এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • চুনসুরকি অলিগলি

    Sayantan
    বইপত্তর | ২৮ ডিসেম্বর ২০০৫ | ১৪৪৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sayantan | 59.160.140.1 | ২৮ ডিসেম্বর ২০০৫ ০৮:৪৭451223
  • শোনো বন্ধু
    - সায়ন্তন

    । ১।
    বেলা প্রায় এগারোটা হয়ে গেল, তবু বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সেই কোন সকালে পরোটা আর তরকারি খেয়ে বেরিয়েছিল সন্তু। ভোর পাঁচটায় উঠে নেড়াদেউল হাওড়া বাস। লাক্সারি বাস। তাতে মুরগীর খাঁচা, সবজি বোঝাই চটের বস্তা, ছানার টিন - কি নেই। বাবা একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল হাওড়ায় নেমে কোন রুটের বাস ধরে কলেজে যেতে হবে। আজ তো ফর্ম ফিল আপ। অ্যাডমিশনের। বিদ্যাসাগর কলেজের মেন গেট থেকে একহাঁটু জলে দাঁড়ানো অনেকগুলো লোকের পেছনে ফুলপ্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে অপেক্ষা করছে সন্তু।

    ভালোনাম শান্তনু সান্যাল। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হবার পর পরই ঠিক করে ফেলেছিল ইংরেজিই নেবে। আটান্ন পার্সেন্টের মত আছে, অনার্স পাবে না কি। বাকি সায়েন্স গ্রুপে কোনওটার অবস্থাই খুব একটা ভালো নয়। তাও টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন আছে। একটা রোগামত লোক অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখছে। আরে, এ যে দেখি আমার দিকেই আসছে।
    - "কোন সাবজেক্ট?
    - "কেন বলুন তো? ইংরেজি।
    - "লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম তুলতে অনেক দেরী হবে। এদিকে বেরিয়ে এসো। ঐ যে, পেপসী লেখা সাইনবোর্ড, পাশে ছোট দরজা।

    আরে, এদিক দিয়ে ঢুকে যে একেবারে কলেজের মধ্যে এসে গেলাম। একটা ক্লাসে আমার মত অনেকে বসে আছে। তাদের চোখেমুখে উৎকন্ঠা আর দ্বিধা দুইই। এখানে স্কুল কলেজে ক্লাসগুলো কী বিশাল! একটা দেওয়ালে মস্ত ব্ল্যাকবোর্ড, তাদের মফস্বলের স্কুলের মত পুরনো রোঁয়াওঠা কাঠের নয়, এখানে সিমেন্টের। সিমেন্টে ব্ল্যাক অক্সাইড মিশিয়ে তৈরী, আমি জানি। সামনে একটার পর একটা গ্যালারীর মত উঠে গেছে, সেখানে সব বেঞ্চ পাতা। শেষের দিকে খুঁজেপেতে জায়গাও পাওয়া গেল একটা। পাশের মেয়েটা জিন্স পরে এসেছে। কেমন যেন অবজ্ঞা ভরে দেখল একটু। দেখুক গে যাক! তাদের টাউনেও আজকাল মেয়েরা ব্যাগি জিন্স পরে।
    একটু পরে ছয়-সাত জন ছেলে আর দুটো মেয়ে ক্লাসে এলো। একজনের হাতে তাড়াবাঁধা কাগজ। ওগুলো-ই ফর্ম হবে। কিন্তু কী সব সার্বিক উন্নয়ন, উন্নত পরিকাঠামো ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে শুরু করল যে! ভর্তির ফর্মের আগে অন্য একটা খালি কাগজে নাম লিখে দিলাম। কাগজের মাথায় ছাত্র পরিষদ কথাটা জ্বলজ্বল করছিল।

    । ২।
    না:। কলেজ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া হল না আর। সন্ধ্যের মুখে বাড়ী ফিরেই অন্য শক। একইসাথে মা আর দিদি উত্তেজিতভাবে হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্ট করছে। মায়ের হাতে আজকের খবরের কাগজ। ওফ্‌।
    - "এবার একটু বাংলায় বলবে? তখন থেকে দুজনেই যে মগজ ধোলাই করছ -
    - "হি হি। ভাই তোকে তো দ্বীপান্তরে পাঠানোর মোটমাট ব্যবস্থা হয়ে গেল রে। ব্যাঙ্গালোরের কোন কলেজে বাপি মা তোকে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে পাঠাবে। ডোনেশন দিয়ে ...
    - "চুপ কর সুমি। সন্তু এই দ্যাখ কত বড় বিজ্ঞাপন কলেজের। ভালোয় ভালোয় ঠাকুর যেন এখানে তোর অ্যাডমিশনটা করে দ্যান।
    - "আমি? ব্যাঙ্গালোর? ঐ অত দূরে? অসম্ভব।
    - "তা কেন যাবে? প্লেন পাশ করে এখানেই ধেইনাচ করে বেড়াও আর কি! - মায়ের গলায় ক্ষোভ - "কলকাতাতে এর আগে তো আরও তিনটে কলেজে চেষ্টা করেছ, পেলে কোথাও। এখানেই কোথাও কিছু দ্যাখো এবার। আর সন্ধ্যে হলে বাসস্ট্যান্ডে পিন্টুর ঠেক তো রয়েইছে।
    - "মা যা বলছে ঠিকই বলছে। - এবার বাবার হাতে রিমোট ক®¾ট্রাল - "ওখান থেকে পাশ করে বেরোলে কত সুযোগ। তাছাড়া একবার বিদেশে যেতে পারলে আর দ্যাখে কে। স্বপ্ন দেখতে শেখো সন্তু। নিজের ফিউচারটা নিজের হাতেই। - আবার শুরু হল - "কালকেই ইন্টারভিউ। কলকাতায়। সকালে উঠতে হবে, মনে থাকে যেন।

    আমাকে দূরে পাঠিয়ে দেবে! সেই কোন ছোটবেলা থেকে কথা না শুনলে বলত তোকে পাঁচবেড়িয়া বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেব। সেকথা শুনলেই সব দৌরাত্ম ঠান্ডা। আর আজ কি না - তাহলে রুমা! রুমার সাথে দেখা হবে কি করে! দিদিটাও না! সব জেনেও কেমন নিপাট ভালোমানুষের অ্যাক্টিং করে গেল! ওদের বাড়িতে ফোন আসেনি এখনও। তাহলে সাইকেলটা বার করি। এখুনি একবার দ্যাখা হওয়া যে খুব দরকার। কীভাবে বলব কথাটা!

    । ৩।
    লাউডন স্ট্রীট। হোটেল "রাত দিন'। ঝাঁ চকচকে এলাহি বড়লোকি কারবার। রিসেপশনের সামনে অনেকগুলো সোফা। তার একটায় আমি বাবার সাথে। আজ বাবা ও আমি যতটা সম্ভব চকচকে হয়ে এসেছি। হলই বা চাকরীর জন্য নয়, তা হলেও তো জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। বসে অপেক্ষা করছে আরও অনেক ছেলে মেয়ে। সকলেই বেশ স্মার্ট, সপ্রতিভ। অলক্ষ্যে শার্টের ভাঁজগুলো ঠিক করে নিই আরেকবার।

    একটু পরে বাইরে একটা কালো অ্যাম্বাসাডর এসে দাঁড়ায়। মাথার উপরে লাল আলো লাগানো। মন্ত্রী-টন্ত্রী নাকি? হলে হবে। অভ্যর্থনা করতে নেমে আসে বেশ কিছু হোটেলের কর্মচারি আর জমকালো স্যুটেড-বুটেড ছাগলদাড়িওয়ালা একটা লোক। সকলে ওপরে যায় এবং দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে নেমে আসে। আরে, ওর আগে হয়ে গেল না কি! আমর সকলে যে বসে আছি এতক্ষণ।

    পাশের এক ভদ্রলোকের সাথে যথারীতি বাবা ভাব জমিয়ে ফেলেছে। চলছে ছেলের সাতকাহন। বাবা না পারেও, এক্কেবারে মায়ের মত।
    - "এই যে, আমার ছেলে, শান্তনু।
    - "এবার পাশ করেছো? - সরাসরি প্রথম প্রশ্ন।
    - "হ্যাঁ।
    - "তোমার বাবা তো বললেন যে তোমার বাংলা মিডিয়াম, তা অসুবিধে হবে না? - পাশ থেকে ছেলেটা মুখ তুলে তাকায়। ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস কি! ও:, নিজে শহরের ছেলে বলে কি একেবারে মাথা কিনে নিয়েছে? পুরো পাড়ার লাল্টু মার্কা দেখতে।
    - "ও শিখে যাবে ধীরে ধীরে। - বাবা ত্রাতার ভূমিকায়।

    মনে মনে সেনটেন্সগুলো ঝালিয়ে নিই আর একবার। ইংরেজিতে বলতে গিয়ে মাঝে আটকে না যায়। আরও কিছু পরে ডাক আসে উপর থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত জামাপ্যান্টগুলো ঠিকঠাক করে নিই। লিফটে করে তিনতলায়। মোটা কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সেই জমকালো লোকটা। রিভলভিং চেয়ারে বসে। টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারগুলো দেখিয়ে দ্যান।
    সমস্ত মার্কশীট, সার্টিফিকেট দেখে কি না দেখে অবহেলাভরে পাশে সরিয়ে রাখে।
    - "সো, হুইচ কোর্স হ্যাভ ইউ চোসেন?
    - "কম্পিউটার সায়েন্স। - বাবা বিগলিত, গর্বিতও।
    - "আর ইউ পেয়িং বাই ক্যাশ?
    - "ইয়েস, হিয়ার ইট ইস। - বাবা এতক্ষণ আগলে রাখা কালো চামড়ার ব্যাগটা খুলে টাকা গুনতে শুরু করে। এক, দুই, তিন - তিনটে একশ টাকার দশহাজারি বান্ডিল আর আরও একটা থেকে আলাদা করে রাখা পাঁচ হাজার। তার পর টাকাগুলো এগিয়ে দেয় টেবিলের ওপাশে।
    টাকাগুলো ভালো করে গুনে ছাগলদাড়ি মুখ তুলে তাকায়।
    - "সি, ফর হস্টেল ফেসিলিটি ইউ নীড টু পে ফাইভ থাউস্যান্ড রিফান্ডেবল ডেপোসিট অ্যালং উইথ ওয়ান মান্থস সিট রেন্ট ইন অ্যাডভান্স, দ্যাট ইস টোট্যাল সিক্স থাউস্যান্ড সিক্স হান্ড্রেড। - বাবা যথাসাধ্য সপ্রতিভভাবে আবার টাকা গোনে।
    - "অ্যান্ড ইয়েস, আই ফরগট টু মেনশন, হি নীডস টু স্টিচ টু সেটস অফ ব্লেজার। দ্যাট ইস, থ্রী থাউস্যান্ড আ পীস।
    - "ইজ দেয়ার এনি প্রভিজন টু পে দ্যাট লেটার? - বাবা সামান্য চিন্তিত গলায়।
    - "বাট আই উইল পার্সোন্যালি অ্যাডভাইস ইউ টু ক্লিয়ার ইট অফ নাও।

    বুকের মধ্যে একটু কেমন যেন হয়, বাবার তিলতিল করে জমিয়ে তোলা এতগুলো পয়সা, এভাবে! হয়ে গেল ইন্টারভিউ। শুধু ক্যাপিটেশনের পয়সা। টাকার অঙ্কটা সত্যিই আমি জানতাম না। দিদি তাই সেদিন বলতে গেলেও মা চুপ করিয়ে দেয়। বাড়ী ফিরছি বাসে করে।
    - "আমাকে একবারও বলেছিলে বাবা? এখানে এত পয়সা লাগে জানলে কে আসতো?
    - "চুপ কর সন্তু। কি করতিস এখানে থেকে? সে জেনারেল লাইনে পাশ করে লক্ষ লক্ষ বেকারের মত - একটা চাকরীর জন্য এর ওর দরজায়। পার্টীর মদত, তারপর তো বুঝিসই, এখন বাজারে কম্পিউটার নিয়ে পাশ করে বেরোতে পারলে ভালো চাকরীর অভাব হবে না। তখন এ সব সুদে আসলে উঠে আসবে।
    - "কিন্তু দিদিটার -
    - "দিদির জন্য তোকে চিন্তা করতে হবে না। সেজন্য আমি আছি। তাছাড়া ও বলছিল এসএসসি তে বসবে বলে। ওর কিছু একটা হয়ে গেলে তোর মা আর আমি দুজনেই নিশ্চিন্ত।

    মায়ের মুখে হাসি ঝলমল।
    - "হয়ে গেছে?
    - "ছাব্বিশে আগস্ট ক্লাশ শুরু হবে। এখান থেকে চব্বিশের করমন্ডলের টিকিট কাটতে হবে। দেখি খোকোনকে একবার ফোন করে, টিকিটগুলো দিতে পারে নাকি - বাবা বাথরুমে ঢোকে।
    - "কি রে? এবার কি হবে? - দিদি প্রগলভ - "তোকে রুমা একটা চিঠি দিয়েছে। তোর পড়ার টেবিলে ইটুবি ডিকশনারিটার মধ্যে রেখেছি। অ্যাই, পূজোয় বাড়ী আসবি তো? তখন আমার জন্য চন্দনের গুঁড়ো নিয়ে আসবি তো।
    - "দিদি জানিস কত টাকা লাগল? আমার এত খারাপ লাগছে না।
    - "চুপ কর। মা শুনলে আবার বলবে আমি তোকে এসব বলতে বলেছি বলে। তুই আমার কথা ভেবে বলছিস তো? আমি কোনওরকমে একটা স্কুলের চাকরি পেয়ে গেলে বাবার পাশে একটু দাঁড়াতে পারি। ওসব বিয়ে-ফিয়ে কে করবে? তুই ভালোভাবে পাশ করে খুব উঁচু একটা চাকরি পা, দেখিস আর কোনও কিচ্ছু নেই। তারপর লালি তো রয়েইছে। অ্যাই, অ্যাই মারলে মাকে বলে দেব। মা, ও মা -

    কোনদিন একদিন নেই ঘুম দুপুরেতে সময় হারায়
    এ জীবন নিশীদিন আচমকে সচকিতে দুহাত বাড়ায়
    ভাবনারা কথা দিয়ে কথা ছলে বসে আছে দিন প্রতিদিন
    সেদিনের শেষে থাকে নি:সীম আকুলতা আর নাম হীন

    যাওয়ার আগের দিনগুলো কেটে যেতে থাকে হু হু করে - "The fleeting passage of time" - রুমার চোখে চোখ রাখার সাহস খুব একটা হচ্ছে না। ও তো যেন ধরেই নিয়েছে যে আমি আর বাড়ীমুখো হব না, ওপাশেই কিছু একটা - আরে দূর পাগলী, মাত্র তো তিনটে বছর। ও দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

    সব কথা, সব কিছু, সবসময় মাত্রাবহ, অর্থবহ হয় না। তাহলে পৃথিবী একমাত্রিক হয়ে যেত। তা হয় নি বলেই এখনও মানুষ কথা বলে, গান গায়, ভালোবাসে।

    । ৪।
    অবশেষে যাওয়ার দিন চলে আসে। করমন্ডলের কনফার্মড টিকিট অনেক চেষ্টাতেও পাওয়া যায়নি। অগত্যা কোচিন গৌহাটি বাই-উইকলি। হাওড়া থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় রাত আটটা। সবাই এসেছে সাথে। বিদায় জানাতে। যাবো শুধু আমি আর বাবা। দিদি খুব সুন্দর একটা নীল সিল্কের রুমাল বানিয়ে দিয়েছে, তার এককোণে জ্বলজ্বলে "এস' অক্ষরটা। রুমার সাথে শেষ দেখা হয়নি। ইচ্ছে করে দেখা করেনি নাকি কি জানি।

    মা একটা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে লুচি, শুকনো আলুর দম আর গাজরের হালুয়া বানিয়ে ঠেসে ভরে দিয়েছে। খাবার ব্যাগটা থানইঁটের মত ভারি। নিউ কমপ্লেক্সে বড় ঘড়ির নীচে আমরা অপেক্ষারত। এখন সবে সাড়ে ছটা।

    একে একে কত ট্রেন এলো, কত প্যাসেঞ্জার উগরে দিয়ে, পেটে ভরে নিয়ে চলে গেল প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে। ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর অনেক আগে পেরিয়েছে। তবু আমাদের ট্রেনের দেখা নেই। বাবা কোত্থেকে যেন খবর নিয়ে এলো ট্রেন উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির জন্য চার ঘন্টা লেট। আরো কিছু দেখে মা আর দিদি কে বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হল। বলা হল ফোন করে খবর দেওয়া হবে।

    রাত একটা। প্রায় খালি প্ল্যাটফর্মে আমি আর বাবা, সুটকেসের উপর বসে। লুচিগুলো দশটা বাজার আগেই শেষ হয়ে গেছে। দুচোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম। ভারি পাতা বারবার নেমে আসে। প্রতীক্ষা তবু শেষ হয় না। তারই মধ্যে ছেঁড়া স্বপ্ন দেখি - কেমন হবে ওখানের জীবন, লোকজন, রুমমেটরা। কে যেন কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয় -
    - "ঘুমিয়ে পড়েছিস যে। চল চল ওঠ, ট্রেন দিয়ে দিয়েছে।
    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় আড়াইটে বাজে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি তো! এস টেনে বার্থ খুঁজে নিতে ঘুমচোখে একটু দেরী হয়। সাইড আপার আর সাইড লোয়ার।

    দীর্ঘ আটত্রিশ ঘন্টার শেষে ম্যাড্রাস সে¾ট্রালে নামি। অন্ধ্রপ্রদেশের গরমে শরীর পুরোপুরি বিধ্বস্ত। এখানে প্রায় চার ঘন্টা কাটিয়ে রাত দশটায় কানেক্টিং ট্রেন। ওয়েটিং রুমে দুজনে গিয়ে বসি।

    রাতের খাবার খাওয়া হল ইডলী-সাম্বার সহযোগে। এ তো আর পাড়ার বংশীদার ন্যাতানো চটচটে ইডলী হয়, খোদ দক্ষিণীদের নারকোলের চাটনী মাখা ইডলী। তবে অনেক চেষ্টাতেও খান চারের বেশী খেতে পারলাম না। প্রথম বার বলেই বোধহয়।

    রাতের ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। নতুন পৃথিবী দেখার আনন্দে আর কিছুটা উত্তেজনায় চোখে ঘুম নেই। বাবা আপার বার্থে ঘুমিয়ে। আমি জানলার সাথে বাইরের আলো-আঁধারী দুনিয়ায়। কত ছবি সরে গেল, আলোকিত কিছু জানলা অন্ধকার পাথুরে বুকের উপর দিয়ে আঁকচিরা কেটে যায়, ধীরে ধীরে পার হয়ে আসা অংশগুলো শাদা হয়ে গেল।

    । ৫।
    ওরেবাবারে! এখানে আগস্ট মাসে এমন ঠান্ডা কেন এবং কিভাবে? বাবা বলছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় আড়াইহাজার ফীট উঁচু। গেলবারে পূজোর পর কেনা ফোমের জ্যাকেটটার চেন গলা পর্যন্ত টেনে দিই। বাবা তো কাল রাতে একবার উঠে থেকেই সেই যে মাফলার পরেছে, সেটা মনে হয় বাড়ী ফিরে নামা পর্যন্ত থাকবে।

    স্টেশনের বাইরে সাবওয়ে দিয়ে রাস্তার ওপিঠে এলে বাসস্ট্যান্ড। কলেজের প্রসপেক্টাসে রোড ডিরেকশন দেওয়া ছিল। সেই মত জিজ্ঞেস করে সতেরো নম্বর স্ট্যান্ড থেকে কে আর পুরমগামী তিনশ পনেরো নম্বর বাস। অনেকটা কলকাতার স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট কর্পোরেশনের বাসগুলোর মতই। কাঠখোট্টা সীট আর ততোধিক কাঠ কন্ডাকটর। এসে টিকিট চাওয়া তো নয়, "চিটি' বলে কি একটা বলল, মনে হল টিকিটই হবে। রাস্তার দু'ধারে সবকিছু দেখে মনে হল না আদ্যপান্ত নতুন কিছু। কেবল প্রচুর সবুজ আর সবুজ। আর রাস্তাঘাটও বেশ সরুই বলা চলে। আশেপাশে দৃশ্যপট চটজলদি বদলে গেল। বুঝলাম শহরের উপকন্ঠে আমরা। একসময় নামতে হল।

    কলেজ হস্টেলের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসে গিয়ে কাগজে কলমে সব কিছু মিটতে বেলা প্রায় এগারোটা। দৈনন্দিন প্রয়োজনের বালতি, মগ, সাবান, বিছানার তোশক, মশারি ইত্যাদি টুকিটাকি সারতে সারতে আরও দু ঘন্টা।

    তিনতলা হলুদ রঙের বাড়ী। লাল রং করা গ্রীল আর রেলিং। এটাই হস্টেল! এখানেই কাটাতে হবে তিনটে বছর। আমার "রুম' তিনতলায় এগারো নম্বর সাঁটা ঘরে। ঢুকে দেখি আমাকে নিয়ে মোট সাতজন। প্রত্যেকেই বেশ রাগী রাগী চোখে আপাদমস্তক জরিপ করে নিল নবাগত আগন্তুকের। কিছুক্ষণ পরে বাবা ফিরে গেল। আজ সন্ধ্যেতেই যে ফিরবার ট্রেন। আমাকে তো এখন এখানেই থাকতে হবে।

    । ৬।
    - "হেই, ইউ, মেক শ্যুয়োর ইউ টেক অফ ইয়োর স্লিপারস বিফোর ইউ কাম আউট অফ দ্য বাথরুম। - মানভজিৎ সিং গ্রেওয়াল। তখন মনে হয়েছিল রুম লীডার।
    - "ইয়েস স্যার। - নতুন ব্যাচ, যেহেতু এরা আগে এসেছে তাই জুনিয়র সিনিয়র নির্বিশেষে সক্কলকে "স্যার' বলে "উইশ' করতে হবে।
    - "অ্যান্ড ডোন্ট ইউ ট্রাই টু অ্যাক্ট স্মার্ট উইথ আস। - এই ছেলেটা একটু ফ্রেন্ডলি, নভনীত সোধী। প্রথম দিন বাবা চলে যাওয়ার পর ছাদে যখন একা বসে ছিলাম, নভনীত পাশে এসে বসেছিল।
    - "ক্যায়া য়ার! সেন্টি হোনে সে কুছ বদলনেওয়ালা থোড়া হি। চল নীচে চলতে হ্যঁয়।
    আরেকটা বাঙালী ছেলে আছে এই রুমেই। কসবায় বাড়ী। কিন্তু এই একমাত্র যে আসার থেকে একটাও কথা বলেনি। কিছু না বললে তো ভালই - শান্তনু ভাবে।
    - "অওর, সুনাও অপনা বাত বঙ্গালীবাবু। মচ্ছি খেয়েছো? আমি তুমাকে বালোবাসি।
    - "ওয়ে, অবভি নহি য়ার, ওয়ার্ডেন নীচে হ্যঁয়। - অগুন্তি মুখ। অজস্র অচেনা চোখ। নতুন শিকার পেয়েছে, চোখের কোণে কিসের ঝিকিমিকি।

    সারাদিন ভয়ে একলা বসে থাকি। মাঝখানে "ক্যান্টিনে' "লাঞ্চ' করে এসেছি। একড্যালা ভাতের মন্ড, লাল কি একটা ঝোল, "ভিন্ডী ফ্রাই' আর টক দইয়ের ঘোল। উপরে ফিরে দেখি আমার টেবিলের সামনে বেশ ভীড়। আমার অনুপস্থিতিতে মায়ের বানানো নারকোল নাড়ুগুলো শেষ করেছে হতভাগার দল! নিজের "কাবার্ড' কি নীচে খেতে গেলেও বন্ধ করে যেতে হয়! আর ভুল হবে না।

    সন্ধ্যে হয়। একটু দূরেই স্টেশন। যাত্রীগামী ট্রেনগুলো প্রবল হুইশ্‌ল বাজিয়ে গমগম করে চলে যায়। আজকে বুকলিস্ট পেয়েছি। কাল অ্যাভিনিউ রোড বলে একটা যায়গায় গেলে বইগুলো কেনা হবে। ততক্ষণ তো কিছুই করবার নেই। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সকলেই কিছু না কিছু পড়ছে। "চন্দামামা', "ফিল্মফেয়ার', "স্টারডাস্ট', "প্লেবয়' - সবরকমের বইই দেখেছি বিছানার তোষকের নীচে রাখা। রাত প্রায় দশটা। দরজায় শব্দ হয়।
    - "হু'জ দেয়ার?
    - "তেরা বাপ। ওপেন দ্য ব্লাডি ডোর।
    মুখ চাওয়াচায়ি করি সকলে। পাশের রুম থেকে একজন চাপা গলায় বলে "সুপার সিনিয়র'রা এসেছেন। একটু কাঁপা হাতে দরজা খুলি।
    - "হোয়াট টুক ইট সো লং টু ওপেন আ লক? ** মার রহে থে ক্যায়া?
    - "গুড ইভনিং স্যর। - সমবেত কন্ঠে। মুখ নীচু। চিকুক অস্বাভাবিকভাবে বুকের সাথে সাঁটা।
    - "ওক্কে। লেটস কাম টু দ্য পয়েন্ট স্ট্রেট। অল অফ ইউ আর ইন কম্প সায়েন্স?
    - "নো স্যর, আ য়্যাম ইন হোটেল ম্যানেজেমেন্ট। - বঙ্গপুঙ্গব অনিন্দ্য। একটু মজা পাই।
    - "বি এইচ এম? আরে ওয়া! ক্যায়া কোর্স সিলেক্ট কিয়া! কাস্টমার লোগোঁকো গোদমে বিঠাকর চুম্মাচাটি করোগে? - এক সিনিয়রের হাস্যরসে বাকি সকলে তুমুল মজা পায়। আফটার অল সিনিয়র, যথারীতি সেন্স অফ হিউমার ও অনেক বেশীই হবে।
    - "অলরাইট। রেস্ট অফ ইউ অল গাইস কাম স্ট্যান্ড ইন দ্য মিডল অফ দ্য রুম। অ্যান্ড নোবডি আসকস এনি কোয়েশ্চনস, ওকে?
    - "নহিঁ য়ার। দীস পিপল আর অলরেডি ডান উইথ। আই গেস ডে বিফোর ইয়েস্টারডে সামবডি নিউ কেম। - সতিন্দর সিং। বি কম্প, ফাইন্যাল ইয়ার। - "ইস দ্যাট ইউ? - আমার দিকে আঙুল।
    - "ইয়েস দ্যাটস রাইট।
    - "অ্যান্ড হু দ্য **** উইল সে "স্যর'?
    - "সরি স্যর। ইয়েস স্যর।
    - "চল ঠিক হ্যয়। নাও গো টু দ্য লু, পোর আ বাকেট অফ ওয়াটার অন ইয়োরসেল্ফ অ্যান্ড কাম আউট উইদাউট আ থ্রেড।
    মাথা ঝিমঝিম করে। এসব কি বলছে!
    - "সালে জলদি কর নহিতো দুসরে রুমকা কিসি সে জবরদস্তি করওয়াউঙ্গা। - সবার চোখ কৌতুকে ভরপুর এখন। এমন খোরাক তো প্রতিদিন হয় না। একটা ছেলে, আমার মতই হবে, একটু হাসছিল। চোখে পড়ে যাওয়ায় তাকেও আমার সাথে শামিল করা হয়। যাক তবু একা নই আমি। পরের দশটা মিনিট এভাবেই কেটে যায় ফিসিক্যালি অফেন্সিভ কমেন্টস করে। শীতের রাতে গোটা গায়ে জল মেখে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একে একে সব আদেশ পালন করতে হয় - "মুরগা বননা', "চওআন্নি আঠান্নি', দেশলাই কাঠি দিয়ে সারা ঘরের মাপ নেওয়া, চামচে করে পেপসীর দেড় লিটারের বোতল জলভর্তি করা।

    রাত একটা নাগাদ বিদায় নেয় সকলে। অনিচ্ছাভরে। মজাটা আরও হলে ভালো হত।
    - "চল য়ার। য়হ সব দিলপে মত লেনা। দিস ইস, ইউ নো, কাইন্ড অফ ট্র্যাডিশন। চলতা আ রহা হ্যয়। কল ফির কলেজ মে মিলতে হ্যয়।

    ভোর চারটেতেও চোখে ঘুম নেই। গায়ে জ্বরভাব। গায়ের ওপর কম্বলটা বোধহয় নভনীত চাপিয়ে দিয়েছিল। একটু আগে একটা ডিসপ্রীন আর একটা ক্যালপল খাইয়ে গেছে। বুঝতে পারছি বেশ কাল দিন খুব একটা ভালো যাবে না। ভিক্রান্ত উঠে আসে। ভিক্রান্ত দেভগন, রাণীগঞ্জে বাড়ী।
    - "য়ার, তুঝপর যো হুয়া হ্যয়, হমেঁ অফসোস হ্যয় পর য়হ সব কুছ তু আনেসে পহলে হমিসে ভি করওআয়া গয়া। দেখ, নেক্সট সাল, যব হম সব সিনিয়র বন যায়েঙ্গে, তো সব বরাবর হো যায়েগা, না? - প্রশ্নসূচক মুখে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা।

    কী জানি কি ভাবছে, ওর মধ্যেও কি আছে প্রতিশোধস্পৃহা! এর নাম র‌্যাগিং? কি পায় এভাবে অপমান করে! কেন এমন বিকৃত মানসিকতা! না কি এরাও সেই করে "র‌্যাগড' হয়েছিল, আমারই মত "হ্যারাসড' হয়েছিল! কিন্তু তার বদলা আমার উপর কেন? একটু আগে ভিক্রান্ত যা বলল তার মানে সামনের বছর এই সয় ও আবার একটা "সতিন্দর'এর জন্ম দেবে! আমি সে ভুল করব না।

    । ৭।
    পূজোর সময় চলে এলো। সকলের মধ্যে একটা বাড়ী ফেরার সাড়া। টিকিট কাটবার ধুম। প্রিপারেটরি পরীক্ষা চার তারিখে শেষ হলে ঐ দিনই রাতের ট্রেন, অক্টোবরের ছ তারিখে বাড়ী, রবিবার সপ্তমীর দিন।

    - "ওয়ে সালোঁ, পতা হ্যয় আজ লিটর‌্যাচর কী ক্লাসমেঁ কওন আ রহী হ্যয়? - সমীর ছুটতে ছুটতে ক্লাসে ঢোকে। - "সুমা ম্যাম। - তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে ক্লাসময়। সুমা ম্যাম, সুমা সুসান জোস, আমাদের কলেজের মরূদ্যান। ক্লাসের পেন্তী কুন্তী মেয়েগুলোর থেকে অনেক অনেক বেটার। মীণাক্ষী ছদ্ম রাগে চোখ মটকায় -
    - "তুম লড়কেঁলোগ জিন্দগীভর য্যায়সে থে বস সির্ফ লড়কেঁ হী রহ যাওগে। - হিংসে? হবেও বা।
    - "অওর তুম লড়কী - উত্তাল অট্টহাসি।
    - "আজ তো ম্যয় পহলীবার য়হ ক্লাস অ্যাটেন্ড করুঙ্গা।

    বিকেল চারটেয় কলেজ শেষে হেঁটে হস্টেল ফিরছি। নভনীত কোত্থেকে আসে। ওরও বাস "মিস' হয়ে গেছে।
    - "আজ শাম পিকচার চল রহা হ্যয়? সব যা রহেঁ হ্যয়। লিডো মে লগী হ্যয়। তেরে মেরে সপ্নে।
    - কিঁউ লাস্ট উইক হি তো গয়ে থে ন হম। আজ ফিরসে? মেরে পাস পয়সা অবভি কম হ্যয়। ফির ছুট্টীমে ঘর ভী যানি হ্যয়।
    - "পয়সা ছোড়। লে লেনা মেরেসে। চল ম্যয় আজ তুঝে স্পনসর কর রহা হুঁ। অব ঠিকঠাক?
    - "অচ্ছা, তো যানেকা অটো ফেয়ার মেরা।
    - "ডীল।

    সন্ধ্যে থেকেই আজ সকলের মুখে চাপা উত্তেজনা। সকলেই জানে আজ কি হতে চলেছে, তবু কেউ যেন কাউকে কিছু না বলে। ফুল প্রুফ প্ল্যান। আজ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একদিন পিছিয়ে পরেরদিনের টিকিট কাটা হয়েছে। আজ রাতে সেলিব্রেট করা হবে। ওয়ার্ডেন অলরেডি বাড়ী চলে গেছে। এক নীচে সিকিউরিটি ছেলেটা। তা ওকেও দলে টেনে নিলে আর কোনও চাপ থাকছে না। আমাদের রুমটা সবচেয়ে বড় বলে ওখানেই আয়োজন। টেবিল আর খাট টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরের এক কোণে। বাকি চেয়ারগুলো বিছানার ওপর। পাশাপাশি দুটো টেবিল সাজিয়ে "সেলার', তার পাশ দিয়ে সিলিঙ থেকে ঝুলছে গোটা চারের চলিশ ওয়াটের বাল্ব, রঙীন কাগজ জড়ানো। স্পেশাল এফেক্ট।

    যথাসময়ে বিশ্বাসযোগ্য সদস্যের হাতে করে চলে আসে খবরের কাগজ জড়ানো নিষিদ্ধ পানীয়। রাত নিশুতী হলে প্রত্যেকে গোল হয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। হাতে হাতে ডিসট্রিবিউট হয়ে যায় প্লাস্টিকের গেলাস।
    - "য়ার মুঝে নহীঁ পীনী। কভি নহীঁ পীয়ী। - আমি আমার মত জানিয়ে রাখি। - "কনট্রিবিউট তো কিয়া হুঁ।
    - "থোড়া সম্‌জ্‌হা কর য়ার। বাত কনট্রিবিউশন কি নহীঁ হ্যয়। সারে একসাথ ব্যাঠকে বাতেঁ করেঙ্গে। ইসমে কওনসী বঢ়ী বাত! হদ হো গয়া য়ার। অওর হম পী তো রহেঁ হ্যয় বীয়ার। ইসে পীকে তুঝে কুছ নহীঁ হোগী। - নভনীত নাছোড়বান্দা।
    আরও কিছুক্ষণ "বখওয়াস' করে মানতে হয়, কথা হয়, আমি মাত্র আধ গেলাস নেব। অ্যান্ড দ্যাটস ইট।
    যা আছে কপালে। একবার তো খাবো। একঢোঁকে পুরো তরলটা গলায় চালান করে দিলাম। ওয়্যাক! এর নাম লিকার। একেই লোকে এত সাধ করে পয়সা খরচ করে খায়! এর থেকে তো ঠেলাগাড়িতে লেমন সোডা অনেক ভালো খেতে। গলা জ্বলছে। নভনীত দেখছিল আমার দিকে একদৃষ্টে।
    - "ক্যায়া পানী য্যয়সা পী রহা হ্যয় - অওর থোড়াসা লে। - নিজের বোতল এগিয়ে নিয়ে আসে।
    - "নহী, অওর মত ডাল। নহী চাহিয়ে মুঝে।
    - "আরে লে না য়ার। মর তো নহী যায়েগা না!
    পিঙ্ক ফ্লয়েডের "ডিভিশন বেল' উত্তাল বাজতে থাকে। "লেটস নট ফরগেট দিস প্লেস' - প্যান পাইপ মুড হয়ে কেনি জি'র স্যাক্সোফোনে "সংবার্ড' উড়ে যায় - "লেটস নট ফরগেট দিস প্লেস' - রাউন্ডস চলতে থাকে।
    - "আরে ভিক্রান্ত, তুনে ক্যায়া ঠিক কিয়া ফির? ওয়াপস যাকে ইসবার তেরী লড়কীকো প্রপোস কর পায়েগা কি নহী?
    - "মানভ, অবভি উসকি বারে মে বাত মত কর, প্লিজ য়ার"

    রাত প্রায় একটা। যে যার রুমে ফিরে গেছে। আমাদের রুমে বোতলের পাহাড়। খাবার মোড়ার র‌্যাপার, প্লাস্টিকের গ্লাস - পুরো জায়গাটা নরক হয়ে আছে। ঠিক হল গ্লাস, র‌্যাপার ইত্যাদি বাইরে ফেললে সন্দেহ হবে, তাই ওগুলো একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে থাক। বাড়ী থেকে ফিরে দেখা যাবে। আর বোতলগুলো বাথরুমের বাঙ্কে থাক। যেগুলো ধরবে না সেগুলো কমোডের মধ্যে। আর দরজা বাইরে থেকে লক করে দেওয়া হবে। সবার সম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। গোটা ঘরে ডিওডোর‌্যান্ট স্প্রে করে কোনওরকমে সবাই শুতে গেলাম।

    সকাল আটটা বোধহয় তখন। কেউই ওঠেনি। মাথাটা ভারি হয়ে আছে। একবার চান করতে পারলে যেন ভালো হত। বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা।
    - "ওপেন দ্য ডোর - অচেনা গলা।
    - "হু'স দেয়ার?
    - "কো-অর্ডিনেটর হিয়ার। ওপেন দ্য ডোর।
    হৃৎপিন্ড গলায় উঠে আসে যেন। কো-অর্ডিনেটর! মানে করীম? এত সকালে কি দরকার? ততক্ষণে মানভ উঠেছে। অনিন্দ্যও।
    - "হেই হোয়াটস আপ! হু'স ব্যাঙ্গিং অন দ্য ডোর?
    - "শাট আপ মানভ। ইটস দ্য কো-অর্ডিনেটর। হি ইস অন দ্য ডোর ফর হোয়াটএভার আই ডোন্ট নো।
    করীম ঘরে ঢোকে। সাথে কালকের সেই সিকিউরিটিটা। শালার পেটে পেটে এত ছিল।
    - "আই ডোন্ট ওয়ান্ট অনি আরগুমেন্ট। ডোন্ট মেক মি টু কল দ্য প্রিন্সী অর দ্য ডাইরেকটর। আই ওয়ান্ট দ্য ট্রুথ। টেল মি নাও হু অল ওয়্যার ইনভলব্‌হ্‌ড ইন লাস্ট নাইটস বীয়ার পার্টী?
    ভগবান, বাড়ী যাওয়ার আগে কপালে এই ছিল! আর যাই করুক, বাড়ীতে যেন খবর না পাঠায়! যদি রাস্টিকেট করে !! আর ভাবতে পারি না।
    - "লেট মি টেল দ্য ট্রুথ স্যর -
    - "আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি লেকচার। আই ওয়ান্ট নেমস। - আজ করীম ভীমের ভূমিকায়, আমাদের রক্তপান করবে। ব্যাটার সরু গোঁপ দেখে আগেই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, লোকটা সুবিধের নয় বলে।
    - "স্যর, দ্যাট ওয়ে, অল ওয়্যার হিয়ার লাস্ট নাইট। এনটায়ার হস্টেল। ইভেন দিস সিকিওরিটি গার্ড। - সাবাশ মানভ।
    পুরো হস্টেলকে রাস্টিকেট করা অসম্ভব। দ্য বল ইস ইন ইয়র কোর্ট স্যর।
    করীম এক মোক্ষম চাল চালে।
    - "হি হু কামস আউট উইথ স্পেসিফিক নেমস, উইল বি আউট অফ দিস মেস।
    প্রবল চোখে একে অপরকে দ্যাখে। কেউ যদি মুখ খোলে তো সে বাকিদের হাতে শহীদ হয়ে যাবে আজ। বেশ কিছুক্ষণ সব চুপ। কিছু পরে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসে। কে কাঁদছে! সবাই তো একই লাইনে দাঁড়িয়ে। প্রথমটা বুঝতে পারিনি। তারপর একটু ঝুঁকে দেখি অনিন্দ্য।
    - "স্যর, প্লিজ ডোন্ট টেক এনি অ্যাকশন অন মি। প্লিজ ডোন্ট সেন্ড এনি লেটার টু মাই হোম। আই উইল টেল ইউ দ্য নেমস। অল দ্য মেম্বারস অফ রুম নাম্বার ইলেভেন অ্যান্ড টুয়েলভ আর ইনটু দিস।
    মানভ একটা বাজে কথা প্রায় বলেই ফেলেছিল, পাশ থেকে চিমটি কেটে চুপ করে থাকতে বলি। এরপর ডাইরেকটর আসে। কালো সিয়েলো তে করে। ডাইরেকটর তো নয়, যেন যম নামলো গাড়ী থেকে। রুমে ঢুকেই যমের মতই আমাদের মুখ দেখতে লাগল। ওরেদ্দাদা, পিছনে দেখি সাথে ডাইরেকটরের মেয়েও ঢুকল। কলেজ হস্টেলে মেয়ে, অন্য সময়ে হলে পাতি বাওয়ালি হয়ে যেত, কিন্তু আজ না, আজ আমাদের বিনাশকাল। স্বয়ং যম নিতে এসেছে কালো রথে চাপিয়ে নিয়ে যেতে। এত চাপের মধ্যেও দেখি মানভ ঠিক ঝাড়ি মেরে যাচ্ছে মেয়েটাকে। হয়ে গেল!

    ফরমান হয়ে গেল। এ রুম সে রুম মিলিয়ে সাত ছয়ে তেরো জনকে ছুটী কাটিয়ে ফেরার পর একমাসের জন্য কলেজ থেকে সাসপেনশন। অনিন্দ্য ও বাদ গেল না। তবে ল্যাব করা যাবে। এইচ ও ডি'র পারমিশন নিয়ে। বাথরুম খুলে বোতলগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাওয়া হল।

    - "নেকস্ট অ্যাকাডেমিক ইয়ার শুরু হোনে সে প্যাহলে হমে য়হ রুম ছোড়না হ্যয়। অওর, যাহাঁ হো, য্যায়সে ভী হো, আনিন্দো, তু হমারে সাথ নেহী আ রহা হ্যয়। - মানভ কথাগুলো আমাদের সকলের হয়েই বলল। আমরা সকলে চুপ।
    - "পর, আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু কাম আউট অফ দিস, মানভ - অনিন্দ্য আত্মপক্ষ সমর্থন করছে! এখনও!
    - "সো ডীড উই অল ইউ মোরোন। - নভনীত চীৎকার করে বলল শব্দগুলো - "অ্যান্ড ইট কুড হ্যাভ বিন পসিবল ইফ ইউ য়ুড হ্যাভ নট ওপেনড ইয়োর ******* মাউথ। - পুরো রুমে পিন ড্রপ সাইলেন্স।
    - "সালে একবার ক্যায়া ডরানে কি কোশিশ কী তো ফাট গয়ী পুরী !! অ্যায়সা দোস্তী নিভাতা হ্যায়? - মানভ পুরো গরম সামোসা।
    - "অব বস করো য়ার। বোল দিয়া না উসে যো বোলনা থা। উয়ো সমঝ লিয়া উসে যো সমঝনা থা। - পরিস্থিতি সামলানোর একটু চেষ্টা করি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। - "ফির সজা তো উসে ভী মিলি। নাও এন্ড অল দিজ য়ার, প্লিজ।

    । ৮।
    আজ শেয়ালদা স্টেশনে কীসের কি জানি বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। অবরোধ ইত্যাদি শুরু হল বলে - লাল ঝান্ডা হাতে লোকগুলো দৌড়ে এসে লাইনের ওপর বসবার অপেক্ষা। বারুইপুর লোক্যাল আজ সময়মত এসেছিল বলে রক্ষে - নইলে এতক্ষণেও কিছু জুটত নাকি ভেবে দেখার! তাছাড়া আজ পারচেজ অর্ডারটাও হাতে পেয়ে গেল শান্তনু, কোটেশন পাঠিয়ে অনেকদিন ফলো-আপ করছিল, রক্ষিতদা যদিও আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাও ফ্যাক্স কপিটা চোখের সামনে তুলে ধরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না ঠিক। যাক, এ মাসের টার্গেট হয়ে গেছে। আর শনিবারের মিটিঙে চোখরাঙানীর ভয় নেই। তাছাড়া এমাসে স্যালারিও পুরোটাই আসবে। একশ' পার্সেন্ট।

    বিএসসি পাশ করে পুরো দুটো বছর কত চেষ্টা করেছে ... ফ্রেশারের পোস্টে সফটওয়্যারে বি ই ছাড়া অন্যদের তো কত জায়গায় ইন্টারভিউও দিতে দেয়নি, বায়োডাটা সিকিওরিটি গার্ডের হাত থেকে ফিরে এসেছে। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজে লাল স্কেচপেনে টিক দেওয়া আর তারপর ঠিকানা খুঁজে ইন্টারভিউ দিতে বেরিয়ে পড়া। ঠিক এমন করেই একবার একটা কোম্পানীতে কাজ পেয়ে গেছিল, কোম্পানী না বলে একটা ছোট এক কামরার ঘর বলাই বোধহয় সঙ্গত হবে। একজন মোটাগোঁফের লোক ঘরের মাঝে ঘর আলো করে, দেওয়ালের কোণের দিকে গোটা চার দুখী শ্যামলা কম্পিউটার, আর দেওয়ালে দেওয়ালের অজস্র তাকে মোটাসোটা ভিস্যুয়াল বেসিক, লার্ন সি প্লাস প্লাস ইন টুয়েন্টিওয়ান ডে'জ জাতীয় বই। শুভদৃষ্টি শেষ হলে জানা গেল পাঁচ হাজার টাকা রিফান্ডেবল ডিপোজিট রাখতে হবে (এখানেও সেই একই কেলো! আবার রিফান্ডেবল! ও পয়সা তো আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। ঠিক যেমনটা কলেজ হস্টেলের ক্ষেত্রে হয়েছিল।)। প্রতি মাসে ফিক্সড স্যালারি বলে কিছু নেই, সি তে কোড লিখতে হবে, ঠিকঠাক হলে প্রতি কোড পিছু পাঁচশ টাকা। তিনমাস মহা উদ্যমে কাজ করে শেষমেষ যখন বোঝা গেল যে পুরোটাই ধাপ্পাবাজি, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।

    বাবা আর টানতে পারছিল না। বাড়ীতে সকলের অনেক প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিয়ে অবশেষে একদিন বাড়ী ফিরে গেছিল শান্তনু। মাত্র ঊনিশদিনের মাথায় ছোটখাটো এই প্রাইভেট কোম্পানীতে সেলসের চাকরীটা পাওয়া যায়। বাবার রক্ত জল করা লাখ লাখ টাকা ... বুকের অনেক গভীরে নিয়ত রক্তক্ষরণ হত, কিন্তু তা সত্বেও আজ মাসের শেষে অন্তত পাঁচ হাজারটা টাকা তুলে দিতে পারছে। এটাই বা কম কি! সে কথা তো মা ও বুঝেছে। চোখের কোণে জল নিয়ে বোবা মুখে আশাহত চেয়ে থাকার পাশে একটু হলেও যে হাসতে চেষ্টা করে - এটাই না অনেক পাওয়া, যা পেয়েছে সেই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। ভালো দিন আসবে একদিন - পথ চেয়ে অপেক্ষা করে থাকা।

    রুমা আর অপেক্ষা করেনি, ওর বাড়ী থেকেও চাপ দিচ্ছিল, নেহাত একটা সেলসম্যান, পালিশ করা ভাষায় সেলস এক্সেকেটিভের আর কতই বা দাম বাজারে, তাই নিয়ে ওর বাবার সব প্রশ্নের সম্মুখীন বেশীক্ষণ হয়ে পারেনি। সেই শেষ দেখা। ওর যেদিন বিয়ে হল তখন তো সে নিজে উত্তর দিনাজপুরে, রায়গঞ্জে, অফিসের কাজে।

    কলেজের সবকিছু এর মধ্যেই হালকা হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। শুধু মনে পড়ে প্রথম দিনগুলোর উচ্ছ্বাস, লাগামছাড়া মাত্রাহীন স্বাধীনতা, একা থাকবার যথেচ্ছাচার আর আত্মপ্রত্যয়। কনফিডেন্স কি আজ নেই, নিজেকে প্রশ্ন করে শান্তনু, তাহলে কি সে আজ হেরে গেছে, শুধু দিন-কাল গুজরানের জন্যই বেঁচে থাকা, মধ্যবিত্ত স্বপ্ন ভেঙে গেলে বোধহয় এমন করেই কাচ ভাঙার শব্দ হয়। বড় একা লাগে সবসময়, ট্রামে, বাসে, গলায় ফাঁস হয়ে চেপে থাকা টাইটার দিকে তাকিয়ে ঘেন্না হয়, চোখ জ্বালা করে। তারি মধ্যে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া দিদিটার সাথে, ও স্কুল থেকে ফিরে এলে সব কথা উড়ে যায়। ওর কথার সুরে, ওর চোখে যে দূরের দৃষ্টি তার ভাসমান গন্তব্যপথে পথ খুঁজে প্রখর দুপুর মহাশূণ্যে মিলিয়ে যায়। সারাদিনের যান্ত্রিক আবর্তে এলোমেলো ওর গুছি চুল কপাল থেকে সরিয়ে দেয়, সেখানে ঘামের ফোঁটা মুক্তোদানা হয়ে ঝরে। শান্তনু জানে, শুরুটা হয়ত ঠিকমত হয়নি, তাই আবার সবকিছু নতুন করে ভেঙে সাজাতে হবে, নিজেকে যে প্রমাণ করতে হবেই, জোয়ারের জল এখন সরে গেছে, সেখানে একরাশ পলিমাটি ভাঙা ঝিনুক - সেসব সরিয়ে খুঁজে নিতে হবে নতুন পথ, যেপথ চলে গেছে অনেক দূরে, পথ চলে উজানে এলে হয়ত দেখা মিলবে আলোর রশ্মির। অনেক সময় - সময়ের পলি সরাতে হবে। আলোমুখে দুমুঠো শস্যদানার মত নতুন দিনের স্বপ্ন লুটোপুটি খায়, এ স্বপ্ন একসাথে পথ হাঁটার অঙ্গীকারে, ছন্দবদ্ধ কর্তব্যের সুঠাম ডোরে বাঁধা। ঐ দূরে আলোকোঙ্কÄল পথ দেখা যায়।
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৮ জানুয়ারি ২০০৬ ০৪:৩৪451331
  • এ শুকনো ডাঙায় রোদ্দুর চড়ে উঠলো মার্চেই। ফেব্রুয়ারীর শেষ থেকেই রাগী হয়ে উঠছিলো,এখন তাপ কত বেড়ে গেছে! গ্রীষ্ম কত দীর্ঘ এখন,বর্ষা গড়িয়ে যায় শরতের বুকের উপর দিয়ে হেমন্ত ছেয়ে। তার পরে খুব সংক্ষিপ্ত শীত আর বসন্তীর এক ঝলক শেষেই আবার চড়া গ্রীষ্ম।
    শীতে মোড়া বিভুঁইয়ে এখনো কত বরফ,কত ঠান্ডা,তুলোর মতন তুষার ঝরে ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে,আশ্চর্য শ্বেতপুষ্পবৃষ্টি।আমাদের বিস্মৃত শ্বেতপ্রভুদের দ্বীপে বিষন্ন সকালসন্ধ্যা বয়ে যায়,এখন উলটোযাত্রায় আমরাই সেখানে গিয়ে থাকি,কাজ করি, সুতো জড়াই আর সুতো খুলি আর ভুলে যাওয়া শিশুকালের কথায় দু:খবিলাস করি।
    শুকিয়ে আসা খালের পাড়ে ক্ষীরকাঁঠালের গুঁড়িতে বাঁধা নৌকার কাছি খুলে ফেলি, নৌকোর খোলে নামতে নামতে মোহর খিলখিল হাসে, বলে " বংশী,মাঝিকাকা তোর রক্ষা রাখবে না জানতে পারলে।"
    বাবার রাগী রাগী মুখটা মনে পড়ে, লাল চোখ,শক্ত কেঠো কেঠো কাঠামো। কতদিন হয়ে গেলো একটা ভালো দেখে ক্যালাকেলি হয় নি! আজকে দেরি করবোই,আজকে ধরা পড়বোই। মারবে খুব,কেটেকুটে যাবে হয়তো,রাতে খেতে দেবে না। না দিক গে, কতদিন আর এমনি এমনি খাবো?
    মোহরের দিকে ফিরে হাসি। বলি," কি করবে? হয়তো মারবে। তাতে কি হবে?"
    মোহরের চোখ নরম হয়ে যায়, বলে,"বংশী তোকে তোর বাবা খুব মারে,নারে? "
    " আগে খুব মারতো, প্রায় রোজ। এখন আর অত মারে না, কিছু দোষ খুঁজে পায় না বলে নাকি আমি দূরে দূরে থাকি বলে কে জানে। আজকে ধরতে পারলে নিশ্চয়...."
    মোহর বলে,"তাহলে যেতে হবে না। চল ফিরি।"
    "না না ফিরবো কি? তুই যে বলেছিলি ইন্দিরবিলের কচুরিপানা ফুল দেখবি? দেখবি না? এসব আর কতদিন থাকবে বল? দশ পনেরো বছর থাকে তো তাই ঢের।"
    কি অপূর্ব রঙ কচুরিপানা ফুলের! সাদার উপরে অতি হাল্কা বেগুনী একটা আভা। বাঁশের লগি জলের নীচে মাটিতে ঠক করে ঠেকিয়ে নাও থামাই,হাত বাড়িয়ে কচুরিফুল তুলে নিই বেশ কয়েক থোকা। মোহরের বেণীর গোড়ায় গুঁজে দেবার সময় দুষ্টু মেয়েটা চুপ করে বড়ো বড়ো চোখ মেলে চেয়ে থাকে দূরে, কেন এত উদাস হয়ে গেলো? দূরে অনেক দূরে ঐ পশ্চিমদিগন্তে রাঙা সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে থাকে,ওর কালো চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে লাল রঙ।শুভ্র ও হাল্কা বেগুনী মেশানো ফুলগুলি কি দারুণ মানিয়েছে ওর গোছা ধরা কালো চুলে।
    ঐ রক্তাভা বড়ো নেশা ধরায়, বড়ো স্বপ্ন দেখায়। আমি জানি। এ মোহ কাটানোই খুব শক্ত হবে।
    মুখে হাতে পিঠে গলায় গরম রক্ত অনুভব করি,চোখ ঝাপসা লাগে,বেরিয়ে আসা রক্তধারা বাতাসে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বাবা এত কি মারবে আজ? মা কিছু বলে না, বরং লাঠিসোটা এগিয়ে দেয়।পরে অবশ্য জল দেয়,গামছায় রক্ত মুছিয়ে দিতো ছোটোবেলায়, কাটাগুলোতে পুরানো কাপড়ের ফালি দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতো। আজকেও দেবে কি? সারাদিন কিছু খাই নি, রাতেও কিছু দেবে না ওরা। যদি জ্বর হয়,কাউকে বলবো না। কি দরকার কতগুলো টাকা খরচ করিয়ে?
    মোহরের কাঁধে হাত রেখে কই,"মোহর,কি হলো?"
    নাড়া লাগা ফুলের ভেতর থেকে ঝরঝর করে জল পড়ে যেমন,তেমনি করে ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে।
    (ক্রমশ)
  • pra. ba. | 131.95.121.251 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৬:৪৫451342
  • ধূসর আকাশ থেকে একটানা তুষার ঝরছে, রাস্তাগুলো সাদা হয়ে গেছে।গাছগুলো সব ন্যাড়া,কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণহীন প্রত্নপ্রস্তর যেন।অদ্ভুৎ বিষন্নতা বর্ণহীন চাদরের মতন ছড়িয়ে আছে সবটুকু জুড়ে,বাইরে আর ভেতরে।সূর্যহীন ধূসর মেটে তুষারাচ্ছন্ন দিন যে কি প্রচন্ড বিষাদের! আহ,উষ্ণতা যে কি ভীষণ আকাংক্ষার,সে কি এই অবস্থায় না পড়লে কোনোদিন বুঝতে পারতাম?
    প্রবল সূর্যের দাবদাহের দেশ থেকে আসা আমি,আগুন আবিষ্কার নিয়ে এদের এই আদিখ্যেতার অর্থ অস্পষ্টভাবে বুঝতে শুরু করি।
    মস্ত মস্ত গাম্বাট পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত লোকেরা পথ চলেছে,আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না কখন ফিরবো,এখন না আরো অনেক পরে?
    হুতুমথুমের মতন দিন,ধোঁয়া ধোঁয়া সব কিছু।
    মোহর,তুই কোনোদিন এখানে আসবি না,কোনোদিন না।
    থুতনি ঠেকাই মোহরের গালে,বলি,"কিরে, কেন কাঁদছিস ছিঁচকাঁদুনির মতন?"
    মোহর দুহাত দিয়ে গাল চোখ মুছতে মুছতে হাসে,বলে,"চোখে আঞ্জনি না খঞ্জনি কি হয়েছে কে জানে।"

  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৩:৪৮451353
  • প্রবল হাওয়ায় উড়ছে মোহরের চুল, সন্ধ্যার রঙ গড়িয়ে পড়ছে আকাশ বেয়ে, কাকেরা দল বেঁধে উড়ে চলে আসছে পুবের দিকে,ওরা সর্বদা বাসায় ফেরার সময় পুবে উড়ে আসে।সকালে বেরোবার সময় সূর্যের বিপরীতে ওড়ে আবার ফেরার সময়ও। আচ্ছা,ওরাও কি জানে জ্যামিতি,অংক,গোল জ্যামিতি?
    ওরা নিশ্চয় আমাদের থেকে অন্যরকম জানে,কত উপরে ওড়ে ওরা,জন্মকাল থেকে।
    সারি বেঁধে ওড়া কাকের দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে একটি কাক, তাছাড়া অন্য কাকেরা উড়ে যাচ্ছে নিঁখুত একটি গতিময় প্যাটার্নের মতন,ওদের ডানায় আলো থেকে ছায়া পড়ে আসছে।
    পিছিয়ে পড়া কাকটিকে মোহর বললো,"তাড়াতাড়ি যা,এই তাড়াতাড়ি যা। হারিয়ে যাবি নইলে।"
    মোহরের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠলাম আমি, "তুই একটা পাগলি রে মোহর।"

    শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীর মুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি,নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। হাওয়ায় ওর সোনালী চুলের গোছাও উড়ছে আলতো আলতো করে।
    ক্যারোলিনকে ছেঁড়া পুরানো পোশাকে এলোমেলো চুলে কল্পনা করতে চেষ্টা করি,কিন্তু তাতেও ওর রূপ এতটুকু কমে না। এমন সাদাতে গোলাপীতে মেশানো মুখের রঙ! এমন নিঁখুত করে গড়া নাক মুখ চোখ! নীল চোখের ভিতরে আলো জ্বলছে।
    ওকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত কল্পনা করি,তাতেও রূপ কমে না ওর।
    ও বলেছিলো একসময় নাকি খুব কঠিন অবস্থা গেছে ওর,রোজ খেতে পেতো না, ছেঁড়া পোশাক পরতে হোতো। কিন্তু এই আকাশচ্যুত বিদ্যুতের মতন সুন্দরী কি তাতে ম্লান হয়? আমার দু:স্বপ্ন যত দূর যেতে পারে,চেষ্টা করি ততদূর খারাপ অবস্থায় ওকে কল্পনা করতে,কিন্তু এই সামনে ফুলে ছাওয়া শ্বেতপাথরের বেদীটিতে এলিয়ে বসা হাসিমুখ তরুণীটির চেয়ে কোনো মতেই বেশী ম্লান হয় না আমার কষ্টকল্পনার অতীত ক্যারোলিন।

    মোহর সাইকেল চালিয়ে আসছে।ভীষণ গরম দিনটা। সারাদিন শহরে তেতেপুড়ে একশা হয়ে গেছে মোহর। কাছে এসে সাইকেল থামিয়ে নামলো ও। তেলেভাজা পাঁপরের মতন ওর মুখখানা,ঘামে বারে বারে ভিজে বারে বারে শুকিয়েছে বলে একটা কালছে ছোপ লেগেছে মুখে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো মোহর,"কী রে বংশী,কি দেখছিস?"

    "ক্যারোলিন,চলো,লাইব্রেরী যাবে না?" আমি ওর হাত ধরতে হাত বাড়িয়ে দিই। ক্যারোলিন ওঠে,একটি আলোর হিল্লোলের মতন এগিয়ে আসে। কোথা থেকে খিলখিল একটা হাসি শুনতে পাই,একদম মোহরের গলা।
  • Sayantan | 59.160.140.1 | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:৫০451364
  • নাম নেই
    =====

    । ১।
    চোখের সামনে জলের বিন্দুগুলো ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে একটানা ঝরে যাওয়া জল, ঝরঝর ঝরনা, কখন বালতি উপচে সারা মেঝে ভাসিয়ে নিরন্তর টানা সুরের গান, জলের রং এত সুন্দর হয়! কখনও বা নামহীন, শুধুই বয়ে যাওয়া ... ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া...

    - "বাপির আজ দেরী হয়ে যাবে না? অ্যাই তিতি ... হ'ল তোর?
    দূর থেকে কে ডেকেছে আজ? ব্যস্ত পৃথিবীর হাঁটাপথে তার ছায়া কে পার হয়ে গেছে! বুকের গভীরে কুশাঙ্কুর কে বিঁধিয়ে গেছে এমন ক'রে - নিজের নাম অন্যের মুখে শুনতে এতো ভালো লাগে! কই, কোনওদিন তো বুঝিনি!
    - "হয়ে গেছে মা, আমার ব্যাগটা একটু টেবিলের ওপর এনে রাখবে? ওটা একটুও গোছানো হয়নি।
    - "নিজের কাজ নিজেই কেন যে ঠিক সময়ে করে রাখিস না। লক্ষ্মীচ্ছাড়া মেয়ে কোনও একটা কাজ যদি ঠিকঠাক করতে শেখে। আমার এখন হাত জোড়া। ভাইকে বল। - উফ্‌, মাও না ...

    আজ আবার দেরী হয়ে গেল। ঠিক সময়ে বাসটা পেলে হয়। ঐ তো, এসে পড়েছে দেখছি।

    - "কি রে তিতির, গানটা পুরো তুলেছিস? আজ কিন্তু রিহার্সালে ক'লাইন গাইতেই হবে, স্নিগ্‌ধাদি হারমোনিয়াম নিয়ে আসবেন, আজ ওয়ার্ক এডুকেশন ক্লাসের পর, কমন রুমে। তুই গানের খাতা নিয়ে এসেছিস তো?
    - "আজ কি করে? তোকে কে বলল?
    - "অ্যাই, কাল তুই নিজেই তো বললি, ফেরার সময়, এরই মধ্যে ভুলে গেছিস! শোন আজ তোর টিফিনবক্সে কি আছে রে?
    - "যা আছে তুইই খাবি, হ'ল? তুই শুধু আমায় একটা কথা বল, কালকে ঐ ছেলেটাকে তুই চিনিস কি? ঐ যে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ... আর ও আমার নামই বা জানল কি করে!
    - "কে কার কথা বলছিস? ও বুঝেছি, ও তো সৌম্য, সৌম্যব্রত, দাদার সাথে, একই ক্লাসে, ওখানে আবার কি হ'ল?
    - "ও:, শুধু তো নাম জিজ্ঞেস করেছি, আমার নাম ধরে ডাকল, তাই।
    - "তোকে বলা হয়নি, পঁচিশে বৈশাখ ওদেরও তো কি যেন একটা শ্রুতিনাট্য আছে, প্রতিদিন জোরকদমে প্র্যাকটিস চলছে শুনছি।

    সৌম্য, এমন কিছু নামই মনে হয়েছিল, ই®¾ট্রার দিনও তো ঐ ছিল, সদলবলে, এখন মনে পড়ছে, ঠিক ঐ মুখই, ভুল হবার নয় তো, বারান্দার থামে হেলান দিয়ে মাতব্বর ভাবভঙ্গী, হি: হি:, অস্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখ বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।

    - "দিদি, আজ যে তুই অ্যাড জেলের পেনটা আনবি বলেছিলি, এনেছিস?
    বিচ্ছুটা ঠিক মনে রেখেছে, ভোলেনি তো! মনে তো সে নিজেও রেখেছিল, কিন্তু স্কুলের বাইরে সৌম্য যে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা তো সে জানত না, ওর সাথে হেঁটে ফিরতে গিয়েই তো সব ভুলে গেল সে।
    - "শোন বুবলা, তোর পেন তুই কাল ঠিক পেয়ে যাবি, আর এই নিয়ে এখন যদি চীৎকার জুড়িস তো কিচ্ছু পাবি না। ঠিক আছে?
    - "তোর ব্যাগটা সকালে এমনি এমনি গুছিয়ে দিলাম বুঝি? তখন তো বেশ বললি, তুই না - কাল যদি না আনিস তো মাকে বলে তোকে বকুনি খাওয়াবো।
    - "আচ্ছা, এখন বললাম তো, কাল ঠিক আনব।

    নিজের থেকেই সামনে এগিয়ে এসেছিল সে, অপ্রস্তুত মুখে সপ্রতিভ ভাবভঙ্গী নিয়ে।
    - "হাই, আমি সৌম্যব্রত' - নাম জেনে গেছি আগেই।
    - "তিতির'
    - "আজ রিহার্সালে গান শুনলাম। জাস্ট টু কনগ্র্যাচুলেট ইউ ...
    শুধু তাই, তবে তোমার চোখে এত অস্থিরতা কেন সৌম্য?
    - "থ্যাঙ্কস। স্তুতিটুকু মেখে নিয়েছিল আলতো করে।
    বাকি সারাটা পথ শুধু হাবিজাবি বকে গেল একনাগাড়ে ছেলেটা। কি ছিল না তাতে, স্কুল ম্যাগ, ভলিবল, ক্রিকেট সব। আর শুধু চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে গেছে সে, বকবক করুক যা খুশী, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে তো সে জেনে নিয়েছে যা কিছু জানবার, এখন শুধু অপেক্ষা, আদৌ মুখ ফুটে তাকে সে কথা বলতে পারে নাকি।

    । ২।
    - "তিতির, তুমি কি শুভ কে রেডি করিয়েছ? এরপর কিন্তু আমার সাথে ও আর বেরোতে পারবে না।

    একধাক্কায় অতীত থেকে ফিরে আসে তিতির, সৌম্য'র তিতির, রান্নাঘরে শুভর খাবার টিফিনবক্সে ভরতে ভরতে কখন যে দুচোখের জলে ভেসে গেছে সে নিজে, জলের রং এত বিস্বাদ, বর্ণহীন ফ্যাকাশে! পুরনো দিন এত জীবন্ত হয়ে উঠে আসে কখনও, সবুজ পাতার লুকোনো মোড়কে রামধনু আলো ছটা ছড়ায়, স্মৃতিহীন তারাদের যাতায়াতে পথ কখনও বৈশাখী আহেলিদের কথা বলে।

    এখনও সে তো মনে রেখেছে সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যার প্রতিটা মুহূর্ত, সৌম্যর চোরাচোখের দেখা, মাত্র দুমাসের চোখে দেখা, তাও, প্রথম ভালোবাসা - প্রথম কিছুই স্থায়ী হয় না - নিজেরই নজর পড়ে গেছিল বোধহয়।

    নীচে অস্থির হর্ন বাজতে শুরু করেছে। এরপর আজ আবার শুরু হবে বা, শুভকে তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়ে হাত নেড়ে টাটা করে আসে।

    আবার একলা সে নিজে। প্রথম দিনের মতই, সেই কোন প্রথম দিন থেকে। কবে বুঝেছে সুমন তাকে। তার কাছে সময় কই। তার জীবন জুড়ে তার ক্যারিয়ার, তার কাজ, তার দিনরাত্রির কম্পিউটার। আর সে নিজে, ভালোবাসা হয়েছিল কি কোনওদিন, শরীর ছাপিয়ে, তাকে নিজেকে ভালোবেসে! এমনটাই কি সে চায়নি! মনে মনে কাকে ভেবেছিল তিতির নিজে, কে ছিল সেখানে, কার চলে যাওয়ার ছবি এঁকেছিল সে!

    চলে যাওয়া! এ সব কি ভাবছে তিতির! আজ আবার হারিয়ে যাওয়ার দিন, সারাটা দিন জুড়ে শুধু অনাহুত পায়ের আওয়াজ, সে যে চলে গেছে, আসবার অনেক আগেই, চলে যাওয়ার পথে অনেক জলের রঙে অলীক ছবি এঁকে।

    । ৩।
    আজ বুবলার পেনটা মনে করে নিয়ে যেতেই হবে। নাহলে ওটা মাকে নালিশ করবে নির্ঘাৎ, যা ছিঁচকাঁদুনে, বাব্বা:। আজ গোটা রাস্তায় জ্যাম যেন অনেক বেশী, সেই সকালে সুপর্ণা ফোন করে বলল আজ ও আসছে না, ওরা সকলে মিলে প্রিয়াতে ... সে যাক, তাকে তো স্কুলে যেতেই হবে, ভীতু ছেলেটা সেই কোন বেলাশেষে গেটের বাইরে ... না:, এত ভাবছে কেন!

    স্কুলগেটের ঠিক বাইরেই কেমন যেন জটলামত ভীড়, অনেক কৌতূহলী লোক একসাথে, ট্র্যাফিক কনস্টেবলটাও ভীড় সরাতে ব্যস্ত ... কি হয়েছে ওখানে! আরে, স্কুলের অনেকজন তো দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, কয়েকজন মিস ও ... পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, ঋতু ছুটে আসে ওকে দেখে, সোমা, সহেলী আরও সবাই -
    - "আমাদের স্কুলের সৌম্যব্রত মজুমদার, রাস্তা পার হবার সময় ...

    কি বলছে এরা! কার কথা বলছে। কান মাথা ঝিঁ ঝিঁ করতে থাকে, পায়ের নীচে রাস্তা দুলে ওঠে তিতি'র, ভীড় ঠেলে সামনে এগোয়, তখনই দমকা হাওয়ায় মুখের একপাশ থেকে ঢাকা দেওয়া চাদরটা সরে গেছিল, তার নীচে শান্তিতে শুয়ে ছিল সে।

    বিকেলের অনেক দেরী। রাস্তায় পিচগলা তাপ। সব ছবি ভেঙেচুরে যায় ... ভাঙচুর তার মুখেও।

    অনেক বসন্ত পার হয়ে আজ এই গ্রীষ্মের দুপুরে অনেক দিনের জমে থাকা জড়বুদ্ধি বোকা নির্বাক কান্না বুক ফাটিয়ে বার হয়ে আসে, আজ পাশে কেউ নেই, নির্লজ্জের মত দুহাতে সব কিছু আঁকড়ে ধরতে চায়, আবার, শেষবার।
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:০৮451375
  • সায়ন্তন, এতদিন পরে অলিগলিতে দেখা গেল তোমাকে।এতদিন আসো নি কেন?
    ভারী সুন্দর কিন্তু বড়ো দু:খের।মধুরতম গান হতে গেলে কি করুণতম হতে হয়?
    ভালো থেকো,আরো লিখো।
    (স্বগত: ওপাড়ায় সঙ্গীতা এসে দু:খী প্রেমের সূর্যশিশির লিখে দেখি কাকু থেকে আরম্ভ করে সব ভাইপো ভাইজিদের দিয়েও দু:খের নতুন পুরানো প্রেমের গপ্পো লিখিয়ে নিচ্ছে!)
  • Pra Ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৫:১৮451386
  • মোহরও আসবে, বংশীকে নিয়ে। শীগগীরই।
  • Sayantan | 59.160.137.4 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০৮:৪৪451397
  • না তনুদি, বিচ্ছিরি একটা সময়ে আজকাল অফিস আসি যাই ... ব্যক্তিগত কাজকর্ম সম মাথায় উঠেছে, তারই মাঝে কখনও সখনও :) - কিন্তু pra.ba মানে কি? সঙ্গীতাদির সূর্যশিশিরের থেকে খানিকটা রেশ টেনে তো বটেই, কখন যে লেখা হয়ে যায়। মোহরের জন্য বসে রইলাম কিন্তু।

    ----

    নক্ষত্রের নীল সরোবরে নিজের ছায়া দেখে
    তুমি কি ভয় পাও -
    অজান্তে কেঁপে ওঠো বজ্রের নির্ঘোষে -
    স্মৃতির সিলিঙে কি জড়িয়ে আছো ... এখনও -
    ... একবার ভিক্ষা চাও ভিক্ষুক -
    এ হাতে মোহরই ওঠে
  • pra. ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:০৩451408
  • সায়ন্তন,তবুও মাঝে মাঝে এই সূর্যশিশিরের কণাগুলি ঝলকে ওঠে বলেই না জীবন বহনের অর্থ থাকে!
    প্র ব মানে প্রত্যুষা বসু।হি হি। :-)))
    "যোজন যোজন বালি পেরিয়ে
    এসে থামি ছায়ায়।
    এক আঁজলা জলে
    এককুচি পাতা,
    একটা নক্ষত্র দুলে ওঠে।
    আকাশের আয়নায়
    ও কার মুখ?
    যেদিকে তাকাই,
    কি নীরব!
    অথচ কি বাঙ্ময়!"
  • pra. ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:০৬451224
  • মনে পড়ে তোর?
    সোনাঝুরি মহালয়া ভোর?
    আলোঝরা গানে ভরা ভোর?
    মনে পড়ে মনে পড়ে মনে পড়ে তোর?
    ও মোহর!!!
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:১২451235
  • এখানে কবিতা দেয়া যায়?
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:১৫451246
  • সুর্যশিশির গাছ দেখেছ সায়ন্তন?
    বা কলসপত্রী?
  • pra.ba | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২১:২২451257
  • আগে কেবল ছবিতে দেখেছিলাম।খাসিয়া জয়ন্তীয়া পাহাড়ের কোলে নাকি ও গাছগুলো দেখা যায়।
    আমাদের দেশটা কত বৈচিত্রময়,না?
    কলসপত্রী সত্যি সত্যি দেখলাম দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে। তাও আবার গ্রিন হাউসের মধ্যে।
    কমলালেবুর বদলে ভিটামিন সি ট্যাবলেট!:-(
    খুব ইচ্ছে জয়ন্তী পাহাড়ে বেড়াতে যেতে।সত্যি সত্যি কমলালেবু ভর্তি গাছ সমস্ত উপত্যকা জুড়ে,পায়ের নীচে সবুজের মধ্যে সূর্য শিশির চকচক করছে!
    যাবে? তোমার মেঘকে নিয়ে? সেই মেঘের দেশে?
    ফিরে এসে বোলো সেই গল্প।
  • sayan | 59.160.140.1 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:০৪451268
  • সূর্যশিশির দেখিনি তো! তবে কলসপত্রী দেখেছি, ড্রসেরা ও তো ওটারই নাম? এখানে কবিতা কেন, যা খুশী লেখ, যা মন চায় ... খাসিয়া জয়ন্তীয়া গারো যেখানে যেতে চাও বলো - আমার মেঘ কে নিয়ে ভিজিয়ে দিতে ঠিক হাজির হয়ে যাব :)
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২২:১৪451279
  • কলসপত্রীকে বলে নেপেন্থেস।আরো অনেক নাম আছে। পিচার প্ল্যান্টও বলে।
    ড্রসেরা হলো সূর্য শিশির।
  • deepten | 202.122.18.241 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২৩:১৩451290
  • কলসপত্রী ? কলসপত্রী ??
    পুর্নেন্দু পত্রীর কেউ হন উনি ? হ্যাঁ ?
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২৩:২৬451301
  • তা পূর্ণেন্দুই জানেন।:-)))
    পূর্নেন্দু তো খালি লরা আর পেত্রার্ককে নিয়ে কবিতা লেখেন।
    "তুমি জানতে না আমি এক ত্রুবাদুর
    গীতিকবিতায় খুঁজছি সার্থকতা।"
    ত্রুবাদুর মানেটা কি খুঁজতে গিয়ে সেই এঁচোড়ে পাকা ছোঁড়া বলে,"দিদি ওটা হলো গিয়ে আড়াইখানা বাদুর বা বাঁদর।"
    বুঝুন ব্যাপারটা।
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ২৩:৪১451312
  • মোহরলতা গাছ দেখেছ সায়ন?
    তারাপদ রায়ের গল্পে পড়ি ও গাছটার নাম। দেখিনি কোনোদিন। ঘনবৃষ্টির দেশে ছাড়া নাকি ও গাছ হয় না।

  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:১২451323
  • আরো বেশ কটা লেখা এখানে এলে বেশ হয়।
  • pra.ba | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:৪৩451332
  • কি জানি কেন খোলে না বাংলায় ইমেল।আজকে সব কেমন যেন!
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:৪৯451333
  • মনে পড়ছে চন্দনবন, মনে পড়ছে সূর্যমন্দির,মনে পড়ছে অভয়ারণ্য।
    মনে পড়ছে বর্ণালীর হাতে ভেলভেটের মতন নরম ভায়োলেট ফুলের গুচ্ছ।পার্কের মধ্যে সিঁড়ির ধাপকাটা,মাঝে মাঝে গোল ছাউনি সে পথের উপরে।তাতে লতারা ঝামরে ঝমরে ফুলে প্রজাপতিতে ...
    কোথায় বর্ণা আজ?
    কোথায় মীনাক্ষী? ওর দীর্ঘ চুলে ছিলো একগোছ হাল্কা গোলাপী ডিসেম্বর ফুলের থোকা!ও বলেছিলো সারাজীবন ঐ পাহাড়ে অরণ্যে থাকতে পেলে সে শুধু সারাদিন ফুল দিয়ে ঘর সাজাতো?
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:৫৫451334
  • ঝকমকে দিন ছিলো সেই পাহাড়ে অরণ্যে চুলের কাঁটার বাকে।
    সকালের কুয়াশা,মাথাঘোরা,মনখারাপ সব কেটে গেছে তখন।ঝকমকে রোদে ভেসে যায় গোটা পাহাড় ও উপত্যকা।
    পথের পাশের গাছগুলো গাঢ় কমলা রঙের ফুলে ভরা।

  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০০:৫৯451335
  • দুপুরে থামা হলো খেতে।
    সে হোটেলে চলছে এক বিয়ের অনুষ্ঠান।
    অচেনা রীতি নীতি, অল্পচেনা খাবারদাবার।বিয়ের অনুষ্ঠানে দুটি অলংকৃত গদা দেখে ভারী অবাক লেগেছিলো।
    আমরাও খেলাম পংক্তিভোজে,টেবিলে কাগজের রোল পাতা,তার উপরে কলাপাতায়,সাধারণ ডালভাত তরকারি, তবে শেষে একটি করে অতি আশ্চর্য মিষ্টি!

  • pra.ba | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:০১451336
  • খাওয়া শেষেই আবার বাসে,আবার চুলের কাঁটা বাঁক,আবার ঝর্ণাপাহাড়ফুললতা। তবে এবারে সবাই ধাতস্থ,সকালের মতন অত মাথা টাথা ঘোরাচ্ছে না কারুরই।
  • pra.ba. | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:০৪451337
  • গন্তব্যে পৌঁছতে গাঢ় সন্ধ্যে হয়ে গেলো।
    এক আকাশ তারা ঝমঝম করছে তখন।চন্দ্রহীনা সেই তারাময়ী রাত্রির যাদু আমাদের সবাইকে মুহূর্তে অবশ করে দিলো।
    রেস্ট হাউসের ছাদে ওঠা হলো মই দিয়ে,ছাদে বসে গেলো নৈশ গানের আসর,সঙ্গে পান।

  • pra.ba | 131.95.121.251 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ০১:৫০451338
  • ছাদের চারিদিকে নারকোল গাছেদের মাথা,হাত বাড়ালেই নারকোল পেড়ে নেয়া যায়।কিন্তু রাতে আর ওসব ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে আমাদের গান ও পান চলতে লাগলো।
    এ অঞ্চলটি চন্দনের গাছে ভর্তি। তারই জন্যে এর নাম সুরভি শৈল।
    এখানে হরিণেরা আসে নাকি রাতে।
  • Babaji | 213.173.163.2 | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১২:৫৮451339
  • কলসপত্রী দেখেছি শিলং পাহাড়ে। অনেক অজানা অচেনা গাছ পতঙ্গভূক আর অর্কিড দেখেছি চেরাপুঞ্জীর পথে।
  • Milli | 131.95.121.251 | ০৫ মার্চ ২০০৬ ২৩:০১451340
  • কতকাল সময় আর খেলেনা আমায় নিয়ে! সেই লুকোচুরি, দৌড় দৌড়, টুকি। সেইসব অরূপগন্ধী সকাল,সেইসব শিরশিরে হাওয়া,সেই লংকাগন্ধের গ্রীষ্মদুপুর,ক্লান্ত মধুর বিকেল,মনকেমন করা হেমন্ত,গোধূলির ম্লান রাঙামাটি আলো,আনন্দের শরতের দ্রুতচ্ছন্দ প্রহর- সবকিছুর ভিতর দিয়ে টুকি টুকি টুকি করে দৌড়!
    বৃদ্ধ কাল হাসিমুখ দাদামশায়ের মতন,একমুখ সাদা দাড়ি শরতের মেঘের মতন-সবকিছু নিয়ে ঐ আলোছায়া হাসিকান্না দু:খসুখ রাগবিরাগের ভিতরে সস্নেহ হাসি নিয়ে চেয়ে থাকতেন। কেউ যে কাল পেরিয়ে যেতে পারেনা জীয়ন্তে! অথচ ঐ বুড়ো দাদুর কি যে স্নেহ,বারে বারে ধরা দিতে চান কচি কচি আঙুলগুলোর মধ্যে। ঐ শিরাওঠা হাতগুলো ওঁর, কি কোমল কি স্নিগ্‌ধ!
    জলদা হয়ে কোর্টের বাইরে পড়ে যাওয়া বালিকাটিকে নিজের পাশে ডেকে এনে খেলতেন তিনি, ওর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু যা কেউ কোনোদিন দেখেনি-তা উনি মুছে দিতেন ওঁর সাদা উত্তরীয়ে। দখিন বাতাসে শুকিয়ে যেতো সে জলের দাগ।
    মার্চের বিকেলে কি মনকেমনকরা বাতাস বইতো! ছাদের উপর থেকে কত দূর পর্যন্ত দেখা যেতো।ঐ দূরে পশ্চিমে গাছের ঘন সবুজ রেখা নীল হয়ে আসতো,সেখানে আকাশে নীল বুকে মিশে গেছে পৃথিবীর সবুজ আঁচলটি। দিগন্তকুহেলী এসে ঢেকে দিয়েছে সে ঘন রহস্য।

    সবাই যখন ব্যস্ত থাকে নানা কাজে অকাজে,তখনই কি কুঁড়িরা ফুল হয়ে ফুটে যায়? আকাশ থেকে টুপ টুপ করে তারাগুলো কি তখন নেমে পড়ে সমুদ্দুরে?
    ঐ তো ওরা গানের ক্লাসে চলে যাচ্ছে খাতা বগলে নিয়ে, শনিবারের বিকেলমাঠ একলা পড়ে আছে,কেউ আজ খেলবে না কিৎকিৎ,কাকজোড়া বুড়ী বসন্তী,ভাইবোন বা এমনি এমনি কোনো তখনি বানানো খেলা।তাই বুঝি মাঠের মনখারাপ? কোণের খেজুরগাছগুলোরও মনখারাপ? তাই মাঠ শনিবারের বিকেল এলেই অমন চুপ হয়ে যায়?

    মাঠের পাশে ঐ তো ঝুনিদিদিদের বাগান- জিনিয়া ফুল লাগায় ওরা। আর কত রঙের গোলাপ। তুলতে পারা যায় না। সবসময় বুড়ো রাগী একটা লোক পাহারা দেয়। ঝুনিদিদির রিটায়ার করা বাবা।রিটায়ার করলে কি লোকে খুব রাগী হয়ে যায়? কাজকর্ম থাকে না বলে? তখন খালি চোর ধরার মতলব খোঁজে?

    ঝুনিদিদের পাশেই অনুদের বাড়ী,ওর ভালো নাম অনুব্রতা। ওখানে কতকিছুই হবে,আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী, পর পর বেশ অনেক বছর ওদের প্রশস্ত ছাদে, তারপরে একদিন আমাদের উল্কা দেখার রাত্রি। একদিন ওর বাবার স্মৃতিসভাও।

    তরতর কলকল করে বয়ে যায় নদী,অদ্ভুত শব্দ ওঠে তীরে তীরে। অথচ এই কালনদীটি নিত্য বহমানা,তবু কি নি:শব্দ!

    আমিই কি দাঁড়িয়ে গেলাম হঠাৎ,নদীপারের সিডার গাছটির মতন? চুপচাপ স্থবির হয়ে? খেলা বন্ধ হয়ে গেলো? আর নতুন দিনগুলো হাতের মুঠো বন্ধ করে দুষ্টু দুষ্টু হাসিমুখে বলছে না,"বলো তো কি আছে?"

    অথচ কি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখনো ক্লাস ফোরের সেই নতুন ঘরখানা, দোতলায়,দক্ষিণের জানালায় আমগাছের মাথা, উত্তরে ফাঁকা, পুবের দিকে ছোট্টো মাঠখানা, ঐদিকের জানালার পাশেই ব্ল্যাকবোর্ডখানা রাখা। সদাবিষন্ন পুষ্পাদিদিমণি ক্লাস টিচার। বয়স্ক মহিলা সবসময় সরু পাড়ের সাদা একখানা শাড়ী কুঁচি না দিয়ে সাধারণভাবে পরতেন, মুখে হাসি দেখা ছিলো অত্যন্ত বিরল ঘটনা। উনি অঙ্ক করাতেন আমাদের। হাসিবিহীন কঠিন কর্তব্যের মতন বোর্ডে বুঝিয়ে বুঝিয়ে করাতেন পাটিগণিত, ভগ্নাংশ, গুননীয়ক গুণিতক। ঐ তো দেখতে পাচ্ছি পশ্চিমের দেয়ালে ঝোলানো অনেক অনেক ছবি, আগের বছরের দাদাদিদিরা দিয়েছিলো। এখন সেই দিদিরা অনেকেই দুটো মোড় পার হয়ে যে বড়ো হাইস্কুল, সেখানে পড়ে। আমরাও যাবো পরের বছর। তাই ঐ ছবিগুলো দেখলেই আমাদের ডানার কুঁড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে। যেন দিনবদলের ছাড়পত্রের গন্ধ লেগে থাকে ঐ ছবি ঝোলানো দেয়ালে। অপটু হাতের
    বালকবালিকাদের জলরঙে বা প্যাস্টেলে আঁকা ছবি, কত যত্ন করে বাঁধিয়ে রেখেছেন দিদিমণিরা। এই ক্লাসরুমটাই তো একদম নতুন,চালু হোলো মোটে গত বছর।
    সোমাদির হাতের সৌরজগৎ এর ছবিখানা কি যে আবিষ্ট করে দিতো!অথচ রঙবিহীন জ্যামিতি শুধু। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো দিয়ে আঁকা সব গ্রহগুলো আর কক্ষপথসমূহ, মাপের ও কোনো মাবাপ নেই। অথচ কি য হোতো ও ছবিটার দিকে তাকালে, শিরশির করতো সারা গা। তাই ওটার দিকে তাকাতুম না ছুটির আগের পিরিয়ডগুলোতে। ছুটির সময় তাকিয়ে নিয়ে বাড়ী ফেরা, আহা ঐ শিরশিরাণিটা সঙ্গে লেগে থাকতো পথটুকু জুড়ে।
    হাঁটাপথের পাশে পুকুর,মধুফুলের ঝোপ, খাটালে মস্ত মস্ত কালো কালো মোষ, ছোটো একটি গুমটি দোকান, মস্ত পাঁচিলে ঘেরা প্রাসাদের মতন একটি বাড়ী, বাড়ীর নাম নফর ধাম। আহা, অত বড়োলোক কেন নফর হবে? কারই বা নফর সে?
    এইসব প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে দৃশ্যপট বদলে গিয়ে এইবারে এসে গেলো বড়োমাঠ,সেখানে এখন কেউ নেই বটে,তবে আরেকটু পরেই বড়ো দাদারা ফুটবল খেলতে আসবে।

    এইবারে বাড়ী। বইয়ের ব্যাগ রেখে হাতমুখ ধুয়ে খেলতে যাওয়া, আমাদের খেজুরতলার মাঠে। পুতুল মামণি পারমিতা, পম্পি,টুম্পা রুম্পা দুই টুলটুলে বোন, মেনেদি,মৌদি,সোনাদি। জয়দা,টুটুনদা সোমেনদা,শিব্রামদা। কত নাম মনে পড়ছে। গরমকালের বিকেলগুলোতে অনেক সময় পাওয়া যেতো,টুপ করে সূর্য ডুবে যেতো না তাড়াতাড়ি। অনেকক্ষণ খেলা জমতো। তারপরে ধুলোপায়ে বাড়ী ফিরে কুয়োর ঠান্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসা। বেশীরভাগ দিনই লোডশেডিং, তাই হ্যারিকেন লন্ঠনের আলোতে পড়াশুনো।

    তবুও কুলকুল করে এসবের আড়ালে আড়ালে বয়ে যায় সময়, একা একা লাগে খুব। কোথায় যেন তীব্র দলছুট হৃদয় আমার নির্জন বনে পলাশগাছের নীচে একা দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুণি যেন কোথা থেকে উড়ে আসবে এক অলৌকিক নীলপাখি,ওর একটি পালক উড়ে এসে পড়বে আমার ফ্রকের সামনের কুঁচিতে।
    অনু একটু আলাদা রকমের কাছের বন্ধু,বারে বারে ভাব আড়ি ভাব আড়ি করে করে কোথায় যেন মিল হয়ে গেছে ওর মনের সঙ্গে আমার। জানিনে এ কতদিনের অথবা সত্যি কিনা,তবু অবাক লাগে। আর কারুর সঙ্গে তো এমন হয় নি!
    "ঐ দ্যাখ মিলি তিনখানা জ্বলজ্বলে তারা একলাইনে, কালপুরুষের কোমরবন্ধ।" বসন্তের সন্ধ্যায় দক্ষিণ আকাশে অঙ্গুলিনির্দেশ করে অনুই তো বলছে,ঐ তো কেমন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! মানুষের স্মৃতি কি সময়ের নদীর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে? তীরবর্তী সিডার গাছটির মতন?
    অগণ্য তারা ছড়ানো নির্মল বাসন্তী সন্ধ্যায় কি এক তরঙ্গ এসে লাগে প্রাণের কোন্‌ গোপণ গভীর নিশীথবীনায়, যেখানে কে যেন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আমার জন্য,নীরব,অন্ধকার,তার মুখ দেখা যায় না। এই কি সেই "ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন/ তলাতল খুঁজলে পাতাল পাবি রে সেই কৃষ্ণধন।" এই কি সেই।সেই, সেই, সেই?
    আমি এইবারে অনুকে চেনাচ্ছি সপ্তর্ষি, রাজহংসমন্ডল, অভিজিৎ- নীল তারাটি---সে কবে? কতকালের পরে? কত জল বয়ে গেছিলো মাঝে পৃথিবীর সমস্ত নদীতে নদীতে? গঙ্গায় নীলে মিসৌরিতে ওব ইনিসি লেনায়?
    "জানিস মিলি, আমার কাকে সবচেয়ে ভালো লাগে? "
    "কাকে?"
    আবার হাত আকাশে বাড়িয়ে দিয়ে অনু বলে,"কালপুরুষকে।"
    কালপুরুষের জন্য তীব্র তৃষ্ণা মনে লুকিয়ে রেখে আমি ঝট করে বলে দিই,"আমার ভালো লাগে সপ্তর্ষিকে।"
    অনুব্রতা হেসে লুটিয়ে পড়ে প্রায়,"ওরে বাবা, সাতজনকে? "

    তার কতকাল পরে,সদ্য বিবাহিতা অনুব্রতা বস্ত্রালংকারে সুসজ্জিতা হয়ে স্বামীর সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে এসেছে,পরিজনেরা জিনিসপত্র সমেত তুলে দিলো ওদের কামরায়, ব্যাঙ্গলোরগামী দম্পতির সামনে সন্ধ্যার খোলা জানালায় ঝলমল করে কালপুরুষ। শৈশব কৈশোর ছেড়ে যাবার বেদনায় অনু নীরবে উঠে চোখে জল দিতে যায়,এক একা কালপুরুষের দিকে চেয়ে ওর আয়ত চোখ দুটি জলে ভরে যায়।
    পৃথিবীর সংসার কি অয়স্কঠিন! সব স্বপ্ন কেমন শ্যাওলা ধরে যায়,কত তাড়াতাড়ি মিছা হয়ে হয়ে যায়।
    "তোকে দিলাম তোকে দিলাম তোকে দিলাম মিলি, আমার কালপুরুষ তোকে দিলাম।"
    নির্বিকাল রেলগাড়ী চলে ঝম্‌জ্‌হমঝমঝম,সব চেনা কিছু দূরে মিলিয়ে যায়,ঠিক তখন আমি সন্ধ্যার ছাদে।কালপুরুষ আমার দিকে চেয়ে ভ্রূভঙ্গী করলেন,কতকাল আগে থেকেই তো সবটা রহস্য তিনি জানেন। আমি দুহাত প্রসারিত করে যতটা সম্ভব ততটা আঁকড়ে ধরি এই ক্ষুদ্র বাহুদ্বয়ে,মুখ গুঁজে দিই ঐ নীহারিকায়। ওর হাতদুটি অস্ত্র মুক্ত হয়ে নেমে এসেছে আমার মাথার চুলের উপরে।
    প্রার্থনা করি, "কখনো কখনো কখনো যেন সংসার না নিতে পারে আমাকে ছিঁড়ে তোমার বুক থেকে।" এতকালের সযত্ন সঞ্চিত অশ্রু অঝোরে ঝরে পড়ে অবারিত ভিজিয়ে দিতে থাকে ওর নীল বুক।
    সে হাসে, ওর থেকে ছিঁড়ে নেবে, এমন সাধ্য কি থাকতে পারে কখনো ক্ষুদ্র পৃথিবীর সংসারের?

    সময়ের নীলধারার পাশে শান্ত নগ্রোধ বৃক্ষটির মতন পাখিটিকে কোলে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অজ নিত্য শাশ্বত আলো-অন্ধকারের হৃদয়।
  • Sayantan | 59.160.140.1 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ১৮:০৯451341
  • অদ্ভুত সুন্দর মিলিদি, অসম্ভব ভালো লাগলো, কবে যেন পড়েছিলাম, জলের বুকে কালপুরুষের ছায়া দেখলে সব ঠিকানা হারিয়ে যায় ...
  • trq | 211.28.40.185 | ০৬ মার্চ ২০০৬ ২০:০২451343
  • " শোন মিলি,
    দু:খ তার বিষমাখা তীরে,
    তোকে বিঁধে বারংবার।
    তবু নিশ্চিত জানি,
    একদিন হবে তোর সোনার সংসার।

    উঠোনে এসে পড়বে এক ফালি রোদ,
    পাশে শিশু গুটিকয়;
    তাহাদের ধূলোমাখা হাতে ধরা দেবে
    পৃথিবীর সকল বিস্ময়। '

    - হুমায়ুন আহমেদ।
    "কবি'- উপন্যাসে।

    নামটা কিন্তু মিলি-ই ছিলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন