চারটে দশের ঘন্টা পড়তে গিয়ে তাই নিজেকেই ফিরে পড়ি। মনে হয় এ কোনো বিশেষ ব্যক্তির স্মৃতি-গাথা নয়, বরং সত্তর আশির দশকে ব্যাপ্ত মফস্বল তার সমস্ত কাহিনি নিয়ে এইখানে জ্যান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ অরহান পামুকের স্মৃতিকথা ইস্তানবুলের মতোই এতে শুধু ব্যক্তি নয়, প্রাধান্য পেয়েছে বিশেষ সময় এবং স্থান। নাই বা হলো সে কোনো বিখ্যাত শহর, কিন্তু মেদিনীপুরের কাঁসাই কী মন্ত্রবলে উত্তরবঙ্গের মানসাই নদীকে স্মৃতির জলোচ্ছ্বাসে মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছে। ... ...
সুধীর চক্রবর্তী। প্রয়াত হলেন সম্প্রতি। অনন্য প্রাবন্ধিক। অসাধারণ বাগ্মী। তেমনই ছিলেন একজন চিরায়ত শিক্ষক, যে শিক্ষক স্নেহপ্রবণ, যে শিক্ষকের আশীর্বাদমুদ্রা সতত তাঁর ছাত্রদের মাথার উপরে। বিবিধ বিষয়ে তাঁর গভীর গবেষণা। প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ ও ঈশ্বর সম্পর্কিত যে বোধগুলি লোকধর্মগুলি নুড়িপাথরের মতো পড়েছিল, সুধীরবাবু তর্জনী নির্দেশে দেখালেন, এই দ্যাখো, এগুলো রত্ন। লিখছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী ... ...
বইটা একটা ভয়াল নকশিকাঁথার মাঠ। ছুঁচের নিপুণ বুনুনিতে গাঁথা হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট কোলাজ। তাতে নানান চিত্র, নানান শহরের টুকরো ছবি। কোলকাতা থেকে মুম্বাই, পুনে, কেরল এবং পাটনা। সবমিলিয়ে ধীরে ধীরে উপন্যাসটি ৭২ টি পর্বে এবং পঞ্চাশ হাজার শব্দের বয়নে এক মহাকাব্যিক আকার নেয়। আর বইটি নিখাদ উপন্যাস, সমসাময়িক জীবনের জীবন্ত দলিল, কিন্তু কখনই খবরের কাগজের রিপোর্ট নয়। একশ বছর আগের স্প্যানিশ প্লেগে শুধু শহর কোলকাতায় দু’কোটি মানুষের মরে যাওয়ার গল্প আমাদের আজ তেমন বিচলিত করে না। ও তো অনেক আগের কথা, তখন ভারত ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। তখন তো টিবি’রও তেমন চিকিৎসা ছিল না। স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কার হয়নি। আজ স্বাধীন ভারতে এমনটি হতে পারে না। তখন এত হাসপাতাল ছিল না। এত প্রাইভেট হাসপাতাল ছিল না। খোলা বাজারে এত ওষুধ পাওয়া যেত না। আমরা নিশ্চিন্ত থাকি। এখন মানুষের গড় আয়ু তখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোন চিন্তা নেই। ... ...
পেন্ডুলাম দোলে একই নিশ্চিত গতিতে –ডাইনে থেকে বাঁয়ে, ফের বাঁ থেকে ডাইনে। টিক টক, টিক টক। এই দোলনগতিকেই বোধহয় স্কুল পাঠ্য বই বর্ণনা করে সিম্পল হারমোনিক মোশন বলে। আরও দুটো শব্দ শুনি—গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ এবং কাইনেটিক এনার্জি বা গতিশক্তি। কিন্তু বিশেষ অবস্থায় বোধহয় মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে গতিশক্তি জোর বেশি—যা বস্তুর অবস্থানকে বদলে দেয়। ঘাবড়াবেন না। আমি কোন স্কুলে বিজ্ঞান পড়াই না, আমার সে যোগ্যতাও নেই। কিন্তু এতসব কথা আমার মনে এল একটি গল্প-সংকলন পড়তে গিয়ে। বইটি হল একডজন গল্পের একটি সংকলন। ... ...
ডঃ অনিরুদ্ধ কালা, পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পারিবারিক ও কর্মসূত্রে খুব কাছ থেকে দেখেছেন দেশভাগের শিকারদের। দেখেছেন দেশভাগ কী গভীর ক্ষত রেখে গেছে মনোরোগীদের মধ্যে। ডঃ কালা মাতৃগর্ভে সীমান্ত পেরিয়েছিলেন, স্বাধীনতার কয়েক মাস পরে জন্ম তাঁর, বড় হওয়া ‘রিফিউজি বাচ্চা’ হিসেবে। ছোটবেলায় দাঙ্গা সম্পর্কে জিগ্যেস করলে তাঁর মায়ের বাঁধা উত্তর ছিল ‘আমাদের গ্রামে ওসব হয় নি, অন্য গ্রামে হয়েছে’। এলাকার অন্য বাচ্চাদের মায়েরাও একই কথা বলতেন তাদের। ঐতিহাসিক পার্থ চ্যাটার্জি যাকে বলেছেন একটু সরে সরে বলা। বড় হয়ে বুঝেছেন এ আসলে ভয়াবহ আতঙ্ক ও মানসিক আঘাত থেকে বাচ্চাদের এবং নিজেদেরও সরিয়ে রাখার জন্য বলা। ... ...
সুকোভ কোনও সময় টুপি পরে খাবার খায় না। সেটা খুলে সে হাঁটুর ওপর রাখে। তার দিয়ে তৈরি করা একটি চামচ যেটা সেই ১৯৪৩ সাল থেকে তার সঙ্গী সেটা সে তার পায়ের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলোর মধ্যে থেকে বার করে। চামচ দিয়ে দুটো বাটির তরল নাড়িয়ে দেখে। গরম, ধোঁয়া উঠছে। এক চামচ সে মুখে দেয়, আরও এক চামচ। উষ্ণতা তার শরীরের জমে থাকা হিম ভেদ করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। আঃ স্বর্গীয়! তার মুখ উদ্ভাসিত, কোনও কষ্টই তার কাছে আর কষ্ট নয়। লপসিটা সে নাড়ায়, চলে যাবে, মাছের একটা সেদ্ধ ক্ষীণ কাঁটাও আছে যেটার সঙ্গে ফুলকো পাখনার টুকরাটাকরা লেপটে আছে। প্রতিটি কাঁটা সে শুষে নিঃশেষিত করে ফেলে, ছিবড়ে করে টেবিল ভরিয়ে দেয়। ৎসজারের বাটিতে আবার একটা বরফঘেয়ো আলু! কোনও তাড়াহুড়ো নেই তার, ধীরে সুস্থে খায়। আলুটা মিষ্টি, কিন্তু শক্ত। সুকোভ একটা বাটির তরল শেষ করে অবশিষ্টটা কাচিয়ে দ্বিতীয় বাটিতে ঢেলে দেয়। সেটাও চেটেপুটে চকচকে করে দিয়ে তবে তার শান্তি। ... ...
প্রথমেই যা নিবিষ্ট করে তা হল এই বইয়ের অত্যন্ত সুলিখিত ভূমিকাটি। লেখক পাঠক দুইয়ে মিলেই তো সাহিত্যের সেতু গড়া। "সকলে কি লেখেন? কত নিবিষ্ট পড়ুয়া আছেন, খুঁজে খুঁজে বার করে আনেন সাহিত্যের মণি-মুক্তোগুলি। ভালো পড়ুয়া আছেন বলেই অনেক মহৎ লেখক বেঁচে ওঠেন বিস্মৃতি থেকে।" এইরকম পাঠকেরাই খুঁজে বার করেছেন কতোদিনের হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলি। তাদের অনেকগুলিই বিশ্বমানের, অথচ তাদের স্রষ্টারা আজ বিস্মৃত। এদের সংগ্রহ করে এবং একত্রে সংকলিত করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন সাহিত্যিক অমর মিত্র, প্রকাশনার জন্য গুরুচন্ডা৯। আমাদের সাগ্রহ অপেক্ষা থাকে পরবর্তী খন্ডগুলির জন্য, কারণ "এই সংকলন যেন আমাদের বংশলতিকা খুঁজে বের করা। সেই খোঁজের শুরু হলো মাত্র।" ... ...
খালের প্রসঙ্গ ধরে কলকাতার ইতিহাসে প্রবেশ করার গুস্তাখি মাফ; আমি নিরুপায়। যা পড়েছি, তাই বলছি: সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন মারাঠা বর্গিরা বারবার বাংলায় হানা দিচ্ছে, গঙ্গাপ্রান্তের এই শহরকে বাঁচানোর জন্য শহরের মাঝবরাবর একটা বিরাট খাল কাটা হয় (যাকে বুজিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের সার্কুলার রোড)। বৃথাই খাল-কাটা! বর্গি এল না কলকাতা ঘুরতে, উল্টে সেই পরাক্রমশালী খাল ডিঙিয়ে সিরাজের সৈন্যদল হাহা করে এসে শহরের সবচেয়ে পুরোনো নাট্যশালা 'ওল্ড প্লে হাউজ' ভাঙচুর করে চলে গেল ১৭৫৬ নাগাদ। এতকিছুর পর বোধ হয় অনেকের মনে হয়েছিল, এতবড় একটা খাল কাটলাম, একেবারে কোনোই কাজে আসবে না? সে থেকেই অনুবর্তী নবজাগরণ -- 'খাল-কাটা' টু ‘ক্যালকাটা’। ... ...
"আমাদের দেশভাগ এক জটিল, বহুস্তরীয় ইতিহাস। বিভিন্ন ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথায় তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। কোনও একটি লেখা তো তার সব কোণ ধরতে পারে না। তার উপর উদ্বাস্তু শব্দটা তো আর কোন সমসত্ত্ব গোষ্ঠীকে বোঝায় না। বিভিন্ন জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-দেশ-কালের স্থিতির ভিত্তিতে একেক জনের দেশভাগের স্মৃতি একেক রকমের। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় এক রক্তমাখা ইতিহাস। সেখানে হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি। যে দেশভাগ মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণ বাঙালি পুরুষের কাছে ধন-মান-প্রাণ নিয়ে পলায়ন, এবং পরবর্তীকালে এক ধরণের স্মৃতিমেদুরতার জন্মদাতা, সেই একই দেশভাগ অন্য অনেক মেয়েদের ব্যক্তিগত যাতনার উৎসমুখ।" জ্যোতির্ময়ী দেবীর "এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা" আর গোপালচন্দ্র মৌলিকের "দেশভাগ ও ননীপিসিমার কথা" - পড়লেন স্বাতী রায়। ... ...
"উদ্বাস্তু কলোনি পত্তন ঘিরে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট, ডান-বাম রাজনৈতিক বিরোধ, দলাদলি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত কোঁদল, নেতাদের দাপট- দুর্নীতি- ধান্দাবাজি ছিল। কিন্তু সেটাই সমাজে নির্ধারক ছিল না। জমিদারের গুন্ডা-পুলিশের সঙ্গে যুঝে রাতপাহারার ফাঁকে জলজংলা, পতিত জমি দখল করে নয়া বসত পত্তন ও ভিটেমাটির বিলি-বন্দোবস্তের কালে নানা মতের পূর্বপুরুষদের যূথবদ্ধ অস্তিত্বের লড়াই এখন পুরাকথার সামিল।" উদ্বাস্তু কলোনির কথা : একটি স্মৃতিকথা সংকলন - বইটি নিয়ে লিখলেন বিশ্বজিৎ রায়। ... ...
আসলে, মেধা-যুক্তি-বিতর্কের সঙ্গে কায়েমি স্বার্থ কোনওদিনই পেরে ওঠে না। তখন, সব কালে, একটি পথই অনুসৃত হয়। চরিত্রহনন আর কুৎসা রটনা। একেবারে, এক জিনিস ঘটেছিল খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের সঙ্গে। মূলতঃ লুক্রেশিয়াসের রচনা থেকে তাঁর দর্শন রেনেসাঁসের সময় ইওরোপ জানতে পারে। এবং পরম শক্তিশালী, জ্ঞানবিপণির চাবিকাঠির রক্ষক চার্চ, তাঁর দর্শন - যার সঙ্গে যাবজ্ জীবং সুখং জীবেৎ - এর আশ্চর্য মিল - কে অসংযত বেলেল্লাপনার সমার্থক বলে দেগে দেয়। ইংরিজিতে এপিকিউরিয়ান বলতে লাগামছাড়া ইহসুখবাদী (হেডনিস্ট) এক মানুষকে বোঝানো হয় আজও। ... ...
দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে! আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম। ... ...
কথা বাড়াতে ইচ্ছে করবে না বলেই হাঁটব। আমার পাশেপাশে যারা ভীড় জমাবে তাদের গা থেকে উঠে আসা ধোঁয়া গন্ধে ভয় পাব না। না জেনে না চিনে অযথা ভয়ে একটা অভিশপ্ত জীবন আঁকব না, এটুকু অন্তত আমার উত্তরণ ঘটবে আমি নিশ্চিত। গুনিনের বুকের ভিতর কোন ঝড় গেঁথে তুলেছেন লেখিকা সেকথা ভাবতে ভাবতে বরং অন্ধকারের গায়ে আঙুল রাখব। কেউ হয়ত গল্প শোনাবে তাদের গুনিন হবার কাহিনী। ভুলভ্রান্তিতে ভরা ভয়ংকর দানবীয় ইতিবৃত্ত। লেখিকাও যে 'গুনিন' গল্পে বুক মুচড়ে ওঠা শব্দটুকু লিখেছেন, ভাবতে থাকব... ... ...
সাহিত্য নয়, কথকতা। পড়তে পড়তে মনে হয়, কথকতাও নয়, চিত্রনাট্য। সাবলীল গদ্যের টানে টেনে নিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রই যেন। প্রতিটি ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আর তার আগে-পরে বহু ফ্ল্যাশব্যাক মুহূর্তকে লেখক ধরেন কখনও ক্লোজ শট, কখনও মিড শট, কখনও লং শটে। তাঁর ক্যামেরার চোখে কখনও ভি শান্তারাম, কখনও বিমল রায়, কখনও গুলজার। ছোটখাটো চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত আদ্যন্ত বাঙালি যে মানুষটি বাংলা সাহিত্যের পুনর্নির্মাণ করেছেন সেলুলয়েডে, তাঁর নির্ভার স্মৃতিচারণে কী অবলীলায় ধরা পড়েছে ষাট-সত্তর দশকের বোম্বে থেকে কলকাতা। শচীনকর্তার বাড়ি থেকে হেমন্ত কুমারের সঙ্গে আড্ডা, বিমল রায় থেকে সত্যজিৎ রায়ের সাহচর্য, ম্যাডাম কাননবালা থেকে মিসেস সেনের কাছের মানুষ, মহানায়ক উত্তম থেকে ম্যাটিনি আইডল রাজ কাপুরের সখ্যতা... বর্ণময় জীবন কি একেই বলে? ... ...
চিররহস্যের আড়াল থেকে মনকে অনাবৃত করার প্রচেষ্টা দার্শনিকেরা করেই চলেছেন। গত পঞ্চাশ বছরে কম্পিউটার ও স্নায়ু বিজ্ঞানের অগ্রগতি মনোদর্শনের চর্চাকে যে ভাবে উজ্জীবিত করেছে, তার অভিঘাত বাংলা প্রকাশনার জগতে সে ভাবে পড়েনি বললেই চলে। বহু বিচিত্রপথে বিশ্বের জ্ঞানচর্চার জগতে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া আলাপ-আলোচনার সঙ্গে বাংলাভাষার আগ্রহী পাঠকদের পরিচয় হবে এই গ্রন্থটির মাধ্যমে। অমিতাদেবী ভূমিকাতেই রবীন্দ্রনাথ থেকে ডেনেটের উক্তি তুলে ধরে দেখিয়েছেন, তাঁর উদ্দেশ্য মনোদর্শনের সরটুকু কল্পগল্পে ফুটিয়ে তোলা। প্রশ্ন ওঠে, গল্পের আগে কল্প কেন? এখানেও লেখক রবীন্দ্রনাথের শরণ নেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গল্পমাত্রেই কি কল্পলোকের অধিবাসী নয়? ক্বচিৎ কখনও গল্প যদি সত্য হওয়ার দাবি রাখে, তবে অধিকাংশ গল্পই কেবল সত্য নয়, ‘আরও-সত্যি’।’’ ... ...
পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং মেলে AC 2 tier এ confirmed টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা বা এবারের ICC Test Championship এ ভারতের champion হওয়ার সম্ভাবনা কতটা --- এই ধরণের আলোচনা তো আমরা হামেশাই করে থাকি। যদুবাবু এই সব ধরণের সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর আলোচনাগুলো একেবারে আমাদের মত আনাড়ি সুলভ নয়। আবার যদুবাবু এই বিষয়ে পণ্ডিত হলেও তাঁর লেখার মধ্যে পণ্ডিতি ব্যাপার স্যাপার একেবারেই নেই। বরং দৈনন্দিন জীবনে, রকেট উৎক্ষেপণ বা যুদ্ধক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের পেছনে কিভাবে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা তত্ত্বের প্রয়োগ --- যদুবাবু পুরোটাই আলোচনা করেছেন বৈঠকি মেজাজে। ... ...
মাইকেল গুটেনব্রুনের। অস্ট্রিয়ার কবি ও গদ্যকার। লেখেন জার্মান ভাষায়। নাৎজিবাদের বিরোধিতার জন্য কারারুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। হিটলার পরাজিত হওয়ায় মুক্তি। আধুনিক জার্মান কাব্যধারা অন্যতম স্বর। লিখছেন কবি ও তরজমাকার হিন্দোল ভট্টাচার্য ... ...
তাহলে অভিজিৎ সেনের এই দুটি উপন্যাসই মানুষকে তার নানা সম্পর্ক, নানা পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। রোদে সেদ্ধ চাল শুকোনোর মতো কলম দিয়ে উল্টেপাল্টে আউলা ঝাউলা করে ছাড়ে তার প্রতিটি প্রতিক্রিয়াকে। আদর্শ বা পূর্ণ মানবের দেহরেখা আঁকার কোনো চেষ্টাই করে না, অপূর্ণতা আর অসহায়তার রঙে চুবিয়ে তোলে আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব। শেষ করে পাঠক ফুঁপিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সেজন্য তার লজ্জা হবে না। এই অপূর্ণতার অশ্রুই আমাদের ভবিতব্য! ... ...
যদিও রবীন্দ্রনাথকে ‘ভক্তি’র কবি বলা যায় না, তবু ‘ভক্তি’র সঙ্গে তাঁর যোগ কি অস্বীকার করা যায়? ছেলেবেলায় তিনি তুকারাম তরজমা করেছিলেন। মধ্যবয়সে করলেন কবির, ইভলিন আন্ডারহিল-এর সঙ্গে ইংরেজিতে। বিদ্যাপতির বেশ কিছু মৈথিলি পদও একসময় করেছিলেন। দুটি শিখ ভজন আছে তাঁর গানে অনূদিত। ‘গুরুগ্রন্থসাহেব’-এর একটি পদও বলা হয় তাঁর করা। অনুবাদ ছাড়াও তাঁর গভীর বোধ আছে ‘ভক্তি’ নিয়ে, বিশেষ করে কবির ও নানক নিয়ে। অতএব, তাঁর উনিশ শতক সঞ্জাত ও ক্রমান্বিত অভিজ্ঞতায় জারিত যে-আধুনিকতা তার সঙ্গে বোধকরি কোনো বিরোধ নেই ঐতিহ্যের। ... ...
'দুষ্কালের আখ্যানমালা'র গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে একটা ট্রেনে করে যেতে যেতে জানলা দিয়ে আচমকা কয়েকটি চরিত্রের ঝলক এবং কিছু দৃশ্য দেখছেন, আর এই যাত্রাপথে ট্রেনটা আসলে এগিয়ে যাচ্ছে এক দুষ্কাল থেকে আরেক দুষ্কালের দিকে। চরিত্রগুলোকে পড়তে পড়তে আসলে আমরা যখন এই সামগ্রিক যাত্রাপথের কথা অল্প সময়ের জন্য বিস্মৃত হই, তখনই মাঝে মাঝে দিনের বেলা আচমকা সূর্যগ্রহণের মত এই সমস্ত দুষ্কালের ছায়া নেমে আসে চরিত্র এবং দৃশ্যাবলীগুলির ওপর। ... ...