এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    দলমার কোলে কোলে - জাদুগোড়া - নরেশ জানা | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়জাদুগোড়াআমরা এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরা যেমন কেন্দাডি পাহাড়টার মাথায় একটা শিবের মন্দির গড়ে তার নাম সিদ্ধেশ্বর পাহাড় করে দিয়েছি তেমনি জাদুগুড়া কিংবা জাদুগড়াকে জাদুগোড়া করে দিয়েছি। এক সময় এই জাদুগুড়া ছিল বন্য হাতিদের আদি বাসস্থান। হাতিদের বাসস্থান অর্থেই জায়গাটার নাম জাদুগুড়া। এই জাদুগুড়া আসলে ঝাড়খণ্ডের যাকে বলে সোনার খনি। আমরা যখন কলকাতার দিক থেকে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করছি তখন বহড়াগুড়ার কাছাকাছি এলাকা থেকে প্রথমে বাঁহাতি তারপর ডানহাতি দুটি পাহাড়শ্রেণী দেখতে পাই। আসলে এই গোটাটাই দলমা পাহাড়শ্রেণী বা দলমা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ঝাড়খন্ড প্রবেশের মুখটায় এই দলমা যেন অনেকটা হাঁ করে আমাদের প্রবেশের জায়গা করে দিচ্ছে। ধলভূমগড় থেকে আমরা সেই হাঁ-এর ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। ঘাটশিলা থেকে গালুডি হয়ে জামসেদপুর আমরা সেই হাঁ-এর ভেতরেই থাকছি। ডানদিকের ঠোঁটটা উঁচু হয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে ধরে রেখেছে আর বাঁদিকের পাহাড়গুলো নিচের ঠোঁটের মতই একটু ঝুলে পড়া। আমাদের এতক্ষন বর্ণিত এলাকাগুলি যার মধ্যে এই জাদুগুড়াও রয়েছে তা ওই নিচের অংশে। এই অংশটি নিচু কিন্তু সর্বাধিক খনি সমৃদ্ধ আর জাদুগুড়াকে ঘিরেই রয়েছে সেই সব একের পর এক খনি। ঝাড়খণ্ডের সমৃদ্ধশালী খনিজ ভান্ডার। এই খনিজ সম্পদকে ঘিরেই এখানে মানুষজনের বাড়বাড়ন্ত হতে লাগল। বন্য হাতিরা তখন সরে গেল উত্তরের উঁচু পাহাড়ে, দলমার উতুঙ্গু শিখরে আরও গভীরতর জঙ্গলে।এটাও যেমন একটা ট্রাজেডি তেমন আরও একটা ট্র্যাজেডি আছে। গুনগুন আমাদের যে কথাটা বলেছিল সেই হাই রেডিয়েশনের কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। সরকার একথা যদিও স্বীকার করেনা কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠান দাবি করে আসছে ভটিন এবং নারোয়া পাহাড় থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম শোধনের পর যে বর্জ্য 'টেইলিং পন্ডে' সংরক্ষিত হয় তার মাশুল দিতে হচ্ছে এলাকার সাধারণ মানুষকে। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এমনটা দাবি করা হয়। সরকার অস্বীকার করলেও ইউরেনিয়াম বিচ্ছুরনের প্রভাবকে অস্বীকার করব কী করে? সব মিলিয়ে এটাই জাদুগুড়ার ট্রাজেডি।যাইহোক আদার ব্যাপারী জাহাজের ব্যাপারে নাক গলাই কেন? বেড়ানোর কথাই বলি, দুপুর দুটো পনের নাগাদ নারোয়া ছেড়েছিলাম ঘটাশিলার ফুলডুংরি মোড়ে পৌঁছালম প্রায় তিনটা। পেটে ছুঁচোর লম্বা দৌড় শুরু হয়েছে। অতদুপুরে হোটেলে খাবার খুঁজে পেতে একসা হতে হল। এদিক ওদিক খানিকটা তেল পুড়ল গাড়ির। অবশেষে হোটেল মিলল। যে যার মত রুটি, ভাত ইত্যাদি খেয়ে নিলাম। গাড়িতে আমরা প্রায় ১৫ লিটার জল নিয়েছিলাম। সেটা এখন শেষের মুখে। এবার গন্তব্য বুরুডি। এখানে বলে রাখা ভালো, যদি কেউ চান তবে জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলডুংরি টিলায় চড়তে পারেন। এখান থেকে শুয়ে থাকা সুবর্ণরেখা নদী সহ পুরো ঘাটশিলা শহরটা দেখা যায়, মায় গালুডি ড্যাম অবধি। আমরা আর উঠলাম না, নারোয়া থেকে ফেরার পথে যে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছিল তা এখনও ধরাই আছে বটে কিন্তু ঈশানে ঘনিয়ে আসছে আরও একটা মেঘ। মনে হচ্ছে এখুনি ঘাড়ে এসে পড়বে। সুতরাং আর দেরি না করে রওনা দিলাম বুরুডির পথে। পাহাড়ে চড়ার একটা প্ল্যান আমার ছকাই আছে সেটা কারুরই কাছে ভাঙলামনা। ফুলডুংরি থেকে জাতীয় সড়কের রিলিফ রোড ধরে একটু এগিয়ে কাশিদা থেকে গাড়ি বাঁয়ে মুড়ল। ঝিলমিল গুগল ট্র্যাকিংয়ে চোখ রেখে জানালো যে হোটেলটায় আমরা খেলাম সেই 'ধাবা রেন বাসেরা'র গা দিয়েই বুরুডি যাওয়ার একটা রাস্তা ছিল কিন্তু আমরা কাশিদার মোড় থেকেই বাঁয়ে মোড় নিলাম। মহালিডি আর চেংগজোড়া পেরিয়ে পূর্ণাপানির কাছে সেই রাস্তাটা আমাদের রাস্তায় মিশে গেল। ধনওয়ানী পেরিয়ে বুরুডি পৌঁছানো অবধি মাথার ওপর মস্ত মেঘটা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলল, ভারী না হলেও সে কিন্তু মাঝে মধ্যেই জল ঝরাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য ঠিক ভিতরগড় বা বুরুডি ঢোকার মুখে মেঘটা ফেটে সরে গেল! এই রাস্তাটা মাত্র বাইশ তেইশ মিনিটের হওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু বৃষ্টি আর সেই গাড়িটা আমাদের ডোবালো সাড়ে সাত কিলোমিটারের রাস্তা খেয়ে নিল প্রায় ৪০ মিনিট। বুরুডি লেকের কাছে এসেও জোর ধাক্কা খেলাম! সার সার দিয়ে সুদৃশ্য টেন্ট টাঙিয়ে, চেয়ার টেবিল বিছিয়ে লেকের পাড়েই লাঞ্চ, টিফিন আর ডিনারের মস্ত আয়োজন। অন্ততঃ গোটা দশেক টেন্ট। কমল হোটেল, গণেশ হোটেল, কুর্মি এন্ড কুর্বি চিকেন, নায়েক হোটেল, মুরাহির ক্যাফেটেরিয়া, গণপতি রেস্টুরেন্ট। দেখে শুনে রুষতি হায় হায় করে উঠলেন, "ইস্, এখানেই তো খেতে পারতাম আমরা! কী সুন্দর গুলি মুরগীর ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া যেত!" খড়গপুর ছাড়িয়ে গুপ্তমনির যে ধাবায় আমরা খেয়েছিলাম সেই ধাবার খাটিয়ার নীচে বেশ কয়েকটা দেশি মোরগ দেখেছিলাম। বললে ওরা রান্না করে দেয়, ২২০টাকা প্লেট, ৬ পিস! সেই থেকে গুলি মুরগি যেন পেয়ে বসেছে ওঁকে। কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই। 'ধাবা রেন বাসেরা'র তন্দুরি রোটি, চিকেন, মিক্সড ভেজ আর চায়ে আমাদের পেট ঠাসা। তাছাড়া বছর ২০ আগে আমি যখন বুরুডি এসেছিলাম তখন এখানে মাথা খুঁড়েও খাবার জায়গা পাইনি। এখানে যে এত খাবার জায়গা গজিয়েছে জানব কী করে?যদিও গুলি মুরগীর ঝোল খাওয়ার ইচ্ছাটা শুধু যে রুষতিরই এমনটা নয়। পূর্ণাপানি পেরিয়ে যে সঙ্কীর্ণ রাস্তায় আমাদের গাড়িটা পাক খেল তার পাশের ক্ষেতে চরে বেড়াচ্ছিল বেশ কয়েকটা মোরগ। রিয়ান বলছিল, 'দাদা, একটাকে ধরে ফেলুন তো!' গ্রাম বলেই নয়, এখানে মোরগ যেন সর্বত্রই। 'ধাবা রেন বাসেরা'র আগে আমরা প্রথম যে হোটেলটায় খেতে নেমেছিলাম জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষে সেই হোটেলটাও যথেষ্ট অভিজাত বলেই মনে হয়েছিল। হোটেলটার নাম সম্ভবতঃ 'ধোসা ধাবা', খাবার পাইনি বটে কিন্তু তার চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বেশ কয়েকটা মোরগ। এখানকার মোরগ গুলো একটু অদ্ভুত, লেজ গুলো নিচের দিকে নামানো। রুষতি বললেন, বন মোরগের জাত। না, বন মোরগ এখানে মেলেনা। আমি জানি তার রহস্য, দু'দশক আগে সে মোরগ আমাকে খাইয়েছিলেন গোপীনাথ মাহাত। দলমার ওপারে কাঁকড়াঝোরের গোপীনাথ মাহাত আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চিত তাঁর মাহাত হোটেলে রুষতি, রিয়ানদের বনমোরগ খাওয়াতে পারতাম। কিন্ত সে কথা এখন থাক।বুরুডি ছুঁলাম পাক্কা বিকাল পাঁচটায়। ওপরে মেঘের চাদর থাকলেও দিনের আলো পাওয়া গেল যথেষ্ট। গাড়ি থেকে তরতরিয়ে নিচের দিকে নামলাম। হঠাৎ দেখলাম শতদল নেই। এই ক'দিন বৃষ্টি হলেও আদতে চলতি মরসুমে সবমিলিয়ে বৃষ্টির পরিমান যথেষ্ট কম। হ্রদের ভেতর জলের পরিমান ১০ ভাগের এক ভাগ। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন যে এটি একটি কৃত্তিম হ্রদ। সামনের দিকটা বুরুডি, পেছনে বাঘমুড়ি। সেই বাঘমুড়ি পাহাড়ের তলদেশে হ্রদটা। বাঘমুড়ি পাহাড়টা যেন দুহাত আঁকড় করে হ্রদটাকে ধরে রেখেছে। একসময় জমা হওয়া জলরাশি বাঘমুড়ির সেই আঁকড় করা দুটি হাতের ডান হাতটির তলা দিয়ে গলে গিয়ে বুরুডিকে পাক খেয়ে নিচে নামত। কিন্তু সেই সঙ্কীর্ণ জায়গাটি বর্তমানে বেঁধে ফেলা হয়েছে কংক্রিটের মস্ত একটা বাঁধ তৈরি করে। কাজটা করা হয়েছিল ইংরেজ আমলে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে হ্রদের জল উঠলে সেই জল গড়িয়ে নামে বুরুডির গা বেয়ে। এছাড়া একটি মাত্র স্লুইস গেট রয়েছে যেখান থেকে প্রয়োজন মত চাষের জন্য জল ছাড়া যায়। শতদলকে শেষ অবধি পাওয়া গেল। বুরুডির ডানদিক ঘেঁষে কেঁদডাঙ্গার গা ঘেঁষে হ্রদে নেমে আসছিল সে। হাতে স্নাইফারের মতই ক্যামেরা, ক্লিক ক্লিক শব্দ উঠছিল। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ল এক শীর্ণ কীর্ণ কায়া। ট্যুরিষ্টদের ছায়া এড়িয়ে অতি সন্তর্পণে বঁড়শি এড়ে বসে রয়েছে সে। ছিপের চেয়েও যেন রোগাসেই বৃদ্ধের চেহারা। সারা বিশ্ব নিয়ে যেন কোনও মাথা ব্যাথাই নেই তার। তাবৎ আগ্রহ তার ফাৎনার দিকে। সেদিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। আমার মনে পড়ে গেল বানোয়ারি লাল পাটোয়ারীর কথা। লবটুলিয়া বইহারের ইজারাদারের কর্মচারী সত্যচরনকে কী এরই কাছ থেকে মাছ জোগাড় করে দিত পাটোয়ারী?রিয়ান দু'মাস আগেই আরন্যক পড়েছে। তার স্মৃতিতে ঝকঝক করছে লবটুলিয়া বইহার। জাদুগুড়া থেকে বুরুডি সে যেন লাবটুলিয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমার ঠিক পেছনেই বসেছিল সে। রাস্তার দুধারে লাগানো নতুন আম জাম কাঁঠালের চারায় সে পাচ্ছিল যুগলপ্রসাদের ছবি। চেংজোড়ার ক্ষেতের পাশে বৃষ্টির মধ্যেও এক বৃদ্ধ গরু চড়াচ্ছিলেন। রিয়ান বলে উঠল, ওই দেখুন দাদা দবরু পান্না! আমি হেসে উঠলাম। ধনওয়ানীতে আমাদের রাস্তা পেরিয়ে গেল দুটি মস্ত মোষ, রিয়ান যেন আপন মনে বলে উঠলো, টাঁড় বাড়ো !' আরন্যক স্রষ্ঠা যাদের বলেছেন, বুনো মহিষের দেবতা। সবমিলয়ে আমার, সাগরিকার সবারই মনে বোধহয় সংক্রমিত হয়ে গেছে লবটুলিয়া। শতদলের তোলা ছবির সেই রোগা লিকলিকে বৃদ্ধও যেন লবটুলিয়া বইহারের কোনও হত দরিদ্র প্রজা। এ এলাকায় প্রায় সব কিছুর এলাকার পাশেই একটা করে ডি থাকে। যার অর্থ ডিহি বা উঁচু জায়গা। সেই অর্থে বুরুডি হল দেবতাদের ডিহি বা বাসস্থান। সাঁওতালি ভাষায় বুরু অর্থ দেবতা। ওঁদের সবচেয়ে বড় দেবতা মারাংবুরু। শুনে রিয়ান বলল, ঠিক বলেছেন দাদা, বুরুডি হল সেই হ্রদ যেখানে দেবতারা চান করতে আসে। আমি বুঝলাম রিয়ান সরস্বতী কুণ্ডীর কথা বলছে। যেখানে মায়াবিনী বনদেবীরা গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নারাতে হ্রদের জলে জলকেলি করতে নামে। মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের আমিন রঘুবর প্রসাদ সত্যচরনকে সরস্বতী কুণ্ডীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিল, 'ওটা আসলে মায়ার কুণ্ডী, ওখানে রাত্রে হুরী-পরীরা নামে; জ্যোৎস্নারাত্রে তারা কাপড় খুলে রাখে ডাঙায় ঐ সব পাথরের উপর, রেখে জলে নামে। সে-সময় যে তাদের দেখতে পায়, তাকে ভুলিয়ে জলে নামিয়ে ডুবিয়ে মারে।' আমার সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। রুষতি এরই মধ্যে বুরুডি ড্যামের স্লুইসগেটের সামনের উঁচু পৈঠাটায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। পৈঠাটা বিপজ্জনক ভাবে ড্যামের নিচে ঝুলে রয়েছে। ওর যেন খেয়াল নেই ওদিকে। বুরুডির সৌন্দর্য ভুলিয়ে দিয়েছে বিপদের কথা। হলুদ ডোরাকাটা বাঘের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত মযুরী যেমন তারই দিকে এগিয়ে আসা খাদক বাঘের থেকে আসা বিপদ ভুলে যায়। রুষতি হ্রদের ছবি তুলছেন। ঠিক তখুনি বাঁদিকের পাহাড়টার মাথায় মেঘ ছিঁড়ে সূর্য উঁকি দিল। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল বাঘমুড়ি পাহাড়টার ছায়া পড়েছে হ্রদের জলে। পাহাড় ও জলের ছায়া মিলে তৈরি হয়েছে একটা পুরুষ্টু ঠোঁট! ঝিলমিল আর রাগিনী হেঁটে যাচ্ছিল ডানদিক ঘেঁষে। রাগিনীকে দেখে মনে হল দোবরু পান্না বীরবর্দীর সূর্যবংশীয় কন্যা হেঁটে যাচ্ছে। গ্রীবা উঁচু করে উঁচু করে বুরুডির ভিতর গড়ে পেরিয়ে যাচ্ছে রাজকন্যা ভানুমতি। বিভূতিভূষণ এই অঞ্চলকে নিয়েই আরন্যক লিখেছিলেন কিনা জানার প্রয়োজন মনে করিনা। আমি যেখানে দোবরু পান্না, ভানুমতি, যুগলপ্রসাদ আর টাঁড়বাড়োকে খুঁজে পাই সেই আমার আরন্যক, সেই আমার লাবটুলিয়া বইহার। তাছাড়া লাবটুলিয়া থেকে দোবরু পান্নার রাজত্বে যাওয়ার পথে বিভূতিভূষন এক জায়গায় বলছেন, "দুইটি বন্য গ্রাম ছাড়াইয়া আসিয়াছি-একটার নাম কুলপাল, একটার নাম বুরুডি!"বুরুডি ছাড়তে সন্ধ্যা ছ'টা বাজল। আবার আকাশে মেঘ ভেঙে পড়ার উপক্রম। বন্ধু আশিস মিশ্র বলেছিলেন, বুরুডির কোল বেয়ে পেছন দিকের একটা গ্রামে গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে। পথটা আমার চেনা। ওই রাস্তায় সাত কিলোমিটার গেলেই ধারা জলপ্রপাত। অসাধারন সেই দৃশ্য, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কিন্তু এই দুর্যোগ আর এই সময়ে সেই পথে যাওয়া চলেনা। অন্তত দু কিলোমিটার পথ ট্রেকিং করতে হবে কিন্তু বাকী পাঁচ কিলোমিটার পথও এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এ যাত্রায় আমার আফসোস বর্ষায় ধারা প্রপাত দেখা হবেনা। সাগরিকা বিপাশাদের গুলি মুরগির ঝোল খাওয়া ছাড়াও অবশ্য আরও কিছু আফসোস যে থেকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম পরের দিন। তার অন্যতম হল পাথরের গহনা কেনা হলনা। ধারাগিরি জলপ্রপাত অধরা রেখেই আমরা হোটেলে ফিরছি, শুরুর দিনের যাত্রা শেষ করে এই প্রথম হোটেলে যাব আমরা। সেই পথেই বরং বলে নেওয়া যাক আমার কুড়ি বছর আগের ধারা জলপ্রপাত ও বুরুডি দর্শনের কাহিনী। যাঁরা বাংলা থেকে সরাসরি বুরুডি আসতে চান তাঁদের জন্য এই রুটটাও যথেষ্ট মনোরমের।ক্রমশ...
    রবীন্দ্রনাথ - বেবী সাউ | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়অথচ, সেভাবে পাওয়া হলো না আপনাকে! যৌবন যখন শৈশব থেকে কৈশোরে ছুটে গেলপ্রৌঢ়ত্বের আকাশে ঘনিয়ে এলগোধূলি এগোতে এগোতে এক দীর্ঘ গভীর আফসোসের রেখা টানতে টানতে আপনার দিকে ছুটে গেছি বারবার...প্রেমে প্রত্যাখানে বিচ্ছেদেআদরে শিক্ষায় অশিক্ষায় কলঙ্কে অপমানে সম্মানেঅসম্মানে রাতের কান্নায় সকালের ঘাসফুলেসুন্দর যখন সুন্দরের চেয়েও সুন্দরএবং যাপন যখন একাকী অজান্তে, আপনি থেকে কখন যে তুমি'তুমি' হয়ে গেছ!কখন যে এ মন, এ সত্ত্বাএই অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব বোধ তোমাকে উপাস্য ভেবে সখা ভেবে আনন্দ ভেবে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া পতঙ্গের মতো জড়িয়ে ধরেছে মুক্ত করেছে আকাশের দিকে শেকল ছিঁড়ে মাটির উপরভেসে গেছে বাতাসের মতো সহস্র অপমানেও সহজ থাকতে থাকতেমরতে মরতে মরতে মরতেবাঁচিয়ে দিয়েছ তুমি চোখের জলে ধুয়ে নিয়ে শিখিয়েছ আবার চোখের জলে ধন্য হতে আমার শ্রান্তি, ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছ বিচ্ছেদ, বিরহ আমি শূন্য হয়ে গেছিশুরুর থেকেই শুরু করেছি শেষ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি শেষে তোমার জন্য ঠাকুরসাহেবমুখ তুলে চেয়েছি আজযেমন প্রথম শিশুর চোখমুখ তুলে দাঁড়িয়ে একাকীত্বময় জীবনের একেকটি অন্দরমহল খুঁজতে গিয়েখুঁজে পেয়েছি নির্জন এক সৈকতআমার হাতের পোড়া দাগে চোখের নীচে বিষাদের অন্ধকারে উপাখ্যানের কাছে লোককথার মতোনত হয়ে আছি শুধুপ্রেমে কেননা, এত দুঃখের ভেতর দিয়ে না পুড়লে আমার মনকিছুতেই তোমাকে পেত না কিছুতেই তোমার গানের কাছে বাড়িয়ে দিত না সাহস কিছুতেই বুঝতে পারত না অতীত এবং আগামীকে ছেড়েক্ষণিকের জন্যও কীভাবে বেঁচে নেওয়া যায়! কীভাবে অসংখ্য কবরস্থান সরিয়ে শ্মশানের ছাই ঘেঁটে বের করে আনা যায় স্নিগ্ধ মধুর এক জ্যোতিকেআলোয় আলোয় ভরে যায়রাতের বালিশ অপমানের ছুরি আমার কাটা দাগনোনা ঘামুগ্ধ চোখে তোমাকে ভাবিতোমাকে দেখিচেয়ে থাকিআর ভাবিএবং ভাবি... কেন চেয়ে আছ গো মা ! নিপুণ তুমি নিষ্ঠুরনিজেকে সরিয়ে নিলে আমার কাছ থেকে স্পর্শসুখ থেকে রাতের গভীর একাকীত্ব থেকে... এই কান্নাএই বোধ এই সৌন্দর্যএই প্রেম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ? শুধু, শূন্য এক খেয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে শূন্য হয়ে যাওয়া ছাড়া! কীভাবে পূর্ণ হবযদি এভাবে অপূর্ণ না-ই হই?
    কী আমাদের জাত আর ধর্মই বা কী! - প্রতিভা সরকার | এটি কোনো বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়তথাকথিত নীচু জাতের নারীর সঙ্গে তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের জাত কী হবে সুপ্রিম কোর্টে এইরকম একটি কেস উঠেছিল(civil appeal no 654 of 2012, decided o January 18, 2012)সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশনের একটি অনুবাদ নীচে রইল।ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ যদি আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীর মধ্যে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, সন্তান পিতার কাস্টেই পরিচিত হবে।১ এই ধরে নেওয়াটা জোরদার হয়, যদি এইরকম বিয়েতে পুরুষটি উঁচু জাতের হয়। কিন্তু এই ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত হিসেবে কখনই অপরিবর্তনীয় নয়। এইরকম বিয়ের সন্তানের প্রমাণ করার স্বাধীনতা থাকবে যে সে শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইবের মায়ের দ্বারা আজন্ম পোষিত হয়েছে। উঁচু জাতের পিতার সন্তান হয়ে সে জীবনে কোনো সুযোগ সুবিধেই পায়নি, উপরন্তু বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছে, যেমনটি তার মায়ের কাস্টের লোকেরা হয়ে থাকে। তাছাড়াও সন্তানটি মায়ের কাস্টের লোকেদের দ্বারা তাদেরই একজন বলে বিবেচিত হয়েছে এবং সেই কাস্টের বাইরের লোকেরাও তার সম্বন্ধে একইরকম ভেবেছে।এই কেসে এপেল্যান্টের ট্রাইবাল সার্টিফিকেট কেড়ে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র সে ক্ষত্রিয় পিতার ঔরসজাত বলে।এই কারণে হাই কোর্টের এবং স্ক্রুটিনি কমিটির রায় যুক্তিযুক্ত নয়। এইজন্য স্ক্রুটিনি কমিটির কাছে দু-পক্ষের প্রমাণ খতিয়ে দেখে নতুন সিদ্ধান্তের (fresh decision) জন্য কেসটি আবার পাঠানো হল।এক মেধাবী ছেলে, মাথায় ইট বয়ে, রাজমিস্ত্রির কাজ করে জেনেরাল কোটায় সুযোগ পেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিল। মনুবাদী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বিরোধ বাধায় তাকে এবং আরও দুজনকে সাতমাস ধরে স্টাইপেন্ড বন্ধ করে রাখা হয়, যা ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। শুধু তাই নয়, হস্টেল থেকেও বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছতলায় ধরনায় বসেছিল তারা অনেকদিন। কেউ ফিরেও দেখেনি।এত অপমান আর কষ্ট যে কারও জীবনকে অর্থহীন করে দেয়। মেধাবী ছেলেটি আত্মহত্যা করে। তার সুইসাইড নোট সবাই পড়েছে। যে হতে চেয়েছিল নক্ষত্রের সন্তান, তাকে হতে হয় অর্থহীন ভষ্ম। ছেলেটির মা ছিল দলিত সম্প্রদায়ের হতদরিদ্র। সন্তানদের জন্ম দিয়েই খালাস ওবিসি পিতা তাকে ত্যাগ করে। ছেলেটির মা সিংগল মাদার হয়ে দলিত গ্রামে বাচ্চাটিকে বড় করে। জেলা প্রশাসন দলিতের সার্টিফিকেট দেয়। আজ আদালতের রায়ে বলা হচ্ছে ছেলেটি দলিত ছিল না। তখনকার ভিসি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবাই বেকসুর খালাস! কংগ্রেস আমলে এই রায় বার হওয়া খুবই বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। দলিতরা বিরুদ্ধে চলে যাবে। কিন্তু এ মামলা আজকের নয়। সাত বছর ধরে চলেছে, কিন্তু রায় বেরোয়নি। আজ চার পাঁচমাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেল।২ রোহিত ভেমুলা নাকি দলিতই ছিল না। জাল সার্টিফিকেট যোগাড় করে সে পড়াশুনা করেছিল, তাই ভয়ে আত্মহত্যা করেছিল! সে যে জেনেরাল কোটায় সর্বত্র সুযোগ পেত, তার কাস্ট সার্টিফিকেটের দরকার পড়েনি, এটাও মহামান্য আদালত নিশ্চয়ই বিবেচনা করেছেন। তার মৃত্যুর আগে যেসব তার ওপর যেসব অত্যাচার হয়েছিল, (তখন কেউ কাস্টের কথাই তোলেনি) তাও বিবেচিত হয়েছে নিশ্চয়ই। যারা বলে দলিত না হলে দলিতদের নিয়ে লেখালেখি করা যাবে না, তাদের জয় হোক! বিচার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের জয় হোক!১ https://bit.ly/44yTUfN২ https://bit.ly/3QBdhz4
  • হরিদাস পালেরা...
    সৎ পাত্র  - ARUPRATAN MUKHERJEE | সৎ পাত্র: রাজনীতি এতো নীচে বোধহয় কখনো নামেনি।আপনি অদৃশ্য। তুইতোকারি চলছে। তুই চোর তো তোর বাবা চোর।কুর্তাও পরাচ্ছে আবার কাঁকড়ের লাড্ডুও খাওয়াচ্ছে।পাবলিকের চড় খাচ্ছে  তবুও খিলখিল করে হাসছে। চড় খাওয়ায় তো কেউকেউ হ্যাট্রিকই করে ফেললো।যোগ্যতা? ঐ সুকুমার রায় যা বলেছিলেন, '১৯টি বার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে'।আর বিষয়-আসয় ? প্রায়  সবাই কয়েক- কোটিপতি। কারুর কারুর আবার কিটব্যাগে  ক্রিমিনাল রেকর্ড। জেলখাটাতো এখন এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন।সবাই প্রধানমন্ত্রী  হবার যোগ্য ! উপপ্রধান, সহপ্রধান নৈব নৈব চ। সবারই মন্ত্রী লগ্নে জন্ম !জনগণের সেবা করার প্রবল আকুতিতে কারুর নাক ফেটে রক্ত পড়ছে তো কারুর জামার হাতা উড়ে যাচ্ছে। তাতে কি? কুছ পরোয়া নেই। উঠেই আবার ছুট। আম জনতার সেবায় 'আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান তারি লাগি তাড়াতাড়ি '।জনতাই জনার্দন !আদর্শ ফাদর্শ লোপাট ! এখন শুধুই পাটিগণিত। কতোর সঙ্গে কতো যোগ করলে কতো হয়। কতো হলে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা যায়। উপসী জনগণের সেবা করতে হবে না! এই সৎ পাত্রের দল শুধু হিসেব নিপুনই নয়, হিসেব নির্মমও ! পাটিগণিত কষে এরা একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, সুযোগ বুঝে পরস্পরের পিঠ চুলকে দিচ্ছে, কখনো নখ কেটে কখনো নখ না কেটে !!
    তোমার বাস কোথা যে… - Nirmalya Nag | নির্মাল্য নাগ  ।। এক ।।  [ মাঝের কথা ] সরু একটা পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটছে বিনীতা। তার ডান দিকে বরফ আর কুয়াসায় মোড়া উঁচু পাহাড় উঠে গেছে সোজা আকাশের দিকে, আর বাঁ দিকে অতলস্পর্শী খাদ। খুব সাবধানে পা ফেলছে বিনীতা, তবুও পাথরে মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার আট বছর বয়সী মেয়ে রঙিন দিব্যি আসছে, কোনও অসুবিধেই নেই, যেন রাজপথে হাঁটছে। হঠাৎই বিনীতা দেখল খাদটা চলে এসেছে ডানদিকে আর পাহাড়টা বাঁদিকে। মেয়েকে সাবধান করতে ঘুরে দেখে তার কোনও হেলদোল নেই। যেমন আসছিল তেমনি আসছে। এদিকে খাদ ফের ফিরে গেছে বাঁদিকে -  কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না বিনীতা। ক্রমশঃ সরু হচ্ছে রাস্তা। একটা হোঁচট খেয়ে পাহাড়ের গায়ে ডান হাত রেখে টাল সামলাতে গেল বিনীতা। ততক্ষণে পাহাড় চলে এসেছে বাঁদিকে। ব্যালান্স হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বিনীতা দেখতে পেল মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর মেয়ের পিছনে যেন একজন কেউ এসে দাঁড়াল, ওর হাতটা ধরল।…ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিনীতার। কি বিশ্রী স্বপ্ন। দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডবল বেড খাটের ও পাশটা খালি। অসুস্থ স্বামী শুয়ে ছিল ওখানে, বিছানা আর বালিশে তার পরিস্কার ছাপ। অ্যাটাচড টয়লেটের দিকে তাকিয়ে বিনীতা দেখল দরজা বন্ধ। আবার একা একা বাথরুমে গেছে, ডাকেনি ওকে। বিরক্ত হল বিনীতা; বারণ করলেও শোনে না। খাট ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকের জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিল সে। সেপ্টেম্বর গোড়ার দিকের ভোরবেলার আলো ঘরে ঢুকে এল। আর ক’দিন পরে এই সময়ে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগবে। বাইরে সোজা তাকালে যেদিকটা চোখে পড়ে, সেদিকে তিন কিলোমিটার মত গেলেই কুসুমবনি কয়লা খনি, তার কাজ-পাগল স্বামী অরুণাভ দাস যেখানকার অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার। আর ডানদিকে তের-চোদ্দ কিলোমিটার দূরে বোকারো শহর। সেখানকার হাসপাতালে কিছু দিন আগে অপারেশন হয়েছে অরুণাভর।মোবাইল ফোনটা চার্জে দেওয়া ছিল; সেটার সুইচ বন্ধ করল বিনীতা। বেডরুম থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের ভেজানো দরজায় ঠেলা দিল। সে ঘরে খাটের ওপর ঘুমোচ্ছে রঙিন, আর মাটিতে বিছানা করে শুয়ে আছে কাজের মহিলা বিসপাতিয়া।“উঠে পড়ো, বিসপাতিয়া। ছ’টা বাজে।” কাজের লোককে ডেকে দিয়ে ওপাশের ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় বিনীতা। ফেরার পথে দেখল বিছানা তুলছে বিসপাতিয়া। বেডরুমে ঢুকে দেখে তখনও টয়লেটের দরজা বন্ধ। বারান্দার দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি আছে, মানে অরুণাভ টয়লেটেই আছে।এতক্ষণ তো থাকে না বাথরুমে। বিনীতা ভ্রু কুঁচকে মাথা নেড়ে দরজার সামনে যায়।“আবার একা একা বাথরুমে গেছ?” জিজ্ঞাসা করে বিনীতা; কোন সাড়া পায় না ভেতর থেকে। ফের জিজ্ঞাসা করে, “দেরি হবে?”তাও কোনও উত্তর নেই। কী ব্যাপার? দরজায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীতা বুঝল সেটা ভেতর থেকে বন্ধ নেই; যাক, এই কথাটা অন্তত শুনেছে। আর একটু চাপ দিতে দরজাটা পুরো খুলে গেল। ভেতরে কেউ নেই। বিস্মিত বিনীতা দ্রুত পায়ে ঘরের বাইরে গিয়ে গেস্টরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন সব ঘুরে দেখে। কোথাও নেই অরুণাভ। কী ভেবে ফের যায় মেয়ের ঘরে, সেখানে রঙিন ঘুমোচ্ছে, আর কেউ নেই।বাইরের ঘরের দিকে ছুটে যাওয়ার পথে ঝাড়ু হাতে বিসপাতিয়াকে দেখা যায়। “সাব-জীকে দেখেছ?”মালকিনের এমন প্রশ্নে অবাক হয় বিসপাতিয়া। “না তো, কেন ঘরে নেই?”উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় বিনীতা, বিসপাতিয়াও আসে পেছন পেছন। সদর দরজার পাল্লা ভেজানো রয়েছে, আগেরবার যখন এই ঘরে এসেছিল তখন এটা খেয়াল করেনি। দরজা খুলে দেখল বাগানেও নেই অরুণাভ। বাইরের গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায় বিনীতা, একটু দূরে মিস্টার আর মিসেস আগরওয়াল মর্নিং ওয়াক করছেন, আর অন্য দিকটায় একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে, তবে সে কখনই অরুণাভ নয়। গ্যারাজে গিয়ে দেখল গাড়িটা রয়েছে।“ভাবি, একটা ফোন করে দেখ,” বিসপাতিয়া বলে, সেও বুঝে গেছে সাব-জী বাড়িতে নেই।ঠিকই বলেছে, ভাবে বিনীতা। তবে মোবাইল তো শোয়ার ঘরে। ড্রইং রুম থেকেই ল্যান্ডলাইনে অরুণাভর মোবাইলে ফোন করে। সঙ্গে সঙ্গে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে একটা গোঁগোঁ শব্দ পাওয়া যায়। ভাইব্রেশন মোডে রাখা মোবাইলের আওয়াজ।“এই যে,” আঙুল দিয়ে দেখায় বিসপাতিয়া, “এই খানে।” ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ওদিকে তাকায় বিনীতা। তিন-চারটে বই-এর আড়ালে রয়েছে মোবাইলটা, এইবার দেখতে পায় সে। আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ে আরও একটা জিনিস।পাওলো কোয়েলহো-র ‘দ্য জাহির’ বইটা থেকে উঁকি মারছে একটা সাদা কাগজের খানিকটা অংশ। কী ওটা? কাঁপা হাতে বইটা তুলে অর্ধেক ভাঁজ করা কাগজটা বার করে সে… একটা চিঠি… তাকে লেখা অরুণাভর চিঠি। খুব বড় চিঠি নয়, পড়ে ফেলতে সময় লাগে না। সোফার ওপর বসে পড়ে বিনীতা। ফের চোখ বোলায় হাতের কাগজটার দিকে।বিসপাতিয়া জিজ্ঞেস করে, “কী ওটা? সাব-জীর চিঠি?”উত্তর দেয় না বিনীতা, দ্রুত চিন্তা করতে থাকে সে। এখন কী করনীয়? তার ভাবার জন্য সময় চাই, পরামর্শ চাই। মনস্থির করে ফেলে সে।“রঙিনকে ডাকো, বিসপাতিয়া। স্কুলের জন্য রেডি করো,” সোফা থেকে উঠে পড়ে বিনীতা। শোওয়ার ঘরের দিকে এগোয়।“ভাবি… সাবজী?…”বিসপাতিয়ার প্রশ্নে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায় বিনীতা। “বেরিয়ে গেছে… অফিসের কাজে। রঙিনকে ডাকো; ছটা বেজে গেছে, দেরি হয়ে যাবে।”বেড রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও করে না সে। মোবাইলটা খুলে নেয় প্লাগ থেকে। একটা ফোন করে, কিছুক্ষণ সময় লাগে ওপারের লোকের ফোনটা ধরতে।“সরি, ভোরবেলা ঘুম ভাঙালাম… একটা ব্যাপার হয়েছে... না, শরীর না। ও নেই... মানে কোথাও চলে গেছে, বোধহয় ভোর রাতে, একটা চিঠি রেখে গেছে... সে সব কিছু লেখেনি, একবার আসা যাবে?... স্কুলে পাঠাচ্ছি… ঠিক আছে।” ফোন শেষ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিনীতা। চট করে বিছানাটা তুলতে গিয়ে দেখতে পায় তোষকের নিচে অরুণাভর ওয়ালেটটা নেই। পাশের ছোট টেবিলের ওপর ওষুধপত্রগুলো সবই রাখা আছে। নিশ্বাস ফেলে মেয়ের ঘরের দিকে এগোয় সে, ওকে রেডি করতে হবে। বিসপাতিয়া বরং ওর খাবারের ব্যাপারটা দেখুক। এই সবের জন্য আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পরে স্কুল ড্রেস পড়া রঙিন আর বিনীতা বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে। রঙিনের পিঠে ব্যাগ, কাঁধে জলের বোতল। বাসের জন্য অপেক্ষা চলছে। বাসটা কি আজ দেরি করছে আসতে?“বাবা এত সকালে কোথায় গেল?” জিজ্ঞাসা করল রঙিন।“বললাম যে আজ সকাল সকাল কাজে বেড়িয়েছে।... ওই তো বাস আসছে... যাও… টা টা,” বলল বিনীতা।মা-কে টা টা করে বাসে উঠে পড়ে রঙিন। বিনীতা দরজার কাছ থেকে ফিরে সোফায় বসে। আজ সকালে চা খাওয়া হয়নি। এখন চা-বিস্কুট এনে দেয় বিসপাতিয়া। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভাবিকে তার কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সাহস হল না।রান্নাঘরে ফিরে গেল সে; চায়ে চুমুক দিল। ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে তার মোটা বুদ্ধিতে কোনও ব্যাখ্যাই পাচ্ছে না সে। রঙিন যখন এইটুকু ছিল, তখন থেকে এই বাড়িতে কাজ করছে সে। গায়ত্রী ভাবি তাকে এনে দিয়েছিল এখানে। সাব-জী এত সকালে কোনও দিন বেরিয়ে যান না; এটাও পরিস্কার যে ভাবি জানত না উনি বেরোবেন। ভাবির ঘুম খুব গাঢ়, বুঝতে পারেনি কখন উনি চলে গেছেন। ওই কাগজটা নিশ্চয় চিঠি; কিন্তু চিঠি লিখলেন কেন? মোবাইল নিয়ে যাননি কেন? গাড়িটাও রয়েছে কেন? সাব-জীর অফিস যাওয়ার ব্যাগটাও যে যথা স্থানেই রয়েছে সেটাও চোখ এড়ায়নি তার। ভাবি সত্যি কথা বলছে না। সাব-জী তো সারাক্ষণই অফিসের কাজ নিয়ে থাকেন; তবে এখন তিনি কাজে যাননি, এটা নিশ্চিত। কোথায় গেলেন অসুস্থ মানুষটা? এই তো ক’দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এলেন। ফিরবেন তো?বাইরের ঘরে বিনীতার কাপ নিতে এসে বিসপাতিয়া দেখল এক চুমুকও খাওয়া হয়নি তার থেকে, ঠান্ডা হয়ে গেছে লাল চা। মিইয়ে গেছে বিস্কুট। ভাবি যেমন বসেছিল তেমন ভাবেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বয়সে নিজের চেয়ে কিছুটা ছোট ভাবির জন্য খারাপ লাগল বিসপাতিয়ার। ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি কাপের দিকে হাত বাড়াল বিনীতা।“ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার করে এনে দিচ্ছি। একটু দাঁড়াও।” বিসপাতিয়া কাপ তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।“বিসপাতিয়া।” ভাবির ডাকে দাঁড়িয়ে গেল সে। “সাব-জী আজ ভোর বেলা চলে গেছেন। কোথায় গেছেন জানি না, বলে যাননি কিছু। রঙিনকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলব।” কথাগুলো সোজা সামনে তাকিয়েই বলল বিনীতা, বিসপাতিয়ার দিকে না তাকিয়েই।“কবে ফিরবেন?”“জানি না,” একটু সময় চুপ করে থাকল বিনীতা, এবার দিরে তাকাল ওর দিকে। “চা দেবে বললে যে।” কাপ ডিশ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরল বিসপাতিয়া। যা ভেবেছিল তাই, বড় ব্যাপার কিছু একটা হয়েছে।বাইরের ঘরে বিনীতার মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরল সে, ওপাশের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “কতক্ষণ লাগবে? ... আচ্ছা, ঠিক আছে।”ফোনটা সেন্টার টেবিলে রাখতে গিয়ে অরুণাভর মোবাইলটা দেখতে পেল বিনীতা। তারপরই সেই ‘দ্য জাহির’ বইটা যার মধ্যে চিঠিটা ছিল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে চিঠিটা রেখেছে সে। স্বামীর কাছ থেকে প্রথম, আর হয়তো বা শেষ, চিঠি। বইটা তুলে ফরফর করে পাতাগুলো উলটে গেল বিনীতা। আর কিছু নেই বই-এর ভেতরে। তবে বিনীতার মনের ভেতরে ভাংচুর হচ্ছে অনেক কিছু। (ক্রমশঃ)
    ভোটুৎসবে ভাট - যাকগে চলবে - সমরেশ মুখার্জী | হুজুগের ফিকির      দেখতে দেখতে এসে গেল বৈশাখ। ওড়িশার সুন্দরগড়ে গ্ৰীষ্মকালে গরম ভালো‌‌ই পড়ে। তবে অনেক প্রাচীন বড় বড় গাছপালা ও  ফাঁকা জায়গা থাকায় সৌমেন‌দের এলাকায় তখনো বিশেষ গরম লাগে না। পঁচিশে বৈশাখের তখন‌ও এক হপ্তা বাকি, এক রবিবার সন্ধ্যায় সৌমেনদের বাড়িতে তাসের আড্ডায় সুদীপ প্রস্তাব দেয়, 'চলুন বৌদি, আমরা এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি।'      কবিতা আবৃত্তি, গীতিনাট্য, রবীন্দ্রসংগীত ইত‍্যাদিতে রমেনের বিশেষ আগ্ৰহ নেই। তবে সুন্দরগড়ে‌র মতো শান্ত জায়গায়, নিস্তরঙ্গ জীবনে একটু আনন্দ উচ্ছ্বাস করার হুজুগের গন্ধ পেয়ে রমেন‌ও বলে, 'হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ, বেশ হবে। তাহলে আপনাদের ছাদেই হোক। আপনাদের বাড়ি‌টা একানে, ছাদটা‌ও বেশ বড়। কিছু লোকজন, বাচ্ছাদের জমায়েতে হৈচৈ হবেই, তবে আপনাদের বাড়ি‌ওয়ালা‌ও বাঙ্গালী, মনে হয় আপত্তি করবেন না। তাহলে ছাদে লাইটিং করার দায়িত্ব আমার।'      মৌমিতা হাসে, 'তোমরা বাড়ি‌র কর্তার মত না নিয়ে নিজেরাই সব ঠিক করে ফেললে যে। এই যে কর্তামশাই, আপনি কিছু বলুন।'     সুদীপ হেসে বলে, 'সৌমেন‌দা আবার কী বলবেন? আমরা কী ভুলে গেছি কদিন আগে দোলের দিন কী হোলো। রঙ না মাখানো‌র খুব শর্ত টর্ত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সৌমেন‌দাই তো দেবীবৌদিকে কষে রঙ মাখিয়ে দিলো মাথায় ঝড়াস করে ঢেলে এক বালতি জল। এবার‌ও হয়তো প্রথমে না, না, করে পরে দেখবো ওনার‌ই উৎসাহ সব থেকে বেশি।'    সৌমেন মুচকি মুচকি হাসে। ভুল বলেনি ছোঁড়া। বলে, 'তা বেশ তো, হোক না। তবে রবীন্দ্র‌জয়ন্তী শুনলেই আমার মৌয়ের ঠাকুর্দার ঘটনা‌টা মনে পড়ে।' যাকগে চলবে    শুনেই মৌমিতা‌ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে সুদীপ, রমেন দুজনে‌ই উদগ্ৰীব। চারজনে তাস খেলা হচ্ছিল শোয়ার ঘরে বড় খাটে বসে। রমেন হাতের তাস বিছানায় উল্টে রেখে ওর পেটেন্ট 'ওওও মুখার্জী‌দা‌আআআ' আওয়াজ ছেড়ে বলে,  'কী রকম, কীরকম। বলুন তো শুনি।'   সৌমেন বলে, 'শিবপুরে মৌয়ের ঠাকুর্দার চেম্বারের সামনে‌ ছিল একটা মাঝারি সাইজের খেলার মাঠ। ছিল মানে, এখন‌ও সে মাঠ আছে। কেবল  ঠাকুর্দা মারা যেতে সে চেম্বার‌ উঠে গেছে। ঐ মাঠটা ছিল একটা শরিকী জমি। বেদখল হ‌য়ে বারোয়ারী হয়ে গেছে। ওখানেই হয় শিবপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব। ছেলেরা বিকেলে ফুটবল পেটায়। স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলন হয়, এইসব হয় ওখানে। একবার তোমাদের মতো ওখানকার কয়েকটি কিশোরের মাথায় এসেছিল রবীন্দ্র‌জয়ন্তী করার। সেই মতো বেদী করা হয়েছে। নির্দিষ্ট দিন সকালে ফুল, মালা, ধূপ সব হাজির। কেবল কবিগুরুর ফটো নিয়ে যার আসার কথা, সেই বেপাত্তা।"   সুদীপ বলে ফ‍্যালে, 'যাঃ, তারপর?'- ঠাকুর্দা‌র চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা‌রত পেশেন্টের জন‍্য কক্ষে গুটিকয় চেয়ার ও একপাশে বড় একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। কারুর শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ার জন‍্য। তার ওপরে দেয়ালে সার দিয়ে টাঙানো ছিল কয়েকজন মনীষীর ছবি। নেতাজী, গান্ধী‌জী, বিবেকানন্দ ইত‍্যাদি। পাড়ার একটি কিশোর এসে বলে, 'জেঠু একটা ফটো নিয়ে যাচ্ছি। একটু বাদে ফেরৎ দিয়ে যাবো।' চেনা ছেলে, তাই রোগী দেখা‌র মাঝে ঠাকুর্দা অন‍্যমনস্ক হয়ে‌ বলেন, 'ঠিক আছে নিয়ে যা, দেখিস, পাড়তে গিয়ে ফেলে ভাঙিস না যেন।'     রমেন বলে, 'ছেলেটা স্মার্ট আছে বলতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্ল‍্যান বি ছকে ফেলেছে।'    সৌমেন গম্ভীর মুখে বলছে কিন্তু মৌমিতা থেকে থেকে হেসে ফেলছে বলে ওরা কিঞ্চিৎ দিশেহারা। এতে হাসির কী হোলো! মৌ রমেনকে বলে, 'শেষ অবধি শোনো‌ই না কী হয়।'    সৌমেন বলে, 'ঘন্টা‌ দুয়েক বাদে, তখন কোনো পেশেন্ট নেই, ঠাকুর্দা একটু আড়মোড়া ভাঙতে চেম্বার ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে‌ছেন। দেখলেন ঐ ছেলেটা ফটোটা ফেরৎ দিতে আসছে। ডাক্তারীর ব‍্যস্ততায় ওনার মনেই ছিল না সেদিন রবীন্দ্র‌জয়ন্তী। ছেলেটাকে ফটো হাতে আসতে দেখে ঠাকুর্দার মনে পড়ে, তাইতো, কেন নিয়ে গেছিল সেটাই তো জানা হয়নি। তাই বললেন, 'হ‍্যাঁ‌রে, তো কী রাজকম্ম হোলো ফটো দিয়ে?'    সুদীপের আর তর স‌ইছে না। নড়েচড়ে বসে।   সৌমেন ভাবলেশহীন মুখে বলে, 'ছেলেটা বলে, 'জেঠু আজ আমরা রবীন্দ্র‌জয়ন্তী পালন করলাম। যার ফটো নিয়ে আসার কথা ছিল সে আসেনি বলে আপনার চেম্বার থেকে এটা নিয়ে গেছিলাম।' ঠাকুর্দা আঁতকে উঠে বলেন, 'বলিস কী রে!' ছেলেটা ভেবলে গিয়ে বলে, 'কেন? কী হোলো?'    মৌ এবার ফুলে ফুলে হাসছে। রমেন‌ বলে, 'এতে ওনার আঁতকে ওঠা‌র কী হোলো?' সুদীপ মাঝে মাঝে বোকার মতো তাকাচ্ছে হাস‍্যরতা মৌমিতার দিকে।   সৌমেন নির্বিকার মুখে ডেলিভারি দেয় ক্লাইম্যাক্স, 'ঠাকুর্দা কপাল চাপড়ে বলেন, 'ওরে হতভাগা, এটা তো ঋষি অরবিন্দ‌র ছবি! ওখানে তো রবীন্দ্রনাথের ফটো‌ ছিল‌‌ই না!'   এবার রমেন ও সুদীপ‌ও ভ‍্যাক করে হেসে ফেলেছে। মৌমিতা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে হাসতে হাসতে হাত ইশারায় জানায়, ক্লাইম্যাক্সের এখোনো কিছুটা বাকি।  সৌমেন বলে, 'ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে, 'এ্যাঁ, তাই নাকি! এঃ হে, তাহলে তো খুব ভুল হয়ে গেছে। তাই কে একজন বললো, ছবিটা তো ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতো লাগছে না। তাতে আবার বিমল বিজ্ঞের মতো বললো, এটা ওনার অল্পবয়সে‌র ছবি। যাকগে চলবে। পরের বার খেয়াল রাখতে হবে।'     এবার আর রমেন, সুদীপের হাসি থামতে‌ই চায় না। রমেন খাটে চাপড় মেরে মেরে হাসছে আর বলছে, ' কী বললো ছেলেটা? যাকগে চলবে?'    সৌমেন বলে, 'আমি তো তাও ঠিকমতো বলতে পারলাম না। প্রথমবার বাপী এটা এমন ক‍্যারিকেচার করে রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন যে শুনে আমার‌ও তোমাদের মতোই অবস্থা হয়েছিল। তাই বলছি, দেখো, তোমরা‌ও যেন এরকম কিছু কেলোর কীর্তি ক‍রে ফেলো না।'
  • জনতার খেরোর খাতা...
    জীবন তরঙ্গ - ২০ - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ২০দুজনেরই বেশ কয়েকদিন অফিস কামাই হয়ে গেল। রণজয়ের ছুটি পাওনা আছে, তেমন একটা সমস্যা নেই। রাশির চাকরি তো এক বছরও হয়নি। বসেরা ভাল, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছে। বাবা বাড়ি চলে এসেছে, আর অযথা কামাই করার কোন অর্থ হয় না। দুজনে একসাথেই অফিসে বেরোয়, ফেরে আলাদা আলাদা সময়ে। অফিস যাওয়ার পথে বাবার খবর নিতে রাশিকে নিয়ে রণজয় নিজেদের বাড়িতে গেল। কণিকা জানালেন যে কত্তাবাবু ঠিকঠাকই আছেন আর ছেলেকে অতিশীঘ্র তাঁর সাথে দেখা করতে বলেছেন। একটা কিছু নাকি হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।রণজয় জিজ্ঞেস করল—বেশ তো ছিল, আবার কি হল?-- সে তোদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, এলেই জানতে পারবি।মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখে রণজয়ের মনে হল না তেমন কোন সিরিয়াস ব্যাপার।-- দিদিরা কি চলে গেছে?-- হ্যাঁ, একদম সকালেই চলে গেছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে, মাকে টাটা করে দুজনে স্টেশনের দিকে পা বাড়াল।কণিকা ওষুধ খাওয়াতে ঘরে ঢুকতেই দিগ্বিজয় জিজ্ঞেস করলেন—ছেলেকে এখানে আসার জন্য খবর দিয়েছ?-- দিয়েছি।-- তাও রাসকেলটা এল না!-- ভুলে যেওনা, ওরা দুজনেই চাকরি করে। তোমার শরীর খারাপের জন্য অনেকদিন অফিস কামাই করেছে। আজ জয়েন করবে। অফিস থেকে ফিরে হয়ত আসবে।-- আবার হয়ত কেন?-- কখন ফেরে তার ওপর নির্ভর করছে। ফিরতে বেশিদেরি হলে কাল আসবে। অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই, আসবে যখন বলেছে, ঠিক আসবে।রাত নটার কিছু পরে রণজয় এল।-- কিরে খোকা, এত রাত করে এলি?-- এই তো একটু আগে অফিস থেকে ফিরলাম। ক’দিন যাইনি, প্রচুর কাজ জমে ছিল।-- রাশি এল না?-- রাশির কথা তো তুমি বলনি। তুমি বললে বাবা কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবে। বাপ ব্যাটার এই হেস্তনেস্তর মাঝে ওই মেয়েটাকে এনে আর কষ্ট দিই কেন।-- সেই একরোখা মানুষটা এখন অনেক পাল্টে গেছে রে। কথা বললেই বুঝতে পারবি। অনেকবার তুই এসেছিস কিনা জিজ্ঞেস করেছে। যা, দেখা করে আয়।-- বাবার রাতের খাওয়া হয়ে গেছে?-- এই একটু আগে হল।-- একটু আগে কেন? ডাক্তার তো রাতে আটটার মধ্যে খেয়ে নিতে বলেছে।-- অনেক আগে থেকেই খাওয়ার জন্য বলছি, খেলে তো। বলছে, “এখন টিফিন করার সময়। সন্ধেবেলা কেউ ডিনার করে!”-- না না, এখন নিজের মর্জি মত চললে হবে না। ডাক্তার যেমন বলেছে তেমন ভাবেই চলতে হবে। ওদিকে গিয়ে দেখি কি জন্য ডাক পড়েছে। বাবার কাছে যেতেই ভয় লাগছে। অসুস্থ মানুষ, হেস্তনেস্ত করতে গিয়ে ক্ষেপে উঠলে আবার শরীরটা খারাপ হবে।-- খোকা নিশ্চিন্তে যা। আমি বলছি, কোন ভয় নেই।মা আশ্বাস দিলেও একটু ভয়ে ভয়েই রণজয় বাবার ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল—বাবা কেমন আছ?-- বস। আসতে এত দেরি হল?-- অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে।-- ক’দিন তোমাদের বিশেষ করে তোমায়, খুব ঝামেলায় ফেলেছিলাম। শুনলাম দিনরাত নার্সিং হোমেই কাটাতে। তার মানে খাওয়া দাওয়া তো কিছুই হত না!-- না না, নার্সিং হোমে ভাল ক্যান্টিন আছে, ওখানেই খেতাম।-- তোমাদের চেষ্টায় আরো কিছুদিন রয়ে গেলাম। মনে হয় প্রস্থানের সময় এখনও হয়নি। কতদিন বাদে তোমার দর্শন পেলাম। তোমার মায়ের কাছে শুনলাম যে, তোমাকে দেখলে যদি আমি রেগে যাই, এই ভয়ে নাকি তুমি আমার সাথে দেখা করনি। বড্ড তালেবর হয়ে গেছ। লেখাপড়াই শিখেছ, বোধ বুদ্ধির কোন বিকাশ হয়নি। মা বাপের কাছে সন্তানের থেকে বড় পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সন্তানের জন্য মা বাবার চিন্তা ভাবনায় ভুল ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু তা সব সময় সন্তানের মঙ্গল কামনাই করে। নার্সিং হোমে ভিজিটিং আওয়ারে তোমাকে দেখার জন্য হাঁ করে বসে থাকতাম। ভাবতাম, যতই রাগ, দুঃখ বা অভিমান থাক, অসুস্থ বাবাকে দেখতে ছেলে আমার ঠিক আসবে। তুমি আসনি,আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।-- সরি বাবা, আমার অনুমানে ভুল ছিল।-- এবার যে কারণে তোমাদের ডেকেছি সেটা বলি। তার আগে বৌমাকে ডাক, ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।-- সে তো আসেনি। আসার কথাও নয়, তোমার আদেশে তার তো এই বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ।-- কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়াই সে এই বাড়িতে এসেছিল। শুধু এসেছে যে তাই নয়, যতদূর জানি, কয়েকদিন থেকেও গেছে।-- বিশেষ প্রয়োজনে থাকতে হয়েছে।-- এ ব্যাপারে আমি তোমার সাথে কোন কথা বলব না, বৌমার সাথে কথা বলতে চাই। কাল রবিবার অফিস যাওয়ার ব্যাপার নেই। সকালবেলা বৌমাকে সাথে করে আমার কাছে নিয়ে আসবে। এখন রাত হয়ে গেছে, বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া কর।বেরোবার আগে রনজয় মার সাথে দেখা করল।-- কি রে খোকা, বাবা কি বলল?-- এমনি তো সব ঠিকঠাকই বলছিল কিন্তু কথা শুনে মনে হল, রাশির এই বাড়িতে থাকাটা বোধহয় বাবার পছন্দ হয়নি। রাশিকে কাল আনতে বলে বলল যে, এই ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলবে।-- তুই নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। আর শোন, সকালে এখানে এসে জলখাবার খাবি।রণজয় বাসায় গিয়ে রাশিকে বাবার এত্তেলার কথা জানাল। রাশি শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।-- একথা ঠিক যে বাবার অনুমতি ছাড়া আমার তোমাদের বাড়িতে ঢোকা উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমি তো গিয়েছিলাম মাকে একটু সঙ্গ দিতে। এতে যদি বাবা আমার ওপর রাগ করে থাকেন, ক্ষমা চেয়ে নেব।-- তোমার অত চিন্তার কিছু নেই। আমি তো সঙ্গে থাকব।ছুটির দিন, ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে দুজনে রওনা হল দিগ্বিজয় ধামের উদ্দেশ্যে।দিগ্বিজয় বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। দোতলা থেকে ছেলে আর বৌমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে খুব আনন্দ হল।শাশুড়ির কাছে গিয়ে রাশি জিজ্ঞেস করল—মা, বাবা কি আমার ওপর খুব রেগে আছেন?কণিকা মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন যে মেয়েটা বেশ ঘাবড়ে রয়েছে।ব্যাপারটা সাসপেন্সে রেখে বৌমাকে আদর করে বললেন—চলো আমার সাথে, দেখাই যাক না কি বলে মানুষটা।কণিকা রাশিকে নিয়ে দিগ্বিজয়্বের ঘরের দিকে গেলেন, রণজয়ও পিছন পিছন গেল। দিগ্বিজয় তখনো বারান্দাতেই বসে ছিলেন। রাশি গিয়ে শ্বশুর মশাইকে প্রনাম করল। দিগ্বিজয় আশীর্বাদ করে পাশে চেয়ারে বসতে বললেন। মেয়েটাকে দেখে মন ভরে গেল। কি মিষ্টি লক্ষ্মীমন্ত চেহারা। ভেতরের অনুভুতি ক্ষণিকের জন্য চেপে রেখে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন—আমার অনুপস্থিতিতে তুমি এই বাড়িতে এসে ছিলে?-- হ্যাঁ বাবা। মা বড় ভেঙে পড়েছিলেন। বাড়িতে একা থাকবেন, তাই ওনাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ছিলাম। কোন অপরাধ করে থাকলে মার্জনা করবেন।-- থাকার কারণ আমি জানতে চাইনি। কারণ যাই হোক না কেন, আমার নিষেধ অমান্য করেছ, এটাই বড় কথা। এর জন্য তুমি আমার কাছে কি আশা কর?রণজয় দেখতে পাচ্ছে বাবা আবার তাঁর পুরনো স্বভাবে ফিরে যাচ্ছেন। গত কালের আচরণের সাথে এখনকার আচরণের বিস্তর ফারাক। সকলেই চুপ।একটু সময় নিয়ে রাশি বলল— আপনি যা বলবেন তাই মেনে নেব।-- মানতে তোমাকে হবেই, এটা আমার আদেশ।রণজয়ের আর ধৈর্য থাকছে না, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছে। এভাবে চললে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা সম্ভব হবে না।-- বলুন আমাকে কি করতে হবে?-- কালকে বা সম্ভব হলে আজকেই, তুমি, তোমার ওই তালেবর বরটিকে নিয়ে এই বাড়িতে পাকাপাকিভাবে চলে আসবে।রাশি ছলছল চোখে বলল—বাবা তার মানে আপনি আমাদের মার্জনা করে দিয়েছেন?-- মার্জনা করবার জন্য আমি তোমায় ডাকিনি। তোমরা কোন অপরাধ করনি, ভুল আমি করেছি। আমার কৃতকর্মের জন্য তোমরা অনেক ব্যথা পেয়েছ, দুঃখ প্রকাশের আমার কোন ভাষা নেই। পারলে বুড়ো বাপটাকেদিগ্বিজয় মাথা নিচু করে বসে রইলেন।রাশি দিগ্বিজয়ের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল—বাবা, আপনি গুরুজন, ওভাবে বলবেন না। আমার খুব খারাপ লাগছে।এবার রণজয় নিশ্চিত হল যে, বাবা সত্যিই পাল্টে গেছে।দিগ্বিজয় নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন—তাহলে ওই কথাই রইল, কালকেই ভাড়া বাড়ির পাট চুকিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসবে।-- বাবা, বাড়িওয়ালাকে দশ মাসের অ্যাডভানস দেওয়া আছে। এখনই বাড়ি ছেড়ে দিলে টাকাটা মার যাবে।-- মার যায় যাক। টাকার জন্য খুব যদি কষ্ট হয় তাহলে এখনই বাড়ি ছেড় না। জিনিসপত্র যেমন আছে থাক, তোমরা চলে এস। মাঝে মাঝে লোক নিয়ে গিয়ে বাড়িটা একটু ঝাড়পোঁছ করিয়ে নিও। কাল সকালেই আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব, সঙ্গে করে যদি কিছু জিনিস আনার থাকে নিয়ে এস।রণজয় আর রাশির কাছে এ বড় কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। রজতের মামার বাড়ির সংখ্যা আবার একে ফিরে এল। চলবে
    জীবন তরঙ্গ - ১৯  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ১৯রাতে শোয়াটা এখনো একঘরেই আছে। পরিবর্তিত পরিবেশ, পরিস্থিতির প্রভাব দৈনন্দিন যাপনের অনেক ক্ষেত্রে পড়লেও বিছানা এখোনো একটাই আছে। বেডরুমের লাগোয়া একটা অ্যান্টি চেম্বারের মত আছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রোজ প্রায় ঘন্টা খানেক দিগ্বিজয় ওই ঘরে বসে ওকালতির কাজকর্ম করেন। কণিকা খাওয়ার পর টুকটাক কাজকর্ম সেরে, একটু টিভি দেখে তারপর ঘরে আসেন। দুজনে প্রায় একই সময়ে শুতে যান। সেদিন টিভি দেখতে ইচ্ছে করছিল না। নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগেই শুতে এসে কণিকা দেখেন যে ঘরে বড় আলো নেভান, রাতের আলো জ্বলছে। তাঁর স্বামী ইতিমধ্যেই শুয়ে পড়েছেন। এমনটা সচরাচর হয় না। ভাবলেন হয়ত খুব ক্লান্ত হয়ে আছেন বা হয়ত কাল কোর্টে তেমন একটা কাজ নেই। উনিও শুয়ে পড়লেন। মাঝরাতে একটা গোঙানির আওয়াজে কণিকার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখেন ওনার স্বামী বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন। কণিকার মনে হল হয়ত কোন দুঃস্বপ্ন দেখে অমন করেছেন। গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—কিগো, ওরকম করছ কেন, কি হয়েছে?-- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ডাক্তারকে খবর দাও।কণিকা খুব নার্ভাস হয়ে পড়লেন। রাতে ওনাদের বাড়িতে একজন পাহারাদার থাকে। এ ছাড়াও দিনরাতের কাজের একটা মেয়েও থাকত। কণিকা দুজনকেই ঘুম থেকে তুলে ছেলেকে ডেকে আনতে বলল। রণজয়ের বাড়ি ওখান থেকে মিনিট পাঁচেকের মত হাঁটা পথ। এত রাতে মা যখন ডেকে পাঠিয়েছে তখন বাবার শরীর নিশ্চই বেশিরকমের খারাপ। দৌড়ে গিয়ে ওদের হাউস ফিজিসিয়ান সরকার কাকুকে বগলদাবা করে নিয়ে এল। দরকার হতে পারে তাই রণজয় দুজন বন্ধুকেও সাথে আনল। ডাক্তার সরকার সব দেখে শুনে জানালেন যে, বাড়িতে রাখার কেস নয়। একটা ওষুধ তখনই কিনে এনে খাইয়ে দিতে বললেন। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। কপাল ভাল, বাড়ির সামনের ওষুধের দোকানটা খোলা ছিল। ওষুধ খাওয়াবার পর সকলে ধরাধরি করে দিগ্বিজয়কে বাড়ির গাড়িতে এনে শুইয়ে দিল। রণজয় গাড়ি চালাতে পারত, কালক্ষেপ না করে রওনা দিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রণজয় গাড়ি ভালই চালাতে পারে, কিন্তু এত জোরে কখনো ড্রাইভ করেনি। মধ্য রাত, রাস্তা ফাঁকা ছিল, অসুবিধে হয়নি। গড়িয়াহাট অঞ্চলের একটা বড় নারসিং হোমে দিগ্বিজয়কে ভর্তি করা হল। সারা রাত রণজয় আর তার দুই বন্ধু নারসিং হোমেই কাটাল। সকালবেলা বড় ডাক্তারবাবু জানালেন—পেশেন্টের মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখন আইসিসিইউ তে অবজারবেশনের জন্য রাখা হয়েছে, কন্ডিশন স্টেবল। আপাতত ভয়ের কিছু নেই। ঠিক সময়ে এখানে এসেছেন, বেশি দেরি করলে বিপদ বাড়ত। আপনাদের লোকাল ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ধাক্কাটা অনেকটাই সামলে দিয়েছে। ওরা বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসতে পারে কি না জিজ্ঞেস করাতে ডাক্তারবাবু বললেন-স্বচ্ছন্দে পারেন, এখন আপনাদের থাকার প্রয়োজন নেই। যাওয়ার আগে অফিসে গিয়ে যোগাযোগের জন্য আপনাদের একটা ফোন নম্বর দিয়ে যাবেন।রণজয় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এল। বাড়ি ফিরে রাশিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের বাড়ি গেল। হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে শোনা আশ্বাস মাকে শুনিয়ে আশ্বস্ত করল। রাশিকে দেখেই কণিকা ওকে কাছে টেনে নিলেন। রণজয় মাকে জানিয়ে দিল যে বাবা যতদিন বাড়ি না ফেরে রাশি তাঁর কাছেই থাকবে। রাশি ক’দিন অফিস যাবে না। কণিকা রাশিকে জড়িয়ে ধরে বললেন—এটাই তোর নিজের জায়গা মা। আমি বলছি, একদিন তুই নিজের জোরেই মাথা উঁচু করে এই বাড়িতে আসবি। আর হ্যাঁরে খোকা, তুই এখানে থাকবি না।-- অনুমতি করলে থাকতে অসুবিধে নেই, তবে বাবা বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত। বাবা ফিরে এলে সব আবার সে আগের মতন। আর একটা কথা তোমায় জানিয়ে রাখি। এই মুহূর্তে বাবার সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন কিছু হওয়াটা একেবারেই কাম্য নয়। আমাকে সামনে দেখলে বাবার কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানি না। তাই আমি রোজই হাসপাতালে যাব কিন্তু বাবার সামনে যাব না। বাবার কাছে তুমি বা দিদি যাবে।-- তোকে যদি দেখতে চায়, তখন কি হবে?-- আমাকে দেখতে চাইলে দেখা করব।বাবার শরীর খারাপের খবর পেয়ে বাণী রজতের সাথে পরের দিনই চলে এসেছিল। দিন দুয়েক বাদে বিকাশও শিলিগুড়ি থেকে চলে এসেছিল। দ্বিতীয় দিন রণজয় বোন আর মাকে নার্সিং হোমে নিয়ে গেল। দিগ্বিজয় তখন অনেকটাই সামলে উঠেছেন। আইসিসিইউ থেকে বার করে কেবিনে রাখা হয়েছে। আর কেউ এসেছে কিনা জানতে চাইলেন। কণিকা বুঝতে পারলেন যে, ঘুরিয়ে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছে। কণিকা ছেলের কথায় মিথ্যে বলেছিলেন। একদিন রজতও দাদুকে দেখতে এসেছিল। নাতিকে দেখে দাদু আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। পাঁচ দিন বাদে দিগ্বিজয়ের হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গেল। ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল তবু রণজয় ডাক্তারের কাছে গিয়ে সবকিছু আর একবার ভাল করে জেনে নিল। রণজয়ের সাথে বিকাশ, বাণী আর দুজন বন্ধু এসেছিল। বাড়ির দুটো গাড়িই নার্সিং হোমে আনা হয়েছিল। দিগ্বিজয়ের গাড়ি চালাবে বাড়ির ড্রাইভার, সঙ্গে থাকবে বিকাশ আর বাণী। অন্য গাড়িটা রণজয় চালাবে, সাথে থাকবে দুই বন্ধু। নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়ে দিগ্বিজয়্বর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। আরো ভাল লাগছে দূরে সরে যাওয়া অতি আপনারজনদের কাছে ফিরে পেয়ে। গাড়িতে মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। বাণী নিজের বাবাকে ঠিক মেলাতে পারছে না। এতদিন মানুষটাকে একজন গম্ভীর, স্বল্পবাক, ডিক্টেটর হিসেবেই দেখে এসেছে। আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। বিকাশ ডাক্তারের নিষেধের কথা জানিয়ে শ্বশুর মাশাইকে কম কথা বলতে বলল। কত্তাবাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে সকলেই খুশি, সবথেকে বেশিখুশি কত্তাবাবু নিজে। দিগ্বিজয়ের ঘরে মেয়ে, জামাই, নাতি, বৌ, সকলে বসে গল্প করছে। মাঝেমাঝে ডাক্তারের নিষেধ অমান্য করে দিগ্বিজয়ও তাতে যোগ দিচ্ছেন। এই বাড়িতে এমন ছবি আগে কেউ কখনো দেখেনি।রাতে একান্তে কনিকাকে বললেন—আমার কাছের মানুষেরা সকলেই এল, প্রতিদিন নার্সিং হোমে গিয়ে খোঁজ খবর নিল, কেবল আমার সব থেকে কাছের মানুষটাই নার্সিং হোমে পৌঁছে দেওয়ার পর আর একবারও খোঁজ নিতে এল না।-- তুমি কার কথা বলছ?-- তোমার ওই রাসকেল ছেলেটার কথা বলছি।-- অমন ছেলে লোকে ভাগ্য করে পায়, কেবল তুমিই ওকে চিনলে না। ও প্রতিদিন নার্সিং হোমে গেছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন থেকেছে। ডাক্তারের সাথে আলাপ আলোচনা করেছে। প্রথম দুটো রাতও নার্সিং হোমে কাটিয়েছে। এই সময় কোন রকম উত্তেজনা তোমার শরীরের পক্ষে ভাল নয়। ওকে দেখলে যদি তুমি রেগে যাও তাই ও তোমার সামনে যায়নি।-- ভিজিটিং আওয়ার্সে ছেলেটাকে একটু দেখতে পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। অন্যদের সাথে কথা বলার ফাঁকে চোখ চলে যেত দরজার দিকে, এই বোধহয় খোকা এল। অপেক্ষাই সার হল, বুঝতে পারলাম, বাপের ওপর থেকে অভিমান তার এখনও যায়নি। অসুস্থ বাপটার ওপরে তখনো অভিমান করে আছে মনে হতে খুব কষ্ট হয়েছিল। গাধাটা কিনা আমি রাগ করব বলে সামনে এল না। এই বুদ্ধি নিয়ে ও আলাদা হয়ে সংসার করবে।-- আর একটা কথাও তোমাকে জানিয়ে রাখি। তুমি যে কটা দিন নার্সিং হোমে ছিলে, আমাকে আগলে রেখেছিল আমার বৌমা। কিচ্ছুটি করতে দেয়নি। রান্না করা থেকে আমাকে খাওয়ানো সব কিছু নিজে করেছে। কেবল আমাকেই নয়, তোমার মেয়ে জামাইকেও সাধ্যমত সেবাযত্ন করেছে। জানি না, অনুমতি ছাড়া এ বাড়িতে ক’দিন ছিল বলে তোমার আবার মেজাজ বিগড়বে কিনা।-- গিন্নি, অসুস্থ মানুষটাকে আর রগড়িও না। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। আমিও করেছি, আমার মাত্রাটা হয়ত একটু বেশি। একমাত্র খোকা ছাড়া আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমরা কখনো যাওনি। আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বা করলে বরদাস্ত করতে পারতাম না। খোকার বিয়ের ঘটনার পর থেকে আমার মেয়ে, জামাই,‌ তুমি, এমনকি নাতিটাও আমাকে মনের থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। মানসিকভাবে আপনজনেদের কাছে একঘরে হওয়াটা আমার জীবনে একটা বড় ধাক্কা। এই মানসিক আঘাতে আমার “যা করেছি ঠিক করেছি” ধরণের অনুভুতিটা ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। এখন বুঝতে পারি ওটা ছিল একটা ব্যাধি। আমার এই শারীরিক ব্যাধি ওই মানসিক ব্যাধিকে প্রায় নির্মূল করে দিয়ে গেছে আর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে দূরে সরে যাওয়া কাছের মানুষগুলোকে। সব খারাপেরই তো কিছু ভাল থাকে। তুমি বৌমাকে একটু ডাক না। শ্বশুর হয়ে ক্ষমা চাইতে না পারি, দুঃখপ্রকাশ তো করতে পারব। আর হ্যাঁ, বলে দিও ওরা যেন এ বাড়ি থেকে আর কোথাও না যায়। -- তুমি ফেরার পরেই রাশি চলে গেছে। ওরও তো নিজের ঘর সংসার আছে।-- খোকাকে কালই আমার সাথে দেখা করতে বল। অনেকদিন পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে, এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।চলবে
    জীবন তরঙ্গ - ১৮  - Sukdeb Chatterjee | জীবন তরঙ্গ - পর্ব ১৮পছন্দসই একটা আস্তনার সন্ধান পাওয়া গেল। রণজয়ের এক ছাত্রের বাবা ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুটি থাকেন কোলকাতায়, ছুটিছাটাতে এখানে এসে দু এক দিন কাটিয়ে যান। একজন মালি বাড়িটার দেখাশুনা করে। বাগানওয়ালা সুন্দর দোতলা বাড়ি। এক তলায় দুটো ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর আর একটা বড় বারান্দা ভাড়াটিয়ার জন্য বরাদ্দ হল। বাড়ির চারপাশে অনেকটা বাগান। সুন্দর পরিবেশ। রণজয় ঢোকার আগে গৃহকর্তা ছোটখাট মেরামত, রং ইত্যাদি করিয়ে বাড়িটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দিলেন। রণজয় খাট, বিছানা, আলমারি, বাসন-কোসনের মত নতুন সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ধীরে ধীরে কিনতে থাকল। একদিন মাকে সাথে করে নিজের নতুন ঠিকানায় নিয়ে এসেছিল। ঘরদোর, আসবাবপত্র, সব কিছু দেখিয়েছে। দেখেশুনে ছলছল চোখে কণিকা বলেছিলেন—কি কপাল আমার, অত বড় বাড়ি থাকতে ছেলেকে ভাড়া বাড়িতে সংসার পাততে হচ্ছে।নির্মাল্য মেয়ের বিয়েতে কিছু আসবাব দিতে আগ্রহী ছিলেন কিন্তু রণজয় শোনা মাত্রই সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। নভেম্বারের ২৭ তারিখ বিয়ের দিন ঠিক হল। কিছুদিনের মধ্যে নির্মাল্যদের বাড়ির কার্ড ছেপে চলে এল। মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করাও ওনারা শুরু করে দিলেন। গৃহত্যাগের সময় আসন্ন, রণজয় বেশ সমস্যায় পড়ল। বাবার কারণেই বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে, তাই বাবাকে নিয়ে ভাবছে না। ভাবনা মাকে নিয়ে, মা খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু রণজয় নিরুপায়, এ ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই।বাণী একদিন বিকাশকে অনুরোধ করেছিল ভাইয়ের ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলতে। বলেছিল, “তোমার কথা বাবা ফেলতে পারবে না। তুমি বুঝিয়ে বললে বাবা ঠিক রাজি হয়ে যাবে।”বিকাশ আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, “তোমার বাবা চরম উন্নাসিক মানুষ। কেবলমাত্র অর্থই ওনার মানুষ মাপার মাপকাঠি। তা না হলে নিজের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সম্পর্কে অমন কুকথা কেউ বলতে পারে! রাশি যদি কোন ধনী ঘরের মেয়ে হত, উনি সাদরে গ্রহণ করতেন। তখন কোন কিছুতেই আপত্তি থাকত না। সবকিছু জানার পর আমার এই ব্যাপারে ওনার সাথে কথা বলার কোনোরকম ইচ্ছে নেই। তবে তোমার ভাইয়ের বিয়েতে আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত থাকব এবং তা তোমার বাবার জ্ঞাতসারেই।”বাড়ি ছেড়ে চলে আসার দিন রণজয় কারণ জানিয়ে বাবাকে একটা চিঠি লিখে ওনার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে এসেছিল। ওনার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য মার্জনাও চেয়েছিল ওই চিঠিতে। বাবার অনুপস্থিতিতে বাড়ি ছেড়েছিল। কণিকা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলেন। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না।রণজয় মাকে আদর করে বলল—এত ভেঙে পড় না মা। আমি তো দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি না। আর তুমি হাসি মুখে বিদায় না জানালে আমাদের অমঙ্গল হবে।একথা শোনার পর কণিকা সংযত হলেন।বাড়ি ফিরে ছেলের চিঠি পড়ার পর দিগ্বিজয় একটু গুম হয়ে গেলেন। কণিকা চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে বললেন- কাপুরুষ।-- কেন, আমি কি করলাম?-- তুমি নয়, তোমার ছেলে। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেকথা সামনে বলার সাহস হল না। চিঠি লিখে গেছেন। একটা পরের মেয়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।-- পরের মেয়ের দোষ দিচ্ছ কেন? ওকে বাড়ি ছাড়া করেছ তুমি। মেয়েটাকে ভালোবাসে জানার পর ওকে তুমি কি না বলেছ? এত ভাল ঘরের কি সুন্দর মিষ্টি মেয়ে, যেমন দেখতে তেমনি ব্যবহার, তাকে কিনা তুমি বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না।-- চুপ কর। একদম বাজে বকবে না।-- চুপ[ করিয়েই তো সারা জীবন রেখে দিলে। অন্যদের কথা একটু যদি শুনতে তাহলে আজকে এই দিন দেখতে হত না।কণিকা আর তর্কের মধ্যে না গিয়ে ওখান থেকে চলে এলেন।স্ত্রী ঘর থেকে চলে আসার পর দিগ্বিজয়ের হঠাৎ মনে হল কণিকা ছেলের বৌয়ের এত প্রশংসা করল কি করে? ও কি তবে দেখেছে!রাতে খাওয়ার সময় কথাটা তুললেন—তুমি কি মেয়েটিকে দেখেছ?কণিকা একটু সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ।”দিগ্বিজয় আর কোন কথা বলেননি।বৌভাতের কার্ড ছাপতে দেওয়ার সময়ও রণজয় একটু চিন্তায় পড়েছিল। ছেলের বৌভাতের নিমন্ত্রণপত্রের নিচে বাবা আর মায়ের নাম থাকাটাই উচিৎ। যে বিয়েতে বাবা অংশগ্রহণই করছেন না, তার কার্ডে নিজের নাম আছে জানতে পারলে আরো বিগড়ে যেতে পারে। একটু ভাবনা চিন্তার পর ভবিষ্যতের সমস্যা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে বাবা আর মার নাম দিয়ে কার্ড ছাপিয়েছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠান কোথায় হবে এই নিয়েও একটু চিন্তা ছিল। রণজয়কে এলাকার বহু মানুষ ভালবাসত, বন্ধু-বান্ধব আর আপনজনেরা এগিয়ে এল, ফলে কোন অসুবিধে হয়নি। হরিসভার পাশের মাঠে বৌভাতের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হল। বৌভাতের অনুষ্ঠানের সব দায় দায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিল। কেবল আপনজনেরা এগিয়ে এসেছিল তা নয়, এগিয়ে এসেছিল আরো কিছু মানুষ যারা দিগ্বিজয়কে মোটে পছন্দ করত না। অপছন্দের মানুষকে হিউমিলিয়েট করার এত বড় সুযোগ তারা হারাতে চায়নি। শালার বিয়েতে বরকর্তা হয়ে যাওয়া থেকে আরম্ভ করে বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত সবটা বড় ভাইয়ের মত বিকাশ তদারকি করেছিল। বাবার অনুপস্থিতি রনজয়েকে টের পেতে দেয়নি। বরের বলে বলিয়ান হয়ে বীণাও বাবার অসন্তোষকে উপেক্ষা করে প্রাণভরে উপভোগ করেছিল একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে। রজতও খুব আনন্দ করেছিল মামার বিয়েতে।সুন্দরভাবে বিয়ের সব অনুষ্ঠান হয়ে গেল, কেবল দুজন মূল মানুষের অভাবে তা সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারল না।শুরু হল নতুন বাড়িতে রণজয় আর রাশির নতুন সংসার। নয়নের মত রজতেরও দুটো মামার বাড়ি হয়ে গেল। সেই সময় রজত ক্লাস নাইনে পড়ে, অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। দাদুকে ও খুবই ভালবাসত, কিন্তু দাদুর মামার বিয়েতে না থাকাটা ও মেনে নিতে পারেনি। ফিরে আসার আগে দাদুকে বলেছিল—দাদুভাই, এটা তুমি ঠিক করলে না। তোমার জন্য দিদা কত কষ্ট পেয়েছে জান? মা হয়ে নিজের ছেলের বিয়ের পুরো সময়টা ঘরে বসে কাটাল। আর নিজেদের এত বড় বাড়ি থাকতে মামু কিনা বিয়ের পর মামিকে নিয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। এটা কি ভাল লাগে?কিশোরের এই অভিমান, এই অভিযোগের কোন উত্তর তার উকিল দাদুর কাছে ছিল না।রণজয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে কণিকার আর এক মুহূর্তও বাড়িতে ভাল লাগে না। কত্তার সাথে প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলেন না। মাঝে সাঝে দুপুরের দিকে বেরিয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে একটু গল্প করে আসেন। সংগ্রহ করে আনেন বেঁচে থাকার কিছুটা অক্সিজেন।দিগ্বিজয়ের মনও আজকাল একদম ভাল নেই। এজলাসে গিয়ে কাজকর্মেও তেমন একটা মন দিতে পারেন না। মেয়ে, জামাই আর নাতি ক’দিন এসে ছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময় কাটাল ছেলের ওখানে। বাড়িতে ছিল ওই পর্যন্তই, কথাবার্তা প্রায় কিছুই হয়নি। অন্যান্যবার নাতিটা কত গল্প করে, এবারে সেও যেন কেমন ছিটকে ছিটকে ছিল। যাওয়ার আগে অভিমান উগরে দিয়ে গেল। কনিকাও কেমন যেন বোবার মত হয়ে গেছে, চুপচাপ নিজের মত থাকে। ছেলের বিয়েটাকে কেন্দ্র করে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আপনজনেরা সব একে একে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে হছে একটা বেষ্টনীর মধ্যে তিনি একা ঘুরপাক খাচ্ছেন। ভালবাসার মানুষগুলোর মায়া, মমতা, অনুরাগ, কোন কিছুই যেন সেই নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী ভেদ করে তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। প্রাচুর্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠান করেও নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। না, কিছুই ভাল লাগছে না। কোর্টেও রোজ যেতে ইচ্ছে করে না। উদ্দেশ্যহীন রোজগারে আর মন সাড়া দিচ্ছে না। বাড়িতে থাকলে একটু বই পড়েন, নয়ত চুপচাপ ঘরে বসে থাকেন। কণিকার সাথে ছেলে আর বৌমার যে যোগাযোগ আছে তা তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারেন। তাঁরও যে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেনা তা নয়, কিন্তু নিজেরই টানা গণ্ডি পার হওয়া সাধ্যে কুলোয় না।চলবে
  • ভাট...
    commentr2h | একদম তাই। আর এই আমরা বৃত্তের বাইরের লোকজনদের অস্তিত্বই কেউ অস্বীকার করে, কেউ আবার থ্রেট বলে মনে করে।
    commentdc | ভোটে কোন একজন প্রার্থী জিতে আসাটা চাপিয়ে দেওয়া নাও হতে পারে, কারন যারা সেই প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিল আর যারা দেয়নি, তারা সবাই এক্সপেক্ট করে যে সেই প্রার্থী সবার জন্য কাজ করবে। 
     
    চাপিয়ে দেওয়া তখন হয় যখন সেই প্রার্থী তার ব্যাক্তিগত দর্শন, বিশ্বাস, ইত্যাদিকে সবাইকে ফলো করতে বাধ্য করে। সেই প্রার্থী যখন বলে আমি দেশকে মা মনে করি, অতএব সবাই দেশকে মা মনে করবে; আমি বন্দে মাতরম শুনে আবেগে মথিত হয়ে যাই, তাই সবাইকে আবেগে মথিত হতে হবে; আমি জাতীয় সংগীত শুনলে উঠে দাঁড়াই, তাই সবাইকে উঠে দাঁড়াতে হবে - সেটাকে বলে চাপিয়ে দেওয়া। আর যখন সেই প্রার্থী বলে এসব না করলে তুমি পাকিস্তানে যাও, আমার চ্যালারা এসে তোমাকে পিটিয়ে দেবে আর তার পরেও যদি তুমি বেঁচে থাকো তো পুলিশ এসে তোমাকে অ্যারেস্ট করবে, সেটাকে বলে চাপিয়ে দেওয়া। আমি থেকে আমরা, যে আমরার মধ্যে আখলাক ছিলো না। 
    commentkk | এই দুদিনের এত এত পোস্টের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগলো অরিত্র'র বলা '&/' সিম্বলের চিত্রকল্প। এলেবেলের পোস্টগুলোও ভালো লেগেছে। না জানা জিনিষ জানলাম। ঋন স্বীকার না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে।
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত