ঠাকুমা তো জানে না—এগিয়ে চলা প্রতিটি মুহূর্ত আমার বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে। বুঝতে পারছি সব আকুতি বিফল হয়ে আমাদের আরেকটু পরেই শহরে ফিরে যেতে হবে। এমন সময়গুলোতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। এসব সময়ে আমি শুধু দেখি আমার বাড়িটাকে, দেখি বাড়ির মানুষগুলোকে, এমনকি উঠোনে দুলতে থাকা গাছের ছায়াগুলোকেও। শহরের বাসায় রোদতপ্ত নিরিবিলি দুপুরে মা যখন ভাতঘুম দেয়, তখন নির্ঘুম আমি মায়ের পাশে শুয়ে এসব আবার দেখি খোলা চোখের অন্দর পেরিয়ে বুকের কোঠর থেকে। ... ...
— তোর ঠাকুরদার জন্ম ১৯২৩ সালে। ঐ সময়ে বাংলার অবস্থাটা আগে মন দিয়ে বোঝ। অমর যখন সাত বছরের বালক, তখন ঘরের পাশে পিছাবনিতে হয় লবণ সত্যাগ্রহ। — আরে পিছাবনি দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ঢোকে, তখন বাজারে ইস্কুলের কাছে একটা স্তম্ভ আছে, সেইটা? বাবা বারবার দেখায়? — হাঁ সেইটাই ঐ সত্যাগ্রহের স্মারক স্তম্ভ। জেলাশাসক পেডির সামনে মিছিল থেকে আওয়াজ উঠেছিল, ‘আমরা পিছাবনি’। — তারপর? ... ...
ভারি আশ্চর্য। এখানকার কোন মেয়ে বসে থাকেনা। ঘরের কাজের সঙ্গে মাঠে কাজ করে, কাজু বাদামের বিচি থেকে শাঁস ছাড়ায়, বিড়ি বাঁধে। সরকারি ভাতাও পাচ্ছে। একটু সম্পন্ন ঘরে পরিচারিকা বা রান্নার কাজও করছে। আবার শ্বশুরবাড়িতে বরের মার খাচ্ছে, অভিভাবকদের বকুনি খাচ্ছে - এমন অল ইন ওয়ান উপযোগী প্রাণী যার ঘরে থাকবে তার লাভ। মেয়ে কমার তো কথা নয়। পড়াশোনা জানা ঘরে মেয়েরা কেউ কেউ শিক্ষিকা হয়, কিন্তু বেশিরভাগ নার্সিং পড়ে। বোধ করি সারা দেশে এখানকার নার্স আছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে টপ করে একটা চিন্তা আসে। মেয়ে কমেছে না কি ছেলে বেড়েছে? ... ...
আমি একটা ফেসবুকের পাতা বানিয়েছিলাম, সেখানে নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা লেখা, আঁকা, মোবাইলে তোলা ফটো, নিজের করা হাতের কাজ, রান্নার ছবি, গান, নাচ বা আবৃত্তির ভিডিও - লকডাউনে যে যা পাঠাত, সেগুলো আপলোড করতাম। এছাড়া ওদের মন ভাল করার অন্য কীই বা উপায় ছিল! বেশিরভাগ তো সব দূরদূরান্তে অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি, কলেজের কাছে মেস করে থাকে। নিজেরা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। একবার একটা পিজি ব্যাচ পাশ করে মেস ছাড়ার আগে আমাদের নেমন্তন্ন করে মাংস ভাত খাইয়েছিল। যা হোক, আলটপকা দু সপ্তাহের লকডাউন হতে দু তিনটে জামাকাপড় নিয়ে সব বাড়ি চলে গিয়েছিল। বই খাতা মেসে পড়েছিল, আর যে ওগুলো নিতে ফিরতে পারবেনা, তা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। বাড়িতে বসে লেখা পড়া যে করবে, উপকরণ ছিলনা। আমি যখন বলতাম এই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী এসে গেল, কিছু লিখে পাঠাও। অনেকে বলেছিল, ঘরে কাগজ নেই ম্যাডাম। তখন আমি বললাম, যে ওমা! লিখতে বুঝি সব সময়ে কাগজ লাগে? আমি তো মোবাইলে লিখি। তখন আর্জি এলো কোন, জয়ন্তী নয়, শুধু আমাদের জন্য মোবাইলে লিখুন ম্যাডাম। ... ...
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি? - সব গেছে, দেবে কী করে? - গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল, - আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’ - যাঃ জানা হলনা তবে? ... ...
স্বর্গে গেছেন মা, সেই পঞ্চাশের দশকে। আমাদের জন্মের দু’দশক আগেই তিনি গত হয়েছেন। আমরা শুধু গল্প শুনেছি। আমার মা বাবার বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে। মায়ের তখন চোদ্দ বছর বয়েস। ভব আপা মায়ের পিসশাশুড়ি। বারো বছরে বিধবা। মায়ের কাছেই শুনেছি – তাঁর লম্বা চওড়া চেহারা, ফর্সা রং, টিকোল নাক, ধবধবে থান পরা, সবাই ডাকত ভবপা – ভব আপাকে দেখে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। কিন্তু কেউ কাছে ভিড়তে পারত না, এমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব। কারোর তোয়াক্কা রাখতেন না। তাঁর দাপটে বাড়ি থেকে পাড়া কাঁপত। সেই যুগের গ্রামে এমনধারা মহিলা একেবারেই ব্যতিক্রমী। নিজের আলাদা ঘর, স্বপাক আহার। সঙ্গে থাকত পনেরো-ষোলোটা বিড়াল। ... ...
বিয়ের পরে নতুন বউ, শ্বশুর বাড়িতে দুর্গাপুজো, শাশুড়ি বরণ শেখাচ্ছেন, সিঁদুর খেলা, বরের ক্যামেরায় সিঁদুর মাখা মুখের ছবি, মত্ত হয়ে ছিলাম। বাড়িসুদ্ধ সবাই মাতোয়ারা। হঠাৎ চোখে পড়লো, সবার প্রিয় বড়দি, আমার বড় ননদ ঘরে মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে। বিধবা বলে এই আনন্দে তার অধিকার নেই, নিজের বাড়িতেও। সেদিন বিজয়ার আর একটা নির্মম মানে বুঝলাম - সধবার স্বীকৃতি আর আনন্দের তলায় বিধবার দুঃখ। সধবার অধিকারের উলটো দিকে রয়েছে বিধবার নিঃসঙ্গতা - একরকম সামাজিক বহিষ্কার। এ চাবুক চোখে দেখা যায়না, তাই আসল চাবুকের চেয়ে অনেক কঠিন আর ধারালো, চামড়া কেটে গভীরে বসে যায়। ঐ দৃশ্য দেখার আগে বিজয়া দশমী যে কিছু মেয়ের জন্য এতটা অপমানের তা বুঝতে পারিনি। এখন দশমীর বরণে পারুল কে ডাকি। অল্প বয়সে পারুলের বর সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডসে মারা যায়। তিনটি শিশু সন্তানসহ একঘরে পারুলকে শাশুড়ি আশ্রয় দেন। পারুল বলে, "হ গো বৌদি, মো কি ঘরো পূজা করিনা? শুধু সিন্দুর দিবানি, প্রদীপ, ধূ্প, মিষ্টি, জড়ো, পানো সবু দিবা"। প্রথাগত শিক্ষার নাগালের বাইরে থাকা আত্মবিশ্বাসী নারীকে বড় ভালো লাগে। ... ...
জীবনের এক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাজের পরিসরে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ভিতরে। শালিক পাখির গল্প লেখার জন্য আমার নামে পুরষ্কার উঠেছে। আজই অনুষ্ঠান। হাসিমুখে দাঁড়াই মঞ্চে, মাইক ধরে দু চার কথা বলি নিপুণ পেশাদারিত্বে। আজ এই দৃশ্য দেখে যারা সবচেয়ে খুশি হত, তারাই আজ নেই। এ যে কী শূন্যতা বলে বোঝানো যায় না। আত্মীয় স্বজনের গুঞ্জন কানে ভাসে, 'তোমার খুব মনের জোর।' 'তুমি তো একটা ছেলের কাজ করছ'। এদের কাছে অন্তর ঢেকে রাখি সঙ্গোপনে। অসুস্থ বোনটা বাবা মায়ের কাছেই থাকত। এখন তাকে নিয়ে এসেছি সব পাট চুকিয়ে। আর আমার দুটো মেয়ে নয়, তিনটে। মনে ভাবি সামলাতে পারব তো সব দায়িত্ব! ... ...
- মা, শ্বেত পাথরের টেবিলের গল্পটা বলবে বলেছিলে! - টেবিলের গল্প? টেবিলের তো আর আলাদা কোন গল্প হয়না রে বাবু, এ হল টেবিলের চারপাশের মানুষের গল্প। - সেটাই বল শুনি। - শোন তবে। আমাদের ছোটবেলায় খুব রেডিওতে নাটক শোনার চল ছিল। যেদিন যেদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেত পাথরের টেবিল নাটকটা হত, সেদিন মা, মামা, মাসিরা সব কাজ ফেলে রেডিও ঘিরে বসত আর নানান মন্তব্য করত। নাটকটা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ সেই আড্ডা চলতেই থাকত। আলোচনার মূল কথা হল, এ তো আমাদের বাড়ির গল্প, সঞ্জীব বাবু কীভাবে জানলেন? ইত্যাদি। সেই সব গল্প থেকেই প্রথম জানতে পারি যে, আমার মামার বাড়িতে এককালে বিশাল এক নকশাকাটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল। - নাটক থুড়ি গল্পটার সঙ্গে মিলটা কী? - গল্পটা তোকে পড়তে হবে, তবে তো? মোবাইলে খোল, গুগলে আছে। - আচ্ছা, ওয়েট, দেখি, ... ...
আমাদের কর্তা গিন্নি দু'জনের জীবনেই ঝুলন পূর্ণিমার স্মৃতি মনের ঝিলের গভীর স্তরে সাজানো আছে। আমার স্মৃতিতে ভরে আছে - কাঠকলে গিয়ে বস্তা করে কাঠের গুঁড়ো আনা, সেগুলো নানারকম রঙ করা, গ্রাম, শহর, জঙ্গল সব পাশাপাশি, একধারে পাহাড়, নদী, ঝরনা - সেই পাহাড়ের মাথায় শিব ঠাকুর। প্যাকিং বাক্স ওপরে ওপরে রেখে, কাদা জলে ছোপানো কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পাহাড়, কায়দা করে শিব ঠাকুর বসানো। নিচে বড় মোটর সাইকেলের পাশেই ছোট ছোট হাতির সারি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে করা একরত্তি পুকুরে উত্তরাধিকারে পাওয়া এক মস্ত পোর্সেলিনের হাঁস। আর ঝুলন যেদিন শেষ হয়, সেদিন হল রাখী। ... ...
— চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে খুব একটা ঢোকেনি। টিভিও খুব কম ঘরে ছিল। তাই ব্যাপারটা লেখাপড়ার জন্য নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওসব জায়গায় খুব ভালো ভাবেই ছিল। তারিণীপ্রসাদ আর তাঁর বয়স্যরা মিলে স্বাধীনতার পরে তৈরি করেছিলেন ঐ এলাকার ছেলেদের জন্য প্রথম হাইস্কুল। আর মেয়েদের ইস্কুল শুরু হয়েছিল তোর ঠাকুমা বেলারানীর তত্ত্বাবধানে, তোদেরই বাড়ির দাওয়াতে। — এই তো, এবার ইস্কুলের গল্প চলে এসেছে। বল, বল পুরোটা। কিন্তু আমি তো জানতাম ইস্কুল, হাসপাতাল সব কিছু বুড়ো ঠাকুরদা তারিণী করেছেন। এর মধ্যে ঠাকুমাও ছিল! ঠাকুমা লেখাপড়া জানতো? একটু খুলে বল দেখি। ... ...
বারান্দায় আজ পাত পড়েছে আমার একার। আর উঠোনে বসেছে মুসা। আমার পাতে আউশের লাল ভাত, উচ্ছেপাতার বড়া আর কাজলি মাছের আদাঝোল। আমার অনিহায় আড়ি দিতে মা নিজেই ক’দিন হলো খাইয়ে দেয় আমাকে। আজও তার ব্যত্যয় হল না। লালভাতে উচ্ছেপাতার বড়া মেখে আমার মুখের সামনে ধরতেই নাকে ধাক্কা দিল উচ্ছেপাতার তিতকুটে ঘ্রাণ। ভাতের গ্রাসটুকু মুখে পুরতেই সোঁদা একটা স্বাদ ছড়িয়ে গেল মুখে, ও মা, আরেকটু বড়া ভেঙে দাও… ... ...
আমরা মনখারাপের সঙ্গে লড়াই করার জন্য কলেজে মাঝেমাঝেই মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে ওয়েবিনার করছিলাম, যাতে তাঁরা আমাদের বাঁচার কোন পথ বাতলে দিতে পারেন। তাঁরা বলেছিলেন বই পড়তে, বিশেষ করে জীবনীমূলক বই। পরীক্ষা শেষ হবার পর, আমি পূর্ব দিনের মহামারীগুলি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম স্বামী বিবেকানন্দের লেখা প্লেগ ম্যানিফেস্টোর প্রথম কয়েক লাইন বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই যেন করোনার সাবধানতার সঙ্গে মিলে যায়। সেই একই পরিচ্ছন্নতার বার্তা, টাটকা আর পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ। ডাক্তার আর জি করের প্লেগের ওপরে লেখা একটি বই হাতে এলো। নতুন করে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় কুমুদিনীর বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মচরিত পড়লাম। হজরত মহম্মদের ওপরে লেখা তাঁর বইটি আন্তর্জালে খুঁজে পেলাম। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জগৎ ভুলে পাগলের মত কেবল পড়েই যেতে লাগলাম। বই থেকে মুখ তুললে যত রাজ্যের আতঙ্ক এসে ধরে, তাই কেবল বইয়ের আড়ালে আড়ালে আমার দিন কাটতে লাগল। ... ...
বড়দাদীর রান্নার স্বাদ এ পাড়ার সবার কাছেই অনন্য। আর বড়দাদী রাঁধেনও খুব যত্ন করে। সবার আগে উনুনে বসল একটা মাটির বড়মুখের হাঁড়ি। তাতে বড়দাদী ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। সেই তেলে ফোড়নে পড়ল তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন। একটু নেড়েচেড়ে তাতে বড়দাদী মুঠো ভরে পেঁয়াজ কুচোনো দিয়ে দিল। এদেরকে লাল করে ভাজার ফাঁকে কতগুলো কাঁচামরিচও দিয়ে দিল বড়দাদী। পেঁয়াজের সাথে সাথে হাঁড়ির মরিচগুলোও রঙ বদলাতে শুরু করলো। বড়দাদী এবার আদা, রসুন বাটা দিয়ে দিল। একটু সময় পরেই তাতে পড়ল জিরাবাটা। সাথে লাল টকটকে শুকনো মরিচ বাটাও পড়ল খানিকটা। ... ...
কড়াইয়ের জল ফুটে উঠতেই তাতে মা দিয়ে দিল মাসকলাইয়ের ডাল। সঙ্গে খানিকটা লবণ মিশিয়ে ঢাকনা দিল কড়াইয়ে। পুঁইয়ের লতা বেছে কেটে ধুয়ে নিল মা। মুসার মা আজ তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে গিয়ে উঠেছে মসজিদের মাঠে। সেখানে গুড়ের শিন্নি। রান্না করতে হবে তাকে। বড়দাদীর বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে ডেকচি ভরা গুড়, চালের গুঁড়া আর নারিকেল কুরোনো। আসরের নামাজের পর মসজিদের মাঠে কলাপাতায় বিলানো হবে শিন্নি। ... ...
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান। ... ...
- তোমার ছোটবেলার সিনেমার গল্প বল। - আরে তখন যুগটাই ছিল, যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন- বন্ধু বান্ধব মিলে সিনেমা দেখতে যাবার যুগ। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকে অসিত বরণ, উত্তম কুমারের সিনেমা দিয়ে হাতেখড়ি। মামার বিয়ে হল - নতুন বৌকে নিয়ে মায়ার সংসার। রবিবার এলো তো বাবা মার হাত ধরে সব্যসাচী। মাসিমণির বিয়ের কথা চলছে, নতুন পাত্রকে নিয়ে চিরন্তন। কালে কালে বাবার হাত ধরে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী, এন্টার দ্য ড্রাগন, গ্রেট এসকেপ, গানস অফ নাভারোন। অবশ্য হিন্দি সিনেমায় বাধানিষেধ ছিল। স্কুল পাশ করে কলেজ পর্যন্ত শুধু সফেদ হাতি আর পার। কলেজে উঠে ও ব্যথাও মিটে গেল। নুন শোয়ে ফুল অর কাঁটে, প্রতিবন্ধ, লমহে - আহা কীসব দিন। - দাঁড়াও, কলেজে উঠি, তারপর আমিও যাব। - যাবি। - সিনেমা দেখে দেখে সিনেমা প্রীতি? - না না তা কেন? আসল হল, চরিত্র চিত্রণ, কোন সিন কীভাবে তোলা হচ্ছে, এসবের চুলচেরা আলোচনা। - কীরকম? ... ...
- "মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি। - গান জানিনা তো। - তাহলে বাজাচ্ছো কি করে? - আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা। - হলনা কেন? - হারমোনিয়ামটা হারিয়ে গেল। - কীকরে? - সে অনেক কথা, পরে বলব।" ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে? ... ...
— চট্টগ্রামের জালালাবাদের যুদ্ধে তিনি মাস্টারদার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ওঁর ভাই টেগরা সেই যুদ্ধেই মারা যায়। আমরা ওঁর বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। শিখাদির মা তখন বেঁচে ছিলেন, ভীষণ আমুদে একজন দিদা। ঐ বাড়িতে লোকনাথ বলের একটা বড় অয়েল পেন্টিং ছিল। ছোটবেলায় দেখলে গায়ে কাঁটা দিত আমার। — ওঃ আর কাউকে জানো? — পারিবারিক সূত্রে লেডি অবলা বসুর গল্প জানেন, এমন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। — কী বলছ মা? বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী? — বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী বটে, তবে সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। — তাহলে? ... ...
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে? - বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল - - ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’ ... ...