বাংলার ভাগ্যাকাশে এখন ব্যোমকেশের দুই সত্ত্বাধিকারী, ঈশেন আর সত্যবাহন, ইয়ে মানে দত্তবাবু আর শীলবাবু। দত্তবাবু ল্যাপ শুরু করেছিলেন আগে, অন্যজন সদ্য যোগ দিয়েছেন। ওনার আগের ফিল্মটা দেখে মনে হয়েছিল, বজরা টজরা এনে ট্রিবিউট দিয়ে ফাটিয়ে দিতে চাইলেও, জ্ঞানের বহর প্রথমজনের চেয়ে একটু কম হওয়ায় হয়তো একটু বেশি সহনীয় হবে। কিন্তু এই পর্ব দেখে উপলব্ধি: এটা বাস্তবে দত্ত vs দত্ত। আসলে ট্রিবিউটের মধ্যেই কেলোটা লুকিয়ে ছিল। এতে উনি ট্রিবিউট দিয়েছেন স্বয়ং অঞ্জন দত্তকেই, একটু আদিবাসী নাচে আগন্তুক, রেসকোর্সের বাইরে সীমাবদ্ধ ইত্যাকার কিছু হালকা সত্যজিৎ বাদ দিলে। লোকেশন সেই এক ডুয়ার্স, ভিলেন সেই এক কৌশিক, গ্রেফতারির আগের সেই এক ধাঁচের বক্তৃতা, এবং জ্ঞানের বাটখারা। ফিরে এসে মনে হল ন্যাশনাল এনথেম ও ন্যাশনাল সং দিয়ে মোড়া এই সিনেমাটিতে কী কী চমক লাগলো, তারও লিস্টি করা দরকার। শুরুতে ড্রোন ক্যামেরায় রেল লাইনের বিহঙ্গদৃষ্টি অতি চমৎকার, কিন্তু তারপরেই চমক। রাইটার্সে বসে আছেন স্বয়ং অরিন্দম শীল, টেবিলে লেখা 'মুখ্য সচিব'। এবং তার পর থেকেই সত্যবতী, অজিত, বড় দারোগা সবাই বিন্দাস বলে যাচ্ছে মুখ্য সচিব অমুক, মুখ্য সচিব তসুক। ১৯৪৮এর আগস্টের আগেই 'মুখ্য সচিব' শব্দের এরূপ প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা দেখে তাক লাগার শুরু। আমার সহদ্রষ্টাকে বললাম, ইয়ে তখনও মাউন্টব্যাটেন আছেন, সংবিধান আসতে বহু দেরি তো, তিনি বললেন, চুপ করে দ্যাখ। দেখলাম। এবং এটা হজম করার পর আর কষ্ট হল না যখন দেখলাম সেই মুখ্য সচিবের ঘরের দেওয়ালে অখণ্ড বাংলার ম্যাপ, তিনি নিজেই সান্তালগোলার তদন্তের দায়িত্ব দিতে তো এসেইছেন সরকারের তরফ থেকে, সেই সান্তালগোলার সম্ভাব্য কোন কোন ব্যবসায়ী আসামী হতে পারেন তার লিস্টিও তিনিই পকেটে নিয়ে ঘোরেন, দারোগা নন, এসপি নন, এমনকি সিপিও নন। তা সেই তথাকথিত নগণ্য জায়গার ওসিকে সরাসরি নির্দেশ দেন মুখ্য সচিব, এবং তার পরেও সেই সচিবের পাঠানো খাস গোয়েন্দার সামনে সরাসরি তাচ্ছিল্য, হুমকি ইত্যাদি দেখাতে সাহস করেন আংরেজ জমানার সেই দারোগা। চুপ করে দেখা ছাড়া উপায় নেই। আমি তো কোন ছার, ব্যোমকেশ-ই চুপ। ... ...
দেখুন দাদা, ওঁর প্রথম বইটির জন্যই উনি বাংলা সাহিত্যে থেকে যাবেন, খুব ইমপরট্যান্ট লেখক। অচিন এবার কোনো মন্তব্য করল না। প্রথম বই আসলে দ্বিতীয়। তার আগের পুস্তিকায় ছিল দুটি গল্প। পুস্তিকার গল্প দুটির কথা কি জানে শুভ্রাংশু? গল্পদুটির কথা মনে পড়ল অচিনের। ত্র্যস্ত নীলিমা এবং শবযাত্রা। পুস্তিকাটি হাতে হাতে ঘুরেছিল। তারাই পুস্তিকা প্রকাশের খরচ দিয়েছিল। কী আবেগ সেই সময়! কতকাল আগের কথা। কিন্তু এখন মনে হয় ওসব ছেলেখেলা। কম বয়সের অপরিণত চিন্তা। পৃথিবীতে দুঃখ, কষ্ট, কখনো দূর হয়েছে ? দারিদ্র সভ্যতার সঙ্গে আছে। সেই পশুপালনের যুগ থেকেই তার আরম্ভ। গুহামানবের ভিতরে হয়তো সাম্য ছিল। সবই নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মহাজ্ঞানীরা। তারপর সব যেমন ছিল তেমনি আছে। দীপেন কী এমন গল্প লিখেছিল ! তারপর কী করতে পারল, কিছুই না। ... ...
কারোর মনে হতে পারে কলকাতা শহরটি - উত্তর দক্ষিণে লম্বাটে, পূর্ব-পশ্চিমে কম চওড়া শহরটি তার জালিকাটা রাস্তা ও জায়গাগুলি সমেত - যেন একটি বৃহদাকার জাল যে জালের মধ্যে কোন মানুষ পড়ে যেতে পারে, পড়ে গিয়ে কলকাতা শহরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে! এরকম হয়ত পুরোটা নয় যে এই জালের কেন্দ্রে মিনোটরের মতো কেউ আছে যার কাজই হল এক এক করে কলকাতার মানুষদের শুধুই গ্রাস করে যাওয়া আর সেই কাজ থামানোর জন্য থিসিউসের ম্তো কারোর দরকার, শহরটা হয়ত অতখানি কুটিল বা বিভ্রান্তিকর নয়, বিভিন্ন মানুষ তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে কলকাতায় এসেছে, অনেকেই জন্মাবধিই এই শহরে থেকেছে যে শহর তাদের আশ্রয় দিয়েছে, ফলে সব চরিত্রই এই শহরের মধ্যে হারিয়ে যায়নি, কেউ নিশ্চয়ই সেখানে নিজেকে খুঁজেও পেয়েছে। কিন্তু এমনও বোধ হয়, এই শহরের এক কালো আত্মা আছে যাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা যায়নি, যে নিজেকেও ক্রমাগত বদল করেছে, যে এক কুহক তৈরী করে যার নিয়ন্ত্রণে চরিত্ররা থাকতে বাধ্য হয়; মূলতঃ এই শহর হয়ত ক্রীতদাস -ক্রীতদাসীদের শহর হয়েই রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই যেদিন থেকে গ্রামগুলো শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে, ফলে কিছু মানুষ ও মানুষী এই শহরের কালো আত্মার গ্রাস থেকে চেষ্টা করেও মুক্ত হতে পারেনি। ... ...
ঠিক এই জায়গাটাকেই দর্শককূল বা পাঠককূল মনে করে থাকেন অ্যারোগেন্স বলে। অ্যারোগেন্সটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনা। সেসব কথায় পরে আসছি। আপাতত বলা যাক যে, এই আমাদের গোষ্ঠীটার ভেতর আবার দুটো স্পষ্ট ভাগ রয়েছে। আমরা মোটামুটিভাবে বন্ধু হলেও আমাদের চিন্তাভাবনার পদ্ধতি আমাদের দুটো আলাদা কাজ করতে ঠেলে দেয়। আমরা যারা এই গোষ্ঠীর এবং মেইনস্ট্রীম সিনেমা নিয়ে খুশি নই, ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে কিছু করতে চাই; একদল মনে করি লোকে না দেখলে কাজ করে কি হবে, আরেকদলের মতানুযায়ী যে করে হোক কাজটা শুরু করা দরকার, তারপর লোকে নিশ্চয়ই দেখবে, না দেখে যাবে কোথায়! ঠিক এই পার্থক্যটাই আমাদের একসাথে কাজ করতে দেয়না, যদিও উদ্দেশ্য আসলে একই। আমি দ্বিতীয় দলের লোক হলেও প্রথম দল সম্পর্কে আগে বলে নেওয়া যাক। এরা বিশ্বাস করে আভাঁ-গার্দ এবং মেইনস্ট্রীম ফিল্ম এর মধ্যে আদানপ্রদানটা খুবই জরুরী। সেটা আমরাও যে করিনা তা নয়, তবে এদের ওই লোকে না দেখলে কিছুই হলো না জাতীয় মনোভাব থেকে এরা একটা কি দুটো শর্ট ফিল্ম বানানোর পরপরই ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার পথ খুঁজতে শুরু করে। কেউ স্ক্রিপ্ট রাইটার তো কেউ এডি (সহকারী পরিচালক) হয়ে ঢুকেও পড়ে। আসল উদ্দেশ্য দশ কি পনেরো বছর ধরে আটঘাটগুলো জেনে নেওয়া, তারপর নিজে ছবি বানানো শুরু করা। কেউ পারে কেউ পারেনা। এরপর কোনোদিন দেখা হলে আলোচনার বিষয় হয়ে যায় তমুকের ক্যামেরাম্যান কেন ইচ্ছা থাকার পরও কোনদিন ইউনিট ছেড়ে বেড়িয়ে গিয়ে নিজের ছবিটা করে উঠতে পারলোনা, অথবা অমুক পরিচালক আদতে কতটা সৎ কিংবা এই যে বড় বড় প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটর-হলমালিকদের আঁতাত, ইত্যাদি। দেখা না হলেও চলে, তবু এইসব সাক্ষাৎ এবং পরস্পর পরস্পরকে আমরা মনে রেখে দিই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় দুটো কারণ হল ১) একটা কমন ক্রাইসিস, যে, ছবিও করতে হবে আবার খেয়ে-পরে বাঁচতেও হবে আর ২) আত্মবিশ্বাসের অভাব। নিজেকে নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস না করতে পারলে অন্য কেউও তোমায় বিশ্বাস করতে পারে না এবং এতে তাদেরকে দোষ দেওয়ারও কিছু থাকে না। এই বিশ্বাসের অভাবই কি সেই ভয়ের জন্ম দেয়না যে দর্শক আমায় রিজেক্ট করতে পারে? আর সেই ভয়ই কি একটা সময়ের পর নিজস্ব সাফল্যের ফর্মুলা অনুযায়ী ছবি করতে বাধ্য করে না? এইভাবেই তো সত্যা-র সাফল্যের পর পাঁচ তৈরী করার কথা ভাবে একটা লোক অথবা ওম্যানিয়া আর চি-চা লেদারের সাফল্যের পর বোঝাই যায় যে ড্রিমাম ওয়েকাপ্পাম দর্শক ভালই ‘খাবে’। মাথার ভেতর কোথাও বোধহয় ওই বিশ্বাসের অভাব বা ওই ভয়টা ‘মশলা’টা মেশাতে শিখিয়ে দেয়। হলই বা নিজস্ব মশলা, মশলাই তো। তাছাড়া কম বয়সে কেই বা বিপ্লব করেনি বলতো! শয়তানের ভেতর মোরাভিয়া ঢুকে যায়, জনি গদ্দারের মধ্যে জেম্স্ হ্যাডলী চেজ। যাই হোক! ... ...
অনেক দূরের জিনিষ দেখতে পাওয়া আর তার ফলে যে সব তথ্য যোগাড় হল তাই দিয়ে অতীতের বিভিন্ন সম্ভাব্য ছবি ফুটিয়ে তোলা, আধুনিক মহাকাশ গবেষণা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কত রকমের তরঙ্গের ব্যবহার, কত রকমের দূরবীন, কত মাপজোক। অনেকে নিজের দরকারে বা শখে একনলা কি দোনলা দূরবীন কেনেন, ব্যবহার করেন, সাজিয়ে রাখেন। আমি এ পর্যন্ত যে দু-তিনটি কিনেছি, নিতান্ত মামুলি, খেলনার বেশি মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়। হারিয়েও গেছে তারা। তবে অন্য একটি দূরবীন মাঝে মাঝে ব্যবহার করি। স্মৃতির দূরবীন, ফেলে আসা জীবনের ছবি দেখতে। কতটা অতীত দেখতে পাওয়া যায়? যাচ্ছে? বেশীর ভাগ ছবি-ই ফোকাসের বাইরে। তবু শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে, যেন ডিজিটাইজ করে, পিক্সেল জুড়ে জুড়ে রেন্ডারিং করে নানা ভাঙ্গাচোরা টুকরো থেকে এক একটা ছবি বার করে আনা। যা ঘটেছিল তার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া, যতটা পারা গেল। ... ...
টেবিলে আমার স্ত্রী সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল, “শ্রাবন্তী কে?” আমি অবাক হয়ে গেলাম এই প্রশ্নে। আমিও জিজ্ঞেস করলাম, “শ্রাবন্তী কে?” এবং এরপরেই আমার মনে পড়ল শ্রাবন্তী কে। এ নিয়ে আমাদের কথা কাটাকাটি হতে লাগল। আমি আমার বউকে বোঝাতে পারছিলাম না যে শ্রাবন্তী আমার লেখার একটা চরিত্র। লেখার ড্রাফট দেখিয়েও আমি তাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। সে বলল, অনেকবার সে বেইজমেন্টে এসে দেখেছে আমি এই মেয়ের সাথে কথা বলছি। তার কথা মিথ্যে নয়। আমি এরকম অনেক কথা বলেছি ওই মেয়ের সাথে। এবং সৎ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ওই মেয়ের প্রতি আমার বড়ো রকম দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। কারণ সে ঠিক আমার মনের মতো। এটা কি আমার লেখার চরিত্র সেই জন্যে? কেবল লেখার চরিত্র হলে সে কীভাবে উঠে আসবে? এইভাবে হাসবে, আর আমার পাশে বসে আমারই লেখা নিয়ে এমন সব কথা বলবে যা আমি নিজেও কখনও ভাবিনি? এসব নিয়ে আমি নিজেও দ্বিধায় ছিলাম। এর মধ্যে শুরু হল বউয়ের সাথে ঝামেলা। ... ...
এ তো গেল সামাজিক আচার-বিচার সংক্রান্ত চাপ, যা রবীন্দ্রনাথকে সামলাতে হয়েছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাটাকেই ভিতর থেকে বদলে দেবার জন্য রীতিমত অন্তর্ঘাত চলতে থাকে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পর থেকেই শান্তিনিকেতনে এই মারণ-জীবাণু প্রবেশ করে। নোবেল-প্রাপকের বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়িয়ে আত্মপ্রসাদ ও সামাজিক গরিমাবৃদ্ধির তাড়নায় সেখানে সামাজিকভাবে উচ্চ আর ধনী অভিজাত শ্রেণীর ভিড় বাড়তে থাকে। এই শ্রেণীটির অর্থ এবং তজ্জনিত ক্ষমতার জোর ছিল প্রবল। মূলত তাঁদের চাপেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক অবাঞ্ছিত পরিবর্তনেও সায় দিতে বাধ্য হন। আগে এখানে মণ্ডলীপ্রথায় শিক্ষা হত, অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক একই সঙ্গে মাটিতে বসে পড়াশুনা হত। তিরিশের দশকেই তার পরিবর্তে শিক্ষকদের জন্য উঁচু মাটির বেদী তৈরি হয়। খাওয়াদাওয়ার পর ছাত্রদের নিজেদের বাসন মেজে নেবার রীতিও উঠে যায়। ছবি আঁকা, গান, হাতের কাজ, গ্রামসেবা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে মূল পাঠক্রম থেকে সরিয়ে ‘আনুষাঙ্গিক পাঠক্রমে’ পরিণত করা হয়। ১৯৩১ সালে বিশ্বভারতীর তরফে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাতে শান্তিনিকেতন ওই সময় কী কী বিষয়ে পঠন পাঠন হয় এবং কী কী পরীক্ষা বা ডিগ্রি দেওয়া হয়, তার উল্লেখ ছিল। তাতে এও জানানো হয়েছিল যে, বিশ্বভারতীর ছাত্রদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আই.এ এবং বি.এ পরীক্ষা দেবারও ব্যবস্থা আছে। মহান রাবীন্দ্রিক শিক্ষাদর্শ থেকে মুখ ঘুরিয়ে এই যে বিশ্বভারতীর কেরানী-গড়ার প্রথাগত শিক্ষার দিকে চলন, তা-ই রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে তুলেছিল। ১৯২৫ সালে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “একদিন এই কলেজের বিরুদ্ধে মাথা তুলেই একলা আমার তরী ভাসিয়েছিলুম --- কিন্তু তরী ঘুরেফিরে এলো সেই কলেজের ঘাটেই। বসে বসে দেখছি … শান্তিনিকেতন আপন আইডিয়ালের গর্ব ভাসিয়ে দিয়ে ছেলে পাশ করাচ্ছে। … ভাগ্যে ছিল আমার কলাভবন এবং শ্রীনিকেতন। আমার শেষ বয়সের সমস্ত চেষ্টা যদি ঐ কলাভবন সংগীত ভবনের জন্য দিতে পারতুম … মনে করতুম জীবন সার্থক হয়েছে।“ ... ...
পানু পাল আঠারোতেই দানা ভরতে শিখে গিয়েছিল। প্রথমবার মাথা ফাটে ষোলোতে। সে আদতে বকুলতলার। সদ্য অ্যাক্সিলেটর গিয়ারের রহস্যভেদ করতে শিখে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল। ধাবার মালিক হরদয়ালের ভেস্পা নিয়ে মুচিপাড়ায় গিয়েছিল রং ওড়াতে। কিন্তু বেশি উৎসাহে ভুল জায়গায় আওয়াজ দিয়ে ফেললে তরুণতীর্থ ক্লাবের ছেলেরা তাকে ধরতে আসে। সে ভেবেছিল একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেলে ঝড়ের বেগে উড়ে যাবে। কিন্তু স্ট্যাটিক পজিশন থেকে একবারে ফোর্থ গিয়ারে ফেললে ভেস্পা প্রয়োজনীয় গতিজাড্য পায়না, সামনের চাকা উঠে যায় এবং প্রাণেশ মাটিতে পড়ে যায়। ক্লাবের ছেলেরা এই নবকর্ণকে আচ্ছাসে বানিয়েছিল। প্রথমবারের মত তার মাথা ফাটল। ... ...
মাতৃভাষার সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে নানারকম বিতর্ক আছে। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তির প্রথম বুলিকেই তার মাতৃভাষা বলা যায়, তাহলে এই মহিলার মাতৃভাষা বাংলা। বাড়িতে বাবা এবং মায়ের সঙ্গে উর্দু এবং ইংরেজিতে কথা বললেও চট্টগ্রামে বাড়ির কর্মচারীদের কাছে বড় হওয়ায় এঁর প্রথম বুলি কিন্তু বাংলাতেই ফোটে। ... ...
ভয়ার্ত না হলে মায়ের খনখনে গলার আওয়াজ কোনোদিন ভাঙেও না ফাঁটেও না। বামহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পাছার ঢাল থেকে ঘষটে লুঙ্গিটা কোমরের খাদ পর্যন্ত উঠিয়ে চেপে ধরে ডান হাত দিয়ে ক্যারমের রেড খাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কানে এলো মায়ের এই চিৎকার- কু...মিকই...ই...ইর... রন... জকও...ওকও...ওন... শি...লাকআ...আ...আ... চিৎকারে মায়ের গলা একবার উপরে উঠে ফেটে যাচ্ছে তো আরেকবার ধাক্কা খেয়ে একবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না কী বলে না বলে। কিন্তু এর মধ্যেও তার চিৎকার থেকে আমার আর আমার বোন শিলার নামটা যেমন ঠিক অনুমান করতে পারছি তেমনি তার খনখনে গলা ভেঙে যাওয়া থেকে বুঝতে পারছি কিছু একটা বিপদ ঘটেছে। আমি যেহেতু এখানে বস্তির ক্লাবঘরে দোস্তদের সাথে মশকরা মারছি সেহেতু বিপদটা নিশ্চিত শিলার শিলার এখন শেষ পোয়াতিবেলা। স্বামীর ঘরে দেখাশোনার কেউ নাই বলে বাচ্চা বিয়াতে সে মায়ের কাছে চলে এসেছে। আমি ক্যারমের স্ট্রাইক ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগালাম। এইটারে আমরা বাড়ি বললেও বাড়িওয়ালা এইগুলারে বলে ঘর; আর পত্রিকাওয়ালারা বলে ছাপড়া। নদীর ঢালে বাঁশের মাচান বেঁধে খুপরি খুপরি বস্তি। ... ...
জেম্স র্যান্ডি। প্রয়াত হলেন সম্প্রতি। পেশায় দুরন্ত জাদুকর, ম্যাজিশিয়ান। হুডিনি-র একটি রেকর্ড ভেঙেছিলেন। কিন্তু নেশায় ও মননে ছিলেন জ্যোতিষী, সাইকিক ইত্যাকার অলৌকিক শক্তির দাবিদারদের বুজরুকি ফাঁস করে দেওয়ার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। এরিক ফন দানিকেন থেকে উরি গেলার পর্যন্ত বহু বুজরুকের মুখোশ খুলে দিয়ে লিখেছেন একাধিক বই। সেগুলির মধ্যে একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম—ফ্লিম-ফ্ল্যাম! পড়লেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান পরিষদের সচিব, পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় ... ...
জনসাধারণের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দিলে ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল কর্মীরা তাদের বাচ্চাদের বাড়িতে ফেলে রোগীদের সেবার কাজ করবেন কী করে? আর সব রেস্তোরাঁ, দোকান-বাজার বন্ধ করে দিলে যত লোকের কাজ চলে যাবে, যে ভীষণ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে, সেটা সামলানো যাবে কেমন করে? ফলে এঁদের অধিকাংশেরই সিদ্ধান্ত যে এঁরা শেষ অবধি লড়ে যাবেন। যতটা দূরত্ব রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় তাই করবেন। এই সঙ্কটকে গুরুত্ব দেবেন, কিন্তু ভয়ে গুটিয়ে থাকবেন না। তাই যথাসম্ভব সেলফ আইসোলেশান, ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে হাঁটাহাঁটি আর স্বাস্থ্য বিভাগের ছবি সহ নির্দেশিকা মেনে ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া - করোনার বিরুদ্ধে কিস্তিমাত করার জন্য এই চালই বেছে নিয়েছেন অধিকাংশ সুইডিশরা। ... ...
“এই দ্যাখ, এমনি করে ক্যাপটা দু আঙ্গুলে ধরে দেয়ালে চট করে ঘষে দে” - চাপা একটা ফট শব্দ -মেয়েটা ভুরু কুঁচকে ধোঁয়ার রেশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। ... চেষ্টা করি? যদি আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগে? না থাক বাবা ... উল্টে সে মাটিতে ক্যাপের রোলটা ফেলে হাওয়াই চটি দিয়ে পিষে দেয়, বারুদের আওয়াজ টা আরও চেপে গিয়ে কিরম ম্যাদামারা মত শোনায়। মরুক গে যাক! নতুন ক্যাপ বন্দুকটা কিনেছে কি করতে, সেই যদি হাতে-পায়ে করে ফাটাবে? গেলবার সেই যে বাপির সাথে বন্দুক কেনা নিয়ে দারুণ ঝগড়া হল- বলে কি না পুরনোটাতে তেল দিয়ে দিচ্ছি, ওটাই ফাটা! পুজোয় নতুন জামা পরে পুরনো ক্যাপ বন্দুক? এ আবার কেমনধারা কথা! বাপির মনখারাপ করছে বুঝতে পেরেও জেদ করে কথা বলেনি দু-দিন। তারপর তো সেই জ্যেঠু আর বড়দাদার হাত ধরে গিয়ে দোকান থেকে পছন্দ করে নতুন বন্দুক কেনা হল। ... ...
ফারচা, আকুরি, সাল্লি, পপেতা পর ইডু, লগান্যু কাস্টার্ড… শুধু ধানশাক নামটা মাথায় নিয়ে এখানে হাজির হলে আর সব খানার আগে মোক্ষম ভ্যাবাচাকা খেতে হবে। কারণ কলকাতায় পারসি খানার এক বিরল ঠিকানা কিড স্ট্রিটে এমএলএ হস্টেলের ঠিক উলটোদিকে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট! নাম তার ‘মনচারজি’জ’। দীপঙ্কর দাশগুপ্ত ... ...
বাঙালি হিন্দু মেয়েরা নদীতে নাইতে যায়। সিরাজের চরেরা নৌকো নিয়ে ঘুরঘুর করে খবর জোগাড় করে। মেয়েদের তুলে আনে। এইসব করতে গিয়ে সিরাজ রানি ভবানীর মেয়ে তারা সুন্দরীর পিছু ধাওয়া করেন। কিছু সুবিধে করতে পারেন নি। ভরা বর্ষায় বা জোয়ারের সময় পারাপারের নৌকোগুলোকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিতেন, কখনো নৌকো ফুটো হয়ে যেত আর তখন সাধারণ গাঁয়ের মানুষকে ছেলে বুড়ো মেয়ে নির্বিশেষে জলের মধ্যে নাকানি চোবানি খাইয়ে দারুণ মজা পেতেন! অনেকে হয়তো ডুবে যেত কিন্তু উনি খুব আমোদ পেতেন! ... ...
ওদিকে দেখি অনেক ক্যাম্প। সেখান থেকে ডাকছে, আসুন কমরেড। কোথাও কোথাও রুটি গুড় কাগজে মোড়া কোথাও লুচি আলুর দম। কড়াই ভর্তি আলুর দম। আমি দেখছি কড়াইয়ের নাম। দেখি, ও মা, ধীরেন। কড়াইকেও মনে হল, কমরেড কড়াই। আমরা ছোটো। জল তেষ্টা পেয়েছে। একজন স্বেচ্ছাসেবক বললেন, কমরেড খোকা, ওইদিকে জলের ট্যাঙ্ক আছে। আমাকেও কমরেড বলেছে। মনে হল, অনেক বড় হয়ে গেছি। আনন্দে জল এসে গেল চোখে। কেউ আমাকে কমরেড বলেছে। ... ...
রহমান ৩০ বছর ধরে কামারহাটিতে থাকে। আজ থেকে ২৩ বছর আগে রহমানের আব্বা,আফজল, সুস্থ মানুষ,হজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। রহমানের মা সাকিরা আগে খুব কাঁদত। তারপর আল্লার কাছে দোয়া করত, জলজ্যান্ত লোকটাকে ফিরিয়ে দাও। তারপর শুধু চিৎকার করত। একদিন চুপ করে গেল। সারাদিন ধরে ঘরে বসে থাকত। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনবার পানি খেতো, একবার ভাত। তার চোখে পানি নেই.. সব শুকিয়ে গেছে। রহমান বাসায় ফিরে এলে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত। লোকে বলে রহমানকে দেখতে তার হারিয়ে যাওয়া আব্বা আফজলের মতো। সেই রকম চোখ মুখ ভুরু। ... ...
গাড়ি থেকে যখন নামানো হল, তখন আমরা সংখ্যায় পরিণত হয়েছিলাম। গরু বাছুরের মত আমাদের বারবার গোনা হচ্ছিল, এরপরে একটা অন্ধকার করিডোরে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা চারজন একজনার পিছনে আরেকজন ঢুকছি, আমাদের সামনে পিছনে চারজন কারা প্রহরী। সবার আগে রাসেল ভাই, তারপরে শুভ, তারপরে আমি, সবশেষে বিপ্লব ভাই। আমাদের ১৪ সেলে নিয়ে গেল। ১৪ সেলের দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল, তাদের টিনের বাসন দিয়ে শব্দ করে কান ঝালাপালা আবস্থা। তারা সবাই একসাথে স্লোগান দিতে লাগলো; বলতে লাগলো, "নাস্তিকমুক্ত জেলখানা চাই", "নাস্তিকদের আজই ফাঁসি চাই", "জেলখানায় নাস্তিক, মানি না মানবো না" ... ...
মহাশ্বেতা দেবীঃ ...মুন্ডাদের মধ্যে, আমি খেরিয়াদের মধ্যে যে ধরণের কাজ করি, সেরকম কাজ করার ছিল না। কিন্তু ওদের সংগঠিত করার ছিল। সেটা আমি সব সময় বিশ্বাস করি, ওরা নিজেরাই সংগঠিত হোক। মিনিমাম কতোগুলো কাজের ভিত্তিতে ওরা নিজেরাই সংগঠিত হোক। ওদেরকে পলিটিক্যাল ফোর্স বলে মনে করা হতো। সেটা সব সময় মিথ্যাও হয়নি। তাই...মুন্ডা গেল...অঞ্চলের দিকে মুন্ডা, ওঁরাও সব আর মাঝামাঝি তো সব চলছেই; ইঁট ভাটার শ্রমিক, সেসব ইনভেস্টিগেট করে লেখাটেখা, কংক্রিট কাজের মধ্যে আমি বেশী বলবো যে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ এ শব্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হল। ... ...
মিষ্টির রসে ডুবে থাকা মাছি উঠে আসতে পারে না সেই রসকুণ্ড থেকে। ডানা, পা, শুঁড় রসে ভারি। নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ধের মতো এদিক ওদিক ঘোরে।আয়ু থাকলে সে বাঁচে আরও কিছুদিন। কিছুদিন আরও স্বাধীনভাবে জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখে নেয়।কিন্তু তার দৃষ্টির ঘোরাফেরা একটা নির্দিষ্ট সীমায়, জীবনকালও সেই গণ্ডির ভেতরেই সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষের জীবনই এই। এই অঞ্চলের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই একরকম। নিশ্চেষ্ট, উদ্যমহীন।খেয়েপরে অর্থ উপার্জন করার আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে হাজার অপমান আর অসম্মানেও তারা বোবা। চেনা ছকের বাইরেও যে জীবনের যে একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে এমন কথা তারা সম্ভবত চিন্তাতেই আনতে সক্ষম নয়। ... ...