... - ভালো ভাজা হল কিনা, বুঝব কি করে? - আঁচ বাড়িয়ে প্রথমে নাড়বি, তারপর আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে দিবি। একটু পরে আবার খুন্তি দিয়ে নিচের আনাজ ওপরে করে দিবি। ভাজা হয়ে এলে দেখবি, একটা সুবাস পাবি। কড়ায় আনাজের পরিমাণ কম মনে হবে। মানে, আয়তন কমে আনাজগুলো জরে যাবে। আনাজ কড়ায় দেবার আগে হলুদ মাখিয়ে নেয় অনেকে। না নিলেও অসুবিধে নেই। হলুদ পরে দেওয়া যাবে। কাঁচা রাঁধুনির হাতে হলুদে পোড়া ধরে যেতে পারে। আর নুনটা প্রথমেই দিবি না। একটু ভাজা হবার পর দিবি। নুন দেবার পর আনাজ থেকে জল বেরিয়ে যায়। - বাবা! অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় দেখছি। - অনেক কিছুর ব্যাপার নয়। ধারণা হয়ে গেলে দেখবি থোড় বড়ি খাড়া। রান্নাও তো বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান। নিয়ম, সূত্র, পরিচ্ছন্নতা, শৈলী, ঘরানা সব মিশে আছে। ... ... ...
প্রচুর প্রচুর রেস্টুরান্ট পাবেন লিসবনে, যারা এই ফাদু মিউজিকের সাথে ডিনার অফার করে। তবে কিনা, সব ট্যুরিস্টিক জায়গার মতই, লিসবনেও ফাদু মিউজিক নিয়ে ব্যবসা চালু হয়ে গেছে পুরোদস্তুর। খুব বেশি ট্যুরিস্টের ভিড় হলে যা হয় – অনেক স্ক্যাম টাইপের আছে। মানে ফাদু মিউজিকের নামে আলতু ফালতু গান গেয়ে এবং একদম ফালতু খাবার দিয়ে প্রচুর চার্জ করবে। .... আমার মতে, ভালো জায়গাতে টার্গেট করাই ভালো – খরচ হবে ঠিক আছে, কিন্তু অথেন্টিক জিনিস পাবেন, ঠকার চান্স কম। আর সস্তায় বাজিমাত করতে গেলে সেই তেমন অভিজ্ঞতা হবে, যা আমার একবার হয়েছিল অন্য পাবলিকের অ্যারেঞ্জ করা ডিনার উইথ বেলি ড্যান্সিং-এ গিয়ে। পাশের ছেলে সেই নাচ দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে, বেলি ড্যান্সিং-এ কি বেলি নড়বে?” আমি বললাম, “তেমনই তো কথা!”। সে ছেলে হতাশ হয়ে বলল, “অনেকক্ষণ তো নাচ হয়ে গেল, কিন্তু বেলি তো দূরের কথা, শরীরের কোন অঙ্গ নড়ছে সেটাই বুঝতে পারলাম না!” ... ...
বিয়ের চারদিনের দিন এক ঘটনা ঘটল। এখানে বাসি বিয়ে হয় না। চৌথী হয়। ঐদিন রাতে শাড়ির আঁচলে পাঁচটা ফল বেঁধে ঘুমোতে হয়। ভোরে পুকুরে ডুব দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ভোররাতে বর ঘুম থেকে ডেকে বলে, নিচে কলটানার আওয়াজ। মা উঠে পড়েছে। তুমি উঠে পড়। আমার আর হুঁশ নেই। শেষে দরজায় ঠকঠক। নভেম্বরে বালির ঠান্ডা, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে খিল খুললাম। দেখি বাইরে মোটা শাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি মা। পুকুরে নামা অভ্যেস নেই। এই ঠান্ডায় শাল জড়িয়ে... বলির পাঁঠা হয়ে চললাম। পুকুরের সামনে শাশুড়ি বললেন, গাছের আড়ালে জামা বদলে নাও। বলে আমার পরনের শাড়িটা পুকুরে কেচে মেলে দিলেন। আর বললেন, চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমার ওপরে যা চলেছে তা বৌয়ের ওপর হতে দেব না। মনে ভাবি, আড়বালিয়ায় যদি এমন হত, জ্যাঠাইমারা বলতেন – একটা দিন মানতে হয়। ওষুধ খেয়ে নেবে। রীতি-রেওয়াজ এক ফুঁয়ে উড়িয়ে আমার প্রাণরক্ষা করলেন ইনি। না হলে হাসপাতালের শয্যা অপেক্ষায় ছিল। ... ...
ইসকান্দর কাবাব-এর নামকরণ হয় – এটা যিনি আবিষ্কার করেন, সেই শেফ ইসকান্দর এফেন্দি এর নামে – যিনি উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের বুরশা বলে একটি জায়গায় বসবাস করতেন। এই ডিশটি বানানো হয় ডোনার কাবাপ এবং গ্রিলড ল্যাম্বের টুকরো দিয়ে, যা বেছানো থাকবে গরম ট্যামেটো সসের মধ্যে, সাথে পিটা ব্রেড – এবং এই সবের উপর ছড়ানো থাকবে দই এবং কোনো কোনো সময় ভেড়ার দুধের থেকে বানানো বাটার। ... ...
আজ ঠাকুমার একাদশী। এসব দিন ঠাকুমা আগবেলা নির্জলা থাকে। বারবেলায় সব কাজ সেরে স্নান করে ঠাকুরঘরে গোবিন্দকে সাবুর ফলার সাজিয়ে তারপর নিজে খায়। তবে আজ ঠাকুরঘরে সব নেবার আগে আলাদা পাথর বাটিতে দুধে ভেজানো সাবু, কোরা নারকেল, ক্ষীরের সন্দেশ, একটা বারোমাসি আম আর আমাদের গাছের চন্দন কবরী কলা আলাদা করে সরিয়ে রাখে ঠাকুমা, “কোহিনূরদের বাড়িতে দিয়ে আসিস।” ... ...
এতদিনে পান্তাভাত কি ও কয় প্রকার, কতখানি স্বাস্থ্যকর, কতটা জিভে জল আনা, কোথায় কোথায় কি কি নামে ডাকা হয় কি কি দিয়ে খাওয়া হয় - সব আপনি মোটামুটি জেনে গেছেন। ভেবে কি একটু অবাক লাগছে, যে এতই পুষ্টিকর ও উপাদেয় আদ্যন্ত দেশী খাদ্যটিকে চিনে-জেনে নিতে অস্ট্রেলিয়ার মাস্টারি দরকার হল কেন? প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা কিঞ্চিৎ জটিল, ধাপে ধাপে পৌঁছতে হবে। ... ...
সেদিনের আগে জানতাম না, যে এই রুটির মত জিনিসটাকে ওরা বলে ‘ইনজেরা’। এটা বেস করেই ওদের নানা খাবার গড়ে উঠেছে – আপনি নিরামিষ, আমিষ, ভাজাভুজি – যা-ই চান, এই রুটির উপর পরিবেশিত হবে। আর আমাদের ভারতীয় ক্যুজিন-এর মত ইথোপিয়ান ক্যুজিনেও ‘কারি’-র ব্যবহার প্রচুর, বেশ মশালাদার খাবার বানায় এরা। আমাদের মত এরাও ব্যবহার করে লঙ্কা, আদা, রসুন, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং জিরা। ... ...
এখানে খিচুড়ি থেকে দু-দণ্ড সরে ঘিয়াৎশাহি সুলতানের হেঁশেলের ‘ভাত’ নিয়ে একটু চর্চা করার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। এ কেতাবে যেসব বৈচিত্র্যময় ‘ভাতের’ কথা আছে তা ভেতো বাঙালিকে পদে পদে অপ্রস্তুত করবে! যেমন, চিনি মেশানো গোলাপজল কিংবা গোলাপ-গন্ধী চিনি (গুলশকর) দেওয়া ভাত, জংলি আঞ্জির দেওয়া ভাত, তালমিছরি দেওয়া ভাত, ‘দুটি সোনার মোহরের মাপে চাকা চাকা করে কাটা দশটি কলা আর দুই শের কিশমিশ দেওয়া ভাত’, সেঁকা ছোলা আর সেঁকা তিল দেওয়া ভাত, দুঘ কিংবা রস কিংবা সুগন্ধি জল কিংবা কুমড়োর রস মেশানো ভাত, সেঁকা তিল, মেথি, এলাচ, লবঙ্গ, লেবুর রস, নুন, ঘি এবং ঘিয়ে ভাজা হিং দেওয়া ভাত, দুঘ আর রসুন দেওয়া ভাত, বড়ি, মাংস আর লেবু দেওয়া ভাত, টক কমলার রস, কুমড়োর রস, লেবুর রস, মিষ্টি কমলার রস, পোমেলোর (সদাফল) রস কিংবা কামরাঙার রস মেশানো আলাদা আলাদা কিসিমের ভাত… ... ...
আমরা যারা সেই ছুটিতে বাড়ি যেতে পারতাম না, তাদের জন্য গ্রেস হাউসে ক্রিসমাস-ইভে ডিনারের আয়োজন করা হত। আসলে আমরা একটা পরিবারের মতই ছিলাম – তাই আমাদের ওয়ার্ডেন ক্রিস এবং অফিস-কর্মী অ্যালেন-ক্যাথি তাদের পরিবার নিয়ে আমাদের সাথেই ওইদিন ডিনার করত, ক্রিসমাস ট্র্যাডিশনাল ডিনার। ডিনার করে রাতের দিকে আমি যোগ দিতাম জেন আর যোসেফের সাথে, মধ্যরাতের চার্চ সার্ভিসে। রাত বারোটায় চার্চে ওই দিন এক স্পেশাল প্রার্থনার আয়োজন করা হত – আমরা বাড়ি থেকে হেঁটে যেতাম হারবোর্ন চার্চে। সেই রাতের প্রার্থনা আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে মানুষের ধর্ম নয়, নিজেদের মধ্যে ভালোবাসাটাই বড় ব্যাপার – আর সমস্ত ধর্মের মূল কথা তাই। একই ভাবে আমার প্রিয় বন্ধু আহসানের সাথে রমজানের মাসের সময় ইফতার করতে যেতাম স্টুডেন্ট গিল্ডে – সেও সেই ভালোবাসার গল্প, ধর্মের ভেদাভেদের উর্দ্ধে। তবে সেই সব নিয়ে অন্য একদিন লিখব। ... ...
কাছে এগিয়ে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল – বিশাল কিছু আলো জ্বলছিল না বলে ঠিক ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তবুও, মেক্সিকান এদের তো মনে হচ্ছে না! একদম কাছে গিয়ে খাবারের লিষ্টে চোখ বোলাচ্ছি, মনে হল যে বাংলা ভাষা শুনলাম! আরো ভালো করে বলতে গেলে, আমাদের কলকাতার উচ্চারণে বাংলা নয়, বাংলাদেশের বাংলা। লন্ডনে বাংলাদেশী বাংলা শুনতে পাওয়া কোনো অবাস্তব ব্যাপার নয়, কিন্তু টুপি পরে মেক্সিকান স্টলে খাবার বিক্রি করছে – এমনটাও চট করে দেখা যায় না! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, বাঙালি নাকি”? একগাল হেসে উত্তর এল, “জি দাদা, আপনে কোথাকার?” ... ...
আমিও সেদিন তাই করলাম। পাশ দিয়ে ওয়েটার যাচ্ছিল, তাকে বললাম, “আচ্ছা ওমলেট পাব কোথায়”? সে বলল ওমলেট স্টেশনে চলে যান! ওমলেটের যে আবার স্টেশন হয়, তা কে জানত! তো যাই হোক, যেন বেমানান না লাগে – এমনভাবে দুলকি চালে ওমলেট স্টেশন খুঁজতে বেরুলাম। সেই প্রকাণ্ড জায়গা পাক দিয়ে, প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় দেখতে পেলাম, এক শেফ এক গাদা ডাঁই করে রাখা ডিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম এই সেই মোক্ষ স্থান! গিয়ে চাইলাম ওমলেট – ব্যস, প্রশ্নবাণে গেলাম ফেঁসে! প্রায় ৫ মিনিটের ইন্টারভিউ দিয়ে, ১০ মিনিট বাদে ওমলেট নিয়ে টেবিলে ফিরলাম। ... ...
মেজ নন্দাই যখন শ্বশুর বাড়িতে আসতেন, আমাকে বক্সীবাজারে নিয়ে যেতেন। কতরকম যে নোনামাছ বাজারে, তাদের চেহারা, আকৃতি সব কিছু অদ্ভুত। আমি অবাক হয়ে যেতাম। মাছগুলো বেশ স্বাদু, কিন্তু দামে কম। কম তো হবেই, স্থানীয় সমুদ্রের মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। শহরের মানুষ তো খেতে জানে না, তাই দামও ওঠে না। কিন্তু এই মাছগুলো এখানকার মানুষের শরীরে সস্তা প্রোটিনের যোগানদার। আর দীঘা-মোহনায় ইলিশ উঠলে, বাড়িতে ফোন চলে আসে। তখন বর, দেওর, আরো কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে কাকভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। কারখানা থেকে থার্মোকলের বাক্স কিনে রেখেছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে টাটকা ইলিশ ঠেসে বরফ দিয়ে চওড়া সেলোটেপ দিয়ে সিল করে নিয়ে আসে। শহরেও এভাবে ইলিশ নিয়ে আসি আমরা। প্রতিবেশী, নিকটজন ইলিশ উপহার পেলে খুবই খুশি হয়। হাওড়া স্টেশনের পাশে ইলিশের নিলাম হয়। সেখানেও যাওয়া হয় কখনো-সখনো। ... ...
ভোরের আজানের শব্দে ঠাকুমার ঘুম ভাঙলে ফুরিয়ে যায় আমারও ঘুম। আর আজ তো ঘুম ভাঙার অজুহাত আছেই, “ও ঠাকুমা, আমার হাতটা ধুয়ে দেবে একটু? দেখো মেহেন্দি শুকিয়ে সারা বিছানায় গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়েছে”। ঠাকুমার সাথে আমিও নেমে আসি উঠোনে। বরইগাছের মাথা ছুঁয়ে থাকা আকাশটাই আলো ফুটছে একটু একটু করে। সেই আলো মিশে যাচ্ছে শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড়ে। চারপাশের নীরবতার সাথে তাল মিলিয়ে ফিসফিস করে উঠি, “ও ঠাকুমা, পূজার ফুল তুলবে না আজ?” কলঘর থেকে একঘটি জল এনে ঠাকুমা ঢেলে দেয় আমার হাতে। ঠাকুমার আঁচলে ভেজা হাত মুছি আমি। আবছা অন্ধকারে তাকাই আমার হাতের দিকে। মেহেন্দি আঁকা চাঁদটা কেমন জ্বলজ্বল করছে। ঠাকুমা বারান্দায় রাখা ফুলের সাজি শ্বেতকাঞ্চনে ভরে দেয়। সেখান থেকে কয়েকটা ফুল মুঠোয় করে নাকের কাছে আনতেই ফুলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে নাকে এসে ধাক্কা দেয় মেহেন্দির ঘ্রাণ। আমি ঠাকুমার দিকে তাকাই, “ও ঠাকুমা, আজ ঈদ”। ... ...
তবে জাউ হলে দারুণ আনন্দ হত। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। শীতের সকালে একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি, খুব হৈ হৈ হচ্ছে। সবাই খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তড়বড়িয়ে খড়ের গাদাটা কাছ থেকে দেখতে গেলাম। দেখি, খড়ের গায়ে অনেক সাদা সাদা ব্যাঙের ছাতা ফুটে আছে, ঠিক যেন খড়ের ফুল। আর মাটির কাছের ছাতাগুলো লালচে। এগুলো দেখে সবাই আনন্দ করছে। এবার আমার সঙ্গে কর্তার যা কথোপকথন হল, তা এইরকম – - এগুলো কী? - ছাতু ফুটেছে, খড়-ছাতু। - মানে? মাশরুম? - হ্যাঁ, দারুণ খেতে। মাংসের মত। মাকে বলব আজ সকালে জাউ করতে। - ঝাউ করা কী? - আরে দূর! ঝাউ নয় জাউ। খেলে বুঝবে। ... ...
শহরে আমাদের দু’কামরার বাড়িটাকে মা-বাবা বাসা বলে। হ্যাঁ তাই তো, চিলতে উঠোনের নিরিবিলি ছোট্ট এই বাড়িটা কীভাবে আমাদের বাড়ি হবে? বাইরবাড়ি নেই, দুপুরের ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে জেঠি ঠাকুমাদের আড্ডা নেই, আমার খেলার কোনো সঙ্গী নেই আর নেই কোনো হৈ-হুল্লোড়। তাঁতঘর থেকে তাঁতিদের গানের মত ভেসে আসা সুর দূরে থাক, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে একটু আধটু কারো কথার আওয়াজও পাওয়া যায় না। আর তা যাবেই বা কী করে? এখানে সব বাড়িই প্রাচীর ঘেরা যে। ... ...
- মা দেওয়ালে এত রাক্ষুসী কে আঁকে বল তো? - রাক্ষুসী? ও! ঐ ইন্দিরা গান্ধীকে আঁকে। - ই-ন্দি-রা গান্ধী! সে তো দারুণ দেখতে। দিল্লীতে থাকে। সিনেমার আগে, যার সিনেমা হয় – সে-ই তো? তার হাতে তারা-হাতুড়ি-কাস্তে থাকে? রাক্ষুসীর পাশে আঁকা থাকে। - আমি ওসব বলতে পারব না। বাবাকে জিজ্ঞেস কর। বাবা ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিল। মাঠে ফুটবল খেলা হলে যেমন কয়েকটা দল থাকে, দেশ চালাতে গেলেও তেমন। ... যে জিতে যায়, সে দিল্লিতে থাকে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে থাকে, মানে জিতে গেছে। ... তবে কি বড় হলে ইন্দিরা গান্ধীই চিঠি দেবে আমাকে? কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম ইন্দিরা গান্ধী খেলায় হেরে গেছে। থমথমে মুখে ঘুরতে লাগলাম, আমার চিঠির কী হবে? ... ...
আমরাও বাবার শুনে শুনে খুব জোরে জোরে চেঁচিয়ে আলক্ষ্মী বিদায় করে দিতুম। তারপর বাবা তালপাতার পাখা আর বেতের কুলো নামিয়ে আনত। এগুলো ঠাকুরের জায়গায় তোলা থাকত। তিনজন মিলে সেগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে ছড়া কেটে বাতাস দিয়ে দিয়ে রাস্তায় গিয়ে অলক্ষ্মীকে তাড়িয়ে দিতুম। কুলোর বাতাস আর পাখার বাতাস দিতে আমাদের দু’ বোনের এত উৎসাহ আর তিড়িং বিড়িং লাফালাফি দেখে বাবা হা হা করে হাসত। বাবা খুব শান্ত, চুপচাপ মানুষ ছিল। কিন্তু ঐ লক্ষ্মীপুজোর দিন বাবা যেন আমাদের সমবয়সী ছেলেমানুষ হয়ে যেত। এখন বুঝি, ঐ সব রীতি বাবার ছোটবেলার স্মৃতিতে মিশে ছিল। আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাবা নিজের ছোটবেলায় ফিরে যেত। ... ...
আমলাপাড়ার নিরিবিলি বাসাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আমার বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। আমি ফিসফিস করে বলি, “ও মনিপিসি, বাবার শহরের চাকরি কবে ফুরাবে?” মনিপিসি কি একটু হেসে উঠল? অন্ধকারে তা ঠাওরে উঠতে পারলাম মা। তবে আমার কাছে আরেকটু সরে এসে মনিপিসি বলল, “এই শহরের পর আরোও বড় শহর, তারপর আরোও বড় শহরে যেতে হবে তোকে। তোকে অনেক বড় হতে হবে মনি”। মনিপিসির স্বরে কিছু একটা আছে। উত্তর খুঁজে পাইনা আমি। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি, “বড় হলে কি আর নিজের বাড়ি, নিজের জায়গাতে আর ফেরা যায় না?” ... ...
এমনি গোঁজ করে থাকা প্যাঁচা মুখ এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি আমি। অল্পবয়সে একবার পিজি হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি ছিলাম কয়েকদিন। একদিন গভীর রাতে দেখি ওয়ার্ডের সব আলো জ্বলে উঠল। ডাক্তার, নার্স – সব খুব ছোটাছুটি করে বেড রেডি করছেন। তারপর বেনারসী পরা এক সালঙ্কারা মেয়েকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া হল। আনতে আনতে মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিল। বিশাল ওয়ার্ডের সেই অনন্ত সংখ্যক বেডে পড়ে আছি পেটকাটা মেয়ের দল। কিছুটা নির্বিকার উদাসীনতা, কিছুটা ক্রোধ, কিছুটা উদ্বেগ – সব খেলা করে মেয়েদের মনে। গরীব কিংবা বড়লোক, হিন্দু নাকি মুসলমান, বিয়েওলা বা অনূঢ়া, অল্পবয়সী না পাকাচুলো - সব ধরণের মেয়ে সাক্ষী রইল ঘটনার। চোখের পাতা এক হল না। এরপর সকাল হলে ... ... ...