এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • প্রেম দেহ মন - পর্ব ৫

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১১৯ বার পঠিত
  • প্রেম দেহ মন
    পর্ব - ৫

    বিদিশা 

    তন্ময়ের সাথে যত মিশেছি  ততই আমার ওর প্রতি আকর্ষণ আর  ভাললাগাটা বেড়েছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র কিন্তু  তার জন্য এতটুকু দেমাক নেই। বড়লোকের একমাত্র সন্তান কিন্তু কোন দেখনদারি নেই, আচরণে অত্যন্ত সহজ সরল। কিছু করতে বললে তা করার আপ্রাণ চেষ্টা  করে। প্রাণ খুলে ভালবাসতে পারে। এমন একটা ছেলের ভালবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি সত্যিই ভাগ্যবান। বি টেকে অসাধারণ রেজাল্ট করেছে। অবশ্য কেবল বি টেক কেন ও সব পরীক্ষাতেই ভাল ফল করে। ওর ইচ্ছে ছিল পছন্দসই একটা চাকরিতে ঢুকে একটু পয়সা কড়ি জমিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে ফেলা। ছেলেটা ভালবাসার কাঙাল। আসলে জীবনে মা ছাড়া তো আর কারো স্নেহের পরশ পায়নি। আমার ভালবাসা পেয়ে ওর জীবনটাই পাল্টে গিয়েছিল। অর্চনা মাঝে মাঝে ইয়ার্কি মেরে বলত, “তুই  তো আমার ভাইটাকে মানুষ করে দিলি রে। এতদিন তো লেখাপড়ার বাইরে আর কিছু জানতই না, আর এখন বাবু একেবারে তৈরি হয়ে গেছে।” সত্যিই প্রথম দিন দেখা সেই চুপচাপ, লাজুক  মানুষটা তখন কত হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল।   আমি নিজে কিছুই করিনি, আমাকে পেয়ে এই পরিবর্তনগুলো ওর মধ্যে আপনা আপনিই এসেছে। সাথে সাথে ওর মনের মধ্যে একটা ভয়ও পাক খেত, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, “আমাকে  কখনো ছেড়ে চলে যাবে না তো?”   জানিনা কেন এমনটা ভাবত, হয়ত ওর অতীত জীবনই এই ভাবনার উৎস। এই  হারাবার ভয় থেকেই বোধহয় বিয়েটা তাড়াতাড়ি করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি এই তাড়াহুড়োয় বাধ সেধে জানিয়েছি এম টেক করে তারপর বিয়ে। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল তবে অনুরোধটা রেখেছে। অনুরোধ রাখায় খুশি হয়েছিলাম। ওর চরিত্রের একটা দুর্বল দিক আছে। ওর ইচ্ছে, অনিচ্ছে বা মতামত  কখনও জোরের সাথে প্রকাশ করতে  পারে না। আমার যে কোন অনুরোধ রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করত। ভালবাসার এই পর্যায়ে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কেবল আমি নয়, দেখেছি  বাড়ির অনেক অন্যায় নিয়ম নীতি আদেশ নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে বিসর্জন  দিয়ে ও বয়ে নিয়ে চলত। এত বড়  হওয়ার পরেও  এগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে নি। সেই মানসিক জোরটাই    ওর গড়ে ওঠেনি। আমার কাছে এসে অসহায় মুখে দুঃখ করত। শুনে আমারও খারাপ লাগত। ওকে আর বলব কি,  আমি নিজেও তো সেই একই ধাতুতে  গড়া। প্রতিবাদ করা ব্যাপারটাই আমার  আসে না। চরিত্রের এই দিকটা  ধরলে আমরা  মেড ফর ইচ আদার।

    এম এ পাশ করার পর একটা স্কুলে চাকরি পেলাম। প্রাইভেট স্কুল, মাইনে সাধারণ শিক্ষকদের তুলনায় কম। অস্থায়ী নিয়োগ, পরে স্থায়ী হওয়ার ব্যাপারেও কোন নিশ্চয়তা নেই।  তবু নিরেট বসে থাকার থেকে ভাল। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে বাড়ির সকলের জন্য জামাকাপড় কিনে আনলাম। ‘আবার এসব কেন কিনতে গেলি’ জাতীয় কথা বললেও দেখলাম সকলেই খুব খুশি। এমনকি মার মুখেও একটু হাসির আভাষ ছিল, শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। বাবার হাতে সংসারের জন্য দু হাজার টাকা দিতে বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলল। তন্ময়ের জন্য একটা ভাল টিশার্ট কিনেছিলাম। ওটা দিতে ওর সে কি আনন্দ। উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে রাস্তাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। একজন পথচারীর রসাল তির্যক মন্তব্য শুনে লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি  সরে গিয়েছিল।
    চাকরিতে ঢুকে আমার  একটা বড় চারিত্রিক পরিবর্তন এসেছিল। অর্থ উপার্জন আর তা নিজের  খুশিমত ব্যয় করার স্বাধীনতার সাথে সাথে  আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আত্মবিশ্বাস। কিছুটা লেখাপড়া ছাড়া  কোন ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কখনও এগোতে পারিনি। চাকরিটা কিছুদিন করার পরে মনে হয়েছে যে আমি পারি, আমি অনেক কিছুই পারি। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জয়িতা ঘোষকে প্রথম দিকে ভয়ে একটু এড়িয়ে চলতাম। সাধারণ কথাও এত জোরে বলেন যে হঠাৎ শুনলে মনে হবে বকাবকি করছেন। অতি গম্ভীর,  মুখটা একটা রাগী মানুষের সাইনবোর্ড। অতি মাত্রায় নিয়মনিষ্ঠ, একটু বেচাল হলে ছাত্রী শিক্ষিকা কারো রেহাই ছিল না। সকলেই খুব সমীহ করে চলে। জয়িতা ঘোষ কেবল প্রধান শিক্ষিকাই নন স্কুলের অন্যতম  মালিকও বটে। ফলে ক্ষমতা অসীম।  একদিন ওনার ঘরে  আমাকে ডেকে পাঠালেন, ভয়ে ভয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকতে অত্যন্ত নরম স্বরে বললেন ‘বোসো।” স্কুলের পরিবেশ পরিস্থিতি  কেমন লাগছে, বাড়িতে কে কে আছেন, অবসর সময়ে কি করি, এমন অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। চলে আসার আগে মাথায় হাত দিয়ে বললেন—তুমি আমার সন্তান তুল্য, কোন রকম সামস্যা হলে নির্ভয়ে আমাকে জানাবে। মন দিয়ে কাজ কর।

    ঘরে ঢুকেছিলাম মানুষটার সম্পর্কে একরকম ধারনা নিয়ে আর বেরিয়ে এলাম সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষকে প্রত্যক্ষ করে। এরপর ধীরে ধীরে জয়িতাদি হয়ে উঠলেন আমার অত্যন্ত আপনার জন। ওনার ইচ্ছেতেই  আমার অস্থায়ী চাকরিটা স্থায়ী হয়েছে। স্কুলে কাছেই নিজস্ব দু কামরার একটা ফ্ল্যাটে ওনারা স্বামী স্ত্রী  থাকতেন। এক মেয়ে বিয়ে  হয়ে বিদেশে থাকে।  একদিন ছুটির পর জোর  করে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। সাজান গোছান সুন্দর ফ্ল্যাট। ওনার স্বামীর সাথে পরিচয় করালেন। অরুণ কাকু দীর্ঘদেহী সুপুরুষ। কথাবার্তাও খুব সুন্দর। অল্প কিছুদিন হল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ‘কাকু’ ডাক শুনে জয়িতাদি মজা করে  বললেন—মেয়ের এ কেমন সম্বোধন। একটা প্যারিটি তো রাখবি, নাকি! আমি দিদি আর আমার বর  কাকু। নয় ওকে দাদা বল আর নয় আমায় কাকিমা বল।   

    “তুমি ওর সহকর্মী তাই দিদি বলে। কর্মস্থলে পিসি, মাসি, কাকা, জেঠু, এসব চলে না। নাহলে ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে  তোমাকে কাকিমাই বলত”, হাসতে হাসতে  অরুণ কাকু বললেন। খুব  সুন্দর পরিবার। যাতায়াত  করতে করতে আমি ওনাদের আর একটা মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলটা আমার জীবনের অক্সিজেন। আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করে জীবনের অনেক ভাঙাগড়ার সময় আমার মেরুদন্ড সোজা রেখে বাঁচতে সাহায্য করেছে।

    সময়ের অভাবে সেই সময় আমাদের মেলামেশাটা আগের থেকে অনেক কম হচ্ছিল। এ নিয়ে তন্ময়ের বিস্তর  অভিযোগ। স্কুল, পড়াশোনা, ছাত্রছাত্রী, এসব নিয়েই  আমি মেতে থাকি। ওর জন্য আমার কাছে আর নাকি   আর কোনো সময় নেই। অভিযোগ পুরোটা না হলেও আংশিক সত্যি। এমনকি  অর্চনার সাথেও তখন কম দেখা হত । পাগলিটা অবশ্য সেই  আগের মতই ছিল। 

    জয়িতাদি একদিন একান্তে জিজ্ঞেস করলেন—হ্যাঁরে মেয়ে, বাড়ি থেকে তোর বিয়ের জন্য চেষ্টা করছে না? আমি লাজুক মুখে চুপ করে আছি দেখে বললেন—পছন্দের কেউ আছে নাকি? একটু চাপাচাপি করতে বলে ফেললাম। শুনে বললেন—গুণী মেয়ে, কাজ তো এগিয়েই রেখেছিস। তা  একটা ছুটির দিন দেখে আমাদের বাড়িতে একবার নিয়ে আয়, একটু দেখি।
    তন্ময়কে দেখে, ওর সাথে কথা বলে জয়িতাদি আর অরুণদা দুজনেরই ভাল লেগেছিল। ও চলে যেতে  অরুণদা  জয়িতাদিকে বললেন—ছেলেটি বেশ ভাল। মেয়ের আমাদের পছন্দ আছে বলতে হবে।

    দেখতে দেখতে তন্ময়ের এম টেকের এক বছর হয়ে গেল। একদিন বেড়াতে বেড়াতে বেশ ধমকেই আমাকে বলল—দেখ পাশ করতে মাত্র আর এক বছর। পাশ করে চাকরি পেতে যতটুকু সময়, ব্যাস তার পরেই কিন্তু বিয়ে। এর পরেও যদি কোন বেগড় বাঁই কর তাহলে সোজা তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করব।
    হেসে বলেছিলাম—তোমার ক্ষমতা আমার জানা আছে। যা বললে তার সিকিভাগও করার সাহস তোমার  নেই।
    মুখে যাই বলি  না কেন মনে মনে আমিও বিয়ের সেই শুভ দিনটার  জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

    অর্চনা

    এম এ পাশ করার পর আমার  কাজ বলতে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রেম করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর টিভি দেখা।  বাড়ির কাজ যে টুকটাক করতাম না  তা নয় তবে রান্নার দিকটায় খুব ঠেকায় না পড়লে যেতাম না। আমার রান্নার ব্যাপারটা নিয়ে মার খুব চিন্তা ছিল। বলত, “আমার পাশে বসে দু চার পদ একটু রাঁধতে শিখে নে, না হলে বিয়ের পরে  শ্বশুরবাড়িতে তো সবাই ছ্যা ছ্যা করবে।”

    আমি মাকে আশ্বস্ত করতাম, “তোমার কোন চিন্তার কারণ নেই। কাজ চলা গোছের দু তিনটে পদ রাঁধতে জানি, ফলে  উপোস করতে হবে না। আমি অমিতকে প্রথমেই বলে দিয়েছি যে রান্নাটা আমার তেমন আসে না আর ভবিষ্যতেও এ ব্যাপারে উন্নতির খুব একটা সম্ভাবনা নেই। আর সব থেকে বড় কথা আমি না জানলেও তোমার হবু জামাই অনেক রান্না জানে ফলে চিন্তা নেই। তোমার ওইটুকু মাথায় এত চাপ নিও না মা।”

    “বেহায়া মেয়ে কোথাকার, বলতে লজ্জা করল না? কাল থেকে মাঝে মাঝে একটু রান্নাঘরের মুখো হোয়ো বুঝেছ।” একদিন  হঠাৎ জিজ্ঞেস করল--হ্যাঁরে বুলি,  তনু  আর বিদিশা কবে বিয়ে  করছে কিছু জানিস? আমি বললাম “ তনু আগে পাশ করে চাকরি বাকরি করুক তারপর তো বিয়ে। ধরে নাও আরো বছর দুয়েক। তা হঠাৎ বিদিশার বিয়ের  কথা জিজ্ঞেস করলে?”
    -ওকে সেই এতটুকু থেকে দেখছি, শান্ত মেয়ে। ওর বাবার দেমাক আর মেজাজ দুটোই তো  বেশি আর মেয়েটা  বড্ড বেশি ভাল  তাই চিন্তা হয়। অবশ্য বৌদি মানুষটা খুব ভাল আর তনুও ছেলে খারাপ নয়। ভালয় ভালয় বিয়েটা মিটে গেলে শান্তি পাই।

    -- সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে মা, এত আজেবাজে চিন্তা না করে ব্রেনটাকে একটু রেস্ট দাও। 
    সোফায় বসে টিভিটা সবে চালিয়েছি মার আবার প্রশ্ন— হ্যাঁরে বুলু, এত লেখাপড়া শিখলি কি নিরেট  বাড়িতে বসে থাকার জন্য। তোর বন্ধুদের দেখ, সবাই কিছু না কিছু করছে।
    --হ্যাঁ গো মা আজ তোমার কোন কাজ নেই, আদাজল খেয়ে আমার পিছনে পড়েছ। শোন রান্না নিয়ে ভেবে অযথা মাথা খারাপ কোরো না ওটা হওয়ার নয়, তবে চাকরিটা গুড সাজেসান, ভেবে দেখছি।

    কলেজ ইউনিভার্সিটির পাট চোকার পর প্রথম কটা দিন মৌজ মস্তিতে কাটলেও  পরের দিকে অখন্ড অবসরটা বেশ  বোরিং লাগছিল। লেখাপড়া কোনদিন এনজয় করিনি তাই শিক্ষকতা আমার জন্য নয়। ওসব বিদিশার মত ভাল মেয়েদের জন্য। দেখে শুনে পাঁচ রকম জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছি, দু একটা পরীক্ষাও দিয়েছি, বাকিটা কপাল। কিছুদিন  বাদে রেলে একটা চাকরি পেলাম বটে, তবে পোস্টিং আদ্রাতে। যাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই, তবু খবরটা মাকে জানিয়ে বললাম আমার জিনিস পত্র গোছগাছ করে দিতে। মা জানিয়ে দিল যে অত দূরে গিয়ে একা থেকে চাকরি করার কোন দরকার নেই। কুঁড়ের ভগবান সহায়, আমিও তো এটাই চাইছিলাম। উল্টো চাপ দিয়ে বললাম, “লোকে চাকরি পায় না আর তুমি এত ভাল একটা চাকরি ছেড়ে দিতে বলছ। চাকরি নিয়ে কিন্তু আর কোনদিন কিছু বলতে পারবে না।”  কিছুদিন  বাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে একটা চাকরি পেলাম। এবার আমি খুশি, অমিত খুশি, আমার মাও খুশি।  অমিতকে বললাম—বর ডাক্তার, বউ ডাক্তার হতে পারেনি তো কি হয়েছে তারও কারবার স্বাস্থ্য নিয়ে। মাইনে পেয়ে ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। প্রচুর কেনাকাটা করলাম। মা, দাদা, বিদিশা সকলের জন্য জিনিসপত্র কিনলাম।  অমিতের জন্য  জিনসের দামি প্যান্ট আর একটা ভাল ব্যাগ আর ওর বাড়ির সকলের জন্য কিছু  কিছু কিনলাম। একটা রোববার সব জিনিসপত্র নিয়ে ওর ভাড়া বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে ভুরভুর করছে মোঘলাই রান্নার গন্ধ। বলে রেখেছিলাম যে দুপুরে খাব তাই বাবু সকাল সকাল বাজার করে এনে  রান্নায় লেগে গেছে। ও মাঝে কিছুদিন খুব ব্যস্ত থাকায় সেবারে আমাদের প্রায় মাস খানেক বাদে দেখা হচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকতে দরজাটা বন্ধ করে জিনিসপত্র  সমেত ছোঁ মেরে  আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে একেবারে ঘরের বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেলল। কথা বলারও উপায় নেই কারণ আমার মুখ ওর মুখের সাথে লক হয়ে আছে। বেশ কিছুদিন বাদে দেখা তো তাই একেবারে ২০/টোয়েন্টি খেলছে, আক্রমণাত্মক রোমান্স। ঠোঁটের বাঁধন খোলার পরে  জিনিসগুলো দেখালাম। খুব খুশি  হল, আনন্দে শুরু হল রোমান্সের দ্বিতীয় পর্ব। উনুনে মাংস চাপান  রয়েছে, পুড়ে যাওয়ার ভয়ে সোহাগ মাঝপথে থামিয়ে ছুট লাগাল রান্নাঘরের দিকে। এক্কেবারে ছেলেমানুষ, কেউ বলবে এই মানুষটাই একটা বড় হাসপাতালের দায়িত্বশীল ডাক্তার। ওর এই ছেলেমানুষি আমি কণায়  কণায় উপভোগ করি। ও যখন আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে তখন আমি আর  নিজের মধ্যে থাকি না, হারিয়ে যাই কোন এক অনন্ত আনন্দলোকে। মনের মানুষের হৃদয় উজাড় করা আদর আর পাগলা করা রান্না খেয়ে, খাসা কাটল দিনটা। আর দেরী নয়,  ঠিক করলাম,  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব  এক বিছানায় শোয়ার আইনগত স্বীকৃতিটা এবার নিয়ে নিতে হবে। দূরে থেকে অকারণে শরীর আর মনকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ! এর কিছুদিন বাদেই ওই বাড়ি ছেড়ে অমিত একটা বড়ো সুন্দর ফ্ল্যাটে উঠে গেল।  বাড়ি ফিরতে মা জিজ্ঞেস করল—অমিতের কি খবর রে? কতদিন আসেনি, ভাল আছে তো? 

    --হ্যাঁ মা দিব্য আছে। হাসপাতালে খুব ব্যস্ত ছিল। আমার সাথেই তো এক মাস বাদে দেখা হল। আমি রাঁধতে না পারলে কি হবে ভালোমন্দ খাওয়ার কপালটা আমার দারুণ ভাল। বাড়িতে রোজ  তোমার হাতের মুখরোচক রান্না খাচ্ছি আর ভবিষ্যতেও যে এমন খাবার থেকে বঞ্চিত হব না সে ব্যাপারে  আজ কনফার্ম হয়ে গেলাম। অমিতের রান্নাগুলো এখনো মুখে লেগে আছে।
    সারা দিনের ঘটনাগুলো একটু সেন্সর করে মাকে গল্প করলাম। মা তার সন্তানের সুখের মনে মনে অংশীদার হয়ে তৃপ্ত  হৃদয়ে বসে বসে শুনল। গল্প ফাঁকে মাকে বললাম, “এবার আমাদের বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা শুরু করতে পার।”
    --যাক বাবা এতদিনে নিশ্চিন্ত করলি। ধিঙ্গী মেয়ে দিনের পর দিন টো টো করে প্রেম করে বেড়াচ্ছে এ বাপু ভাল লাগে না। লোকেই বা বলবে কি!
    --ওরে পেটেপেটে এত। এতদিন লোককে বলতাম আমার মা খুব লিবারাল এখন তো কথা শুনে মনে হচ্ছে মডেল তো বেশ পুরোনো।

    মার কোলে মাথা রেখে শুলাম, মা ধীরে ধীরে চুলে বিলি কাটতে লাগল। আর তো কটা দিন, একটু মায়ের আদর খেয়ে নিই। বিয়ের  পর অমিতের  মাঝে  বিলীন হয়ে ভালবাসায় প্লাবিত হব, মিলনসুখের মধুর  তরঙ্গে দোল খাবে তৃপ্ত  শরীর ও মন তবু থেকে থেকেই  মিস করব পৃথিবীর সবথেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয়, স্নেহময়ি মায়ের কোল। ঈশ্বর দুঃখকষ্ট দেওয়ার সময় কত বেহিসেবি  হয়, সুখের বেলায় এত নিক্তি মেপে কাজ করে কেন বুঝিনা। একটা  পেতে গিয়ে অন্য একটাকে হারাতে হবে কেন? একটু উদার হয়ে দুটোই  কি একসাথে দিতে পারে না।
    অমিত একদিন জোর করে মাকে নিয়ে গেল ওদের দেশের বাড়িতে। মা প্রথমে একটু নিমরাজি ছিল,  কিন্তু আমি  যখন বললাম যে “ওখানে গিয়ে বিয়ের  ব্যাপারে আলোচনাটা সেরে এসো না” তখন আর না করেনি। অমিতের আমাকেও নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু অফিসে আমার ছুটির ভান্ডার বাড়ন্ত বলে যাইনি, মা একাই গিয়েছিল। বিয়ের সময় ছুটির দরকার, আগেই সব  ফুঁকে দিলে পরে  সমস্যা হবে।

    মাকে নিয়ে সেই কোন সকালে অমিত বেরিয়েছিল, জমা দিয়ে গেল যখন তখন বাজে রাত দশটা। ঘুরে এসে মা খুব খুশি। রাতের রান্নাটা আমিই যা হোক করে করে রেখেছিলাম। রান্নাঘরে গিয়ে রান্না রেডি দেখে মা জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, “আমার লক্ষ্মী মেয়ে, সোনা মেয়ে।”  খাওয়া দাওয়া করে ফিরে যাওয়ার সময় অমিত মাকে বলল—কাকিমা, আপনার  মেয়ের রান্না খুব বাজে নয়।

    আমার উত্তর দেওয়ার আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। রাতে মা আর বেটিতে বহুক্ষণ গল্প করলাম। মা তো ওদের বাড়িতে গিয়ে আপ্লুত।
    ---কি সুন্দর মানুষগুলো রে বুলি। অমিতের  বাবা, মা, ভাই, বোন, সব্বাই সারাদিন আমার সাথে ছিল। কত গল্প, কি  আপ্যায়ন। আর খাওয়া দাওয়া, কত রকমের যে রান্না করেছিল তোকে কি বলব। সব রকম পদ পাতের পাশে সাজিয়ে দিয়েছে, খাওয়া তো দূরের কথা দেখেই আমার চক্ষু চড়ক গাছ। অনেক অনুনয় বিনয় করে কিছুটা নিস্তার পেয়েছিলাম। বাড়ি, বাগান, সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। কত গাছ গাছালি, ফলের গাছ, ফুলের গাছ, চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ওদের কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথেও আলাপ হল। একজন তো ওর বাবা পরিচয় করাবার আগেই আমার   দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তুই অণু না?” আমি হ্যাঁ বলাতে বলল, “এতদিন বাদে দেখছি,  তুই কিন্তু একটুও পাল্টাস নি।”   আমি হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছি  দেখে লোকটা বলল “আমি নিমাইরে, নিমাইদা। ছোটবেলায় খড়গপুরে পাশাপাশি রেল কোয়ার্টারে কতদিন ছিলাম মনে পড়েছে।” লজ্জা পেয়ে বললাম, “একদম চিনতে পারিনি।  যখন দেখেছি তখন তোমার পনের কি ষোল হবে। আমার চেনা সেই মুখ দিয়ে আজকের তোমাকে সত্যিই চেনা মুশকিল।”
    তোদের বিয়ের ব্যাপারেও কথা হল। কয়েক মাস পরেই তো অমিতের বোনের বিয়ে, ওরা তারপর আমার সুবিধেমত একটা সময় জানতে চাইল। ওদের বললাম যে  আমার ইচ্ছে আগামী বছরের শীতে, নভেম্বর বা ডিসেম্বর  মাসে বিয়েটা হোক। যোগাড় যন্তর করার জন্য খানিকটা  সময় পাওয়া যাবে। ওদেরও দেখলাম সেইরকমই ইচ্ছে।
    মা একটানা অনেকক্ষণ বকে থামার পর বললাম—মা, চৈতন্য কাকু তোমার বয় ফ্রেন্ড ছিল তাই না?
    --কে চৈতন্য কাকু?
    --ওই যে তোমার  নিমাইদা গো। 
    --মায়ের সাথে ছ্যাবলামো হচ্ছে। আমার মা তোর মায়ের মত নয়, তোদের মত বেচাল দেখলে আস্ত রাখত না। আমার বাবা যখন খড়গপুরে পোস্টেড ছিল  তখন আমাদের পাশের কোয়ার্টারে থাকার সুবাদে ওদের সাথে পরিচয়। তখন আমি খুব ছোট, দশ এগার মত বয়স। তবে এটুকু মনে আছে ওদের বাড়ির সাথে আমাদের বেশ সুসম্পর্ক ছিল।
    -- ঠিক আছে আমি অমিতকে বলে দেব আমার মায়ের বয় ফ্রেন্ড চৈতন্য কাকুকে যেন বরযাত্রীদের লিস্টে রাখা হয়।

    খুনসুটি করতে করতে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন