিক থেকে বাঁ হাত পর্যন্ত  যন্ত্রণা হচ্ছে। ও আর কোন চিন্তা ভাবনা না করে দু এক জন বন্ধুকে সাথে নিয়ে বাবাকে একটা গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে সোজা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিল। খবর পেয়ে আমি গেলাম। দেখলাম বাবার একটা হাল্কা অ্যাটাক হয়ে গেছে। ভাইয়ের  তৎপরতার জন্যে আরো বড় কিছু হয়নি। আটচল্লিশ ঘন্টা পর বাবা একটু স্টেবল হতে একটু রিস্ক নিয়েই অ্যাম্বুলেন্সে করে সোজা কলকাতায় আমার হাসপাতালে ভর্তি করলাম। অনেকটা ব্লকেজ থাকায় দুটো স্টেন্ট বসাতে হল। সাত আট দিন বাদে বাবাকে ডিসচার্জ করার পর আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে রাখলাম। ওই সময় আমাদের বাড়ির সকলেই এমনকি আমার বোন আর ভগ্নিপতিও আমার কাছেই ছিল। দেশের বাড়ি তখন কাজের লোকের ভরসায় ছাড়া আছে।  সুস্থ হয়ে গেলেও তিন মাস পর্যবেক্ষণের জন্য বাবাকে আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। মাও বাবার কাছেই রইল। বিপদের সময় অর্চনা সারাক্ষণ আমার পাশে থেকেছে। এমনকি বাবাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর পনের দিন অফিস ছুটি নিয়ে বাবার সেবা করেছে। মৌজ মস্তি প্রিয় হাসিখুশি চটুল স্বভাবের অর্চনার এক নতুন রূপ দেখলাম। ওকে নতুন করে চিনলাম, ভাল লাগল। আমার মা বাবা ওকে প্রথম থেকেই পছন্দ করত, এই ঘটনা বা  দুর্ঘটনার পর তা আরো অনেক অনেক  বেড়ে গেল। এ আমার এক বিরাট পাওয়া। কমল কাকু আর বীণা কাকিমা বাবা যতদিন ছিল আমাদের সকলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা থেকে আরম্ভ করে সব রকমভাবে পাশে থেকেছেন। সারাদিন অতগুলো লোকের খাবারের যোগান দেওয়া যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ। আর এক জনও  ওই সময় আমার সাহায্যে সর্বতোভাবে এগিয়ে এসেছিল। তন্ময় টানা দু রাত আমার সাথে হাসপাতালে জেগেছিল। শুধু তাই  নয়,  দরকার লাগতে পারে ভেবে  সাথে করে অনেক টাকা এনেছিল আমাকে দেওয়ার জন্যে। তখনকার চালাবার মত টাকা আমার কাছে ছিল বলে অনেকে জোরাজুরি  করা সত্ত্বেও নিইনি। সেন্টিমেন্টাল হয়ে বলেছিল, “বুঝলাম, বিদিশার মত তোমরা কেউই আমাকে পছন্দ কর না।”  আমি বললাম, “এমা না না, একেবারেই তা নয়। এখন আমার কাছে টাকা আছে।  যদি প্রয়োজন হয় নিশ্চই নেব। তুমি আমার অসময়ে যে ভাবে পাশে রইলে তা কখনো ভুলবো না।”
    বাবা সুস্থ হয়ে আমার এখান থেকে দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই বিদিশার ছেলে হল। রেগুলার চেক আপ থেকে ডেলিভারি সব ব্যবস্থা পিসিই করিয়েছেন। ডঃ জয়ন্ত ঘোষের নাম আছে আর  পিসির পরিচিত।  আমি কেবল মাঝে মাঝে একবার করে গিয়ে দেখে আসতাম। ডেলিভারির দিন নার্সিংহোমে ঢোকার সময় দেখি বাইরে একধারে উদ্বিগ্ন মুখে তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “পারলে একটু খবরটা জানিয়ে যেও, আমি এখানেই অপেক্ষা করব।” আমার খুব কষ্ট হল, ওকে আমার সাথে  ভেতরে আসতে বললাম। কে কি বলবে সেইজন্য কিন্তু কিন্তু করছিল। আমি জোর করে ওকে ভেতরে নিয়ে গেলাম। যদি ভুল না দেখে থাকি বিদিশার সাথে ওর একবার চোখাচুখি হয়েছিল। বিদিশার মুখে কোন রকম বিরক্তি দেখিনি, অবশ্য তখন ও অ্যানাস্থেসিয়ার ঘোরের মধ্যে ছিল।  ওই সময় ওর দু একটা অনুরোধও রেখেছিলাম, যা রাখতে পেরে আমার খুব ভাল লেগেছিল।
    বাবা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতেই আবার নতুন  উদ্যমে শুরু হয়ে গেল আমাদের বিয়ের তোড়জোড়। অনেক আগেই অর্চনার মা আর আমার মা বাবা আলোচনা করে আমাদের বিয়ের একটা সম্ভাব্য সময় বেছে রেখেছিল।  বিদিশা যাতে উপস্থিত থাকতে  পারে সেটা মাথায় রেখে  কয়েক মাস বাদে শীতকালে একটা দিন ঠিক করা হল। আমি আর অর্চনা টুকটুক করে বিয়ের কেনাকাটা শুরু করলাম। দু বাড়ির কেনাকাটাই আমরা করছি। ওদেরটা ওদের বাড়িতে রাখা হচ্ছে আর আমাদেরটা আমার ফ্ল্যাটে। বোন মাকে সঙ্গে  নিয়ে বর্ধমান থেকেও বিয়ের টুকিটাকি কেনাকাটা করছে। হাতে সময় আছে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সময়টা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম।
    অর্চনার বাড়িতে যাতায়াত থাকলেও বাইরে থাকে বলে ওর দাদা অরুপের সাথে সেরকম পরিচয় ছিল না। একবারই দেখেছি, বয়সে আমার থেকে কিছু বড়  হবে। কথাবার্তা সামান্যই হয়েছে, তবে ওইটুকুতেই বুঝে  গেছি  যে জিনিসটি  গাম্বাট প্রকৃতির। অর্চনার কাছে শুনেছি চাকরি পাওয়ার আগে এলাকায় একটু দাদা গোছের ছিল। স্বাভাবিক, দুটো তো প্রায় সমার্থক শব্দ। বিয়ের ক’দিন  আগে শালা বাবুর সাথে ভাল করে পরিচয় হল। অনেকক্ষণ গল্পগুজব হল। মানুষটা খারাপ নয় তবে আমার মূল্যায়নে কোন পরিবর্তন হল না, একেবারে আগমার্কা গাম্বাট। বাবার অসুখে অনেক ছুটি চলে গেছে তাই বিয়ের জন্য মাত্র  সাত দিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারলাম। বিয়ের ঠিক  তিন দিন আগে অর্চনা অফিস ফেরত আমার ফ্ল্যাটে এল। আমাকে ফোন করে বলেছিল দরকারি কথা আছে তাই আমিও একটু আগেই ফিরে এসেছিলাম।  একটু চিন্তায় ছিলাম, কি এমন দরকারি কথা! দরজায় আস্তে আস্তে টোকা মারার আওয়াজ পেতে উঠে গিয়ে ছিটকিনি খুললাম। অর্চনা ঘরে ঢুকেই দরজাটা আটকে দিল। জুতো ছেড়ে ব্যাগপত্র টেবিলে রেখে গম্ভীর মুখে গিয়ে চেয়ারে বসল। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে অর্চনা?” মুখে কিছু না বলে সরে এল আমার আরো কাছে। তারপর কিছু বোঝার আগেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। ওর ঠোঁট দুটো তখন আমার সারা মুখে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পাগলের মত সোহাগ করার পর একটু থেমে বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার কি হয়েছে বল তো? একজন যুবতী, যে কিনা দুদিন বাদে তোমার বৌ হবে, তোমাকে ভীষণভাবে কাছে পেতে চাইছে আর তুমি কিনা নির্বিকার!”
    আমি বললাম, “তোমার ব্যাপার স্যাপারটাই তো বুঝতে পারছিলাম  না। প্রথমে বললে দরকারি  কথা আছে, তারপর বাড়ি এসে গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলে, আর তারপর ঝাঁপ মারলে। এটা তোমার ক্রোধ না কাম তাই গুলিয়ে যাচ্ছিল। এ সব ইংরাজি সিনেমায় দেখা যায়। বিস্তর ঝগড়া ঝাঁটির মাঝে হঠাৎ করে শুরু হয়ে যায় হামি পর্ব। তুমি তো তেমন ইংরাজি বই দেখ না তাহলে এই টেকনিকটা শিখলে কোথায়? ”
    “ইনোভেসন মশাই ইনোভেসন। দুদিন বাদে তো বিয়ে হয়ে যাবে আর তখন প্রেমিকা থেকে হয়ে যাব বৌ। হঠাৎ আজ সকালে উঠে খুব ইচ্ছে করল প্রেমিকা রূপে শেষ বারের মত তোমাকে শারীরিক ভাবে কাছে পেতে। সুযোগ থাকলে  বাসনা অতৃপ্ত রাখতে নেই, তাই চলে এলাম। কদিন বাদে যার লাইসেন্স পেয়ে যাব আজ তা নিষিদ্ধ,  আদম আর ইভের প্রতি সম্মান জানিয়ে  সেই নিষিদ্ধকে শেষ বারের মত উপভোগ করতেই ছুটে এসেছি।”
    কোন ভণিতা নেই, চরিত্রের ধারা বজায় রেখে এ ক্ষেত্রেও একেবারে সোজা সাপটা।  অর্চনাকে বিমুখ করার সাধ্য আমার ছিল না। তার ইচ্ছা কড়ায় গন্ডায় পূরণ হয়েছিল। 
    পরের দিন সকালেই চলে গিয়েছিলাম দেশের বাড়িতে। ফ্ল্যাট থেকে আসার আগে একবার  অর্চনাদের  বাড়িতে কাকিমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম কেনাকাটা বা অন্য  কিছু দরকার আছে কিনা জানতে। দেখলাম মোটামুটি সব রেডি। কাকিমার দেওয়া জলখাবার আর আমার হবু বৌয়ের এগিয়ে দেওয়া গালে  ছোট্ট একটা  হামি খেয়ে  নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেখি উৎসবের মেজাজ, অনেক আত্মীয় স্বজন ইতিমধ্যেই চলে এসেছেন। আমি পৌঁছোতে আনন্দ উল্লাস আরো বাড়ল। বাবাও বেশ ফুর্তিতেই রয়েছে, ভাল লাগল। বাবাকে বললাম, “সময়ে খাওয়া, ওষুধ খাওয়া আর ঘুম, হৈ হট্টগোলের মাঝে এগুলোয় যেন কোন অনিয়ম না হয়।”
    অনেকটা পথ তাই বিয়েতে বাবাকে যেতে দিইনি। কমলকাকু বর কর্তা হয়েছিলেন। অবশ্য বর  কর্তা হয়ে গেলেও অর্চনাদের বাড়িতে পৌঁছোবার পর  ওদের লোক হয়ে গেলেন। আসলে ওদের বাড়িতে লোকজন কম বলে অর্চনা ওনাকে আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল। বিদিশা ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে এসে খুব আনন্দ করেছিল। তন্ময়কে আমার বিয়েতে আসার জন্য আমি অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু ও  অক্ষমতা জানিয়  বলেছিল “আমি গেলে বিদিশা ওর বন্ধুর বিয়েতে যাবে না, আর তা কখনই কাম্য নয়।” বিয়ের কিছুদিন আগে একদিন সকাল বেলা আমার ফ্ল্যাটে এসে খুব দামি গয়নার সেট উপহার দিয়ে  গেল। অনুরোধ করেছিল ও দিয়েছে  সেটা অর্চনাকে না জানাতে কারণ, শুনলে হয়ত পরবে না।  ওকে আঘাত দিতে চাইনি  তাই উপহারটা গ্রহণ করেছিলাম। আমার বন্ধু বান্ধবেরা গান বাজনা আর নানা ছলা কলায় মাতিয়ে দিয়েছিল বিয়ের বাসর। ওধার থেকেও অর্চনাকে ঘিরে থাকা  কিছু তন্বী, একমাত্র মায়া ছাড়া যাদের কাউকে চিনি না, রঙ্গরসের ফোয়ারা ছুটিয়ে তরজা জমিয়ে দিয়েছিল।
    পরদিন সকালে চলে আসার সময় অর্চনা মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছিল।  এই ধরণের প্রাণোচ্ছল মেয়েকে কাঁদতে দেখলে খুব খারাপ লাগে। ছোটবেলা থেকে  মাকে আঁকড়ে বড় হয়েছে, ছেড়ে আসতে কষ্ট তো হবেই।
    আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানও বেশ ভালভাবেই মিটল। বিদিশা বৌভাতে আসেনি, ওইটুকু বাচ্চা নিয়ে আসা সম্ভবও নয়। পিসি এসেছিলেন, খুব আনন্দ করেছেন। সব কিছু  মিটতে মিটতে প্রায় একটা হয়ে গেল। আমাকে অনেক আগেই সবাই মিলে ঠেলে ঠুলে ঘরে ঢোকাচ্ছিল, কিন্তু সকলের খাওয়া দাওয়া মেটার পর আমি এলাম। দোতলায় পূব দিকের নতুন ঘরটা বাবা আমার জন্যই বছর খানেক আগে বানিয়েছে। এখন বাড়িতে এলে এই ঘরেই থাকি।  ভেতরে ঢুকে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করলাম। এত চেনা ঘরকেও কেমন যেন অচেনা লাগল। একটা হাল্কা নীল আলো জ্বলছে। তার শীতল ছোঁয়ায় ভেতরে তখন এক মায়াবী পরিবেশ। খাট তো বটেই, পুরো ঘরটাই ফুল দিয়ে মোড়া। সুগন্ধের  প্লাবন পরিবেশকে আরো মনলোভা করে তুলেছে।   খাটের একধারে অর্চনা বসে আছে। বসে আছে না বলে অপেক্ষারত বলাটাই বোধহয় মানানসই হবে। একটু কি লাজুক লাজুক লাগছে! হবেও বা। বিশেষ পরিবেশ বা পরিস্থিতি কখনো কখনো মানুষের স্বাভাবিক আচরণকে একটু এডিট করে দেয়। তাই সেদিন অর্চনা কেঁদেছিল আর তাই হয়ত এই লজ্জাভাব। ঘর ঘরণী আর শয্যা, সর্বত্রই অনন্য সৌন্দর্যের ছোঁয়া । ছিটকিনিটা ঠিকঠাক লেগেছে কিনা দেখে নিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম, “তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।” খুশী হয়ে আমার আরো কাছটায় ঘেঁসে বসল। জিজ্ঞেস করল, “এবার এই মুকুট আর সাজসজ্জাগুলো খুলে ফেলি?” আমি বললাম, “অবশ্যই, আরো আগেই খুলে ফেলতে পারতে। মিছিমিছি এতক্ষণ এই ধড়াচুড়োগুলো পরে থেকে কষ্ট পেলে।  ওগুলোর কাজ তো কখন মিটে গেছে।  যত  তাড়াতাড়ি পার ভার মুক্ত হও। তবে কতটা মুক্ত হবে সেটা তোমার ব্যাপার।”  ও একটা চিমটি কেটে বলল, “কেন তোমার ব্যাপার নয়?” হেসে বললাম, “গ্রহীতা তো পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে কিন্তু কতটা পাবে তা তো দাতাই ঠিক করে।”   ওর মুকুট আর অন্য গয়নাগুলো একটা একটা করে খুলে বিছানায় রাখল। আমি সেগুলো তুলে আমার রুমালে বেঁধে টেবিলের ওপর রাখলাম। বেনারসিটা  খুলে যত্ন করে ভাঁজ করে অর্চনা খাটের একধারে রাখল। ইশারায় আমাকে আলোটা নিভিয়ে দিতে বলল। আমি বললাম, “কত সুন্দর মিঠে আলো, ওটুকু থাক না। চোখ দুটোকে কেন তার প্রাপ্য সুখ থেকে বঞ্চিত করবে? আজকের দৃশ্য, স্পর্শ, শব্দ, ঘ্রাণ, সব কিছুর  রেকর্ডিং হয়ে থাকবে আমদের মনের গভীরে, ভবিষ্যতের স্মৃতি রোমন্থানের জন্য। এই দিনটার স্মৃতি সারা জীবনের সম্পদ। একটুও আলো না থাকলে চোখ তার ভিডিও রেকর্ডিং করবে কি করে? তাই বলি কি ওটুকু থাক না।” অর্চনা  বলল, “নতুন জায়গা, লজ্জা করে।”  উত্তর বললাম, “জায়গা নতুন, মানুষটাতো নতুন নয়।”   বলল “তা নয়, জানলা দরজাগুলোয় যদি ফাঁক টাক থাকে তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।”  ওকে নিশ্চিন্ত  করে বললাম, “সে সব আগেই চেক করে নিয়েছি। সব বড় পরদা টানা আছে, শত চেষ্টা করলেও বাইরে থেকে কেউ কিচ্ছুটি দেখতে পাবে না। আর সেরকম উৎসাহী মানুষ এ বাড়িতে তেমন একটা নেই।” আমার আশ্বাস পেয়ে অর্চনা ভারমুক্ত হতে শুরু করল।  অচিরেই সম্পূর্ণরূপে ভারমুক্ত হয়ে নিজেকে সমর্পণ করল।  গল্প আর সোহাগের মাঝে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে যেতে থাকলাম  পরস্পরের দেহে। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি তখনো অর্চনা আমাকে আঁকড়ে ধরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমাদের এই কয়েক বছরের ভালবাসায় আমরা কয়েকবার শারীরিকভাবে কাছাকাছি এসেছি, উপভোগ করেছি  সেই সান্নিধ্য। তবে বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সেই রাতের  শারীরিক ও মানসিক পরিতৃপ্তি ছিল অপরিমেয়।
    বৌভাতের দুদিন পরে ছুটির অভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও  কলকাতায় ফিরে আসতে হল। অর্চনা আরো কয়েক  দিন গ্রামের বাড়িতে রইল আর সেটাও অনিচ্ছাসত্ত্বে। টাটকা পাওয়া স্বামীকে ছেড়ে কেই বা একা  থাকতে চায়, যদিও দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। এটাই অর্চনার মস্ত গুণ।  পরিচয় হওয়ার পর থেকে নানা সদর্থক  ভূমিকায় অর্চনাকে দেখে এটা  নিশ্চিত হয়েছি যে এই মেয়ে পাশে থাকলে জীবন অনেক মসৃণ হয়ে যায়। অষ্টমঙ্গলাতে শ্বশুর বাড়ি ঘুরে আসার পর শুরু হল আমাদের ছোট্ট নতুন সংসার।

    (চলবে)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন