মনিপিসি এগিয়ে দিল ডুমো করে কাটা ভাপিয়ে রাখা মানকচু। কড়াইয়ে আরো খানিক সর্ষের তেল পড়লো। তাতে তেজপাতা ফোড়ন। দেরি না করে তাতে পড়লো ভাপিয়ে রাখা মানকচু। হলুদ লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে তাতে ঠাকুমা বাটি থেকে মিহি করে বাটা জিরে আর শুকনো মরিচ বাটা দিয়ে দিল। এরপর বাটি ধুয়ে খানিক জলও। জল পেয়ে কড়াইয়ের তেলমশলা ধোয়া ছেড়ে দিল। খুন্তি দিয়ে খুব ভালো করে সেই মশলা কষাতে লাগল ঠাকুমা। ... ...
ঠাকুমা কচুপাতা নেবার আগে এ-গাছ ও-গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছে। ঠাকুমার বাগানে মাচা ভরা ঝিঙে ধুন্দল ঝুলছে। আর শিউলি গাছ বেয়ে উঠে গেছে পুঁইয়ের লতা। তবে এসবে আমার মন বসে না। আমি শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড় ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মাটি থেকে দেবদারুর ফল কুড়িয়ে পুকুরের জলে ছুঁড়ে মারলাম। পড়ন্ত আগবেলায় রোদের তাপে ঝিমিয়ে থাকা পুকুরটায় ঢেউ উঠল, কোণায় কোণায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ মাথা তোলা হেলেঞ্চা শাকগুলো নড়েচড়ে উঠলো। আর ঠিক তখনি তাঁতঘর ঘেঁষা নিমগাছটা থেকে ডেকে উঠল কুটুম পাখি, কুটুম আসুক, কুটুম আসুক… ... ...
এ বাড়িতে পশু পাখিকে, গাছকে, ঘাসকে, পুকুরের মাছকে খেতে দেওয়ার, সম্মান করার এক প্রাচীন প্রথা আছে। আমার বাপের বাড়ির গ্রাম আড়বালিয়াতে এমন কখনও দেখিনি। সেই প্রথা হল গমা পূর্ণিমাতে প্রকৃতি পুজো। পুজোতে সকল পশুপাখির প্রতিনিধিত্ব করে গমা বুড়ি অর্থাৎ গোমাতা। এইদিন খুব সকালে গোয়ালের যত গরু আছে তাদের পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে দুই শিঙে রাখী বেঁধে দেওয়া হয়। সারাদিন ধরে পুজোর জন্য আস্কে পিঠে তৈরি করা হয়। সেদ্ধ চাল আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকাল সকাল বেটে নেওয়া হয়। এবার তাতে একটু নুন আর অল্প অল্প করে গরম জল মিশিয়ে খুব ভালো করে ফেটানো হয়। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখা হয়, যাতে মণ্ডটা একটু ফেঁপে যায়, তারপর মাটির সরায় পাতার জ্বালান দিয়ে একটা একটা করে আস্কে পিঠে তৈরি হয়। ... ...
অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, ছোট জা আমাকে চোখ মটকাচ্ছে। ... একটু দূরে আছে বলে ওর ইশারা বুঝতে পারিনি, খাওয়ার দিকেই একতানমন হয়ে ছিলাম। পরে কথা বলে বুঝলাম, জা আমার খাওয়া দেখে ইশারা করছিল, এখনই অতটা পরিমাণ খেয়ে না নিতে। ওর কথাটাকে সত্যি করে, চাটনির পরে এল সাদা ভাত আর ঘি। তারপর একে একে পোস্ত ছড়ানো লাল শাক ভাজা, মুড়োর ডাল, ছ্যাঁচড়া, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, ঘন টমেটোর চাটনি, দই, মিষ্টি, পান। এমন দুই পর্বের খাওয়া দেখে, খেয়ে আমার মনটা ভীষণ অবাক, আর পেটটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেল। ... ...
আমুদী মাছটাও বেশ সুস্বাদু। বিয়ের আগে খাওয়া দূরস্থান, এসব মাছের কখনও নামও শুনিনি আমি। একটু ছোট আকারের লালচে স্বচ্ছ ধরণের চেহারা মাছটার। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা হয়, তবে ফ্যাসার মত কড়া করে নয়। সর্ষের তেলে কয়েক দানা চিনি ফেলে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হয়। পেঁয়াজ কুচো, আদা রসুন বাটা, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষে তেল ছেড়ে গেলে টমেটো বাটা মেশায় রুনাদা। আবার মশলাটা কষে। এইভাবে দু’বার করে কষে ধৈর্য ধরে এক একটা রান্না করে রুনাদা, আমি দেখি। এবার অল্প জল দিয়ে মাছগুলো ঢেলে দেয়। এবারে বেশ ছ’-সাতটা নধর কাঁচালঙ্কা আস্ত আস্ত ঝোলে ফেলে চাপা দিয়ে দেয়। আর এমন চৌখস, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে দেবে ঠিক সময়ে, কিন্তু ঢাকা খুলবে না। পুরো ভাপটা ঠান্ডা হয়ে রান্নার ঝোলে ঢুকে যাবে। আর খাওয়ার সময়ে ঝোলে একটা অসাধারণ কাঁচালঙ্কার গন্ধ বেরোয়, কিন্তু ঝাল হয় না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি রান্নায় ঐ কাঁচালঙ্কার ফ্লেভার আনার, এখনও সফল হতে পারিনি। ... ...
– জেঠিমা, তার মানে পুতুল দিদা যে এমন হৈ চৈ করে, সেটা মনের দুঃখ ঢেকে রাখার জন্য? এসব এত কিছু তো জানতামই না। – মানুষের মনের খবর কেই বা রাখতে পারে বাবু। – জেঠিমা, তুমি মোহনবাগানের গল্প বলতে গিয়ে বলেছিলে, স্বামীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন কুমুদিনী। পুতুলদিদাও কি ভেঙে পড়েছে? – এসব কথা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। বুঝে নিতে হয়। তবে আগের পিসি আর এখনকার পিসির মধ্যে কিছুটা তফাৎ তো আছেই। তোর জেঠুও ঐজন্য সবসময়ে দেখিস না পিসির সঙ্গে টরেটক্কা করে যায়? আগের পিসিকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। আর রইল কুমুদিনীর কথা। নিজের কথা তিনি নিজেই বলে গেছেন। ... ...
উমমম, দারুণ জিনিস এনেছে আজ, মাঝারি সাইজের একেবারে টাটকা জীয়ন্ত চিংড়ি মাছ। পুরোনো স্মৃতি মনে আসে। ওয়েটল্যান্ডে যখন দু’জনে চাকরি করতাম, কর্তা একবার পুকুরের গলদা চিংড়ি রান্না করে অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। চিংড়িগুলো এতটাই তাগড়া ছিল, যে দুটো চিংড়ি ছ’ টুকরো করে আমরা ল্যাবের ছ’জন প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট টিফিনে হাপুস হুপুস করে খেয়েছিলাম। সে গলদার দাঁড়াগুলো একেবারে নেভি ব্লু আর মোটা মোটা। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দাঁতে চেপে ভেঙে খেতে হয়েছিল। কিন্তু এগুলো গলদা নয়, চাপড়া চিংড়ি। রান্নার বৌদের হাতে ছাড়লে ওরা সেই একটাই জানে – সেটাই করবে। ডুমো ডুমো আলু, নারকেল বাটা, আর সেই কাঁচা কাঁচা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঝোল। ওরা যা পারে করুক। আমি একটু চিংড়ি আলাদা করে চিংড়ি থেঁতো বানাব। ... ...
- সেনবাড়ির ঝোল আর মাছের ঝালের তফাৎটা কি? - তফাতের বদলে তুলনা বলছি। ১। দুটোতেই তেলে পাঁচফোড়ন আর লঙ্কা ফোড়ন পড়ে। কাঁচা লঙ্কা অথবা শুকনো লঙ্কা - আপরুচি খানা। মা কাঁচা লঙ্কা দিত, আমিও তাই। ২। ঝোলে নানারকম সব্জি দেওয়া যাবে। কিন্তু ঝালে সেটা হয়না। ঝালে আমার মা মাঝে মাঝে আলু বা বেগুন, অথবা শীতের সময়ে পেঁয়াজ কলি বা কচি শিম ভেজে দিতো, যেকোনো একরকম। ৩। আজকাল সারাবছর টমেটো পাওয়া যায় বলে, দুটোতেই টমেটো দেওয়ার চল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় টমেটোর এত ব্যবহার ছিলনা। ৪। হলুদ দুটোতেই কমন। ৫। ঝোল বা ঝাল হবে নোনতা স্বাদের। কোনো মিষ্টি পড়বেনা। ৬। ঝোলের মশলা হচ্ছে প্রধানত ধনে; জিরে দিলে খুব অল্প, মা জিরে দিতনা। ডালনা বা দমে জিরে হল প্রধান, কিন্তু ঝোলে নয়। বেগুন দিয়ে ঝোল হলে হাল্কা সর্ষে ধোওয়া জল দেওয়া যাবে। ... ...
- সাতরকম ভাজা কী কী? - যেদিন যেমন বাজারে ওঠে—চাকা চাকা গোল আলু ভাজা, লম্বা লম্বা পটল ভাজা, পাতলা করে কাটা কুমড়ো ভাজা, বোঁটা সমেত বেগুন ভাজা, চাকা করে কাঁচকলা ভাজা—এগুলো রোজই হবে, যতদিন পুজো চলবে। তার সঙ্গে ধর ডুমো করে ঢ্যাঁড়শ ভাজা বা ফুলকপি ভাজা হল – সব মিলে সাতরকম। অষ্টমীর দিন আর একটা বাড়বে—ধর কলমি শাক ভাজা হল, নবমীর দিন ধর এগুলোর সঙ্গে নারকেল ভাজা হল—এইরকম। সবসময়ে যে এই যা বললাম, সেগুলোই হবে, তা নাও হতে পারে। উচ্ছে ভাজা, গাজর, শিম বা কুঁদরি ভাজা—কতরকম হতে পারে। ভাজার কি আর শেষ আছে? বাড়িতে এতগুলো কলা গাছ, থোড় ভাজা হতেও বাধা নেই। ... ...
- মা কী বলবে বলেছিলে মনে আছে? - কী রে? - দাদুরা আড়বালিয়ার বাড়ি ছেড়ে শহরে কেন গিয়েছিল? - ইচ্ছে হয়েছিল তাই গিয়েছিল। - না, বল ঠিক করে, বলতেই হবে। তোমার মামার বাড়ির কথা তো অনেক শুনলাম। আমার মামার বাড়ির কথা জানবোনা বুঝি? আড়বালিয়ার অমন প্রাচীন ইতিহাস নেই? - সে তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কিনা রাজা মহারাজাদের সাত পুরুষ, দশ পুরুষ সব নাম নথি পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের সেসব লেখা থাকেনা, তাই হারিয়ে যায়। আমাকে নিয়ে কেবল চার পুরুষের কথাই জানি। - সেটাই বল, আমাকে তো জানতে হবে। - জানতে হবে? সংক্ষেপে জানবি নাকি বিশদে? - ওসব জানিনা, তুমি যা জানো আমাকে বলতে হবে। - তাহলে তোকে কিন্তু ধৈর্য ধরে অন্তত সোয়াশো বছর আগের আড়বালিয়ায় যেতে হবে। পারবি? - তাই নাকি! চল, চল, শিগগির। ... ...
কখনও মনে পড়ে – সরস্বতী পুজো হচ্ছে, সদর দরজার কাছে বাঁদিকে প্রথম ঘরে ঠাকুর। ঘর জুড়ে অনেক কিছু সাজানো। দূরে ঠাকুরের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ওপরেরটা আমার। নীল মলাটের ওপর লাল আর সাদা দিয়ে লেখা। আমার বইটা নিয়ে নিয়েছে সবাই। এত জিনিস টপকে আমি যেতেও পারছি না যে তুলে আনব। মা সমানে বোঝাচ্ছে, যে, ঠাকুরের কাছ থেকে বই তুলে নিতে নেই। কিন্তু আমার ভবি ভোলার নয়। বারবার দরজা দিয়ে বইটা দেখছি, সদর দরজা অবধি দৌড়োচ্ছি আর প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কাঁদছি। আচ্ছা, কী বই ছিল ওটা? দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, মা কোলে করে ক্যালেন্ডারের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলছে, ‘এটা কে? আমি বলছি বিবেকান্দ-নন্দ।’ মা হাসছে, আমি হাততালি দিচ্ছি। ... ...
সারাদিনের মধ্যে এই ফুলতোলার সময়টুকুতেই তো ঠাকুমাকে আমি আমার মতো করে পাই। এ-কথা ও-কথায় আমরা দু-জনকে বারবার জানাই—আর কেউ না, তুমিই আমার সব আবদারের জায়গা। তবে শহরে যাবার পর অবশ্য ঠাকুমার আবদার আমার থেকেও বেড়ে গেছে। ফুলের সাজি হাতে বাইরবাড়িতে যেতে যেতেই ঠাকুমার আবদার, ও দিদি, এবার বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করতে হবে কিন্তু তোমার। শহরে বাবা নিয়ে গেছে তো ভালো করে পড়াতে। বাবার কথা মানতে হবে দিদি। ... ...
এর মধ্যে আবার শুনলাম মতির ছেলেরা ফের বাবার কাছে গিয়েছিল বলতে যে অভিযোগ যেন তুলে নেয়। বাপ বলে পাঠিয়েছে, তোদের মাকে বল আমাকে নিঃশর্ত আইনি বিচ্ছেদ দিয়ে দিতে, তবে মামলা তুলব। সপ্তাহ খানেক পর কোর্টের খবর আসে, জানা যায় কাগজটা ভুয়ো। এমন কোন কাগজ আদালতে জমাই পড়েনি। সবই মতির বরের চালাকি। মা আর তিন ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুলিশ আসবে শুনে সকলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওরাও তো আর সব সময়ে সোজা পথে চলে না। তবে ডামাডোলে রেশন কার্ড ফেরৎ পাবার কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। শহর থেকে বিস্তর ফোনাফুনি করে মতি যাতে চাল গম পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মতি অনেক জ্বালিয়েছে ঠিকই, ওর এই দুর্দশার দিনে মোটেই খুশি হতে পারি না। বরঞ্চ কপালে করাঘাত করে ভাবি, এই মতি এখনও স্বপ্ন দেখে যে তার যোগ্য বর ওকে আবার ঘরে নেবে, আবার ও তার সঙ্গে সংসার করবে। ... ...
এখানে বা কলকাতায় সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায় না? আমি খেতাম তবে। - এখানে না, তবে কলকাতায় পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দোকান নদীয়া সুইটস, আমার মায়ের হট ফেভারিট। সেখানে পাওয়া যায়। - ও, তাহলে তো কলকাতাতেই খেয়ে নেব। কৃষ্ণনগর যেতে হবে না। - আরে পাগলি, এক এক জায়গার এক এক স্পেশালিটি। অধর দাসের সরপুরিয়ার সোয়াদ কোনোদিনই অন্য দোকানে পাওয়া যাবে না। - কেন পাওয়া যাবে না? একই তো মিষ্টি। - না রে বাবু। কোনো জায়গার মিষ্টি সোয়াশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় – এ কি কখনও এমনি এমনি হয়? আমরা তো সার্ভের কাজে গিয়েছিলাম। তখন এই দোকানের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। এই দোকানটা উত্তম-সুচিত্রার সবার উপরে সিনেমাতেও আছে। - তাহলে তো ঐতিহাসিক দোকান বলা যায়। মিষ্টিটা কেমন খেতে? কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে বানানো হয়? ... ...
ভারি মুশকিল হল তো। অনেক বছর আগে একবার যেদিন সংসদে জঙ্গি হামলা হল, সেদিন সবাই মিলে ঘরে ঘরে, ল্যাবরেটরিতে আঁতিপাঁতি খুঁজে সব ছাত্রছাত্রীকে বাইরে বার করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। ছেলেমেয়েগুলো অনেকেই রেলপথে দূর থেকে আসে। কখন কী ঘটে যায় আশঙ্কা ছিল। এখন তো সেসব কিছু হয়নি রে বাবা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা দূর, মারপিটও হয়নি কোথাও। চারদিক শান্ত। অসুখের জন্য কলেজ বন্ধ হয় – এ কেমন অসুখ! আশ্চর্য তো। ... ...
একদিন হল কী, আমি দোতলায় বাচ্চাদের মাংস রান্না করেছি, তেল কড়াটা বারান্দায় একপাশে সরিয়ে রেখেছি। কর্ণাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিলনা। একজায়গায় বসিয়ে খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে, পিঠ চাপড়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়তো। ওর পর্ব মিটিয়ে ছুটকীকে নিয়ে পড়তাম। ও দৌড়োতো, আমিও থালা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতাম। মেয়ে মাংসের তেলকড়া নিয়ে তেল মাখতে বসল, সেই ফাঁকে আমি দুটো দুটো গাল মুখে ঢুকিয়ে দিই। এমন সময়ে রুণাদা বাটি ভরা টমেটোর চাটনি দিয়ে গেল। আমি জানি রুণাদা যে বাটিটাতে চাটনি এনেছে, সে বাটিটাও আগে খাবার জলে ধুয়ে নেয়। এখানে সমুদ্র কাছে বলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি। তাই মাটির স্তরে জল প্রাকৃতিক ভাবে ফিল্টার হবার সুযোগ পায়না। টিউবয়েল খুঁড়লে এক পাইপে জল পাওয়া যায়, লোকে তাই আরও গভীরে যাবার জন্য খরচ করেনা। আর এই জল খেয়ে ঘরে ঘরে পেটের বালাই। আমরা যতদিন থাকি খাবার জল কিনতে হয়। বাড়িতে খরচ করে মেশিন বসাতে ভয়। পরের বার এসে হয়তো দেখবো, ভোল্টেজের জন্য মেশিন পুড়ে গেছে, বা ঝেড়ে মুছে সব ফাঁকা। ... ...
একই জিরা,ধনে,লংকা,হলুদ (একটু গ্যাপ দিয়ে পড়বেন প্লীজ) ঐ সব দিয়ে একই ঘ্যাঁট রেঁধেছি আর খেয়েছি- দিনের পর দিন। তা ও ভালো ইউ টিউব আসায় গুল তাপ্পি মারা সহজ হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস - কতোই বা লিখবো? সুবিধের মধ্যে এই, যে আপনেরাও বিশেষ পড়েন টড়েন না। তা ও, কথা যখন দিইছি, তখন লিখবোই। এইবারের থিম হচ্ছে "হারিয়ে যাওয়া খাবার"। জানেননি তো, যাদের আর কিছু নেই, তাদের নস্টালজিয়াই সম্বল। ... ...
এসে গেল শীতকালের দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাকসিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে শিগগির। আনলক চতুর্থ পর্ব চলছে। যেহেতু কলেজ এখনও খোলেনি, তাই আমার লকডাউন বহমান, থামার জো টি নেই। লকডাউনের অবসরে কর্তামশাই আমার এই একচিলতে বাসার জানলাগুলো বাগান করে ভরিয়ে দিয়েছেন। জানলা থেকে পুঁইশাক কেটে খাওয়া চলল নানারকম, কখনো শাক, কখনও শুধু ডাঁটা অথবা পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি। বিলোনোও হল কিছু নিকট আত্মীয় আর প্রতিবেশীকে। এখন ঐ জানালার একফালি রোদে তার বীজ শুকনো হচ্ছে আবার নতুন করে বোনার জন্য। বারান্দাকে তো একটু বড়সড় জানলা হিসেবে ভাবাই যায়, সেখানে তিনি ফলিয়েছেন ছোটো ছোটো বেগুন, দুরকম - সাদা আর বেগুনি। এখন শীতকালে দক্ষিণের জানলায় রোদ আসে বেশ। ছোটোবেলার স্মৃতি আর ইউ টিউবের পড়া মিশিয়ে, রান্নার মেয়েটির সঙ্গে যুক্তি করে থালায় থালায় দিলাম বড়ি। শুকোতে দিলাম সেই জানলায়। ... ...
আজ গুজার কাটা মাছের রসা হবে। আর হবে পুঁটি মাছের জ্বালের ঝোল। ডালে এবার কাটা পড়ল, তা ঘুরানো হল নরম হাতে। যেন কিছু ডাল আস্ত থেকে যায়। জলে ভালোভাবে সেদ্ধ ডাল মিশে যেতেই তাতে পড়ল কতগুলো বুক-চেরা কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ আর ডাল ফুঁটে হাওয়ায় মিশতে শুরু করল ঘ্রাণ। রান্নাঘরের কালো ঝুল কালি মাখা কালো জানালা পেরিয়ে সেই ঘ্রাণ গিয়ে দাঁড়াল উঠোনে। উঠোনে তখন বারবেলার রোদ সবে গা মেলেছে। সেই রোদে পেয়ারা গাছের ডাল দুলে দুলে ছায়ার আল্পনা আঁকতে। ... ...
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফুরিয়ে গেছে অগ্রহায়ণের নগরকীর্তনও। তবে বাড়ি ফেরার কড়ে গোনা দিন এখনো শেষ হয়নি আমার। ক-দিন আগেই পিয়ন চাচা লাল ঝুলি থেকে দিয়ে গেছে চিঠি। পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। গোটা শব্দের সে চিঠিতে যতটুকু বাড়ি আর নিজের কথা লেখা তারচেয়ে অনেক বেশি লেখা আমার কথা। কেমন হল আমার পরীক্ষা, কতটুকু বড় হলাম আমি, এখনো পাতের খাবার না ফুরাবার অজুহাত খুঁজি কিনা, বাড়ির কথা মনে করে মনমরা হয়ে থাকি কিনা—কতশত প্রশ্ন! সেই পোস্টকার্ড আমি বারবার পড়ি, অনেকবার পড়ি। বিছানার তোষকের তলা থেকে সুযোগ পেলেই বের করে সামনে ধরি সেই পোস্টকার্ড, মা… ও মা…. ঠাকুমা আর কী লিখেছে? বাইরবাড়ির অর্জুন গাছে ফল এসেছে এবার? গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছে নতুন পাতা এল? এবার কি পাটাই ব্রত করবে ঠাকুমা? ... ...