আইনি মর্যাদার চেয়ে বড় প্রশ্ন সাংবিধানিক মর্যাদার। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী (বা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তি) কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতে পারেন? আমাদের সংবিধানের বিধান স্পষ্ট: সাংবিধানিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত ভাবে যেমন খুশি ধর্মীয় বিশ্বাস বা অনুশীলনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু একজন পদাধিকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তা করতে বাধা দেয়। সংবিধান এও বলে যে সরকারকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যে কোনও একটি ধর্মের প্রতি ঝোঁক সাংবিধানিক মর্যাদার লঙ্ঘন। ২২ জানুয়ারির আচার-অনুষ্ঠানে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে বিভাজন রেখা ঝাপসা হয়ে গেছে। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই দেশের অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে হিন্দু ধর্মকে। ... ...
আমাদের ভারতবর্ষ যখন ‘আজাদির অমৃত মহোৎসব’-এ বুঁদ হয়ে আছে সেসময়ও কি ভারতের টুকরো হয়ে যাওয়াকে বাদ দিয়ে কোনভাবে লেখা যায় এ দেশের টুকরো হয়ে যাবার কোন কাহিনী? জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে তাঁর Remembering Partition: Violence, Nationalism and History in India (২০০৩) গ্রন্থের গোড়াতেই দু’টি প্রশ্ন তুলেছেন – (১) সরকারি সহস্র-অযুত বয়ানের মধ্য থেকে ‘ইতিহাস’ কিভাবে ‘সত্য’-কে (১৯৪৭-এর হিংসার সত্যকে) জন্ম দেবে, (২) সেদিনের সেই চরম মুহূর্তগুলোকে আজকের ইতিহাসে কিভাবে “struggle back into history” ঘটাবে? (পৃঃ ৪) এ গ্রন্থেরই অন্তিমে লেখক এক জরুরী প্রশ্ন রেখেছেন – “What would it mean to imagine India as a society in which the Muslim does not figure as a ‘minority’, but as Bengali or Malayali, labourer or professional, literate or non-literate, young or old, man or woman?” (পৃঃ ২০৫) ... ...
প্রথম দর্শনে ছবিটি দেখে মনে হয়, এ যেন আফ্রিকার আদিম অরণ্যের গভীরে, কোন নরখাদক আদিম উপজাতির উৎসবের ছবি। তারপর, রাতের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে, মশালের আলো এবং ধোঁয়ায় মিছিলের কয়েকজনের কাঁধে প্রকাণ্ড কালী-প্রতিমাটি দেখে বোঝা যায় – এ ছবি, এদেশের তো বটেই, একেবারে বাংলার দৃশ্য। কালীর দুই হাতে ঝুলে থাকা দু’টি মুণ্ডু এবং মশালের আলোর পিছনে প্রতিমার বিরাট ছায়া যেন ছবিটিকে রহস্যময়তার সঙ্গে সঙ্গে ভীতিপ্রদও করে তোলে। ছবিটিতে আঁকিয়ের নিজের অবস্থানও বেশ রহস্যময়। দৃশ্যটি দেখে মনে হয়, শিল্পী যেন গাছপালার ফাঁক দিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব গোপন রেখে, দৃশ্যটি দেখছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় আফ্রিকার আদিম অরণ্যে অ্যাডভেঞ্চারের যেসব কিশোর-পাঠ্য গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হত, তার অলঙ্করণের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে স্যাল্টিকভের আঁকা ছবির আশ্চর্য মিল। কৈশোরে এইসব গল্পে আফ্রিকার আদিম উপজাতিদের যে রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ে আমরা শিহরিত হয়েছি, স্যাল্টিকভের ছবিতে আমাদের কয়েক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদেরই সেইভাবে চিত্রিত হতে দেখা যায়। এইটাই মানব সভ্যতার বিরাট আয়রনি। ... ...
সিন্ধুলিপি যেমন প্রায় দেড়শো বছর ধরে নানান পণ্ডিত গবেষকের কাছে একটি খুব শক্ত চ্যালেঞ্জিং সমস্যা হিসেবে আদৃত হয়েছে, তেমনই অনেক অত্যুৎসাহী পাঠোদ্ধারকের নানান অদ্ভুত পাঠোদ্ধারের দাবিতে লাঞ্ছিতও হয়েছে খুব বেশী। এই ভুলভাল পাঠোদ্ধার সম্পর্কে খুব মজার একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ভারততাত্বিক আসকো পারপোলা (Asko Parpola), তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত "Deciphering the Indus script" নামের বিখ্যাত বইতে। পারপোলা দেখিয়েছেন যে, স্প্যানিশ মিশনারি পণ্ডিত ফাদার হেরাস (Enric Heras de Sicars ওরফে Henry Heras) তাঁর ১৯৫৩ সালে লেখা একটি বইতে সিন্ধুলিপির অদ্ভুত সব প্রোটো-দ্রাবিড়ীয় পাঠোদ্ধার ক'রে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন। এমনকি হেরাসের গবেষণার সম্মানার্থে ভারতীয় সিকিউরিটি প্রেস উনিশশো একাশি সালে হেরাসের ছবি আর মহেঞ্জোদারোয় পাওয়া একটি সিন্ধুলিপিযুক্ত সীলের ছবি পাশাপাশি রেখে প্রায় কুড়িলক্ষ ৩৫ পয়সার ডাকটিকিটও ছাপায়। এখন দেখা যাক ফাদার হেরাসের পাঠোদ্ধারের ধরণ ঠিক কিরকম ছিল! ... ...
কিন্ত ইতিমধ্যেই বাঙলায় মুসলমান এবং হিন্দু উৎখাত শুরু হয়ে গিয়েছে । দেশভাগের অনতিপূর্বে এবং পরে কুখ্যাত কোলকাতা কিলিং এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের নিজগৃহ এবং নিজভূমী থেকে উৎখাত করা শুরু করে । তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি সরকার মুসলমানদের জীবন এবং সম্পত্তির নিরাপত্তারক্ষায় পূর্ণ রূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হন । ঘন ঘন মুসলমান বস্তিতে আগুণ , হত্যার ঘটনা এই ব্যর্থতা এবং উদাসীনতার অন্যতম উদাহরণ । প্রকৃত অর্থে এ কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিলোনা বরং মুসলমানদের ওপর একতরফা আক্রমণ এবংসরকারী নিস্ক্রিয়তার ইতিহাস । এই ক্রমাগত দাঙ্গার ফলে এবং ভয়ঙ্কর ভয়ের পরিবেশে পশ্চিমবঙ্গের বিপুল পরিমাণ মুসলমান প্রাণ বাচাতে গৃহত্যাগী , দেশত্যাগী হতে বাধ্য হতে থাকে ।দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধিষ্ণু মুসলমান সম্প্রদায় নিরাপত্তার খাতিরে হয় শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে অথবা সদ্য গঠিত পূর্ব পাকিস্তানে দলে দলে চলে যেতে থাকেন । ... ...
যে কোনো বাঙলা সাহিত্য বা ভাষার ইতিহাসের স্কুলপাঠ্য সিলেবাস বা বইতে চর্যাপদকেই আরম্ভ বা প্রথম নিদর্শন বলা হয়েছে। যেটা আমাদের স্কুলপাঠ্য বইতে লেখা নেই, সেটা হল, এই পুঁথি শুধু বাঙলার নয়, ওড়িয়া, অহমীয়া, ভোজপুরি এইরকম বেশ কয়েকটি ভাষারও পূর্বপুরুষ। ওই সব ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস বইতেও একই কথা লেখা আছে। তাই প্রশ্ন আসে, এটা আদি নিদর্শন বটে, কিন্তু এ ভাষা তখনো কি বাঙলা হয়নি? এই চর্যাপদের কবি বা গীতিকাররা নিজেদের কোথাকার লোক ভাবতেন? তাঁরা কি নিজেদের বঙ্গবাসী ভাবতেন? এই ভাষাকে কোন সময় থেকে বাঙ্গালা বলা শুরু হয়েছিল? বাঙ্গাল অরিজিনালি কারা ছিল? এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা, যা স্কুলপাঠ্য বইয়ে নেই.. পড়তে থাকুন। ... ...
শিবপুজনজি সারা জীবন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বেশ কয়েকবার জেলে গিয়েছিলেন। তিনি আশির দশকে মহেন্দ্র সিং টিকাইতের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও ছিলেন। ১৯৮০ সালে খালে জলের জন্য আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি জামিন চাইবেন না। ফলস্বরূপ, ছাব্বিশ মাস তিনি সাসারাম জেলে ছিলেন। তাঁর মুক্তির জন্য তারই এলাকার কৃষকরা দিনারা থেকে সাসারাম পর্যন্ত চল্লিশ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছিল। একবার বিধায়ক হওয়ার পরে, শিবপুজনজি নিজেকে বড় দলগুলির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি আর কখনও নির্বাচনী রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি। কিন্তু শত প্রলোভন সত্ত্বেও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আপোষ করেননি। ... ...
বিজেপি সমর্থকরা ইতিমধ্যেই জয়ের উচ্ছ্বাসে মত্ত। অন্যদিকে বিরোধীরা হতাশ। কিন্তু কারও জিজ্ঞাসা করার সময় নেই: এই সারমর্ম কি আদপে সত্যি? এভাবেই বিজেপি মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলে এবং জিতে যায়। সত্যের একটি ছোট বেলুন এত বড় করে ফুলিয়ে তোলা হয় যে বিপরীত সত্যিটা লুকিয়ে পড়ে। লড়াই শুরুর আগেই প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে পড়লে ম্যাচ ওয়াক ওভার পেতে পারে। অতএব, আমাদের এই দাবিটি ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। ... ...
আজ থেকে প্রায় বাহাত্তর বছর আগে, ১৯৫০ সালে, প্রোফেসর উইলিয়ম এস রবিনসন একটি যুগান্তকারী পেপারে (“Ecological Correlations and the Behavior of Individuals”) প্রমাণ করে দেখান, যে, দুটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক (অর্থাৎ কোরিলেশন) সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা দুরকম হতেই পারে, যদি একটি মাপা হয় সমষ্টির জন্য (অর্থাৎ এগ্রিগেট লেভেল) আর একটি ব্যক্তির পর্যায়ে (অর্থাৎ ইন্ডিভিজুয়াল লেভেলে)। রবিনসনের পেপারে ১৯৩০ সালের আমেরিকান জনগণনার—অর্থাৎ সেন্সাসের—ডেটা অ্যানালাইজ করে দেখানো হয়, যে ঐ সময়ের ৪৮টি স্টেটে যদি বিদেশে-জন্মানো (ফরেন-বর্ন) শতাংশ এবং সাক্ষর জনতার (আমেরিকান ইংলিশে সাক্ষর) শতাংশের মধ্যে কোরিলেশন পজিটিভ: ০.৫৩। এর থেকে ধারণা হতে পারে—যে রাজ্যে যত বিদেশ থেকে আসা লোক, সে রাজ্যে তত কম নিরক্ষর মানুষের শতাংশ, অথবা, তত বেশি সাক্ষরতার হার। আর একটু এগিয়ে ব্যক্তি-স্তরে নিয়ে গেলে, এমন মনে হতে পারে—যে, বিদেশে-জন্মানো মানুষের (আমেরিকান ইংলিশে) সাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা দেশে-জন্মানোদের থেকে বেশি। কিন্তু, এই সম্পর্ক-ই যদি ব্যক্তির স্তরে দেখেন, ঐ দুই রাশি—বিদেশে জন্ম আর সাক্ষরতা—এবার কিন্তু কোরিলেশন নেগেটিভ: —০.১১, অর্থাৎ সমষ্টি থেকে ব্যষ্টি-স্তরে আসতেই সম্পর্ক উল্টে গেলো। তবুও কখনো কখনো ব্যক্তির আচরণ আর সমষ্টির ব্যবহার এক-ই হয়, কখনো হয় এক্কেবারে উলটো। সেই গণ্ডগোলের নাম “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি”। “ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসি” শব্দবন্ধ অবিশ্যি রবিনসনের দেওয়া নাম নয়, সেটির আবির্ভাব কিছুদিন পর সেলভিনের ১৯৫৮ সালের পেপারে – ইকোলজিক্যাল ফ্যালাসির সংজ্ঞা পেলাম আমরাঃ ‘the invalid transfer of aggregate results to individuals’! ... ...
রিনকিন বলেন তাঁর গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব বা Moral Dilemmaই নানাভাবে হানা দিচ্ছে তাঁর দুঃস্বপ্নে। সাদা পবিত্রতার প্রতীক। যেহেতু তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাস, স্কাউটিংয়ের শপথ, গীর্জায় নেওয়া বিবাহ শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেন নি তাই তাঁর হারানো পবিত্রতাবোধ প্রতিশোধ নিতে স্বপ্নে শ্বেত-কঙ্কাল হয়ে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। র-বাবু বলেন, যদি স্ত্রীকে ত্যাগ না করি - ফ-মণিকেও বিয়ে না করি - তবে স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ তলানিতে ঠেকেছে বলে ফ-মণির সাথে মেলামশা করে নিছক আনন্দ পেতে চাই - কেমন হয়? রিনকিন বললেন, এভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলা শক্ত তবু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। যদি দুই মহিলাই, বিশেষ করে আপনার স্ত্রী, তা মেনে নেন তো ভালোই। তবে আমার পরামর্শ এখন কিছুদিন কার্টুন আঁকা থেকে বিশ্রাম নিন, ফ-মণি থেকেও দুরে থাকুন, দেখুন তাও ঐ দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে কিনা। ... ...
সেই যে ফিলিস্তিন বা প্যালেস্তাইন নামকরণ হয়েছিল ১৩৪ সাল নাগাদ, সেই নাম সরকারিভাবে ব্যবহার হয়েছে রোমের পতনের এক হাজার বছর পরেও। রোমানরা যে বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক সীমানা তৈরি করেছিল সেই সীমানাগুলো রোমের পতনের পরও ব্যবহার হয়েছে- কিছু অদলবদল করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে, তারপর খিলাফত সাম্রাজ্যে আর মামলুক সাম্রাজ্যেও। ... ...
মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং জীবনবোধের বিশিষ্টতা এমন সর্বব্যাপী যে তাঁর এ দিকগুলোকে নিয়ে চর্চা অনেক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকেরা করেছেন। এদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দুটি বিষয় সহজেই চোখে পড়ে – প্রথম, তাঁর ধারণায় ও বীক্ষণে অহিংসার স্থান এবং দ্বিতীয়, তাঁর লেখা “হিন্দ-স্বরাজ” পুস্তিকাটি ও এ পুস্তিকায় নিহিত ধারণার ব্যাপ্তি। তুলনায় গান্ধীর বোধে মেডিসিনের দৃষ্টিকোণ থেকে চিকিৎসা, দেহ, দেশজ চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা কম। ... ...
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী তখনও ক্ষমতায় আসেননি, সারা দেশে তখন একটাই শ্লোগান ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, নিজেও চুরি করবো না, অন্যকেও চুরি করতে দেবো না। সারা দেশের সমস্ত মানুষ তখন একযোগে একটাই কথা বলছেন, একমাত্র নরেন্দ্র মোদীই পারবেন, দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে। মানুষের মনে তখন অনেক আশা, গত সত্তর বছর ধরে, কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো যেভাবে চুরি করে, দেশটাকে ফোঁপড়া করে দিয়েছে, তাতে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীই এখন একমাত্র পারেন দেশকে রক্ষা করতে। তাই শ্লোগান উঠেছিল, ‘আব কি বার, মোদী সরকার’, অর্থাৎ এবার চাই মোদী সরকার। কিন্তু আজকে যখন আমরা ২০২৪ সালের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি, তখন কি মনে হচ্ছে, দুর্নীতি কমেছে? ... ...
এদের মধ্যেকার সম্পর্কের এতো অবনতির কারণটা কি? জাতিগত এই ঘৃণা, হানাহানি এটা কি রাজ্যে বরাবরই ছিল? এরা কি কখনই একত্রে বসবাস করতে পারেনি? এদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করা কি একেবারেই সম্ভব নয়? এই প্রশ্নগুলির ওপরেই কিন্তু রাজ্যের ভৌগলিক ঐক্য অটুট থাকবে কি না তা নির্ভর করছে। এটা ঘটনা যে এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যেকার আন্তসম্পর্ক জটিল। এই প্রতিবেদনে আমরা নিজেদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সমস্যাগুলো বুঝবার চেষ্টা করবো এবং সামনে এগোনোর কিছু সূত্র সন্ধানের চেষ্টা করব। ... ...
আমি আর সন্দীপ কোনো এককালে সাইকেল করে এয়ারপোর্ট দেখতে আসতাম। ভি. সি কলেজে পড়ি তখন। কলেজ কেটে , বলাই বাহুল্য। মাঝেমধ্যে সুবর্ণও আসতো। সাইকেল চেপে ঘুরতাম, সে তো কত জায়গাতেই। ক্লাশ না পালিয়েও আসতাম পরের দিকে। যেমন শীতের ভোর ভোর কুয়াশায়, যখন নীলগঞ্জ রোডের ধারে চায়ের দোকানে সবে উনুনে আঁচ পড়ছে, বাসিমুখ দোকানী হাই তুলতে তুলতে প্রাণপণে হাওয়া দিচ্ছে; ধোঁয়া আর কুয়াশায় মিলিয়েমিশিয়ে জট পাকিয়ে একাকার। দাওয়ায় মাদুর পেতে পড়তে বসেছে বাচ্চা ছেলে, গায়ে নস্যি রং চাদর না আলোয়ান কেবা জানে; উঠোনে রোগাভোগা বেড়াল-ছানার মত ফালি রোদ ডুরে শাড়ির পায়ে পায়ে ঘোরে। ... ...
ভুঁইপটকা ছিল দেওয়ালে বা মেঝেয় ছুঁড়ে মারার জন্য - জোর আওয়াজ। কম্বাশন বাই প্রেশার, অর্থাৎ ভুঁইপটকা আর পেটোর মশলায় তফাৎ ছিলো না কোনো, পুলিশ তাই বেআইনি করে দেয়। এবছরে, আশ্চর্য, আবার সেগুলিকে বাজারে দেখছি, তা প্রায় তিরিশ বছর বাদে। চপেরই মতো, পেটো ইন্ডাস্ট্রিও কি কুটির শিল্প হিসাবে সরকারি তকমা পেলো তাহলে? ... ...
একটি জানা গল্প আবার বলতে ইচ্ছে করছে। গল্পটা আফ্রিকা মহাদেশের। বান্টু অঞ্চলের। একজন নৃতত্ববিদ একটা মজার খেলা আমদানী করলেন ৷ একটা গাছের ডালে একঝুড়ি আপেল ঝুলিয়ে দিলেন ৷ দূরে একটা দাগ দিলেন। দাগ ধরে সাতটি বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে দৌড়বে বলে। শর্ত হল, যে আগে পৌঁছতে পারবে সব কটা আপেল তার। সাহেবের যে দেশে জন্ম সেখানে বাচ্চাদের এরকম খেলা দিলে তারা হয়ত হৈ হৈ করে দৌড়াত এবং একজন প্রথমে ছুঁতো। সবকটা ফল সেই পেত। এটা-ই তো খেলার শর্ত। কিন্তু এই বাচ্চারা যে দেশে জন্মেছে তাদের উচিৎ অনুচিত বোধ একেবারেই আলাদা। বাচ্চাগুলি সকলে মিলে হাত ধরাধরি করে একই সাথে ঝুড়ির কাছে হাজির হলো। সাহেব তো অবাক - শুনি নাই কভু, দেখি নাই কভু অবস্থা। জানতে চাইলেন এরকম তারা কেন করতে গেল। উবন্তু। উত্তর দিল সবাই মিলে ৷ বুঝিয়ে দিল সাহেবকে উবন্তু কথাটির মানে, উবন্তু বলতে কী বোঝায় ৷ তাদের কথা এই যে যদি আর সকলে দুঃখ পায় তবে একজন কি করে আনন্দ পাবে। সবাই একসাথে ভোগ করতে না পারলে সেটা আনন্দ নয়। সবাই আছে তাই আমি আছি - এই হল ওই বাচ্চাগুলির শিক্ষা। এত অল্প বয়সে ওরা এটা জানে না আজকের এগিয়ে থাকা, স্মার্ট, বিজ্ঞানমনস্ক সভ্যতায় আতিপাতি করে খুঁজলেও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না বাচ্চাদের সহজাত সদ্ভাবনায়। এই শিক্ষার অস্তিত্ব আধুনিকতায় আর মোবাইল অ্যাপে হারিয়ে গেছে। একেবারে গোড়া ধরে নাড়া দেয় আজকের মূল্যবোধে, জীবনচরিতে, জোটবদ্ধ হওয়ার ফাঁকা আওয়াজে আর মৌলিক ভাল-মন্দ বোধে। ... ...
সকাল ৯ টা থেকেই তালপাটি খালের দক্ষিণে খেজুরি প্রান্তে একে একে পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ি ঢুকতে থাকে। বেলা সাড়ে নটার মধ্যে সারি সারি পুলিশের গাড়ির কনভয় খেজুরির বারাতলা কলেজ থেকে ভাঙাবেড়ায় ও তেখালি ব্রিজের ওপারে শেরখাঁচকে এসে হাজির হয়। ভাঙাবেড়ায় হাজার হাজার পুলিশের মাঝে সাদা পোশাকের গুটিকয়েক লোকের মধ্যে এপারের আন্দোলনকারীরা গোকুলনগরের সিপিএম নেতা শ্রীপতী জানাকে চিনিয়ে দিলেন। এছাড়া বাকিদের অচেনা ও বহিরাগত বলেই আন্দোলনকারীদের ধারণা হয়েছিল। পিছনে দূরে খেজুরি ও নন্দীগ্রামের সিপিএম নেতা ও কর্মীরা ছিলেন সে খবর পরে জানা গেল। তালপাটি খালের ধারে ঝোপের মাঝে বন্দুক উঁচিয়ে কিছু লোকের উপস্থিতি পরে পুলিশের ভিডিও ক্যামেরাতেও ধরা পড়েছে। ... ...
অনেকেই হয়তো জানেন না, পৃথিবীতে মাত্র দুটি অঞ্চল আছে, যার প্রায় পুরো বসতিটাই সমুদ্রতল থেকে অনেকখানি নীচে – একটি হল হল্যান্ড আর অন্যটি আমাদের সুন্দরবন। সমুদ্রের খুব কাছে হওয়ায় জোয়ার-ভাটায় সুন্দরবনের নদীগুলিতে জল ওঠানামা করে কুড়ি থেকে পঁচিশ ফিট। তাই সুন্দরবনের সে সমস্ত দ্বীপে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, জোয়ারের সময় সেগুলো সবই চলে যায় জলের নীচে, জেগে থাকে শুধু গাছপালার মাথা। আর যে দ্বীপগুলোতে মানুষের বাস, জোয়ারের জল যাতে সেই দ্বীপগুলোকে ডুবিয়ে দিতে না পারে, সেই কারণেই প্রতিটি দ্বীপকে চারপাশে বেড় দিয়ে রাখে দেড় মানুষ বা দু-মানুষ সমান উঁচু বাঁধ। জোয়ারের জলের প্রবল চাপ ধারণ করে রাখে সেই বাঁধ। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, একবার কোনো জায়গায় সেই বাঁধ ভাঙলে নোনাজল ঢুকে বেশ কয়েকটি গ্রাম আর কয়েকশো একর জমিকে ডুবিয়ে দেয়। এই কারণেই নদীবাঁধগুলোকে বলা হয় সুন্দরবনের লাইফ-লাইন বা জীবন-রেখা। ... ...