কলকাতায় দুটি বিরাট মিছিল হয়েছে, যে খবর সকলেই জানেন। মুম্বাইতে হয়েছে বিশাল এক বিরাট বিক্ষোভ। কোথাওই গোলমালের খবর নেই। তা আসছে বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ-শাসিত দিল্লি থেকে। লক্ষৌ এবং ম্যাঙ্গালোরের অবস্থা ভয়াবহ। আগুন জ্বলছে। গুলি চলেছে। অন্তত পাঁচজন আন্দোলনকারী মারা গেছেন বলে এখনও জানা গেছে। দিল্লিতে দমনপীড়ন নামিয়ে আনা হচ্ছে আন্দোলনের উপর। অন্তত ১০০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তালিকায় আছেন প্রকাশ কারাত, যোগেন্দ্র যাদব এবং সীতারাম ইয়েচুরি। বেঙ্গালুরুতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহকে। নাটকীয়ভাবে একটি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার সময় তিনি পুলিশের অন্যায় গ্রেপ্তারি নিয়েই বলছিলেন। স্পষ্টতই 'রামচন্দ্র' বা 'সীতারাম' নামগুলি বিজেপির হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করেনি ... ...
কী বুঝলেন? এই হল ফ্যাসিবাদ। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের ঘোষিত এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরপর তিনটি বড় বড় মিছিল করে জানান দেওয়া স্ট্যান্ড হল -- ক্যাব নয়, এনআরসি নয়। তবুও এখানে নির্বিবাদে প্রো-ক্যাব পথসভা হচ্ছে, মাইকিং হচ্ছে, ধর্মীয় মেরুকরণ করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। করছে এমন এমন সংগঠন, রাষ্ট্রীয় নাগরিক উদ্যোগ, সনাতন দল ইত্যাদি, যাদের নাম কস্মিনকালেও কেউ শোনেনি। কেউ কিছু বলছে না, না মানুষ, না পুলিশ। লোকে শুনছে কি শুনছে না সে কথা আলাদা। আর গুজরাতে দুটো দেওয়ালে দেওয়াল চিত্র এঁকেছে আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা। No CAB Modi. 'o'-এর জায়গায় স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকেছে যা সারা পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ঘৃণিত হয়। তার জন্য পুলিশ পাঁচজন একুশ বাইশ বছরের ছাত্রকে অ্যারেস্ট করেছে। আরো দু-জনকে খুঁজছে। ... ...
রাজ্যের কিছু হিংসাত্মক ঘটনার পর ফিসফিসিয়ে চলছে প্রচার। 'ওদের' নিয়ে। উলুবেড়িয়া, সাঁকরাইলে ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনার পর থেকে ফিসফিসিয়ে বা সোচ্চারে চলছে সাম্প্রদায়িক প্রচার। 'ওদের আন্দোলন', 'ওরা হিংসা ছড়াচ্ছে'। কিন্তু কী বলছেন স্থানীয় মানুষ? আমাদের হাতে আছে দুই সম্প্রদায়ের কিছু স্থানীয় মানুষের বক্তব্য সম্বলিত একটি ভিডিও। কী বলছেন তাঁরা? কী হয়েছিল? কী নিয়ে আন্দোলন? কারা করছেন? শোনা যাক, বক্তব্য। উলুবেড়িয়া থেকে সরাসরি. প্রকাশ করা হল গুরুচণ্ডালির পক্ষ থেকে। ... ...
গভীর রাত থেকেই ছাত্ররা রাজপথে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অবস্থান। ছাত্রছাত্রীরা গভীর রাতে যাদবপুর থেকে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। সারা রাত অবস্থান বিক্ষোভ চলেছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত। বিক্ষোভ চলছে এন-আর-সির বিরুদ্ধে, এন-পি-আর এর বিরুদ্ধে। নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। স্লোগান চলছে কেন্দ্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকারের একনায়কত্ব না যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঞ্চলিকতাকে রক্ষা করা? সংখ্যাগুরুর একচেটা একনায়কতন্ত্র, নাকি ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুর সমানাধিকার? বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মূল প্রশ্নটি এইই। প্রথাগত বাম, শাসক তৃণমূল ছাড়াও বাংলা জাতিয়তাবাদী শক্তিগুলিও এবারের আন্দোলনে ভীষণভাবে সক্রিয়। সব মিলিয়ে কলকাতা হয়তো শাহবাগ ধাঁচের একটি গণ-আন্দোলন দেখতে চলেছে আজ থেকে। অন্যান্য মিডিয়া প্রকাশ করুক না করুন, এই আন্দোলনের খবর আমরা প্রকাশ করে চলব। নজর রাখুন এই পাতায়। ... ...
মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ নির্বাসন ভেঙে টুইটারে ফিরে এসে বিবৃতি দিয়েছেন নতুন আইনের বিরুদ্ধে। বললে বিশ্বাস করা মুশকিল, চেতন ভগতও ছাত্রদের উপর রাষ্ট্রীয় হামলার নিন্দা করেছেন। সারা ভারতের নারী-পুরুষরা যাঁদের কথা ভেবে শয়নে-স্বপনে নালেঝোলে হন, যাঁরা মাঝেমাঝে টিভিতে 'সামাজিক' বিষয়ে অনুভূতিপ্রবণ অনুষ্ঠান করেন, সোশাল মিডিয়ায় বাণী দেন, মুম্বইয়ের সেই বৃহৎ তারকারা অবশ্য এই সংকটকালে নিশ্চুপ। বাংলাও ব্যতিক্রম নয়। বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে পক্ষ নিলেও সিনেমার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, যাঁরা আজকাল সিনেমার সুবাদে টিভি থেকে সংসদ সর্বত্রই সহজে ঢুকে পড়েন, তাঁদের মধ্যে তেমন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছেনা। খুব সম্ভবত কোন পক্ষ নিলে সুবিধে হবে, তাঁরা এখনও এই জল মাপতেই ব্যস্ত। ... ...
ধর্ষণ বলতে যেহেতু আমরা পুরুষ কর্তৃক অনিচ্ছুক নারীদেহের দখল নেওয়া বোঝাচ্ছি, পুরুষের মনোভাব এবং চিন্তাধারার পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তবে সে কতো যুগের কতো সাধনার ফল তা জানা নেই । তথাকথিত শিক্ষার দৌড় দেখা হয়ে গেছে মি টুর দৌলতে। অন্তর্জালে যে পরিমাণ রেপ থ্রেট দেখা যায় তাতে মনে হয় মেয়েদের শায়েস্তা করার ঐ একটি পদ্ধতিই আমাদের শেখা। খুবই লজ্জা হয় যখন দেখি রেপিস্টের ধর্ম তুলে সেই ধর্মের নিরপরাধ মেয়েদের ধর্ষণ করবার ডাক দেওয়া হয়। চিত্তশুদ্ধির প্রচেষ্ট জারি থাকুক, আপাতত আর কিছু করতে না পারি রাষ্ট্র প্রশাসন এবং সমাজের ঘাড় নোয়ানোর জন্য আমরা সমস্বরে চিৎকার তো করতে পারব। সমস্ত ট্যাবু ভেঙে ফেলে প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রবল আলোচনা,উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, চেঁচামেচি । ধর্ষণকে ঘিরে থাকা বোবা নৈশব্দকে ভেঙে ফেলে একেবারে অনর্থ করা যাকে বলে। আমরা এখন পরিষ্কার জানি ধর্ষণ শুধু লালসার কারণে হয়না । মেয়েদের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবার একটি হাতিয়ার এটি। ... ...
আমরা এক পা এগোলে হিন্দুত্ববাদীরা পাঁচ পা এগিয়ে যায়। ফলে আমরা যারা এতদিন সিএবি এর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে তার বিরোধিতা করেছি, শীতকালীন অধিবেশনে যে ভার্সনটি বিজেপির নিয়ে আসবার কথা তাতে সেই বিরোধিতার প্রসঙ্গগুলি হিসেব করেই আনা হবে বলে আমার ধারণা। ২০১৬ সালের বিলটি অবিকৃতভাবে আবারও রাজ্যসভায় এবং লোকসভায় পেশ করা হবে, এই অনুমান ভুল প্রমাণিত হতেই পারে। গতবারের বিলটিতে লেখা ছিল যে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত এবং পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এর নাগরিক মানুষদের এদেশ থেকে পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী বহিষ্কার করা হবে না এটুকু মাত্র। এই বিলে খুব সম্ভাবনা যে কোনও ভাবে নাগরিকত্ব প্রদানের সম্ভাবনার বিষয়টি যুক্ত করা হবে, আইনের ফাঁকফোঁকর রেখে। তাহলে বিরোধীদের মুখ অনেকটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আমরা প্রথম থেকে প্রশ্ন তুলে আসছি যে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় একজন মানুষ এবং তার পরিবার কি প্রমানপত্র সঙ্গে নিয়ে আসতে পারে যাতে সে প্রমাণ করতে পারে যে তারা এই তিনটি দেশের নাগরিক ছিলেন, ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়েছিলেন এবং তারা এই অমুসলিম? হতেই পারে যে এতদিন যা গ্রাহ্য করা হয়নি সেই সেল্ফ ডিক্লারেশন বা এফিডেভিট কে গ্রাহ্য নথি হিসেবে মেনে নিয়ে এদেরকে আপাততঃ এ দেশে থাকার অনুমতি দেওয়া হলো। তাহলেই তো অনেকগুলি বিরোধিতার জায়গা দূর হয়ে যাবে। ... ...
নৃবিজ্ঞানের জেন্ডার পঠনপাঠনের কোর্স পড়তে পড়তে নারী হিসেবে আমার মাঝে যৌন নিপীড়ন নিয়ে নানান রকমের সচেতনতা তৈরী হয়েছিলো। তারপরেও ব্যক্তি জীবনে আমি ভাবতাম যা কিছু আমার জীবনে দমনমূলক, নিপীড়নমূলক তার কারণ কোন না কোন ভাবে আমি, আমার অসাবধানতাই আমাকে উৎপীড়নের সুযোগ করে দিচ্ছে কিংবা আমি যেহেতু নারী তাই নিপীড়িত হবই। এই লালিত বোঝাপড়া সমেত আমি ধর্ষিত নারীদের নৃশংস নিপীড়ন অভিজ্ঞতা শুনতে শুরু করি। ধর্ষিত নারীদের নিপীড়ন অভিজ্ঞতার কথন শুনতে শুনতে গবেষক আমার জীবন মূল্যবোধ, ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে থাকে। সহিংসতাবিদ্ধ নারীর সাথে আমার ‘যন্ত্রণা’ বোধে মিলের জায়গা তৈরী হয়। ১৮ জন নারীর যৌন উৎপীড়ন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে করতে, লেখতে লেখতে কখনও আমি রেগে উঠি, কখনও আমার অসহায় লাগতে থাকে, আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে থাকে, আমি হাঁপিয়ে উঠি, প্রতিনিয়ত অসুস্থ বোধ করি। আমি দেখতে থাকি মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে বসবাসে অভ্যস্ত আমার আজীবন ‘নির্ভরতা আর শ্রদ্ধার’ সম্পর্কগুলো ভাঙ্গতে শুরু করেছে, আমার মধ্যবিত্ত শ্রেণীচৈতন্যের ধরে নেয়া ধারণাগুলো (আমার বাবা, ভাই তো নয়ই আমার পরিচিত কোন মানুষই ধর্ষক হতে পারে না) নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে (তারমানে কিন্তু এই নয় যে পিতা কিংবা ভাই মাত্রই ধর্ষক)। গবেষণা আমাকে এই বোঝাপড়ায় পৌঁছে দেয় যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণীভেদে নারী আসলে কেবল ‘ভোগের বস্তু’ তাই যেকোন সময়ে, যেকোন পরিসরে, যেকোন সম্পর্কে নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারে ... ...
নাকি আদতে ভাবনাটা এই যে, যে বস্তুটি আমার হাতের আওতার মধ্যে তার আবার মতামত কি? মতামত কার থাকে? যে প্রাণহীন বস্তু নয়, তারই থাকার কথা। জড় পদার্থের অবশ্য থাকে না। অবশ্য এই মতামতের বোধটা সবার এক নয়। কেউ কেউ ভাবেন যে দিনের পর দিন একটি মেয়েকে উত্যক্ত করে গেলে বা অ্যাসিড মারার ভয় দেখালে সে যখন একটি খাঁচায় পরা ইঁদুরের মত হ্যাঁ বলে সেও সম্মতি। রাজেশ খান্নারা তাই শিখিয়েছেন। কিশোরকুমাররা গানের সুরে তাকে মোলায়েম, দৃষ্টিনন্দন করেছেন মাত্র। আবার কারও কারও মনে হয় সময়বিশেষে এই মতামতের কোন দরকার নেই। আজকের দিনেও। এমনকি শিক্ষিত মানুষেরাও তাই বলেন। তাই উত্তরবঙ্গের প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়ির সামনে ধর্নায় বসে তাকে বিয়েতে বাধ্য করেন প্রেমিকপুরুষটি - তার মধ্যে কোন হিংসা দেখতে পান না অনেকেই। ... ...
তত্ত্বগতভাবে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী সমস্ত নাগরিক আইনের চোখে এক হলেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই তাত্বিক অবস্থান বাস্তব অর্থে যে ভিন্ন ছিল তা প্রমাণিত হয় সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে । মুসলমানদের যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে যে তারা এদেশীয় নন । তাদের আনুগত্য বিষয়ে সদা সন্দিহান মনোবৃত্তির ফলে ভারতের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস মুসলমানদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ***(পাদটীকা ) । ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারী অ্যাডমিনস্ট্রেসানের উচ্চ পদে মুসলমান সংখ্যা অতি নগণ্য । শিক্ষা ক্ষেত্রের উচ্চ পদে মুসলমান অবর্তমান । ভারতীয় রেলে যত সংখ্যক মুসলমান কর্মরত তার ৯৭ % চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা ঐতিহাসিক সময় থেকে হিন্দুদের তুলনায় সম্পদে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং শিক্ষায় পিছিয়ে থেকেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা ছিল জমিদার আর মুসলমানেরা রায়ত এবং ভাগচাষী । কেবলমাত্র ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ এর সময়ে অবিভক্ত বাঙলায় মুসলমান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে দাঁড় করাতে পেরেছিল । মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র এবং ব্রিটিশ প্রবর্তিত কিছু সংরক্ষণের সুবিধা ,সাথে মুসলিম লীগের রাজনীতি তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিল , কিন্তু দেশ ভাগের পরে সমস্ত প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের এবং শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের সাথে সাথে স্বাধীন সেকুলার ভারতবর্ষে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের পরিবর্তে চলে আসে জাতির ভিত্তিতে সংরক্ষণ । ... ...
আমাদের বিমানটি নামার সময় যখন এয়ারলাইন্সের কর্মীরা ঘোষণা করলেন যে যাত্রীরা মোবাইল চালু করতে পারেন, উড়ানের সমস্ত লোকজন (বেশিরভাগই কাশ্মীরী ছিলেন) বিদ্রূপের হাসিতে ফেটে পড়েন। "কী অসাধারণ রসিকতা", এই ছিল প্রতিক্রিয়া, কারণ সেই ৫ই আগস্ট থেকেই মোবাইল, ল্যান্ডলাইন ফোন আর ইন্টারনেট সবকিছু বন্ধ। শ্রীনগরে পা রাখার সাথে সাথেই আমরা একটা পার্কে কয়েকটা ছোট বাচ্চাকে খেলতে দেখলাম, শুনলাম তারা বলছে 'ইবলিশ মোদী’। ‘ইবলিশ' মানে 'শয়তান'। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত বাবদে আমরা বার বার লোকদের কাছ থেকে যে শব্দগুলি শুনছিলাম তা হ'ল 'জুলম' (নিপীড়ন), 'জ্যাদতি’(অতিরিক্ত / নিষ্ঠুরতা) এবং 'ধোকা '(বিশ্বাসঘাতকতা)। সাফাকাদালের (শ্রীনগরের কেন্দ্রে) একজন যেমন বললেন, "সরকার আমাদের কাশ্মীরিদের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করেছে, আমাদের বন্দী করে রেখে আমাদের জীবন এবং ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা তো আমাদের মাথায় বন্দুক ধরে, হাত-পা বেঁধে, জোর করে গলা দিয়ে কিছু ঢেলে দেওয়ার মতো"। ... ...
দুখানা বাঁদর। শেকল দিয়ে বাঁধা। শেকলের এক প্রান্ত আটকানো মেঝের সাথে। বাঁদরগুলো বসে আছে একখানা ছোট জানালার ওপরে। সম্ভবত জেলখানার কুঠুরি - অন্তত জানালার ধাঁচ তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাঁদরগুলো যেখানে বসে, সেই জানালায় ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু বাদামের খোলা - বাঁদরগুলো বাদাম খাচ্ছিল। আমি ছবিটা দেখছি এই জেলখানার কুঠুরির মধ্যে দাঁড়িয়ে। একখানা বাঁদর তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিষণ্ণ, সম্ভবত - অবশ্য সে আমার ভুলও হতে পারে। আরেকটি অন্যমনস্ক - মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে - আমার সাথে চোখাচোখি হতে পারছে না তেমন একটা। ... ...
‘কার আবেদনে আমি এখানে এসেছি জানেন? সুভাস চন্দ্র বসু। ১৯৩৮ সালে তিনি যখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন আবেদন করেছিলেন চিনের মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসক ভলান্টিয়ার চেয়ে। কলকাতায় আমাদের বিদায় নেওয়ার সময়ে হাত ধরে বলেছিলেন, আপনারা যাচ্ছেন এক পরাধীন দেশ থেকে আরেক পরাধীন দেশে। তাঁদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিতে। তাঁদের জানাবেন এই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক ভারতবাসী চীনাদের পাশে আছেন। আমাদের দেশও খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে। তারপর স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এশিয়ার এই বিশাল দুটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন হবে।’ অন্য চারজন ভারতীয় চিকিৎসক দেশে ফিরে গেলেন। বিদায়ের সময় নতুন চীন সরকার তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। ডাঃ কোটনিস থেকে গেলেন। তিনি যোগ দিলেন ডাঃ বেথুন আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালের প্রধান হিসাবে। ... ...
রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছিল, আনাজপাতির দাম বাড়ছিল, অটোভাড়া বাড়ছিল, চাকরির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সুমনের পুরোনো গান ভেসে আসছিল, কন্ঠ জোরে ছেড়ে খুব একটা লাভ হচ্ছিল না, কারণ আমরা হেজে গেছি। আমাদের মতো এরকম হাজার হাজার পরিবার যারা দেখেছে কিভাবে ভিড়ের মানুষ ক্রমশ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে বয়ে নিয়ে যায় উলঙ্গ রাজার পোশাক, আমরাই যারা ঝেড়েমুছে সে পোশাক পরিয়েছি বারবার রাজার গায়ে, সেইসব মানুষেরা ততদিনে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আলো আকাশের নীচে যেদিকেই হেঁটে গিয়ে তারা দাঁড়িয়েছে, তারও খানিক আগে এসে পথরোধ করেছে শস্য নয়, মাংস নয়, তাদেরই নিজস্ব ছায়া। বয়েসের তুলনায় অরুণ বড়ো হয়ে গেছিল অনেক, শুনতে পেতাম রাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ বাড়ছে, কলেজের দিনগুলো তাকে সময়ের অশনি চিহ্ন ও সংকেতগুলোর মধ্যে সমাচ্ছন্ন করে তুলছিল। মানচিত্রের গায়ে আঁকা দেশ নয়, আমাদের হৃদয়ের গভীরের দেশ পালটে যাচ্ছিল ক্রমশই। মানুষের শ্রম নয়, নিবিড়তা নয়, অন্য কোনো অন্ধকার অনুভূতিকে সম্বল করে দেশের ভেতরে এক দেশ গড়ে উঠছিল, যেখানের জল-আবহাওয়ায় আমার প্রজাতি ক্রমে দানব হয়ে যায়। ... ...
রামচন্দ্র জানতেন, এবং বুঝতেন, জম্বুদ্বীপে পাকাপাকি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে, পপুলার সাপোর্ট তাঁর দরকার। শুধুমাত্র গায়ের জোরে এই আসমুদ্র-হিমাচল দাবিয়ে রাখা বেশিদিন সম্ভব নয়। আজ লঙ্কা জয়ের দরকার হয়ে পড়েছে কারণ এই অযোধ্যাই হবে তাঁদের আর্য-সাম্রাজ্যের পরীক্ষাগার। কিন্তু দশরথ বা গৌতম মুনির মতন ওটাকেই মূল লক্ষ্য বলে রামচন্দ্র ধরে নেননি। কারণ কেউ জানুক বা না জানুক, এটা ঘটনা যে আর্যত্ব দিয়ে রামচন্দ্রের কিছু এসে যায় না। ওটা ততদিন-ই দরকার, যতদিন ক্ষমতার পক্ষে কাজ করবে। রামচন্দ্র বোঝেন ব্যবসা। ক্ষমতার ব্যবসা। যে বা যা তাঁকে ক্ষমতা এনে দেবে, তিনি তাকেই ব্যবহার করবেন। যেমন, এই মুহূর্তে, অযোধ্যার ক্ষমতায় নিজের গদি সুনিশ্চিত করতে হলে, লঙ্কা অভিযান দরকারি, আর তাই ব্যবহার্য। ... ...
রামজনমভূমি-বাবরি মসজিদ নিয়ে শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের বেঞ্চের রায়ে যা বলা হয়েছে, এই কথাটাই তো ৩০ বছর আগে বলেছিলেন এল কে আদবানি। তখনও মসজিদ ভাঙা হয়নি, ১৯৮৯ সালে তাঁর সমাধানসূত্র ছিল মসজিদকে তুলে নিয়ে গিয়ে (রিলোকেট) নতুন জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হোক, আর সেই জায়গায় মন্দির তৈরি হোক। মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পর, আদবানি একদিকে বলেছিলেন, সেদিনটা (৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২) নাকি ছিল (মাই কান্ট্রি মাই লাইফ) তাঁর জীবনের সব থেকে দুঃখের দিন। আর বলেছিলেন, ভারতে এমন কোনও রাজনৈতিক দল নেই যে দল প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারে যে তারা ক্ষমতায় এলে নতুন করে ওই খানেই বাবরি মসজিদ তৈরি করে দেবে। শনিবার, ৯ নভেম্বর, শীর্ষ আদালতের রায় শোনার পর এই কথাগুলোই মনে পড়ে গেল। ... ...
কী ঘটেছিলো সেই রাতে কুপওয়ারা জেলার এই জনবিরল গ্রামদুটিতে ? অভিযোগ করা হয়েছে, কাছাকাছি কোথাও সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে রাতের বেলা রাজপুতানা রেজিমেন্টের সামরিক উর্দিধারীরা তল্লাসির নামে ঘিরে ফেলে গোটা গ্রাম। সাধারণ আবালবৃদ্ধবনিতাকে ঘেরাও করে রেখে চালানো হয় নির্বিচার ধর্ষণ। বৃদ্ধা থেকে বালিকা প্রায় একশ কাশ্মিরী নারী এই লালসার শিকার হয়। পরবর্তীতে মেয়েরা স্বাভাবিক ট্যাবু ঝেড়ে বার বার অভিযোগ করা সত্ত্বেও সৈন্যবাহিনীর অস্বীকার করাকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হয় এবং এই অভিযোগকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ... ...
উর্মিমালা বসুকে 'কামপন্থীদের নতুন যৌনদাসী' অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। এত শুদ্ধ একটা বাংলা বানান-টানান ঠিক রেখে লেখার জন্য লেখককে অভিনন্দন। তবে কিনা লোকের কালো মনে সাদা নেই – লেখককে বা লেখকের অভাবে তাঁর পোষিত রাজনৈতিক দলকে ফুলের তোড়া পাঠানোর বদলে আমরা রেগে উঠলাম। এত অপমান! মেয়ে বলেই এসব শুনতে হবে! ... ...
তো, নেলী আমাদের সাথেই আছে, অনেক দিন ধরে আছে। নেলী, মানে নেলী নামের অঞ্চলটি, আসামের আর পাঁচটা ছোট মফস্বলের মতই। ঘন সবুজ ধানখেত, দিগন্তে মেঘালয়ের কালো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, দুএকটা জায়গায় সেগুনগাছ-ঝোপঝাড়, ব্যস্ত বাজার, দূর্গাপূজার মন্ডপ, আর জামাকাপড় থেকে বড়সড় মুসলমানদের জনসংখ্যা অনুমান করা গেল। ১৯৮৩-র দিনটিতে কী হয়েছিল তার কোনো স্মারকচিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। দিল্লী ১৯৮৪ বা গুজরাট ২০০২-হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্র ন্যূনতম বিচারের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে, তার কারণ তাদের প্রেতাত্মারা ফিরে ফিরে আসে। আর নেলী দেশের দূরের কথা, রাজ্যের রাজনীতিতেও এক বিস্মৃত অধ্যায়। গরিব, পাড়াগেঁয়ে মুসলমানরা মরেছে এরকম এক গণহত্যা কে মনে রাখে। দ্বিতীয়ত, যারা মরেছে মরেছিল অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ফলে তাদের সুবিচারের দাবি আরেকটু নড়বড়ে হয়ে যায় বইকি। দিল্লী বা গুজরাটের মৃতদের ঠিকঠাক ধর্ম ছিল না, কিন্তু তারা যে ভারতীয় নাগরিক, অনুপ্রবেশকারী নয় এই নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। তৃতীয়ত, হত্যাকান্ড ঘটেছে এক প্রান্তিক প্রদেশে, ভারতীয় মূলভূমি থেকে অনেক দূরে। তাই আমাদের জাতীয় যৌথ বিস্মৃতি ঘণ হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, নেলীর কথা কেউ শোনে না। একটি হত্যাকান্ডের পরোক্ষ বৈধতার জন্য যখন আগের একটিকে খাড়া করা হয়, নেলীর নাম তখনো আসে না। কেননা নেলীর মধ্যে পরবর্তী কোনো হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার মূল্যটুকু নেই। দেশের যৌথ স্মৃতির কাছে নেলী ঘটেইনি। ... ...
এই পুজোতে একজনের কষ্টের কথা শুনে যেন চোখের কাজলের মতো আরো ঘোরা কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গেলেন দেবী। তার সঙ্গে আমার আলাপ তো বেশি দিনের নয়। তার গায়ের রঙ কুমারী গাছের ছায়ার মতো, বসন্তের শুরুতে যার ঝাঁকড়া মাথা জুড়ে নতুন পাতার রঙ হয় টকটকে লাল। সে মেয়ের চোখেমুখে কষ্টের কালি। স্বামী সন্তান ঘর, সব সে খেইয়ে লিয়েছে গ্য। সে এক আস্ত ডাইন। পিনাকী মিত্র বললো অন্য মানুষের পুজোর গল্প চাই, তাইতে আমার মনে পড়ল ফুলকুমারি মেঝেনের কথা। পুরুলিয়ার ফুলকুমারি। তার হাত ধরে গল্প করার সময় একবারও তো মনে হয়নি সে নাকি এক সব-খাওয়া ডাইন, যার নামে তার গ্রাম তো গ্রাম, আশেপাশের গ্রামগুলিও ভয়ে কাঁপে। ... ...