এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন পর্ব - ১০

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫৬ বার পঠিত
  • প্রেম দেহ মন পর্ব - ১০

    তন্ময়

    বিদিশাকে হারিয়ে আমার প্রায় উন্মাদের অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কোন কিছুই ভাল লাগত না। এই সমস্ত কিছুর জন্য আমি দায়ী, শুধুমাত্র আমি,  আর কেউ নয়। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার  সুযোগ  বিদিশা আমায় দিয়েছিল কিন্তু সাহস করে এগোতে পারিনি। বিদিশা ঠিকই বলেছে, আমি একটা   মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ। তা না হলে যে মেয়েটাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসি তার বিপদের সময় ওভাবে কেউ গুটিয়ে থাকতে পারে না। আর সব থেকে বড় কথা তাকে সেই বিপদে ফেলেছি আমি। বাবা ওর সাথে যে ব্যবহার করেছে বাবার মত মানুষের কাছে ওই পরিস্থিতিতে সেটাই প্রত্যাশিত। বাবার কাছে ওর থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না। মাও বাবার সিদ্ধান্তের কাছে চিরকালের মত অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল।  ওই সময় আমার একটু ইতিবাচক পদক্ষেপ সব কিছু স্বাভাবিক করে দিতে পারত। কিন্তু তার জন্য যে মনোবল দরকার, আমার মত এক মানসিক প্রতিবন্ধীর তা ছিল না। লেখাপড়ায় যতই ভাল হই না  কেন আমি একপ্রকার  মানসিক প্রতিবন্ধী। শিশুকাল থেকে যার ইচ্ছে অনিচ্ছের স্টিয়ারিং অন্যের হাতে থাকে তার মানসিক বিকাস স্বাভাবিক হতে পারে না। আমারও হয়নি, চিরকাল অন্যের ইচ্ছেতেই চালিত হয়েছি। নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিলাম না।

    চরম  আঘাতের কয়েকদিন পর   বাবার   দখলদারিকে উপেক্ষা  করে  উদভ্রান্তের  মত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। উঠলাম গিয়ে কলেজের এক বন্ধুর মেসে। মা অনেক কান্নাকাটি করেছিল, বাবাও বারণ করল, কিন্তু সে সব আমার মনে কোন প্রভাব ফেলেনি। পাগলের মত চেষ্টা করলাম বিদিশাকে জানাতে  যে আমি ওর প্রস্তাবে রাজি,  কিন্তু আমার সাথে যোগাযোগ করতে ও আর আগ্রহী ছিলা না।  ওর এই দুর্দিনে বুলি সব সময় ওর পাশে ছিল। ওর পিসির বাড়িতে বিদিশার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। নিজে না পেরে পিসিকে ফোন করে আমি যে বিয়ে করতে আগ্রহী  সে কথা বিদিশাকে জানাতে বললাম। পিসি কথা বলে জানিয়েছিল যে ও আর রাজি নয়। সেটাই স্বাভাবিক।   তখন পার হয়ে গেছে বেশ কিছুটা সময় আর   সময়ের ওই ফাঁক গলে  হারিয়ে গেছে  আমার ভালবাসা।  কতদিন ওই বাড়িটার কাছে একটু আড়ালে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি বিদিশাকে একটু দেখতে পাওয়ার আশায়। যখন  একটু দেখতে পেয়েছি  মনটা আনন্দে ভরে গেছে। মেস থেকেই ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম।  পাশ করার পর অনেক চাকরির অফার এল। কলকাতায় পোস্টিং দেবে এমন  একটা চাকরিতে জয়েন করলাম। মাস দেড়েক বাদেই বিদিশার ডেলিভারির ডেট, বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত কোলকাতা ছাড়তে চাইছিলাম না। যদিও জানি আমার কোনরকম সাহায্য বা সহযোগিতা বিদিশা নেবে না, এমনকি আমার উপস্থিতিও ওর কাছে কাম্য নয়। তবু রয়ে  গেলাম, নিজের মানসিক শান্তির জন্য রয়ে গেলাম। চাকরি পাওয়ার পরে মেস ছেড়ে  একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। মার জন্য খারাপ লাগলেও বাড়িতে আর ফিরে যাইনি। খুব মন খারাপ হলে মাঝে মাঝে মাঝে  গিয়ে মার সাথে দেখা করে আসতাম। চাকরিতে ঢোকার পর খানিকটা মানসিক স্থিতি এল। সারাদিন কাজের মধ্যে কেটে যাওয়ার ফলে দুশ্চিন্তা করার মত ফাঁকা সময় খুব একটা থাকত না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বি হয়ে মনে অনেক জোর পেয়েছিলাম। মাসে সাত আট দিন অফিসের কাজে বাইরে যেতে হত। বাকি সময়টা কলকাতাতেই থাকতাম। পিসি আর অমিতের কাছ থেকে বিদিশার খবরাখবর নিতাম। মায়ার সাথেও যোগাযোগ ছিল। ডেলিভারির সময় যত এগিয়ে আসছিল আমারও তত টেনসন বাড়ছিল। মায়ার থেকে  বিদিশার নার্সিং হোমে ভর্তি হওয়ার কথা জানার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সাহস করে ভেতরে ঢুকতে পারিনি, বাইরেই ঘোরাঘুরি করছিলাম।  আমার দিকে নজর পড়ায় অমিত জোর করে  আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল। ছেলে হওয়ার পরে বিদিশাকে যখন ওটি থেকে বেডে নিয়ে যাচ্ছে আমি তখন অন্যদের থেকে দূরে একধারে অমিতের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক দিন বাদে কাছ থেকে দেখলাম, বড় শান্তি পেলাম। অমিত বিদিশাকে না জানিয়ে কায়দা করে এক ফাঁকে আমায় নিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে দেখাল। দেখে আনন্দে চখে জল এসে গেল। দেবশিশু, একেই কিনা আমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। গৃহীত হবে না জেনেও অমিতের কাছে একটা অনুরোধ করেছিলাম। ওকে বলেছিলাম নার্সিং হোমের খরচটা আমি দিতে চাই আর এটা যেন গোপন থাকে। ও তখনই হ্যাঁ বা না কিছু বলেনি কিন্তু পরে আমার অনুরোধ রেখেছিল। জানিনা ও কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিল। নিজের সন্তানের আগমনের সময় পরোক্ষভাবে হলেও একটু পাশে থাকতে পেরে খুব  মানসিক শান্তি পেয়েছিলাম।  এরপর অনেকদিন বাচ্চাকে দেখতে পাইনি। মা গিয়ে মাঝে মাঝে দেখে আসত। মাকে দেখার অনুমতি দিলেও বিদিশা বলে দিয়েছিল যে আর যেন কেউ না আসে।  তাই ‘আর যেন কেউ’ মানে আমি দেখার জন্য ছটফট করলেও আমার ছেলের কাছে যেতে পারিনি। মা তো নাতিকে দেখে উচ্ছ্বসিত, বলত “কি সুন্দর দেখতে হয়েছে রে! মুখটা একেবারে তোর মত রে তনু।” তারপরেই হতাশ হয়ে  বলত, “এমনই কপাল ঘরের ছেলে পরের ঘরে বড় হচ্ছে।” মায়ের কাছে ছেলের গল্প শুনে মনে মনে   তার ছবি আঁকতাম। যে কোন কারণেই হোক অতীতের সব কিছু জানা সত্ত্বেও  বুলির পিসি আমার ওপর একটু সদয় ছিলেন। আমার বর্তমান অবস্থা দেখে হয়ত মায়া হত   তাই  যখনই ওনার কাছে গিয়েছি, দেখা করেছেন, ফিরিয়ে দেননি। ওই ফাঁকে ছেলেটাকে দু দন্ড কোলে  নিয়ে প্রাণভরে আদর করেছি। অবশ্য এ সবই হয়েছে ছেলেটা একটু বড় হবার পর বিদিশা যখন স্কুলে যেত সেই সময়। বাপ ব্যাটায়  দেখা হত লুকোচুরি করে। ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে অবগাহন করতাম আনন্দ সাগরে, সেই মুহূর্তে ধুয়ে যেত আমার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা। মুখে বুলি ফোটার পর পিসির কাছে শুনে শুনে ছেলেটা আমাকে দেখলেই  ‘বাআআব্বা’  ‘বাআআব্বা’ করে ডাকত। ওই ডাক শুনে ভেতরটা জুড়িয়ে যেত। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম।

    বিদিশার কাছে সঙ্গত কারণেই আমি ঘৃণার পাত্র। জানিনা সময়ের স্রোত  তার তীব্রতা  কিছুটা ধুয়ে দিয়েছিল কি না। আমার কিন্তু ওর প্রতি ভালবাসা একই রকম ছিল, তার সাথে যোগ হয়েছিল  কৃতজ্ঞতা। আমার অনুরোধ রেখে সমাজের কাছে অয়নের বাবা হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। অয়নকে  স্কুলে ভর্তির সময়  বিদিশা কোন তথ্য গোপন করেনি। ভর্তির দিন ছেলেকে নিয়ে দুজনে একসাথে স্কুলে গিয়েছিলাম। বিদিশার কি অনুভূতি জানিনা, বহুদিন পর বিদিশাকে পাশে পেয়ে আমার বড় ভাল লেগেছিল।  কথা খুব কমই হয়েছিল তবু ওই সামান্য সান্নিধ্যেই পেয়েছিলাম অসীম তৃপ্তি। ছেলে সারাক্ষণ আমার হাত ধরেই ছিল। স্কুলে শিক্ষকদের সামনে সেদিন আমরা দুজনেই  সুখী পরিবারের অভিনয় করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম।  শিক্ষকদের সাথে আলাপচারিতার সময়  এক আধ বার একটু পিছলে যাচ্ছিলাম, বিদিশা সময় মত ঠেকা দিয়ে সামলে  দিয়েছে।  ফেরার সময় আমার তিন বছরের অয়ন কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না।  ওর সাথে ওর বাড়ি যেতেই হবে। যেতে পারলে আমার থেকে সুখী আর কেউ হত না, কিন্তু নিরুপায়। বিদিশা  ছেলেকে নানা মিথ্যে কথা বলে বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা একটু ধমক দিয়ে নিয়ে চলে গেল নিজের ঠিকানায়। অসহায় দুঃখী বাবা নীরবে দেখলাম।

    মাঝে খুব ধুমধাম করে বুলির বিয়ে হল। অরূপ দা আর স্বপ্না পিসি এসেছিল নেমন্তন্ন করতে। বুলি আমার সাথে আর কথা বলে না। শুধু আমি নয় ও ওই ঘটনার পর থেকে আমাদের বাড়ির কারো সাথেই কোন যোগাযোগ রাখে না। আমরা কেঊই ওর বিয়েতে যাইনি। বুলি না বললেও অমিত আমাকে অনেকবার অনুরোধ করেছিল বিয়েতে যাওয়ার জন্য। ওকে বুঝিয়ে বললাম যে আমি গেলে প্রাণের বন্ধুর বিয়েতে বিদিশার যাওয়া হবে না। তাতে বিদিশা আর বুলি দুজনেই কষ্ট পাবে। বিদিশা বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে খুব আনন্দ করেছে শুনে  ভাল লেগেছিল। 
    তখোনো আমি ভাড়া বাড়িতেই থাকি। তবে  ছুটিছাটার দিনে সকলের খবরা খবর নিতে  বাড়িতে যেতাম। একটা  দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অনুতাপে মনের দুঃখে বাড়ি ছেড়েছিলাম। এটা প্রায়শ্চিত্ত কি না জানিনা তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে একটু মানসিক শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়া দেরীতে হলেও বাবার সেদিনের দুর্বিনীত আচরণের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা ছিল আমার প্রতিবাদ। যা সরাসরি ঘা দিয়েছিল সযত্নে লালিত বাবার অহং কে। অতি বাধ্য ছেলের কাছ থেকে এমন একটা সিদ্ধান্ত বাবা ভাবতেও পারেনি। আমি বাড়ি থেকে চলে আসার পর মা মাঝে মাঝেই ছুটে আসত আমার সাথে দেখা করতে। যতই তেজ দেখাই না কেন চাকরি পাওয়ার আগে  মায়ের লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে আসা অর্থ হাত পেতে নিয়েছি। কারণ এ ছাড়া ওই মুহূর্তে আমার কোন উপায় ছিল না। মার কাছে শুনেছি আমি বাড়ি ছাড়ার  পর বাবা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকে কিছু না বললেও পরে মার কাছে আমার ব্যাপারে খবরাখবর নিত। তবে মনের ভেতরে যতই তোলপাড় হোক না কেন বাইরের জেদটা কিন্তু বজায় রেখেছিল। মাকে আসতে মানা না করলেও নিজে কিন্তু একবারও আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে  এক রবিবার বিকেলে আমার বাড়িতে গেলাম। তখন আমি সব দিক থেকেই স্বাবলম্বী। মা বাবা আর বলরাম কাকু, তিনজনের জন্যেই তাদের পছন্দের  অনেক জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা আর বলরাম কাকু তো আমাকে বাড়িতে দেখে তো আনন্দে আত্মহারা। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটু পরে বাবার ঘরে গিয়ে বাবার জন্য আনা স্যুটের কাপড় আর একটা রিস্ট ওয়াচ দিয়ে “এগুলো পোরো” বলে নমস্কার করলাম। জিনিসগুলো নিয়ে টেবিলে রেখে খুব  আস্তে জিজ্ঞেস করল “কেমন আছ?” উত্তর দেওয়ার সময় সামনে তাকিয়ে দেখি বাবার চোখের কোনে জল। যে মানুষের অহং  সর্বস্ব বেয়াড়া রুদ্র  রূপ দেখে বড়  হয়েছি, অপছন্দ করেছি, সেই মানুষের আমারই কারণে চোখে জল দেখে বড় হতবুদ্ধিকর অবস্থার মধ্যে পড়লাম। কথাবার্তা যথা সম্ভব সংক্ষেপে সেরে বাবার সামনে থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসেছিলাম। সেই শুরু, তারপর থেকে মাঝে মধ্যে বাড়িতে যেতাম।  বাড়ির মানুষগুলোর  আমার জীবনে যার যা ভুমিকাই  থাক না কেন এদের প্রতি সন্তান হিসাবে আমার কিছু  দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। সেই  কর্তব্যবোধের তাগিদেই মাঝে মাঝে খবরাখবর নিতে যেতাম। মাইনে পেয়ে বিদিশার জন্যেও অনেক কিছু কিনেছিলাম। জানি আমার হাত থেকে ও কিছু নেবে না তাই সাহস করে নিজে ওর হাতে দিতে পারিনি। এক ফাঁকে  গিয়ে পিসির কাছে দিয়ে এসেছিলাম। কদিন বাদেই বিদিশার ডেলিভারির ডেট তাই পিসি একটু চিন্তায় ছিল।  পরে পিসি বলেছিল যে বিদিশা আমার দেওয়া জিনিসগুলো ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমার ধারণা ব্যাপারটা সত্যি নয়, আমার মন রাখার জন্য পিসি অমনটা বলেছিল। ছেলে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তবু বিদিশার সাথে মাঝে সাঝে দেখা হত,  অল্প স্বল্প কথাও হত। যদিও তার প্রায় সবটাই নাটক, কিছুটা ছেলের সামনে আর বাকিটা স্কুলে  দিদিমণিদের সামনে। অন্তরের কথা যতটুকু যা বলার আমিই বলতাম, উত্তরের আশা না রেখেই। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে  আসা আর নিয়ে আসার কাজটা বিদিশাই করত। অভিভাবকদের যখন স্কুলে কোন মিটিং এ ডাকত তখনই কেবল     আমি সাথে যেতাম, বলা ভাল যাওয়ার সুযোগ পেতাম। অবশ্য আমার অফিসের যা সময় তাতে রোজ স্কুলে যাওয়া  আমার পক্ষে সম্ভবও ছিল না। এইভাবে বছর দুয়েক চলল। শেষের দিকে আমাদের মধ্যে নাটকে নির্ধারিত ডায়লগ ছাড়া দু একটা  বাড়তি কথাও হত। যদিও  সে সবই আমার বাড়ি বা ওর বাড়িতে কে কেমন আছে তাই নিয়ে,  তার কোনটাতেই আমি নেই। তবে আমাদের মধ্যে আগের আড়ষ্টতা আর তেমন একটা ছিল না। আড়ষ্টতা না থাকলেও অত দিন দেখা সাক্ষাতের পরেও বিদিশার কথাবার্তায় আমার প্রতি সদয় হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। ওর মনের ভেতরে কোন পরিবর্তন এসেছিল কিনা জানি না কিন্তু বাইরেটা একই রকম ছিল।   ছেলে একটু বড় হওয়ার  পর থেকে আমাকে মিস করে। আমাকে কাছে পেতে চায়। ছেলেকে বিদিশা বুঝিয়েছে যে বুড়ো বাবা মাকে ছেড়ে আমার  ওদের ওখানে গিয়ে থাকা সম্ভব নয় আর বুড়ি পিসিকে ছেড়ে বিদিশার আমার কাছে গিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই আমরা আলাদা থাকা। অয়ন তখন শিশু তাই ব্যাপারটা ভাল না লাগলেও গল্পটা বিশ্বাস করত। এইভেবে শঙ্কিত হতাম যে এরপর বড়  হয়ে যখন জানতে বুঝতে শিখবে তখন প্রশ্নের জোয়ারে ভেসে যাবে ওই ছেঁদো গল্প।  আমাদের  বিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ জানার পর অয়নের প্রতিক্রিয়ার ওপর  নির্ভর করবে অনেক কিছু, অন্তত আমার জীবনের অনেক কিছু। সব কিছু শোনার পর সে আমাকে বিদিশার মত ঘৃণা করে দূরে  সরিয়ে দিতে  পারে অথবা না দেখা  অতীতকে  অতটা গুরুত্ব না দিয়ে  তার চেনা ভালবাসার মানুষটাকে একই রকমভাবে বাবা বলে জড়িয়ে ধরতে পারে।

    একদিন অফিসে গিয়ে খবর পেলাম আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে, ব্যাঙ্গালোরে। দিন পনেরর মধ্যেই রওনা দিতে হবে। আমাদের চাকরিতে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবু ছেলেটাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। আমার বদলির খবর জানিয়ে  বিদিশার কাছে এই কটা দিন রোজ একবার অন্তত ছেলেটার কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। বিদিশা আমার অনুরোধ রেখেছিল, আর আমাকেও একটা  অনুরোধ করেছিল।  বলেছিল “চলে যাওয়ার আগে ভাড়া বাড়ির পাট চুকিয়ে নিজের বাড়িতে মা বাবার কাছে গিয়ে থাক। তোমার  মা খুব দুঃখী  অসহায়, ওনাকে আর কষ্ট দিও না।” এতদিন বাদে এই প্রথম বিদিশাকে আমার বা  আমার বাড়ির ব্যাপারে কিছু মন্তব্য করতে শুনলাম। আসলে মাকে বিদিশা  পছন্দ করত, সেইজন্যেই  অয়নের কাছে যেতে কখনো  বাধা দেয়নি। মা  কোন দিনই বাবার মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি, সেদিনও পারেনি। প্রকৃত মনোবাসনা যাই হোক না কেন সেদিন আমাদের চুপ করে থাকাটাই হয়ে গিয়েছিল বাবাকে একপ্রকার পরোক্ষ সমর্থন। যা বিদিশাকে মর্মাহত করেছিল।  মায়ের প্রতি বিদিশার সহানুভূতি দেখে খুব ভাল লাগল। আমি অপেক্ষায় থাকতাম আমার জীবনের এই শুভ  দিনটির জন্যে।  আশা করতাম  একদিন কালের স্পর্শে  মুছে  যাবে বিদিশার সব অভিমান। যাইহোক,  কারফিউ একটু শিথিল হয়ে ছেলের কাছে আসার  আবেদন মঞ্জুর হয়েছে এটাই অনেক পাওয়া। কোলকাতা ছাড়ার আগে প্রতিদিন পিসির বাড়িতে ছেলের সাথে অনেকটা সময় কাটাতাম। আশ্রমের ছেলেগুলো এসে অয়নের সাথে খেলা  করে। ওরা অনেকটা বড় হওয়ায়  সারাক্ষণ অয়নকে  আগলে আগলে রাখত। সকলের জন্যে অনেক খেলনাপাতি নিয়ে যেতাম। ওই বাচ্চাগুলো খেলনা পেয়ে খুব খুশি হত আর জন্মাবধি  অনেক কিছু পেয়ে অভ্যস্ত অয়ন খেলনার থেকেও অনেক বেশি  আনন্দে মেতে উঠত তার বাবাকে দীর্ঘক্ষণ কাছে পেয়ে।  ওই কটা দিনের অপারসুখ স্তিমিত করেছিল   আমার অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণাকে।

    ওই প্রথম কোলকাতার বাইরে যাওয়া। পরিচিত জায়গা, মা, বাবা,পরিচিত জন, বিচ্ছিন্ন হয়েও  মনকে সদা  আচ্ছন্ন করে রাখা বিদিশা এবং সর্বোপরি আমার জীবনের আলো অয়ন, এতকিছু একসাথে ছেড়ে যাওয়া খুবই কষ্টের। মা খুব ভেঙে  পড়েছিল। বাড়িতে না থাকলেও প্রায়ই যাতায়াত করতাম। বাবারও বয়স হয়েছে, আর কয়েক বছর বাদে রিটায়ার করবে। নানা ঘটনা প্রবাহে মানুষটা একেবারে পালটে গেছে। কোলকাতা ছাড়ার কয়েকদিন আগে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে জিনিসপত্র নিয়ে চলে এলাম নিজের বাড়িতে। খানিকটা বিদিশার অনুরোধে আর অনেকটাই নিজের মনের টানে।  স্বেচ্ছা নির্বাসন কাটিয়ে বহুদিন বাদে নিজে বাড়িতে ঢুকে খুব ভাল লাগল। আমি চাকরি পেয়ে প্রথম যে বার বাড়িতে আসি বলাই কাকু   তার কয়েক মাস পরেই দেশে চলে গেছে। নানা অসুখে শরীরটা একেবারে ভেঙে গিয়েছিল, আর পারছিল না। সত্তরের ওপর বয়স,  ব্যামো হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অবশ্য বিকল্প একটা ব্যবস্থা করে তবে গেছে।  ভাইপো চন্দনকে আমার মা বাবার দেখভালের জন্য রেখে গেছে। ছেলেটা মন্দ নয়, ভরসা করা যায়। আমি ফিরে আসায় মা বাবাও খুব খুশি। বাবা আমার সাথে অনেক গল্প করল। আমার অফিস কেমন লাগছে, আর অন্য কোথাও চেষ্টা করছি কি না , ব্যাঙ্গালোরে কতদিনের জন্য যাচ্ছি, কোথায় থাকব, ওখান  থেকে কলকাতায় ফিরে আসব নাকি বিদেশে চলে যাব, সে কত কথা। এই মানুষটা আমার একেবারেই চেনা নয়। সবই সময়ের খেলা। যে ‘সময়’ বলাই কাকুর জীবনী শক্তি শুষে নিয়ে তাকে  অক্ষম করে দিয়েছে সেই সময়ের প্রবাহেই  সব অহং বিসর্জন দিয়ে বাবা যেন এক নতুন মানুষ। জীবনে এই প্রথমবার বাবার সাথে এত গল্প করলাম। চলে আসার আগে ওই কটা দিন বাড়ির আদুরে ছেলে হয়ে বেশ কেটেছিল।

    (চলবে)
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন