এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • achintyarup | 59.93.243.86 | ১০ জুন ২০১১ ০৫:০৮480453
  • তখনকার দিনে (১১শত শতাব্দীর শেষ ভাগের কথা) ঐ সকল গ্রামে যাইতে নল খাগ্‌ড়া নামক জলজ অথচ স্থলেও বর্দ্ধিতায়মান্‌ একপ্রকার জ্বালানীযোগ্য ও নানাবিধ শিল্পকার্য্য উপযোগী বনের গভীর অরণ্য অতিক্রম করিয়া জাইতে হইত। রাস্থা দুর্গম ছিল, ব্যাঘ্রাদি হিংস্র পশুগণের ভীতিও যথেষ্ট ছিল। সুতরাং সহজে কেহ যাইতে সাহস করিত না। ব্রাহ্মণগণ নিমন্ত্রণ রক্ষা ও প্রচুর দক্ষীণা পাওয়ার আশায় কখন২ যাইতেন।

    জয়গোবিন্দ রায় তখনই ভৃত্যকে তামাক দেওয়ার আদেশ করত: খানাবাড়ী সংলগ্ন বাসী প্রধান গোয়ালাকে আহ্বান করিলেন, এবং উপস্থিত ব্রাহ্মণমণ্ডলীকে দেখাইয়া বলিলেন, তাঁহাদের ভোজনপযোগী দধি, দুগ্‌ধ ও খির লইয়া আইস। তখনকার দিনে দধিদুগে্‌ধর প্রাচুর্য্যতা ছিল; গো, মহিষ পোষিবার ও তাহাদের খাদ্যাদি সংগ্রহের জন্য কোন আয়াস পাইতে হইত না; পতিত অনাবাদী তৃণাদি পরিবৃত ভূখণ্ড গ্রামের সম্মুখভাগে বৃহদায়তনে বিস্তারিত থাকিত। গোমহিষাদি যথেচ্ছ বিচরণ করিয়া উদর পূর্ণ করিত ও হৃষ্টপুষ্ট হইয়া গৃহস্ত গৃহের শোভা বর্দ্ধন করিত। গোয়ালাদিগের ঘরে২ প্রচুর দধি দুগ্‌ধাদি স্থিত থাকিত। ঘোল কেহ খাইত না, অধিকাংশই ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হইত।

    প্রয়োজন মত দধিদুগ্‌ধাদি উপস্থিত হইলে ব্রাহ্মণগণকে অতি পরিতোষ সহকারে রায় মহাশয় ভোজন করাইলেন ও বিনয়নম্র বচনে তাঁহাদের তৃপ্তিসাধন করিতে ত্রুটী করিলেন না। তখনকার সময়ে দধিচিড়া ও খৈ সহযোগে দুগ্‌ধ ও খির ভক্ষণ বিশেষরূপ প্রচলীত ছিল। সামাজিক বহ্বারম্ভ নিমন্ত্রণেও অন্নাদির ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষত: ব্রাহ্মণগণ ব্রাহ্মণেতর জাতীর গৃহে অন্নগ্রহণ দুষণীয় মনে করিতেন। যথোপযুক্তাপেক্ষা অধিকতর দক্ষিণা পাইয়া ভূদেবগণ আশীর্বাদ করিতে২ প্রফুল্লবদনে গৃহে ফিরিলেন। এরূপ অযাচিত ভোজন ব্যাপার ও দানাদি রায় মহাশয়ের নিত্য কার্য্য মধ্যেই গণ্য ছিল; অতিথি, অভ্যাগত, অর্থী, প্রত্যর্থী কখন বিমুখ হইত না। এসকল তাঁহার সদাব্রত ছিল।

    গ্রামে সামাজিক সাশনের কর্ত্তৃত্বভার তাঁহার উপরই ন্যস্ত ছিল। তাঁহার নিরপেক্ষ ব্যবহার ও ব্যবস্থায় কেহই অসন্তুষ্ট হইত না।
  • kumudini | 122.160.159.184 | ১০ জুন ২০১১ ১১:০৫480454
  • ১।ব্রাহ্মণদের নিজস্ব জীবিকা ছিল নিশ্চয়ই,দক্ষিণা ই: অতিরিক্ত উপার্জন।

    ২।দুধ,দই,ক্ষীর-একইসাথে খাওয়া হতো।
  • saikat | 202.54.74.119 | ১০ জুন ২০১১ ১১:১১480455
  • দুধ-চিঁড়ে আর দই-চিঁড়ে, দুটোই অখাইদ্য।

    কী করে যে খাওয়া হয় বুঝি না।
  • siki | 123.242.248.130 | ১০ জুন ২০১১ ১১:১৪480456
  • দই-চিঁড়ে আমি খুব ভালোবাসি খেতে।

    বামুনের তেজ যাবে কোথায়!
  • Nina | 12.149.39.84 | ১০ জুন ২০১১ ২২:৪২480457
  • দুধে দই মেশালে কেটে যাবেনা?? দই চিঁড়ে বেশ ভাল খেতে, ক্ষীর মেশালে তো কথাই নেই।
  • achintyarup | 59.93.243.155 | ১১ জুন ২০১১ ০৫:০০480458
  • কৃষ্ণচন্দ্র।

    জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের একমাত্র পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র বাল্যকাল অতিক্রমের পর পিতৃসমীপে ময়মনসিংহ নগরে বাসাবাটীতে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করত: যৌবনকালে দারগার (subinspector) পদগ্রহণে গবর্ণমেণ্টের চাকুরী স্বীকার পূর্ব্বক গাবতলী থানার ভার গ্রহণ করিলেন। তিনি যেমন রূপবান সুপুরুষ তেমনি তেজোগর্ব্ব সম্পন্ন যুবক ছিলেন। সে পদ তাঁহার পক্ষে শোভন হইল ও পিতাও তাহা অনুমোদন করিলেন। তখন কোম্পানির আমল, জেলার থানাওয়ারী বিভাগ বন্দবস্থের প্রথম সূত্রপাত ও আরম্ভাবস্থা। সদরের নিকটে গাবতলীই প্রথম পোলীষ স্টেশন। কৃষ্ণচন্দ্র অতি দক্ষতা সহকারে কার্য্যে প্রবৃত্ত রহিলেন।

    এই সময়ে পুত্রের বিবাহের প্রস্তাব হইলে, জয়গোবিন্দ রায় মহাশয় বলিলেন, হাজরাদী পরগণার সর্ব্বপ্রধান বংশে যে কন্যা মিলিবে তাহার সহিতই কৃষ্ণচন্দ্রের পাণিগ্রহণ হইবে। সৌভাগ্যক্রমে ভাল বংশেই কন্যা জুটীল। কাহেস্তপল্লী গ্রামের (মস্তকী) দত্তবংশে প্রথম শ্রেণীর ঘরে পাত্রী নির্ব্বাচন হইল। এ সম্বন্ধে একটু রহস্যের উদ্ভব হইল। পাত্রীর পিতা বর্ত্তমান ছিলেন না, মাতাই কন্যা সম্প্রদান করার অধিকারিণী, তিনি রূপবান বিষয়ী প্রভূত বিত্ত সম্পত্তি ও ধনগৌরবে গৌরবান্নিত পাত্র দেখিয়া বিমোহিতা হইলেন। কিন্তু পাত্রীর মাতুল প্রভৃতি আত্মীয়গণ তাহাতে অসম্মত হইয়া বিরুদ্ধাচরণ করিবেন প্রকাশ পাইল। জয়গোবিন্দ রায় ভীত হইবার লোক নহেন। পাত্রীর মাতাকে অভয় প্রদান করিয়া কন্যাযাত্রীদের সাহায্যার্থে ৫ শত লাটী সর্‌কীধারী বলবান ""লাটীয়াল'' সহ কন্যা আনয়নের শোভাযাত্রার মিছিল প্রেরণ করিলেন। বাদ্যভাণ্ডাদি ধুমধামের আতিশয্য ও লাটীয়াল বহুল জনতা দর্শনে বিপক্ষ পক্ষ গা ঢাকা দিলেন। নিরাপদে নিজালয়ে কন্যা আনয়ন করত: মহাসমারোহে বিবাহ উৎসবরূপ বিরাট ব্যাপার সুসম্পন্ন ও দান ভোজনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করিলেন। জয়গোবিন্দ রায়ের প্রবল প্রতাপ বিঘোষিত হইল।

    কৃষ্ণচন্দ্র একদা বৃহদাকার ঘোটকারোহণে মপস্বল পরিভ্রমণে বাহির হইলেন। পথিমধ্যে কোনও স্থানে সেকেন্দর নগরের ""সা সাহেব'' নামক প্রসিদ্ধ ফকীর ও পির (গুরু) সাধক প্রবর বাক্‌সিদ্ধ পুরুষ সহ তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। তিনি উক্ত সাহেবের গুণগ্রাম কিছু জানিতেন না এবং পরিচয় ছিল না, তিনি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ কি সম্মান সম্ভ্রমাদি কিছুই না করিয়া চলিয়া গেলেন। সা সাহেব বলিয়া উঠিলেন ""বাঞ্চৎ পাগল কি দেওয়ানা হে''। এই উক্তির পরই দেখা গেল কৃষ্ণচন্দ্র আর প্রকৃতিস্থ নহেন। ঘোটকসহ বিপথে চালিত হইলেন। ঘুড়িতে২ মধুপুরের গভীর গজারীবনের অরণ্যানীতে উপস্থিত হইলেন। সঙ্গিয় লোকজন হতবুদ্ধি হইয়া ময়মনসিংহ বাসাবাটীতে জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়কে সংবাদ প্রদান করিল। বজ্রাঘাতের ন্যায় এ সংবাদ পিতৃহৃদয়ে আঘাত করিল। ৭ দিন পর কৃষ্ণচন্দ্রকে বাসায় ফিরাইয়া আনা হইল।

    যথোচিত চিকিৎসা ও শুশ্রুষাদি সত্যেও কৃষ্ণচন্দ্রের মানসিক বিকারাবস্থা দূর হইল না। বৎসরাবধিকাল এভাবে থাকিয়া শোকে দু:খে মুহ্যমান পিতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে দু:খসাগরে ভাসাইয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন। এ হেন রূপ-গুণবান যুবক একমাত্র সম্বল পুত্রকে হাড়াইয়া জয়গোবিন্দ রায় সংসারের অনিত্যতা অনুভবে অন্ধকার বোধ করিতে লাগিলেন।
  • achintyarup | 59.93.243.155 | ১১ জুন ২০১১ ০৫:২৫480459
  • কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে তৎপত্নী নি:সন্তান অবস্থায় পরলোকগামিনী হইলেন। এইরূপে জয়গোবিন্দ রায়ের ভবিষ্যত বংশ বিলুপ্ত হইল। জয়গোবিন্দ রায়ের কন্যাদ্বয় মধ্যে একজনকে বনগ্রামের চৌধুরী বংশে ও অপরাকে যশোদলের আঁইচ রায়দিগের বংশে সম্প্রদান করিয়াছিলেন। বনগ্রামের কন্যা নি:সন্তানাবস্থায় বিধবা হইয়া কাল কবলে পতিত হন। যশোদলের কন্যাকে কাশীকিশোর রায় বিবাহ করিয়াছিলেন। কাশী রায় উকীল ছিলেন; তাঁহার ঔরষে দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করে। জ্যেষ্ঠ কমললোচন, কনিষ্ঠ ত্রিলোচন। ইহারাই জয়গোবিন্দ রায়ের ভাবী ওয়ারিষ ও তাঁহার সান্ত্বনার স্থলবর্ত্তী হইল।

    নিদারুণ পুত্রশোকে রায় মহাশয়ের শারীরিক ও মানসিক অবসন্নতা ঘটীল। কাজকর্ম্ম বিষবৎ বোধ হইতে লাগিল, জীবন অকর্ম্মণ্য ও অন্ধকারময় হইল। নশ্বরদেহের আর মমতা রহিল না, দিন দিন দুর্ব্বল হইতে দুর্ব্বলতর হইয়া তাহা মৃত্যুর দিকে গড়াইতে লাগিল। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর কতিপয় বৎসর পরেই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, অর্থী প্রত্যর্থী সকলকে শোক সাগরে ভাসাইয়া গরীব দু:খীর একামাত্র আশ্রয় ও বিপন্নের বন্ধু স্বগ্রাম ও ময়মনসিংহ নগরের কীর্ত্তিস্তম্ভ জয়গোবিন্দ রায় স্বর্গধামে প্রয়াণ করিলেন। ""চলৎ চিত্তং চলৎ বিত্তং চলৎ জীবন যৌবনং চলাচলমিদংসর্ব্বে কীর্ত্তি যস্য স জীবতি:'' এই নীতিবাক্যের সার্থকতা প্রতিপন্ন হইল, জয়গোবিন্দ রায় মরিয়াও মরিলেন না। তাঁহার অক্ষয় কীর্ত্তি তাঁহাকে জিবিত রাখিল! মৃত্যুকালে তাঁহার পত্নী বর্ত্তমানা ছিলেন না।
  • kumudini | 122.160.159.184 | ১১ জুন ২০১১ ১৩:১৫480460
  • ১।একজন সুস্থ সবল যুবক হঠাৎ মানসুক স্থিতি হারিয়ে ফেললেন-এর অন্য কোন কারণ থাকা সম্ভব।
    ২।শেষ জীবনে ভূদেবতাগণের সেবার ফল পাননি জয়চন্দ্র।
  • kumudini | 122.160.159.184 | ১১ জুন ২০১১ ১৩:১৭480461
  • দু:খিত,জয়গোবিন্দ।
  • achintyarup | 59.93.241.5 | ১২ জুন ২০১১ ০৫:৫৮480463
  • রাজকৃষ্ণ রায়।

    এখন রাজকৃষ্ণের কথা বলিব। রাজকৃষ্ণকে বিশেষ যত্ন করা সঙ্কেÄও জয়গোবিন্দ রায় তাঁহাকে বিদ্যাভ্যাসে মনোযোগী করাইতে না পারিয়া বাড়ীর কর্তৃত্ব ভার ন্যস্ত করত: তাঁহাকে বাড়ীতে রাখেন; অতি সামান্য লিখাপড়া মাত্র রাজকৃষ্ণ শিখিয়া ছিলেন। তিনি সরল, ধর্ম্মভীরু ছিলেন। বৈষয়ীক জ্ঞান তত প্রখর ছিল না। তাঁহার তিন পুত্র, রাজচন্দ্র, শ্যামচন্দ্র ও রামকানাই। জয়গোবিন্দের অভাব সময়ে তাঁহারা কেউই বয়:প্রাপ্ত ছিলেন না।

    জয়গোবিন্দ রায়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁহার কন্যাজামাতা কাশীকিশোর রায় রাজকৃষ্ণ রায়ের নিকট উপস্থিত হইয়া অর্দ্ধসম্পত্তির দখলপ্রাপ্তির কথা প্রকাশ করিলেন। রাজকৃষ্ণ সরল লোক, তিনি জানিতেন সকল সম্পত্তিইঁ গোবিন্দজিউ বিগ্রহের সেবার জন্য দাদা করিয়া গিয়াছেন। ভাগবণ্টন করিয়া ভোগ দখল করার কাহারও অধিকার নাই। সুতরাং তিনি কাশী রায়কে জানাইলেন --ঁ ঠাকুরের সম্পত্তি ভাগ কিরূপে হইবে?

    কাশী রায় মহাশয় বলিলেন যদি দেবোত্তরের কোন দলীল থাকে তবেই সম্পত্তি দেবোত্তর হইতে পারে। জয়গোবিন্দ রায় তৎ সম্বন্ধে কোন দলীল করিয়া যান নাইঅ সুতরাং রাজকৃষ্ণ কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। কাশী রায় মহাশয় সম্পত্তি দখলের উদ্যোগ করিলে, খানাবাড়ীর ভাণ্ডারীর দল ক্ষেপিয়া উঠিল, একদা কাশী রায় মহাশয় শ্বশুরালয়ে আসিলে রাজকৃষ্ণ রায়ের অজ্ঞাতে ভৃত্যগণ কাশী রায়কে ঠাকুরদালানের মাল্‌খানার কামরায় আটক করিয়া রাখিল এবং তাহারা কাশী রায় মহাশয়কে বলিল যদি সম্পত্তি পাইয়াই থাকেন তবেঁ ঠাকুরের সেবার্থে সম্পত্তি রাজকৃষ্ণ রায়কে ছাড়িয়া দিয়া যান।

    অল্পক্ষণ পরেই রাজকৃষ্ণ রায় এ সংবাদ পাইয়া মাল্‌খানায় আসিলেন এবং ভাণ্ডারির দলকে ভর্ৎসনা করিয়া কাশী রায়কে মূক্ত করিলেন, এবং যথাযোগ্য জামাতার সম্মানে স্নানাহার করাইয়া খুড়্‌তত শ্বশুরের কর্ত্তব্য পালনে ত্রুটী করিলেন না।

    সেই ক্রোধে ও অপমানে অত্যল্প কাল পরেই অর্দ্ধসম্পত্তি পাওয়ার দাবীতে জেলার জজ আদালতে তৎপুত্রদ্বয়ের অভিভাবক স্বরূপে কাশী রায় মোকদ্দমা উপস্থিত করিলেন। এই মোকদ্দমা বহুদিন চলিল। ইতিমধ্যে রাজকৃষ্ণের পুত্রগণ কেহ২ বয়:প্রাপ্ত হইলেন। পিতার শেষ অবস্থা ও বৈষয়িক জ্ঞানের অভাব দেখিয়া এবং মোকদ্দমার ফলাফল অনিশ্চিত জানিয়া হাইকোর্টে আপীল দায়ের অবস্থায় মোকদ্দমা আপোষে মিমাংসা করাই কর্ত্তব্য মনে করিয়া রাজকৃষ্ণ রায়ের পুত্রগণ পিতাকে বলিয়া কহিয়া ও জেঠ্‌তাত ভগ্নির (কাশী রায়ের স্ত্রী) অনুরোধে মোকদ্দমা আপোষ মিমাংসা করিলেন। কাশী রায়ের পত্নী মধ্যবর্ত্তিনী হইয়া খুড়্‌তত ভাই তিনজন হেতু তুল্যাংশে সম্পত্তি ভাগ না করিয়া ।।/০ আনা ।/০ আনা হিস্যারূপে বিভাগ করিলেন, খুড়্‌তত ভাই দিগকে ।।/০ আনা দিলেন। নিজের পুত্রদ্বয়ের জন্য ।/০ আনা রাখিলেন এবং যে পর্য্যন্ত তিনি (জয়গোবিন্দ রায়ের কন্যা) বর্ত্তমান থাকিবেন তৎকাল পর্য্যন্ত ঐ ।/০ সাত আনা সম্পত্তিও রাজকৃষ্ণ রায়ের পুত্রগণের হস্তেই থাকিবে। বাৎসরিক যে নিট লভ্য হইবে তাহাই তিনি তদ্দিগ হইতে গ্রহণ করিবেন এই ব্যবস্থা............ প্রকাশ পাইল এবং রাজকৃষ্ণ রায়ের সান্ত্বনাও ................. সম্পত্তিগুলী আপোষ বণ্টনে অর্দ্ধেক কাশী রায় মহাশয় হস্তগত করিলেন। তৎপত্নীর জীবিত কাল পর্য্যন্ত সম্পত্তি সাশন পরিচালনা এইভাবেই চলিল। তদভাবে কমললোচন রায় সাবালক হইয়া সম্পত্তি নিজহস্তে গ্রহণ করিলেন এবং সুসাশনের পরিবর্ত্তে নানারূপ অবিহিত আচার ব্যবহারে প্রজাকূল নির্ম্মূল করিলেন। খানাবাড়ীর চতুষ্পার্শ্বস্থ প্রজাগণ উঠিয়া গেল। তাহাদের বাস্তুভিটা অরণ্যে পরিণত হইল।

    রাজকৃষ্ণ রায় শেষাবস্থায় মোকদ্দমায় জড়িত হওয়ায় প্রভূত ঋণজালে জ্বালাতন হইয়া অনেক সম্পত্তি হস্তচ্যূত করিলেন। আরও ।/০ আনা সম্পত্তি বাহির হইয়া যাওয়ায় তালুকদারীর আয় অনেক কমিয়া গেল। যথা সময়ে অতী বৃদ্ধাবস্থায় তিন বয়:প্রাপ্ত পুত্র ও এক কন্যা বর্ত্তমান রাখিয়া রাজকৃষ্ণ পরলোকগামী হইলেন।

    রাজকৃষ্ণের পুত্রগণ জয়গোবিন্দ রায়ের আমলের সুখ সৌভাগ্য কিছুরই অধিকারী হইলেন না। বাড়ীঘরের অবস্থাও শোচনীয়,ঁ ঠাকুর সেবা বন্ধ ও ঠাকুর পুরহিতের আশ্রিত হইলেন। ।।৯০ দশকালী মাত্র জমী ঠাকুর সেবার পরিবর্ত্তে পুরহিতের জিম্মায় দেওয়া হইল। শূণ্য সিংহাসনে বিশ্বম্ভর পূজিত হইতে লাগিলেন। একথা পূর্ব্বেই উল্লেখ করা গিয়াছে।

    রাজকৃষ্ণের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ পুত্র রাজচন্দ্র রায় পিতৃপ্রকৃতি অনেকটা অনুকরণ করিলেন। লিখাপড়া বিশেষ কিছু শিখিলেন না, বাড়ীতে ............. যে টুক্‌ তাঁহা দ্বারা চলে সেই পর্য্যন্তই ......

    ........... মধ্যমপুত্র শ্যামচন্দ্র রায় বাঙ্গলা ও পার্শী ভাষায় কিছু জ্ঞান লাভ করিলেন। তিনিই সংসারের কর্ত্তৃত্বভার গ্রহণ করিলেন। তালুকদারীর আয় দ্বারা সংসার চলে না দেখিয়া সর্ব্বকনিষ্ঠ রামকানাই রায় খামার জমীগুলী চাকর দ্বারা নিজ করায়ত্তে রাখিয়া চাসাবাদ করাইলে অধিক লাভ হইবে বিবেচনায় শ্যাম রায় মহাশয়ের পরামর্শানুসারে এক বিস্তৃত গৃহস্তির কারবার আরম্ভ করিলেন। শ্যাম রায় মহাশয় খাস মহাল প্রভৃতি ইজারা বন্দবস্থ করিয়া আয়বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। গৃহস্তিতেও লাভ দাঁড়াইল; উভয়প্রকার আয়ের সংস্থানে সংসার আবার ভাসিয়া উঠিল। রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ও গৃহস্তি কার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন। টাকা লগ্নি কারবার আরম্ভ হইল। রাজচন্দ্র রায় এক লগ্নি কারবার খুলিলেন। শ্যাম রায়ও পৃথকরূপে এক কারবার খুলিলেন। রামকানাই রায় গৃহস্তি চালাইতে লাগিলেন এবং মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি বাহিরের কার্য্যভারও তিনিই গ্রহণ করিলেন।

    এই সময়ে বাঙ্গলা ১২৬২ সালে গবর্ণমেণ্ট পক্ষে বাঙ্গলাদেশে থাকবস্থ জরীপ আরম্ভ হইল। তৎ সংসৃষ্টে অনেক মোকদ্দমাদির সৃষ্টি হইল। রামকানাই রায় ঐ সকল বিষয়..........ন্তু রাজকৃষ্ণ রায়ের কর্মশৈথিল্যে ............. সেই সময় আবার কতকগুলী তালুক... হস্তচ্যূত হইয়া গেল। রামকানাই রায় মহাশয় থাকবস্থ স.. বহু মোকদ্দমায় অক্লান্ত যত্ন, পরিশ্রম ও বহু অর্থ ব্যয় করিয়াও সে সকল বিত্ত উদ্ধার করিতে অপারগ হইলেন।

    --------------
  • achintyarup | 59.93.242.103 | ১৩ জুন ২০১১ ০৪:৩৭480464
  • আত্মকথা।

    ২য় পরিচ্ছেদ।

    ঁরাজচন্দ্র রায়।

    রাজচন্দ্র রায় মহাশয় অজ্ঞাতসারে জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের ধর্ম্মপ্রবণতার ছায়া যেন অনুসরণ করিতে লাগিলেন। যদিও তিনি বিশেষ লিখাপড়া শিখেন নাই, তথাপি তাঁহার শাস্ত্রজ্ঞান প্রখর ছিল। পঞ্জিকা দেখিয়া দিন ক্ষণ ঠিক করা তাঁহার নিত্য কার্য্য ছিল। তাহাতে তাঁহার গভীর জ্ঞান জন্মিয়াছিল। প্রতিবেশী লোকেরা প্রায় সকলই তাঁহা দ্বারা পঞ্জিকা দেখাইয়া, যাত্রা ও বিবাহাদি দশসংস্কারের কার্য্য করিতে দেখিয়াছি। অপর পণ্ডিতে দেখিলেও লোকের মনের সন্দেহ নিরসন হইত না, যতক্ষণ না রাজচন্দ্র রায় মহাশয় তাহা ঠিক বলিয়া সাব্যস্থ না করিতেন। বিশেষ সে সময়ে গ্রামে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বড় কেহ ছিলেন না, অন্যগ্রাম হইতে পণ্ডিতের বিধিব্যবস্থা যখন তখন গ্রহণ করিতে বিশেষ আয়াশ স্বীকার করিতে হইত। তাইঅ রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের সর্ব্বক্ষণ পঞ্জিকা আলোচনায় তাঁহার প্রতিভা ফুটীয়া উঠিয়াছিল।

    পঞ্জিকা আলোচনার আর একটা উদ্দেশ্যও ছিল। ভাল দিন, তিথী ও যোগ দেখিয়া তিনি শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী ধর্ম্মকর্মাদি সদা সর্ব্বদা করিতেন।ঁ ঠাকুর যদিও স্থানান্তরে ছিলেন, তথাপী যোগ, তিথি ও পর্ব্ব উপলক্ষে ঠাকুর (বিগ্রহ মূর্ত্তি) কে বাড়ীতে আনিয়া অর্চ্চনা করা ও ভোগাদি দেওয়া তাহার নিত্য কার্য্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে পঞ্জিকা আলোচনাটা প্রাতে প্রতিদিনই করিতেন। আজ ভাল তিথীঁ ঠাকুরকে /৫ সের দুগে্‌ধর পায়েশ, অন্যদিন ভাল যোগ কি পর্ব্ব -- দশসের দুগে্‌ধর খির এইরূপ সময়োচিত যাহা তাহার অভিলাষ হইত ঠাকুর সেবার সুব্যবস্থা করিতে কখনও ত্রুটী করিতেন না। আজীবন তিনি এইরূপে ঠাকুর সেবা ও তদোপলক্ষে ব্রাহ্মণ সেবাদি করিয়া গিয়াছেন।ঁ বিগ্রহের প্রতি তাঁহার অগাধ বিশ্বাস ও অবিচলিত ভক্তি ছিল। ঠাকুরকে তিনি বাহ্যভাবে ভক্তিযুক্ত যে প্রণাম করিতেন তাহাতে তাঁহার ললাটের মধ্যভাগে এক দৃঢ় গুট্‌লী উত্থিত হইয়াছিল। ইষ্টক নির্ম্মিত প্রকোষ্ঠের মেজেতে ঠাকুঅর সিংহাসনের সম্মুখে বারম্বার ললাটস্পর্শে এই গুট্‌লী উত্থিত হইয়াছিল। তৎসহযোগে বারম্বার প্রণতির আঘাতের শব্দ নীচতালা পর্য্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া লোকের মনে বিস্ময় ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি উৎপাদন করিত।

    ৮০।৮৫ বৎসর বয়সের সময়েও মাঘের শীতে প্রাত:স্নান করিতে ও পাকা ঘাটলায় বসিয়া আহ্নিকাদি করিতে কখনও তাঁহাকে কুণ্ঠিত দেখি নাই। একাদশী প্রভৃতি উপবাস করিতে এবং পর্ব্বাদি ও রবিবার মৎস্য ভোজন প্রভৃতি নিষিদ্ধ কার্য্য করিতে স্মৃতি শাস্ত্রে যে বিধি নিষেধ আছে তাহা বিহিতরূপে পালন করিতে তিনি কখনও পরাঙ্মুখ হন নাই। নিরামিষ ভোজন তাঁহার অধিক প্রিয় ছিল। জীব হিংসাদি সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। এমনকি মশক, মাছি ও পিপিলীকা পর্য্যন্ত তিনি বধ করিতেন না। অন্য লোককে তাঁহার সম্মুখে সর্প বধ করিতে দিতেন না, কুকুর বিড়ালকে সযত্নে আহার দিতেন।

    এই পরিবারে মাংস ভক্ষণ পুরুষাণুক্রমেই নিষিদ্ধ। কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ ও মহাপ্রভূর পন্থায় বৈষ্ণবধর্ম্মের আচারাদি পালন এই পরিবারের কূলধর্ম্ম। এই বিষয়ে তিনি যে দৃঢ়তা দেখাইয়া গিয়াছেন তাহার দৃষ্টান্ত বিরল।

    গো সেবা তাঁহার নিত্য কার্য্য ছিল। গোবৎসকে তিনি দেবতার ন্যায় মান্য করিতেন। গোশালা নিজ হস্তে পরিস্কার করা ও গোপালন সম্বন্ধে যতদূর সুষ্ঠু ব্যবস্থা হইতে পারে তাহা করার পক্ষে যত্নের ত্রুটী করিতেন না। গাভীদোহন কালে বৎস জন্য প্রচুর দুগ্‌ধ গাভী বাঁটে থাকে কিনা তৎ প্রতি লক্ষ্য করা তাঁহার নিত্য কার্য্য ছিল।

    অতি সামান্য কর্ত্তব্যবিষয়ও তাঁহার দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই। আহারকালে মৎস্যাদির কণ্টক সকল যাহা ভোজনের পাত্র সান্নিধ্যে থাকিত, ভোজনাবশেষে তাহা সযত্নে তুলীয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিতেন; বলিতেন এ সকল কণ্টক স্ত্রীলোকের কোমল হস্তে বিঁধিলে পাপ হইবে। স্ত্রীলোক মাত্রকেই তিনি মাতৃজ্ঞান ও বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন তাঁহার ঐ কার্য্যই তদ্‌ বিষয়ে প্রমাণ।

    টাকা লগ্নি কারবারে তাঁহার হৃদয়ের উদার ভাব অধিকতর পরিস্ফুট হইয়াছিল। যে কন্যাদায়গ্রস্থ, যাহার হালের গরু নাই, যাহার ঘরে অন্নাভাব কি অন্য প্রকারে যে দায়গ্রস্থ নিস্ব: ও দুস্ত: তাহাদিগকেই তিনি আগ্রহ করিয়া টাকা করজ ও হাওলাত স্বরূপ দিতেন। টাকা পরিশোধের পন্থা আছে কিনা সে প্রশ্ন তাঁহার মনে আদৌ উত্থিত হইত না। কাহারও নিকট জামিনও চাহিতেন না। অল্প টাকা হইলে সাদা হিসাবে বেশী টাকা হইলে স্টাম্পে খত লইয়া অম্লান বদনে করজ দিতেন। উত্তরকালে এরূপ অধমর্ণ অধিকাংশই টাকা আদায়ে অক্ষম হইয়া পরে। তাহাতেও তিনি কোনরূপ আক্ষেপ প্রকাশ করেন নাই।

    গোলায় ধান্য মজুদ থাকিত। দুর্ব্বৎসরে গরীব দু:খী লোককে সংবাদ দিয়া ধান্য বিলী করিতেন। কিছু সুদের কথা থাকিত। বলিয়া দিতেন সুদিন হইলে সুদ সহ ধান্য ফিরাইয়া দিও কি মূল্য নগদ দিও। এরূপ ভাবে দেন কেন? জিজ্ঞাসা করিলে উত্তরে বলিতেন, মানুষ কি না খাইয়া মরিবে? খাইয়া বাঁচুক পশ্চাৎ কৃষ্ণ যাহা করেন, তাহাই হইবে। পরে সুদিন হইলে যাহারা ভাল লোক তাহারা ধান্য কি তন্মূল্যাদি পরিশোধ করিয়াছে, অক্ষম কি দুষ্ট লোকে আদৌ কিছু দেয় নাই। তজ্জন্য তাঁহাকে বিশেষ প্রতিকার চেষ্টা করিতে দেখি নাই। ""কৃষ্ণ যাহা করেন'' এই বাক্য সকল কার্য্যেই শুনা যাইত। এরূপ নির্ভরশীলতা খুব কম লোকেই দৃষ্ট হয়। ইহাই তাঁহার মূলমন্ত্র ও সম্বল ছিল, জীবনের শেষপর্য্যন্ত এই নির্ভরশীলতা অটুট ভাবে তাঁহার হৃদয়ে বর্ত্তমান ছিল।

    হঠাৎ জলপ্লাবনে ধান্যাদি ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রমে লোকে যেরূপ ব্যস্ততা প্রকাশ করিত তিনি কিন্তু সেরূপ করিতেন না। তাঁহার কার্য্য ধীরে সুস্থে হইতেছে, তাড়াতাড়ির কথা বলিলে বলিতেন ""কৃষ্ণ যাহা করেন তাহাই হইবে, মানুষের কি হাত আছে?'' যদি জলপ্লাবনে বিস্তর ক্ষতিও ঘটীত তথাপী তৎপ্রতি ভ্রুক্ষেপ করিতেন না। এরূপ ""তরোরিব'' সহিষ্ণু ব্যক্তি বড় দৃষ্ট হয় না।

    তিনি দুইবার দারপরিগ্রহ করেন, ১ম বারে সন্তানসন্ততি হওয়ার পূর্ব্বেই প্রথমা স্ত্রী মৃত্যুকে বরণ করেন। ২য়া স্ত্রীর গর্ভে ৩ কন্যা ১ পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ২ কন্যা ও পুত্র মথুর শিশুকালেই জীবনলীলা শেষ করে। কন্যা নৃত্যময়ী জীবীতা থাকিয়া পিতা মাতার একমাত্র আশ্রয় স্থল হয়। নৃত্যের বয়স যখন ৪।৫ বৎসর তখন তাহার মাতাও বৃদ্ধ পতি এবং অনোঢ়া বালীকাকে পরিত্যাগে সংসারাভিনয় শেষ করিয়া কালের কুক্ষিগতা হন। নৃত্য এখন তৎকাকীমাতা অর্থাৎ রামকানাই রায় মহাশয়ের পত্নীর আশ্রিতা হইল।

    ১২৮২ বাঙ্গলা সালের আশ্বীন কি ভাদ্র মাসে পূর্ব্বময়মনসিংহে এক প্রবল ভূমি বাটী ও বৃক্ষাদি ধ্বংশকারী ঝড় কি ঘূর্ণিবায়ুর আক্রমণে লোকের বিস্তর ক্ষতি ও দুরাবস্থা ঘটে। লেখক তখন ঢাকা কলেজিয়ট স্কুলের ছাত্র। ঢাকা থাকিয়াই সে সংবাদ প্রাপ্ত হই। এখানে লেখকের আত্মপরিচয় প্রদান না করিলে নানা বিষয়ে অসঙ্গতি দোষ ঘটীবে।
  • achintyarup | 59.93.242.103 | ১৩ জুন ২০১১ ০৫:০৬480465
  • আমি রাজচন্দ্র ও শ্যামচন্দ্র রায় মহাশয়দ্বয়ের সর্ব্বকনিষ্ঠ ভ্রাতাঁ রামকানাই রায়ের পুত্র। ১২৮২ বঙ্গাব্দে আমি ১৮ বৎসরে পদার্পণ করত: বয়:প্রাপ্ত হইয়াছি। ১২৭৭ সালে পিতৃবিয়োগ ঘটে। ১২৬৬ কি ৬৭ বঙ্গাব্দে শ্যামরায় মহাশয় স্বর্গগত: হন। এহেন অবস্থায় সুবৃদ্ধ রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের উপর সংসারের ভার চাপিল। জরাজীর্ণ শরীর নিয়া গৃহস্তি ইত্যাদি চালান তাঁহার পক্ষে দু:সাধ্য হইল। ১২৮২ সালের পুজার ছুটীতে আমি বাড়ী আসিলে তিনি বলিলেন, দেখ বাড়ীঘরের অবস্থা, দেখ আমার অবস্থা, দেখ ঋণজালে জড়িত সংসারের অবস্থা, আমি আর পারি না। দালানের প্রকোষ্ঠ মধ্যে শয্যাশায়ি হইয়া বৃদ্ধ যখন অশ্রুপূর্ণ লোচনে এই কথাগুলী বলিতে লাগিলেন তখন আমার ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটীল। তিনি বলিলেন বাবা! আর পড়াশুনার কাজ নাই, সংসার রক্ষা কর। আমি স্কুলের ছাত্র; কিরূপে সংসার রক্ষা করিতে হয় জানি না, তথাপী জ্যেষ্ঠতাতের কথা লঙ্ঘন করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

    ঢাকা আর গেলাম না, সংসার দেখাই কর্ত্তব্য মনে করিলাম; না হইলে সংসারে অসারে পরিণত হইবে। বিশেষ পড়ার খরচও ঋণ করা ভিন্ন চলিবার সম্ভব দেখা গেল না।

    ঋণ বহুতর দেখিয়া জিজ্ঞাসা করায় জ্যেষ্ঠতাত মহাশয় উত্তর করিলেন, যে রূপেই ঋণ করিয়া থাকি আমার সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া ঋণ মূক্ত কর। যদি পার সম্পত্তিসহ ঋণভার গ্রহণ কর। চেষ্টা করিয়া যদি সদোপায়ে ঋণটা শোধ দিতে পার তবে ঘরের সম্পত্তিটা ঘরেই থাকিয়া যাইবে। এখানেও তাহার উদারতা যথেষ্ট। অন্য হইলে বলিত যে ""ঋণ তো কেবল আমার জন্য হয় নাই, এজমালী পরিবারের জন্যই হইয়াছে। তোমরা অর্দ্ধেক দেও বক্রী অর্দ্ধেকে আমি দায়ী''। তাঁহার মুখে একথা আসিল না। অম্লান বদনে বলিলেন ""আমার কতক সম্পত্তি বিক্রয় করিয়া ঋণ আদায় কর''। আমি সংসার দেখিতে লাগিলাম। ঋণ আদায়ের উপায় খুজিতে লাগিলাম। অবশেষে স্থির করিলাম, আমার চেষ্টার যথেষ্ট সময় ত আছেই -- এখনই কেন ঘরের সম্পত্তি পরকে দিব? জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের পরামর্শমতে ।।০ আনা সম্পত্তিসহ তাঁহার কৃত ঋণভার গ্রহণ করিলাম। সংসারী হইলাম, তাঁহাকে অবসর দিলাম।
  • achintyarup | 59.93.247.142 | ১৪ জুন ২০১১ ০৫:২৬480466
  • কিরূপে সংসার চলিল সে সব কথা আমার জীবনী লেখার সময় প্রকাশ পাইবে। এখন রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের কথা বলিয়া শেষ করি। ১২৮৪ সনে তাঁহার সম্পত্তি কাওলা করা হইল। ১২৯৩ সন পর্য্যন্ত রাজচন্দ্র রায় মহাশয় জীবিত ছিলেন। এই ১০ বৎসরকাল তিনি সংসার সম্পর্ক বিরহিতাবস্থায় কখন বা স্বপাকে কখন বা আমার বিধবা মাতা ঠাকুরাণীর পাকে আহারাদি ক্রীয়া সুনির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন।

    নৃত্যময়ীর বিবাহ ১২৮২ সালেই সে গৃহশূণ্য প্রায় দালানমাত্রাবশিষ্ট বাটীতে সম্পন্ন হইয়াছিল। তাহা আমি ঢাকা হইতে আসিবার পূর্ব্বেই। গছিহাটা গ্রামের নন্দী বংশোদ্‌ভব আনন্দচন্দ্র রায় মহাশয়কে নৃত্যময়ী বরণ করে। তাহার ভাগ্য ভাল, বংশ উচ্চ, পাত্র বিষয়ী, আলীপুরে বাসাবাটীতে থাকিয়া উপার্জ্জন করেন। বিবাহান্তে তাহাকে লইয়া রায় মহাশয় আলীপুর চলিয়া গিয়াছেন। জ্যেষ্ঠতাত মহাশয় এখন নিশ্চিন্তেঁ ঠাকুরের সেবা পুজায় মন:কায় সমর্পণ করিলেন।

    তিনি সীমানাদি বিবাদে কি ভূসম্পত্তি সম্পর্কিত কলহে লিপ্ত হইতেন না, অপরে ঠগাইয়া নিলেও তাহা পরিত্যজ্য। নীরবে ধর্ম্মকার্য্যে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করাই তাঁহার প্রধান লক্ষ্য ছিল। ১২৯৩ সালের পৌষ মাসে শরীর জখন খুব ভগ্ন হইয়া পড়িল তখন একদিন আমাকে নীরবে বলিলেন বাবা! আমার ত আসন্ন কাল সমীপবর্ত্তী, যে সম্পত্তিটুকু অবশীষ্ট আছে তৎসম্বন্ধে একটা লিখাপড়া করিতে হইবে। বাড়ীর ধন বাড়ীতে থাকুক, পূর্ব্বেও অন্য ওয়ারিষে সম্পত্তি বিভাগ করিয়া নিয়া দুর্ব্বল করিয়াছে, আবার যদি তাহা হয় তবে আর বাড়ীর নাম থাকে কই। একটা লিখাপড়া কর, যাহা আছে দিয়া যাই। ভ্রাতষ্পুত্রেন পুত্রতা শাস্ত্রেও আছে। মেয়ে ত বিদেশ বাসিনী, তাহাকে প্রতি সালে কিছু টাকাদিলেই আমার দায়ীত্ব থাকিবে না। তাঁহার এই উদারতা আমাদের প্রতি বাৎসল্য ও দুরদৃষ্টির তুলনা নাই। বক্রী যে ১/৪র্থ অংশ সম্পত্তি অবশীষ্ট ছিল তাহার সম্বন্ধে মৃত্যুর ১০/১২ দিবস পূর্ব্বে উইল সম্পাদনে নির্ভুঢ় সঙ্কেÄ আমরা দুই ভাইকে অম্লান বদনে দিয়া গেলেন। কন্যার জন্য কিছু বার্ষিক বৃত্তি নির্দ্ধারিত রহিল। এ হেন মহঙ্কÄ কয়জনের আছে?

    যথা সময়ে তিনি মানবলীলার অবসানে আমাদিগকে নিরাশ্রয় করিয়া স্বর্গধামে গমন করিলেন। সে ১২৯৩ সালের ২৯শে পৌষ। আমি তখন ময়মনসিংহ সদরে কার্য্যস্থলে। তথা হইতে সংবাদ পাইয়া শোকে দু:খে ম্রিয়মান হইলাম। আমার কনিষ্ঠ সহোদর গুরুদাস যথারীতি তাঁহার অন্তিম কার্য্য শেষ করিয়াছে অবগত হইলাম। এইরূপেঁ রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের স্ববংশের বিলুপ সাধন হইল।
  • kumudini | 122.161.57.126 | ১৪ জুন ২০১১ ২০:৫৯480467
  • নৃত্যময়ী-নামটি বেশ।

    লেখকের কলমে জাদু আছে,একজন অসুস্থ,ঋণগ্রস্ত,অসহায় বৃদ্ধের স্বর যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
    "নীরবে বলিলেন" অর্থাৎ মৃদুস্বরে বলিলেন?
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৪ জুন ২০১১ ২১:২৫480468
  • চুপথায় জানিয়ে গেলাম অপার মুগ্‌ধতা --চলুক চলুক --এটি বই আকারে বেরোনো উচিৎ !
  • Nina | 12.149.39.84 | ১৫ জুন ২০১১ ০১:৪১480469
  • *চুপকথায়
  • achintyarup | 59.93.195.79 | ১৫ জুন ২০১১ ০৫:৪৬480470
  • শ্যামচন্দ্র রায়।

    অত:পর মধ্যম জ্যেষ্ঠতাত শ্যাম রায় মহাশয়ের কথা বলিতেছি। তিনি রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের কত বৎসরের ছোট ছিলেন তাহা আমার অজ্ঞাত। আমি যখন তিন বৎসর বয়সের শিশু তখন তিনি জীবনলীলা অবসানে কাল সাগরে ঝম্প দিয়াছেন। তৎ সম্বন্ধে যাহা কিছু লিখিব তাহা সমস্তই রাজচন্দ্র রায় মহাশয় ও বাটীস্থ অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট জানাশুনা মতে। প্রত্যক্ষ জ্ঞান নাই।

    শ্যাম রায় মহাশয়ও অজ্ঞাতভাবে জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের ভক্তিধর্মে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। তাঁহার ভক্তিপ্রবণতা কৃষ্ণপ্রেমের উন্মাদকতায় পরিণত হইয়াছিল। তাহা লোকচক্ষুর গোচরে বিশেষ পরিস্ফুট ছিল। তৎকর্ত্তৃক ঠাকুরসেবা ও পরিচর্য্যা এবং নিত্য সংকীর্ত্তনাদি বিশিষ্ট রূপে চলিয়াছিল। তাঁহার সহ্যায় সম্পদেরও অভাব ছিল না। তখন নিজ খানাবাড়ীর পরিখার ভিতরেই বহু লোকের বাস ছিল। তাহাদের অনেকেই শ্যাম রায় মহাশয়ের আকর্ষণে তাঁহার সহিত যোগদান করিয়াছিল। ঠাকুর তখন নিজ অট্টালীকায়ই স্থাপিত ছিলেন। শ্যাম রায় মহাশয়ের ভক্তি নদীতে ১ম বয়সেই বন্যা বহিয়াছিল। সেই সময় কাশী রায় মহাশয় সহ মোকদ্দমা চলিতেছিল। সুতরাং জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের মৃত্যুর অনেক পরে ঠাকুর সিংহাসনচ্যূত হন। তাহার ভক্তি অঙ্কুর উপযুক্ত ক্ষেত্র পাইয়াই বৃক্ষে পরিণত হইতে চলিল। নিষ্ঠার চূড়ান্ততা, জীব হিংসা বর্জ্জন, জীবনের প্রধান লক্ষ্য হইয়া উঠিল। তাঁহার টাকা লগ্নি কারবারও রাজচন্দ্র রায় মহাশয়ের অনুসৃত প্রণালীর উপরই স্থাপিত হইল। দু:স্ত ও নিস্ব: লোকেরাই টাকা করজ পাইত। দিবার সংস্থানের দিকে আদৌ লক্ষ্য ছিল না। গোলার ধান্যও দুর্দ্দিনে ঐ সকল লোককে বিলি করিতেন, আদায় হউক কি না হউক সে পরের কথা, উপস্থিত বিপদে খাইয়া বাঁচুক, বিপদাপন্ন গরীব দু:খী বিপদ হইতে রক্ষা পাউক, ইহাই যেন টাকা লগ্নি ও ধান্য বিলী কার্য্যের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল।

    তাঁহার নিষ্ঠা সতী বিধবার নিষ্ঠাকে অতীক্রম করিয়াছিল, একাদশী প্রভৃতি উপবাস ও স্মৃতি শাস্ত্রোক্ত কঠোর সংযমবিধি ব্যবস্থানুযায়ী সমস্ত কার্য্য ও নিয়ম পালন করিতেন। টাক লগ্নি কারবারে কি প্রজার খাজানাদি আদায়ে যে টাকাই তিনি লইতেন তাহা বিষুদ্ধ জলে ধৌত না করিয়া গৃহে নিতেন না। শুনিয়াছি একদা কোন মুসলমান লোক টাকা দিলে, দেখিতে পাইলেন সে টাকায় অন্নাদি শঁকরী সংলগ্ন আছে। টাকা পয়সা ধৌত করিবার ইহাই হেতু।

    তিনি কথায় কথায় বলিতেন -- ""ছাগলের রায়, কবুতরের বায় কৃষ্ণভক্তি পলাইয়া যায়''। সুতরাং ছাগল কি পায়রা খানাবাড়ীর নিকটস্থ হইতে পারিত না। কাক, কুকুর প্রভৃতি জীব যদি কখনও পাকশালায় প্রবেশমাত্র করিত, মাটীর পাত্রাদি তৎক্ষণাৎ পরিত্যক্ত হইত। ধাতু পাত্রগুলী মার্জ্জনে ও প্রক্ষালনে শুদ্ধ হইত। যে কাপড় পড়িয়া কার্য্যব্যপদেশে মুশলমান পাড়াদি নীচ জাতীয় লোকের সংশ্রবে যাইতেন, বাড়ী আসিয়া স্নানান্তে সেই সকল কাপড় ধৌত না করিয়া গৃহপ্রবিষ্ট হইতেন না। শুনিয়াছি একদা কোন বিশিষ্ট মুশলমান ভদ্রলোক সহ সম্মুখীন ভাবে দাঁড়াইয়া আলাপের সময় উক্ত ভদ্রলোকের মুখ হইতে কণিকাকারে থুথু নিক্ষিপ্ত হইয়া তদীয় অঙ্গে কি বস্ত্রে পতিত হইয়াছিল। সেই হইতে অস্পৃশ্য জাতীয় লোক সংশ্রবে গেলেই স্নান অনিবার্য্য হইত। যেখানে সেখানে অর্থাৎ ঠাকুরদালানের নিকটে আশে পাশে কি সিঁড়িতে অথবা পুকুরের পাকা ঘাটলায় কি জলে কেহ থুথু ফেলাইতে পারিত না। এ বিষয়ে বিশেষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও সাশনের ব্যবস্থা ছিল।
  • ranjan roy | 122.168.204.176 | ১৫ জুন ২০১১ ০৬:২৩480471
  • আ-বা-প'র যেমন হ্রস্ব-ই, তেমনি গগন রায়ের দীর্ঘ-ই।
  • M | 59.93.199.153 | ১৫ জুন ২০১১ ০৭:৪৬480472
  • ক্ষী ক্ষেলো! ডুবে কেউ মুখ থেকে কিছু বার করে দিলে?

    যাউকগা, চিন্টু বাবু বা রঞ্জনদা কেউ একখান ফেমিলি ট্রি টাঙালে ভালো হয়, ক্যামন গুলিয়ে যাচ্ছে। আগেকার দিনের লোকেরা অত সম্পর্ক ম্যানেজ করতো ক্ষী ক্ষরে?
  • arnab | 14.96.50.79 | ১৬ জুন ২০১১ ০১:৪০480474
  • আ-বা-প'র 'ই' কার এতোটা সরলীকরণ করা নিরাপদ নয়কো। 'কী লিখবেন কেন লিখবেন' বাধ্য হয়ে কিনতে হবে, বাক্‌বাহুল্য ঘটালে।
  • achintyarup | 59.94.2.155 | ১৬ জুন ২০১১ ০৫:৩৭480475
  • শ্যাম রায় মহাশয় যথাকালে অষ্টগ্রামের নন্দীবংশে বিবাহ করেন। তাঁহার ১ পুত্র ৪ কন্যা সন্তান জন্মে। কন্যাগণ বিবাহযোগ্যা হইবার পূর্ব্বেই তিনি মানবলীলা সম্বরণ করেন। পুত্রকন্যা ও স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও সম্পত্তি সংরক্ষণের ভার রামকানাই রায় মহাশয়ের উপর ন্যস্ত হয়। পুত্র ও সর্ব্বকনিষ্ঠা কন্যাদ্বয় অবিবাহিতাবস্থায় বাল্যের সীমা অতিক্রম করার পূর্ব্বেই কালকবলে নিপতিত হইয়া বিধবা মাতাকে দুর্ব্বিসহ শোকযন্ত্রণায় রাখিয়া যায়। প্রথমা কন্যা অর্থাৎ আমার বড়দিদিকে গছিহাটা গ্রামের নন্দিরায় বংশিয় বৈকুণ্ঠ প্রসাদ রায় মহাশয় বিবাহ করেন। দ্বিতিয়া কন্যা অর্থাৎ আমার মেজদিদিকে অষ্টগ্রামের পরাশর গোত্রীয় বংশের মদনমোহন রায় মহাশয় বিবাহ করেন। উভয় বিবাহ খুব ধুমধাম ও সমারোহে সুসম্পন্ন হইয়াছিল। বড়দিদি একমাত্র কন্যাসন্তান বর্ত্তমান রাখিয়া যথাকালে ও মেজদিদি নি:সন্তানাবস্থায় অকালে আমাদিগকে শোকসন্তপ্ত করিয়া মৃত্যুমুখে প্রয়াণ করিলেন। জেঠাইমাতা শিবসুন্দরী দাস্যা মহাশয়া তাঁহার গভীর শোক ও দু:খের একমাত্র সান্ত্বনার অবলম্বন নাতিনীকে লালন পালন করিতে লাগিলেন। এইরূপে শ্যাম রায় মহাশয়ের সন্তান সন্ততির পরিণাম ব্যবস্থা হইল।

    যথাকালে বৈকুণ্ঠ রায় মহাশয় তৎকন্যা কুলসুন্দরীকে জঙ্গল বাড়ী গ্রামের শরত চন্দ্র কারকুন মহাশয় নিকট সম্প্রদান করিলেন। বিত্তসম্পত্তিশালী পতি হইলেও বয়োধিক্যতা প্রযুক্ত এ বিবাহ শোভন হইল না। যাহা হউক ভগবানের বিধান অনতিক্রমণীয়। কুলসুন্দরী যথাকালে এক পুত্রসন্তান লাভ করিলে আমরা সকলই সুখী হইলাম। অত:পর পুত্রকে শিশু রাখিয়াই বৃদ্ধ কারকুন মহাশয় স্বর্গগামী হইলেন। তৎসঙ্গে তাহার বিত্তসম্পত্তির অবস্থাও শোচনীয় দশা প্রাপ্ত হইল। পুত্র সতীশ দুরাবস্থায় পতিত হইয়া বিধবা মাতার একমাত্র আশা ভরষার স্থল হইল।

    ১৩১০ সালের বৈশাখ মাসে জেঠাইমাতা স্বর্গারোহণ করিলেন। শ্যাম রায় মহাশয়ের বংশের উল্লেখযোগ্য আর কেহ অবশীষ্ট রহিল না। জেঠাইমাতা অতি সরলা ও মধুরভাষিণী ছিলেন। আমাকে তিনি বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন এবং আদর যত্ন করিয়া প্রায়ই খাওয়াইতেন।
  • achintyarup | 59.94.2.155 | ১৬ জুন ২০১১ ০৫:৪১480476
  • শ্যাম রায় মহাশয় যথাকালে অষ্টগ্রামের নন্দীবংশে বিবাহ করেন। তাঁহার ১ পুত্র ৪ কন্যা সন্তান জন্মে। কন্যাগণ বিবাহযোগ্যা হইবার পূর্ব্বেই তিনি মানবলীলা সম্বরণ করেন। পুত্রকন্যা ও স্ত্রীর ভরণ পোষণ ও সম্পত্তি সংরক্ষণের ভার রামকানাই রায় মহাশয়ের উপর ন্যস্ত হয়। পুত্র ও সর্ব্বকনিষ্ঠা কন্যাদ্বয় অবিবাহিতাবস্থায় বাল্যের সীমা অতিক্রম করার পূর্ব্বেই কালকবলে নিপতিত হইয়া বিধবা মাতাকে দুর্ব্বিসহ শোকযন্ত্রণায় রাখিয়া যায়। প্রথমা কন্যা অর্থাৎ আমার বড়দিদিকে গছিহাটা গ্রামের নন্দিরায় বংশিয় বৈকুণ্ঠ প্রসাদ রায় মহাশয় বিবাহ করেন। দ্বিতিয়া কন্যা অর্থাৎ আমার মেজদিদিকে অষ্টগ্রামের পরাশর গোত্রীয় বংশের মদনমোহন রায় মহাশয় বিবাহ করেন। উভয় বিবাহ খুব ধুমধাম ও সমারোহে সুসম্পন্ন হইয়াছিল। বড়দিদি একমাত্র কন্যাসন্তান বর্ত্তমান রাখিয়া যথাকালে ও মেজদিদি নি:সন্তানাবস্থায় অকালে আমাদিগকে শোকসন্তপ্ত করিয়া মৃত্যুমুখে প্রয়াণ করিলেন। জেঠাইমাতা শিবসুন্দরী দাস্যা মহাশয়া তাঁহার গভীর শোক ও দু:খের একমাত্র সান্ত্বনার অবলম্বন নাতিনীকে লালন পালন করিতে লাগিলেন। এইরূপে শ্যাম রায় মহাশয়ের সন্তান সন্ততির পরিণাম ব্যবস্থা হইল।

    যথাকালে বৈকুণ্ঠ রায় মহাশয় তৎকন্যা কুলসুন্দরীকে জঙ্গল বাড়ী গ্রামের শরত চন্দ্র কারকুন মহাশয় নিকট সম্প্রদান করিলেন। বিত্তসম্পত্তিশালী পতি হইলেও বয়োধিক্যতা প্রযুক্ত এ বিবাহ শোভন হইল না। যাহা হউক ভগবানের বিধান অনতিক্রমণীয়। কুলসুন্দরী যথাকালে এক পুত্রসন্তান লাভ করিলে আমরা সকলই সুখী হইলাম। অত:পর পুত্রকে শিশু রাখিয়াই বৃদ্ধ কারকুন মহাশয় স্বর্গগামী হইলেন। তৎসঙ্গে তাহার বিত্তসম্পত্তির অবস্থাও শোচনীয় দশা প্রাপ্ত হইল। পুত্র সতীশ দুরাবস্থায় পতিত হইয়া বিধবা মাতার একমাত্র আশা ভরষার স্থল হইল।

    ১৩১০ সালের বৈশাখ মাসে জেঠাইমাতা স্বর্গারোহণ করিলেন। শ্যাম রায় মহাশয়ের বংশের উল্লেখযোগ্য আর কেহ অবশীষ্ট রহিল না। জেঠাইমাতা অতি সরলা ও মধুরভাষিণী ছিলেন। আমাকে তিনি বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন এবং আদর যত্ন করিয়া প্রায়ই খাওয়াইতেন।
  • achintyarup | 59.94.2.155 | ১৬ জুন ২০১১ ০৫:৪৭480477
  • যা:, দুইখান একই পোস্ত চলে গেল
  • ranjan roy | 122.168.248.47 | ১৭ জুন ২০১১ ০১:৩২480478
  • এক,
    ""দাসী'' র জায়গায় মহিলাদের নামের শেষে ""দাস্যা'' কেন লেখা হত? কেউ বলতে পারেন, ছেলেবেলা থেকে ভাবছি।
    দুই,
    কোথায় দময়ন্তী? ময়দান মেঁ আ জাইয়ে। তোমার মায়ের ননিহাল অর্থাৎ জঙ্গলবাড়ির কারকুন পরিবারের কথা এসে গেছে।
    আমাদের ছোটবেলার ডাকসাইটে রাইট আউট পি ভেঙ্কটেশ ও কারকুন পরিবারের জামাই।
  • M | 59.93.198.85 | ১৭ জুন ২০১১ ০৭:৩৫480479
  • মেয়েদের নামের শেষে দেবী বা দাসী ছাড়া মাঝামাঝি কিছু ছিলো না?
  • arnab | 14.96.173.183 | ১৭ জুন ২০১১ ১৯:৫৪480480
  • ""দাস্যা: [সং দাসীদাস্যা:(ষষ্ঠী-১ব) দাসীর। পত্রে বিধবা শূদ্রপত্নীর নামের শেষে "দাস্যা' লেখার প্রথা প্রসিদ্ধ। বোধ হয়, পত্রের শেষে "শর্ম্মণ:' পদের অনুকরণে "দাস্যা:' হইতে 'দাস্যা' হইয়াছে।,,,,,,'দাস্যা' কেবল বৈধব্যের সংকেতমাত্র হইয়া রহিয়াছে।'' বঙ্গীয় শব্দকোষ।
  • achintyarup | 59.93.244.5 | ১৮ জুন ২০১১ ০৪:৩৫480482
  • লিং তো দেখছি এখেনে খোল যাচ্ছে না, বলছে ব্যাড লিং! জানিনে বাপু। যাগ্গে, আবার গগন রায়ে ফিরে যাই।
  • achintyarup | 59.93.244.5 | ১৮ জুন ২০১১ ০৫:৩৪480483
  • ঁরামকানাই রায়।

    আমার দ্বাদশ বৎসর বয়:ক্রম সময়ে পিতৃদেব রামকানাই রায় মহাশয় মানবলীলা সম্বরণ করেন। সুতরাং আমার সাধারণ জ্ঞান হওয়ার পর ৪/৫ বৎসর মাত্র তাঁহার কার্য্যকলাপাদি আমার জ্ঞানগোচরে আসিয়াছিল।

    তাঁহার ভক্তিস্রোত ফল্গুনদীর ন্যায় অন্ত:সলীলা ছিল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদিগের ন্যায় লোকচক্ষুর গোচর হইত না। নীরবে সৎকার্য্য সম্পাদন তাঁহার জীবনের লক্ষ্য ছিল। হরিনাম সংকীর্ত্তনে করতাল বাদন তাঁহার নিত্যকার্য্য ছিল, তাহাতে তিনি তন্ময় হইয়া যাইতেন। লোকে বলিত তাঁহার ন্যায় সুন্দর সমধুর করতাল নিনাদন কেহ চেষ্টা করিয়াও শিক্ষা করিতে পারিল না। ইহা তাঁহার স্বাভাবিক শক্তি ছিল। ক্রিয়া কর্ম্মেঁ বিগ্রহ গোবিন্দজীওকে বাটীতে আনয়ন করিয়া সেবা অর্চ্চনাদি করার ঐকান্তিক স্ফূর্ত্তি ও ভক্তির যুগপৎ মিলনে তাঁহার আনন্দের পরিসীমা ছিল না। তৎসঙ্গে মাসে২ ব্রাহ্মণভূজন করান অবশ্য কর্ত্তব্য মধ্যে পরিগণিত ছিল। ব্রাহ্মণভূজনের পারিপাট্য খুব বিচিত্রতার সহিত নির্ণিত হইত। যে ঋতুতে যে জিনিস নূতন ও বিশেষ আস্বাদ বিশিষ্ট তাহাই যত্নের সহিত সংগৃহীত হইত। মধুর সময়ে ভাল মধু, আম্রের সময় ভাল আম্র ও কাঁঠাল, কদলী এবং মৎস্য যে সময়ে যাহা উৎকৃষ্ট বলিয়া পরিগণিত হইত তাহাই ব্যয় বাহুল্য হইলেও তাঁহার চক্ষু এড়াইতে পারিত না। ব্রাহ্মণ কায়স্থ যাহারা ভোজন করিতেন তাঁহারা ইচ্ছাভূজনে পরিতৃপ্ত না হইয়া পারিতেন না। এই সকল কার্য্য দ্বারা তাঁহার ভক্তি ও প্রীতির গভীরতার পরিমাণ উপলব্ধি করা যায়।

    তিনি স্থির, ধীর ও গম্ভীর প্রকৃতি সম্পন্ন বলশালী বীরপুরুষ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় সাহসী লোকও কম দেখা যাইত। তাঁহার অদম্য সাহস ও অতুলনীয় শারীরিক বল তাঁহাকে লোক চক্ষুর গোচরে প্রতিষ্ঠিত করায় তাঁহার ঐশ্ব্যরিক ভক্তি স্রোত কলনিনাদিনী ছিল না। তথাপী তিনি কি বৈষয়িক জ্ঞানে কি পরমার্থ তঙ্কেÄ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাগণ হইতে ন্যূন ছিলেন না। জয়গোবিন্দ রায়ের বৈষ্ণবত্বের অনুস্মৃতি সকলেই বর্ত্তমান ছিল।

    তাঁহার সমকালীয় হিন্দু মোশলমান যাহারা বলীষ্ঠ বলিয়া পরিচিত ছিল তাহারা সকলেই তাঁহাকে সম্মান করিত ও ভয় করিয়া চলিত। তিনি আজানুলম্বিতবাহু পুরুষ ছিলেন। তাঁহার শরীর দৃঢ়, মাংসল ও খুব হৃষ্টপুষ্ট ছিল। তাঁহার শক্তি পরীক্ষার অনেক দৃষ্টান্ত লোক মুখে শুনিয়াছি।

    তাঁহার সাহসিকতার দুইটি দৃষ্টান্ত যাহা আমার জ্ঞান গোচরে আসিয়াছিল তাহা নিম্নে লিপিবদ্ধ করিলাম --

    একদা রাত্রিযোগে তাঁহার শয়নগৃহের বারান্দা হইতে এক পোষা কুকুরকে ব্যাঘ্রে আক্রমণ করিয়া নিয়া যায়। তিনি তদ্দণ্ডেই লাটী হস্তে বহির্গত হইয়া তৎসর্ব্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও চাকর, ভৃত্যাদিকে জাগরিত করত: অস্ত্রশস্ত্র ও মশাল জ্বালাইয়া লইয়া বাটীর অদূরবর্ত্তী অরণ্যে প্রবেশ করত: ব্যাঘ্রকে তাড়াইয়া জীবিতাবস্থায় কুকুরকে প্রাপ্ত হইলেন।

    আর একদিন আষাঢ় মাসে বন্যার জল মাঠে অল্প অল্প প্রবেশ করিতেছে, আমন ধান্যের ক্ষেত্রে ১/১।। হাত জল হইয়াছে, আউশ ধান্য অর্দ্ধপক্কাবস্থায় নূতন জলের উপর শোভা পাইতেছে, এহেন সময়ে প্রাতে বেলা ১ প্রহর আন্দাজ কালে চাকর ও প্রজা ২/৪ জনকে সঙ্গে করিয়া ঘাটের জল ও সশ্যাদি দর্শন করার জন্য নিত্য ব্যবহার্য্য এক সুদৃঢ় যষ্ঠি হস্তে লইয়া ভ্রমণে বহির্গত হইলেন। মাঠে প্রবেশ করিয়াই দেখেন কোন এক ধান্য ক্ষেত্রের কোণাবস্থিত টেকে (উচ্চস্থান) রৌদ্রে ৪/৫ হাত দীর্ঘ লাঙ্গুল বিস্তার করিয়া গো মনুষ্যাদির সাক্ষাৎ যমস্বরূপ এক বৃহদাকার শার্দ্দুল শুইয়া আছে। দেখিয়াই তাঁহাদের হৃৎকম্প হইল। অথচ এমন নিকট যে দৌড় দিয়া সরিবারও সাহস পাওয়া যায় না। সঙ্গীয় লোকেরা পশ্চাৎ হইতে সরিবার সুযোগ লাভ করিল, কারণ তিনি ত সম্মুখে ব্যাঘ্রের দৃষ্টি আবরণ করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার পশ্চাতের লোককে ব্যাঘ্র দেখিতে পায় না। সুতরাং তাহারা প্রাণভয়ে সরিয়া পড়িল। তিনি ভীত হইলেও স্থির গম্ভীর ভাবে ব্যাঘ্রপ্রবরকে দর্শন করিতেছেন ও এরূপভাবে অল্পে২ পশ্চাৎদিকে সরিতেছেন যে সেই রক্তলুলুপ পশু তাহা বিশেষ অনুভব করিতে না পারে। কিয়দ্দূর সরিলে পর ব্যাঘ্র সেই স্থানে উঠিয়া দণ্ডায়মান হইল। বুঝা গেল যে একটা খর্ব্বকায় বৃষ সদৃশ। ব্যাঘ্র তাঁহার দিকে তাকাইয়া কি জানি কি ভাবিয়া ধীর পদে অন্য দিকে চলিয়া গেল। তিনি স্থির চিত্তে ব্যাঘ্রকে নিরীক্ষণ করত: পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখেন পশ্চাদবর্ত্তী লোকেরা বহুদূরে গিয়া তাহাদের সৎসাহসের পরিচয় দিতেছে। তিনি তাহাদের নিকটস্থ হইয়া বলিলেন এই কি তোমাদের মর্দ্দাকী? মর্দ্দাকী অর্থে সাহস।

    তাঁহার কষ্টসহিষ্ণুতা ও পরিশ্রম পটুতা অসাধারণ ছিল। নসিরাবাদ অর্থাৎ জেলার সদরে যাতায়াত পদব্রজে সর্ব্বসাধারণ লোকের পক্ষে ২ দিন -- ২ দিন ৪ দিনের কমে হইত না। তিনি যাতায়াতে ২ দিনেই পারিতেন। কলিকাতা যাতায়াত তখন দুর্গম ছিল। সিয়ালদহ গোয়ালন্দ লাইন সে সময়ে হয় নাই। হাইকোর্টে মোকদ্দমা চালাইবার জন্য যাইতেই হইবে, সুতরাং পদব্রজেই চলিয়া গেলেন আবার কার্য্য অন্তে সেই ৩০০ শত মাইল রাস্থা অতিক্রম করিতে আয়াস বোধ করিলেন না।

    ঁগয়া, কাশী প্রভৃতি তীর্থভ্রমণ কেবল তাহার ভাগ্যেই ঘটীয়াছিল, তাঁহার অগ্রজদ্বয় সে সুযোগ প্রাপ্ত হন নাই।

    গোপালন ও তৎসেবা পরিচর্য্যা করার স্পৃহা তাঁহার যথেষ্ট ছিল। বলীবর্দ্দ ও দুগ্‌ধবতী গাভী সকলে তাঁহার গোশালা পরিপূর্ণ থাকিত। ভৃত্যাভাবে গো গৃহ পরিস্কার কি গাভী দুহন কার্য্য নিজে সম্পন্ন করিতে অসম্মান জ্ঞান করিতেন না।
  • achintyarup | 59.93.244.250 | ২০ জুন ২০১১ ০৬:০৩480485
  • পিতাঠাকুর মহাশয়ের কর্তৃত্ব কালে সাংসারিক অনেক বড় বড় কার্য্য ও ব্যাপার সুসম্পন্ন হইয়াছিল। শ্যাম রায় মহাশয়ের শ্রাদ্ধ, বড় দিদি ও মেজ দিদির বিবাহ, বড় পুখুরের পঙ্কোদ্ধার, বাহির খণ্ডের দক্ষীণের পুখুর ও বাড়ী মধ্যের পুখুর ও বড় পুখুর মৎস্য দ্বারা পরিপূর্ণ করত: তৎপালন পরিপাট্য। ছেলেমেয়েদিগের কর্ণভেদ ও চূড়াকরণ ব্যাপার খুব ধুমধাম ও সমারোহে সুসম্পন্ন হয়, তাহাতে প্রসিদ্ধা স্বরূপা নামক বাইজির নাচ্‌ ও গান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাহিরখণ্ড ও অন্দরের দুই খণ্ড এই খণ্ডত্রয়ের সুশৃঙ্খলা বিধানে গৃহাদির পারিপাট্য এবং আম, কাঁঠাল, কদলী, সুপারী প্রভৃতি নানাজাতীয় ফলের বাগান ও বাঁশ প্রভৃতি আবশ্যকীয় উদ্ভিদের রোপণ প্রভৃতি অনেকানেক কার্য্য তাঁহার কর্তৃত্বাধীনে হইয়াছিল। সর্ব্ববিষয়েই তাঁহার প্রখর দৃষ্টি ও বিবেচনা ছিল। নিজে যেমন খাটীতে পারিতেন, সেইরূপ লোকের সাহায্যও প্রাপ্ত হইতেন। চাকর, ভৃত্য ও ভাণ্ডারী লোক সকলের প্রতি তিনি যেমন সদয় ও বিনম্র ব্যবহার করিতেন, তাহারাও সেইরূপ আনুগত্য করিত। কেহই তাঁহার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হইত না।

    তাঁহাকে লোকে ভাগ্যবান বলিত। তাহার কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভদ্রলোকের যে সকল সুখ সৌভাগ্যের কল্পনা করা সম্ভব, তাঁহার সময়ে তাহা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। গোলা ভরা ধান, গোশালা ভরা গো বৎস্য, পুখুর ভরা মৎস্য ও বাগানভরা ফল, দুগ্‌ধবতী গাভীসকলের দুগে্‌ধ ভরা ভাণ্ড পারিবারিক সুখ বিধানের জন্য বারমাস নিয়ত ছিল। কোন রকম অভাব অনটন স্বপ্নেও কল্পনা করা যাইত না। সংসারটা নানাপ্রকারে ভরপূর ও হাস্য পরিহাসাদি প্রফুল্লতায় মুখরিত ছিল।

    কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী কাহারও চিরকাল স্থিরতর থাকেন না। কমলা চঞ্চলা অথবা ভাগ্যবানেরই অনুগামিনী ইহাই শাস্ত্র বাক্য। ""চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে সুখানি চ দু:খানি চ''। এই বাক্যের সার্থকতা হইল। পিতা ঠাকুর যৌবনে পদার্পণ করিয়া ৪৫ বৎসর বয়ক্রম পর্য্যন্ত সংসারের সুখ ভোগে অতিবাহিত করিলেন।

    ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ১ম ভাগে এক তালুক সংক্রান্ত মোকদ্দমা উপলক্ষে কলিকাতা হাইকোর্টে গমন করিয়াছিলেন। মোকদ্দমা জয়ী হইতে পারিলেন না। আইন নির্দ্দিষ্ট তমাদী কালের পর মোকদ্দমা দায়ের করিয়াছিলেন এই হেতুতে বিপক্ষ পক্ষ জয়ি হইল। ভগ্ন মনোরথ হইয়া কলিকাতা হইতে বাটী ফিরিলেন। তাঁহার শারীরিক অসুস্থতা প্রকাশ ................... জ্বর রোগে দেখা দিল। ২/৪ দিন বিনা.................... তৎপর রোগ কঠিন বিবেচনা হওয়ায় কবিরাজ .................... রীতিমত চিকিৎসাদি হইতে ত্রুটী হইল না। কিন্তু জ্বর ......... হইল না, চিকিৎসা, শুশ্রুষা ব্যর্থ হইল। ১২/১৩ দিবস রোগ ............ ১২৭৭ বঙ্গাব্দের আশ্বীন মাসে লক্ষ্মী পুর্ণীমার রাত্রিতে সকল..... শোকসাগরে নিক্ষেপ করিয়া নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করিলেন।লোকে বলিতে লাগিল, কানাই রায় মহাশয় পূণ্যবান, সকল দিক বজায় রাখিয়া সুদিনে শরত পূর্ণীমার উঙ্কÄল আলোকিত রাত্রে স্বর্গে গমন করিলেন।

    তখন আমার বয়স ১২ বৎসরে পড়িয়াছে, আমি কিছু বুঝি কিছু না বুঝি। কিন্তু সেই অশীতিপর বৃদ্ধের মস্তকে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল -- রাজচন্দ্র রায় মহাশয় ভ্রাতৃশোকে ক্রন্দন করিয়া হায়২ করত: শিরে করাঘাত করিতে লাগিলেন। পুত্র শোকাপেক্ষাও তাঁহার ভ্রাতৃশোক গভীর হইল। কনিষ্ঠ ভ্রাতা হইলেও সংসার পরিচালনার পক্ষে তিনি অতি সুমহান ফলবান বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় বাস করিয়া আপনার নিরাবিল ধর্ম্মজীবন যাপন করিতেছিলেন, সংসারের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করিতেন না। এ হেন অবস্থায় কোথায় অগ্রে তাঁহার মৃত্যু হইবে না তাঁহার একমাত্র আশা ও আনন্দের অবলম্বন সংসার তরীর কর্ণধার ....... তাঁহাকে পশ্চাতে রাখিয়া অগ্রেই অমর............ হায় রে বিধাতা! তোমার এ কি বিচিত্র ব্যবস্থা। ..................... ভাবনা চিন্তায় ও শোকাবেগে তিনি মূহ্যমান ও ........... হায়২ করিতে লাগিলেন।

    যথারীতি পিতৃদেবের অন্তিম কার্য্য যথাকালে ...... হইল। রাজচন্দ্র মহাশয় সাংসারিক কার্যে অনভ্যস্ততা ............ যে দিকে দৃষ্টি করেন সেই দিকেই অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। পদে২ ক্ষতি ও বহু ঝঞ্ঝাট বাঁধিতে লাগিল। অল্প দিনের মধ্যেই নানা অশান্তি উপস্থিত হওয়ায় বোধ হইল যেন ভাগ্যবানের সঙ্গে ভাগ্যলক্ষ্মীও চলিয়া গিয়াছেন।

    পিতৃদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ৩/৪ বৎসরের মধ্যে আমার কনিষ্ঠ সহোদর ঈশ্বরচন্দ্র, দাদা আনন্দকিশোর তৎভগ্নিগণ ও মথুরচন্দ্র এবং তাহার মাতা ও তৎকনিষ্ঠা ভগ্নিদ্বয় সকলেই একে২ চলিয়া যাইতে লাগিল। রোগ জ্বর প্লিহাদি সকলেরই একরূপ। মাত্র ১২ বৎসর বয়সের আমি, ৩ বৎসর বয়সের গুরুদাস ও ৫/৬ বৎসর বয়:ক্রমের নৃত্যময়ী ভিন্ন আর ছেলে মেয়ে কেহ জীবিত রহিল না। সর্ব্বজ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের ভ্রাতৃশোক না যাইতেই পুত্র কন্যা ও পত্নী শোকাদিতে তাহার হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিল। স্ত্রীলোকের মধ্যে আমার মাতাঠাকুরাণী .............. শিবসুন্দরী দাস্যা মহাশয়া ভিন্ন অ............................ বাটী র অবস্থা ভয়াবহ শ্মশান সদৃশ ................. হইতে লাগিল। ভগবানের অচিন্তনীয় বিধান, কে বুঝিতে পারে।

    পিতৃদেব স্বর্গগত হওয়ার ছয়মাসাধিক কাল পর শিক্ষাব্যপদেশে আমি বাটী পরিত্যাগ করিলাম। পূর্ণ পাঁচটী বৎসর পূজ্যপাদ সর্ব্বজ্যেষ্ঠতাত মহাশয় জরাজীর্ণ কলেবরে সংসারের গুরুভার মস্তকে বহন করিয়া দিন কর্ত্তন করিতে লাগিলেন ও আমার শিক্ষার ব্যয় চালাইতে লাগিলেন। মাতা ঠাকুরাণী ও মেজ জেঠাইমাতা ঠাকুরাণী শোকে দু:খে জর্জ্জরিত অবস্থায় কিভাবে দিন কর্ত্তন করিতে লাগিলেন তাহা বিধাতা ভিন্ন অপর কাহারও বোধগম্য নহে। অত:পর সুনার সংসারের যে অবস্থা বীপর্য্যয় সংসাধিত হইল তাহা আমার জীবনীতে যথাস্থানে প্রকাশ পাইবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন