এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • achintyarup | 59.93.240.51 | ০৪ জুলাই ২০১১ ০৫:৫৬480519
  • তিনমাস পর যশোদলে আসিলাম, পুন: পড়াশুনায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যবশত: কয়েকমাস না যাইতে যাইতেই আমার অদৃষ্টাকাশে কাল মেঘ দেখা দিল। একমাত্র আশ্রয় স্থানীয় বিশ্বনাথ রায় মহাশয় দুরন্ত কাসীরোগে ইহলোক ত্যাগ করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর নানা কারণে আমাকে সে বাড়ী পরিত্যাগ করিতে হইল।

    তাঁহার বাড়ীর প্রতিবেশী লোকেরা অনেকেই আমাকে মনোযোগী ছাত্র বলিয়া এবং আমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে বিশেষ ভাল বাসিত। আমি সে বাড়ী হইতে চলিয়া যাইব দৃষ্টে তাহার পার্শ্বস্থিত বাড়ীর এক কায়স্থ জাতীয়া বিধবা স্ত্রীলোক আমাকে বলিল, কেন অন্যত্র যাইবে, ""আমার বাড়ীতে থাক, আমি রান্ধিয়া খাওয়াইব। সেখানেও ত বাড়ি হইতে মাসে২ চাউল আসে, তোমাদের ত রাজার ভাণ্ডার, ধান চাউলের অভাব নাই, এখানে তাহাই হইবে, ভাবনা কি?''

    গত্যন্তর না দেখিয়া ঐ বিধবার আশ্রয় লইলাম। পাক অতি পরিপাটী করিত, তৃপ্তি সহকারে তাহার আলয়ে খাওয়া দাওয়া চলিল। কয়েক মাস পর পুজার ছুটী আসিল। বাড়ী গেলাম। আশ্বীন মাস, পিতামহাশয় কলিকাতা নগরী হইতে কতক রেলওয়ে কতক পদব্রজে ক্লান্ত শ্রান্ত ও অবসন্ন দেহে বাটীতে প্রত্যাগত হইলেন। মনের সে প্রসন্নতা শরীরের সে বলব্যঞ্জকতা আর দৃষ্ট হয় না। বহু পরিশ্রমে ও অর্থব্যয়েও মোকদ্দমায় পরাজয়ী হওয়াই তাহার কারণ বলিয়াই অনুমিত হইল। কিয়দ্দিন পরে অকস্মাৎ জ্বর রোগে আক্রান্ত হইলেন। ২/৩ দিন চিকিৎসার কোন বন্দবস্থ হইল না, পরে চিকিৎসক ডাকা হইল কিন্তু চিকিৎসায় ফলোদয় হইল না। দেখিতে২ লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত্রি আগত, শমন শিয়রে চিকিৎসক জবাব দিলেন। সকলকে কান্দাইয়া চলিয়া গেলেন। আমার মাথায় বজ্রাঘাত ও পায়ে কুঠার পড়িল, অকুল পাথারে ভাসমান হইলাম।

    পিতৃদেবের স্বর্গপ্রাপ্তির পর ৭/৮ মাস বাড়ীতে বসিয়া থাকার পর আমার শিক্ষা সম্বন্ধে মাতা ঠাকুরাণী উদ্বিগ্ন চিত্তে আমাকে বাটী পরিত্যাগ করিয়া চেষ্টা করার জন্য তাড়া করিলেন। যে বিধবার বাড়ীতে থাকিয়া কিশোরগঞ্জে পাঠাভ্যাস করিতাম, তাহার বাটীতে কি এক অসুবিধা ঘটীল, তথায় আর যাওয়া হইল না। নিজেও কিশোরগঞ্জ গিয়া নানাস্থানে চেষ্টা করিলাম, কোন আশ্রয়প্রাপ্ত হইলাম না। অবশেষে জ্ঞাতী জ্যেষ্ঠতাত পত্নী সাবিত্রী দাস্যা মহাশয়া সেই যশোদল দক্ষীণ পাড়ায় তাঁহার মাতুলভ্রাতা আনন্দকিশোর রায় মহাশয়ের বাটীতে থাকার বন্দবস্থ করিয়া দিলেন, কয়েকমাস তথায় থাকার পর কি কারণে তাঁহাদের বাটীতেও অসুবিধা ঘটায়, সেই পাড়ায় মহেন্দ্রচন্দ্র রায় মহাশয়ের বাটীতে গেলাম। তিনি আমার জ্যেষ্ঠতাত পত্নী সাবিত্রী দাস্যা মহাশয়ার অপর মাতুল ভ্রাতা। তাঁহার পত্নীকে মাতুলানী ডাকিতাম, তিনি আমাকে পুত্রতুল্য স্নেহ করিতেন। তাহার তিন পুত্র কৈলাস, যোগেশ ও জ্ঞান, সকলেই আমার বয়:কনিষ্ঠ, তাহারাও আমার সঙ্গে কিশোরগঞ্জেই পড়িত। এতদিনে কিছু শান্তি পাইয়া আবার পড়াশুনায় মনোনিবেশ করিলাম।

    স্কুলের ২য় শিক্ষকের পরিবর্ত্তন হইল। পূর্ব্বতন শিক্ষক গুরুদয়াল বাবু সদরে জেলা স্কুলে বদলি হইলেন। তৎস্থলে বাবু আনন্দ চন্দ্র মিত্র নামে নূতন শিক্ষক আগত হইলেন। আমি ৪র্থ শ্রেণীতেই ছিলাম পড়াশুনায় অনেক বাধা বিঘ্ন যাওয়ায়, বেশী অগ্রসর হইতে পারি নাই। আনন্দবাবু অনুগ্রহ করিয়া ৩য় শ্রেণীতে প্রমশন দিলেন, বলিয়া দিলেন পড়া না চালাইতে পারিলে নামাইয়া দিব।

    খুব মনোযোগের সহিত পাঠাভ্যাস করিলেও ৩য় শ্রেণীর পাঠ্য আয়ত্ম করা সুকঠিন হইল। ২/১ দিন আনন্দবাবুর বেত্র দণ্ডের আস্বাদও পাইলাম। মনে ঘৃণা জন্মিল, নীচের শ্রেণীতে নামাইয়া দিলে অপমানের সীমা নাই, এইরূপ চিন্তান্বিত অন্তরে রাত্রি দিবা অক্লান্ত পরিশ্রম করত: মুখস্ত পাঠগুলী আয়ত্ম করিতে লাগিলাম। অঙ্ক, সাহিত্য বুঝাইয়া দিবার লোকের অনুসন্ধান করিয়া যশোদল পূর্ব্বপাড়ায় মামুদপুর নিবাসী হরনাথ দত্ত নামক জনৈক ছাত্রের সাহায্য গ্রহণ করিতে লাগিলাম। তিনি প্রাতে আমাকে পাঠ বুঝাইয়া দিতেন, এ সময় তাঁহার সাহায্য না পাইলে, ৩য় শ্রেণীতে টিকিয়া থাকা আমার সুকঠিন হইত। তখনকার দিনে ঘরে২ প্রাইভেট (Private) মাষ্টর মিলিত না এবং রাখার প্রথাও ছিল না। পরস্পর ছাত্র সাহায্যেই নামজাদা ছাত্র সকল তৈয়ার হইতে দেখিয়াছি এবং উত্তরকালে বড় "স্কলার' বলিয়া অনেকেই দেশের মুখ উঙ্কÄল করিয়াছেন তাহাও জানিয়াছি। কিশোরগঞ্জ স্কুল হইতে মাইনার পাশ করিয়া বৃত্তিপ্রাপ্ত ছত্রগণ ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে তখনকার দিনে ২য় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হইতেন, আর এখন নাকি ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্ত্তি হওয়াও সুকঠিন। শিক্ষার ও ছাত্রের মানসিক শক্তির এরূপ পার্থক্য হইয়াছে।

    যাহা হউক হরনাথ রায় মহাশয়ের উপকার কখনও ভূলিতে পারিব না। দু:খের বিষয় তিনি অতি অল্প বয়সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। লিখাপড়ায় তাঁহার যথেষ্ট তেজস্বিতা ছিল, তিনি মামুদপুর গ্রামের স্বপরিচিত রাজকিশোর দত্ত মহাশয়ের ভ্রাতষ্পুত্র ছিলেন। তদভাবে রাজকিশোর রায় মহাশয়ও অপুত্রকতাহেতু জীবিত কাল পর্য্যন্ত অশেষ মন:কষ্টে কাল কর্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। হরনাথ রায় মহাশয়ের অমর আত্মার সদগতি প্রার্থনা করিয়া আমি তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।
  • achintyarup | 59.93.240.51 | ০৪ জুলাই ২০১১ ০৬:২০480520
  • এইরূপ যত্ন চেষ্টায় পাঠাভ্যাস করিয়া ৩য় শ্রেণীতে ছাত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় ১ম, ২য় স্থান ঠিক রাখিলাম। কয়েকদিন মধ্যেই গুড্‌ (Good) অর্থাৎ ভাল ছাত্র বলিয়া প্রশংসাও শুনিতে পাইলাম। তখনকার দিনে মাইনারের ৩য় শ্রেণীতে স্পেলীং বোক্‌ (spelling) শেষ করিতে হইত, মুখস্থ করার শক্তি আমার কম ছিল না। স্পেলীং মুখস্থ করাটা যেন আমার নিত্য কার্য্য ছিল। ইহার কারণ হেড্‌মাষ্টর স্বনামধন্য বৈকুণ্ঠনাথ সেন মহাশয় স্পেলীং শিক্ষার খুব উৎসাহ দিতেন, ৪টার সময় ছুটীর ঘণ্টা বাজিলেও, প্রায়ই সর্ব্বশ্রেণীর ছাত্রবর্গকে আটকাইয়া রাখিয়া নিজে স্পেলীং জিজ্ঞাসা করিয়া সমস্ত ছাত্রগণের মধ্যে উপর নীচের ব্যবস্থা করিতেন। ইহাতে এই ফল হইত নিম্নশ্রেণীর ছাত্রগণ উর্দ্ধশ্রেণীতে স্থান পাইত। উর্দ্ধশ্রেণীর অমনোযোগী ছাত্র লজ্জা পাইয়া স্পেলীং শিক্ষায় মনোযোগী হইত। আমি মুখস্থ বিদ্যার ভাণ্ডার, আমার তাহাতে ভয় ছিল না, প্রায়ই ১ম ২য় শ্রেণীতে স্থান পাইতাম। হেড্‌মাষ্টর মহাশয় ইহাতে খুব সুখী হইতেন ও ""কালাচান্দ''২ বলিয়া রঙ্গ রহস্য করিতেও ত্রুটী করিতেন না। স্পেলিং জিজ্ঞাসার সময় হইলেই কালাচান্দের ডাক পরিত আগে, "গত কল্য কোন্‌ স্থানে ছিলে স্থান ঠিক করিয়া বস'? "আজ তোমাকে নীচে নামাইবে ১ম শ্রেণী ও ২য় শ্রেণীর ছাত্রগণ আজ স্পেলীং কণ্ঠস্থ করিয়া আসিয়াছে, তোমার আস্পর্ধা চূর্ণ হইবে'। স্পেলীং জিজ্ঞাসা হইলে পর কেহই আমাকে পরাজয় করিতে না পারায়, হেড্‌মাষ্টর বাবু আমাকে সন্নিকটে আহ্বান করিয়া পৃষ্ঠে চাপরাই বাহাবা দিতেন ও জয়ী হইয়াছ সন্দেশ খাওয়াও ইত্যাদী হাস্যকৌতুক করিতে ত্রুটী করিতেন না।
  • achintyarup | 59.93.243.238 | ০৫ জুলাই ২০১১ ০৫:১২480521
  • এই স্পেলীং পরীক্ষায় আমার একটা অসুবিধা বাড়িয়া গেল। যশোদল দক্ষীণপাড়া হইতে স্কুলের দূরত্ব ৩ মাইলের ন্যূন নহে। শীতকালে স্কুল হইতে বাহির হইতেই সূর্য্যদেব অস্তাচলগামী দেখিতে পাইতাম। কৈলাস, যোগেশ প্রভৃতি সঙ্গীগণ পূর্ব্বেই চলিয়া যাইত। আমি প্রায়ই একাকী সেই তারাপাশার ভীতিব্যঞ্জক বটবৃক্ষের তলদেশ বাহিয়া দীর্ঘ ৩ মাইল রাস্থা অতিক্রম করিতাম। এ সকল কষ্টকে আমি গ্রাহ্য করিতাম না, পড়াশুনার জন্য ততোধিক কষ্ট মনিষীগণ করিয়াছেন শুনা যায়। নিজগ্রামের রামজয় চক্রবর্ত্তী মহাশয় পার্শীভাষায় বিজ্ঞ ছিলেন, উত্তরকালে তিনি ময়মনসিংহের জমীদারগণের সরকারে ও সুসঙ্গ রাজবাটীতে উচ্চ বেতনে নায়েবী কার্য্য করিয়া স্বনামধন্য হইয়াছিলেন। তিনি আমার ছোটকালে বলিয়াছিলেন যে আমি পারস্য ভাষা শিক্ষার জন্য নানা স্থানে ঘুড়িয়া অবশেষে যে স্থানে শিক্ষালাভ করিয়াছি, তাহাতে ক্লেশের সীমা ছিল না, এক বিধবার প্রাঙ্গণে ভোলাবৃক্ষতলে আমাকে অতি অল্প বয়সে পাক করিয়া খাইয়া বিদ্যাভ্যাস করিতে হইয়াছে। মহা পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের জীবনী যাহারা পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা জানেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পদব্রজে চলিতে কিরূপ সমর্থ ও অধ্যবসায়ী ছিলেন।

    মনের প্রফুল্লতায় ও উৎসাহে এ সকল দু:খ কষ্টকে তৃণবৎ জ্ঞান গণ্যে তৎপ্রতি ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করিয়া শিক্ষা সোপান পরম্পরা অতিক্রম করিতে লাগিলাম। ২য় শ্রেণীতে উন্নিত হইলাম।

    এস্থলেই কিশোরগঞ্জের তখনকার ছাত্র শিক্ষক ও হিতৈষী ব্যক্তিবর্গের পরিচয় দিয়া যাই। হেড মাষ্টর বাবু বৈকুণ্ঠনাথ সেন, সেকণ্ড মাষ্টর বাবু আনন্দচন্দ্র মিত্র, ৪র্থ শিক্ষক বাবু গিরিশচন্দ্র চৌধুরী, পণ্ডিত শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি তখন স্কুলের অধ্যাপনার কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় ব্যতীত সকলই ব্রাহ্মভাবাপন্ন। তখন মহাপুরুষ ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতির নূতন ধর্ম্মমতের প্রবল বন্যা বঙ্গদেশের সর্ব্বস্থল প্লাবিত করিয়া ছোট বড় তরঙ্গ ব্যপদেশে কল কল নিনাদে সকলকেই আহ্বান করিতেছিল। উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের অধিকাংশই নূতন ধর্ম্মে আত্মসমর্পণ করত: পৈতৃক ধর্ম্মের ময়লা দূর করার জন্য বদ্ধ পরিকর হইয়াছিলেন।

    বৈকুণ্ঠবাবুর ধর্ম্মমত মৃদু মধুর রকমের ছিল। আনন্দবাবু পূর্ণ তেজস্বীতার সহিত কার্য্য করিয়া যাইতেন। গিরিশবাবু সমাজের গোঁড়া হিন্দুদিগের ভয়ে২ চলিতেন। পণ্ডিত মহাশয় গোঁড়া হিন্দু। আনন্দবাবু হিন্দু সমাজের সাশন অমান্য করিয়া ও মানাপমান তুচ্ছ করিয়া কিরূপে জীবন পথে চলিতে হয় তাহাই শিক্ষা দিয়াছেন। পণ্ডিত মহাশয়ের শিক্ষা ছিল অন্যরূপ। তিনি যেমন নিয়মিত পাঠ শিক্ষা দিতেন, সেইরূপ আচার, আচরণ, ব্যবহার পদ্মতি চলাফেরা কথাবার্তা প্রভৃতি সর্ব্ব বিষয়ের উপদেশ দিতে ত্রুটী করিতেন না -- এমনকি কাপড় পরা পর্য্যন্ত শিখাইয়া দিয়াছেন। ছাত্রগণের চরিত্র যাহাতে সৎপথে চালিত হয় তদ্বিষয়ে তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। এজন্য তাঁহার কড়া শাসনেও কেহ অসন্তুষ্ট হইত না। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের শতকরা ৯০ জন বোধ হয় তাঁহার ছাত্রত্বে তাঁহার নিকট ঋণী।

    গিরিশবাবু মিষ্টভাষী সরলস্বভাব ছিলেন, তাহার অমায়ীক ভাব সকলকেই আকর্ষণ করিত। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। যাহ হউক শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রীতি ও ভালবাসার ভিতর দিয়া ২য় শ্রেণী পর্য্যন্ত অতিক্রম করিতে সক্ষম হইলাম।
  • achintyarup | 59.93.243.238 | ০৫ জুলাই ২০১১ ০৫:১৫480522
  • *স্পেলীং জিজ্ঞাসার সময় হইলেই কালাচান্দের ডাক পরিত আগে
  • achintyarup | 59.93.243.238 | ০৫ জুলাই ২০১১ ০৫:৪০480523
  • ছাত্রদের পরিচয়।

    নীচের ক্লাসে পড়িবার সময়ই প্রসন্নকুমার মজুমদার, মহেশ্বর চক্রবর্ত্তী ও কৈলাসচন্দ্র রায় এই তিন জনের সাক্ষাৎ পাই। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁহাদের প্রীতি প্রফুল্লতার আকর্ষণে ও বন্ধুত্বে আমাকে মুগ্‌ধ করিল। প্রসন্ন ও মহেশ্বরকে আমা অপেক্ষা বুদ্ধিমান ও মনস্বী বলিয়া মনে হইত, কিন্তু অধ্যবসায়টা আমার বেশী ছিল। কৈলাস রায় সমভাব। প্রসন্ন ও মহেশ্বর ব্রাহ্মণ হইলেও তাঁহাদের সহিত যেরূপ একাত্মভাবে মিশিতাম, অপর কাহারও সঙ্গে সেরূপ মিশামিশী হইত না। তাঁহারা আমার জন্য না করিতে পারিত এমন কার্য্য নাই। আমার রোগ হইলে তাঁহারা আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিত। পড়াশুনা ছাড়িয়া রোগশয্যা পার্শ্বে বসিয়া থাকিত। ঔষধ পথ্য ডাক্তার ডাকা সকল কার্য্যই তাঁহারা অক্লান্তভাবে অম্লানবদনে আত্মহারা হইয়া করিত। বিদেশে আত্মীয় বান্ধব শূণ্য স্থানে এমন অকৃত্রিম বন্ধুগণের সঙ্গ না পাইলে আমার জীবন কোন্‌ পথে পরিচালিত হইত কে বলিতে পারে? স্কুলে ভর্ত্তি হওয়ার সময় হইতে মাইনার পরীক্ষা দেওয়া পর্য্যন্ত সুদীর্ঘ পাঁচটী বৎসর ইঁহাদিগের সঙ্গসুখে কাটাইয়াছি। মহেশ্বর অমরধামে চলিয়া গিয়াছে, প্রসন্নের অস্তিত্বের সংবাদও প্রাপ্ত হইতেছি না। তাঁহাদের সেই স্মিত বদন, মিষ্ট বচন ও অমিয়মাখা করুণ ব্যবহার এখনও চিত্ত পটে দৃঢ় অঙ্কিত রহিয়াছে, তাহা জীবনান্ত পর্য্যন্ত মুছিবার নহে। পরলোকের পথেও তাঁহাদের সাক্ষাৎ পাইব মনে করি, তাঁহারা যেন আমার অতি নিজ জন, কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তাঁহাদিগে অবমাননা করিতে ইচ্ছা করি না। তাঁহাদের পরিচয় বিশেষরূপে কার্য্যক্ষেত্রে দিব।

    এই গেল অতি অন্তরঙ্গ বন্ধুর কথা। তারপর হিতৈষী বন্ধুবান্ধবের মধ্যে প্রথমেই স্বনামধন্য নগুয়া গ্রামের নবীনচন্দ্র রায় মহাশয়ের কথা মনে উদিত হয়। কয়েক মাস তাঁহার সহিত এক শ্রেণীতে পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয়। তাঁহার উদার হৃদয় ও বিনয় নম্র চরিত্রের মাধুর্য্যতার আস্বাদ সেই ছোট কালেই প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। পরহিতে অনুরক্ত এরূপ দ্বিতীয় ব্যক্তি কমই দেখিয়াছি। নগুয়া, হয়বৎনগরের দেওয়ান সাহেবদের বাটীরই সংলগ্ন পল্লী। নবীনবাবুর পিতা ঐ সাহেব সরকারের হিতৈষী সর্ব্বেসর্ব্বা মন্ত্রী ছিলেন। তখন তাঁহারই আদেশ উপদেশে হয়বৎনগরের সুবিশাল জমীদারী স্টেট পরিচালিত হইতে দেখিয়াছি। তাঁহার পদের আখ্যা ছিল ""দেওয়ান মুনশী''। তাঁহার মহত্ব ও উদারতাও যথেষ্ট দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি। নবীনবাবু পিতৃগুণধর্ত্তা। ছোটকালেও নবীনবাবু যথোচিতরূপে আমার হিত সাধন করিতে ত্রুটী করেন নাই। পরবর্ত্তী জীবনে কার্য্যক্ষেত্রে যাহা করিয়াছেন তাহার তুলনা নাই। যথাসময়ে তাহা প্রকাশ পাইবে। নবীনবাবুর নিকট আমি যে পরিমাণ উপকৃত ও ঋণী বোধহয় জীবনে আর কাহারও নিকট তত উপকৃত ও ঋণী নহি।
  • ranjan roy | 122.168.222.196 | ০৫ জুলাই ২০১১ ০৬:৫৬480524
  • অচিন্ত্যকে একটি অনুরোধ।
    আমি সেইসময়ের প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণী , তার আবার ওঠানামা, ক্লাসের মধ্যেই শ্রেণীবিভাগ কিস্যু বুঝতে পারছি না।
    আজকের সাথে তুলনা করে প্রাইমারি-মাইনর এগুলোয় যদি মল্লিনাথ হয়ে যান!
  • b | 203.199.255.110 | ০৫ জুলাই ২০১১ ১৪:১৪480525
  • প্রথম শ্রেণী ক্লাস টেন, দ্বিতীয় নাইন ইত্যাদি। (পাগলা দাশুতে যেমন আছে: এই তো সবে ফোর্থ ক্লাশে পড়ি...)

    আর মনে হয় স্পেলিং ক্লাসে ভাল করতে পারলে তাকে উৎসাহ দেবার জন্যে বলা হত তুমি এক ক্লাশ এগিয়ে গেছো, এই আর কি!
  • achintyarup | 59.93.244.148 | ০৬ জুলাই ২০১১ ০২:০৯480526
  • আমারও মনে হয় স্পেলিং প্রমোশনের ব্যাপারটা ছিল আনঅফিশিয়াল। ছেলেদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য।
  • achintyarup | 59.93.244.148 | ০৬ জুলাই ২০১১ ০৩:১২480527
  • তারপর নগুয়াবাসী বহু ছাত্রই আমার বন্ধুশ্রেণীতে পরিগণিত, তন্মধ্যে ভগবানচন্দ্র অধিকারী, রাসমোহন চক্রবর্ত্তী, কামিনীকুমার রক্ষীত ও গুরুচরণ কর ইঁহাদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভগবানের বাড়ী আচমিতা, রাসমোহনের বাড়ী বিক্রমপুর, কামিনী ও গুরুচরণ নগুয়ারই অধিবাসী।

    বত্রিশ গ্রামের কৃষ্ণচন্দ্র দাস প্রভৃতি আরও বহু বন্ধুভাবাপন্ন ছাত্র আমার সহাধ্যায়ী ছিলেন, তাঁহাদের সকলের কথা এখন স্মৃতিপথে উদিত হইতেছে না।

    যশোদলের শ্যামসুন্দর গোস্বামী মহাশয় যিনি উত্তরকালে উকীল হইয়া কিশোরগঞ্জ বারে শোভমান আছেন তিনি আমার অতি প্রিয় বন্ধু। চাতনের বাবু অভয়চন্দ্র দত্ত উকীলও শিক্ষাকালে আমার সহাধ্যায়ী ছিলেন। কার্য্যক্ষেত্রে তিনি তাঁহার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিদ্যার পরিচয় দিয়া আমাদিগকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন।

    নগুয়া স্কুলে।

    কিশোরগঞ্জ স্কুলে ২য় শ্রেণীর পাঠ সমাপন করিয়া ১ম শ্রেণীতে উন্নীত হইয়াছি। স্কুলের সেক্রেটারী ছিলেন সব্‌ডিভিসনেল্‌ অফিসার বাবু কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। তৎপূর্ব্বে রামশঙ্কর সেন মহাশয় কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিচার আসন অলঙ্কৃত করিয়া যে সুবিচারে সুনাম অর্জ্জন ও দেশের মুখ উঙ্কÄল করিয়াছিলেন তাহ কে না জানে? রামরাজ্যে লোকে বাস করিত ও আপদে বিপদে রামশঙ্কর বাবুর দুহাই দিত। মহারাণী কুইন ভিক্‌টরীয়াকে কেহ তখন চিনিত না।

    যেমনটী যায় তেমনটী আর আসে না। ভাগ্যগুণে কদাচিৎ সুজন মিলে। কিশোরগঞ্জের তখনকার অধিবাসীর ভাগ্যগুণে রামরাজ্যের অবসান হইল; রাবণের আধিপত্য বিস্তার হইল। কৃষ্ণচন্দ্র বাবুর বিচার ক্ষমতার যেরূপ প্রশংসা ছিল না, লোক-সদ্‌ব্যবহারেরও সেরূপ নিন্দা ছিল।

    একদা এক ফিরিঙ্গি সাহেব আসিয়া ম্যাজিক দেখাইবার জন্য সেক্রেটারী মহাশয়ের শরণাগত হয়। স্কুল গৃহটী খুব বড় এবং কাছারী প্রাঙ্গণ সংলগ্ন, তাই স্কুল গৃহই ম্যাজিক প্রদর্শনের উপযুক্ত স্থান নির্ণয় হইল। শনিবার সন্ধ্যাকালে ম্যাজিক আরম্ভ হইবে, ছাত্রগণ অর্দ্ধমূল্যে টিকেট পাইবে, নোটীশ প্রচার হইল। নোটীশ দৃষ্টে আমরা ত আহ্লাদে আটখানা। তামাসা দেখিব পয়সাও বেশী লাগিবে না। শনিবার আসিল, সেদিন স্কুলে গিয়া দেখি নোটীশের পরিবর্ত্তন হইয়াছে। এই নোটীশ পরিবর্ত্তনই অনর্থের হেতু হইল। ছাত্রগণ অসন্তুষ্ট হইল। সেদিন হাপ্‌ স্কুলের দিন। একটা হিতসাধিনী নামে সভার অধিবেশন কোন২ শনিবারে হইত। কিন্তু এই শনিবারে সভা খুব জাঁকিয়া বসিল, ৪টা বাজিল তবুও সভার কার্য্য শেষ হয় না। ইহাতে সেক্রেটারী চটীয়া গেলেন এবং চাপরাশী দ্বারা জানাইলেন ছাত্রগণ স্বেচ্ছায় স্কুলঘর পরিত্যাগ না করিলে বলপ্রকাশে তাহাদিগকে তাড়ান হইবে। ছাত্রগণ বুঝিল এবার অন্যায়ের পালা। কাজেই ন্যায়পথ অবলম্বনই কর্ত্তব্য। সকলই বাহির হইয়া পড়িল এবং কেহ তামাসা দেখিবে না বলিয়া স্ব স্ব বাসস্থানে চলিয়া গেল। বলা বাহুল্য কৃষ্ণচন্দ্র বাবুর অধীন ও তোষামোদকারীগণের বাসার ছেলেরা ত তামাসা দেখিয়াছিল।

    পরদিন অপমানিত ছাত্রবর্গ একে২ আসিয়া দলবদ্ধ হইতে লাগিল এবং স্কুলে না যাওয়াই স্থিরিকৃত হইল। সেক্রেটারীর বাধ্য লোকের বাসার ২০/২৫ জন ছাত্র মাত্র উপস্থিত হইয়া স্কুলের অস্তিত্ব রক্ষা করিল। তখন প্রায় দেড়শত বালক কিশোরগঞ্জ মাইনার স্কুলে শিক্ষার্থী ছিল। ঐরূপ দলবদ্ধ ভাবে টাউনে আসা যাওয়া ও মন্ত্রণাদি চলিল। আর একটা স্কুল বসান চাই। কে তাহার ভার নিবে, এই সমস্যা উপস্থিত হইতে লাগিল। ডি: মাজিস্ট্রেটের ভয়ে কেহ কি তাঁহার বিরুদ্ধে যাইবে। কিন্তু যাউক না যাউক একবার চেষ্টা করিয়া দেখি। বলা বাহুল্য এই দলের মধ্যে আমি, প্রসন্ন, মহেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্র অধীকারী প্রভৃতি অগ্রগণ্য অর্থাৎ ১ম ও ২য় শ্রেণীর ছাত্রগণই বিশেষ উৎসাহী।

    অত:পর দলপতী সাজিয়া উপরোক্ত কয়েকজন নগুয়া গ্রামে অনতিবিলম্বে গমন করিলাম। পূর্ব্বেই জানিয়াছিলাম স্বনামপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম সুবিদ্বান ও কৃতী পুরুষ শ্রীযুক্ত কালীনারায়ণ রায় মহাশয় নিজালয়ে আছেন। তিনি ভিন্ন এই বিপন্নদিগের আশ্রয়দাতা এই দু:সময়ে অন্য কেহ অগ্রসর হইতে সাহসী হইবে না বিবেচনায়, আমরা নির্ভিকচিত্তে তাঁহারই দ্বারস্থ হইলাম। তিনি আমাদিগকে প্রথম দর্শনেই বলিয়া উঠিলেন, ""বুঝিয়াছি কিশোরগঞ্জ স্কুলের ছাত্র তোমরা, তথাকার কেলেঙ্কারীর কথাও শুনিয়াছি; এখন তোমাদের কি কর্ত্তব্য স্থির করিয়াছ?''
  • achintyarup | 59.93.244.148 | ০৬ জুলাই ২০১১ ০৪:৪৩480352
  • আমরা বলিলাম অপমানিতভাবে সে স্কুলে আর যাইব না স্থির করিয়াছি, যদি আপনি আশ্রয় ও উৎসাহ প্রদান করেন, তবে এই নগুয়াতে আর একটা স্কুল করিয়া দেন, আমরা আপনারই আশ্রয়ে থাকিব। তিনি বলিলেন ""ছাত্র সংখ্যা কত হইবে? প্রায় একশত বলিয়া অনুমান করা গেল। স্কুল একটা সহজ ব্যাপার নহে, দায়ীত্ব বহু, অর্থও যথেষ্ট চাই, সুনাম দুর্নামেরও কথা আছেই, যদি পশ্চাৎ না টিকে তবেও বিশেষ লজ্জা পাইতে হইবে''। আমরা তাহার এইসকল সারগর্ভ বাক্যের যথাযথ উত্তর প্রদান করিলে, তিনি সন্তুষ্ট হইয়া আশ্বাস প্রদান করিলেন। এখন উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। স্থির হইল নগুয়া নিবাসী বাবু দীনদয়াল দে ৪র্থ শিক্ষক এবং বাবু আনন্দচন্দ্র চক্রবর্ত্তী ৩য় শিক্ষক সম্প্রতি স্কুলের কার্য্য চালাইবেন এবং স্কুল যাহাতে স্থায়ী হয় তাহার যথোচিত চেষ্টা উদ্যোগ করিবেন। দীনু বাবু ও আনন্দবাবু সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদের মত লওয়া হইল। তাঁহারা বলিলেন বাবু আনন্দকিশোর করকে সেক্রেটারী পদে রাখা হউক, তবে সর্ব্ব বিষয়ে সুবিধা হইবে। আনন্দকিশোর কর মহাশয় কালীনারায়ণবাবুর প্রতিবেশী ও সঙ্গতিপন্ন অতি সৎ প্রক্রিতি চরিত্রবান্‌ লোক। তাঁহারা আরও বলিলেন জঙ্গলবাড়ী গ্রামের প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ও নিষ্ঠাবান্‌ উদারচেতা বাবু চন্দ্রমোহন কর্ম্মকার নর্ম্মাল পাশ সুবিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি, তাঁহাকে পণ্ডিতের পদে বরণ করিলে বোধহয় তাহার অমত হইবে না। সম্প্রতি এই কয়জন লইয়াই কার্য্য আরম্ভ করা যাউক, তার পর হেড্‌মাষ্টর যাহাতে সত্বর পাওয়া যাইতে পারে, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। এই কথোপকথন চৈত্র মাসে হইতেছে বলিয়াই মনে পড়ে। আমরা জানুয়ারী মাসে মাইনার ক্লাসে প্রমোশন পাইয়াছি। সুতরাং ৫/৬ মাস মাত্র পরীক্ষাতে উপস্থিত হওয়ার কাল অবশীষ্ট আছে। হেড্‌মাষ্টর অতি শীঘ্র না আসিলে, পরীক্ষা বিভ্রাট ঘটীবে। এই কথা শ্রবণ করিয়া কালীনারায়ণবাবু বলিলেন আমি ২/১ দিন মধ্যেই ঢাকা যাইতেছি; ঢাকাই তাঁহার কার্য্যস্থল স্থিত ছিল, তথায় দেওয়ানবাড়ীর মোক্তার স্বরূপে দেওয়ান সাহেবের হাবেলীতেই বাস করিতেন ও অতি দক্ষতার সহিত প্রসিদ্ধ ""ইষ্ট'' নামক ইংরাজী সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা পরিচালন করিতেন। তখন ইংরাজী কাগজের মধ্যে "ইষ্ট' প্রাধান্যতা লাভ করিয়া সুনাম অর্জ্জন করিয়াছিল, উত্তরকালে এই "ইষ্ট' পত্রিকা পরিচালন ব্যাপারেই কালীনারায়ণ্বাবু উন্নতীর চরম সীমায় উত্থিত হন। তাহার নাম ও যশ দিগন্ত প্রসারিত হইয়া পরে। গবর্ণমেণ্ট তাঁহাকে ""এড্‌মিনিস্ট্রেটার জেনারেল আফিসে'' ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। তাহার বুদ্ধিমত্তা ও অধ্যবসায় উচ্চরবে প্রসংশিত হয়। এ®¸ট্রন্স মাত্র পাশ করিয়া কালীনারায়ণবাবু ও বঙ্গের অদ্বিতীয় গদ্যলেখক ভাব ও ভাষাবিদ বাবু কালীপ্রসন্ন ঘোষ যে সুযশ ও বিদ্যাবঙ্কÄ¡ প্রচার করিয়া গিয়াছেন তাহা অতুলনীয়।
  • achintyarup | 59.93.244.148 | ০৬ জুলাই ২০১১ ০৫:৩২480353
  • কালীনারায়ণবাবু বলিলেন ঢাকা হইতে এই সপ্তাহের মধ্যে জনৈক অভিজ্ঞ প্রধানশিক্ষক পাঠাইতেছি, কোন চিন্তার কারণ নাই, সম্প্রতি আমার ও আনন্দকিশোর করের বাংলা ঘরে স্কুলের কার্য্যটী আরম্ভ করা যাউক, কাল সোমবার হইতেই ছাত্রেরা আসিবে, বেঞ্ছ চেয়ারাদি ঠিক করিয়া ফেলাও, দীনুবাবুকে এই উপদেশ দিয়া সন্ধ্যাকালে আমাদিগকে বিদায় দিলেন। আমাদের চর কিশোরগঞ্জে, যশোদল, ছয়লা, বৌনাই, গাঙ্গাইল, রাকুরাইন ও মহিনন্দের পথে২ বসিয়া আছে, আমরা সকলকে জানাইয়া দিলাম কার্য্য ও চেষ্টা সফল হইয়াছে। কাল হইতে রীতিমত নগুয়া স্কুলে যাইবা।

    পরদিন জয়ধ্বনী করিয়া ১০টার পূর্ব্বেই ছাত্রগণ নগুয়া প্রবেশ করিল। প্রায় শত সংখ্যক ছাত্রই দেখা গেল। কালীনারায়ণবাবু স্মিতমুখে সকলকে আহ্বান করিলেন। সকলেই তাঁহাকে যথাযোগ্য অভিবাদন করিয়া স্কুল গৃহে আসন গ্রহণ করিলাম।

    একটা কথা বলিতে ভূলিয়া গিয়াছি -- স্কুল ভাঙ্গার অনতিপূর্ব্বে, কিশোরগঞ্জের মাইনার স্কুলের সুযোগ্য মিষ্টভাষী সাহিত্য ও ইংরাজী ভাষায় অভিজ্ঞ সর্ব্ব বিষয়ে সুদক্ষ আমার অতিশয় ভক্তি, শ্রদ্ধার পাত্র ও আমার প্রতি অতি স্নেহশীল ও অনুগ্রহকারী স্পেলীং শিক্ষার উন্নতীর মূল ভিত্তিস্বরূপ মহামতী বৈকুণ্ঠনাথ সেন হেড্‌মাষ্টর মহাশয় স্কুল ডেপুটী সবইন্‌স্‌পেক্‌টারের পদে উন্নীত হইয়া, স্থানান্তর চলিয়া গিয়াছিলেন। তৎস্থলে যিনি অভিষিক্ত হইয়াছেন তাঁহার শিক্ষা ও ব্যবহারে কেহই সন্তুষ্ট নহে। তিনি ভিতরে বাহিরে অন্ধকারের জীবন্ত মূর্ত্তি বলিয়া সকলই রহস্যাদি করিতেও ত্রুটী করে নাই। বিশেষ সেক্রেটারীকে তিনি যেন ভয় করিয়া ও খোসামোদরূপ উৎকোচ প্রদানে সন্তুষ্ট রাখিয়া চলিতেন। তাঁহার কাপুরুষত স্কুল ভাঙ্গায় বিশেষরূপ পরিস্ফুট হইলে, উচ্চশ্রেণীর ছাত্রগণ আর ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া, মুখের উপরই তিক্তজনক বাক্য বর্ষণ করিতে ভীত হয় নাই।

    এই হেতু ডিপুটীবাবুর অধীন ও অনুগত লোকের মধ্যেও যাহারা একটু স্বাধীনচেতা, তাহাদের ছেলেরা নগুয়া স্কুলে আসিতে লাগিল। কিশোরগঞ্জে যাহারা ডিপুটীকে ভয় করিত, তাহাদের ছেলেরাই স্কুলে উপস্থিত হইয়া স্কুল বজায় রাখিল।

    দেখিতে২ নগুয়া স্কুলে ছাত্রসংখ্যা খুব বাড়িয়া গেল। ৫/৭ দিন পরই হেড্‌মাষ্টর চন্দ্রকুমার ঘোষ মহাশয় কালীনারায়ণবাবুর চিঠি হস্তে নগুয়াতে পদার্পণ করিলেন। পণ্ডিত চন্দ্রমোহনবাবুও অবৈতনিক ভাবে কার্য্যে যোগ দিলেন। আমাদের স্কুল ভিত্তি দৃঢ় হইল। একটা পতিত প্রাঙ্গনে একখানা গৃহও উঠান হইল, ভাবনা চিন্তা দূরে গেল। পরীক্ষা নিকটবর্ত্তী দেখিয়া আমরা পাঠে মনোযোগী হইলাম। হেড্‌মাষ্টরবাবু মিষ্টভাষী, অমায়ীক ও ব্রহ্ম্যধর্ম্মে দিক্ষিত। কিশোরগঞ্জ স্কুলের সেকেণ্ড্‌ মাষ্টরবাবুর ভায়রা ভাই সম্পর্কিত। পড়াশুনা ভালই চলিল। দিনদিন আমরা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। ১৫/১৬ জন ছাত্র পরীক্ষার "টেষ্টে' এলাউ হইয়া পরীক্ষা ফি দাখিল করিলাম।

    স্কুলের স্থাপয়ীতা হইতে নিম্নতন শিক্ষক পর্য্যন্ত সকলই ব্রাহ্ম, ছাত্রদের মধ্যেও সেই ভাবাপন্ন বহু; প্রিয় সুহৃদ প্রসন্ন, মহেশ্বরও দেখি সেই দিকে গড়াইতেছে। মহারথী কেশববাবুর রণজয় বাদ্যরূপ বক্তৃতা যদিও ময়মনসিংহ পর্য্যন্ত ধ্বনিত হইয়াছিল, কিন্তু কিশোরগঞ্জের অনেক মনস্বীও স্বত:পরত: সে ধ্বনির মর্ম্ম অবগত হইয়া নূতন কলনাদিনী ধর্ম্মস্রোতে গা ভাসাইয়া দিলেন। রাকুরাইন গ্রামের জগমোহন বীর মহাশয় ও জঙ্গলবাড়ীর চন্দ্রমোহন কর্ম্মকার মহাশয়গণ সপরিবারে ব্রাহ্ম হইলেন। সে ধ্বনি ও ধর্ম্মস্রোত আমিও অতিক্রম করিতে পারিলাম না। তাহাতে মুগ্‌ধ ও প্রলোভিত হইয়া সেই পথে অতি সংগোপনে চলিতে লাগিলাম। বহ্নি কখনও ভস্মে আচ্ছাদিত থাকে না, সেইরূপ আমার হৃদয়ে যে ধর্ম্মবহ্নি প্রঙ্কÄলীত হইল, তাহাও ঢাকা রহিল না। বাহিরের আচরণে ও কার্য্যতায় সকলই বুঝিল নূতন ধর্ম্মবন্যার তরঙ্গাভিঘাত লাগিয়াছে। ধর্ম্মগুরু হইলেন পণ্ডিত মহাশয় চন্দ্রমোহন বাবু, যত শিক্ষা দীক্ষা উপদেশ তিনি প্রত্যহ স্কুল ছুটির পর দিয়া থাকেন। একমতাবলম্বী অনেক ছাত্র জুটীয়া দল পোষ্ট হইতে চলিল, উৎসাহ উদ্যোগের সীমা নাই।
  • achintyarup | 59.93.246.133 | ০৭ জুলাই ২০১১ ০৬:১৯480354
  • যশোদলের লোক গোঁড়া হিন্দু। বৈষ্ণব ধর্ম্মের গোঁড়া গোস্বামীগণ, শাক্তধর্ম্মে অকৃত্রিম আস্থাবান ভট্টাচার্য্য মহাশয়গণ। তাঁহাদের নিম্নে যাহারা আছে তাহারা তাঁহাদেরই শিষ্য প্রষিশ্য হেতু সেই ধর্ম্মব্যুহরূপ যশোদলে যে হঠাৎ অন্য ধর্ম্ম প্রবেশ করিবে তাহার সাধ্য কি? আমার কথা ক্রমে যশোদলে প্রকাশ পাইতে লাগিল, কেহ কেহ আমাকে উপদেশাদি দিয়া সতর্ক করিতে ত্রুটী করিলেন না।

    আমি বুঝিলাম যশোদল থাকা নিরাপদ নহে বিশেষ যাঁহার বাটীতে আছি তাঁহাদের বিপদ ঘটীবে। এই জন্য সে দিন স্কুলে যাইয়া ছাত্র ও মাষ্টর -- সকলকে জানাইলাম, যশোদল বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কোথায় বা যাইব, কিছু উপায়ান্তর দেখিতেছি না। হেড্‌মাষ্টর বাবু ২/৪ দিনের মধ্যেই আমার পরিচয় পাইয়াছেন যে, আমি একজন ছাত্র হইলেও সর্ব্ববিষয়ে অগ্রগণ্য, অনেকই আমার মুখাপেক্ষী ও অনুগামী। তিনি দিনুবাবুর সহিত কিয়ৎকাল আলাপ করার পর আমাকে বলিলেন, তুমি কাল হইতে আমার বাসায় আসিয়া থাক, তোমার সর্ব্ববিধ খরচ স্কুল ফাণ্ড হইতে দেওয়া যাইবে। এই অচিন্তিত অনুগ্রহের কথা শুনিয়া আমার সকল ভয় ভাবনা দূর হইয়া গেল। প্রিয় ছাত্রগণ, সেক্রটারী মহাশয় ও অন্যান্য শিক্ষক পণ্ডিতসকলেই এ প্রস্তাব অনুমোদন করিলেন।

    পরদিন প্রাতেই যশোদলে বাটীর কর্ত্তৃকে জানাইলাম, আমি নগুয়া চলিয়া যাইতেছি, অত:পর আর আপনার কোন ভাবনার কারণ নাই। তিনি কান্দাকাটী করিয়া আমাকে প্রবোধ দিবার অনেক চেষ্টা করিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, আপনি স্ত্রীলোক পাছে বিপদে পড়েন, এই ভয়েই আমি আপনার আশ্রয় পরিত্যাগে বাধ্য হইলাম, নতুবা আপনার ন্যায় মাতৃসমা স্নেহশীলা অভিভাবিকাকে কখনই ছাড়িয়া যাইতাম না।আপনি আমার জন্য যাহা করিয়াছেন, অনেকের আপন মাতাও তাহা করেন নাই, আপনার ঋণ আমার অপরিশোধনীয়। অনেক প্রবোধজনক বাক্যের পর তিনি যেন শান্তী লাভ করিলেন। বলা বাহুল্য, কৈলাস, যোগেশ ও রামদুলাল সরকার ইহারা সকলই আমার এই অভূতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন ব্যাপারে দু:খে ম্রিয়মান হইল।

    প্রাতেই একজন মজুর ডাকিয়া শয্যা বিছানাদি ও অন্যান্য যাহা কিছু ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র ছিল তাহা মজুরের হস্তে দিয়া তৎসহ বেলা ১০টার সময় আসিয়া নগুয়া গ্রামে হেড্‌মাষ্টর বাবুর বাসা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দীনদয়াল বাবুদের বাড়ীর সমুখেই তাহার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায়, তিনি মজুরের মাথা হইতে জিনিসপত্রাদি তাঁহার বাড়ীতে নিয়া গেলেন, কারণ থাকিবার ও পড়াশুনা করার স্থান সেখানেই নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে, কেবল আহার মাত্রই হেড্‌মাষ্টর মহাশয়ের একসঙ্গে করিতে হইবে। পূর্ব্বেই আমার আহারিয় অন্নাদি প্রস্তুত হইয়াছিল। দীনুবাবুর আদেশে স্নান করিয়া তথায় আহার করত: স্কুলে গিয়া যেন হাপ্‌ ছাড়িলাম।

    নিশ্চিন্ত হইয়া পড়াশুনায় মন দিলাম। প্রিয় সুহৃদ প্রসন্ন ও মহেশ্বরাদি ছাত্রবর্গকে নিকটেই পাওয়ায় যেন হাতে আকাশ নাগুল্‌ পাইলাম। প্রসন্নের জ্যেষ্ঠ সহোদর গোবিন্দদাদা যেমন সোদরাধিক স্নেহে আমাকে দেখিতেন, দীনদয়ালবাবু মাষ্টরও সেইরূপ প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে আমাকে নিরীক্ষণ করিতেন। তাঁহারা একাধারে আমার অভিভাবক ও বন্ধু। খাওয়া পড়া প্রভৃতি সর্ব্ব বিষয়ের ভার দীনুবাবু গ্রহণ করিলেন। পিতা কি মাতা যেমন শিশু ছেলে কোন্‌সময় কি আহার করিবে তাহার চিন্তা রাখেন, দীনুবাবুও সেইরূপ আমার প্রাতে ও বিকালে জলযোগের ব্যবস্থা করিতে ত্রুটী করিতেন না। কোথায় আম, কোথায় কাঁঠাল, খির, চিড়া ও চিনী প্রভৃতি ভূজ্য দ্রব্যাদির সংগ্রহ ও ব্যবস্থা পিতার ন্যায় দীনুবাবু করিতে যত্নপর থাকিতেন।
  • achintyarup | 59.93.255.158 | ১৫ জুলাই ২০১১ ০৪:৫৯480355
  • এই যে আহারাদির প্রাচুর্য্য ও ভোগসুখের অনুষ্ঠান তাহা যেন সারা জীবনেই আমার একরূপ চলিয়াছে, ভগবান আমাকে যেন চিরসুখী ও ভোগী অবস্থায় জীবনের অবসান করাইবেন। ছাত্রজীবনের কথাও বলিলাম। মধ্য জীবনে কার্য্যক্ষেত্রে যখন ছিলাম তখন নিজ কর্ত্তৃত্বাধীনে ঠাকুর ও ভৃত্যাদির সেবায়ও ভোগসুখের চূড়ান্ত হইয়াছে। শেষ জীবনে প্রায় একবৎসরকাল চুঁচুড়ায় মুক্ষদার বাসায় যে ছিলাম সেখানেও সেবা পরিচর্য্যা এবং সুপেয়, উপাদেয় ভূজ্যাদির উপভোগে পরম সুখ অনুভব করিয়াছি। আর এখন এই শ্রীবৃন্দাবনধামে যে নিতান্ত অপরিচিত সুদূর বীরভূম জেলা নিবাসী মালীক মহাশয়ারঁ শ্রীরাধাবৃন্দাবনচন্দ্র জিউর মন্দিরে বাস করিতেছি তাহাতেও ভোগসুখের প্রাচুর্য্যতা বিদ্যমান। কোন২ লোক হিংসাপরবশ হইয়া বিবাদ স্থলে বলিয়াছে যে আপনি পরের টাকায় রাজভোগ করেন। একথাটা হাড়ে২ সত্য। রাজভোগ যখন আমারঁ ঠাকুরের জন্য ব্যবস্থা আছে, আর আমি যখন তাঁহার সেবক, তখন এই রাজভোগের প্রসাদ আর কে পাইবে? আমি ইচ্ছা করিয়া যাহাকে দেই সেই কিছু পায়। এই যে ব্যবস্থাটা হইয়াছে তাহার জন্য আমি কোন চেষ্টা কি যত্ন করি নাই। শ্রীবৃন্দাবন আসিবার অব্যবহিত পূর্ব্বে ভাবিয়া ছিলাম বৃন্দাবনে গিয়া কোথায়ও সাধু সন্যাসীর সঙ্গ গ্রহণে বনে জঙ্গলে বাস করিব। কিন্তু আমার ইচ্ছায় যে কার্য্য হয় না, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখানেই দৃষ্ট হইতেছে। ভগবানের হস্ত এখানে দেদীপ্যমান প্রসারিত কি দৃষ্ট হয় না? নতুবা আমি ভিক্ষান্নে জীবনযাপন প্রয়াসী হইয়াও রাজভোগে কেন উদরপূরণ করিতেছি? ইহা সেই লীলাময়েরই অচিন্তনীয় লীলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাসঁ তিনি আমার ভোগ বাসনার নিবৃত্তি এখানেই করিয়া নিতেছেন। এজন্য আর আমাকে জন্মান্তর পরিগ্রহ বা অনুসরণ করিতে হইবে না, তবে অন্যান্য আসক্তি প্রযুক্ত জন্মান্তরের কারণ ত বিদ্যমান আছেই। ভগবান আমি তোমার দাস বলিয়াই কি এত কৃপা!!
  • achintyarup | 59.93.254.187 | ১৬ জুলাই ২০১১ ০৫:৪০480356
  • যাহা হউক আপন কথা ছাড়িয়া অনেকদূর সরিয়া পড়িয়াছি; পাঠক মনে রাখিবে, শ্রীবৃন্দাবনধামে বাস করিয়া নির্জ্জন প্রকোষ্ঠে কেবল চড়ই, ইন্দুর ও বান্দর প্রভৃতি ইতর প্রাণীর ভোগ কোলাহলের মধ্যে বসিয়া এই বহী লিখিতেছি। মনে যে ভাব প্রবল হইতেছে তাহাই লেখনী অগ্রে গ্রথিত হইতেছে। ইহার কর্ত্তা আমি নহি। আমি আর এখন আমাতে নাই। যাঁহার শান্তীময় ক্রোড়ে আশ্রয় পাইয়াছি সেই চিরশান্তী দাতার শ্রীশ্রীচরণে কায়মনপ্রাণ সমর্পণ করিয়াছি; দৃঢ় বিশ্বাস তিনি যাহা করান তাহাই করি। এই যে জলের মত লিপী চাতুর্য্য বিস্তার লাভ করিতেছে, তাহা কি আমার আয়ত্বাধীন? কখনই না! স্বয়ং বীণাপাণিই তাহা চালাইতেছেন। আমি তাহার জড় যন্ত্র মাত্র। পূর্ব্বে যে খসরা লিখা হইয়াছিল, এখন তাহার আমূল পরিবর্ত্তন কে সাধন করিতেছে? ধন্য তুমি হেঁ বৃন্দাবনচন্দ্র! ধন্য তোমার অপার মহিমা ও লীলা!! লোকে বলিবে এ সকল বাহাদূরী কথা, তজ্জন্য আমি ভয় ভাবনা করি না। কারণ যশ লাভ কি অর্থের প্রত্যাশায় এ বহী লিখা নহে। সত্যকথা ভাব প্রবণতায় যাহা হইবার হইতেছে।

    ব্রাহ্ম্য ধর্ম্মে একান্ত আস্থাবান হওয়ায় খুটীনাটী সামান্য বিষয়েও পাপ কি অপরাধজনক কার্য্য হয় কিনা তাহার হিসাব করিয়া চলিতে যেন স্বত:ই মনে খট্‌কা বাজিত। চন্দ্রমোহনবাবু গুরুপদে আসীন, তাঁহার উপদেশের মৌলীকতাও এইরূপ। একদা কথা প্রসঙ্গে চন্দ্রমোহনবাবু বুঝাইলেন যে কিশোরগঞ্জ স্কুল ভাঙ্গার ব্যাপারটার মূলে তোমাদের পাপ রহিয়াছে। এই মর্ম্মঘাতী বাক্য শ্রবণ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম এখন সে পাপ যায় কি করিয়া? তিনি বলিলেন ""তাহার প্রায়শ্চিত্ত -- সেখানে গিয়া ক্ষমা চাহিয়া সেই স্কুলেই পাঠ করা''। এই বাক্য শ্রবণান্তে ২য় শ্রেণীর ছাত্র বনগ্রাম নিবাসী ব্রাহ্ম্য ধর্ম্মে আস্থাবান্‌ ছাত্র মহেশচন্দ্র বলিয়া উঠিল আর কেহ যাউক আর নাই যাউক, আমি নিশ্চয়ই সেখানে গিয়া ক্ষমা চাহিব। আমার মনও তাহাতে সায় দিল, আমি বলিলাম তাহাই করিব।

    এই কথোপকথনের সময় অন্যান্য যাহারা উপস্থিত ছিল তাহাদের কেহ গিয়া তদ্দণ্ডেই হেড্‌মাষ্টর চন্দ্রকুমারবাবুকে জানাইল যে গগন ও মহেশ পুরাতন স্কুলে চলিয়া যাইতেছে, চন্দ্রমোহনবাবু এই উপদেশ দিয়াছেন যে স্কুল ভাঙ্গার কার্য্যটার মূলে পাপ রহিয়াছে, সেখানে গিয়া ক্ষমা চাহিলেই তাহার প্রায়শ্চিত্ত হইবে। স্কুল তখন ছুটী হইয়াছে। হেড্‌মাষ্টরবাবু বাসা হইতে সেই মূহুর্ত্তে ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত ছাত্রবর্গকে বলিলেন, কেহই আমার বক্তৃতা না শুনিয়া বাসায় যাইও না। বিশেষ বক্তব্য আছে। চন্দ্রমোহনবাবু তখন চলিয়া গেলেন।

    স্কুল প্রাঙ্গণেই দাঁড়াইয়া আমাকে ও মহেশ রায়কে লক্ষ্য করিয়া গদগদ কণ্ঠে তিনি বলিতে লাগিলেন। ""দেখ কিসে পাপ কিসে পূণ্য তাহা বুঝা সুকঠিন। মহাভারতের কথা স্মরণ কর, জগতের একমাত্র আদর্শ পুরুষ যাহার মুখ হইতে গীতারূপ অমৃত ক্ষরিত হইয়া জগতের সর্ব্বধর্ম্ম সমন্বয় সাধন করিয়াছে, তিনি দ্রোণবধকালে ও জয়ধ্রতের বধকালে কি উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন? কেন? যে কার্য্যের মূলে ধর্ম্ম রহিয়াছে তাহার সুনির্ব্বাহ জন্য দুই একটী কার্য্য বহির্দ্দৃষ্টিতে বিগর্‌হিত দৃষ্ট হইলেও তাহা যখন মূলের অন্তরায় তখন তাহা বাধ্য হইয়া করিতে হয়। আর এই সমগ্র ভারতযুদ্ধ ব্যাপারটা চিন্তা করিয়া দেখিলে ইহা কি মনে স্বত:ই উদয় হয় না যে, যে ব্যক্তি জগতের একমাত্র আদর্শ পুরুষ তিনি কি মনে করিয়া এত কোটী২ লোকবধরূপ হিংসার বিরাট ব্যাপারটা অম্লান বদনে সম্পন্ন করাইলেন? কিন্তু নিবিষ্ট চিত্তে আধ্যাত্মিকভাবে চিন্তা করিয়া দেখিলে বুঝা যায় যে, যে কার্য্যের মূলে ধর্ম্ম অর্থাৎ জাগতিক হিতসাধন তাহাতে এরূপ আততায়ী বধ দোষণীয় নহে। আর পাপ পূণ্যের সুক্ষ্ম বিচার ভগবানের নিকটে কিভাবে হইবে তাহাই কে বুঝিতে পারে? বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যাহারা বহির্দ্দৃষ্টিতে আজন্মই পাপকার্য্য করিয়াছে বলিয়া লোকে মনে করিয়াছে তাহাদেরও অন্তিমকালে সদ্‌গতী লাভ হইয়াছে। পাপ পূণ্যের হিসাব বড় সুক্ষ্মাণুসুক্ষ্ম। আমাদের মত স্বল্পদর্শী লোকে তাহার অণুমাত্র বুঝিতে সক্ষম নহে। বিশেষত: ব্রাহ্ম্যধর্ম্মের এই বাল্যাবস্থায় খুটীনাটী বিষয়ে দৃঢ়তা অবল্‌ম্‌বন করিলে লোকের মনোভঙ্গের হেতু হইয়া ভাবের স্থায়ীত্ব ও ধর্ম্মে আস্থা স্থাপন হইবে না।'' তাঁহার এই যুক্তিপূর্ণ বাক্যগুলী সকলেরই ভাল লাগিল ও মনোভাব পরিবর্ত্তন করিয়া দিল। আমারও আর তৎসম্বন্ধে দ্বিধা রহিল না, বিশেষত: তিনি সজল চক্ষে করুণ কণ্ঠে যখন বলিলেন যে, ""গগন এবার পরিক্ষা দিলে তাহার প্রতি স্কুলের আশা ভরসা আনেক নির্ভর করে, এমন অবস্থায় এই অকারণ ধর্ম্ম বিভ্রাটে ফেলীয়া তাহার জীবন নষ্ট করিতে আমি কখনই দিব না''। তখন কি আর আমি তাঁহার সেই সজল নেত্রপ্রতি দৃষ্টিপাত করত: তাঁহার বাক্যাবলীর প্রতিবাদ করিতে সাহসী হইতে পারি? আমি তাঁহাকে নতজানু হইয়া অভিবাদন করত: বলিলাম, ছার্‌! আমাকে ক্ষমা করুণ, আমি আপনার কথার কখন অবাধ্য হইব না। এসময় দীনুবাবুও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, পাগ্‌লামী ছাড়িয়া দেও, পরীক্ষা নিকট, এখন এসকল তর্কবিতর্কের প্রয়োজন নাই, ধর্ম্ম এক দিকে, বাল্যজীবনে শিক্ষা অন্য দিকে, শিক্ষাই বাল্যজীবনে মূখ্য, ধর্ম্ম গৌণ। তাঁহার দিকে আর নেত্রোত্তোলন করিতে পারিলাম না। তাঁহাদের সেই স্নেহ ও যুক্তিসঙ্গত কথায় সকল ছাত্রই উৎফুল্ল হইল। সভাভঙ্গ করিয়া সন্ধ্যা সমাগমে সকলই যাহার তাহার গৃহে গমন করিয়া শান্তী লাভ করিল। দীনুবাবু আমার গলদেশে হস্তস্থাপন করিয়া বাসায় লইয়া গেলেন। সব গোল মিটিয়া গেল। গোবিন্দদাদা শুনিয়া বলিলেন, গগন যদি যাইতে চায় তাহাকে বান্ধিয়া রাখিব। বলা বাহুল্য, চন্দ্রমোহনবাবু পরদিন হইতে কার্য্য ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া গেলেন। অত:পর বাবু কালাচান্দ দে নামক নর্ম্মাল পাশ পণ্ডিত আসিলেন।
  • I | 14.96.54.110 | ১৭ জুলাই ২০১১ ০১:২৫480357
  • বা: !
  • nk | 151.141.84.194 | ১৭ জুলাই ২০১১ ০২:২৮480358
  • খুব ভালো লাগছে এই লেখা। একদম সেই কালের দৃশ্য কথাবার্তা ঘটনা টানাপড়েন সব নিয়ে ফুটে উঠছে। অসাধারণ লেখা।
    অচিন্ত্যরূপকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
  • achintyarup | 59.93.246.61 | ২৬ জুলাই ২০১১ ২৩:৫৬480359
  • আর এক কথা এখানেই বলিতে হইল -- ভগবানের বিশ্বরচনা ও কল্পনা। জগতটাকে অনেকে ভ্রম -- মরিচীকা সদৃশ বলেন। আমাদের চিত্তটাকে ভগবান এমনই ভাবে গঠন করিয়াছেন যে তাহা দিবানিশি কেবল কল্পনা রাজ্যেই বিচরণ করিতেছে। ছোটবেলা হইতেই আমার অভ্যাস এই কল্পনা লইয়া খেলা করা। রাত্রিতে নিদ্রাকালে কোন একটা সুখজনক বিষয়ের কল্পনা অবলম্বন না করিলে নিদ্রা আসে না। দিনেও অনেক সময় কোন কার্য্যে অবলম্বন না থাকিলে মন কেবল কল্পনা সম্ভূত চিন্তা লইয়াই যেন আরাম লাভ করে। বৈষ্ণবাচার্য্যগণ যে রাগমার্গের ভজন সম্বন্ধে কল্পনার আশ্রয় লইয়াছেন তাহা অস্বাভাবিক নহে। এই সাধন পথে ভগবানের লিলা কল্পনা যে কত সুখকর ও আনন্দজনক তাহা যে এপথে না চলিয়াছে সে বুঝিবে না। সকল রকম কল্পনা হইতে ভগবানের লীলা কল্পনাই মূখ্য কল্পনা। সংসার সাগর উত্তীর্ণ হওয়ার পক্ষে এমন সুগম উপায় আর নাই।

    পীড়া।
    এখন মূল বিষয়ের অবতারণা করা যাউক। আমাদের পরীক্ষার দিন ক্রমে নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল। পড়াশুনার ধূম পরিয়া গিয়াছে, রাত্রি জাগরণেরও ত্রুটী হইতেছে না। ইতিমধ্যে পরীক্ষার প্রায় তিন মাস পূর্ব্বে আমার জ্বর রোগ প্রকাশ পাইল। ১ দিন দুই দিন করিয়া ৭ দিন গেল, জ্বর দূর হয় না। চিকিৎসায় কোনই ফল হইতেছে না। দীনুবাবু মাষ্টর, প্রসন্ন ও মহেশ্বর অনন্যকর্ম্মা হইয়া দিবানিশি শুশ্রুষার ত্রুটী করিতেছেন না। জ্বর ছাড়িল বটে কিন্তু পালা ধরিল, কুইনাইন খাইয়া স্কুলে যাই, পড়াশুনাও ছাড়িনা, কিন্তু শরীর বড় দুর্ব্বল ও অবসন্ন হইয়া পড়িল। আর চলে না, পরিশেষে মাষ্টর, পণ্ডিত ও ছাত্রবন্ধুগণের সকলই মত করিলেন কিছুকাল স্থান পরিবর্ত্তণ করিয়া বাস করা, সুতরাং বাড়ীতে যাওয়াই স্থির হইল। জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের নিকট এ সংবাদ পত্রযোগে জানাইলে তিনি নৌকাযোগে আগমন করিয়া আমাকে বাড়ী লইয়া গেলেন। যাওয়ার কালে দীনুবাবু প্রভৃতি শিক্ষকবর্গ ও ছাত্রবন্ধুগণ সকলেই সজল নেত্রে বলিয়া দিলেন বাড়ীতে খুব সতর্কভাবে থাকিবে, বিশেষ পড়াশুনা করিবে না। কিছু আরাম পাইলেই চলিয়া আসিবে। দীনুবাবু বলিলেন আমি চিঠিপত্র দিব, পরীক্ষার নির্দ্দিষ্ট দিনের ২ দিন পূর্ব্ব পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিয়া পরে যাহা হয় করিব।
  • achintyarup | 59.93.255.47 | ২৭ জুলাই ২০১১ ০২:৪১480360
  • তখন বর্ষাকাল, যথাসময়ে বাড়ী পঁহুছিলাম। বাড়ীতে যে কতদিন ছিলাম জ্বর বড় হয় নাই তবে দুর্ব্বলতা সারিতেছে না। যথাসময়ে দীনুবাবুর পত্র পাইয়া নৌকারোহণে নগুয়া রোয়ানা হইলাম। কিশোরগঞ্জ পঁহুছিয়াই শুনিলাম, দুই স্কুল মিশিয়া এক হইয়াছে। ইনস্‌পেকটার সাহেব আসিয়া নগুয়াতে দরবার করিয়া ছাত্র মাষ্টর সকলকে উন্নতীর আশ্বাস দিয়া বিশেষ শিষ্টাচারের সহিত নগুয়ার ছাত্রদিগকে আদর যত্নে কিশোরগঞ্জে নিয়া গিয়াছেন। পরীক্ষার্থী ছাত্রগণ কেহই তথায় গমন করে নাই। দ্বিতীয় শ্রেণী হইতে সকলই গিয়াছে। নৌকা আখ্‌রার ঘাটে রাখিয়া দীনুবাবুদের বাটীতে গেলাম। দীনুবাবু আমাকে দেখিয়াই কান্দিয়া ফেলিলেন। একত স্কুলের দু:খ, হয়ত আমার অবস্থাঘটীত দু:খেই তাঁহার করুণ হৃদয় বিগলিত হইল। বলিলেন বৈকুণ্ঠবাবু স্কুল ডেপুটী ইন্‌স্‌পেকটারের নৌকা আছে, তিনিও নাসিরাবাদ যাইবেন, কিন্তু তাঁহার নৌকায় গেলে আশঙ্কা হয়, যথাসময়ে পরীক্ষার পূর্ব্বে গিয়া পঁহুছিতে পারি কিনা! যদি সাহস কর তবে অদ্য রাত্রিশেষে তোমাকে লইয়া পদব্রজে রোয়ানা হই। আমি বলিলাম যেরূপে পারি যাইব, চলুন। তাহাই হইল। পরদিন প্রত্যুষে হাঁটীয়া দীনুবাবুসহ রোয়ানা হইয়া দুই দিবস কষ্টে ও অবসন্ন দেহে নসিরাবাদ শহরে পঁহুছিলা। আউটপাড়ার কৃষ্ণ রায় আমার পিস্‌তুত ভগ্নির সন্তান। সেই ভাগিনার বাসায় গিয়া রহিলাম। কৃষ্ণচন্দ্র আমাপেক্ষা বয়সে অনেক বড়,দাওরার সিরিস্থায় জজ আদালতে কাজ করিতেন।

    পরীক্ষা।

    পরদিন যথাসময়ে পরীক্ষাগৃহে গেলাম। কষ্টে ও ভয়ে২ পরীক্ষা দিয়া নিষ্কৃতি পাইলাম। পাশ হইব মনে হইল কিন্তু আশানুরূপ হইবে না। পরীক্ষা অন্তে দীনুবাবু সহ নগুয়ায় ফিরিয়া গল্পগুজব ও ধর্ম্মালোচনা করিয়া দিন কাটাইতে লাগিলাম। আহারাদি দীনুবাবুই যোগাইতে লাগিলেন। শরীর ভাল হইল। নগুয়া স্কুলের অস্তিত্ব ত লোপ পাইয়াছে, তৎস্থলে একটা পাঠশালা বসিল। কয়েক দিন তথায় ছাত্র পড়াইলাম।

    যথাসময়ে পরীক্ষার ফল বাহির হইল। কাগজে দেখি ১ম বিভাগেই পাশ হইয়াছি। পরে জানিতে পাইলাম, প্রসন্ন ও মহেশ্বর বৃত্তিপ্রাপ্ত হইয়াছে। আমার তিনমাস রোগ ভোগ বৃত্তির নম্বর না থাকার কারণ বলিয়া মনে হইল, আরও মহেশ্বর গণিতে, প্রসন্ন সাহিত্যে আমাপেক্ষা ভাল ছাত্র ছিল বলিয়াই আমা হইতে বেশী নম্বর পাইয়া থাকিবে, ইহাও মনে হইতে লাগিল। যাহা হউক তাহাদের বৃত্তি প্রাপ্তিতে ও ১ম বিভাগে ৪ জন ছাত্র পাশ হওয়াতে আমাদের মুখ উঙ্কÄল হইল। কিশোরগঞ্জ স্কুল কর্ত্তৃপক্ষের মুখ ম্লান হইল।

    নগুয়াতে রহিলাম বটে, কিন্তু সে সুখ স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় যেন অরণ্যবাস প্রতিয়মান হইতে লাগিল। সে ছাত্রবন্ধুগণ নাই সে অভিভাবক স্থানীয় সুহৃদগণ সুদূর প্রদেশে চলিয়া গিয়াছেন। আলোর পর অন্ধকার ইহা চির প্রসিদ্ধ কথা। আমাদের বেলায় তাহার অন্যথা কেন হইবে?

    চন্দ্র কুমার বাবু হেড্‌মাষ্টর মহাশয় শ্রীহট্ট নেশনেল্‌ স্কুলে পদপ্রাপ্ত হইয়াছেন। তথা হইতে দীনুবাবুকে লিখিলেন -- ""গগনকে এখানে পাঠাইয়া দেন, পড়াশুনার ব্যবস্থা আমি করিব''। দীনুবাবু বলিলেন এতদূরে গিয়া কাজ নাই, চল ঢাকা যাই, তথায় কালীনারায়ণ বাবু আছেন তাঁহার পরামর্শ মতে যাহা হয় হইবে। প্রসন্ন প্রভৃতি কে কোথায় চলিয়া গিয়াছে সন্ধান পাইলাম না। মাঝে২ কেবল গোবিন্দদাদার সহিত দেখা হইত।

    কিয়দ্দিন নগুয়াতে পরামর্শাদি করিয়া কয়েকজন ছাত্র ও দীনুবাবু এবং বাবু আনন্দকিশোর চক্রবর্ত্তী মাষ্টর ১০/১১ জনে মিলিয়া হুশেনপুরের ঘাটে এক বৃহৎ নৌকা ভাড়া করিয়া ঢাকা রোয়ানা হইলাম। বলা বাহুল্য তখন ঢাকা ময়মনসিংহ রেলরাস্থা হয় নাই। সে ১৮৭৪ সালের কথা। যথাসময়ে ঢাকা পঁহুছিয়া পরামর্শ ক্রমে আমি কলেজিয়ট্‌ স্কুলে জেনারেল লাইনেই ভর্ত্তি হইলাম। দীনুবাবু প্রভৃতি মেডিকেল্‌ স্কুলে ভর্ত্তি হইলেন, তখন মাইনার ও ছাত্র বৃত্তি পাশের সার্টীফিকেট হইলেই ডাক্তারীতে প্রবেশ করা যাইত।
  • achintyarup | 59.93.255.47 | ২৭ জুলাই ২০১১ ০৩:২৩480361
  • ঢাকা কলেজিয়ট স্কুলে।

    ঢাকাতে হয়বৎনগরের দেওয়ান সাহেবগণের যে সুবৃহৎ হাবেলী আছে, কালীনারায়ণবাবু মোক্তার স্বরূপে তথায় বাস করত: উক্ত সাহেবগণ পক্ষে কার্য্য পরিচালনা করিতেন। আমরাও সেই হাবেলীতে স্থান পাইলাম। সেই হাবেলীতে গিয়া আর এক জন ছাত্রবন্ধু প্রাপ্ত হইলাম। ইট্‌না গ্রাম নিবাসী ব্রাহ্ম্য ধর্ম্মে দীক্ষিত বাবু কাশীকিশোর বিশ্বাস মহাশয়ের পুত্র হরকিশোর বিশ্বাস। হরকিশোর আমার সমবয়সী ও সমপাঠী -- উভয়ে বেশ প্রিতী জন্মিল। পূর্ব্বেকার বন্ধুদের কথা কতকটা ভূলিতে লাগিলাম। বাড়ীতে জ্যেষ্ঠ তাত্‌ মহাশয় অতিকষ্টেও সংসার চালাইতে অপারগ হইয়া উঠিয়াছেন। আমার পড়ার ব্যয় দেওয়া তৎপক্ষে সুকঠিন হইয়াছে হেতু হরকিশোর ও আমি দুইজনে দুই পয়সার জলখাবার -- একপয়সায় কলা কি যবের ছাতু ও একপয়সার গুড়, আনিয়া বিকাল বেলায় ক্ষুণ্নিবৃত্তি করিতাম। নিজেরা পাক করিয়া, ভৃত্যব্যতীত সকল কার্য্যই স্বাবলম্বনে নির্ব্বাহ পূর্ব্বক উদর পূরণ ব্যাপারটা অতি স্বল্প ব্যয়ে সমাধা করিতাম। যাহা হউক, কষ্টে দু:খ দেখিতে২ আশ্বীন মাস আসিল, আমার আবার জ্বর হইল। জ্বর লইয়াই বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম।

    কাশী বিশ্বাস মহাশয় আমার রোগজীর্ণ শরীর দৃষ্টে বলিলেন আমি শীঘ্রই বাড়ী যাইতেছি, আমার সঙ্গে বাড়ী চল। আমি যেন হাতে আকাশ স্পর্শ করিলাম। কয়েকদিন পরই তৎসহ নৌকাযোগে বাড়ী রোয়ানা হইলাম, তিনি অতি যত্নের সহিত আমাকে বাড়ী পঁহুছাইয়া দিয়া গেলেন। বাড়ীতে গেলে বাড়ীর লোক -- মাতা -- জেঠাইমাতা ও জ্যেষ্ঠতাত মহাশয় সকলই আমাকে দেখিয়া কান্দিয়া উঠিলেন।

    একেত ঝড়ের প্রচণ্ড প্রতাপে বাড়ী গৃহশূন্য প্রায়, তাহাতে ঋণে সোনার সংসার ছাড়ে খারে যাইতে বসিয়াছে। জ্যেষ্ঠতাত মহাশয় অশীতিপর বৃদ্ধাবস্থায় জরাজীর্ণ শরীরে সংসার ভার বহনে অক্ষম হইয়া অট্টালীকা প্রকোষ্ঠে শয্যাগত প্রায় আছেন। তদোপরি তাহারা শুনিয়াছেন আমি ব্রাহ্ম হইয়াছি। ইত্যাদী কারণ পরম্পরার একত্র সমাবেশে তাঁহাদের হৃদয় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। তাঁহারা কিয়দ্দিন যাবৎ আমার জ্বর রোগের কথা জানিয়া আমার আশাপথ চাহিয়াই আছেন। আমার সহিত সাক্ষাৎমাত্রই সে দু:খযন্ত্রণার বেগ অসহনীয় হওয়ায় সকলেই চক্ষের জলে বক্ষ ভাসাইলেন।

    যথাসময়ে সকলেরই মনোবেদনা প্রশমিত হইলে, সাংসারিক অবস্থা সম্বন্ধে কথা উঠিল। মাতা ঠাকুরাণীর কথার ভাবে বুঝা গেল দোষ সম্পূর্ণই জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের, তাঁহারই বুদ্ধিদোষে সোনার সংসার ছাড়ে খারে গিয়াছে। জ্যেষ্ঠতাত মহাশয় অশীতিপর বৃদ্ধ, সে জড়াজীর্ণ দেহে বুদ্ধির প্রখরতা যে লোপ পায়, ইহা স্ত্রীলোকে কি করিয়া অনুধাবন করিবেন? কাজেই তাঁহার শিরে দোষের বোঝা চাপাইতেছেন। যাহা হউক আমি ভাবিলাম, যাহা হইবার হইয়াছে। বৃদ্ধাতিবৃদ্ধ সরলতার সজীব মূর্ত্তিকে কেন কলঙ্ক কালীমায় লেপন করিব?

    ------------------
  • achintyarup | 59.93.255.47 | ২৭ জুলাই ২০১১ ০৫:১৪480363
  • আত্মকথা।

    ৫ম পরিচ্ছেদ।

    সংসার।

    জ্যেষ্ঠতাত রাজচন্দ্র রায় মহাশয় সজল নেত্রে বলিলেন, ""বাবা! সংসার বুঝিয়া নেও, আর পড়াশুনার প্রয়োজন নাই। আমি আর পড়ার খরচ চালাইতে পারিতেছি না।'' সংসারের ভার যে তাঁহার পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল তাঁহার আবেগময় ব্যাকুলতাপ্রকাশক বাক্যে ইহাই সুস্পষ্ট প্রকাশ পাইতেছিল। সুতরাং তাঁহাকে এই দু:সহনীয় যন্ত্রণা হইতে যে অব্যাহতি প্রদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য, ইহাই আমার মনে উদয় হইল। তবে পড়াশুনার কি হইবে, এই চিন্তাও মনকে আলোড়িত করিতে ছাড়িল না। এখানে একটা বিচার্য্য বিষয় এই হইল যে, যখন বাটী হইতে খরচ চলিবে না, তখন আর এই শিক্ষাব্যয় ভার কে বহন করিবে? এত আর ছোটবেলার পড়া নহে, আর সেই নগুয়া স্কুলের ব্যবস্থাও নহে। এইরূপ ভাবনা চিন্তায় কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলাম। মাতা ঠাকুরাণীও সংসার দেখিবার কথা বলেন, জেঠীমাতা ঠাকুরাণীও তাহা সমর্থন করেন। অন্যান্য হিতৈষী ব্যক্তিগণও তাহাই প্রবোধ দিতে যত্ন করেন; এ হেন অবস্থার বিপাকে পড়িয়া আমি নিজের পদে কুঠারাঘাত পূর্ব্বক শিক্ষাসমাপনে বিদ্যামন্দিরে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিলাম এবং অন্ধের ন্যায় আপাতমধুর সংসারকে বরণ করিয়া লইলাম। হিতৈষী ছত্রবন্ধুগণ ও সুহৃদাগ্রগণ্য শিক্ষক মহাশয়গণের উচ্চ আশা ভরষা যেন ঢাকা হইতে আইসার কালে বুড়িগঙ্গার জলে বিসর্জন করিয়া আসিয়াছি বলিয়াই মনে হইতে লাগিল। ""চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে সুখানি চ দু:খানি চ'' এই শাস্ত্রবাণী যে নি:সন্দিগ্‌ধরূপে সত্য, তাহাই বুঝিতে আর বাকী রহিল না। পূজ্যপাদ জ্যেষ্ঠতাত রাজচন্দ্র রায় মহাশয় যে সরল প্রাণে বিত্তসম্পত্তি সহ ঋণভার আমার স্কন্ধে নিক্ষেপ করিয়া অসহনীয় সংসারের দায়ীত্ব হইতে অব্যাহতি লাভ করিলেন, তাহা তাঁহার জীবনী অংশেই এ গ্রন্থে পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে। এখন সংসারের দায়ীত্ব আমার শিরে। বয়স ১৮ বৎসর অতিক্রম করি নাই। স্কুলে পাঠ ও ব্রাহ্ম্যধর্ম্মের আলোচনা ভিন্ন কিছু জানি না, সংসারের কি বুঝিব? আমি যে সংসার সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক। যাহা হউক, -- একটা বিষয়ে শিশুকাল হইতেই আমার বিশেষ দৃঢ়তা ছিল, যখন যে বিষয় আমি ধরিতাম, তাহার শেষ না করিয়া পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিতাম না। এই কারণে সংসার নদীতে যে হাঙ্গর কুম্ভীরাদি প্রবেশ করিয়াছে তাহা দেখিয়াও ভীত হইলাম না। ঋণ পরিশোধের জন্য নানা ফন্দি আঁটিতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের দেওয়া ঋণ নিদর্শন পত্র (খত) এক উত্তমর্ণ (মহাজন) নিকট পরিবর্ত্তন করিতে গিয়া সুদের হার নিয়া বাদানুবাদ হওয়ায় সে খত আর পরিবর্ত্তন করিলাম না। মহাজন কিয়ৎকাল মধ্যেই বাজিৎপুর মুনশেফ্‌ কোর্টে নালীশ দায়ের করিল। সেই নালীশের জবাব দেওয়া উপলক্ষে তত্রত্য সদাশয় পিতৃস্থানীয় দয়ালু অথচ ন্যায়বান অমিত তেজা মুনশেফ্‌, বাবু হরিনাথ সিংহের সহিত পরিচয় হইল। তিনি অবস্থা জানিয়া দয়াপরবশ হইয়া মহাজনের দাবীকৃত টাকার জের সুদ বন্ধ করিয়া দিলেন অধিকন্তু আমার প্রার্থনা মতে এক বৎসর মধ্যে চারি কিস্তিতে টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করিলেন। কেন যে এ অযাচিত অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইলাম তাহা চিন্তাপথে উদয় হইলে মন দুই দিকে আকৃষ্ট হয়। এক, অদৃষ্টানুসারে সবই হইতেছে আমার কোন হাত নাইঅ মনে হয়, দ্বিতীয় আমার এই কালকটা রঙ্গের চেহারায় এমন কোন মাধুরিমা আছে কিনা, যাহাতে লোকে আমাকে দর্শনমাত্রেই ভালবাসিয়া ফেলে। মুনশেফ্‌ বাবু যে আমাকে প্রথম দর্শনেই ভালবাসীয়া ফেলীলেন তাহার কারণ কি? মণিষীগণ বলেন, মুখের চেহেরায় অন্তরের ভাব প্রস্ফুটিত হয়; তাহা হইলে মুনশেফ্‌ বাবু কি আমাকে বুদ্ধিমান্‌ ছেলে বলিয়া বিবেচনা করিলেন? না তাহা ত হইতে পারে না, এমন ২/৪ টী লোকের সহিত আমার সংঘর্ষ হইয়াছে, যাহারা আমার চেহারা দেখিয়াই আমাকে বুকা বলিতেও ত্রুটী করে নাই। একটী লোক আমাকে ""গারো'' চেহারা বলিয়া ঈঙ্গিত করিয়াছিলেন, সে কথাটা আমার স্মৃতিপথে সময়২ উদিত হয়।
  • achintyarup | 59.93.255.47 | ২৭ জুলাই ২০১১ ০৫:৪৬480364
  • যাহা হউক বারের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ উকীল মহাশয়গণ নিকট অবস্থার বিষয় অবগত হইয়া, উন্নতাবস্থার যে শেষ পরিণতী এখন এই দৈন্য দশায় নামিয়াছে, তাহা বিবেচনা করিয়াই বোধ হয়, ছেলেমানুষ জ্ঞানে অনুগ্রহতিশয় প্রদর্শন করিলেন, আমার এই ধারণা হইল। আর কোন কারণ আছে কিনা ভগবান জানেন এবং মুনশেফ্‌ বাবুই জানেন। তবে ইহাও আমার এক গুণ যে প্রথম দর্শনে লোক সহ আমি খুব সৌজন্যতা প্রদর্শন ও বিনয়নম্র ব্যবহার করিতে পারি; যে পর্য্যন্ত না একজনের খল চারিত্র্য প্রকাশ পায়, তৎকাল পর্য্যন্ত লোক মাত্রই ভগবানের অংশ বিবেচনায় আমি বন্ধু ও নমস্য বলিয়া মনে করি, কিন্তু খলতা প্রকাশ পাইলে, আমি অসহিষ্ণু হইয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণে ত্রুটী করি না। ইহা আমার সাধারণ স্বভাব।

    যাহা হউক যখন কিস্তিবন্দীর টাকা দিবার ১ম কিস্তির সময় আসিল তখন সেই টাকা সহ আমি মুনশেফীতে গিয়া হাজির হইলাম। মুনশেফ্‌ বাবু কোর্টে বসিবার পূর্ব্বেই গিয়া এজলাসে বসিয়া রহিলাম। যথাসময়ে তিনি এজলাসে আসিলে পেষ্কার কাগজপত্র দস্তখত করাইতে লাগিল। আমি গিয়া বলিলাম কিস্তির টাকা আনিয়াছি, কাহার নিকট দিব, তিনি প্যাদাকে বলিলেন ডিক্রীদারের উকীল অমুকবাবুকে ডাকিয়া আন, প্যাদা দ্রুতপদে গিয়া তাঁহাকে লইয়া আসিলে, মুনশেফ্‌ বাবু বলিলেন কিস্তির টাকা নিবেন কিনা দেখুন, নতুবা দাখিল করাইয়া লই। তিনি ম্লান মুখে আমার দিকে তাকাইয়া বলিলেন টাকা আমি নিব। হাকিম পেষ্কার দ্বারা পূর্ব্বেই নথী এজলাসে আনাইয়া রাখিয়াছিলেন, বলিলেন নথীতে রসীদ দেন। রসীদ দেওয়ার পর আমাকে বলিলেন, টাকা তাঁহার হাতে দেন। টাকা দিলাম, মুনশেফ্‌ বাবু আদেশ লিখিয়া নথী পেষ্কারের হাতে দিলে পেষ্কার তাহা রাখিয়া অন্যান্য কাগজপত্র দস্তখত করাইতেছে। আমি বসিয়া আছি দেখিয়া বলিলেন, ""অনেকে কিস্তিবন্দী ফেইল করে, তাহাতে হিতে বীপরিত হয়। আপনি যে তাহা ভূলেন নাই, ইহাতে আমি খুব সন্তুষ্ট হইলাম''। পরে বলিলেন --
    ""শুনিয়াছি আপনাদের অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল, খুব সুখী পরিবার বলিয়া খ্যাতীও আছে। এখন ঋণভারে প্রপীড়িত, আপনি দেখি ছেলেমানুষ, যাঁহার নামে নালীশ হইয়াছে তিনি আপনার কে হন''। আমি বলিলাম, আমি বালক কালে পিতৃহীন হইয়া এই জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়ের তঙ্কÄ¡বধানে বিদ্যালয়ে পাঠ করিতেছিলাম, ঋণের জন্য পড়ার খরচ বন্ধ করায়, এই গত পুজার বন্ধে বাড়ীতে আসিয়া, অশীতিপর বৃদ্ধ, সংসার পরিচালনে অসমর্থ, একমাত্র অভিভাবক স্থানীয়, জ্যেষ্ঠতাত হইতে সংসারের ভার বুঝিয়া নিয়াছি। এখন ঋণের জন্যই সব নষ্ট হইতে চলিল, যদি ঋণ আদায় করিতে পারি তবে সম্পত্তি ও নাম কাম সবই বহাল থাকিবে, নতুবা একেবারে পথে দাঁড়াইতে হইবে।

    হাকিম বলিলেন ""যদি কতক সম্পত্তি বিক্রয় না করিলে এই ঋণ পরিশোধের অন্য উপায় না থাকে, তবে কালবিলম্ব না করিয়া, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ সম্পত্তি ছাড়িয়া দেন। আপনি ছেলেমানুষ ঋণদায় হইতে মূক্তি পাইলে, বিদ্যাশিক্ষাও করিতে পারেন অথবা কোন চাকুরী কি ব্যবসায় অবলম্বনে উপার্জ্জনের পথেও পা দিতে পারেন। ঋণ পরে বৃদ্ধি পাইলে সর্ব্ব সম্পত্তি নষ্ট হইবে।

    তাঁহার এই উপদেশ আমার নিকট এত হিতজনক ও মূল্যবান মনে হইল, যে তাঁহাকে মনে২ অগণ্য ধন্যবাদ দিলাম। পুত্রবৎ স্নেহদৃষ্টিতে আরও বহু সদোপদেশ দিলেন। আমি এখানেই তাঁহার প্রকৃত ভালবাসার পরিচয়ের নিদর্শন প্রাপ্ত হইলাম। তাহা ভগবানের কৃপা বই কিছু নহে মনে করিলাম।
  • achintyarup | 59.93.243.132 | ২৮ জুলাই ২০১১ ০৪:৩৬480365
  • এই বৃদ্ধ বয়সে এই পূণ্যধামেও দেখিতেছি ২/৪ লোক আমার সহিত সাক্ষাতের পর হইতেই অহেতুক রূপে আমাকে ভালবাসিতেছে, সর্ব্বদা আমার হিতাকাঙ্ক্ষা করিতেছে। ইহা আমার নিজস্ব, -- আমার প্রতি ভগবানের যে অসীম করুণা, তাহার একমাত্র চিহ্ন। ভগবানের প্রেরণা তাঁহাদের মধ্য দিয়া আসে।

    মুন্‌শেফ বাবুর উপদেশ মতে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথমেই ভুনা (ভুলা?) গ্রামের তালুক্‌টা ছড়িয়া দিলাম। হাজার দেড়েক্‌ টাকা ঋণ পরিশোধ হইয়া গেল। তৎপর চেষ্টা করিয়া আরও কিছু খণ্ডারূপে জমী বিক্রয় করিলাম। তথাপী বহু টাকা অপরিশোধনীয় রহিল। অত:পর নাহুন্দ নিবাসী স্বনাম প্রসিদ্ধ হাইকোর্টের উদিয়মান মোক্তার বাবু লক্ষ্মীকান্ত রায় হইতে কম সুদে কতক টাকা করজ লইয়া খোজরা ঋণ সমস্ত দিয়া একস্থানেই কেবল দায়ী রহিলাম। এই ঋণও ক্রমে বর্দ্ধিত হয় দেখিয়া, কালেকটরীর খারিজা তালুকগুলী বাটওয়ারা করার জন্য প্রজাগণ হইতে তিন বৎসরের খাজান অগ্রিম গ্রহণে ময়মনসিংহ রোয়ানা হইলাম। রাজনারায়ণ দে তখন তহশীলদার ও সর্ব্ববিষয়ে মন্ত্রী, তাহাকে সঙ্গে লইয়া জিলার সদরে গমন করিলাম। রাজনারায়ণ বহুদর্শী ও নসিরাবাদের মোক্তার বাবুদিগের অনেকেরই পরিচিত, আমি ত তখন পর্য্যন্ত অবিবাহিত বালক। অভিজ্ঞ মোক্তার ও আমলা বাবুদিগের সহিত রাজনারায়ণের সাহায্যে পরিচয় হইল। বাটওয়ারা দায়ের করিয়া মোক্তার বাবু শিবচন্দ্র রায়কে তৎপরিচালনের ভারার্পণ করিলাম। তখন কালেকটরীর অভিজ্ঞ প্রাচীন মোক্তারগন মধ্যে বনগ্রামের জগজ্জিবন রায়, বড়ীবাড়ীর চন্দ্রকান্ত চক্রবর্ত্তী চারিপাড়া গ্রামের চন্দ্রনাথ দত্ত ও কাহেত পাউলী গ্রামের শিবচন্দ্র রায় ও নেত্রকোণার এলাকার প্রসিদ্ধ ধনী ও আইনজ্ঞ ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন সুচতুর বাবু জয়নাথ রায় প্রভৃতি বিশেষ প্রসার ও প্রতিপত্তি বিশিষ্ট বলিয়া জানিলাম।

    এই উপলক্ষে প্রায় মাসাধিক কাল সহরে বাস করিতে হইল। এই সময়েই কালেকটরীর সর্ব্বজনপ্রিয় স্বনামধন্য কাপাসটীয়া গ্রাম নিবাসী বাবু কৃষ্ণকুমার রায় মহাশয় সহ পরিচয় হইল। তিনি তখন বাটওয়ারা বিভাগের পেষ্কার, উত্তরকালে তিনি, স্বিয় প্রতিভাবলে সিরিস্থাদারী পদপ্রাপ্তে কালেকটরী বিভাগে কর্ম্ম সমাপনান্তে বিশেষ খ্যাতী ও প্রতিপত্তি সহকারে পেন্‌সন্‌ লাভ করিয়া সুখী হইয়াছেন। তাহার দ্বারা আমি যে প্রচুর উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম তাহা কর্ম্মক্ষেত্রের অবস্থা বর্ণন সময়ে প্রকাশ পাইবে।

    এই সময়ে কৈলাটী গ্রাম নিবাসী বাবু শরতচন্দ্র বিশ্বাস ও তাঁতিয়র গ্রাম নিবাসী বাবু প্রসন্নকুমার মজুমদার সহ পরিচয় হয়। ইঁহারা সকলেই ১ম দর্শনেই আমাকে বিশেষ ভালবাসার চক্ষে আমার প্রতি সস্নেহ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। কালেকটরীতে ইঁহাদের সময়ে যতকাল কাজ করিয়াছি, তাঁহাদের ভালবাসা হইতে বঞ্চিত হই নাই, ইহা আমার সৌভাগ্য বলিতে হইবে। তাঁহাদের উপকারের জন্য আমি চিরজীবন তাঁহাদের নিকট কৃতজ্ঞ। বাটওয়ারার কার্য্য ৩/৪ বৎসর চলিল।
  • achintyarup | 59.93.243.132 | ২৮ জুলাই ২০১১ ০৫:০৭480366
  • বিবাহ।

    এই সময়ে গোপীমোহন দে নামক আমাদের স্বগ্রাম নিবাসী ও হিতৈষী জনৈক জালিক অভিভাবক স্থানীয় ব্যক্তি ময়মনসিংহ সদরে বাস করিয়া নানা ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল। আমি ঐ বাটওয়ারা উপলক্ষে তাহার দোকানে যাতায়ত করিলে সে একদা প্রকাশ করিল, এখন আপনার বিবাহের বয়স হইয়াছে, বিশেষ নিজে মৎস্য রান্না করিয়া খাইতে হয়। মাতাঠাকুরাণীর শরীর চলে না। এই সময় একটা বিবাহ করিলেই সর্ব্বদিকে সুবিধা হয়। আমি বলিলাম, তোমরাই ত অভিভাবক স্থানীয় দেখ যাহা সুবিধা হয় কর।

    সে তখন বলিয়া উঠিল আমি একস্থানে আলাপ প্রস্তাব করিয়াছি, তিনি আপনাকে দেখিতে চাহেন, তিনি এখানেই আছেন, আপনি গিয়া দেখা করিলেই ভাল হয়। আমি বলিলাম, সন্ধ্যাকালে তোমার সঙ্গে যাইব। সন্ধ্যাকালে রাজনারায়ণ দে ও উক্ত গোপীমোহন দে আমাকে সঙ্গে লইয়া মাগুরা গ্রাম নিবাসী কালেক্‌টরীর অধীন মিউনিসিপাল্‌ অফিসের সুযোগ্য হেড্‌ক্লার্ক বাবু গঙ্গাপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়ের বাসায় উপস্থিত হইল। গঙ্গাপ্রসাদবাবু আমাকে দেখিয়াই সাদরাহ্বানে নিকটে বসাইলেন। এই উপলক্ষে কিছু মিষ্টদ্রব্যাদি জলযোগের জন্য ভৃত্যকে আদেশ করত: আমার বর্ত্তমান অবস্থাদি বিষয়ে আলাপাদি করিলেন। তাঁহার একমাত্র আদরের ভ্রাতষ্পুত্রীকে আমার হাতে সমর্পণ করিতে ইচ্ছুক আছেন ইহাও প্রকাশ করিলেন। যথাসময়ে জলযোগ করিয়া বিদায়কালে গোপীদাদাকে নিভৃতে নিয়া বলিয়া দিলেন বিবাহ, নিয়তী থাকিলে এখানেই দিব। ফাল্গুণ মাসে বোধহয় এই কথোপকথন হইয়াছিল -- তিনি বলিয়া দিলেন আগামী বৈশাখ মাসে শুভদিনে বিবাহ হইবে।

    ইহার কয়েক দিবস পরই নসিরাবাদ হইতে বাড়ী চলিয়া গেলাম। রাজনারায়ণ বাড়ীতে বিবাহের প্রস্তাবের কথা আলাপ করিলে বিবাহ যে এখনই অবশ্য কর্ত্তব্য তাহাতে আর কাহারও দ্বিমত হইল না। যথাসময়ে উভয়পক্ষের উদ্যোগে ১২৮৭ সালের আষাঢ় মাসে বিবাহ হইয়া গেল। আমার স্ত্রীর বয়স তখন ৯ বৎসর, আমার বয়স ২০ বৎসর। এই বিবাহে উভয়পক্ষ সুখী হইলেন। যদিও শ্বশুরঁ গুরুপ্রসাদ ঘোষ মহাশয় তখন স্বর্গগত: তথাপী তৎস্থলবর্ত্তী উদারহৃদয় খুড়্‌তত শ্বশুর মহাশয় বিশেষ আড়ম্বর সহকারেই বিবাহোৎসব ক্রিয়া শেষ করিতে ত্রুটী করিলেন না, তাহার আমায়িক ব্যবহার চিরজীবন ভূলিতে পারিব না, তিনি আপন কন্যাপেক্ষাও ভ্রাতষ্পুত্রীকে বেশী স্নেহনয়নে দেখিয়াছেন ও সর্ব্বদা তঙ্কÄ খবর লইয়াছেন, পিতৃহীন বলিয়া কোন কষ্ট তাহার মনে উপস্থিত হওয়ার অবসর তিনি দেন নাই। এরূপ স্নেহশীল লোক খুব কমই দৃষ্ট হয়। যাহা হউক সংসারী সাজিলাম।
  • achintyarup | 59.93.254.50 | ০১ আগস্ট ২০১১ ০৫:৩৫480367
  • মন্ত্রগ্রহণ -- দীক্ষা।

    একটা কথা পূর্ব্বে বলিতে ভূলিয়া গিয়াছি। বিবাহের অনেক পূর্ব্বেই ১২৮২ সনে কৌলীক নিয়মানুসারে আমাকে মন্ত্রগ্রহণ অর্থাৎ দিক্ষিত হইতে হইয়াছিল। তাহার কারণ বাটীস্থ লোকের সন্দেহ জন্মিয়াছিল যে আমি কুলধর্ম্ম পরিত্যাগে ব্রাহ্ম্য হইয়া যাইব। তাই সে বৎসর গুরুদেব আমাদের বাটীতে পদার্পণ করা মাত্রই আমাকে মন্ত্রদীক্ষিত করার কথা উঠিল এবং আমিও অমত না করিয়া দীক্ষা অর্থাৎ কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণে মন ও শরীরকে পবিত্র করিয়া লইলাম। গুরুদেব অনেক উপদেশের পর বলিয়া গেলেন রাশী নক্ষত্র বিচারে যে মন্ত্র তোমার উক্ত হইয়াছে, তাহার ফলে তুমি বিষয় কার্য্য করিবে। মূল মন্ত্র কখন ভূলিয়া থাকিও না, অনুক্ষণ মনে জাগরুক রাখিও। অন্যান্য অভিভাবক স্থানীয় পণ্ডিত লোকেও এরূপ উপদেশ দিতে ত্রুটী করিলেন না।

    মোক্তারী পরীক্ষা।

    যাহা হউক বিবাহের পর বাটওয়ারা উপলক্ষে আবার জেলার সদরে গেলাম, এবার শ্বশুর মহাশয়ের বাসায়ই থাকিতে হইল। তিনি বলিলেন, ""বাবা! বাড়ীতে বসিয়া থাকিলে ঋণ আদায়ের উপায় হইবে না, একটা কিছু অবলম্বন করিলে সবদিক রক্ষা পাইবে। আমি বলি, মাইনারের যখন সার্টীফিকেট আছে তখন মোক্তারী পরীক্ষা দিলে ভাল হয়। মোক্তার উকীল হইতে কম উপার্জ্জনশীল হয় না, বরং এখানে জয়নাথ রায়, জগজ্জিবন রায় প্রভৃতি অনেক বড় বড় মোক্তার আছেন, অনেক উকীল হইতেও তাঁহাদের প্রসার প্রতিপত্তি বেশী দৃষ্ট হয়।''

    আমার কিন্তু ছোটকাল হইতে আইন ব্যবসায়ের প্রতি একটু ঘৃণার ভাব ছিল। যাহা হউক শ্বশুর মহাশয়ের উপদেশ অবহেলা করা চলে না, বিশেষ অন্যান্য বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ লোকেও এই পরামর্শ দিতে ত্রুটী করিলেন না।

    এই বৎসরই যথাসময়ে আইনের বহী খরিদ করিয়া পাঠ আরম্ভ করিয়া দিলাম। মাঝে২ বাড়িও যাইতে হয়। ৬ মাস সময় সম্মুখে আছে জানিলাম। খুব মনোযোগের সহিত অনন্যকর্ম্মা হইয়া, শ্বশুরমহাশয়ের বাসায় এক গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিবারাত্রি মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করিয়া ৩ মাসে ১৫ খানা আইনের বহী পাঠ শেষ করিলাম। পরে আর কয়েকজন ভূক্তভোগী অর্থাৎ পূর্ব্ব ২ বৎসরে পরীক্ষা দিয়াও যাঁহারা অনুত্তীর্ণ হন তাঁহারা আসিয়া আমার সহিত আলোচনা প্রসঙ্গে মিলিলেন। আমি শিক্ষকরূপে দৈনিক ১০০ পৃষ্ঠা পাঠ নির্ব্বাচন করত: তাহা হইতে প্রশ্ন তৈয়ার করিয়া রাখিতাম, বিকালে ৫ টার সময় সকলে মিলিত হইলে জিজ্ঞাসা উত্তর প্রত্যোত্তর ও আলোচনাদি হইত। এই পরীক্ষার পূর্ব্ববর্ত্তী তিন মাসে বিশেষরূপে আইন পাঠ শেষ করিয়া যথাসময়ে পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইলাম।

    যে সকল পরীক্ষার্থীগণ সহ আলোচনাদি হইয়াছিল, আমরা সকলই এক নৌকায় পরীক্ষাকেন্দ্র ঢাকা সহরে গমন করিলাম। তখন ঢাকা ময়মনসিংহ রেলপথ হয় নাই। সে ১২৯০ সালের কথা। যথা নির্দ্দিষ্ট দিন দ্বয়ে পরীক্ষা প্রদান করিলাম। লিখিত ও বাচনিক দুই প্রকার দুই দিনে হইল। বাচনিকে উত্তীর্ণ হওয়াটা তৎসময়েই জানিতে পারিলাম। লিখিত পরীক্ষায়ও পাশ হইব, তাহারও আশা হইল। যথাসময়ে পরীক্ষার ফল গেজেটে প্রকাশ হইলে দেখা গেল আমরা আলোচনাকারীগণ সকলই পাশ হইয়াছি। ৬ মাস কাল আইন পাঠ করিয়া পাশ হইয়া গেলাম ইহা ভগবানের কৃপা ভিন্ন কি বলিব? অনেকে ইহাতে আশ্চর্য্যান্নিত হইলেন। ১/২/৩ বৎসর পাঠ করিয়াও অনেকে অকৃতকার্য্য হইয়া মনের অপ্রসন্নতায় কাল কর্ত্তন করিতেছেন, এরূপ দৃষ্টান্তের ত অভাব নাই। যেরূপ পাশটী করিলাম, সেইরূপ আইনাভিজ্ঞতাও জন্মিল, কার্য্যক্ষেত্রে তাহার ফল প্রকাশ পাইবে। দৃঢ় অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও একাগ্রতা থাকিলে সকল বিষয়েই যে সিদ্ধিলাভ করা যায়, পাঠক এই স্থলেই তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হইবে। জীবনে অনেকরকম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছি, কোন পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হইয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। এই শেষ জীবনেও ধর্ম্মজ্ঞান লাভ সম্পর্কে গুরুর নিকট এক পরীক্ষা দিতে হইয়াছে, তাহাতেও পাশ হইয়াছি বলিয়া গুরুদেব আশীষ জ্ঞাপন করিয়াছেন। এরূপ ফল লাভের যে শক্তি তাহা আমার নিজের নহে; তাহা ভগবৎ কৃপা ভিন্ন আর কিছু নহে।
  • achintyarup | 59.93.254.50 | ০১ আগস্ট ২০১১ ০৫:৫৯480368
  • ধর্ম্মভাব ও আলোচনা।

    মন্ত্রগ্রহণের পর মনে এই প্রতিতী জন্মিল যে আসল বিষয় সকল ধর্ম্মেই এক। ভগবান যখন এক ভিন্ন দ্বিতীয় নাস্থি, তখন সর্ব্ব ধর্ম্মেরই মূলগত বিষয় এক ভিন্ন দ্বিতীয় হইতে পারে না। তবে উপাসনা আরাধনা ও বাহ্য আচার, অনুষ্ঠান, প্রকরণ ও পদ্ধতি এবং নীতির বৈষম্য দেশ বিশেষে, স্থান বিশেষে জাতী বিশেষে ও মহাপুরুষ বা অবতার বা প্রেরিত মহাত্মাদিগের জীবন বিশেষে পার্থক্য হইবে, ইহাতে আর সংশয় কি? কিন্তু ইহা এক প্রকার সর্ব্ববাদী সন্মত যে আর্য্য বিধিব্যবস্থা যেরূপ অভ্রান্ত ও অবিসংবাদিত সত্যরূপে ধর্ম্মের চরমসীমায় উপনীত হইয়াছিঅল, জগতে আর কোন ধর্ম্মের সেরূপ মৌলীকতা দৃষ্ট হয় না। ব্রাহ্ম্যধর্ম্ম আর্য্যধর্ম্মের কতকগুলী অনুষ্ঠান বর্জ্জিত ছায়া মাত্র। খ্রীষ্টধর্ম্ম আমাদের সেই দ্বাপর যোগের অবতীর্ণ ভগবানেরই উক্তিত্র আংশিক প্রতিধ্বনী মাত্র। মুসলমান ধর্ম্ম, খ্রীষ্‌তধর্ম্মেরই ছায়া মাত্র। বুদ্ধধর্ম্ম হিন্দুধর্ম্মের যজ্ঞাদি কর্ম্মকাণ্ড বর্জ্জিত একমাত্র জ্ঞানের পথই প্রদর্শন করিতেছে। আর্য্য ধর্ম্মের মধ্যেও শাক্তগণ ও শৈবগণ রাজসিক এবং বৈষ্ণবগণ সাঙ্কিÄক ভক্তিভাবে উপাসনা আরাধনা ও অনুষ্ঠানাদি করিয়া থাকেন। তাই দ্বাপর যোগে ভগবান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ রূপে অবতীর্ণ হইয়া সর্ব্বধর্ম্ম সমন্বয় ব্যপদেশে গীতারূপ অমৃতময়ী বাণী প্রচার করিয়া গিয়াছিলেন। এজন্য গীতা এখন জগতের সর্ব্বধর্ম্মেরই মূল তঙ্কÄ বলিয়া স্বীকৃত হইতেছে।

    ধর্ম্মের মূল বিষয় ""ভগবানকে কায় মন প্রাণে ডাকা ও তাঁহার নিকট নিজ পাপ কার্য্য ও দুর্ব্বলতার জন্য ক্ষমা ও বল প্রার্থনা করা'' এই আসল তঙ্কÄটা হিন্দুধর্ম্মে যেরূপ সোপান পরম্পরায় সহজ ও সুন্দর প্রণালীতে অধিকারীভেদে বিধিবদ্ধ হইয়াছে, জগতের অন্য কোন ধর্ম্মে বা পন্থায় তাহা প্রদর্শীত হয় নাই। একমাত্র আর্য্য ঋষিগণই নিজে উপলব্ধি করিয়া জগতে তাহা প্রচার করিয়াছেন। বেদ ও উপনিষদ যে আপ্তবাক্য বলিয়া স্বীকৃত, তাহার একমাত্র হেতু এই, স্বয়ংসিদ্ধ হইয়া ভগবানের আদেশবাণী শ্রবণ করত: ঋষিগণ তাহা প্রচার করিয়াছিলেন।

    মন্ত্র যখন লইলাম তখন ভাবিলাম যে, ব্রাহ্ম্যধর্ম্মে বাঙ্গলায় যে প্রার্থনা, আর্য্যধর্ম্মে দেবভাষায় মন্ত্রদ্বারা সেই প্রার্থনা, তাহাতে কিছু আসে যায় না। তবে পৈতৃক ধর্ম্ম ছাড়িয়া অন্য ধর্ম্মাবলম্বনে ফল কি? বিশেষ পৈতৃক ধর্ম্ম কায় মন প্রাণে অনুষ্ঠান ও পালন করিলে আপন বিষয়ে সহজে অগ্রবর্ত্তী হওয়া যাইবে। এইরূপ ধারণায় সন্ধ্যাহ্নিকে বিশেষ মনোনিবেশ করিলাম। তবে ব্রাহ্ম্যধর্ম্মের কাতর প্রার্থনার ভাবটুকু তাহাতে মিশিয়া রহিল। সে ভাবটা ছাড়িতে মন কিছুতেই রাজী হইল না।
  • ranjan roy | 122.168.240.188 | ০২ আগস্ট ২০১১ ০০:১৯480369
  • অচিন্ত্য,
    ভাল লাগছে। আগে গগন রায় মশায়ের সব ব্যাপারে মারাঠিদের মত দীর্ঘ-ঈকার লাগানো বিচ্ছিরি লাগছিল। কিন্তু গত দুটো পর্ব আমার মনে বেশ এমপ্যাথিন--ইত্যাদি।
  • achintyarup | 59.93.247.54 | ০৪ আগস্ট ২০১১ ০৬:০৫480370
  • পণ্ডিত শশধর তর্কচুড়ামণী প্রভৃতির বক্তৃতা।

    যাহা হউক কিছুদিন পর একটা বড় সুযোগ যেন ভগবানের কৃপায় উপস্থিত হইল। ১২৯০ বঙ্গাব্দের শেষভাগে শ্রীপঞ্চমী উৎসব উপলক্ষে এক অভাবনীয় ব্যাপার ময়মনসিংহঁ দুর্গাবাড়ীতে সংঘটন হইল, আমি তখন শ্বশুর মহাশয়ের বাসায় বসিয়া রুদ্ধদ্বার গৃহে আইন আবৃত্তি করি। দুর্গাবাড়ীর নাটমন্দিরে সভা আহুত হইল, পণ্ডিত নিমন্ত্রিত হইয়াছেন। ধর্ম্মব্যাখ্যা ও বক্তৃতাদি হইবে জানিতে পারিলাম। আইনের বহি বন্ধ করিয়া আরও ২/১ জন ধর্ম্মপিপাসু সহযোগী সহ সভায় গিয়া হাজির হইলাম। দুর্গাবাড়ীতে আরও বক্তৃতা শুনিয়াছি কিন্তু তাহাতে তত মন লাগে নাই। এবার পণ্ডিতাগ্রগণ্য সর্ব্বজন পরিচিত প্রসিদ্ধ অদ্বিতীয় বক্তা শশধর তর্কচূড়ামণী মহাশয় আগত হইয়াছেন। বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়াইয়া হিন্দুধর্ম্ম সম্বন্ধীয় জটীল ও দুর্ব্বোধ্য তঙ্কÄ সকল পাশ্চাত্যভাবে ও পাশ্চাত্য যুক্তিতর্কের অবতারণায় ও মিমাংসায় উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতামন্দির নিনাদিত করিয়া, জলের ন্যায় তরল ও সরল ভাবে তিনি যখন বাক্য যোজনা করিতে লাগিলেন, তখন ভগবানকে ধন্যবাদ প্রদানে তাহাতে মুগ্‌ধ ও তন্ময় হইয়া পড়িলাম। ক্রমে ৪/৫ দিবস ৩/৪ ঘণ্টা সময় ব্যাপিয়া তাঁহার সুযূক্তিপূর্ণ সুমধুর বাক্যসমূহ শ্রবণ করিলাম। যে সকল জটীল তঙ্কÄ ও প্রশ্ন সময়২ আমার মনে উদয় হইয়া মনকে আলোড়িত করিত, খট্‌কা বাজাইত, তাহা যেন বাত্যাতাড়িত কালমেঘবৎ উড়িয়া যাইতে লাগিল। কৌলিক ধর্ম্মের প্রতি যে কিছু অনাস্থার ভাব ছিল তাহা অচিরেই সুদূরে পলায়ন করিল। কুসংস্কার বলিয়া যে যে বিষয়ে ধারণা ছিল তাহাও ক্রমে অপসারিত হইল। পরে কয়েক বৎসর মধ্যেই ক্রমে শিবচন্দ্র সার্ব্বভৌম ও শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন প্রভৃতি অমিততেজা বাগ্মীগণ যখন দুর্গাবাড়ীর নাটমন্দির অলঙ্কৃত করিয়া হিন্দু দর্শনশাস্ত্র সকলের সুযুক্তিপূর্ণ সরল ব্যাখ্যা করিলেন ও ভগবদগীতা প্রতিপাদিত জ্ঞান, কর্ম্ম ও ভক্তিযোগের সুমধুর ভগবদ্‌বাণী সুমধুর সরল ভাষায় প্রচার করিলেন, তখন হিন্দুধর্ম্মের সারতঙ্কÄটা বোধগম্য করিতে আর আয়াস পাইতে হইল না। তখন আমি কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করত: আইনব্যবসা পরিচালনে নিযুক্ত হইয়াছি।

    আহার বিষয়ে তখন হইতে অনেকটা সংযত হইলাম। অসাঙ্কিÄক ব্যাভিচারী ভাবটা সম্পূর্ণরূপেই পরিত্যাগ করিলাম। সন্ধ্যা উপাসনায় অধিকতর মনোনিবেশ করিলাম।
  • achintyarup | 59.93.246.55 | ০৭ আগস্ট ২০১১ ০৫:২৯480371
  • পণ্ডিতের বক্তৃতার মর্ম্ম।

    ১। ঐ সকল অমৃত নিস্যন্দিনী বক্তৃতার হলে এই বুঝিলাম যে ধর্ম্ম আর কিছুই নহে, ""ঈশ্বর ও জীবের স্বরূপ কি তাহা বুঝিবার যে অদম্য চেষ্টা ও অনুশীলন'' তাহাই ধর্ম্ম।

    ২। ঐ পরতঙ্কÄটা বুঝিতে গেলেই কর্ম্ম, জ্ঞান ও ভক্তির অনুশীলন অত্যাবশ্যক।

    ৩। অধিকারীভেদে অনুশীলন হইবে। কেহ কর্ম্ম না করিয়া কখন জ্ঞানের পথে যাইতে পারিবে না। কর্ম্ম দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে পর জ্ঞানরূপ অমূল্য ভাণ্ডারের দ্বার খোলা দেখিতে পারিবে। জ্ঞান অনুশীলনে ঈশ্বর ও জীবের স্বরূপ অবগত হইলে তবে ভগবানের সেবা পরিচর্য্যা করার অধিকারী হইবে, তখন ভক্তি অনুশীলনে প্রবৃত্ত হইবে। ভক্তির উত্তরোত্তর প্রকার ভেদরূপ সোপান আছে। ভক্তি গাঢ় হইলে প্রেম, প্রেম গাঢ় হইলে প্রীতি, প্রীতি গাঢ় হইলে প্রণয়, প্রণয় পরিপক্ক হইলে ভাব বা অনুরাগ, অনুরাগে দৃঢ়তা জন্মিলে শেষ পরিণতি মহাভাব বা মহারাগ বা ভালবাসার তন্ময়তা। নিষ্কাম ভাবে অর্থাৎ স্বার্থান্বেষী না হইয়া কেবল কর্ত্তব্যবোধে যে ভগবানে আত্মসমর্পণ করিয়া ভালবাসা ও তাঁহার সেবা করা তাহাই জীব প্রকৃতির পরম ধর্ম্ম। ইহার অধিক আর কিছু নাই। এক আর্য্যধর্ম্ম ছাড়া ইহা জগতে আর কেহ অবগত নহে। তাই আর্য্যধর্ম্ম জগতে সর্ব্বোপরি গৌরবান্নিত।

    ৪। কর্ম্ম, জ্ঞান ও ভক্তি সকলেরই দ্বিভাব আছে নিষ্কাম ও সকাম। অধিকারীভেদে তাহা হইয়া থাকে। যাহার যেরূপ শক্তি সেইভাবে সে উপাসনা আরাধনা আরম্ভ করিয়া ক্রমে উর্দ্ধে উঠিতে থাকিবে, কেহ বৃক্ষের গোড়ায় পা না দিয়াই যদি ডালের অগ্রভাগে চড়িতে চায় তাহার যেমন ভূমে গড়াগড়ি ও হস্তপদাদি ভগ্ন হয় তদ্রুপ সাধনপথেও স্খলিত পদের দৃষ্টান্তের অভাব নাই।

    ৫। জ্ঞান, কর্ম্ম ও ভক্তির অনুশীলন করিতে গেলেই আর্য্যধর্ম্মের যত বিধি বিধান ও আচার নিয়ম আছে সব মানিয়া চলিতে হইবে নতুবা উপরোক্তরূপ স্খলিত পদ হইয়া পঙ্গু হইতে হইবে। খুটীনাটী নিয়ম পর্য্যন্ত অধিকারীভেদে মানিতে হইবে। কর্ম্ম ও জ্ঞান যোগের শেষ পর্য্যন্ত জাতীভেদ অকাট্টরূপে মানিতে হইবে। কেবল ভক্তির সোপানে পদার্পণ করিলেই এই মহাবাক্য স্মরণ করিয়া জাতীভেদ শিথিল হইতে থাকিবে।

    তৃণাদপী সুনীচেন তরুরিব সহিষ্ণুণাং।
    অমানীনাং মানদেহী কীর্ত্তনীয়া সদা হরি:।।

    ৬। অধিকারীভেদে সাকার নিরাকার দুই প্রকার উপাসনাই হইতে পারে। ঈশ্বর এক হইয়াও দুইরূপেই বিদ্যমান। এই জগত তাঁহার সাকার মূর্ত্তি, জাগতিক প্রকৃতি তাঁহার রাধাভাব। যে আরাধনা করে সেই রাধা। রাধ ধাতু অর্থে আরাধনে। এই অর্থে জাগতিক প্রকৃতি সমস্তই আরাধনার পথে তৎপ্রতি ধাবিত হইতেছে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ হইয়াও সগুণ, ঈশ্বর আনন্দময়; ইহাই তাহার রাধাকৃষ্ণ বা শিবশক্তিরূপে ""উপাসকনাং হিতার্থায়'' কল্পিত বাহ্য ভাব। প্রত্যেক মানুষের চিত্ত বৃন্দাবনে সেই পরমাত্মারূপী কৃষ্ণ ও জীবাত্মারূপী প্রকৃতি বর্ত্তমান। কৃষ্ণ প্রকৃতি ছাড়া বা শক্তিবিহীন থাকিতে পারেন না। তাঁহার মহামহা বিরাট ভূমা প্রকৃতিই তৎঅংশরূপে -- আনন্দময়ীরূপে রাধা। তিনি ""সচ্চিদানন্দ'' অর্থাৎ সৎ-চিৎ-আনন্দ। তিনি সাক্ষাৎ বিদ্যমান আছেন। তিনি চৈতন্য বা চিৎশক্তি স্বরূপ। তিনি আনন্দস্বরূপ। জীবপ্রকৃতি তাঁহারই অংশ যেমন অগ্নি ও অগ্নির স্ফুলিঙ্গ। জীব মায়া বা সংসারশক্তিতে আসক্ত বলিয়াই তাঁহাকে স্ব স্বরূপে দেখিতে পায় না। আরাধনা করিতে করিতে যখন মায়ার আবরণ বা সংসারাসক্তি দূর হইবে, তখনই বুঝিতে পারিবে যে আমি তাঁহার রাধারূপিণী হ্লাদিনী শক্তিরই অংশ। এই মায়াবরণ উন্মোচন করার যে চেষ্টা বা কার্য্য তাহাই আরাধনা বা উপাসনা। আমি সেই রাধা বা হ্লাদিনী শক্তির অংশ ইহা মনে রাখিয়া পুরুষদেহ হইলেও মনে স্ত্রী দেহ বা গোপীদেহ কল্পনা করিয়া স্ত্রীরূপে পতিভাবে সেই ব্রজেন্দ্রনন্দন কৃষ্ণরূপী দ্বিভূজ মুরলীধরকে গোপনন্দন মানুষভাবে বাহ্যে ও অন্তরে যাহার যেরূপ পতিপরিচর্য্যার অভিলাষ জন্মে অর্থাৎ যে ভাবে তাঁহাকে খাওয়াইয়া পরাইয়া পদসেবাদি করিয়া বস্ত্রালঙ্কারে সাজাইয়া, সচন্দন তুলসীপত্র ও পুষ্পমাল্যাদি দ্বারা পুজা অর্চ্চনা ইত্যাদি করিয়া ও তৎসহ পতি বা সখাভাবে হাস্য পরিহাস, রঙ্গরহস্য ও কেলী ও আলীঙ্গনাদি দ্বারা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিয়া ও দাসীভাবে তাঁহার যত প্রকার সেবা পরিচর্য্যা করা যাইতে পারে তাহা করিতে কুণ্ঠিত না হইয়া এবং পত্নীভাবে পতীর যতপ্রকারে সেবাশুশ্রুষা হইতে পারে তাহার অনুষ্ঠানকল্পে কোনপ্রকার ত্রুটী, কার্পণ্য ও নিজ স্বার্থগন্ধ না থাকে, এরূপ নিস্বার্থ প্রণয় বা ভালবাসায় সর্ব্বপ্রকারে তাঁহাকে সুখী করিবে। মানুষের যতদূর সাধ্য, পতীসেবা ততদূর বিলাসীতার সহিত করিবে। মনে রাখিবে তিনি মানুষ হইলেও ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তাহার ঐশ্বর্য্যের সীমা নাই তখন তাঁহার ভোগ রাগ ও বেশভূষায় যতদূর ঐশ্বর্য্য ও বিলাস কল্পনা করিতে পার তাহার চূড়ান্ত করিবে, মনে রাখিবে তুমি তাঁহারই অংশরূপিণী, মানুষ হইলেও চিন্ময়ী দেবী বা তাঁহার প্রণয়িণী, তোমারও রূপগুণ বেশভূষার পারিপাট্য ও বিলাসীতার কোন অভাব নাই, সেই ভাবে নিত্য সাজিয়া গুজিয়া তাঁহার বিলাসিনীরূপে তৎসহ নিকুঞ্জমন্দিরে রাত্রিতে বিহার ও শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করিবে; যদি ভাগ্যোদয় হয় তবে রাস মহারাসাদি ক্রিড়ার অধিকারী হইবে, তাহার অর্থ বাহ্য পশুভাব নহে, আত্মায় পরমাত্মায় মিলন -- রমণ -- সঙ্গসুখ বা রাস। রাস যাহাতে রসের কার্য্য ভিন্ন আর কিছু নাই, রসে বিভোর -- রসসাগরে বা ভাণ্ডারে নিমগ্ন। তাহা নির্ব্বাণ মূক্তি নহে, সাযুয্যতা লাভ। তাহাতে সেবা পরিচর্য্যার বাধা হয় না। এই ত হইল মধুর ভাবের ভজন সাধন, ইহাই হইল বৈষ্ণব পন্থার সারমর্ম্ম। ভগবানের অষ্টকালিন লীলাকার্য্য ইহাতে নিত্য স্মরণ ও অনুষ্ঠান করিবে। মানসিক কল্পনাভাব যে সময়ের যাহা, তাহা অভ্যাস দ্বারা আপনাআপনি স্ফুরণ হইবে ও মন আনন্দরসে আপ্লুত হইবে। সর্ব্বপ্রকার আরাম ও আনন্দজনক সেবায় পতীরূপী ভগবান ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই তোমার চির তৃপ্তি ও শান্তীলাভ হইবে। সাবধান, নিজ সুখ কখনও কল্পনা করিবে না। তোমার সুখ স্বত:এব উদয় হইবে, যেমন অগ্নিতে কাষ্ঠ পুড়িতে থাকিলে কাষ্ঠের কাষ্ঠত্ব দূর হইয়া অগ্নিময় কয়লা উৎপন্ন হয়, তখন কয়লা বুঝিতে পারে যে আমিও সেই অগ্নির অংশ। সেইরূপ পত্নী বা ভক্তরূপী তুমি সাধকও বুঝিতে পারিবে নিষ্কাম ভালবাসারূপ বহ্নিতে তোমার আমিত্ব দূরে গিয়া তোমাকে উঙ্কÄল বা মধুরভাবে সুখ প্রদান করিতেছে। আনন্দ বা রূপসাগরে ডুবিয়া হাবুডুবু খাইয়া কেবলই বলিতেছ রাধাকৃষ্ণ, রাধাগোবিন্দ ও রাধারমণ জিও কি জয়!! সবই রাধা বা আনন্দময়। ভিতরে বাহিরে সব রাধাময় হইয়া যাইবে। রাধাই গুরু, রাধাই সপত্নী, রাধাই মন্ত্রীনী, রাধাই বড় দিদিমণী ও একাধারে আমার সর্ব্বস্বের অধিকারিণী। এজন্য ভগবান রাধাকে দাসখত লিখিয়া দিয়াছেন, রাধা তাহার নামের অগ্রে যোজিত হইয়াছেন। চুড়ার উপর ময়ূর পুচ্ছে রাধা নাম উঙ্কÄল স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে। রাধা একাধারে হ্লাদিনীশক্তি, অর্দ্ধাঙ্গিনী, প্রণয়িণী ও ভক্তচুড়ামণী ভগবানের হৃদবিহারিণী চিরসঙ্গিনী। রাধার জন্যই জগতে সব লীলাখেলার প্রকাশ। রাধা না থাকিলে জগত অন্ধকার -- মিথ্যা। এ রাধাতঙ্কÄ যে না বুঝিল সেই অন্ধকারে রহিল বা নরকে ডুবিল। এই জন্যই বুঝি এই শ্রীবৃন্দাবনধামে রাধে ভিন্ন বুলী নাই। কেহকে ডাকিতে হইলে রাধে! ভিক্ষায় রাধে! মাধুকুরীতে রাধে, কেহকে প্রণাম করিতে হইলে রাধে! আহারে, বিহারে, সম্ভাষণে, সম্বোধনে ও সর্ব্বকার্য্যে ব্রজবাসীগণ ঐ ত্রিতাপহারিণী বুলী বলিয়া থাকেন। যেরূপ মুসলমানগণ সর্ব্বকার্য্যেই বলে ""আল্লার হুকুম''।

    গোপী অর্থ রাধা-ভক্ত বা আরাধনাকারিণী। গোপীদেহলাভ অর্থাৎ মানসনেত্রে তুমি গোপী বা ভক্তরূপী স্ত্রি সাজিবে, অনুঢ়ারূপ লাবণ্যময়ী কুমারী হইবে। বিলাসিনী হইয়া উপপতীকে অসতী স্ত্রীলোক যেরূপ ব্যাকুলভাবে ভজে ও সঙ্গলাভ করিতে চায়, সেইরূপ ব্যাকুলভাবে যতার্থ পত্নীরূপে ভগবানের সঙ্গলাভের বাসনা জাগরূক রাখিয়া সেবাদি করিবে। বাহিরে পুরুষদেহটাকে সর্পের খোলসের ন্যায় ভাবিবে ও তদ্বারা নামকীর্ত্তনাদি ভজনের বাহ্য অঙ্গাদি সাধন করিবে। ভিতরে -- মনে সিদ্ধ স্ত্রীদেহে দিবানিশি ভগবানের সহিত লীলাখেলাদি করিবে। এই প্যারাটী বিস্তার হইয়া পড়িল। কি করা যায়, ইহাই সাধন ভজনের মূল ও গূঢ় তঙ্কÄ।

    ৭। ভগবানকে সখাভাবে বা পুত্রভাবে বা প্রভূভাবেও ভালবাসিলে সাধন হয়, ভগবান সেইরূপে দেখা দেন। ইহা স্বমুখেরই বাণী, কিন্তু পতীভাবটী সর্বোচ্চ ও সাযোজ্যতা লাভের একমাত্র উপায়। এইজন্য ১৬ হাজার পর্য্যন্ত গোপী বা ভক্ত কল্পিত হইয়াছেন, ইঁহারা সকলই পতীভাবে সাধন করিয়া গোপী হইয়াছেন। গোপী কেন বলা যায় -- না ভগবান গোপবংশাবতংশ। তাই স্বজাতীই বেশী প্রিয়, প্রকট বা প্রকাশ্য লীলায় ইহাই দেখাইয়া গিয়াছেন।
  • achintyarup | 59.93.246.55 | ০৭ আগস্ট ২০১১ ০৫:৩০480372
  • ভক্তরূপী স্ত্রী* সাজিবে
  • achintyarup | 59.93.244.104 | ০৯ আগস্ট ২০১১ ০৫:০৪480374
  • ৮। এই যে পতীভাবের সাধনপ্রণালী উপরে বলা হইল তাহা কেবল বৃদ্ধ অর্থাৎ ৫০ বৎসরের উর্দ্ধবয়সের লোকের জন্য। যুবকের সাধন ভজন ইন্দ্রিয়সংযম না হওয়া পর্য্যন্ত বিধিমার্গে হইবে। রাগ বা অনুরাগ পথে চলিবে না, পদস্খলন অনিবার্য্য। যুবক, হৃদয়ে ভগবানকে দাঁড় করাইয়া কি বসাইয়া -- যাহার যেরূপ প্রিতী হয় সেরূপ ভাবে মানসিক সেবা পুজা করিবে অথবা বাহ্য বিগ্রহ মূর্ত্তিতে নিষ্কামভাবের আরাধনাদি করিলেই যথেষ্ট হইবে। ভগবান ত সর্ব্বব্যাপী এবং সর্ব্বদর্শী, তিনি মনের ভাবই দেখেন, বাহিরের কিছুর জন্য প্রত্যাশী নহেন।

    ৯। কলিকালে নামজপরূপ সাধনই সহজ ও দুর্ব্বল অধিকারীর পক্ষে বিশেষ অনুকুল। হরিনাম, দুর্গানাম ও কালীনাম -- যাহার যে নামে দৃঢ় বিশ্বাস, সেই নামে মনস্থির করিয়া তন্ময় হইয়া অনিয়ত কি নিয়তসংযতরূপে মালা দ্বারা কি করে নাম জপ করিবে। উচ্চস্বরে কি মনে মনে যেরূপ রুচি হইবে সেইরূপেই করিবে। মহাপ্রভূ এই সহজপন্থা শিক্ষা দিবার জন্যই জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। ""নামে রুচি জীবে দয়া বৈষ্ণব সেবন'' ""ইহার পর ধর্ম্ম নাই শুন সনাতন'' এই তাঁহার মহাবাণী সনাতন গোস্বামী প্রভূকে শিক্ষা দিয়াছিলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলিয়াছিলেন, যে সর্ব্বযজ্ঞের মধ্যে জপযজ্ঞেই আমি বর্ত্তমান। কিন্তু সে কথা লোকে ক্রমে ভূলিয়া নরকে ডুবিতেছিল, তাই গৌরাঙ্গ অবতারের প্রয়োজন হইল। এ হেন সহজ পথ থাকিতে লোক কঠোর সাধন পথে গিয়া বিড়ম্বিত হয় কেন? কোন আড়ম্বর নাই, খরচ নাই, আয়াশ নাই, কার্য্যকর্ম্মের বাধা নাই ও শুচি অশুচি জ্ঞানের দরকার নাই কেবল অবিরত তৈলধারার ন্যায় অবিচ্ছেদে নাম উচ্চারণ করিয়া যাইবে ও সেই নামের অধিষ্ঠাতৃ দেবতাকে মানসনেত্রে দৃষ্টিপথে রাখিবে।

    ""নাম চিন্তামণি কৃষ্ণ চৈতন্য রস বিগ্রহ:।
    নিত্যশুদ্ধ পূর্ণমূক্তি অভিন্নাত্মানা নামিন:।।''

    নামের সহিত আছেন ""আপনি শ্রীহরি:'', নাম করিতে করিতে তাঁহার দর্শন হইবে, ইহা ধ্রুব সত্য। সত্যভামা দেবীর নারদ ঋষী কর্ত্তৃক তোলা পরীক্ষায় নামের মাহাত্ম প্রমাণ হইয়াছিল তাহা হিন্দুমাত্রেই অবগত আছেন। অন্য জাতীর মধ্যেও দেখা যায় মুশলমানে তজবী দ্বারা নাম জপ করে। নামজপ, নামসংকীর্ত্তনে হরি সন্নিকটে অবস্থিত হন। ইহা তাঁহারই স্বমুখের বাণী --

    ""নাহং তিষ্ঠামী বৈকুণ্ঠে যোগীনাং হৃদয়ে ন চ:।
    মদ্‌ভক্তা যত্র গায়ন্তী তত্র তিষ্ঠামী নারদ।।''

    কলিতে নাম সাধনই একমাত্র নিষ্কাম উপাসনা। এই নাম জপের আদর্শ যবনকুলতিলক মহাঋষি অগ্রগণ্য ""হরিদাস'', তিনপক্ষ নাম জপে দিবারাত্রি কাটীয়া যাইত।

    ""হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামইব কেবলং।
    কণৌ নাস্তেব নাস্তেব নাস্তেব গতিরন্যথা:।।''

    ""গোকোটী দানে গ্রহণে চ কাশী,
    মাঘে প্রয়াগে যদি কল্পবাসী,
    সুমেরু সমতুল্য হিরণ্য দানং,
    নহিতুল্য নহিতুল্য গোবিন্দনামং।।''

    এই নামই ""তারক ব্রহ্ম নাম'' অর্থাৎ অন্তিমকালের একমাত্র স্মরণীয় বলিয়া শাস্ত্রে বিধিবদ্ধ আছে। নামযোগটী বত্রিশ অক্ষরে গ্রন্থিত হইয়াছে।

    ""হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
    হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।''

    সংক্ষেপ করিতে হইলে --
    ""হরিহরয়ে নম কৃষ্ণায় যাদবায় নম:।
    যাদবায় কেশবায় গোবিন্দায় নম:।।''

    আরো সংক্ষেপে কেবল ""নম শ্রীহরি'' জপিলেও হয়। নামাপরাধ ও সেবাপরাধে অবিরত নাম জপিলেই অপরাধ খণ্ডন হয়। অবিশ্বাস ও অরুচি এবং নাম হইতে অবহেলা প্রভৃতি নামাপরাধ মধ্যে গণ্য।

    ১০। হিন্দু সাধকগণ যে তেত্রিশকোটী পর্য্যন্ত দেবতার কল্পনা করিয়াছিলেন ইহা মন্দ হয় নাই। ভারতে ৩০/৩২ কোটীরও অধিক লোকসংখ্যা। ""ভিন্ন রুচিহি লোকা:'' এই শাস্ত্রবাক্য দ্বারা ইহাই বুঝা যায় যে -- নিরাকার ঈশ্বরকে যে যেরূপ ইচ্ছা সেইভাবে কল্পনা করিয়া লইতে পারে। এই হস্তপাদবিশিষ্ট মূর্ত্তির আহ্বান আছে, বিসর্জ্জন আছে। তৎপর আর সে মূর্ত্তি ঈশ্বর নহে। এজন্যই বোধহয় পরবর্ত্তীকালে ঋষিগণ শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গরূপী প্রস্তরখণ্ডে ভগবানের স্থায়ী সঙ্কÄ¡ স্বীকার করিয়া সেই ""অপাদপাণী বিশ্বব্যাপী সর্ব্বগ ঈশ্বরের'' আহ্বান ও বিসর্জ্জন দূর করিয়া দিয়াছেন, এই শিলারূপী নারায়ণ তাঁহার নিরাকারাত্বেরই প্রমাণ করেন। আর গৌরীপাট অর্থাৎ যোগীমূদ্রাস্থিত উর্দ্ধমুখ শিবলিঙ্গ জগতের সৃষ্টিক্রিয়ারই প্রকাশক। এই সকল শাস্ত্র প্রতিপাদিত গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক কল্পনা হেতু আর্য্যধর্ম্মকে সীমাবদ্ধ প্রতিমূর্ত্তি পূজক পৌত্তলিকতা বলায় মুর্খতাই প্রকাশ করে। ভগবদ্‌গীতায় ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন আমি কিরূপ ভগবান? -- না যথা ""সুত্রে মণিগণাইব'' মণিসকলের ভিতরে যেরূপ গ্রন্থন ব্যপদেশে সূত্র থাকে আমিও সেইরূপ জগতের জড়, অজড় তাবদ্‌ বস্তুর ভিতরেই আছি। ইহা অপেক্ষা নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ সর্ব্বব্যাপক সর্ব্বশক্তির আধার ভগবানের আর কি উৎকৃষ্ট উপমা আছে?

    ১১। হিন্দু যে কেবল হাতগড়া প্রতিমূর্ত্তি পুজা করে তাহা নহে, প্রকৃতিকে ভগবানবোধে জড়, অজড় ও উদ্ভিদাদি মধ্যেও সতত পুজা করিতেছে। গো সকলকে হিন্দু দেবতা বোধে পুজা করে ও লালন পালন করে। তাহার কারণ ত সকলেই বুঝিতে পারেন। মনুষ্য জীবন রক্ষার্থে পশ্বাদি মধ্যে গো সকলের ন্যায় প্রয়োজনীয় ও উপকারী আর দ্বিতীয় নাই। জন্মমাত্র গোদুগ্‌ধ মানুষের আহার। জীবনযাত্রার খাদ্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল বস্তুই গোধনের সাহায্যে উপার্জ্জিত হইতেছে। তাই গো -- গোধন শব্দে বাচ্য হইয়াছে ও বিষ্ণুর অংশ বলিয়া কল্পিত হইয়া পুজা পাইতেছে। ভগবান দ্বাপর যোগে স্বয়ং অবতীর্ণ হইয়া নিজে গোসেবা ও গোবিষ্ঠার পর্য্যন্ত সেবাপুজা করিয়া তাহা মানুষকে শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন। তাহার নিদর্শন গোবর্দ্ধন পর্ব্বত অদ্যাপী বৃন্দাবনে বর্ত্তমান আছে। ভগবানের কি আর কোন কার্য্য ছিল না? বাল্যকাল হইতে কৈশোর বয়স পর্য্যন্ত বনে২ গরু চরাণ কার্য্যটা বাছিয়া গোছিয়া কেন অবলম্বন করিলেন? তাহার কারণ কি লোকশিক্ষা নহে? যাহারা পোড়া উদরের তৃপ্তির জন্য জগতে আজও গোবধরূপ পাপে লিপ্ত হয়, তাহাদের জন্য যে অনন্ত নরক ব্যবস্থা হইবে তাহার আর সন্দেহ কি আছে?

    ১২। উদ্ভিদের মধ্যে তুলসী, বিল্ব, নিম্ব, কদম্ব ও জলজ পদ্ম হিন্দুর বিশেষ পুজ্য ও আদরের জিনিস। তন্মধ্যে তুলসী দেবতার আসন গ্রহণ করিয়াছেন; তাহা আজকালের উদ্ভিদতঙ্কÄবিদ্‌ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকগণও বুঝিতে পারিতেছেন। তুলসী মনুষ্যজীবনের স্বাস্থ্য সংরক্ষণে ও রোগ নিবারণে যে দেবীস্থানীয় তাহার বিন্দুমাত্রও সংশয় নাই। ইহা আর্য্য মণিষীগণ উপলব্ধি করিয়াই তুলসী মাহাত্ম প্রচার করিয়াছেন। তুলসীবৃক্ষ সমতলে আঙ্গিনায় রোপণ করিয়া দিবানিশি তৎবিশুদ্ধ বায়ুসেবন, পত্রসংশোধিত জলপান, চর্ব্বণরূপে পত্র ওঅ মঞ্জরী (পুষ্প) গ্রহণ যে আয়ুবর্দ্ধক তাহা বিজ্ঞানবিদ ভিন্ন বুঝিবে না, তাই ঋষিগণ অজ্ঞানীর জন্য তাহাতে দেবত্ব আরোপ করিয়া নিত্য স্নান ও পুজা যত্নাদির সুদৃঢ় বিধিবিধান ও মন্ত্রাদি প্রচার করিয়া লোকের কত হিতসাধন করিয়া গিয়াছেন। যে হিন্দুর বাড়ীতে গো ও তুলসীর সেবা নাইসে অহিন্দু ইহা শাস্ত্র স্পষ্টবাক্যে নির্দ্দেশ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। ভগবান স্বয়ং বলিয়াছেন তুলসী আমার পত্নীস্বরূপা; পত্নী হইতে প্রিয় কেহ জগতে নাই, তাই লোকশিক্ষার জন্য এই অমোঘ বাণী।

    বিল্ব ও নিম্ব বৃক্ষাদি যে জীবের জীবন রক্ষার কত উপযোগী তাহা পুরাতঙ্কÄবিদ ঋষিগণ বুঝিয়াছিলেন বলিয়াই তাহাদের ছেদন ও জ্বালানী কাষ্ঠরূপে ব্যবহার করা পাপ বলিয়া নিষিদ্ধ হইয়াছে। ভগবান যে ঐ সকল পবিত্র বৃক্ষের সন্নিহিত আছেন তৎসম্বন্ধে শাস্ত্র বলিয়াছেন --

    ""তুলসীকাননং যত্র যত্র পদ্মবনানি চ,
    পুরাণ পঠনং যত্র তত্র সন্নিহিত হরি:।''
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন