এতো সমৃদ্ধ এবং এতো প্রাচীন ভাষার নিজস্ব কোন লিপি নেই। সংস্কৃতের কন্যা নয়, অতএব উত্তরভারতীয় ভাষাগুলোর মতো দেবনাগরী-সম্ভূত লিপি গড়ে ওঠেনি সাঁওতালি ভাষার জন্যে। লিপিহীন এই কথ্য ভাষা তাই হোঁচট খেতে খেতেই চলতে বাধ্য হচ্ছে ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে। এই অবস্থার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম চালাচ্ছেন ভাষাবিদ এক শিক্ষিত লড়াকু সাঁওতাল, তাঁর নাম রঘুনাথ মুর্মু। শুধু লিপি তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, ছাপাখানার কাজ শিখে, একটা একটা করে তৈরি করেছেন সাঁওতালি অক্ষর – জন্ম নিয়েছে অলচিকি লিপিমালা। তাঁর একনিষ্ঠ শিষ্যদের মধ্যে জলধর একজন, সে সাঁওতালি এবং বাংলা, দুটি ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ, দুটি ভাষাতেই কবিতা লেখে। রঘুনাথ নামে একটি মাসিক পত্রিকা চালায় সে, পত্রিকাটি দ্বিভাষিক – সাঁওতালি আর বাংলা – সে-ই সম্পাদক এবং প্রকাশক। এই পত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখে নিলীন এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকর্মী কয়েকজন। ... ...
শরতের আকাশে যথারীতি হাল্কা নীলের উজ্জ্বলতম শেড সকালের দিকে – ত্যারছা রোদ এসে জবার টবে পড়েছে আপাতত, ঘুরে ঘুরে অন্য গাছের কাছে যাবে বেলা বাড়লে। এই একফালি রোদটুকু যেন মিঠুর ডাস্টার – যেন ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে লেখা আছে ক্যান্সার, লেখা আছে মৃত্যু, হাড়গোড়, নরকঙ্কাল – এই সব আঁকা রয়েছে যেন – দুষ্টু ছাত্ররা যেমন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বোর্ডে অকথা-কুকথা লেখে – কোনো শিক্ষক রিঅ্যাক্ট করেন, কেউ নির্লিপ্ত মুখে মুছে দেন, যেন কিছুই হয়নি – সকালের এই রোদ, এই নীল রঙ হাতে নিয়ে মিঠু সব মুছে দেয়, নতুন কিছু লিখবে বলে চক নেয় হাতে; রোদ চড়া হলে ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। সিঁড়িতে ওর চটির শব্দ হতেই ছন্দা এসে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ায়, তারপর মিঠু শেষ ধাপে পৌঁছলে, ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। ছন্দার চোখে বিষণ্ণতা আর টেনশন চিরকালই, এখন সে’ চাহনিতে ভয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজে। ইদানিং মা’র চোখে চোখ রাখলে প্রবল শোককেও চিনতে পারে মিঠু – সে যে তার মায়ের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে, ছন্দা যেন তা বিস্মৃত হয়; ওর মনে হয়, ছন্দা যেন সিঁড়ির ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে মিঠুর শব দেখছে। ... ...
দিন যায়, কাল যায়। ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে। চোখের ভুল সবটাই। কেউই যায়না কোত্থাও। দিন, মাস, বছর, জীবন, জোয়ার, ভাঁটা। সবকিছু চোখের ভুল। মনের ভুল। অন্ধ মানুষ কী দেখে কী ভাবে। হয় এক, মানুষগুলো বোঝে আরেক। বোকা মানুষ সব। বোকা নাহলে কেউ সুখ খোঁজে? সুখ জিনিষটা কিনতে প্রচুর দাম দিতে হয়। এমনি এমনিইই পাওয়া যাবেনা কিছুতেই। অ-নে-ক দাম। অথচ মজা এমন, যা দিয়ে তুমি দাম দেবে সেই জিনিষটা মিনিমাগনায় সারাক্ষণ এসে পড়ছে তোমার কাছে। সুখ কিনতে হয় দুঃখ দিয়ে। যন্ত্রনা দিয়েও পাওয়া যায়। কান্না দিয়ে। সেগুলো বিনি পয়সায় ঢের করে পাবে তুমি। নিয়ে যেও সুখ কিনতে। যদি সে বাজারের ঠিকানা জানা থাকে। দুঃখ এসে ওর সব কিছু উজাড় করে দেয় আমার কাছে। নিঃশেষে। আমার শরীর, মন, সত্বা, তারও আড়ালে আরো যা কিছু অদেখা হয়ে রয়েছে, সব কানায় কানায় ভরিয়ে দেয় দুঃখ। অকূল দুঃখ। আকূল। ... ...
সভা বসেছে। শেবার রানি এসেছে। অপরূপ মুক্তোর সাজ তার কালো দেহে। স্নাত, দীপ্র, গভীর। রাজা সলোমন সব সময়েই সুন্দর থাকেন। রানি অনুমতি নিয়ে শুরু করল তার প্রশ্নবাণ। শুরু হল শেবার রানির পরখপর্ব। এতদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে এই সময়ের জন্যেই। ধাঁধাঁ, হেঁয়ালি বা রানির যাচাই সবই জীবনকে ঘিরে। সম্পর্ককে ঘিরে। যাপন, বিবাহ, প্রেম। ঠিক রাজনৈতিক ছিল না সেই সব প্রশ্ন। বা অর্থনৈতিক। জীবনকে ঘিরেই ছিল তার প্রশ্ন ও প্রত্যাশা। ... ...
এই শহরে সবাই তেতে আছে সনতের মত- যেন প্রতিটি লোক জুয়াড়ি , যেন প্রতিটি লোক একটা হেরো ঘোড়ার ওপর নিজের জীবন বাজি ধরেছে,আর সেহেতু প্রতিটি সেকন্ডে নিজের নাড়ি ধরে হার্টবীট মাপছে, তারপর তেড়েফুঁড়ে শ্বাস নিচ্ছে যেন এই শেষবার। সবার ঘোলাটে চোখ, ছুঁচোলো ঠোঁট, নিঃশ্বাস নেয় ঘন ঘন- সনৎএর নিজেকে কানেকটেড মনে হয়। আজ সকালের বাসে লোকটা এনারসি, সি এ এ নিয়ে খুব চোপা করছিল, সনৎ কিছু বলে নি- জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দেখছিল আপাতনিস্পৃহ, অথচ কান ছিল সজাগ- যেন লোকটার রেসের ঘোড়াকে চিনে নিতে চাইছে। মালটা হঠাৎ টপিক চেঞ্জ করে বিক্রম আর প্রজ্ঞান তুলতে ওর মাথা গরম হয়ে গেল। যেন লোকটা নিয়ম ভেঙে দুটো ঘোড়ার ওপর বাজি ফেলেছে - যার মধ্যে একটা সনতের -যার ওপর বাজি ধরার আর কারোর এক্তিয়ার নেই। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে লোকটার হাত সরাতে মরিয়া হ'ল সনৎ-“মহাকাশের তুই কী বুঝিস?” ... ...
স্থানীয় লোকদের মধ্যেও খুব প্রভাব পড়লো এগজিবিশনটার। প্রথম কয়েকদিন এখানকার মানুষরা অবাক হয়ে এতো বাইরের লোকের আনাগোনা লক্ষ্য করেছে, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে সাহস করেনি। কিন্তু জলধর আর হেমন্ত সে সঙ্কোচ ভেঙে দিলো। কয়েকটা বাচ্চাকে ছবি দেখাতে নিয়ে এলো জলধর। তারা এতো ছবি এক জায়গায় দেখে অবাক। ধীরে ধীরে আসতে শুরু করলো তাদের বাড়ির লোকরা, বাবা-মা, ভাইবোন, সবাই। হেমন্তর উদ্যোগে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের একটা 'বসে আঁকো' প্রতিযোগিতাও হয়ে গেলো, এবং প্রতিযোগিতার ছবিগুলোর থেকে গোটা দশেক ছবি প্রদর্শনী কক্ষেও লাগিয়ে দেওয়া হলো। জয়ি বুঝলো শুভেন্দুদা কেন আদিবাসীদের মধ্যে এই ছবির প্রদর্শনী করতে বলেছিলেন। ... ...
এই শিশুরা এখানে কেন? এদের সে এখানে আশাই করেনি। কিন্তু শিশুদের উপস্থিতি তার ভালোলাগল। শিশুরা থাকলে সে সবসময়ই নিরাপদ বোধ করে। মা আর বুড়ো অভিনেতা থাকলেও। মঞ্চে অভিনয় করার সময় এবং অভিনয় নিয়ে বইপত্র ঘাঁটার সময়ও সে একইভাবে নিরাপদ ভাবে নিজেকে। কিন্তু বাকি প্রতিটি মুহূর্তে কেমন একটা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি হতে থাকে তার। সে কিছুতেই স্বস্তি বোধ করে না। কিছুতেই নিজেকে বয়স্ক লোকেদের একজন ভাবতে পারে না। বিশেষ করে শক্তি ও ক্ষমতার সামনে কেমন যেন গুটিয়ে যায়। এখনও গুটিয়েই ছিল। কিন্তু শিশুদের উপস্থিতি সমস্ত জড়তা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তুলছিল তাকে। ... ...
জাওয়া ফুল কী জানেন? জাওয়া ফুল আসলে ফুল নয়, তিন বা পাঁচ বা সাত রকমের দানাশস্যের অঙ্কুর, যা তারা বপন করেছিলো নিজের নিজের শালপাতার থালায় সাত দিন আগে, আর অঙ্কুরোদ্গম করিয়েছিলো রোজ সন্ধ্যেতে জল ছিটিয়ে। পুজোর পর চলবে হাঁড়িয়া পান আর সারা রাত ধরে নাচ; নাচে যোগ দেবে মেয়ের দল আর ধামসা-মাদল নিয়ে ছেলেরা। পরের দিন সকালে, ঐ যে মেয়েরা লুকিয়ে রেখেছিলো ভিজে বালিতে দানাশস্য ছড়ানো জাওয়াগুলো, সেগুলোর থেকে অঙ্কুরিত বীজ উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে তারা, আর সেগুলো ছড়িয়ে দেবে নিজের নিজের বাড়িতে। করম উৎসব বন্ধুত্বেরও উৎসব। বীজ ভাগ করা হয়ে গেলে মেয়েরা পরস্পরকে পরিয়ে দেবে রাখী, এই রাখীর নাম করমডোর। এখন থেকে ওরা করমসখী... ... ...
সতীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি কলেজে ফিলসফি পড়তুম। প্রথম যখন হেগেল-মার্কস পড়েছি, আমরাও মনে মনে মার্কসকে শ্রদ্ধা করেছি; তোর এখন যে বয়েস, এ বয়েসে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলুম, মার্কসিস্ট হওয়ার কথা ভাবিওনি। কেন জানিস? নৈতিক সংঘাত। আমাদের আজন্ম শিক্ষা নাস্তিক মার্কসের মেটিরিয়ালিজ্ম্ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। তোদের তো আমি সেভাবে মানুষ করতে পারিনি। এই তো, এখনই সন্ধ্যা-আহ্ণিক বন্ধ করে দিয়েছিস, বাইরে কার হাতে কী খেয়ে বেড়াস আমি ভয়ে জিজ্ঞাসাই করি না। আমি এখনো বেঁচে আছি, তা সত্ত্বেও পৈতেটা পর্যন্ত ফেলে দিয়েছিস তুই, যদুগোপাল ন্যায়রত্নের পৌত্র ! ... ...
মালিক! মুখে অনেকটা হাসি এনে বলল, মালিক করে কখনও! আমাদের দেড় মাসের টাকা কিছুতেই দেবে না। একটা গোটা মাস আর দিন পনেরো কাজ করেছিলাম। শেষে অনেক ঝামেলা ঠামেলা করে খাওয়া দাওয়ার খরচ সব কেটে রেখে দিল। অনেক কম দিয়েছিল। আমাদের কয়জনেরটা যোগ দিলে প্রায় এক লাখের উপর টাকা মেরে দিল। বাসের ভাড়াও তো অনেক। বাস ভাড়া নিল এক লাখ পঁচাশি হাজার। কোথা থেকে জোগাড় করব অতো টাকা! সবার টাকা মিলিয়েও তো অত টাকা নেই। বাড়িতে সব ফোন করলাম। আমার বৌ ধার করে টাকা পাঠালো। এই উত্তম মণ্ডলের বৌ কানেরটা বন্দক দিয়ে টাকা পাঠালো। মধুর বাড়ি থেকে সুদে টাকা ধার নিল। সব ঠিকাদারের একাউন্টে দিল। সে আমাদের টাকা দিল। আমার বৌকে অবশ্য সুদ দিতে হয়নি। এমনিই টাকা ধার পেয়েছিল। কপাল ভালো বলেন দিদি! ... ...
তোমার প্রতিভা ছিলো, বারবার বলছি জয়ি। প্রতিভা না থাকলে ভূদেবদার মতো অমন খুঁতখুতে লোক তোমার প্রথম ছবিটাই কিনে নিতেন না। আর শুধু ঐটুকু কেনাই তো নয়, কলকাতার লিট্ল্ ম্যাগাজিন ওয়র্ল্ডে আর বিজ্ঞাপন-ইলাস্ট্রেশনের জগতে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে কতো মানুষের সাথে কথা বলেছেন শক্তিদা আর ভূদেবদা, তা তো তোমার চেয়ে বেশি কেউই জানেনা। শুধু ঐটুকুই নয়, তোমার প্রতিভার স্ফুরণের জন্যে বোধ হয় ঠিক ঐ সময়টায় একজনের প্রয়োজন ছিলো, এমন একজন যে তোমাকে ঠিক ঠিক দিশা দেখাতে পারবে, যে তোমার দক্ষতার পরের ধাপটায় তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে হাত ধরে। নিখিলেশদার মাধ্যমে তোমাকে বিকাশ ভট্টাচার্যর কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন শক্তিদা। বিকাশ ভট্টাচার্যর মতো এ যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্র-প্রতিভাদের একজন নিজে তোমার সাথে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন ছবি আঁকার পাঠ দিতে। এ কথা তুমিই আমাকে বলেছো জয়ি যে তোমার তা পছন্দ হয়নি। পালিয়েছিলে তুমি। ... ...
আমরা অতীতে যেখানেই ছিলাম, যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ভেঙে ফেলা খেলাধুলোয় ব্যস্ত ও ত্রস্ত মানুষ -- আমরা কেবল ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে নাড়াচাড়া করে দেখছি। দেখছি, অক্ষরগুলো এখনও বেঁচে আছে কিনা। দেখছি, গনগনে চিতার শিখার থেকে কেউ রুমাল নাড়ে কিনা। চিতাভস্মে সমান হবার যে আবেগপ্রবণ আকাঙ্খা তার লেশমাত্র নাই। এখন কেবল ধানখেতে কালো একটি ছেলে শুয়ে আছে, রক্তাক্ত। কালো কালির ওপর লাল কালির এই কাটাকুটি লিখেছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী। ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়। ... ...
হারুনের এই ঝড়ের মতো হাজির হওয়া, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মজাদার কিসসা বলে এতগুলো ঝানু ব্যাবসাদারকে মাতিয়ে রাখা আবার ঝুপ করে অন্ধকার পথে মিলিয়ে যাওয়া এসবই একজন হাঁ করে গিলছিল। তার নাম হরিণ। বারো-তেরো বছরের বালক। এসেছে শান্তিপুরের দুকুল আর মলমল নিয়ে, দামোদর শেঠের তল্পিবাহক হয়ে। ফাই-ফরমাশ খাটে। শেঠের গা হাত পা টিপে দেয়। মাথায় তেল মাখিয়ে দেয়। শেঠ খাটিয়ে নেবে কিন্তু খেতে পরতে দেবে, কিছু টঙ্কাও আসবে গরিবের সংসারে। এই ভেবেই তাকে যেতে দিল তার বাপ। তা মন্দ লাগছে না হরিণের, এই শেঠের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে। তবে এই ভর হেমন্ত সন্ধ্যায় তার বাড়ির কথা মনে পড়ে। আকাশে মস্ত চাঁদ। জোছনার মধ্যে সে পিঠেপুলির গন্ধ পায়। নারকেলে গুড়ের পাক দেওয়ার গন্ধ। ... ...
যৌবন গিয়ে প্রৌঢ়ত্ব ছুঁই ছুঁই, এমন সময় ছোটদাদু চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন। তখন চাকরি চলে যাওয়া তেমন কোন বড়ো ব্যাপার ছিলোনা, লোকের হামেশাই চাকরি যেত। পরিবারও খুবই সচ্ছ্বল ছিলো -- চারটি কন্যাসন্তানের পিতা ছোট্দাদু বাড়ি এসে "কোনো ভদ্রলোকের বাচ্চা চাকরি করেনা" ঘোষণা করে তাস পিটতে বসে গেলেন। যৌথ পরিবারের কর্তা, বড়োদাদু মার্চেন্ট আপিসের বড়োবাবু। তিনি নার্ভাস হয়ে পরের মাসেই একটা পাকা চাকরির বন্দোবস্ত করে বাড়িতে এসে ছোটভাইকে বলার পর ছোটদাদু নাকি অট্টহাস্য করে বলেছিলেন, "তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে বড়দা? সত্তর টাকার মাইনে পেয়ে এসে আমি এখন পঞ্চাশ টাকায় ঢুকবো?"! বলা বাহুল্য ছোটদাদুকে আর কোনদিন উপার্জন করতে দেখা যায়নি, এবং যৌথ পরিবারটি অনতিবিলম্বে স্বখাতসলিলে ধরাশায়ী হয়। তারপরের দুই প্রজন্ম মুখে রক্ত তুলে খেটেও সেই বিলাসিতার ঋণ চোকাতে পারেনি। যে দারিদ্র পাকিয়ে ধোঁয়া টানে কবি, যে দারিদ্রে জলের ছিটে দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলে আঁকিয়ে - সেই রাজকীয় শিল্পমন্ডিত দারিদ্র নয়। শস্তা অগৌরবের দারিদ্র। ... ...
হঠাৎ করেই একটা চিন্তা তার ভাল লাগাটাকে ঢেকে দিল৷ অর্ডারের চায়ের দামের ব্যাপারে এতক্ষণ খেয়ালই ছিল না তার৷ প্রয়োজনই মনে করেনি৷ সাধারণ চায়ের দাম বেশি না। তবে এমন চায়ের দাম নিশ্চয়ই বেশি হবে৷ সে ভাবল, ওয়েটারের গল্প ফ্রি, তবে অভিনেতাদেরকে অবশ্যই কিছু দেওয়ার কথা৷ কে আর বিনা পারিশ্রমিকে এখানে সময় নষ্ট করে বসে থাকবে! ... ...
এই কথায় ঝর্নার জলের মত স্রোতস্বিনী আমিনা থমকে দাঁড়াল যেন কোন জিন পরী ওকে হঠাৎ পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে, তার আর নড়াচড়ার তাকত নেই, যেন শুধু আমিনা না তার চারপাশের পৃথিবীটাই ওমনি চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বলল আমিনা যার অর্ধেক কথা নোনা বাতাস চুরি করে নিয়ে গেল, আর বাকি আধখানা সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেল। তারপর আমিনা ধীর গতিতে নিজের দুই হাতের পাঞ্জা এক করে নিজের মুখের উপর পান পাতার মত ছড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই এক দমকা হাওয়ার মত কোথায় চলে গেল আমিনা, আলেফ আর দেখতে পেলো না। ... ...
ওই কচি বয়েসে স্কুলের পরীক্ষা পাশের পর মেয়ে যেদিন বললো কলেজে পড়বে না ও, ছবি আঁকবে আর ছবিই আঁকবে শুধু, সেদিন মেয়ের কেরিয়ার পরিকল্পনার একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলো হেমন্ত। ঠিক ঠিক যে ব্যাপারটা বুঝেছিলো, তা নয়। ততদিনে জয়ির তুলির সাথে বন্ধুত্ব আর তুলির বাবার প্রায়-মেয়ে-হয়ে-ওঠার ব্যাপারটা জেনেছে ও। ওরা অনেক বড়লোক, অনেক লেখাপড়া জানে; ভেবেছে ওদের সংস্পর্শে নিজের সম্বন্ধে যে পরিকল্পনা করেছে জয়ি, সেটাকে বাধা দেওয়া ঠিক হবে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামের এক কবির সাথে কথা বলে যেদিন জয়ি পাড়ি দেয় কলকাতায়, ও আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। শুধু নিজের জমানো সামান্য টাকা আর বুকভরা আশীর্বাদ ছাড়া ওর কিছুই দেবার ছিলো না মেয়েকে। ... ...
এই গল্প যেন তার নিজের জীবনে খুঁজে বেড়ানো একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির গল্প। এভাবেই সে হারিয়ে যেতে চেয়েছে নানা চরিত্র হয়ে বারবার। অথচ চেনা পাকদণ্ডীর মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছে এতগুলো বছর ধরে। তার জীবনেও তো আসতে পারত সেই জাদুকর যে তাকে সোনার কাঠি বুলিয়ে ঘুচিয়ে দিত সব বিষাদ। ... ...
শিকড় তো অনেক গহীনে। সেখানে প্রবেশ করবে কী করে রেখা। সে ছিল নিরূপায় নিরালম্ব এক মানবী, খালেকও কি তাই নয়? খালেক--পোকার রক্তে যে শৈশব রয়েছে তাকে সে এড়াতে পারে না। তাকে সে ভোলে নি। টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, ছবিদি, ইস্কুল, পা ভাঙ্গা শালিক...... কী অপূরব এক শৈশব এঁকেছেন মাহমুদুল হক। সেই শৈশবই খেয়েছে তার প্রাণমন। সেই ফেলে আসা গ্রাম, মানুষজন। ১৯৪৭-এর কথা তা। তখন বালকের বয়স আট হবে বড় জোর। ক্লাস টু। তার দাদা টিপু কলেজে ভর্তি হয়েছে। মনি ভাইজান ক্লাস নাইন হবে কি? সেই বালকের অমল শৈশবই এই উপন্যাসের আধার। এই উপন্যাসের প্রাণ। ছোট ছোট এমন অনুষঙ্গে ভরে আছে এই উপন্যাস যে পড়তে পড়তে বুক মুচড়ে যায়। দেখতে পাই আমার জন্মের আগের পৃথিবী। উপন্যাস তো আমাকে জাতিস্মর করে তোলে। দেখতে পাই সেই সময়কে। ... ...
তাঁদের বড় আনন্দের দিন আজ। তাঁদের হাসির দমকে রাস্তার গাছপালা কেঁপে ওঠে। বাসায় ঘুমন্ত পাখি চমকে জেগে ডানা ঝাপ্টায়। একা তাঈর শুধু চুপচাপ। তাঁর মুখে আজ হাসি ফুটছে না। ডানহাত খুইয়েছেন বটে, কিন্তু যুদ্ধের দেবতা অঙ্গহানির পরোয়া করেন না। হাতের থেকে অনেক গভীরে আরো বড় এক ক্ষত থেকে অবিরত তাঁর রক্ত ঝরছে। তাঈরের গলার কাছে ব্যথা করতে থাকে। ... ...