এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • achintyarup | 59.93.244.203 | ২০ আগস্ট ২০১১ ০৫:৩২480375
  • ১৩। আর একটী কথা বলিয়া মূল বিষয়ের অবতারণায় প্রবৃত্ত হইব। ধর্ম্মালোচনা বড় বাড়িয়া গেল, কি করিব, ইহাই এ গ্রন্থের মেরুদণ্ড। আমার জীবনে কি আছে? যাহা বুঝিয়াছি ও শিখিয়াছি তাহা প্রকাশ করিতে পারিলেই ত জীবনী হইল। কথাটী এই -- পাপকার্য্য ও পূণ্যকার্য্যের বিচার ইহকালে হয় কিনা? শাস্ত্র বলেন উৎকট্‌ পাপ বা পূণ্যের ফল ইহজীবনে আশু প্রতিফলিত হয়। আমি যতদূর গবেষণা করিয়াছি, তাহাতে জীবাত্মার বিনাশ না থাকিলেও জীবাত্মার মর্ত্তভূমেই বার২ যাতায়াত হইতেছে বুঝা যায়, মৃত্যুপর অন্য কোন একটা নির্দ্দিষ্ট নরক কি স্বর্গ নাই, যাহাতে জীবাত্মা অবস্থিতি করিয়া পাপ পূণ্যের ফলভোগ করিবে। এই স্থুল শরীর ভিন্ন লিঙ্গদেহাদির কল্পনা শাস্ত্রে থাকিলেও তাহা ভগবানের স্বমুখ প্রচারিত গীতার উক্তির সহিত ঐক্য হয় না। গীতায় স্পষ্টই বলিয়াছেন যেমন একখানা জীর্ণ বস্ত্রকে ত্যাগ করিয়া আর একখানা নূতন বস্ত্র গ্রহণ করা হয়, সেইরূপ জীবেরও বর্ত্তমান দেহ পরিত্যাগ মাত্র নূতন দেহ লাভ হইয়া পুন: ভোগ আরম্ভ হয়। তবে আর অন্য একটা নির্দ্দিষ্ট লোকে বাস করার অবসর থাকিল কই? তবে পৃথিবীর ন্যায় অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহাদিতে যদি জীব বাসস্থান ও পৃথিবীর ন্যায় জীবন ধারণের ব্যবস্থা থাকিয়া থাকে, (বিশ্বাস করি অবশ্যই আছে) কেবল তবে সেই সকল স্থানেই জীবের কর্ম্মফলে দেহান্তর গ্রহণ হইতে পারে। চিন্ময় স্বর্গ নরক বিশ্বাসযোগ্য হয় না। পৃথিবীই যে ভগবানের একমাত্র জীবরাজ্য ইহা নহে। আমার বিশ্বাস -- এই ক্ষুদ্রাদপী ক্ষুদ্র পৃথিবী অপেক্ষা কত বৃহৎ বৃহৎ ভূগোলক রহিয়াছে, তাহাতে জীবসৃষ্টির আরও কত বিচিত্রতা ও উৎকৃষ্টতা আছে তাহা নরবুদ্ধির কল্পনায় আসিবে কি?

    তবে ঐ কল্পিত স্বর্গ ও নরক অস্বীকার করিলে একটা তর্ক উঠিতে পারে যে তবে শ্রাদ্ধ শান্তীর যে শাস্ত্রে ব্যবস্থা হইয়াছে, তাহার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন যে বড় বেশী তাহা বোধ হয় না। হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণবের শ্রাদ্ধ নাই, মুনী ঋষিদের শ্রাদ্ধ নাই, সাধন ভজনশীল সিদ্ধ ব্যক্তিরও তাহা নাই। কেবল অজ্ঞ গৃহী মুর্খ ও পাপাচারি ব্যক্তিরই তাহা প্রয়োজনীয় বলিয়া শাস্ত্র ঘোষণা করিয়াছেন। আর মৃত্যুমাত্র জীবের জন্মান্তর পরিগ্রহ হইলেও তদোদ্দেশে জলপিণ্ডাদি প্রদান বা আত্মার সদ্‌গতী কামনায় মন্ত্রাদি বা আরাধনা করার বাধা দেখা যায় না। ইহা কি দৃষ্ট হয় না যে আমার এই অশান্তীময় জীবনে কোন২ সময় বেশ সচ্ছন্দতা ও শান্তী অনুভব হইতেছে এবং কখন২ অহেতুক প্রাণের ব্যাকুলতাও অনুভব হয়। ইহাতে এই বুঝা যায় গত জন্মের যে পরিত্যক্ত বংশধর সেই আমার তৃপ্তার্থে শ্রাদ্ধ তর্পণ করিতেছে। অতএব শ্রাদ্ধ তর্পণাদি অমূলক নহে। গৃহীর পক্ষে ইহা নিত্য প্রয়োজনীয় বলিয়া যে ব্যবস্থিত, তাহা আধাত্মবিজ্ঞান গবেষণার যে ফল তৎসম্বন্ধে বিন্দুমাত্রও সংশয় হইবার কারণ দৃষ্ট হয় না।

    তাহা হইলে পাপের বিচারটা জন্মান্তরে বা ইহকালে দুই অবস্থায়ই হইতেছে, পূণ্যের পুরস্কারও তদ্রূপ দুইকালেই ঘটীতে পারে স্বীকার করিতে হইবে। ইহকালে যে হয় তাহা লোকে বুঝিয়াও বুঝিতে পারে না, কারণ জীবচিত্ত মোহে মুগ্‌ধ অন্ধ, তবে যে কতকটা মোহপাশ ছেদন করিয়াছে ও এই বিষয়ে সর্ব্বদা হিসাব বা অনুধাবন রাখিয়াছে বা রাখিতেছে সে কতক্‌টা ইহকালেই বুঝিতে সক্ষম হইতেছে। ""সুঁই চুড়ি করিলে কুড়ল হাড়ায়'' কথাটা অমূলক নহে। রোগ পাপে সৃষ্ট হয় ইহা অহ:রহ:ই দৃষ্ট হইতেছে। শারীরিক নিয়মলঙ্ঘন পাপ আর মানসিক পাপ, দুই প্রকারেই রোগ জন্মনের কারণ হয়, ইহা চিকিৎসাশাস্ত্রের উক্তি। ইহা ত ইহকালের প্রত্যক্ষ বিচার। পূণ্যের ফলে আত্মপ্রসাদ লাভ, সুখে অবস্থান ও ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান হয়। বিশেষ রোগভোগ কি দৈব দুর্ব্বিপাকের যাতনা ভোগ, পূণ্যবানের দৃষ্ট হয় না। মৃত্যুই পাপ ও পূণ্যের সাক্ষী। যাহার মৃত্যুকালে সদজ্ঞান থাকে, যন্ত্রণা কম হয় তিনি যে পূণ্যবান্‌ ইহা লোকমুখে সদাই শুনা যায়। শাস্ত্র বলেন পূণ্যবানের মৃত্যু উত্তরায়ণে হয় (পৌষ অবধি জ্যৈষ্ঠ ৬ মাস)। এই ত গেল লোকের কথা ও শাস্ত্রের কথা। এখন আমার জীবনে যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি তাহা বিবৃত করিতেছি।
  • achintyarup | 59.93.243.129 | ২১ আগস্ট ২০১১ ০৫:৩৯480376
  • একটী লোক গৃহদাহে কাহারও সর্ব্বস্বান্ত করিয়াছিল -- সে মৃত্যুর পূর্ব্বে ব্যাধিগ্রস্থ হইয়া সমস্ত শরীর ও অন্তরব্যাপী অগ্নিজ্বালা অনুভব করিতে২ কালের করাল কবলে বিলীন হইল। কোন ব্যক্তি পিতাকে মরণাধিক যাতনা দিয়াছিল, তাহাকে ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে ও লোকের ঘৃণাব্যঞ্জক তাড়া খাইতে দেখিয়াছি। কোনও পদস্থ ব্যক্তি স্বগ্রাম ও প্রতীবেশী গ্রামস্থ ব্যক্তিগণকে নানাপ্রকার মিথ্যানুষ্ঠানে বিপদগ্রস্থ ও জ্বালাতন করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার প্রাক্‌কালে স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয় স্বগণ কর্ত্তৃক ঘৃণিত অবহেলীত হইয়া বিষ্ঠা মূত্রাদি পূর্ণ বিছানায় পড়িয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে দেখিয়াছি। মনে হয় ৫/৬ বৎসর তাহার এরূপ নরকভোগ হইয়াছিল। এরূপ পাপের বিচার ইহকালে কত হইতেছে তাহার হিসাব যে রাখে সেই বুঝে ও অনুতাপানলে পাপ দূরে যায় ও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হয়, তাহাকেই লোকে সাধু আখ্যা প্রদান করে।

    এখন নিজ জীবনের কথা বলিতেছি -- নিজেও শিক্ষাতাড়নায় ছোটকালে এবং সংসারতাড়নায় মধ্যকালে পাপের হিসাব রাখার সুযোগ পাই নাই। তবে কোন অকস্মাৎ ক্ষতি কি অনিষ্ট কিম্বা রোগ উপস্থিত হইলেই তৎক্ষণাৎ বুঝিয়াছি ইহা অমুক পাপের ফল। এরূপ কতকগুলী ঘটনা আজও মনে জাগরূক্‌ আছে, তাহা ব্যতীত দৈনন্দীন পাপকার্য্যে যে কত ঠগাঠগী হইয়াছে, তাহার সংখ্যা কে রাখিয়াছে? যাহা মনে আছে তাহাই লিখিলাম।

    ১। কোন রাজার মোকদ্দমা উপলক্ষে মিথ্যা সৃজিত প্রমাণের অনেকই পোষকতা ও আবরণ প্রদান ব্যাপারে আমি রাজার পক্ষে অগ্রগণ্য হইয়া যথাবিহিত কার্য্য করিলাম ও ঐ মোকদ্দমায় অনেক টাকা পাইলাম। মোকদ্দমাটা ছিল নদীর জলকর স্বত্ব নিয়া। সে ১৩০৯ সনের আশ্বীন মাসের কথা। মোকদ্দমা আমরা হাড়িয়া গেলাম। ইহা কি মিথ্যারূপ পাপের বিচার নহে? তারপর আমার ব্যক্তিগত পাপেরও সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বিচার দৃষ্ট হইল। জলের মোকদ্দমায় বহু টাকা লইয়া পুজার ছুটীতে বাড়ী গেলাম, বাড়ীর নিকটস্থ হইলেই শুনিতে পাইলাম আমার সর্ব্বশেষ সন্তান প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র জলে প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়াছে। ৩-১/২ বৎসরের ছেলের এরূপে অকাল মৃত্যুকে বরণ করা কি আমার উক্তরূপ উৎকট পাপের ফল নহে? তৎপর টাকাও পরে আত্মসাৎ অধিকাংশই করিল। লোকে যে বলে ""পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তে গেল'' একথার সত্যতা কি এস্থলে প্রতিপন্ন হইল না? অন্ধতা বশত: যদি অস্বীকারও করি, তবেও ত ইহার বিরুদ্ধে একটা যূক্তি প্রদান করিতে হইবে? কই, যুক্তি ত খুজিয়া পাই না, মন ত কেবল সেই পাপ চিত্রই সন্দর্শন করে!

    ২। কোনও রেলে মাল উঠাইবার মুটীয়াকে /১০ ছয় পয়সা দিতে ত্রুটী বা ভ্রম হইয়াছিল; ইহার কিয়দ্দিন পরেই ১৫্‌ পনর টাকা মূল্যের চস্‌মাখানা চোরে নিল।

    ৩। কাহারও কার্য্যব্যপদেশে ৫০্‌ টাকা কিছু অন্যায় আবরণে রাখিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এই ইচ্ছার অব্যবহিত পরেই শুনিতে পাইলাম আমার তিনশত টাকা মূল্যে সাধের ও সখের নূতন নৌকাখানা চোরে নিয়াছে; কেবল ইচ্ছামাত্রই যে প্রত্যক্ষ বিচার হইয়া গেল। কার্য্যে পরিণত করারও অপেক্ষা রহিল না।

    ৪। কাহারও কার্য্য করার পারিশ্রমিকস্বরূপ মিথ্যার সূচনা করিয়া ১০/১২্‌ টাকা লাভ করিয়াছিলাম। ইহার কিয়দ্দিন পরেই দেখিলাম হঠাৎ ৫০্‌ টাকা মূল্যের অতি আদরের ও যত্নের দুগ্‌ধবতী গাভীটী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে।

    ৫। যাহার২ প্রতি কিছু অন্যায় আচরণ ও স্বার্থমূলক ব্যবহার করিয়াছি তাহারা প্রায়ই প্রাপ্যের অধিক টাকা আত্মস্মাৎ করিয়া পালাইয়া আমাকে সমূহ ক্ষতি ও বিপদগ্রস্থ করিয়াছে ও মর্ম্মে আঘাত দিয়াছে। এসকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা দিবানিশিই ঘটীয়াছে। যেখানে স্বার্থানুসন্ধান সেখানেই ক্ষতি!!
  • achintyarup | 59.93.240.238 | ২৭ আগস্ট ২০১১ ০৫:৪০480377
  • ধর্ম্মভাবের পরিণতী।

    আমার ছোটবেলা হইতেই ধর্ম্মের যে একটা আকর্ষণ তাহা গ্রহপ্রভাব বশত:ই যেন অনুভব করিতে লাগিলাম। আবার তদ্‌বিপরীতে কাম, ক্রোধ ও লোভাদি ষড়রিপুর আকর্ষণও সামান্য ছিল না। সংসারাসক্তি পূর্ণমাত্রায় আমার কার্য্যতায় পরিলক্ষিত হইয়াছে। তাহাতে ধর্ম্মভাব সময়২ মলিন হওয়ায় বিধিবিগর্‌হিত অনেক কার্য্যও করিয়াছি, ইহাও গ্রহপ্রভাব বশত:ই হইয়াছে বলিয়া এই শেষ জীবনে বুঝিতেছি ও অনুতাপরূপ অনলে দগ্‌ধ হইতেছি।

    কাম অর্থে নানা প্রলোভিত বিষয়ে দুর্দমনীয় যে কামনা তাহাই সাধারণত: বুঝায়। এখন বুঝিতেছি তাহা ঠিক নহে। কাম ও ভগবানে প্রেম একই বস্তু। এরূপ আনন্দদায়ক প্রলোভনের বস্তু আর দ্বিতীয় নাই। প্রথম জীবনে লোকে এই সার সত্যটা উপলব্ধি করিতে পারিলে আর জীবন বিষময় হয় না।

    স্ত্রীলোকে বিমুগ্‌ধ হইয়া পুরুষ যে পতঙ্গবৎ তাহার রূপবহ্নিতে আত্মবলি প্রদান করে তাহাও সেই প্রেমেরই কার্য্য। কেবল ভাবেরই বৈষম্য। বহির্মূখী পশুভাবই কাম শব্দে বাচ্য হয়। আর অন্তরমূখী প্রীতির সুনির্ম্মল ভাবকে প্রেম বলা যায়। ভগবান স্ত্রী পুরুষ দুই সৃজন করিয়া যেমন সৃষ্টিপ্রবাহ রক্ষা করিতেছেন, সেইরূপ প্রেমশিক্ষারও ইঙ্গিত করিতেছেন। কিন্তু লোক বহির্মূখী হইয়া খাটী দুগে্‌ধ গোমূত্র নিক্ষেপ করত: তাহা বিকারিত করিয়া পান করিতেছে ও এই সংসাররূপ সুখের সাগরকে দু:খরূপ নরকে পরিণত করিতেছে। সংসারকে ও ভগবানকে ভালবাসিবার ঐ এক কাম অথবা প্রেমনামা সূত্র ভিন্ন আর কোন সূত্র নাই। সংসারে লোক ভালবাসে কিসে? না সৌন্দর্য্যে মুগ্‌ধ হইয়া। সৌন্দর্য্যই কামের উদ্দিপক। তাহার জন্য লোক দিগ্‌বিদিগ্‌ জ্ঞান ও জপ তপস্যাদি পর্য্যন্ত হাড়াইয়া ফেলায়। কত যোগী ঋষি পর্য্যন্ত অপ্‌সরী ও দেববেশ্যার রূপের মোহে যোগ ও জ্ঞানপথ ভ্রষ্ট হইয়া পশুভাবের অবতারণা করিয়াছেন। আর সাধারণ মনুষ্য আমরা কি করিয়া সে প্রবল পশুভাবের স্রোতের মুখে টিকিয়া থাকিতে পারিব?

    তাই বৈষ্ণব কবি ও দার্শনিকগণ বড় সহজ ও সুন্দর পন্থার সৃজন ও অনুসরণ করিয়া ধন্য হইয়া গিয়াছেন এবং পরবর্ত্তী জ্ঞানী অজ্ঞানী সকল শ্রেণীর লোকের জন্যই সেই সুমধুর উপদেশবাণী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া মর জগতে স্বর্গের দুন্ধুভি নিনাদ যে নিনাদিত হইতে পারে তাহা শিখিবার ও শুনিবার পথ উন্মূক্ত করিয়া গিয়াছেন। জগতে তদীয় কীর্ত্তি দিন দিন অক্ষয় হইতে চলিয়াছে। এখনও বঙ্গদেশের লোক সে আস্বাদ পূর্ণমাত্রায় পায় নাই। সে সকল আলোচনা সেই মৎস্যাশী দেশে অতিব বিরল। কিন্তু বৃন্দাবন প্রভৃতি পূণ্যপ্রদেশ সকল সেই বৈষ্ণবাচার্য্যগণের প্রভাবে মাতোয়ারা। ভগবানের লীলাস্থানেরও মহিমা আছে নতুবা এ সকল পূণ্যপ্রদেশে এত সাধুসমাগম হইবে কেন? ধন্য তাঁহারা। ধন্য জগতবাসী অন্ধ তমসাচ্ছন্নগণ! কেহই ভগবানের কৃপা হইতে বঞ্চিত হইবে না। বাঙ্গলায় যেন পুন: গৌরাঙ্গাবতারের আবির্ভাব হইবে বোধহয়। বাঙ্গলাদেশ ধর্ম্ম সম্পর্কে এখনও অনেক পশ্চাতে আছে।
  • pi | 128.231.22.133 | ২৭ আগস্ট ২০১১ ০৫:৪৬480378
  • মৎস্যাশী জনতাকে নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট একদম ঠিক।
  • achintyarup | 121.241.214.34 | ২৮ আগস্ট ২০১১ ১৮:১৩480379
  • যখন এখানে কথা প্রসঙ্গে ধর্ম্মের কথা উঠিয়াছে তখন আরও কিছু বলিয়া আসল কথাটা শেষ করিয়া যাই, এ সকল অমূল্য প্রসঙ্গের উত্থাপনের আর সময় পাই কি না পাই কে জানে? বৃন্দাবনবাসী হওয়ার হেতুতেই এ প্রসঙ্গ ও তঙ্কÄ এ গ্রন্থে সন্নিবেশীত হইল, নতুবা এ তঙ্কেÄর শিক্ষা সকলের পক্ষেই অসম্ভব ছিল।

    ভগবান যে নিরাকার ইহা কেনা জানে? আস্থিক মাত্রই ইহা অস্বীকার করিবে না। তাঁহার উপাসনার যে বিধিব্যবস্থা বেদ উপনিষদ প্রভৃতি দর্শনশাস্ত্রে আছে, তাহা বিধিমার্গ নামে পরিচিত। তাহার সাধকগণ জ্ঞানী, যোগী ও তপস্বী বলিয়া আখ্যাত। কিন্তু ভক্তিপথের যাঁহারা পথিক অর্থাৎ প্রেমিক সাধক, তাঁহারা এ পথ প্রশস্থ বলিয়া মনে করিলেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব সময়ে যে রূপলীলা তিনি করিয়া গিয়াছেন ও প্রেমপথে অর্থাৎ রাগপথে তাঁহাকে ধরার যে উপায় তিনি গোপীদিগের সাহচর্য্যে শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন, তাঁহার প্রকট লীলা অবসানেও ঐ শিক্ষা কিরূপে স্থায়ী রাখা যায় ইহা তৎসময়ের মনিষী ভক্তগণ চিন্তা করিয়া ভাগবতাদি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাহার স্থূল মর্ম্ম এই যে --

    ভগবান ত এখন অপ্রকট ও অশরীরী, তবে কি উপায়ে সেই একমাত্র প্রেমদাতাকে ভজনা করা যায়? তাঁহারা নিজে২ সেই ভগবানের আদর্শরূপ চিন্তা করিতে২ দেখিলেন যে ভগবান তাঁহাদের ভক্তি প্রীতির আকর্ষণে শরীরীর ন্যায়ই এই ব্রজধামে প্রতিতি হন ও লীলা বিস্তার করেন। ব্রজ বলিতে বাহিরের বৃন্দাবনকে বুঝায়। মানুষের চিত্তকেও বুঝায়। তাই তাঁহারা সমস্বরে উচ্চারণ করিলেন -- গোবিন্দ শরীর নিত্য ও তাহার লীলা সত্য। এই উপলব্ধি তাঁহাদের হইয়াছে ইহা সত্য সত্য ও পুন: সত্য। এই সাধকমুখ প্রচারিত বাণী লিপিবদ্ধ হইয়া ভক্তিশাস্ত্র প্রণিত হইল। ইহাই বৈষ্ণবের বেদ ও উপনিষদ।

    তখনই রাধাকৃষ্ণের বাহ্য মূর্ত্তি নির্ম্মিত হইল, ইহা অজ্ঞানীদের জন্যই প্রধানত:, তবে জ্ঞানীও যে তাহা অবলম্বন না করেন তাহা নহে, উচ্চদরের সাধকগণ ভগবানের ঐ দ্বিভাবের সৌন্দর্য্যতার চূড়ন্ত প্রকাশক মূর্ত্তি চিত্ত-বৃন্দাবনে কল্পনা করিয়া তাহার মানসিক সেবাপুজা ও লীলাখেলা করেন, ভগবানও রাধাকৃষ্ণরূপেই ধরা দিয়া ভক্তকে ""যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী'' এই শাস্ত্রবাক্যের সারবত্তা ও সত্যতা উপলব্ধি করাইয়া দেন। ইহাই প্রকৃত সাধন ভজন ও সিদ্ধি, ভগবানকে আপনা ভাবে দর্শন ও পর্শন করা, ইহাই ত গোপীভাব বা গোপীপ্রেম।

    বহির্জগতে যদি সৌন্দর্য্যই একমাত্র লোকের মনোরঞ্জনের কারন হয়, তবে অন্তর্জগতেও ত তাহাই। অন্তর্জগতে সৌন্দর্য্যের বীজ না থাকিলে বহির্জগতে আসিবে কোথা হইতে? তবে বহির্জগতে বিকারপ্রাপ্ত আর অন্তর্জগতে সুনির্ম্মল কামগন্ধবিহীন -- পশুভাব বর্জ্জিত শুদ্ধ প্রেম, তবেই বুঝা গেল সৌন্দর্য্যই মূল। ভালবাসার একমাত্র উদ্দিপক ১মই সেই রূপের মাধুরী তৎপর গুণ গরিমাটা আনুসঙ্গিক। রূপই যদি প্রধান হইল তবে জগতের যতরকম ঐশ্বর্য্য ও সৌন্দর্য্য আছে তাহা দিয়া প্রাণের দেবতাকে সাজাও নিজেও গোপীদেহ লাভে তাঁহার লীলাখেলার সাহায্যকারিণী হও। যথা স্ত্রী পুরুষের ন্যায় লীলাখেলা; এই খেলাতে ভগবান স্বয়ং মন্মথ মন্‌মথ বলিয়া নিজেই ব্যক্ত করিয়াছেন, এই রাস খেলায় কন্দর্প -- কামবিজয়ী ভগবান গোপী অর্থাৎ ভক্তদিগকে যে চুম্বন আলীঙ্গনাদি দিতেছেন ইহাই প্রকৃত রমণ শব্দে বাচ্য। পশুভাবের রমণ রাধাকৃষ্ণে নাই, গোপীদেরও নাই ও ছিল না। এই কামবিজয় বার্ত্তাটা কেবল বৈষ্ণবাচার্য্যগণই প্রকাশ করিয়াছেন, নতুবা দুর্ব্বল যোগাদিতে অনধিকারী ব্যক্তির পক্ষে সাধনভজন অতি সুকঠিন ছিল।
  • achintyarup | 14.99.224.166 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৪:২৮480380
  • বাহ্য বিগ্রহ মূর্ত্তিও যত সুন্দর হয় তাহা করিবে। ঐশ্বর্য্য ও মাধুর্য্যমিশ্রিত ভাবের মূর্ত্তি না হইলে বহির্মুখী কাম অন্তর্মুখী প্রেমে পরিণত হইবে না। সৌন্দর্য্য উপভোগেই যদি কামভাব চলিয়া যায় তবে পশ্বাচারের প্রয়োজন কি? সুখ ত একই পদার্থ -- কামে যেরূপ অনুভব প্রেমেও সেইরূপ অনুভব। যদি ভগবানের রূপ মাধুর্য্য দর্শনে আমার সে সুখ হয় তবে আর পশুভাবের অভিনয় করার অবসর থাকে কই? পিপাসিত ব্যক্তির সুমিষ্ট পেয় সেবনে যদি পূর্ণ পরিতৃপ্তি হয় তবে কি আরও জল পানের ইচ্ছা করে? কখনই না। বাসনার অতৃপ্তি কেবল পশুভাবে। দেবভাবে তাহা পূর্ণাতিপূর্ণরূপে তৃপ্তি!! হরি হরি! যাহা লিখিলাম তাহা দ্বারা যদি জনেকের চক্ষু প্রস্ফুটিত হয় তবেই .... লিখার সার্থকতা হইবে।
  • achintyarup | 14.99.224.166 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:০৮480381
  • আত্মকথা।

    ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

    মোক্তারী কার্য্য।

    বাঙ্গলা ১২৯১ সালে মোক্তারী পাশ করিয়া কার্য্য আরম্ভ করিলাম। নিজগ্রামে রামধন চক্রবর্ত্তী নামে চিরকুমার, শাস্ত্রজ্ঞ, সুপণ্ডিত ও সুবক্তা জনৈক ব্রাহ্মণ আমার বাটীর পেছন দিকে তাঁহার নিজালয়ে বাস করিতেন। প্রত্যহ আমার পাকা ঘাটলা যুক্ত যে বড় পুখুর বিদ্যমান সেই পুখুরে আসিয়া স্নানাহ্নিক সমাপন করিয়া যাইতেন। আমি ঠাকুর দাদা বলিয়া সম্বোধনে সেই প্রৌঢ়বয়সী ঠাকুরকে বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তিতে পরিতুষ্ট করিতে ত্রুটী করিতাম না। তিনি আমাকে সুহৃদ .. নিজ কনিষ্ঠ সহোদর জ্ঞানে নাম ধরিয়া ডাকিতেন এবং স্নানার্থ আগমন করিয়াই ডাকিতে২ আমার বাটীস্থ বৈঠকখানা গৃহে আসিয়া আসন পরিগ্রহ করত: তামাক সেবনের অভিলাষ প্রকাশ করিতেন। আমিও তাঁহাকে সেসময় সাদর অভ্যর্থনা করিতে ত্রুটী করিতাম না। তিনি একদা ঐরূপভাবে আগমন করিয়া হর্ষপ্রকাশে বলিয়া উঠিলেন পরীক্ষা পাশ করিয়াছ মঙ্গলের কথা; তবে জিলার সদরে থাকা চাই, ""হুজুরের মজুরও শ্রেষ্ঠ''। তাহার বাক্যে উৎসাহিত হইয়াই ময়মনসিংহ সহরে ""পরামাণিকের বাসা'' নামক স্থানে (যাহাতে কোন সময়ে সেই ভক্তশ্রেষ্ঠ কর্ম্মবীর জয়গোবিন্দ রায়ও ওকালতী কার্য্যকালে বাস করিয়াছিলেন) বাসা প্রস্তুত করিলাম। ১২৯৩ সালে রেবিনীউ কোর্টের প্রাপ্ত মোক্তারী সংক্রান্ত আইন পরীক্ষা পাশ করিলাম। তখন কালেকটরীতে ভূমিবণ্টন সংক্রান্ত আইনানুযায়ী বহু মোকদ্দমা এককালিন রুজু হওয়ায় বাটওয়ারা ডিপার্টমেণ্ট বলিয়া কালেকটরীর অধীন একটা পৃথক বিভাগ স্থাপন হইয়াছে। তাহার বিচারক আমলা সকলই পৃথক ভাবে কাজ করিতেছেন। পূর্ব্বে এরূপ ছিল না। জনৈক বিচারকের হাতে ফৌজদারী ও কালেকটরীর নানা কাজের ভার থাকিত, তিনি সামান্য ভাবে বাটওয়ারা সংক্রান্ত কাজও করিতেন।

    আমার রেবিনিউ পাশের পরই আমার ভাগ্যোদয় হইল, বাটওয়ার আইনটী ভাল করিয়া পাঠ করিয়া বাটওয়ারার কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম। ভগবানের কৃপায় বিনা চেষ্টায় অনেক মওক্কেল আগমন করিতে লাগিলেন। লোকে বলিতে লাগিল ""গগন রায় বাটওয়ারা ভাল বুঝে''। বাটওয়ারাতে ১ম ডিপুটী কালেকটর পাইলাম বাবু সূর্য্যকুমার দাস, তিনি আমার অসাক্ষাতে বলিলেন, ""গগন রায় অল্পদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় শ্রেণীর ১ম মোক্তার হইয়াছে, কালে ১ম শ্রেণীতে দাঁড়াইবে''। এই সকল সার্টীফিকেটে মনে খুব বল বাঁধিল। নিজের পায়ে ভর করিয়া যে দণ্ডায়মান হইতে পারিলাম, এজন্য ভগবানকে শত ধন্যবাদ প্রদান করিলাম। তখন অনুগ্রাহক পৃষ্ঠপোষক ও সহানুভূতি প্রদর্শক সুহৃদ সজ্জনের আর অভাব নাই। ১০ বৎসরের মধ্যে মোক্তারী ব্যবসায়ের যথেষ্ট উন্নতী হইল। ১৩০১ সালে নিজে দুর্গাবাড়ীর পুখুর পাড়ে নূতন বৃহৎ বাসা করিলাম। বাটওয়ারা সংক্রান্ত স্পিসিএল ডিপুটী কালেকটর, সূর্য্যবাবু, বাবু নবীনচন্দ্র সেন ও বাবু নরেন্দ্রকুমার চৌধুরী প্রভৃতি মহাত্মাগণ আমাকে খুব স্নেহদৃষ্টিতে দেখিতেন। নিজে মওক্কেল ডাকিয়া দিতেন। নরেন্দ্রবাবুর সময়েই আমার উন্নতী চরমসীমায় দাঁড়াইয়া ছিল। তখন মে: স্প্রাই সাহেব প্রভৃতি কালেকটরগণও আমাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদানে রে: এজেণ্টদিগের জন্য নূতন লাইব্রেরী স্থাপনার্থে নানা প্রকারে সাহায্য করিলেন। পূর্ব্বে রেবিনিউ এজেণ্ট মোক্তারগণের জন্য পৃথক কোন লাইব্রেরী ছিল না। আমরা নবীন উদ্যমে স্প্রাই বার লাইব্রেরী নামে নূতন লাইব্রেরীর পাকা গৃহনির্ম্মাণে দ্বারোদঘাটন করিলাম।
  • ranjan roy | 122.173.178.213 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৯:১৯480382
  • গগন রায় মহাশয়ের রাধাভাবে সাধন ফান্ডা নিয়ে দুপয়সা।
    ১৯৬৭ সালের শেষ। নাকতলা বাড়ির কর্তা গগনচন্দ্রের পুত্র বছর পঁচাত্তরের সতীশচন্দ্র। ওনাদের কয়পুরুষের গুরুপরিবার ত্রিপুরার পত্তনের গোস্বামী নব্বই বছরের বুড়ো শিষ্যপার্ষদ নিয়ে বাড়িতে দশদিন আসর জমিয়ে রইলেন। উনি হুঁকোয় করে তামাক খান। ঠাকুমার অনুরোধে বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসা গেল। ছোট ভাইগুলো সেজে আনার নাম করে বাগানে গিয়ে
    গুড়ুক-গুড়ুক করে আসতে লাগল। ঠাকুমার অনুরোধ এবং কিছু হাতখরচের পয়সা পাওয়ায় "" আমার গোঁসাইরে নি দেখছ খাজুর গাছতলায়'' পল্লীগীতি গাওয়া বন্ধ হল।
    একদিন সন্ধ্যেবেলা প্রবচনের সময় উনি বল্লেন-- নারীদের মতন সেবা কেউ করতে পারে না।
    সঙ্গে সঙ্গে এক ভক্ত পার্ষদ ডুকরে কেঁদে উঠলেন--- প্রভূ, এই আশীর্বাদ করুন আমি যেন আগামী জনমে নারী হয়েই জন্মাই।
  • achintyarup | 14.96.166.87 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৬:০৭480383
  • ঋণ আদায় ও নিজ কালেকটরীর খারিজা তালুকের বণ্টন শেষ।

    মোক্তারীর প্রথম সূত্রপাতেই সুর্য্যবাবু হাকীম ও কৃষ্ণকুমারবাবু সিরিস্থাদার মহাশয়গণের অপরিসীম অনুগ্রহ ও সাহায্যে নিজ মহালগুলীর বণ্টনকার্য্য শেষ করাইলাম। বণ্টনের পর খণ্ড২ রূপে কতক ভূমি ছাড়িয়া দিয়া ঋণ আদায় করত: মহাত্মা হরিনাথবাবু মুন্‌শেফের উপদেশ পালন করিলাম। কারণ তখনও প্রসার ও বিশেষ অর্থোপার্জ্জন হয় নাই। যখন অর্থোপার্জ্জন হইতে লাগিল তখন মুনশেফ্‌বাবুর কথার সারবত্তা উপলব্ধি হইল। যেহেতুক যে পরিমাণ সম্পত্তি ঋণদায়ে বিক্রীত হইয়াছিল তদপেক্ষা অনেক অধিক সম্পত্তি অনায়াসে অর্জ্জিত হইল। বাটওয়ারার এই ফল হইল যে, নিজের অংশের ছাহামের ফুল্‌ মহাল সৃষ্টি করিয়া নিজে মালীক স্বরূপে ষোল আনার অধিকারী হইলাম; ঋণাদি আদায় করাও সুগম হইল। এই বাটওয়ারাই আমার উন্নতীর পথপ্রদর্শক হইল। নিজে মোক্তারী পাশ করার সুযোগ পাইলাম। বিবাহ ত তৎপূর্ব্বে ঐ বাটওয়ারা ব্যপদেশেই জুটীল। এই কালেকটরীর বাটওয়ারাই আমার সর্ব্ব বিষয়ের ভিত্তি বলিতে হইবে। যাহা হউক ঋণ আদায়ে নিশ্চিন্ত হইয়া মোক্তারী ব্যবসা নবিন উদ্যমে পরিচালনে সক্ষম হইলাম। ঐ বাটওয়ারার কার্য্যে কৃষ্ণকুমারবাবুর অনুগ্রহের সীমা ছিল না। তিনি ঐ সম্বন্ধে যে উপকার করিয়াছেন তাঁহার ঋণ আমার অপরিশোধনীয়।

    কর্ম্মক্ষেত্র।

    কর্ম্মক্ষেত্রেও ১মই বাবু কৃষ্ণকুমার রায়েরই সাহায্য প্রাপ্ত হই। মওক্কেল সংগ্রহে ও লোকের নিকট পরিচয় প্রসঙ্গে ও বাসার স্থানপ্রদানে তিনি ১ম উদ্যম সময়ে একমাত্র প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তাঁহার ন্যায় অমায়িক, সদাশয়, পরোপকারী ও উদারহৃদয় লোক অল্পই দৃষ্ট হয়। মোক্তারী পাঠ হইতে কার্য্য পরিত্যাগের সময় পর্য্যন্ত তিনি আমার সাহায্যকারীরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাঁহার মহঙ্কÄ ও উপকার এ জীবনে ভূলিব না ও তাঁহার ঋণও শোধিতে পারিব না। কি বলিয়া তাঁহার মহঙ্কÄ কীর্ত্তন ও গুণগান করিব ভাষায় তাহার শব্দ খুঁজিয়া পাই না।

    তৎপরেই বর্ত্তমানে দিঘাপাতীয়া রাজ স্টেটের চিপ্‌ ম্যনেজার্‌, উদারচেতা ও নি:স্বার্থমূলক পরোপকারী বাবু নবীনচন্দ্র রায় মহাশয়ের কথা স্মৃতিপথে উদিত হয়। তিনি বাল্যকালে আমার সহাধ্যায়ী ও ছাত্র বন্ধু ছিলেন। সে সময়েই তাঁহার প্রশান্ত চিত্তের স্ফূর্ত্তী দেখা গিয়াছিল। তিনি ঐ স্টেটের অডিটারী পদে থাকা কালে ১৩০০ বঙ্গাব্দায় আমাকে ঐ স্টেটের মোক্তারী কার্য্যে নিযুক্ত করেন। তদবধি ১৩২৬ সাল পর্য্যন্ত তিনি ঐ কার্য্য ব্যপদেশে আমার অসীম উপকার করিয়া যেরূপ মহানুভবতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা ভাষায় বর্ণনীয় নহে। তাঁহার ন্যায় অহেতুক পরহিতাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা সংসারে দুর্ল্লভ ও বিরল। কেবল যে আমার উপকারকল্পে একথা বলিতেছি তাহা নহে। আমার ন্যায় বহু লোককে তিনি নানা উপায়ে উপকৃত করিয়াছেন ও করিতেছেন। তাঁহার মহঙ্কেÄর প্রসংশাযোগ্য ভাষা নাই। ভগবানের নিকট তাঁহার যশ গৌরব বিস্থার ও দীর্ঘকাল নিরাপদ জীবনে বাস করার প্রার্থনা করা ভিন্ন তাঁহার কৃত উপকারের যে কিছু প্রতিদান করিতে পারি এমন সাধ্য নাই। আমার কার্য্য পরিত্যাগের পরও আমার সহরের প্রকাশচন্দ্র করকে আমার বেতনে নিযুক্ত রাখিয়া প্রতিপালন ও আমার নামটা জাগরুক রাখিয়াছেন। ধন্য তাঁহার মহঙ্কÄ ও উদার অন্ত:করণকে!!

    মোক্তারী ও ওকালতী ব্যবসায়ে অনেক বিষয়েই আফিস আদালতের আমলাবর্গের .... করিতে হয়। মামলা মোকদ্দমার নথী ও কাগজপত্র তাঁহাদের ....., যদি তাহাদের সহিত সদ্‌ব্যবহার থাকে তবে মওক্কেলগণের কাজে অসুবিধা ঘটে না। আফিস আদালতের আমলাগণের মধ্যে সিরিস্থাদারই ..ম আর এপ্রেণ্টিস্‌বাবুরা সর্ব্বনিম্ন পদে আসীন। আমার সৌভাগ্যক্রমে ...., কালেকটরী, ফৌজদারী ও রেজেস্টরী আফিস প্রভৃতি কোন বিভাগের ...বর্গের সহিতই আমার কখনও অসদভাব হয় নাই। বরং আমলাগণের .... অনেকেই আমাকে স্বচেষ্টায় মোকদ্দমাদি দিয়া ও মওক্কেল সংগ্রহে সাহায্য ... উপকৃত করিতে ত্রুটী করেন নাই। মোক্তারী কার্য্যের ১ম হইতে ... পরস্পর এই সদ্‌ভাব রক্ষিত হইয়াছিল। তাহাতে মওক্কেলগণের কার্য্য ...পক্ষে নিজে যেরূপ আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছি, মওক্কেলগণও .... হইয়া পুরস্কার প্রদান করিয়াছেন।

    .... কার্য্যকালে ময়মনসিংহ সদরে কালেকটরী ও ফৌজদারী বিভাগে ... বিচারকের নিকট আমার আত্মপরিচয় প্রদান ও কৃতীত্ব প্রকাশ করিতে ...ধ্য বাবু সূর্য্যকুমার দাস, উমাপ্রসন্ন গুহ, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ....চৌধুরী, পূর্ণচন্দ্র নাগ, পরমেশপ্রসন্ন রায়, কৈলাসগোবিন্দ .....মোহন দাস, চন্দ্রশেখর কর, গঙ্গানারায়ণ রায়, নবীনচন্দ্র সেন, মৌলবী ফয়েজউদ্দিন হুসেন ও তৎপুত্র মৌলবী মোয়াজ্জম হুসেন সাহেব প্রভৃতি ... নিকট বিশেষরূপে আমি পরিচিত ও কার্য্যকুশলতা প্রদর্শনে ... ছিলাম।
  • achintyarup | 59.94.2.252 | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৩০480385
  • সূর্য্যবাবু নিজ বাটওয়ার কার্য্যে বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শনে আমাকে ...... গিয়াছেন। পূর্ণবাবু নিজ খারিজা মহালগুলীর সেছ কমাইয়া দিয়া অসীম উপকার করিয়া গিয়াছেন। হেমবাবু আদমপুরের বাটওয়ারায় যে মহঙ্কÄ প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন তাহার তুলনা নাই। নরেন্দ্রবাবু মওক্কেল নিকট পরিচিত করিতে চেষ্টা ও প্রশংসা করিয়া যথেষ্ট হিতসাধনে আমাকে ঋণী ও অনুগৃহীত করিতে ত্রুটী করেন নাই। মৌলবী ছৈয়দ ফয়েজউদ্দিন হুসেন ও তৎপুত্র মৌলবী ছৈয়দ মোয়াজ্জম হুসেন সাহেবানের সদাশয়তা, সৌজন্যতা ও উদার হৃদয়ের পরিচয় দেওয়া আমার অসাধ্য। বড় সাহেব সহ অতি শুভক্ষণেই সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তিনি আমাকে তাঁহার স্টেটের মোক্তার নিযুক্ত করিয়া ১৩২৬ সাল পর্য্যন্ত যে অসীম দয়া ও উপকার করিয়াছেন তাহা অবর্ণনীয় ও অতুলনীয়। এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস বোধহয় মোক্তারগণের মধ্যে তিনি কাহাকেও করেন নাই, অনেক তৎস্বজাতীয় মোক্তার তাঁহাকে তৎস্টেটের মোক্তারী পদের জন্য নানারূপ বাক্‌জাল বিস্তারে আমার নিন্দা প্রকাশে ত্রুটী করে নাই। কিন্তু তাঁহার দৃঢ় চিত্ত ন্যায়ের তুলাদণ্ডে সমভাবেই বিরাজমান। একটুও এদিক্‌ ওদিক্‌ হেলে নাই। তিনি স্পষ্ট বাক্যে বলিয়াছেন, ""গগন রায়ের কার্য্যতায় আমি কোন দোষ পাই নাই; বরং তাঁহা দ্বারা উকীলের যে কার্য্য তাহাও অনেকটা হইয়া যায়। গগন রায় কেবল কাগজ বাহক নহে। আইন কানন অভিজ্ঞ, নিজে দেখিয়া শুনিয়া কাগজ পত্র বুঝিয়া তবে উকীলের নিকট যায় ও অনেক কাজ যাহা উকীল দ্বারা করাইতে গেলে বহু টাকা ব্যয় হয়, তাহা গগন রায় নিজে করিতে পারে বলিয়া আমার বহু টাকা বাঁচিয়া যায়। টাকা পয়সা সম্বন্ধে তাঁহার ন্যায় বিশ্বাসী ও মিতব্যয়ী লোক দ্বিতীয় পাইব কিন সন্দেহ। তাঁহার জমা খরচ আমি কোন দিন দেখি না, তাঁহার কথাই আমার বিশ্বাস যোগ্য। এহেন সজ্জন লোকের বিরুদ্ধে কেহ যেন কিছু আমার নিকট প্রকাশ না করেন এই বিষয়ে আপনাদিগকে সতর্ক করিয়া দিলাম''। এইরূপ মিষ্ট ও স্পষ্ট বাক্যে স্বজাতীয় মোক্তারগণের সন্মান বজায় রাখার কথা সাহেব সরকারের প্রধান২ কর্ম্মচারীগণের প্রমুখাৎ অনেক শ্রবণ করিয়া সেই অমিততেজা পুরুষপ্রবরকে শত ধন্যবাদ দিয়া সেলাম অভিবাদন করিয়াছি। তিনি আমার সাক্ষাতে আরও বলিয়াছেন, হিন্দু মুশলমানে আমার কোন ভেদ জ্ঞান নাই। যেই সজ্জন ও ন্যায়বান সেই আদরণীয়। স্বদেশী মোকদ্দমার বিচারে হিন্দুদিগকে মূক্তি দিয়া মুশলমানদিগকে জেলে পুরিয়া তাহার রায় অর্থাৎ নিষ্পত্তিপত্রেও নাকি ঐ উক্তি লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন এবং স্বীয় পুত্র উদিয়মান ডি: মাজিস্ট্রেট মৌলবী ছৈয়দ মোয়াজ্জম হুশেনকেও ঐ বিষয়ে বার২ সতর্ক করা ও উদারভাবে হিন্দু মুশলমানে অভেদজ্ঞানে ব্যবহারাদি করিতে বহু উপদেশ সময়ে দেওয়ার কথা অতি বিশ্বস্থসূত্রে অবগত আছি। তাঁহার ন্যায় ন্যায়বান ও স্বাধীনচেতা লোক অতি বিরল। তিনি উর্দ্ধতন কর্ত্তৃপক্ষকে খোসামোদ করিয়া কি ভয় করিয়া কোন কাজ তাঁহার জীবনে করেন নাই। স্বমুখে আমাদের সাক্ষাতে ইহা স্পষ্টবাক্যে বলিয়াছেন। স্বিয় ধর্ম্মে এরূপ আস্থাবান লোক মুশলমানের মধ্যে দূরে থাকুক হিন্দুর মধ্যে কম মিলে। প্রাতে ৮ ঘটীকা পর্য্যন্ত মালা (তজ্‌বী) জপ ও ইষ্টকার্য্যাদি দৈনিক প্রতিপাল্য নিয়মের অন্যথা কখনও দেখি নাই। ৫ অক্ত (পাঁচ বার) নমাজের ব্যত্যয় গবর্ণর জেনারেল পরিদর্শনে আসিলেও হয় নাই।

    আমার সম্বন্ধে তাঁহার মুখে এমন কথাও প্রকাশ পাইয়াছে যে কালীশঙ্করবাবু প্রভৃতি মোসাবিধা করিয়া দিলেও ""যতক্ষণ আমার মোক্তার ইহা ঠিক হইয়াছে বলিয়া না বলিয়াছেন ততক্ষণ ইহা আমি দাখিল করিব না''। এমন অগাধ বিশ্বাস আর কোন মওক্কেলের মধ্যে দৃষ্ট হয় নাই। কার্য্যব্যপদেশে আমি বাড়ী গেলে, বড় উকীলবাবুদিগের কৃত আরজী বর্ণনা এমনকি সাধারণ দরখাস্তাদির মোসাবিদা পর্য্যন্ত আমার অপেক্ষায় আমলাগণ দাখিল করিতে সাহসী হয় নাই। আমলাগণ সহরে বসিয়া রহিয়াছে, উকীল দ্বারা মোকদ্দমার অবকাশ লইয়াছে কেবল আমার অপেক্ষায়। আমি আসিয়া যখন বলিয়াছি, এসব ঠিকই হইয়াছে তখন দাখিলের হুড়াহুড়ি লাগিয়াছে। আমার সম্বন্ধে আরও উচ্চ ভাব তাঁহার ছিল। কোনদিন তাঁহাকে আগে সেলাম দিতে পারি নাই। গৃহের বাহিরে থাকিতেই উচ্চ স্বরে বলিয়াছেন ""আমার আদাব আসুন''। এহেন বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ সদাশয় লোকের মহঙ্কÄ কি বলিয়া কীর্ত্তন করিব ও কি বলিয়া তাঁহার অসীম সদ্‌গুণরাশীকে ধন্যবাদ দিব, তাহার ত ভাষা খুজিয়া পাই না। জীবনে তাঁহাকে কখনও ভূলিতে পারিব না ও তাহার নিকট যে ঋণভারে আবদ্ধ আছি তাহাও এ জীবনে পরিশোধ করিতে পারিব না।

    বেতনের ও প্রাপ্য টাকাদি দিতে এরূপ নিয়মিত ছিলেন যে চহিবা কি লিখিবা মাত্র টাকা পাঠাইয়া দিতেন। কোন বিষয়ে কাহারও উচিত প্রাপ্য মধ্যে কপর্দ্দক মাত্রও বাজেয়াপ্ত করিতেন না। কেহ কোন বিষয়ে পুরস্কারের যোগ্য হইলে, তাহাকে কখনও বঞ্চিত করিতেন না। তিনি এখনও জীবিত। আমি তাঁহাকে শত২ বার অভিবাদন দেই।
  • achintyarup | 59.93.246.35 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৫৬480386
  • অত:পর মওক্কেলগণের পরিচয় প্রসঙ্গও কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি; কিরূপ লোকের সাহচর্য্যে আমার কর্ম্মজীবন গঠিত হইয়াছে, তাহাতে তাহা প্রকাশ পাইবে। কেবল নিম্নশ্রেণীর লোক লইয়াই বিচরণ করি নাই, অনেক সদবংশজ উচ্চপদবীর লোকই আমার কর্ম্মজীবনের সহায় হইয়াছিলেন ও উন্নতীর পোষকতা করিয়াছিলেন।

    সদর থানার এলাকার রণভাওয়াল পরগণার বড় তালুকদার মে: মার্‌কার্‌ জি পোগজ সাহেব আমার উপর তাঁহার স্টেটের সর্ব্ববিধ মোকদ্দমা পরিচালনের ভার দিলেন। তিনি আমাকে এতদূর উন্নীত করিলেন যে ময়মনসিংহ উকীল লাইব্রেরীতে বসিয়া পর্য্যন্ত অম্লান বদনে প্রকাশ করিলেন যে আমার মোক্তার গগন চন্দ্র রায় একাধারে আমার উকীল ও মোক্তার। তাঁহার সম্বন্ধে আর অধিক বলা নিÖপ্রয়োজন। সদরের বহু হিন্দু মুশলমান তালুকদারগন আমার মওক্কেল হইলেন। বাবু মহেশচন্দ্র সেন বড় তালুকদার তাঁহার জীবন পর্য্যন্ত কাজ করিয়াছি। সেনবাড়ীর প্রসিদ্ধ ভূম্যাধিকারী।

    ঈশ্বরগঞ্জ থানার এলাকার প্রসিদ্ধ মুনশেফ্‌ পেন্‌সন্‌প্রাপ্ত বাবু কালীনাথ ধর রায় আত্মীয় স্বজন মোক্তার উকীলকে উপেক্ষা করিয়া আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করত: সর্ব্ববিধ মোকদ্দমাদির ভারার্পণ করিলেন। ঈশ্বরগঞ্জের এলাকার বহু ছোট বড় তালুকদারই মোক্তারী কার্য্যে আমাকে বরণ করিলেন। সুন্দুয়াইল গ্রামের প্রসিদ্ধ বাবু গিরিশচন্দ্র রায় যিনি এক সময়ে আঠারবাড়ীর জমীদার স্বনামধন্যা জ্ঞানদাসুন্দরী চৌধুরাণী মহাশয়ার স্টেটের প্রধান কর্ম্মচারী ছিলেন এবং অন্য সময়ে তাহার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দিতা করিতেও ত্রুটী করেন নাই তিনিও আমাকে তৎস্টেটের সর্ব্ববিধ বিষয়ে মামলা মোকদ্দমাদি পরিচালনে নিযুক্ত করেন। তাঁহার ন্যায় মামলাবাজ লোক মহার্ঘ বটে। এরূপ আর একজন পাইয়াছিলাম -- দিগদাইর নিবাসী বাবু রামকৃষ্ণ মহলানবীশ।

    কেন্দুয়া থানার এলাকার কাশীপুরের বড় তালুকদার রায়মহাশয়গণ ও বাড়রী গ্রামের কালীকুমার পত্রনবীশ মহাশয়গণ ও নওপাড়ার বহু ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য শ্রেণীর তালুকদারগণ পক্ষে আমি বহুদিন মোক্তারি কার্য্য করিয়াছি।

    নেত্রকোণা বারের উকীল প্রসিদ্ধ নবীনচন্দ্র সাধ্য প্রভৃতি আমাকে নানাপ্রকার মোকদ্দমা ও কার্য্যভার দিয়া সহায়তা করিয়াছেন। ঐ এলাকার আরও বহু ধনী ও তালুকদারের পক্ষে কার্য্য করিয়াছি তাহা এখন স্মৃতিতে আইসে না।

    শুসঙ্গ রাজবাটী এলাকার প্রসিদ্ধ ধনী কালীপ্রসাদ সাহার কাজ অনেকদিন করিয়াছি।

    জমালপুরের এলাকার ব্রাহ্মণ কায়স্থ বহু তালুকদারের কত কাজ করিয়াছি এখন তাহাদের নাম মনে আসে না।

    সেরপুর থানার এলাকার শুসঙ্গ পরগণার ও সেরপুর পরগণার কত লোকের কাজ করিয়াছি তাহার ইয়ত্তা নাই। এখন নাম মনে হয় না।

    টাঙ্গাইলের এলাকার টাটীপাড়ার জমীদার, ছয়াজানীর প্রসিদ্ধ যোগেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার প্রভৃতি ও সাঙ্গানীয়া পাড়ার মহেশচন্দ্র নিয়োগী প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাঁহাদের পরিচয় মতে ঐ অঞ্চলের বহু লোকই আমাকে চিনিয়া লইয়াছিলেন।

    আটীয়ার জনৈক মুশলমান জমীদার ও বিভিন্ন জেলার বহু তালুকদার, যাহাদের ময়মনসিংহে তালুকদারী আছে এরূপ অনেক লোকের কাজ আমি করিয়াছি।

    কোন্‌ অভাবনীয় সুত্রে যে আমি দেশ বিদেশে পরিচিত হইলাম তাহা সেই অচিন্তনীয় সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বজ্ঞই জানেন।

    মূক্তাগাছা থানার এলাকার অনেকেরই কাজ করিয়াছি। তন্মধ্যে মূক্তাগাছার কোন২ জমীদারের পক্ষেও বেতনভোগী হইয়া কাজকর্ম্ম করিয়াছি। পরাধীনতা স্বীকার করিয়া বেতনভোগী হইয়া জমীদারের আজ্ঞাকারী থাকাটা আমার আদৌই পছন্দ হইত না। তাই মূক্তাগাছা ও ময়মনসিংহ পরগণার প্রসিদ্ধ জমীদারগণের সরকারে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করি নাই। করিলে বোধহয় বহু বড় জমীদার সরকারেই স্থান লাভ করিতাম। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে কার্য্য করাই যেন আমার অধিক প্রিয় হইয়াছিল।
  • achintyarup | 59.93.254.131 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৩০480387
  • তবে বড় স্টেটের মধ্যে ভিন্ন জেলাবাসী দিঘাপাতিয়ার রাজসরকারে যে প্রসংশার সহিত ২৬ বৎসর কাজ করিয়াছি, তাহাতে কোন পরাধীনতা বা জবাবদেহী ছিল না। গবর্ণমেণ্টের রোল অনুযায়ী বিগত জমাখরচাদি প্রস্তুত করিয়া দিলেই গোল মিটিয়া যাইত। বেতন ও অন্যান্য প্রাপ্য টাকা বিল দিবামাত্রই আসিত। এমন বিধি বিধানুযায়ী কাজ ও টাকাপ্রাপ্তি অন্য কোন জমীদার ঘরে নাই। এই স্টেটের মোক্তারী কার্য্যে যে আত্মপ্রসাদ ও অর্থ লাভ করিয়াছি তাহা জীবনে অন্যত্র ঘটে নাই। তাহার মূলই বাবু নবীনচন্দ্র রায় চিপ্‌ ম্যানেজার্‌ তাহা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি।

    কিশোরগঞ্জ টাউনের বত্রিশগ্রামের পরামণিক চন্দ্রকান্ত দাস, বড় বাড়ীর রামকুমার দাস, নগুয়ার দেওয়ান মুনশী মহাশয়ের বাড়ী, মহেশচন্দ্র সরকার প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ধনী মহাজন ও তালুকদারগণ, বারের অনেক উকীল মোক্তার ও শুনাকীয়া মহিনন্দ ও তৎপার্শ্বস্থিত বহু গ্রামের কাজকর্ম্মে আমি দিবা নিশি অনবসর থাকিতাম। প্রসার -- কিশোরগঞ্জ, বাদনা, নান্দাইল, কটীয়াদি, বাজিৎপুর, ভৈরব ও অষ্টগ্রাম থানার এলাকায়ই বেশী বিস্তার লাভ করিয়াছিল। ঐ সকল এলাকার ছোটবড় তালুকদার শ্রেণী ও ধনী মহাজনদিগের পক্ষে কত লোকের যে কাজ করিয়াছি তাহার নাম উল্লেখ ও সংখ্যা করা দুষ্কর। ঐসকল এলাকায় আমাকে যে না জানে ও না চিনে এমন লোকের সংখ্যা কম।

    আমার এই প্রসার প্রতিপত্তি কালেকটরী ও দেওয়ানী বিভাগের আফিস ও আদালত সমূহেই সমধিক বিস্তার লাভ করিয়াছিল। ফৌজদারী আইন পাশ করিয়া সে পথে প্রেক্‌টিস্‌ করিতে ধাবিত হই নাই। অত:পর কয়েক মোকদ্দমায় মহামান্য হাইকোর্টেও যে মোকদ্দমা পরিচালন করিতে হইয়াছিল তদ্বিষয় সংক্ষেপে বর্ণন করিয়া অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করিব।
  • achintyarup | 59.93.254.131 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৬:০১480388
  • হাইকোর্টে মোকদ্দমা পরিচালন।

    ১৩০৯ সালে দিঘাপাতিয়া রাজ ষ্টেটের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ জফরসাহী পরগণার সপ্তাংশী সপ্তসংখ্যক জমীদার পক্ষে দাওকোবা নদীর ৮ মাইল ব্যাপী জলে জলকর স্বত্ব সাব্যস্থ করার জন্য সপ্তসংখ্যক স্বত্বের মোকদ্দমা জেলার ১ম সবর্ডিনেট জজ আদালতে একযোগে রুজু করেন। বিবাদী রাজ ষ্টেট পক্ষে পরিচালনের ভার আমার উপর ন্যস্ত হয়। তিনমাস উক্ত মোকদ্দমা পরিচালনান্তে সবজজ বাহাদূর বাদীগণকে মোকদ্দমা ডিক্রী দেন। রাজ ষ্টেট পক্ষে আমরা মহামাণ্য কলিকাতা হাইকোর্টে আপীল দায়ের করি। ১৩১২ সালে দিঘাপাতিয়া রাজধানী হইতে কার্ত্তিক মাসে আমাকে এক টেলীগ্রাম করা হয় যে আপনি অগৌণে কলিকাতা গিয়া ষ্টেটের উকীলবাবুগণ সহ দেখা করেন।

    কলিকাতা কোন দিন যাই নাই। মহুরের (সহরের? -- অচিন্ত্য) প্রকাশ তাহার ছোটকালে তথায় অনেকদিন ছিল, সুতরাং তাহার অনেকটা জানাশুনা আছে বলিয়া তাহাকে সঙ্গে লইলাম। আর কাপাসটীয়া গ্রামের গগন চন্দ্র দে প্রকাশ্য নাম আমাদের প্রদত্ত প্যারী দে কে চাকর স্বরূপ নিলাম। প্যারী পরে ভেটার্‌নেরী হাসপাতালের স্থায়ী পিয়ন হইয়াছে। তিনজনে যাত্রা করিলাম। কলিকাতা পঁহুছিয়া তথাকার রাজ ষ্টেট পক্ষে যে মোক্তার ছিলেন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনি তাঁহার বাসায় আহারাদির ব্যবস্থা করিলেন। তাঁহার নাম অবিনাশচন্দ্র বসু। তিনি আমাকে সিনিয়ার উকীল বাবু লালমোহন দাস সমীপে লইয়া গেলেন। লালমোহনবাবু বলিলেন এ যাত্রায় মোকদ্দমা উঠিবে না, ব্রিফ মুদ্রিত করিতে যে ব্যয় লাগিবে তাহা হাইকোর্টের ট্রেনস্‌লেটার বাবু ৮ হাজার বরাদ্দ করিয়াছেন; আপনি জুনীয়ার উকীল খ্যাতনামা জজ চন্দ্রমাধব ঘোষ মহাশয়ের মধ্যম পুত্র বাবু সতীশচন্দ্র ঘোষ নিকট গমন করেন, তিনি আপনাকে হাইকোর্টে লইয়া গিয়া কাগজপত্র আলোচনায় মুদ্রণ ব্যয় কত হইবে তাহা স্থির করিবেন। ৮ হাজার টাকা অত্যধিক বোধহয়। বলা বাহুল্য লালমোহনবাবু পরে হাইকোর্টের জনৈক বিচারপতীর পদে বরিত হইয়াছিলেন। আইনে তাঁহার পাণ্ডিত্য ডা: রাসবিহারী ঘোষের পরেই। ১৪টী অনুমাণ ৪-১/২ হস্ত উচ্চ ও ৩ হস্ত পরিসর বিশিষ্ট আল্‌মারীপূর্ণ আইনগ্রন্থ তাঁহার বৈঠকখানার প্রকোষ্ঠে সজ্জিত দেখিয়াছি। ইওরোপ ও এমেরিকা খণ্ডের যাবতীয় প্রদেশ বিশেষের আইন তাহাতে দৃষ্ট হইয়াছে। তিনি কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন পৃথিবীর সমস্ত দেশের আইন পাঠ না করিলে আইনজ্ঞ হওয়া যায় না। ধন্য তাঁহার মাথাকে, ধন্য তাঁহাকে। এতবড় বৃহৎ মোকদ্দমার ব্রিফাদি দিবানিশী ঘাঁটীয়া যে কোন্‌ সময়ে এই আইনগ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করিতেন তাহা আমার ধারণাতেই আসে না। কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছেন রাত্রি ১২টা পর্য্যন্ত মওক্কেলীয় কাজ করিয়াছেন। ৩টার সময় জাগিয়া কাজ করেন। শরীর কৃশ ছিল, কিন্তু মস্তকের আয়তন শরীরের অনুপাতে বৃহৎ ছিল। রাত্রির আহার এক ছটাক সরু চাইলের অন্ন ১ পোয়া দুগ্‌ধ ও ১টী কলা।
  • achintyarup | 59.93.242.180 | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৫০480389
  • এখানে আর একটা কথা মনে হইল। আমাদের ময়মনসিংহ বারের স্বনামধন্য প্রবীণ উকীল কালীশঙ্কর বাবু আমাদের এ মোকদ্দমায় আমাদের পক্ষে সিনিয়র উকীল ছিলেন। রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত মোকদ্দমার কাগজপত্র দেখাইয়া আমরা চলিয়া আসিয়াছি। পরদিন প্রাতে গিয়া পুন: হাজির হইয়াই দেখিয়াছি বৈঠকখানার ফরাশের পার্শ্বে ১ গাদা, বোধকরি ১৫/২০টা ভলিউমের কম নয়, আইনগ্রন্থ সজ্জিত আছে। আমাকে দেখিয়াই বলিয়াছেন, এসব বহী আজ এই মোকদ্দমায় ব্যবহার হইবে, একটা ঘোড়গাড়ী সহ ১০টায় আসিয়া কোর্টে লইয়া যাইবেন। আমি আশ্চর্য্য হইয়া বলিলাম; এ সকল বহী কোন্‌ সময় আপনি খুজিয়া বাহির করিলেন্‌, উত্তর করিলেন রাত্রিতে আপনিরা বাসায় গেলে পর এ সকল ঠিক করিয়া রাখিয়াছি, প্রাতে অবসর কোথায়? কেবল যে বহি বাহির করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন তাহা নহে, আইনের যে অংশপত্র বিচারককে দেখাইতে হইবে সেই পৃষ্ঠা পর্য্যন্ত ঠিক করিয়া চিহ্নাদি যূক্তে ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন। বড় উকীলদিগের শক্তি অসীম, মাথার বল কত! এই কালীশঙ্করবাবুরও শরীর কৃশ ছিল, রাত্রিতে দুগ্‌ধ ১ পোয়ার বেশী হজম হইত না নিজেই বলিয়াছেন; অমায়িকতা যে কত ছিল, পর প্রতিপালনে যে কিরূপ উদার ছিলেন তাহা বর্ণনীয় নহে। নিজে এক পোয়া দুগে্‌ধর বেশী পান করিতেন না, তথাপী বাসায় গাভী পালন করিয়া বোধহয় রোজ ৫/৭ সের দুগে্‌ধর ব্যবস্থা করিতেন, কেবল বাসার পোষ্যবর্গেরই জন্য। নিজে পরে বোধহয় বাসায় ২০/২৫ জন লোক প্রতিপালিত হইত।

    লালমোহনবাবুর উপদেশ মত সতীশবাবু উকীলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা মাত্রই তিনি নমস্কার দিয়া বলিলেন, আমাদিগকে বাঁচাইয়াছেন। ""আপনি case নিম্ন আদালতে পরিচালনা করিয়া সর্ব্ব বিষয় জ্ঞাত আছেন। ৮ হাজার টাকার ব্রিফ মুদ্রণের খরচ অসম্ভব বোধহয়, আপনি ট্রেনস্‌লেটার বাবুর সহিত দেখা করিয়া কাগজপত্র ঠিক করিয়া দিবেন যাহাতে ছাপা খরচটা কমিয়া যায়। ১০টার সময় হাইকোর্টে যাইবেন, আমিও তথায় থাকিব, তখন নথীটা দেখিতে হইবে।''

    অত:পর আমাকে তাঁহার বাড়ীতে থাকার ও খাওয়া দাওয়ার ভার গ্রহণের প্রস্তাব করিলেন, আমি বলিলাম এ যাত্রায় মোক্তারবাবুর বাড়ীতেই উঠিয়াছি, তথায়ই সুবিধা হইয়াছে, ইহার পর যদি আসিতে হয় তবে সে কথা হইবে।

    ১০টার সময় ট্রামওয়ের গাড়ীতে চড়িয়া প্রকাশ ও প্যারী সহ হাইকোর্টে গেলাম। সতীশবাবু সহ ট্রেনস্‌লেটার বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। নথীর কাগজপত্রের আলোচনা আরম্ভ হইল। প্রায় একমাস কাল এই কার্য্যে অতীত হইল। তৎপর কাগজ বাছই শেষ করিয়া খরচের হিসাব করিলে দেখা গেল ব্রিফ মুদ্রণের খরচ ৫ হাজারে নামিয়াছে। যাহা হউক আমার মাসৈক কাল পরিশ্রমে যে ষ্টেটের ৩ হাজার মুদ্রা বাঁচিয়া গেল ইহাই যথেষ্ট মনে করিয়া দিঘাপাতীয়া রাজধানীতে সংবাদ প্রদানোত্তর, লালমোহন ও সতীশবাবু নিকট বিদায় লইয়া ময়মনসিংহ ফিরিবার উদ্যোগী হইলাম। উভয়েই সাগ্রহে বলিলেন, মোকদ্দমা বোর্ডে উঠিলে আপনাকে টেলীগ্রামে সংবাদ দিব, আসিতে যেন ত্রুটী না হয়। এ যাত্রার পালা শেষ হইল।

    অত:পর বহুদিন পর মোকদ্দমার বিচারের তারিখ ধার্য্য হইলে টেলীগ্রাম আসিল। এবার চাকর প্যারীকে মাত্র সঙ্গে লইয়া কলিকাতা গেলাম। প্রকাশ বাসায় ময়মনসিংহে রহিল। এ যাত্রায়ও কলিকাতায় ১টী মাস কাল কাটীল, কিন্তু মোকদ্দমার বিচার কার্য্য আরম্ভ হইয়াও শুননী পড়িল। মোকদ্দমায় জেলা, পরগণা ও নদীসংক্রান্ত প্রায় ৬০ খানা ম্যাপ ব্যবহার হইয়াছিল। বিচারপতীগণ বলিলেন, এই সকল ম্যাপকে একটা না করিলে কাজের অসুবিধা, উভয় পক্ষের খরচে তাহা হইবে, এক মাস পরে তারিখ ধার্য্য হইল। ১৭০০ শত টাকা ব্যয়ে সার্ভে জেনারেল্‌ আফিস যোগে কন্‌ছলীডেটেড্‌ ম্যাপ তৈয়ারী হইয়া আসিল। মাসেক কাল অন্তে ময়মনসিংহ বাসায় ফিরিলাম।

    পুন: বিচারের দিনের অব্যবহিত পূর্ব্বে তারে সংবাদ আসিল, প্যারীকে লইয়া যথাকালে রোয়ানা হইয়া গেলাম। এবার বিচার আরম্ভ হইল। ১২০০ শত পৃষ্ঠার ব্রিফ্‌ অর্থাৎ মোকদ্দামার নথী সংক্রান্ত সমস্ত কাগজের মুদ্রিত বহী এবং ১২ হাত দীর্ঘ ৫/৬ হাত পরিসরের ম্যাপ এক২ খণ্ড আমি পাইলাম, তাহা দৃষ্টে লালমোহনবাবুর সঙ্গে থাকিয়া মোকদ্দমা পরিচালন করিতে হইবে। বলা বহুল্য, ব্রিফ্‌ ও ম্যাপ সবই ব্রীটনীয় ভাষায় মুদ্রিত। আমার ইংরাজী ভাষায় জ্ঞান যেটুকু আছে তাহা দ্বারা নিম্ন আদালতে মোকদ্দমা পরিচালনে কোন দিনই কষ্ট হয় নাই। সব সওয়াল জবাব ও বক্তৃতাদি বুঝিয়া এবং রায় ইত্যাদি কাগজপত্র পাঠ করিয়া কাজ অনায়াসে কর্ম্মজীবনে চালাইয়াছি, কেহই বুঝিতে পারে নাই যে আমি ইংরাজী ভাষা ভাল বুঝিনা। কিন্তু হাইকোর্টে গিয়া মহাভারত সদৃশ ১২০০ শত পৃষ্ঠার ছাপান বহী দেখিয়া কাজ করিতে ভয় হইতে লাগিল; বিশেষত: এত বড় ইংরাজী ভাষাবিদ্‌ উকীল ও জজ সাহেবগণ সমক্ষে কাজ করা যেন আমার পক্ষে অসম সাহসীকতার ন্যায় প্রতীতি হইতে লাগিল। যদি কোন কথা না বুঝি, ধমক খাইব কি আহাম্মক সাজিব, এই অপমানের বিষয়ও মনে চিন্তাস্রোত প্রবাহিত করিল। যাহা হউক বাগ্‌দেবীর কৃপা ভরষা করিয়া, রাত্র দিবা ব্রিফ্‌টা দেখিয়া২ বাঙ্গলাতে নোট তৈয়ার করিলাম ও তাহা মুখস্থ করিয়া ফেলীলাম। ম্যাপ্‌টা বিশেষ করিয়া স্থানগুলীর পরিচয় ও চিহ্নাদি করিলাম। এইরূপে কাজে প্রবর্ত্ত হইলাম।

    এ যাত্রায় আর বীডন্‌ স্কোয়ারে অবিনাশবাবু মোক্তারের বাসায় যাই নাই, ভবানীপুরে সতীশবাবুদের বাটীর সন্মুখস্থ কাছারীবাটীর এক কামরা দখল করিয়া নিরাপদে রহিলাম। সতীশবাবুদের আত্মীয়স্বগণ প্রভৃতি লোকের যে মেছ্‌ আছে সেই মেছে খাওয়ার বন্দবস্থ হইল। সতীশবাবুর ইচ্ছা যে খাওয়ার খরচটা তিনি দিবেন, আমি প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম রাজ সরকার হইতে দৈনীক ১।।০ টাকা হিসাবে খোরাকী খরচ পাইব, তাহার বিল দিতে হইবে, আপনারটা খাইতে পারি না। তিনি কিছু অসন্তুষ্ট হইয়াই যেন নীরব রহিলেন। ভবানীপুর বাসের পক্ষে সুখের স্থান, খাস কলিকাতা অপেক্ষা স্বাস্থ্য ও খাওয়া দাওয়া সর্ব্ব বিষয়েই সুবিধাজনক, বড়২ বাঙ্গালীগণ অধিকাংশেরই ভবানীপুরে বাড়ী।ঁ কালীমন্দির নিকট, কাটাগঙ্গা নিকট, দর্শনে ও স্নানাদিতে কোন অসুবিধা দৃষ্ট হয় নাই। প্রাতে ৮টায় গঙ্গাস্নানাদি করিয়া জলযোগান্তে প্রত্যহ লালমোহনবাবুর বাড়ী গিয়াছি। চন্দ্রমাধববাবুর বাড়ী হইতে, ভবানীপুর মধ্যেই লালমোহনবাবুর লক্ষ টাকা মূল্যের চৌতালা সুরম্য অট্টালীকাদিবিশিষ্ট বাড়ী, ১০ মিনিটের রাস্থা, ট্রামওয়ের পার্শ্বেই এবং সেখানে নামিবার ব্যবস্থাও আছে। ১০টার সময় লালমোহনবাবুর বাটী হইতে তাড়াতাড়ী আসিয়া, মেছে আহার করত: দ্রুতপদে গিয়া ট্রামওয়ের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছি। দিগ্‌বিদিগ্‌ জ্ঞান না করিয়া যাবার বেলায় ১ম শ্রেণীর গাড়ীতে লাফ্‌ দিয়া উঠিয়া সাহেব সুবোদের সঙ্গে বসিতে ভয় করি নাই। প্যারী অর্দ্ধমোন কি পনর সের ওজনের কাগজের বস্থা লইয়া প্রায়ই দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রামগাড়ীর পিছনে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। আসিবার কালে কোন ভিড় হয় নাই, দুজনেই ধীরে সুস্থে ২য় শ্রেণী অধিকার করিয়া প্রায়ই নিরাপদে বাসায় ফিরিয়াছি।

    ঐ যাতায়াত কালে আমার পদদ্বয়ে বাতের বেদনাদি থাকায় ট্রাম গাড়ীতে উঠা নামা ও হাইকোর্টে তৃতল-চৌতলের উপরে উঠা ও নামা যে কি ভয়ানক কষ্টকর ছিল তাহা বর্ণনীয় নহে। কি করিব? কর্ত্তব্যকে অবহেলা করিলে চলিবে না। অবশ্যই টাকাও প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হইয়াছি কিন্তু এখানে টাকা অপেক্ষা কর্ত্তব্য ও দায়ীত্বকে বড় জ্ঞান করিয়া চলিয়াছি। পা কাঁপিত, তথাপী তাহাতে কাতর হইয়া বসিয়া থাকি নাই; একটা কি যেন স্ফূর্ত্তি আমার মনের মধ্যে খেলীত, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিনা। সামান্য বিদ্যাবুদ্ধি লইয়া যে বৃহৎ কাজে হাত দিয়াছি, কেবল ইহাই চিন্তা করিয়া জগদীশ্বর নিকট বল প্রার্থনা করিতাম। তাঁহার কৃপায় যেন কোন অসুবিধাই ঘটীল না।

    লালমোহনবাবুর সহিত এ যাত্রার সাক্ষাতের ১ম দিনেই তিনি বলিয়াছিলেন, ""আপনার ব্রিফ ও ম্যাপ্‌ লইয়া যাউন। আমি ঘরে কি বক্তৃতাকালে জজ বাহাদূরদিগের এজলাসে যখন যে কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব তৎক্ষণাৎ তাহার উত্তর দিবেন। এত বড় ১২০০ শত পৃষ্ঠার বহী মুখস্থ করিয়া কাজ করা যায় না। যে দুইজন জুনীয়ার আছেন তাহারা ধামাধরা, কেবল দৈনীক হারে ১০০্‌ টাকা ফিই তাহারা "ড্র' করিবে, কাজের বেলায় চক্ষু বুজিবে। এজন্যই নিম্ন আদালতের কার্য্য পরিচালনা করিয়া এই মোকদ্দমায় আপনার বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে বলিয়া আমার সাহায্যার্থে আপনাকে আনাইয়াছি। আপনি আমার দক্ষিণ হস্তস্বরূপ কি ঘরে কি কোর্টে আমার সাহায্য করিবেন। আমি ১০ পৃষ্ঠা ব্রিফ্‌ পাঠ করিয়া যে কথা বাহির করিব, আপনি প্রশ্নমাত্র সে কথা বলিয়া ফেলীবেন, ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও ভরষা। এই প্রকাণ্ড ম্যাপে কোথায় কি আছে দেখিয়া রাখিবেন, কোর্টে বক্তৃতাকালে বিচারপতীগণকে দেখাইতে হইবে। তখন যেন কোন বিষয়ে ইত:স্তত: বা অক্ষমতা প্রকাশ না হয়।''
  • achintyarup | 59.93.241.91 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৫৪480390
  • বলা বাহুল্য জুনীয়ার উকীলবাবুগণ আমাকে নমস্কার দিয়াই বাঁচিয়া গেলেন। লালমোহনবাবুর ধমকের ভয় হইতে অব্যাহতি পাইলেন। নিরাপদে আমার পার্শ্বে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া বক্তৃতা শুনিয়াই দৈনীক শত মুদ্রা অক্লেশে আত্মসাৎ করিতে কুণ্ঠিত হইলেন না। যাহা হউক মোকদ্দমা পরিচালনের ভার লালমোহনবাবু ও আমি গ্রহণ করিলাম। লালমোহনবাবু আমাকে আর একটা কথা বলিয়া দিয়াছিলেন, ""আপনি নি:সঙ্কোচে আমার ভূল ত্রুটী সংশোধন করিবেন''। এই কথায় আমার সাহস দ্বিগুণ বাড়িল।

    হাইকোর্টের বিচারাগার যাহারা দেখিয়াছেন তাহারা অবশ্যই জ্ঞাত আছেন, বিচারপতীগণের এজ্‌লাসের সন্মুখে বেড়া স্বরূপ রেলীং এর্‌ পর পর রেলীং; ৩টা কি ৪টা এরূপ রেলীং পার হইয়া এজলাসের নিকটবর্ত্তী হইতে হয়। বিচারের ১ম দিবসে, আমি কাগজপত্র লইয়া উকীল ও বারিষ্টারদিগের পশ্চাতে যে রেলীং আছে তাহার পশ্চাতে গিয়া রহিয়াছি। লালমোহনবাবু এজলাসে দাঁড়াইয়া পিছন ফিরিয়া ডাকিলেন, গগনবাবু কোথায়? আমি দূর হইতে বলিলাম, এখানে আছি। লালমোহন তখনই বিচারকদিগকে বলিলেন আমার মওক্কেলের এজেণ্ট যদি আমার নিকটে না থাকেন তবে আমার urguing করা দুষ্কর। তাঁহাকে আমার পার্শ্বে আনিতে হইবে। জজ বাহাদূরগণ yes বলিয়া সম্মতি দিলে তিনি আমাকে ডাকিলেন ভিতরে আসুন্‌। তখন তাঁহার পাশে যে সকল উকীল বারিষ্টার আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা সরিয়া যাইতে লাগিলেন, আমি ভিতরে প্রবেশ পূর্ব্বক লালমোহনবাবুর পাশের আসন দখল করিলাম, জুনিয়ার উকীলদ্বয় তৎপরবর্ত্তী আসন গ্রহণ করিলেন। আমার মনে তখন একটা কি স্ফূর্ত্তির ভাব হইয়াছিল তাহা এখন আর প্রকাশ করিতে পারিতেছি না। এই সন্মানে আমার সাহস আরো বাড়িয়া গেল। যখন যে কথা বলা আবশ্যক তৎক্ষণাৎই লালমোহনবাবুকে বলিয়া দিতে লাগিলাম। এই দিনের প্রাথমিক বক্তৃতা ৩টা পর্য্যন্ত চলিল, তৎপর জলযোগের ঘণ্টা পড়িলে সকলই বাহিরে আসিলাম। লালমোহনবাবু বলিলেন জলখাবার খাইয়া আসুন। অনেক কথা আছে। নিম্নতলে সুরসাল পরিস্কৃত ভোজ্য পানীয় উদরস্থ করিলাম। বলা বাহুল্য যে মধ্যাহ্ন আহারটা রীতিমত চর্ব্বণ করিয়া গলাধ:করণ হইতে পারে নাই। ১১টায় হাইকোর্টে হাজির হওয়ার তাড়াতাড়ী, ট্রামে উঠার হুড়াহুড়ি প্রভৃতি ব্যস্ততা জন্য উর্দ্ধ গ্রাসে অর্দ্ধচর্ব্বণে কথঞ্চিৎ খাদ্য ও পানীয় উদরস্থ করিয়াই দৌড়িতাম। কোন দিন যদি আমার কোর্টে উপস্থিত হইতে গৌণ হইত লালমোহনবাবু অন্ধকার দেখিতেন ও আমি ধমক খাইতাম : জুনীয়ার উকীলবাবুগণ তিরস্কৃত হইতেন। নিম্নতলে উপরতলে যেন আমার অপেক্ষায় ডাক বসিয়া যাইত।

    জলযোগের পর লালমোহনবাবু কোন্‌ পয়েণ্টে আগে আরম্ভ করিবেন তাহারই আলোচনা করিলেন ও প্রস্তুত হইয়া রহিলেন, যথাসময়ে বিচারকদ্বয় আসন গ্রহণ করিলে আমরা যথাস্থানে আসনে উপবিষ্ট হইলাম। সুযুক্তি পুর্ণ সুমধুর প্রাঞ্জল ভাষায় লালমোহনবাবু যখন বলিতে আরম্ভ করিলেন, শ্রুতৃবৃন্দ যেন মন্ত্রমুগ্‌ধবৎ তাহা শ্রবণ করিতে লাগিল। এরূপ জাবেদা মোকদ্দমা সংক্রান্ত সুবৃহৎ ব্যাপার হাইকোর্টেও অল্পই দৃষ্ট হয়, এজন্য হাইকোর্টের উকীল বারিষ্টার অনেকেই আগ্রহ করিয়া লালমোহনবাবুর আর্‌গু শ্রবণ করিবার অভিলাষে এজলাস পূর্ণ করিয়া বসিয়া গিয়াছেন। লালমোহনবাবুর বক্তৃতায় বিচারমণ্ডপ যেন মুখরিত হইল। নি:শব্দে সকলে শ্রবণ করিতে উৎকর্ণ হইয়া রহিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্‌কাল পর্য্যন্ত বক্তৃতা চলিল, অত:পর দিবসের ১১টায় আরম্ভ হওয়ার আদেশান্তে বিচারকদ্বয় মোকদ্দমা স্থগিত করিয়া বিচারাসন পরিত্যাগ করিলেন। আমরা বাহির হইলাম। লালমোহনবাবু আমাকে বলিলেন বাসায় গিয়াই আমার ওখানে যাইবেন। আমরা ২য় শ্রেণীর ট্রামে চড়িয়া বাসায় গেলাম।

    বাসায় গিয়া বিশ্রামান্তে লালমোহনবাবুর বাড়ী গিয়া রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত কাগজপত্র সংযোগে মোকদ্দমার আলোচনাদি করিয়া বাসায় ফিরিতাম।

    এরূপে ১২ দিন মোকদ্দমার সওয়াল জবাব হইল। ৭ দিন আমাদের ও ৫ দিন অপর পক্ষের। শেষ দিনে দেখা গেল বিচারক চন্দ্রমাধববাবু যিনী সেই দিনেই চিপ্‌ জষ্টিসের পদপ্রাপ্তে চিপ্‌ বেঞ্ছে বসিয়াই আমাদের বিচার করিলেন, তিনি যেন আমাদের বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন। লালমোহনবাবু রিপ্লাই দিতে গিয়া তাহার মত পরিবর্ত্তণ জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করিলেন। অবশেষে কৃতকার্য্য হইয়া শেষ ঘণ্টায় এজলাস্‌ হইতে বাহির হইয়াই আমার পৃষ্ঠে চাপড় দিতে২ বলিলেন গগনবাবু আর ভয় নাই -- ""বুড় বেটাকে পাক্‌ড়াইয়াছি'', অর্থাৎ চন্দ্রমাধববাবু সিনিয়ার বৃদ্ধ বয়স্ক বিচারক তাঁহার মত আমাদের পক্ষেই দেখা যায়। অত:পর লালমোহনবাবু প্রফুল্লচিত্তে আমার সহিত বিচারগৃহের বারান্দায় বসিয়া আলাপাদি ও বিশ্রাম করিলেন। ১২ দিন ব্যাপী সওয়াল জবাব হাইকোর্টেও অল্পসংখ্যক মোকদ্দমায়ই দেখা যায়। অনেকে আমাদের প্রতি বিরক্তিভাব দেখাইল, যেহেতু আমাদের এক মোকদ্দমার জন্য তাহাদের বহু মোকদ্দমা মুলতবী, আবার অনেকে আমাকে নানা প্রকার সন্মানসূচক আদর সম্ভাষণও করিলেন।

    অত:পর সেখানেই আমি লালমোহনবাবুকে বলিলাম, অদ্য রাত্রির ট্রেইনেই দেশে ফিরিতে চাই। তিনি বলিলেন আর ময়মনসিংহে গিয়া কাজ কি? এখানে মোক্তারী আরম্ভ করিয়া দেন। আমি বলিলাম অর্দ্ধেক বয়স গত হইয়াছে। এখন কি আর নূতনত্ব সাজে? প্রথম বয়সে হইলেও কতকটা সম্ভবপর ছিল। ইহা যে মহাসমুদ্র আমার ন্যায় ক্ষুদ্র জলবিম্ব কি এখানে মাথা তুলিতে পারিবে? তিনি হাসিতে২ বলিলেন খুব২! কেন পারিবেন না? মোকদ্দমা পরিচালনের যে কায়দা, অধ্যবসায় ও যত্ন আপনার আছে তাহা অল্প লোকেই দৃষ্ট হয়। অবশ্যই এখানে প্রসার হইবে। আমরা কি আপনার সাহায্য কল্পে যতদূর হইতে পারে করিব না? আমি তাহাকে ধন্যবাদ দিয়া বলিলাম, এ আশা ত করিতেই পারি। আপনার অনুগ্রহে কি না হইতে পারে? তবে কিনা ময়মনসিংহে যে প্রসার আমার আছে, তাহাও অবহেলার যোগ্য নহে। তাহার ফলেই লোকসমাজে পরিচিত হইয়া আছি, আর তাহা না থাকিলে রাজাবাহাদূরও আমাকে চিনিতেন না। তাহা ছাড়িতে গেলে নানা বিষয়ে অকস্মাৎ গোল উপস্থিত হইবে, ছাড়া দুষ্কর। তিনিও তাহা বুঝিতে পারিয়া সায় দিলেন। তৎপর তাঁহার নিকট সেখানেই বিদায় চাহিলে বলিলেন, আজ নয় কাল সন্ধ্যা ট্রেইনে যাইবেন। দুপ্রহরেঁ মায়ের বাড়ীতে ডালা দিয়া, পুজা দিয়া তবে যাইতে হয়। মোকদ্দমার জয় পরাজয় মায়ের হাতে। অত:পর সকলই সেদিন বাসায় ফিরিলাম।

    ট্রামে বসিয়া ভাবিলাম, হাইকোর্টের এত বড় উকীল ২ দিন পর জজ হইবে। বলা বাহুল্য যে সে সময়েই হাইকোর্টে রাষ্ট স্পষ্ট হইয়াছিল যে দিগম্বর মিত্র পেন্‌সন্‌ গ্রহণ করিলেই লালমোহনবাবুর chance. এ হেন লোকটা যে গোঁড়া হিন্দু মতে চলে অতি আশ্চর্য্যের বিষয়ই বলিতে হইবে। শুনিয়াছি প্রাতে ৮ট পর্য্যন্ত মালা জপ করেন। গঙ্গাস্নান করেন। বোধহয় নিরামিষ ভোজী। মনে২ খুব শ্রদ্ধা ভক্তি হইল। সুরী কুল পবিত্রকারী ঢাকা বিভাগের গৌরব বলিয়া মনে২ শত ধন্যবাদ দিলাম।

    বাসায় বিশ্রামান্তে সতীশবাবু উকীলের সহ সাক্ষাৎ করিলাম ও বিদায় প্রার্থনা করিলে তিনি বলিলেন রাজা প্রমদানাথ আমার বন্ধু ব্যক্তি; কলিকাতায় আগমন কালে তাঁহাকে আপনার অধ্যবসায় ও কার্য্যকুশলতার পরিচয় দিব। আপনি না আসিলে এ মোকদ্দমায় এমন সুপরিচালীতভাবে কখনই সওয়াল জবাব হইত না। ধন্য আপনার অধ্যবসায় ও ধৈর্য্যকে। আপনি যেরূপ ধৈর্য্য সহকারে লালমোহনবাবু সহ অক্লান্ত পরিশ্রমে পুঙ্কানুপুঙ্করূপে সমস্ত আলোচনা করিয়া কার্য্য করিয়াছেন আপনার অনুপস্থিতিতে অসম্ভব হইত। আমরা কখনই এই মহাভারত সদৃশ ব্রিফ পাঠে তাহা বুঝিতে ও বুঝাইতে পারিতাম না। আপনি Lower court এ ও High court-এ অশেষ অধ্যবসায় ও যত্ন সহকারে কাজ করিয়াছেন। এখন ফল ভগবানের হাতে। সুফল হইলেই আপনার পরিশ্রম সার্থক হয়।

    এইরূপ আলাপাদির পর তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। তৎপর দিবসঁ কালীমন্দিরে ডালা ও পুজাদি দিয়া, চেতলায় ভগ্নির বাড়ীতে মধ্যহ্ন আহার সমাপনে বাসায় ফিরিলাম। সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই ট্রামে চড়িয়া সিয়ালদহ রেল স্টেশনে গেলাম। ময়মনসিংহের টিকেট লইয়া গাড়িতে চড়িলাম। দীর্ঘ দিন পর নিজ বাসায় ফিরিয়া যেন হাপ্‌ ছাড়িলাম। বন্ধুবান্ধবগণ সহ দুই এক দিন হাইকোর্টের বিচারপ্রসঙ্গে আলাপ আলোচনাদির ত্রুটী হইল না।
  • achintyarup | 59.93.246.83 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৪:৪৭480391
  • এই মোকদ্দমা পরিচালনে যে দক্ষতা ও কৃতীত্বের পরিচয় দিয়াছিলাম জীবনে আর এমন শুভযোগ কখনও উপস্থিত হয় নাই। এটী আমার জীবন সংগ্রামের একটী বিশেষ স্মরণীয় ও বরণীয় ঘটনা। জীবনে কর্ম্মশক্তির পরিচয় প্রদানের অনুকুল ক্ষেত্র পাইলেই শক্তি প্রকাশিত হয়। যাহা হউক, হাইকোর্টে ও নগুয়ার কোর্টে যে সন্মান প্রাপ্ত হইয়াছি, তাহা আমার ন্যায় বিদ্যাবুদ্ধি ও শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে যথেষ্ট। মোক্তারী ব্যবসায়ে অল্প লোকেই এরূপ যশোভাজন হয়। ইহা অহঙ্কার বা আত্মশ্লাঘার কথা নহে। হাইকোর্টে ময়মনসিংহস্ত অপর পক্ষের (বাদীগণের পক্ষের) মোক্তারকে দেখিয়াছি বিচারকালে আমাদের পশ্চাতে বহুদূরে মওক্কেলীয় আসনে বসিয়া রহিয়াছেন। কখন জজ বাহাদূরগণের এজ্‌লাস্‌ সমক্ষে উপস্থিত হইয়া উকীলবাবুকে সাহায্য করিতে দেখি নাই।

    যাহা হউক ন্যূনাধিক ১৫ দিবস পর সংবাদ আসিল হাইকোর্টে আমরা মোকদ্দমা জয়ী হইয়াছি। এই মোকদ্দমায় যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়াছিলাম রাজা বাহাদূর তাহার পুরস্কার প্রদানে ত্রুটী করেন নাই। মোকদ্দমা জয়ী হওয়ার বাবদ ২০০ শত টাকা এককালীন পুরস্কার দিয়াছিলেন। রাজা বাহাদূরের ষ্টেটে আমি মাসিক নিয়মিত যে বেতন পাইতে ছিলাম তদতিরিক্ত মাসিক ১৫০ একশত পঞ্চাশ টাকা হারে নিম্ন আদালতে ৩ মাস কাল ও হাইকোর্টে ৩ মাস কাল বেতন পাইয়াছি। হাইকোর্টে থাকা কালে দৈনীক ১।।০ টাকা হিসাবে আহার ব্যয় বাবদে পাইয়াছিলাম। তদতিরিক্ত উকীলবাবুগণকে যে ফি: দিয়াছিলাম সেই ফি: ৬ ছয় হাজার টাকাতে শতকরা ২০্‌ কুড়ি টাকা হারে ফি:ও পাইয়াছিলাম। ঐ ফি: বেআইনী নহে, ষ্টেটের মঞ্জুরীমতেই উকীলবাবুগণ শতকরা ৮০্‌ টাকা ও আমি মোক্তার ফি: বাবদ ২০্‌ টাকা পাইয়াছিলাম। তৎপরও আমার সাহায্যকারীরূপে অন্য একজন মোক্তারের বেতন ৩ মাস কাল দৈনীক ৫্‌ টাকা অর্থাৎ মাসিক দেড়শত টাকা হারে দিয়াছিলেন। এ হেন সৌভাগ্য আমার ন্যায় ক্ষুদ্র লোকের জীবনে কমই ঘটে। ময়মনসিংহ মোক্তার বারের অনেকেই বলাবলী করিয়াছেন গগন রায় এক মোকদ্দমায়ই বড় মানুষ। তাহা অসত্য বলা যায় না।

    এই উপলক্ষে আর একটা কথা বলিয়া যাই -- ময়মনসিংহ জজ আদালতের উকীলবারে আমার যে সকল উকীলবাবুগণ সহ মোক্তারী কর্ম্মক্ষেত্রে মোকদ্দমাদি আদানপ্রদান সম্পর্ক ছিল তন্মধ্যে বাবু কালীশঙ্কর গুহ, জাদবচন্দ্র ঘোষ, শ্যামাচরণ রায়, বাণেশ্বর পত্রনবিস, অভয়চন্দ্র দত্ত, মহেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ মজুমদার, অনাথবন্ধু গুহ, দীননাথ চৌধুরী, সতীশচন্দ্র রায় ডি: এল, ক্ষিতিশচন্দ্র রায়, রেবতীমোহন গুহ, হরিমোহন রায়, মহিমচন্দ্র রায়, প্রসন্নকুমার গুহ, কামিনীকমল সেন ও সরকারী উকীলবাবু সারদাচরণ ঘোষ প্রভৃতি সিনিয়ার ও প্রথিতনামা এবং গুণে জ্ঞানে ও মোকদ্দমা পরিচালনে সুদক্ষ মহারথীস্বরূপ মণিষীগণের অনুগামী হইয়াই আমি কার্য্য করিয়াছি। এই সকল মণিষীগণকে কখনও আমাকে কোন বিষয়ে অসন্তুষ্ট হইতে দেখি নাই। আইন ফি: ১৫্‌ টাকা স্থানে সর্ব্বদাই উকীলবাবুগণ ২০্‌ টাকা হারে প্রদান করিয়াছেন। এই বারের ইহাই নিয়ম। কেহ২ এমনও সদ্‌ব্যবহার করিয়াছেন যে, ফি:র টাকা সাকল্য আমার অসাক্ষাতে কোনও মক্কেল তাঁহাকে বুঝাইয়া দিয়া গেলেও আমার প্রাপ্য ফি: হয় আমার বাসায় পাঠাইয়া দিয়াছেন অথবা কোর্টে গিয়া আমাকে সাক্ষাৎ কালেই দিয়াছেন। এই সকল ধুরন্ধর আইনজ্ঞগণের সংশ্রবে সুদীর্ঘ ৩৫ পয়ত্রিশ বৎসর কাল আমি মোক্তারী কার্য্যে বহু বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি। তাহাতে আমার কর্ম্মজীবনে আত্মপ্রসাদ ভিন্ন আত্মগ্লানী ঘটে নাই।
  • achintyarup | 59.93.246.83 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৩৪480392
  • মোক্তারী কার্য্যকালে যে সকল ব্যয় ও আয়াস
    সাধ্য কার্য্য সম্পাদন করিয়াছি।

    যদিও আমি সুদীর্ঘ ৩৫ বৎসর কাল সসন্মানে মোক্তারী করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছি, কিন্তু আমার সমশ্রেণীর অন্যান্য খ্যাতনামা মোক্তার মহাশয়দিগের ন্যায় বিত্তশালী হইতে পারি নাই। তাহার কারণ টাকা আমার হাত দিয়া অধিক খরচ হয় নাই। উপার্জ্জনের টাকা বাড়ীতে দিয়াছি। বাড়ীর কর্ম্ম পরিচালকগণ মিতব্যয়ী হইলে বোধহয় আরও উন্নতী হইতে পারিত। যাহা হউক কুষ্ঠির ফলে যখন দৃষ্ট হয় ব্যয় স্থলে শনিগ্রহ অবস্থান করিতেছেন তখন সে বিষয়ে মন:ক্ষুণ্নতা পরিত্যাগ করাই শ্রেয় বিবেচনায় অনিত্য অর্থের জন্য ব্যতীত হইব কেন?

    কর্ম্মজীবনের উন্নতী সময়ে যে সকল ব্যয় ও দু:সাধ্য কার্য্য করিয়াছি তাহার পরিচয় এ গ্রন্থে থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যত বংশীয়গণ তদ্দৃষ্টে বুঝিতে পারিবে তাহাদের কল্যাণকল্পেও কিছু করা হইয়াছে।

    ১। মোক্তারী পরীক্ষার বহু পূর্ব্ববর্ত্তী পাঠ্য জীবনে থাকা কালেই আমার গ্রন্থ অধ্যয়ন স্পৃহা বলবতী হয়। অর্থের অভাবে সে সময়ে মনের বাসনা পূর্ণ না হওয়ায় মনেই বিলুপ্ত থাকে। কদাচিত কখনও অপরের গ্রন্থ পাইলে পাঠ করিয়া তৃপ্তি লাভ করিয়াছি। মোক্তারীর উপার্জ্জনের ১ম উদ্যমেই সে বাসনা জাগরূক হইলে, বহু পত্রিকা মাসিক ও সাপ্তাহিকার গ্রাহক হইলাম। তাহা ছাড়া বহু সদ্‌গ্রন্থও ক্রয় করিতে লাগিলাম। পাঠ্যজীবনে ছিল নাটক নভেল পাঠেই বেশী পরিতৃপ্তি, কিন্তু ধর্ম্মগ্রন্থ পাইলেও ছাড়িতাম না; এখন কেবল ধর্ম্মগ্রন্থের ও কার্য্যকরি জ্ঞান লাভের গ্রন্থাধ্যয়ন পীপাসাই যেন বলবতী হইল। ক্রমে ৫/৬ শত টাকার বহী খরিদ করিয়া ফেলীলাম। রাত্রিতে মওক্কেলীয় কার্য্য অন্তে আহারের পর ১২/১টা পর্য্যন্ত কোনদিন পাঠ চলিত, অবসর পাইলেই পত্রিকা কি গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া থাকিতাম। এখনও সে স্পৃহা আছে। সে অন্য রকমে দাঁড়াইয়াছে। সে স্পৃহা পূরণও হইতেছে। একটী ক্ষুদ্র লাইব্রেরী হইল। বাসার আশেপাশের লোকেও পাঠাদি করিয়া তৃপ্তি লাভ করিতেন। ৩৫ বৎসরকাল এই গ্রন্থগুলী আমার সঙ্গী থাকিয়া আমার ধর্ম্মজীবন নিয়মিত করিয়াছিল বলিয়াই এ বৃন্দাবনরূপ গোলোকধামের অধিবাসী হইতে পারিয়াছি। ৫/৬ শত ব্যয় সার্থক হইয়াছে মনে করি।

    কর্ম্মজীবনের শেষভাগে মোক্তার লাইব্রেরীতে (স্প্রাই বার রে: এ: গণের) ৬০্‌ টাকা আন্দাজ মূল্যের ও প্রথিতনামা ময়মনসিংহের গৌরব, বহু গ্রন্থ লেখক, কর্ম্মবীর, সাহিত্যসেবীশ্রেষ্ঠ, বিদ্যাভূষণাদি উপাধি ভূষিত, পণ্ডিতাগ্রগণ্য, ""সৌরভ'' মাসিক পত্রিকার সম্পাদক বাবু কেদারনাথ মজুমদার মহাশয়ের লাইব্রেরীতে ২০ খণ্ড সদ্‌গ্রন্থ ও আমার মহুরের শ্রীমান্‌ প্রকাশচন্দ্র করকে তাহার শিক্ষা উপযোগী ১০/১২ খানা মূল্যবান গ্রন্থ দান করণান্তর অবশীষ্ট কেবল ধর্ম্মজীবনের সঙ্গী বহীগুলী বাড়িতে রাখিয়াছি। ভগবদগীতা, মোহমোদ্‌গর প্রভৃতি কয়েকখানা আমার সঙ্গেও আছে। গীতা নিত্য পাঠ্য; তাহা ছাড়া থাকা যায় না। এই ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটী আমার প্রাণাপেক্ষা প্রিয় ছিল।
  • achintyarup | 59.93.241.39 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৪৭480393
  • ২। আমার উন্নতীর সময়ে ময়মনসিংহে আমার বাসায় বিদ্যা শিক্ষার্থী ছেলের মধ্যে আমার সম্পর্কীত ছাত্র ছাড়াও নি:সম্পর্কিত অনেক ছাত্রকে আমি যথাসাধ্য সাহায্য প্রদানে স্থান দিয়াছি ও তাহাদের যত্ন লইয়াছি। তাহাদের সকলের পরিচয় প্রদান এখন অসম্ভব। যতদূর মনে আছে লিখিতেছি। এই সম্পর্কীত ও নি:সম্পর্কীত ছেলেদের শিক্ষাব্যয় আমার মনে হয় অন্যূন ১০ হাজার টাকার কম হয় নাই। নি:সম্পর্কীত ছেলের মধ্যে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, নরেন্দ্রকৃষ্ণ ও দেবেন্দ্রকৃষ্ণ মহলানবীশ, উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, দেবেন্দ্রচন্দ্র ধর ও দেবেন্দ্রচন্দ্র সাধ্য। তন্মধ্যে যোগেশ তাহার কৃতীত্বগুণে হাইকোর্টের ওকালতী পাস করিয়া পরে ডিপুটী মাজিস্ট্রেট হইয়াছিল। এখন কোথায় কোন্‌ পদে আছে অবগত নহি। অন্যদের মধ্যে নরেন্দ্র মোক্তারী পরীক্ষা দিয়াছিল ও দেবেন্দ্রচন্দ্র ধর ওভারসিয়ার হইয়াছিল শুনিয়াছি।

    সম্পর্কীত ছেলেদের মধ্যে আমার পুত্র সতীশ, আমার জামাতা চতুষ্টয়, এবং শ্যালক, ভ্রাতষ্পুত্রদ্বয়, অরুণচন্দ্র দাস, ভাগিনেয়ীপুত্র সতীশ ইহারা সকলেই আমার প্রদত্ত সর্ব্ববিধ ব্যয়ে বিদ্যাশিক্ষা করিয়াছে। সতিশকে ওকালতী পর্য্যন্ত পাশ করাইয়াই আমি কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছি। শ্যালক মুক্ষদাপ্রসাদ ঘোষ তাহার নিজ অধ্যাবসায়ে যথেষ্ট উন্নতী লাভ করিয়াছে। সে এখন দেড়শত টাকা মাসিক বেতনোপার্জ্জনে পশুচিকিৎসালয় বিভাগে ইনস্‌পেকটারী পদে নিযুক্ত, সুনাম ও প্রতিপত্তি অর্জ্জন করত: বিশেষ প্রতিষ্ঠাবান আছে।

    ৩। আমার উপার্জ্জনের মধ্যাবস্থায় ১৩০৫ সালে আমার প্রথম কন্যা শ্রীমতী কুসুমের বিবাহের প্রস্তাব হয়। আমার চারিকন্যা ও এক পুত্র। পুত্র সকলের জ্যেষ্ঠ। কন্যাগুলী জন্মিবার পরই আমার মনে এই গুরুতর চিন্তা উপস্থিত হয় যে, দেশকালের অবস্থামতে কন্যাদায়াপেক্ষা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভদ্রলোকের পক্ষে কোন দায়ই যেন গুরুতর দৃষ্ট হয় না। আমি সুমহান দায়ীত্ব হইতে কিরূপে উদ্ধার পাইব, ছেলেকে ত দিনে২ অল্পে অল্পে মানুষ করার উপায় আছে। এ যে এককালিন ব্যয়বাহুল্যের ব্যাপার। এই চিন্তাস্রোত দিবানিশি আমার মনে প্রবাহিত রহিল। যাহা হউক কুসুমের বিবাহের প্রস্তাব হওয়া মাত্রই পাত্র দেখিয়া অবস্থা অবগত হইয়া তাহা যে কর্ত্তব্য, স্থির করিয়া ফেলীলাম। তখন কুসুমের বয়স মাত্র ৯ বৎসর। বলা বাহুল্য আমি সর্ব্বদাই বালীকা বিবাহের পক্ষপাতী। যৌবন উদ্‌গত হইলে যে বিবাহ দেওয়া সেটা যেমন শাস্ত্র বহির্ভূত কার্য্য তেমনি কতকগুলী অশান্তী ও বিপদের সম্ভাবনামূলক বলিয়া ধারণা করি। ৯/১০ বৎসরে মেয়ে পাত্রস্থ হইলে স্বামীগৃহের অভিভাবক ও অভিভাবিকাগণের হস্তে তৎপারিবারিক নিয়মে গড়াপেটা হয় ও স্বামীগৃহের গুরুজনদিগের অনুগত থাকিয়া চিরজীবন শান্তীর সহিত বাস করে। এই বিশ্বাসে ৯ বৎসরের বালীকাকে পাত্রস্থ করিলাম। নগদ টাকা পাত্রপক্ষ গ্রহণ না করায় ছেলের শিক্ষার ভার গ্রহণ করিলাম। বিবাহ যথাসম্ভব সমারোহে আমাদের বাড়ীতে সম্পন্ন হইল। এই বিবাহে আমার নগদ প্রায় হাজার টাকা ব্যয় হইল। আহারিয় সামগ্রী ইত্যাদির অধিকাংশই নিজ গৃহস্তির আয়োৎপন্ন, মৎস্য পুখুরের, আরও অনেকানেক বিষয়ে নগদ খরচের টাকা বাঁচিয়া গেল। ছেলেকে ময়মনসিংহ-নগরের বাসায় নিয়া বিদ্যাভ্যাসে নিযুক্ত করিয়া দিলাম। বংশ ভাল হইল, ছেলে দেখিতে সুশ্রী ও সচ্চরিত্র, মাতা পিতা বর্ত্তমান, অবস্থা মধ্যবিত্ত; মনে খুব শান্তী পাইলাম।

    এই বিবাহের পরবৎসরই দ্বিতীয়া মেয়ে শ্রীমতী খিরদার বিবাহের প্রস্তাব হইল। ভগবান যেন সহায় হইয়া কুসুমকে যে প্রকারে ঘরে বরে দিয়াছি, সেই অনুরূপ ঘর বর উপস্থিত করিলেন। যথাসময়ে কথোপকথন স্থির হইয়া বিবাহ সম্পন্ন হইল। পাত্রীপক্ষ বাড়ী খরচা বাবদে কিছু টাকা গ্রহণ করিলেন ও ছেলের শিক্ষার ভার আমার স্কন্দে নিক্ষেপ করিলেন। আমি তথাস্তু বলিয়া কার্য্য শেষ করিলাম। এই বিবাহেও হাজার টাকার অধিক নগদ খরচ হয় নাই।

    তৎপর ৩য় মেয়ে শ্রীমতী বিনোদিনীর বিবাহ ২/৩ বৎসর পর বাটীর অদূরবর্ত্তী বিশেষ সঙ্গতিপন্ন পরিবারে ঠিক হইলে তাহাতে সম্মতি প্রদান করিলাম। ভ্রাতা শ্রীমান্‌ গুরুদাস রায়ই এই বিবাহের উদ্যোগ কর্ত্তা এবং তাহার অনুরোধেই আমি বাধ্য হইলাম। পাত্র সুশ্রী সচ্চরিত্র ও বুদ্ধিমান হেতু এবং অবস্থা খুব ধনে জনে উন্নত বলিয়া মনে শান্তী হইল। শুভদিনে বিবাহ হইয়া গেল। আমার চিন্তা ভাবনার বুঝা যেন হৃদয় হইতে অপসারিত হইল। পাত্রপক্ষকে নগদ কিছু দিতে না হওয়ায় এই বিবাহ অষ্টশত পরিমাণ মুদ্রা ব্যয়ে সঙ্কুলন হইল। বলা বাহুল্য ধনী লোকের ছেলে বলিয়া তাহার শিক্ষা ব্যয় আমাকে কিছুই দিতে হইল না, কিন্তু তাঁহাদের স্বীয় খরচে মাত্র আমার বাসায় থাকিয়া বিদ্যাভ্যাসে নিযুক্ত হইল।

    তিন মেয়ে পাত্রস্থ করিয়াছি, আমার ন্যায় বীর কে আছে, এই মনে করিয়া খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করিলাম। আরও আত্মপ্রসাদের কারণ হইল মেয়েরাও সুখী হইয়াছে দেখিয়া। ৪র্থ মেয়ের জন্য আর ভাবনাই রহিল না, মেয়েটা তাহার সকল ভগ্নিগণ হইতে একটু লাবণ্য বিশিষ্টা হেতু, মনে হইল এ মেয়ের আদর আছেই। বলা বাহুল্য মেয়েরা সকলই সুন্দরী তবে কেহ একটু বেশী ফরসা কেহ একটু কম। তবে ছোট মেয়ে একটু বেশী ফরসা বলিয়াই আমার অহঙ্কার জাগিয়া উঠিল। ২/১ বৎসর পর একদিন ময়মনসিংহের বাসায় গুরুদাসের টেলীগ্রাম পাইলাম যে শ্রীমতী সুনীতি বালার (৪র্থ মেয়ের নাম) বিবাহ ঠিক হইয়াছে, পাত্র দেখিয়া বাড়ি আসুন। মনে আহ্লাদ হইল; পর দিনই ভৃত্য মাত্র সঙ্গে করিয়া কিশোরগঞ্জ টাউনে যাত্রা করিলাম। রেলে, ঘোড়গাড়ীতে ও কতক পথ পদব্রজে অতিবাহিত করিয়া পাত্রপক্ষের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। পাত্র দেখিলাম, বেশ সুশ্রী, মাতা পিতা বর্ত্তমান, অবস্থা একসময় খুব ভাল ছিল, এখন পাত্রের পিতার শেষাবস্থায় উপার্জ্জনহীন হওয়ায় অবস্থা খারাপ হইয়াছে। তবে পাত্রের মাতুলগণ খুব বড় তালুকদার ও সঙ্গতিপন্ন লোক বটেন, এ বিবাহের খরচ তাঁহারাই বহন করিবেন জানিলাম। পাত্রের পিতার দৈন্যাবস্থার সুচনা হইতেই তাঁহারা যথাসাধ্য সাহায্যদানে ত্রুটী করিতেছেন না, ভবিষ্যতেও করিবেন আশা আছে। অবস্থা সম্বন্ধে আর বেশী দেখা সঙ্গত মনে করিলাম না। ছেলে খুব ইন্‌টেলীজেণ্ট্‌ ও সচ্চরিত্র জানিয়াই আমার মন আকৃষ্ট হইল। কথোপকথন পূর্ব্বেই গুরুদাস সহ ঠিক হইয়াছে, সামান্য মাত্র বাড়ী খরচা দিতে হইবে, আর, ছেলের শিক্ষার খরচ মাতুলরাই দিতেছেন, তবে বিবাহের পর হইতে আমাকেও কিছু দিতে হইবে। আমি তথাস্তু বলিয়া স্বীকার করত: আহারাদি অন্তে বাড়ী চলিয়া গেলাম। যথাসময়ে শুভদিনে বিবাহ হইয়া গেল। ছেলে ঢাকা সার্ভে স্কুলে পড়িতে গেল। এই বিবাহেও হাজার টাকার অধিক নগদ ব্যয় হয় নাই। যাহা হউক ন্যুনাধিক ৪ চরিহাজারটী টাকাতে আমার স্কন্দে যে গুরুভার ছিল তাহার উন্মোচন করিলাম।

    বড় জামাতা, ২য় জামাতা ও ছোট জামাতা তিনজনেই সার্ভে পাশ করিয়া বড়টী আমিনী কার্য্য, ছোত জামাতা কতকদিন আমিনী করার পর ময়মনসিংহ ডি: বো: অফিসে মাসিক ৫০্‌ টাকা বেতনে কার্য্য করিতেছে। অতি মর্ম্মঘাতী দু:খের কথা লেখনীমুখে প্রকাশিত হইতে চাহে না। আমার জীবনে কেবল একটী ব্যতীত শোকসন্তাপ কেমন জানি না। সকলই আমার বর্ত্তমান। মেয়েদিগের সকলই পুত্র কন্যার মুখদর্শনে সুখে সন্তুষে কাল কর্ত্তন করিতেছে। এহেন সুখের দিনে ""অকস্মাৎ বিধি হরিয়া নিল গুণনিধি'' -- ২য় জামাতা নিদারুণ নিমুনীয়া রোগে অকালে প্রাণত্যাগ করিল। আমার সুখের নির্ম্মল জীবনে এই একটী মাত্রই কালী দাগ বসিয়াছে ও সুখভরা হৃদয়ের মধ্যস্থলে কে যেন একটা শোকভরা শেল বিদ্ধ করিয়া দিয়াছে, যাহা আর এ জীবনে খসিবে না।
  • Shibanshu | 59.90.221.5 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৮:১৮480394
  • এই লেখাটি আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে অচিন্ত্য যে শ্রমস্বীকার করছেন তা সত্যিই ধন্যবাদের যোগ্য। আমি লেখাটি কৌতূহল সহকারে নিয়মিত পড়ে থাকি। বিশেষত পূর্ববঙ্গে হিন্দু মধ্যবিত্তবর্গের বিবর্তনের একটি বিশ্বস্ত ইতিহাস নথিবদ্ধ হচ্ছে এভাবে।
  • achintyarup | 59.94.2.155 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৪:৩১480396
  • অনেক ধন্যবাদ শিবাংশু :-))
  • achintyarup | 59.94.2.155 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৩২480397
  • ৪। যদিও পিতামহদেবঁ রাজকৃষ্ণ রায়ের সময় হইতে, খুল্লপিতামহদেব ভক্তবীরঁ জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের দেহাবসানে খানাবাড়ী সংক্রান্ত তালুক ও দ্বিতল পাকা বাটীর ষোল আনা আমাদেরই দখলে আছে তথাপীঁ জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের দৌহিত্রাদি ওয়ারিষগণের একটা দাবী দাওয়া ।/০ আনা হিস্যা সম্পর্কে নামমাত্রে পর্য্যবসিত ছিল। এই দাবী আমার সময়ে দূরীভূত না করিলে ভবিষ্যতে কলহ বিবাদ উপস্থিত হইতে পারে বিবেচনায়, বহু অধ্যবসায় ও কতক অর্থব্যয়ে সত্যত্যাগ পত্রাদি গ্রহণে সকল অংশীরই দাবী দূর করিয়া খানাবাড়ী নিষ্কণ্টক ও নিজস্ব করিয়াছি।

    ৫। শিবরাম পশুরাম নামক তালুকের মালীকঁ জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের সময় হইতে আমরাই থাকা সঙ্কেÄও শঠতা মূলে অপর লোকেই বহুবৎসরাবধি দখল করিয়া আসিতেছিল। আমার উন্নতীর চরমাবস্থায় তাহা বিপক্ষগণের গ্রাস হইতে কতক বলে ও কতক মোকদ্দমাদির ফলে নষ্ট উদ্ধার করিয়াছি। ইহাতে যে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও মানসিক বলের প্রয়োজন হইয়াছিল তাহা বর্ণনার স্থান এ নহে। স্বগ্রামবাসী শত্রু মিত্র সকলকে স্তম্ভিত করিয়া এ কার্য্য সাধন করিয়াছি।

    ৬। কালেকটরীর তৌজীভূক্ত খারিজা তালুক সকলেঁ জয়গোবিন্দ রায় মহাশয়ের দৌহিত্রদ্বয়ের মৃত্যুর পর তদীয় অংশ ক্রমে নানা হস্তে হস্তান্তরিত হইয়া বহু অংশীর করতলগত হয়। তাহাতে আমার দুইটী বিষয়ে অসুবিধা উপস্থিত হয়। ১ম বহু সরিকের মহাল সম্পর্কীত আমার নিজ কিছু অংশ উচিত মূল্যে বিক্রয় ও ঋণ পরিশোধের বাধা ঘটে। ২য় প্রজাগণ হইতে কর আদায়েরও বিগ্ন বিপত্তির সীমা নাই। এই হেতু বহু আয়াশে ও অর্থব্যয়ে কালেকটরীতে বণ্টন করাইয়া ঐ সকল বাধা বিঘ্নাদি দূর করিয়াছি। প্রজাকে সুখী করিয়াছি।

    ৭। খানাবাটীস্থিত পূর্ব্ববর্ত্তী সময়ের পুরাতন গৃহাদির আমূল সংস্কার ও বহির্ব্বাটী এবং অন্দর খণ্ডের নানা পরিবর্ত্তন ও উন্নতীসাধনা। ১৪ খান টীন গৃহ নির্ম্মাণে বাটীর সৌষ্ঠব বৃদ্ধি। ইহাতে বহু টাকা ব্যয় হইয়াছে।

    ৮। পাকা দ্বিতল অট্টালীকা ও ঘাটলা নির্ম্মাণের ১২৫ বৎসর পরে তাহা আমূল সুসংস্কার ও সৌষ্ঠব বৃদ্ধি। ইহাতে ১৬০০ শত টাকারও অধিক ব্যয় হইয়াছে।

    ৯। সচীন্দ্র রায় হইতে তালুক খরিদ। আদমপুরের তালুক খরিদ, বণ্টন ও সুদক্ষতার সহিত দখল ও সাশনকার্য্য পরিচালন।

    ১০। জোত জমী ও খামার জমীর প্রভূত বৃদ্ধি ও উন্নতীসাধনকল্পে বহু টাকা ব্যয় ও গৃহস্তির শ্রীবৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধি।

    ১১। পাল্‌কী ও আলমায়রা, টেবোল, বেঞ্চ, ছোট বড় চৌকী ও বসিয়া আহারাদি করার কাঁঠাল, চাম্বলাদি কাষ্ঠের বহু কাষ্ঠাশনাদি, নানা প্রকার কাঠের মূল্যবান জিনিস ......................................................................................................
    কুলায় না হেতু বাসায় পরিবার রাখার বাসনা পরিত্যাগ করিলাম। বিদেশে পরিবার রাখিবার দোষগুণ দুই আছে......হাও কতটা পরিমাণে সময়২ মনকে আলোড়িত করিত। পরিবার সঙ্গে রাখিলে পরিবারের মনে এবং নিজ মনে যে শান্তী থাকে ও খাওয়া দাওয়ার সুবিধা হয়, তেমনি আবার সংসারের দিক দিয়া দেখিলে, সহরবাসী মেয়েরা অত্যধিক পরিমাণে সহরের বিলাসীতায় অভ্যস্থ হইয়া ... গতিকে, নিজের স্বার্থানুসন্ধান ভিন্ন অপরের সেবা করিতে চায় না। আর গ্রাম্য মেয়েদের সহিত অহঙ্কার বশত: মিশিতে পারে না, যাহার স্বামী বেশী উপার্জ্জনশীল তাহার পা ত মাটীই স্পর্শ করে না, সে বাড়ী গিয়া দশজনের সেবা কি করিয়া করিবে? এই কারণে অনেক শান্তীনিকেতনে অশান্তী ও নিরানন্দের স্রোত প্রবাহিত হয়। আমার মন এই জন্য পরিবার বিদেশে না রাখারই পক্ষপাতী। সম্মিলীত পরিবারের উচ্ছেদ সাধন করিয়া কেবল নিজ সুখানুসন্ধান আমার কখনও অভিপ্রেত নহে। তবে সকলের অবস্থা একরকম ঘটে না। যাহার দুই দিক রক্ষা হয় কি যাহার একদিক মাত্রই, অর্থাৎ কেবল নিজের স্ত্রি ও সন্তান ........ সংশ্রব নাই তাহার পক্ষে ... কথা। কিন্তু আমার সংসারের সে অবস্থাও নহে। নিত্য চাকরাদির ..... ত আছেই, অতিথী অভাগতও সময়২ জোটে। তদোপরি ফসল উঠানী, নিরানী ইত্যাদি মরশুমে এমন হয় যে সপ্তাহ ..... ৩০/৪০/৫০/৬০ জন উপরি মজুর বাটীতে ...... খাওয়ার রান্না করিতে হইবে। বৎসরের মধ্যে এরূপ ..... ৩/৪ বার ...... ধান্য রূপা, ধান্য কাটা, ..... ক্ষেত্র নিরান, পাট ক্ষেত্র নিরানী, পাট... কর্ত্তন ও ভিজান প্রভৃতি গৃহস্তি .... নানা সময়ে উপরি মজুর .... কাজ করাইতে ... কেবল বেতনগ্রাহী .... দ্বারা চলে না। আমাদের ..... গৃহিণী বসিয়া থাকিয়া দাসী, ভাণ্ডারী কি ঠাকুর দ্বারা পাক কার্য্য ...... নিজেই ...। এই গৃহস্তি কারবার যাহারা করেন ...... ইহা ........ মাছ ও বাগানের ফল যাহার আছে তাহার কোন বিষয়েই পরমুখাপেক্ষী হইতে হয় না। এ হেন সুখ সৌভাগ্যের হেতু ভূত স্বাধীন ব্যবসা গৃহস্তিকে অবহেলা করিয়া কেবল বিদেশ-বাসাবলম্বনীয় সুখ জন্য বাসায় আর পরিবার নিলাম না।

    বাসায় যখন ছাত্র সংখ্যা বেশী ছিল তখ নিত্য ১০/১১ জন লোকের রান্না হইত। তখন পশ্চীম দেশীয় পাচক ব্রাহ্মণে পাক কার্য্য সমাধা করিত। আবার লোকসংখ্যা হ্রাস সময়ে, ভাণ্ডারী চাকরদের মধ্যে যাহাকে নিজে পাক কার্য্য শিক্ষা দিয়া পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাদি সর্ব্ব বিষয়ে নিজের মনোরঞ্জনের উপযোগী করিয়া তুলিতে পারিয়াছি সেই চাকর দ্বারাই রান্না করাইয়াছি। যাহার তাহার হাতে খাওয়া কোন দিনই প্রবৃত্তি হইত না। এজন্য মহরির ও ছাত্রগণ সকলকেই পাক কার্য্য শিখিতে হইয়াছে। এ বিষয়ে আমার সর্ব্বশেষ মহরির প্রকাশ চন্দ্র কর ও পুত্র সতীশ প্রভৃতি অনেকেই রান্নার সাহায্য করিয়া নিজেরাও পাকে পটু হইয়াছিল। সুতরাং পরিবার না থাকা অবস্থায় আমাদের খাওয়া দাওয়া মন্দ হইতে পারে নাই।
  • achintyarup | 59.93.255.5 | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৬:০৩480398
  • আমি নিজে ১০ বৎসর বয়সেই যে বাঘাসুরা স্কুলে শিক্ষা সময়ে পাক করা অভ্যাস করিয়াছিলাম তাহা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি। সেই অভ্যাস যখন পিতৃদেব স্বর্গগত হওয়ার পর বিধবা মাতাঠাকুরাণীর আদেশে বাড়ীতে চাকর ও মজুর প্রভৃতি গৃহস্তি কার্য্য পরিচালক ব্যক্তিগণের জন্য মৎস্য পাক করিতে আরম্ভ করিলাম, তখন পরিপক্কতা লাভ করিল। পাঠাদি সময়েও যখন বাড়ীতে অবস্থিতি করিয়াছি তখনই এরূপ পাকে আমার আলস্য ছিল না। এমনও কখনও ঘটীয়াছে, ২৫/৩০ জন লোকের আহার সংকুলন জন্য পাক করিতে হইয়াছে। আমার ছোটবেলা হইতে ধারণা, পাক স্ত্রীলোকের কার্য্য হইলেও পাক কার্য্য শিক্ষা না করিয়া বিদেশে চলা ফেরা ও বাস করা বড়ই সুকঠিন। এই চিন্তা হইতেইঅ মনে পাক কার্য্য শিক্ষার আগ্রহ হয়। মোটা মোটী জীবন রক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষার উপযোগী পাক কার্য্য অবগত আছি এবং এ বৃদ্ধ বয়সেও পাক করার উৎসাহ ও সাহস আছে। নিজের হাতে রান্না করিলে যেমন পরিতৃপ্তি ও পবিত্রতা জন্মে, এক জননী ভিন্ন অপরের হাতে প্রস্তুতীকৃত খাদ্যে সেরূপ পরিতৃপ্তি ও পবিত্রতা হয় কি?

    ১২৯১ সালে যখন সনন্দ গ্রহণে মোক্তারী কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম তখন ভৃত্য রাখাও চলে না, মহরেরও পোষায় না এবং পরিবার রাখাও দু:সাধ্য। অবশ্য বাড়ী হইতে টাকা নিয়া খরচা করিতে পারিলে ঐ সকলই সুসাধ্য হইত। কিন্তু তাহা আমার প্রবৃত্তিজনক হইল না; বিশেষত: বাড়ীতে তখন ঋণ বর্ত্তমান ছিল। মনে হইল এখানকার আয় দ্বারা যেরূপে চলে সেইভাবেই থাকিব, তথাপী বাড়ী হইতে টাকা আনিব না। সুতরাং একজন ঠিকা ভৃত্য রাখিয়া নিজে পাক করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিয়াই চলিতে লাগিলাম। ভৃত্য জল, মসল্যা দিত, বাসনাদি ধুইত, আর সবই নিজে করিয়াই আইন ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত রহিলাম। এরুপ কষ্টজনক ব্যাপার ২/১ বৎসর চলিল, তৎপর প্রসার বৃদ্ধির সঙ্গে২ স্থায়ী চাকর হইল, পরে ক্রমে মহরের হইল। সুখের দিন আসিল।

    মহরেরের কথা ও চাকরের কথা। (খ)

    আইন ব্যবসা পরিচালনে মহরের আবশ্যকতা ও দায়িত্ব খুব বেশী, প্রসার বৃদ্ধি হইলে মহরের ছাড়া একপদও চলিবার শক্তি নাই। মহরেরটী ভাল হইলে তাহার গুণে প্রসারও দিন২ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আমার ব্যবসা ক্ষেত্রে অনেক মহরেরই সাক্ষাৎ পাইয়াছি, কিন্তু বাবু ভারতচন্দ্র আচার্য্য, জানকীনাথ রায় ও সর্ব্বশেষ মহরের প্রকাশচন্দ্র কর এই তিনজন যেরূপ দক্ষতার সহিত কার্য্য করিয়া আমার পরিশ্রমের লাঘবতা করিয়াছেন সেরূপ আর কাহারও দ্বারা হয় নাই। ভারতবাবু নিজ ক্ষমতাবলে পরে মোক্তারী পাশ করত: কার্য্যক্ষেত্রে বিশেষ প্রসার প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন। তাঁহার উন্নতীতে আমি বিশেষ আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছি। ভগবান তাহাকে নীরোগ ও দীর্ঘজিবী করুন।

    প্রকাশ ১৩০৮ সাল হইতে ১৩২৬ সাল পর্য্যন্ত দীর্ঘ ১৯ বৎসর কাল আমার পরিচর্য্যা করিয়াছে, তাহার কার্য্যদক্ষতা, সাহস, উদ্যম ও অমানিভাব বড়ই সুখকর ও প্রসংশনীয়। তাহাকে দেওয়ানী ও কালেকটরী বিভাগের সমস্ত কার্য্য ভালরূপে শিক্ষা দিয়াছি, ফৌজদারী বিভাগের কার্য্যেও সে অনভ্যস্থ নহে। অনেক সময় উকীলবাবুগণ পর্য্যন্ত সুদক্ষ মহরের প্রয়োজন হইলে প্রকাশকে ডাকিয়া থাকেন। ভাল অভিজ্ঞ মহরের বলিয়া উকীল ও মোক্তার বারে তাহার প্রসিদ্ধি আছে। গৃহকন্নার কাজে ও পাকে কি জিনিশাদি ক্রয়ে কি কোনও লোকের নিকট কোন প্রয়োজন সিদ্ধিকল্পে আলাপ পরিচয়ে প্রকাশ অপটু নহে। তাহার বিনয়নম্র ব্যবহারে ও কার্য্যকুশলতায় ১৯ বৎসরকাল সুখে কর্ত্তন করা হইয়াছে।

    তাহাকে আমার প্রসার প্রতিপত্তি বহাল রাখার উদ্দেশ্যে, আমার অনুপস্থিতি কালে অনেক খাটীতে হইয়াছে। এজন্য আমলাবর্গ ও হাকিমদিগের মধ্যেও সে বিশেষ পরিচিত। সকলই তাহাকে বুদ্ধিমান, কর্ম্মকুশল বলিয়া মনে করিয়াছেন।

    আমি প্রতি মাসেই একবার কি দুইবার করিয়া বাড়ী গিয়াছি। বাড়ীর কার্য্যের উন্নতীকল্পে এই যাতায়াত অনিবার্জ্য হেতুই যাইতে হইয়াছে। প্রকাশই তখন আমার স্থলবর্ত্তীরূপে আমার প্রসার রক্ষা করিয়াছে। আমি কার্য্য পরিত্যাগ করার পরও আমার অনুরোধে এবং পূর্ব্ব পরিচয়ে আমার বড়২ মওক্কেলগণ তাহাকে কাজকর্ম্ম দিয়া প্রতিপালন করিতেছেন। সে যোগ্যতার সহিত এখনও মহরের কার্য্য করিয়াই সংসারের উন্নতীসাধন করিতেছে।

    বাসায় পরিবার না রাখা অবস্থায় চাকরের উপরই অধিকাংশ বিষয়ে নির্ভর করিয়া চলিতে হয়। ভাণ্ডারী চাকর সচ্চরিত্র পাওয়া বহু ভাগ্যের কথা। কারাণ বাঙ্গালী চাকরদিগের মধ্যে বোধকরি শতকরা ৯০ জনের অধিক চরিত্রহীন। তাহাদের না আছে পাপ ভয়, না আছে লোক ভয়, বাজারের জিনিশ খরিদে যে পয়সা তাহাদের হাতে পড়ে, তাহা হইতে যে প্রত্যহ ২/৪ পয়সা চুরী করা ইহা তাহাদের মামুলী প্রথা। এই মামুলী প্রথায় জিনিশাদি খারাপ হয়, তদ্দরুণ খাওয়াটা ভাল হয় না। এজন্য আজকালের দিনে অধিকাংশ ভদ্রলোক নিজে বাজারে গিয়া থাকেন। কিন্তু আইন ব্যবসায়ী লোকের তাহা ঘটে না। বাসা ছড়িয়া গেলি মওক্কেলীয় কাজের ক্ষতি ঘটে, মওক্কেল ফিরিয়া যায় কি বিরক্ত হয়। তজ্জন্য আমাকেও বহু ক্ষতি ও মন:কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছে। বাজারে যাওয়া প্রায় ঘটে নাই, মহরেরও যাইতে বড় পারে নাই, দুই বেলাই তাহার কাজ বিস্তর।

    চাকরের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতে ও তাহার বেতন উচিত সময়ে কি প্রয়োজন বিশেষে অগ্রিম দিতেও ত্রুটী করি নাই। অনেক দুষ্ট প্রকৃতির ভাণ্ডারী চাকর অগ্রিম বেতনাদি লইয়া পলায়ন করিয়াছে, তাহাতেও বোধ হয় ২/৩ শত টাকার কম ক্ষতি সহ্য করি নাই। দীর্ঘ ৩৫ বৎসরের মধ্যে বহু চাকরের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে। তন্মধ্যে ভাল লোক যে না পাইয়াছি এমন নহে, তবে দুইটী সৎ প্রকৃতি লোকের সদ্‌ব্যবহারের বিষয় বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

    ব্রাহ্মণ কচুরী গ্রামের মহেশচন্দ্র দে ১৩৯৪ সালে আমার ১ম ভাণ্ডারী চাকুরীতে নিযুক্ত হয়। ১২৯৫ সালের আষাঢ় মাসে আমার ""কলারা'' রোগ হয়। আমি মরণাপন্ন কাতর হই। বাসায় যাহারা ঘনিষ্ট সুহৃদ বলিয়া পরিচিত ছিলেন, তাহারাও নাকি আমার দর্শন স্পর্শনে বিমুখ হইয়া আমার সান্নিধ্য আসিতেন না, সেবা শুশ্রুষা করা ত দূরের কথা। সেই সময় মহেশ অকুণ্ঠিত চিত্তে আমার শুশ্রুষাদি করিয়াছিল। মল মূত্রাদি অম্লান বদনে হস্ত দ্বারা দূর করিতে তাহাকে কিছুমাত্রও বিমুখ দৃষ্ট হয় নাই। কাহারও কথায় সে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া যায় নাই, সে সাহসপূর্ণ বাক্যে বলিয়াছিল ""আমি যদি মরিও তথাপী এসময় গগনবাবুকে ছাড়িয়া যাইব না''। তাহার গুণে ও জ্ঞানে এবং সদব্যবহারে আমি আজীবন তাহার নিকট ঋণী আছি। তাহার উপকার আমি কিছু করিবার সুযোগ পাই নাই বলিয়া আক্ষেপ রহিয়া গেল।
  • achintyarup | 59.93.255.248 | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৫৮480399
  • তারপর আর একটী ভৃত্য পাইয়াছিলাম, কাপাসটীয়া গ্রাম নিবাসী গগন চন্দ্র দে; সে ৩্‌ টাকা বেতনে অল্প বয়সে আমার সঙ্গী হয়। পরে ৫্‌ টাকা পর্য্যন্ত বেতনে আমার বাসায়ই চাকরী করিয়া গিয়াছে। চাক্‌রীর ভাবে সে চাক্‌রী করে নাই, ঠিক আপন বাড়ীতে যে ভাবে লোকে কাজ করে, সে সেই ভাবেই আমার বাসারূপী সংসারের কর্ত্তৃত্ব করিয়াছে। আমি তাহার কার্য্যকুশলতায় ও গুণে মুগ্‌ধ হইয়া সর্ব্ববিষয়েই অর্থাৎ তাহার সর্ব্ববিধ কর্ত্তব্যানুষ্ঠানে তাহারই কর্ত্তৃত্ব স্বীকার করিয়া নিয়াছি। খাওয়ার বন্দবস্থ, হাটবাজার করা ও বাসার পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে আমাকে একটুকুও দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে হয় নাই। তাহাকে আমরা প্যারী নামে ডাকিতাম। কেহ কোন বিষয়ে গৃহকন্নার কাজের কথা বলিলে আমি তৎক্ষণাৎই উত্তর দিয়াছি ""প্যারী যদি সেটা করিয়া থাকে তবেই হইয়াছে''। অথবা কোন অসম্পূর্ণ কাজের উল্লেখ হইলে বলিয়াছি, ""প্যারীই দেখিয়া শুনিয়া করিবে''। প্যারীর প্রতি এমনি অগাধ বিশ্বাস ছিল। কোন দিন প্যারীর হাতে পরিবেশন না হইলে বলিয়াছি ""প্যারী না দিলে পেট ভরে না, প্যারী যেন ঠিক মায়ের মত খাওয়ায়''। দু:খের বিষয় (এবং তাহাকে সুখেরও বলা যায়) প্যারীকে কতক বৎসর পরে ছাড়িতে হইল। মোক্তারীর শেষ পর্য্যন্ত তাহাকে রাখিতে পারি নাই। সে কথা পরে বলিতেছি।

    প্যারী আমার দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিল। কনিষ্ঠ সহোদরের ন্যায় ব্যবহার তাহা হইতে সর্ব্বদাই প্রাপ্ত হইয়াছি। আপদে বিপদে সে সৎসাহসী, অক্লান্তকর্ম্মা, ও কঠোর পরিশ্রমী ছিল। কোন কাজের জন্য বলা হইলে সে কোনও দিনই বলে নাই যে ""আমি উহা পারিব না''। সে সব কাজেই পারুক, না পারুক পশ্চাৎপদ হওয়ার লোক নহে। টাকা পয়সা সম্বন্ধে, বাক্‌সের চাবী তাহার নিকট নি:সন্দেহ চিত্তে ফেলীয়া রাখিয়াছি। বাজারের পয়সা চুরী করা দূরে থাকুক ভূল ভ্রান্তিতে মেজে কি বিছানায় চাবী কি টাকা পয়সা ফেলীয়া গেলেও কোনও দিন এক কপর্দ্দকও নড়্‌চর্‌ হয় নাই।

    তিনবার সে আমার সহিত কলিকাতা গিয়াছে। তখন তাহার কার্য্যতা ও গুণে মুগ্‌ধ রহিয়াছি। তাহার বুদ্ধিও বেশ প্রখর। কখন হঠাৎ রেলের কি ট্রামের গাড়ীতে কি ষ্টিমার চড়িতে আমার জিনিশাদি লইয়া আমার পশ্চাদবর্ত্তী না হইতে পারিলেও সে হতাশ্বাস হইয়া অবোধের মত কাজ কখনও করিয়া ফেলে নাই। তাহার প্রত্যোৎপন্নমতিত্ব তাহাকে অতি সুন্দর ব্যবস্থায় যথাসময়ে আমার সমীপবর্ত্তী করিয়া দিয়াছে। রাস্থায় ঘাটে খাওয়া নাওয়ার এমনি সুবন্দবস্থ অত্যল্প কালের মধ্যে করিয়াছে যে ভাবিলে অবাক হইতে হয়। আমি হোষ্টেলে খাইব না তাহার জানা আছে, এই বিবেচনায় পূর্ব্ব হইতে সতর্ক হইয়া পথ ভ্রমণে খাওয়ার বন্দবস্থ করিয়া লইয়াছে। সে আমার প্রকৃতিটাকে সম্পূর্ণরূপে চিনিয়া লইয়াছিল। আমিও তাহার প্রাকৃতিক শক্তি আয়ত্ব করিয়াছিলাম। এইরূপে চাকর মুনিবই হউক কি ভ্রাতায় ভ্রাতায় হউক কি মাতা পুত্র কিম্বা পিতাপুত্রই হউক অথবা গুরু শিষ্যই হউক দুইজন কি ততোধিক জন একগৃহে কি বাসায় কি সংসার রঙ্গশালায় বাস করিতে গেলেই যদি একজন আর এক জনের সম্যক প্রকৃতিটা আয়ত্ব করিতে পারে তবেই বোধহয় কলহবিবাদ কি মনোমালিন্যাদি দুর্ব্ব্যবহার সকল দূরে পলায়ন করে, অভিনয় সুন্দর হয়, আর যদি এক গৃহবাসী দুজনার মধ্যে একজন আর একজনের স্বভাবটা সম্পূর্ণরূপে চিনিতে কি জানিতে কিম্বা বুঝিতে না পারে তাহা হইলেই গৃহলক্ষ্মী সে স্থান হইতে অন্তর্ধান করেন। কোন বিষয়েই সুখ মুখ দর্শন প্রত্যাশা করা যায় না। স্ত্রি পুরুষে, মাতাপুত্রে ও পিতাপুত্রে পর্য্যন্ত যে মনোমালিন্য ঘটে তাহারও এই একটী মাত্রই কারণ একজন আর একজনের সম্পূর্ণ স্বভাবটা আয়ত্ব করিতে পারে না। এক্ষেত্রে স্বার্থনানুসন্ধান করার বেশী প্রয়োজনীয়তা নাই।

    আমাদের বাড়ীতে যে সকল বৃহৎ২ ব্যাপার হইয়াছে -- যথা প্রথমা কন্যার বিবাহ, মেজ্‌কাকীমার শ্রাদ্ধ ও সতীশের বিবাহাদি সেই সমস্ত ব্যাপারের পূর্ব্বাহ্নেই প্যারীকে আমাদের বাড়ীতে উপস্থিত থাকিয়া ব্যাপার সুনির্ব্বাহান্তে অগৌণে আবার বাসায় গিয়া বাসার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইয়াছে। সপ্তাহপ্রায় কাল সে আমাদের বাড়ীতে প্রায় ব্যাপারেই অবস্থান করিয়া কেবলই লোকের আহারাদির সুবন্দবস্থ করিয়াছে ও চুরি ও প্রবঞ্চনামূলক কার্য্য নিবারণ করিয়াছে। তাহার স্বভাব ঠিক আমার ন্যায় কোমল ও কঠোর। ন্যায়পথে চলার সময় সর্ব্বদাই কোমল ও সুশীতল। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর নির্ম্মম ও বিষম উষ্ণ। এইটী আগাগোঁড়া প্যারীর আমার স্বভাবেরই সম্পূর্ণ অনুকরণ করিয়াছিল।

    তাহার সদব্যবহার ও কার্য্যে সন্তুষ্ট হইয়া মাতৃ ও শ্বাশুরী ঠাকুরাণী প্রভৃতি যখন তীর্থভ্রমণে গিয়াছিলেন তখন বাসায় কিয়ৎকালের জন্য অন্য চাকর রাখিয়া প্যারীকে তীর্থভ্রমণে পাঠাইয়াছিলাম। সে তাঁহাদের পরিচর্য্যা ও সেবাশুশ্রুষায় যথেষ্ট কৃতীত্ব প্রদর্শনে তাঁহাদিগকে সুখী রাখিয়া যাতায়াত করত: বাসায় ফিরিয়াছিল।

    আমার পূর্ব্বোল্লিখিত শ্যালক মুক্ষদা যখন ভেটার্‌নেরী ডিপাটমেণ্টের সার্জ্জেন হইয়া ময়মনসিংহ নগরে আগমন করিল, তখনও আসিয়া প্যারীকে আমার বাসায়ই দেখিতে পাইয়া বলিল -- ""প্যারীকে আমার সঙ্গে থাকিতে দেন, তাহাকে পীয়নী চাকুরী দিব, বেতন ৮্‌ টাকা হইবে, খোরাকীও দিব''। এই উন্নতীজনক ব্যাপারে আমার অমত করা অসঙ্গত মনে করিয়া, আমি তৎক্ষণাৎই বলিলাম, প্যারী একজন ভাল চাকর দেখিয়া আন, তুমি মুক্ষদার প্রস্তাব মতে উন্নতী লাভ করিলে আমি খুব সুখী হইব। অত:পর একজন ভাণ্ডারী চাকরের ব্যবস্থা করিয়া প্যারী ভেটার্নেরী হস্পিটালের পিয়নী পদে নিযুক্ত হইল। অদ্যাবধি উন্নতী সহকারে সেই পদে আছে। তাহার দীর্ঘায়ু ও চির উন্নতী আমার সতত বাঞ্চনীয়। সে এখন সুখী।

    আমার ""কলারা'' রোগ বিবরণ। (গ)

    ১২৯৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের ১৬ই তারিখ কালেকটর সাহেবের অফিসে সদর খাজানা অর্থৎ বাকী রাজস্ব আদায়ের নীলামের দিন ছিল। এই আষাঢ় মাসের নীলামী ব্যাপারটীতে সদরে বহু মপস্বলীয় লোকের সমাগম হয়। কারণ চৈত্রমাসের কিস্তিতে সর্ব্বশ্রেণীর রাজস্বদায়ী মহালেরই রাজস্ব দিবার দায় থাকে। তাহা আদায় না হইলেই আষাঢ় মাসে নীলাম অর্থাৎ বিক্রয় হওয়ার দিন ধার্য্য হয়। প্রতি বৎসরেই চৈত্র কিস্তিতে বহু মহালের রাজস্ব অনাদায়ী থাকে। অন্য তিন কিস্তি হইতে এই কিস্তি বড়। ইহা সাল তামামী অর্থাৎ শেষ কিস্তি। বাকীর সংখ্যা বেশী হইলেই নীলামটীও বিরাট ব্যাপারে দাঁড়ায়। এবারও সেই বিরাট ব্যাপার, আমার মোক্তারীর প্রসারবৃদ্ধির সবে প্রথমাবস্থা, অনেক মওক্কেলের বাকী আদায়ের জন্য আমি প্রার্থনা করিয়াছিলাম। আষাঢ় মাসের প্রখর রৌদ্রত্তাপে ছুটাছুটী ও বহুল জনতা মধ্যে অবস্থিতি ও রাজস্বাদি দাখিলের জন্য গলদঘর্ম্ম পরিশ্রম, (বলা বাহুল্য সে সময়ে মহুরের কেহ নিযুক্ত হয় নাই) ও বাদপ্রতিবাদাদি করিয়া যখন কা: সাহেবের এজলাস্‌ হইতে সন্ধ্যাসমাগমে বাহির হইলাম তখন দেখিতে পাইলাম যে আমার গাত্রবস্ত্র সমস্ত ঘর্ম্মজলে আদ্র; আপাদমস্তক ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে বাসায় ফিরিলাম। মহেশচন্দ্র দে তখন ভাণ্ডারী চাকর, পূর্ব্বেই সে কথা উল্লেখ করিয়াছি। কাপড় ছাড়িয়া মহেশকে বলিলাম এ সকল ধুইয়া দেও।

    অত:পর কিছু জলখাবার উদরস্থ করিয়া ক্লান্ত শরীরে মওক্কেলদের সহিত আলাপ ও কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলাম। রাত্রি ১১/১২ টায় আহার করিয়া নিদ্রার কূলে আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। শেষ রাত্রিতে মলত্যাগের বেগ হইলে পায়খানায় গেলাম। ক্রমে ৩/৪ বার দাস্ত হইল। সহরে রোগ ছিল না, কাজেই ভয়ের কারণ মনে জাগরুক হইল না, রাত্রি প্রভাতে মহেশকে ডাকিয়া বলিলাম, আমার রাত্রে ৪/৫ বার দাস্ত হইয়াছে, শরীর বড় অবসন্ন হইয়া পড়িল, শিঘ্র রাজেন্দ্রবাবু হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারকে ডাকিয়া আন, আর গৃহেই মলত্যাগের ব্যবস্থা কর, সে তৎক্ষণাৎ তাহাই করিল। রাজেন্দ্রবাবু আসিলেন, ঔষধ দিয়া পরীক্ষাদি করিয়া গেলেন। দেখিতে২ রোগ বাড়িতে লাগিল। এদিনেই কি তাহার পরদিন বিকার লক্ষণ প্রকাশ পাইল। রাজেন্দ্রবাবু আসিয়া দেখিয়া বলিলেন অবস্থা খারাপ হইয়া উঠিল, এসময় আত্মীয়স্বজনের শুশ্রুষার বিশেষ দরকার। খুল্লতাত শ্বশুর গঙ্গাপ্রসাদবাবু ভিন্ন তখন সহরে পরমাত্মীয় কেহ ছিলেন না, কিন্তু তিনি তখন মূক্তাগাছা মিউনীসিপালিটীর হেড্‌ক্লার্ক হইয়া তথায় অবস্থিতি করিতেছিলেন। বাসায় যাঁহারা আত্মীয় ছিলেন, তাঁহারা রোগের অবস্থাদৃষ্টে ভীত হইয়া পড়িলেন। গঙ্গাপ্রসাদবাবুকে টেলীগ্রাম করা হইল, কিন্তু তিনি না পঁহুছ পর্য্যন্ত রাত্রিতে জাগরিত থাকিয়া শুশ্রুষা কে করিবে? একা মহেশ দ্বারা ত কুলায় না। নেত্রকোণা সব্‌ডিবিসনের এলাকায় ডেম্‌রা গ্রামের উচ্চবংশীয় বাবু গোবিন্দচন্দ্র মজুমদার নামে প্রায় আমার সমবয়স্ক জনৈক কালেকটরীর ক্লার্ক ছিলেন, তাঁহার সহিত আমার বিশেষ পরিচয় ও আত্মীয়তার ভাব ছিল, তিনি আমাকে দেখিতে আসিয়া অবস্থা শুনিয়া বলিয়া উঠিলেন, ভাবনা কি আর কেহকে যদি না পাওয়া যায় আমি রাত্রিতে রোগীর পরিচর্য্যায় থাকিব। ডাক্তারবাবুও বলিলেন আমাকেও বাধ্য হইয়াই থাকিতে হইবে, কারণ রোগীর অবস্থা শঙ্কটাপন্ন। এসকল কথা যখন হয় তখন আমি সংজ্ঞাহীন, পরে জ্ঞাত হইয়াছিলাম বলিয়াই লিখিতেছি। যথাসময়ে গঙ্গাপ্রসাদবাবু মূক্তাগাছা রাজবাটী হইতে অর্দ্ধমোন ""বরফ'' লইয়া উপস্থিত হইলেন, সকলেরই মুখ কথঞ্চিৎ পরিমাণে প্রসন্নতা লাভ করিল। তিন রাত্রি ডাক্তার, গোবিন্দবাবু ও পূজ্যপাদ গঙ্গাপ্রসাদবাবুর যত্ন ও শুশ্রুষায় ও চিকীৎসায় ৬ দিনের দিনে বিকার দূর হইয়া সংজ্ঞালাভের আশা দৃষ্ট হইল। বাড়ীতে কে জানি গিয়া প্রকাশ করিয়াছে ""গগন রায় মারা গিয়াছে'', তাহা প্রকাশ হওয়ারই কথা। কারণ অবস্থা খারাপ দেখিয়া রাজেন্দ্রবাবুর পরামর্শে সহরের কোনও নামজাদা ডাক্তারকে ডাকা হইয়াছিল, তিনি ঘোড়গাড়ীতে আগমন করিয়া গৃহদ্বার হইতে রোগীর প্রতি দৃষ্টি করত: নাকি ২্‌ টাকা ভিজিট ও ।।০ আনা গাড়ী ভাড়া লইয়া বিদায় হওয়ার কালে বলিয়া গেলেন, রাজেন্দ্রবাবু বৃথা চেষ্টা, এ রোগী কি আর বাঁচে? রাজেন্দ্রবাবু তদোত্তরে নাকি বলিয়াছিলেন ""যখন রোগীকে অন্তিমশয্যায় বাহির করা হইবে তখন চলিয়া যাইব''। এ সকল কথাবার্ত্তা গ্রামের লোক কেহ শুনিয়া গিয়া গ্রামে রাষ্ট্র করিয়াছে, ""গগন রায় নাই''। বাড়ীতে ক্রন্দনের রোল পড়িয়া গিয়াছে, গুরুদাসের বয়স তখন বৎসর ১৪/১৫ হইবে। সে আর আসিল না, খানাবাড়ীর প্রজা জগমোহন মালীকে ভয়ে২ অবস্থা ঠিক কিনা জানার জন্য পাঠাইয়া দিল। তখন আমার নূতন বাসা হয় নাই, ""পরামাণিকের বাসা'' নামক স্থানে যে প্রথম বাসাবাটী প্রস্তুত করিয়াছিলাম সেই বাসায় আছি। জগমোহন সেই বাসায় হাজীর হইল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ যেন কাঁপিতেছে। তখন আমার সংজ্ঞা হইয়াছিল, তাহাকে চিনিতে পাইলাম।

    বাড়ীতে এ সংবাদ দেওয়ার জন্য জগমোহন তখনই দৌড়িল, বলিল আজ ৪/৫ দিন বাড়ীতে উনন্‌ জ্বলে না, কেহই প্রায় খাওয়া নাওয়া করেন না। আমি গিয়া সংবাদ দিলে স্নানাহার ও রান্না হইবে। তখন ঢাকা-ময়মনসিংহে রেল হইয়াছে। রেলে চড়িয়া, গঁফর গা ষ্টেশনে নামিয়া পদব্রজে ২৫ মাইল হাঁটিয়া দৌড়িয়া তবে জগমোহন সেই দিনেই বাড়ীতে শুভসংবাদ দিলে, বাড়ীতে সকলে স্বস্থি বোধ করিল।

    জ্যেষ্ঠতাতঁ রাজচন্দ্র মহাশয় তখন স্বর্গগত:, বাড়ীতে গুরুদাস মাত্রই পুরুষ, সতীশের জন্ম মাত্র সেই ১২৯৫ সলের বৈশাখ মাসে হইয়াছে। ২।। মাসের ছেলে কোলে আমার স্ত্রী ও মাতৃঠাকুরাণী। গুরুদাসের বিবাহ তখনও হয় নাই। মেজকাকীমাঁ শিবসুন্দরী দাস্যা মহাশয়া পৃথক ঘরে তখন বাস করিতেছিলেন। এই মাত্রই স্ত্রীলোক। গুরুদাস পড়াশুনা ছাড়ান দিয়া গৃহস্তি কার্য্যে মনোযোগী হওয়ায় ৩/৪ জন গৃহস্তির চাকর বাড়ীতে আছে ও কাম্‌লা, মজুরে বাড়ী জনতাপূর্ণ বলিয়া বোধহয়। এই তখন বাড়ীর অবস্থা ছিল।

    যাহা হউক গ্রামে মিত্রপক্ষ যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা যেন শ্বাস্‌ ফেলীয়া বাচিলেন। আর শত্রুপক্ষ যাঁহারা ছিলেন, তাঁহাদের প্রসন্ন বদনে আবার কালীমা রেখা অঙ্কিত হইল। গ্রামে দলাদলী থাকায় এ কথাটার এখানে উল্লেখ করিতে বাধ্য হইলাম। দলাদলী ও গ্রামের অবস্থা যথাস্থানে বর্ণন করিব। বাড়ীতে যে যাহা দেবতার উদ্দেশে মানত করিয়াছিলেন তাহা যথাযোগ্য মতে ধুমধামের সহিত আদায় হইল।

    এদিকে সহরে ডাক্তারবাবু ও গোবিন্দবাবু ধন্যবাদ পাইলেন। পূজনীয় শ্বশুর মহাশয়ের চিন্তা দূর হইল, তাহার পরিশ্রম ও অর্থব্যয়ের সার্থকতা হইল। মহেশ ও মেথর পুরস্কৃত হইল। রোগ নিরাময়ের পরও ১৫ দিবস শয্যাশায়ী রহিয়াছিলাম। শুইয়াই পায়খানার কার্য্য হইত। ধন্য মহেশ!! সে দিবারাত্রি মলমূত্রের পাত্র হস্তে ধারণ করিয়া পরিস্কার করিত। পাত্র বাহিরে স্তুপাক্রিতি দেখিয়াছি, বাবুরাম নামক মেথর তাহা গো গাড়ী বুঝাই করিয়া নিতে দেখিয়াছি। কাজেই এ হেন লোককে পুরস্কৃত না করিলে চলিবে কেন?

    গোবিন্দবাবুর নির্ভীকতা, নিদ্রাহীনতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের কোনই পুরস্কার দিতে পারি নাই। তাঁহার নিকট আমি চিরঋণে আবদ্ধ। কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও ধন্যবাদ মাত্রই তাঁহার প্রাপ্য পুরস্কারে পর্য্যবসিত। আর ডাক্তারবাবু জীবনদান করিয়াছিলেন। ৫০্‌ টী টাকামাত্র এই অমূল্য জীবনের বিনিময়ে তাঁহাকে দিয়াছিলাম। তাঁহার অমায়ীকতা, সদব্যবহার ও করুণাদ্র হৃদয়ের মহত্ব জন্য তাঁহাকে যথোচিত পুরস্কৃত করিতে অপারগ হইয়া তৎকৃতোপকারের জন্য কেবল চিরকৃতজ্ঞতাপাশেই আবদ্ধ রহিলাম। উক্ত উভয় মহাত্মা এখন স্বর্গগত:, তাঁহাদের অমরাত্মা সর্ব্বসুখপূর্ণলোকে বাস করিয়া চিরশান্তী অনুভব করেন, ইহাই সেই একমাত্র অগতীর গতীঁ ব্রজেন্দ্রনন্দন ভবতাড়ণ ভগবানের সমীপে করযোড়ে কাতর প্রার্থনা।

    পীড়ার অতীব শঙ্কটাপন্ন অবস্থাকালে আমার যে মনের গতী হইয়াছিল তাহা এখনও স্মৃতিতে উদয় হয়। শরীর যে আত্মা হইতে পৃথক তাহা বিশেষরূপেই উপলব্ধি করিয়াছিলাম। শরীর ও আত্মায় তখন সংগ্রাম উপস্থিত। আত্মা তখন শরীর যেন ছাড়িতে চাহিয়াছিল, কিন্তু নিয়তী পূর্ণ না হওয়ায়ই যেন দেহ সংগ্রামে জয়ী হইয়া আত্মাকে আবার মায়াবরণে আবদ্ধ করিল। পরে যে কেমনে বাঁচিলাম মনে নাই।
  • Nina | 12.149.39.84 | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২০:৪০480400
  • চিন্টুবাবু, ডিসেম্বরে কলকাতা আসছি--ততদিনে কি চান্স আছে এইটির বই আকারে পাওয়ার? প্লিজ!
    রঞ্জনভাউ গেলেন কই?
  • achintyarup | 121.241.214.34 | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ ২৩:৫৫480401
  • বই পাওয়ার চান্স আছে বলীয়া মনে হয় না, প্রীণ্টাউট পাওয়া যাইতে পারে
  • achintyarup | 59.93.244.80 | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৫:৫০480402
  • বৃহৎ২ উৎসবাদির কথা। (ঘ)

    আমার উন্নতীর সময়ের উৎসবাদির মধ্যে তিনটী উৎসবই বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১ম বড় কন্যা শ্রীমতী কুসুমের বিবাহ, ২য় মধ্য জেঠীমাতা শিবসুন্দরী দাস্যা মহাশয়ার শ্রাদ্ধ, ৩য় শ্রীমান্‌ বালক সতীশের বিবাহ।

    (১) ১৩০৬ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে শ্রীমতী কুসুমের বিবাহ-উৎসব সুসম্পন্ন হয়। প্রথমা কন্যার বিবাহ, বাটীস্থ সকলেরই আহ্লাদ হইল পাত্রকে বাটীতে আনয়ন করিয়া বিবাহ কার্য্য সমাধা হয়। পাত্র পক্ষও তাহাতে সম্মতী প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য আমাদের অঞ্চলে ব্যয়বাহুল্য ভয়ে অনেক অবস্থাবান লোকেও বরকে স্বভবনে আহ্বান না করিয়া পাত্রীসহ বরকর্ত্তার ভবনে গমন করত: তথায়ই কন্যাসম্প্রদান করিয়া থাকেন। অধিকাংশ লোকের মধ্যেই এ রীতি প্রচলীত দেখা যায়। আমি এ রীতিকে অতিক্রম করিতে সাহসী হইলাম।

    বাড়ীতে চাইল, ডাইল, চিড়া, মুড়ী, তৈল, ঘৃত, শাক তরকারী ও আরও অন্যান্য গৃহাস্তি উৎপন্ন দ্রব্যাদির অভাব ছিল না। দুইটী পুখুর মৎস্যে পরিপূর্ণ ছিল, বাগানে যথেষ্ট আম্র, কাংঠাল ও কদলী ফল ছিল। উন্নতীর সময়ে অনেক লোকেই আনুগত্য স্বীকার করে, সুতরাং কাজ কর্ম্ম ও সেবা পরিচর্য্যাদির লোকেরও অভাব ছিল না, ভ্রাতা শ্রীমান্‌ গুরুদাসেরও তখন নূতন উদ্যম, আমার প্রসার প্রতিপত্তিও ক্রমে উন্নতীর দিকেই অগ্রসর হইতেছে, কাজেই কর্ম্ম জীবনের প্রাথমিক শুভ অনুষ্ঠানে ব্যয় বাহুল্য ও ধুমধাম চাই।

    তাহাই যথাসম্ভব হইল। সপ্তাহকাল ব্যাপী আহারাদির অনুষ্ঠান হইল। কুটুম্ব, আত্মীয় ও স্বগণাদি অনেকেই আমন্ত্রিত হইয়া আগমন করিলেন, যথাযোগ্য পরিচর্য্যায় সকলেই অপ্যায়ীত ও সন্তুষ্ট হইলেন। আমার অবস্থানুযায়ী বিশেষ সমারোহের সহিতই এই বিবাহোৎসব ব্যাপার সুসম্পন্ন হইয়াছিল বলিতে হইবে।

    (২) ১৩১০ সালের বৈশাখ মাসে অকস্মাৎ একদিনের ব্যারামে মধ্যমা জেঠীমাতা ঠাকুরাণীর দেহাবসান ঘটে। তিনি সরলা, মধুরভাষিণী ও পূণ্যবতী ছিলেন বলিয়াই তাঁহার মৃত্যুটীও তৎপক্ষে সুখময় হইয়াছিল। কোন বিশেষ শারীরিক কষ্ট তাঁহাকে মৃত্যুকালে ভোগ করিতে দৃষ্ট হয় নাই।

    তিনি তৎপতির ত্যজ্য সম্পত্তির একমাত্র মূখ্য উত্তরাধিকারী। আমরা ভ্রাতাদ্বয়কে বর্ত্তমান রাখিয়াই স্বর্গগতা হইলেন। তাঁহার পারলৌক মঙ্গলানুষ্ঠানরূপ শ্রাদ্ধকার্য্য আমাদিগকেই সুসম্পন্ন করিতে হইয়াছিল। মনে মনে সংকল্প করিয়া স্থির করিলাম, যখন তিনি এক সংসারের একা কর্ত্তৃ ছিলেন, আমরা তাঁহার ত্যজ্য সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছি, তখন তাঁহার পারলৌকিক সদ্‌গতীর কার্য্যটী যাহাতে লোকের ভুরীভোজন ও মনোরঞ্জনে সুনির্ব্বাহ হয় তাহাই কর্ত্তব্য।

    শ্রাদ্ধক্রীয়ার অন্যান্য অনুষ্ঠান যথারীতি বাটীতে বিশেষ আয়োজনে হইতেছিল, আমি নির্দ্দিষ্ট দিনের ৪/৫ দিবস পূর্ব্বেই ময়মনসিংহ নগর হইতে ময়দা, ঘৃত, চিনী ও দানসামগ্রী ইত্যাদি লইয়া বাটীতে পঁহুছিলাম। পূর্ব্বে কাহাকে বলি নাই যে পাকা ফলাহারের ব্যবস্থা হইবে। এক্ষণে সকলেই তাহা জানিতে পারিয়া বিশেষ আনন্দ লাভ করিলেন। আমাদের অঞ্চলের প্রায় ১০/১১ খানা গ্রাম নিয়া এখনকার ইউনীয়নের ন্যায় বাদসাহী আমলের ইউনীয়ন অর্থাৎ যাবনিক ভাষায় ""জোয়ারা'' ভিধান (?) বিশিষ্ট এক্‌এক্‌টী বিভাগ আছে। আমরা যে জোয়ারে বাস করি তাহা ""বাগ্‌মোড়'' জোয়ার নামে প্রসিদ্ধ। এই জোয়ারের সমস্ত হিন্দুকেই উক্ত বিরাট ব্যাপারে আমাদের ভবনে ভোজনের নিমন্ত্রণ করা হইল। তদতিরিক্ত প্রতিপার্শ্বিক আরও ৩/৪ খানা গ্রামের কেবল ব্রাহ্মণগণকে ভোজনের আমন্ত্রণ করা হইল। খুব সমারোহের বিধি ব্যবস্থায় শ্রাদ্ধক্রীয়া ও ভোজনব্যাপার সুসম্পন্ন হইল। কোনরকমে কাহারও নিন্দা কি অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায় নাই। ""বিরাট'' ও ""সমারোহ'' শব্দ ব্যবহার করিলাম কেন? আমার অবস্থামতে বিষয়টী খুব বৃহৎই হইয়াছিল, পিতৃদেব কি জ্যেষ্ঠতাত মহাশয়দিগের পারলৌকিক ব্যাপার এরূপ ব্যয় বাহুল্যে ও সমারোহ বিধানে ব্যবস্থিত হয় নাই। ব্রাহ্মণেরা শতাধিক, মুশলমান অন্যূন তিনশত ও কায়স্থাদি প্রায় হাজার সংখ্যক লোকের ভোজন হইয়াছিল।

    বলা বাহুল্য কাঁচা অর্থাৎ দধি, চিড়া কি অন্নব্যঞ্জনাদি ও দুগ্‌ধ খির, চিনী, গুড়াদি মিষ্টদ্রব্য সহযোগে ভোজনই দেশপ্রথা। লোচী পুরী ও তদানুসঙ্গিক অন্যান্য উপকরণাদি ভোজন সহর ভিন্ন গ্রামে দৃষ্ট হয় না। আমি তাহা কখনও কোনও অবস্থাবান্‌ ব্রাহ্মণ কি ভদ্রলোকের বাটীতেও দেখি নাই। তাই এই পক্কান্ন ভোজন ব্যাপারে লোকেরও আনন্দ উদ্বেলীত হইয়াছিল এবং আমারও যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ লাভ ঘটীয়াছিল।
  • kumu | 122.160.159.184 | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ ১৯:০২480403
  • লেখক গগনচন্দ্র নিজের স্ত্রীর বিষয়ে প্রায় কিছুই লেখেননি।
  • achintyarup | 59.93.192.84 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ ০৬:০৯480404
  • (৩) ১৩১৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে শ্রীমান্‌ বালক্‌ সতীশের বিবাহ উৎসব কার্য্য সুসম্পন্ন হইয়াছিল। সতীশকে কন্যা সম্প্রদান করার জন্য অনেক কন্যাদায়গ্রস্থ মহাত্মাই উদ্যোগী ছিলেন, কিন্তু বিবাহকার্য্যে শাস্ত্র বলেন -- নিয়তীই মূল। ""সহিলা'' গ্রামের হোম রায় বংশোদ্ভব শ্রীযুক্ত গোবিন্দ চন্দ্র রায়ের কন্যা শ্রিমতী সরযূবালার পাণিগ্রহণে সতীশের নিয়তী পূর্ণ হইল। বধুমাতা বুদ্ধিমতী, সুশীলা ও গৃহকার্য্যে নিপুণা, লিখাপড়াও কিছু অভ্যাস আছে। গুরুজনে ভক্তিশ্রদ্ধার ত্রুটী দৃষ্ট হয় নাই। আমি যতকাল বাড়ী ছিলাম তাঁহার সেবা ও গুণে মুগ্‌ধই ছিলাম। গোবিন্দ রায় মহাশয়ও সদাশয় লোক, তাঁহাদের অবস্থা বিদ্যা বুদ্ধি প্রভৃতি গুণ গৌরবে ও ধনসম্পদে গৌরবান্নিত। তদঞ্চলে তাঁহারা প্রতিষ্ঠাবান ও প্রতিপত্তিশালী বলিয়া সকলেই জানে। সুতরাং সতীশের বিবাহে আত্মপ্রসাদ লাভ ভিন্ন কোনরূপ অসুখ কি অসোষ্ঠভের কারণ হয় নাই। গোবিন্দ রায় মহাশয় সর্ব্বজন পরিচিত সুবিদ্বান ও ধর্ম্মপ্রাণ শ্রীযুক্ত গগন চন্দ্র হোম রায় মহাশয়েরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা। গগন চন্দ্র রায় মহাশয় কৃতীত্বগুণে এখন কলিকাতা ""এড্‌মিনিষ্ট্রেটার জেনারেল'' অফিসের ম্যানেজারী পদে বরিত আছেন।

    আমার অবস্থামতে এই শুভ ব্যাপারে ব্যয় বহুল্যের ত্রুটী হয় নাই। সকল উৎসবাদি হইতে ব্যয় বেশীই হইয়াছিল। আহারাদির ব্যবস্থা সপ্তাহকাল চলিয়াছিল। নৃত্যগীত, বাদ্যাদি ও যাত্রাভিনয়ে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা হইয়াছিল, প্রায় ১৫ দিবসে সর্ব্ববিধ অনুষ্ঠান ও আড়ম্বরের পরিসমাপ্তি হয়। বন্ধু, বান্ধব আত্মীয় স্বগণ, মেয়ে চতুষ্টয় ও জামাতাগণ অধিকাংশই আগত হইয়া আনন্দ ও প্রীতিবর্দ্ধন করিয়াছিলেন। স্বগ্রাম ও প্রতিবেশী গ্রামের ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক অধিকাংশই এই শুভ অনুষ্ঠানে যোগদান ও ভোজনাদি করিয়া আপ্যায়ীত করিতে ত্রুটী করেন নাই। আমার কর্ম্মজীবনের ইহাই শেষ ও সর্ব্বপ্রধান উৎসব হেতু তাহা নিরাপদে ও সুখ্যাতী সহকারে সুসম্পন্ন হওয়ায় আমি যথেষ্ট আনন্দলাভে নিশ্চিন্ত হইলাম।

    যাতায়াত। (ঙ)

    আমি মোক্তারী ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইয়া সহরে বাসা করিলেও প্রায় প্রতি মাসেই ২/১ বার বাড়ী গমনাগমন অনিবার্য্য ছিল। ভ্রাতা শ্রীমান্‌ গুরুদাস বয়:প্রাপ্ত না হওয়া পর্য্যন্ত বাটীস্থ সর্ব্ববিষয়ের কর্ত্তৃত্ব করার যোগ্য পুরুষ লোক কেহ বর্ত্তমান ছিল না। কাজেই বাটীর তালুকদারী সাশন, গৃহস্তি ও লগ্নি কারবার ইত্যাদি বহু বিস্তৃত না হইলেও সময়োপযোগী বিধি ব্যবস্থা ও আদায় তহশীলের অভাবে নষ্টপ্রায় ও বিশৃঙ্খলায় পরিণত হওয়ার যথেষ্ট কারণ বর্ত্তমান ছিল। তাহা ধংশোন্মুখ হইলে আমার মোক্তারীর আয়ে তাহার পুনরোদ্ধার কখনই সম্ভবপর ছিল না। এজন্য বাধ্য হইয়া বাটীস্থ সর্ব্ব কার্য্যের সুব্যবস্থার জন্য এই গমনাগমনে অক্লান্ত পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করিয়াছি। তখন ভৈরব ময়মনসিংহ রেল পথ ছিল না। ঢাকা ময়মনসিংহ রেল রাস্থায় কাঁওরাইদ ষ্টেশন পর্য্যন্ত গমন করিয়া তথা হইতে নৌকাযোগে কটীয়াদি অবতরণ করত: ৬/৭ মাইল রাস্থা পদব্রজে যাইতে হইত। বাটী হইতে আসিবার কালেও ঐ ব্যবস্থা; ৬/৭ মাইল পাল্‌কীতে যাতায়াত চলে কিন্তু অবস্থা থাকিলেও কখনও পাল্‌কী চড়ি নাই। ঐ ৬/৭ মাইলের অর্দ্ধপথে "মাগুরা' গ্রামে শ্বশুরালয়। পদব্রজে হেমন্তকালে চলিবার সময় প্রায়ই শ্বশুরালয়ে পূর্ব্ব সংবাদানুসারে আহারাদির বন্দবস্থ থাকিত, তথায় উপস্থিত হইয়া আহার ও বিশ্রাম করত: বাটীতে গমন সুলভই ছিল। আসিবার কালেও কোন যাত্রায়, প্রত্যুষে রোয়ানা হইয়া আসিয়া সেই শ্বশুরালয়ে স্নানাহার করিয়া পরে কটীয়াদি পঁহুছিয়া নৌকায় চড়িয়াছি। লোকে কথায় বলে সংসারে সকলই অসার কেবল ""সারং শ্বশুরমন্দিরং'', আমার পক্ষে তাহা বিশেষরূপেই উপলব্ধি হইয়াছে। যদিও শশুরমহাশয় আমার বিবাহের বহু পূর্ব্বে স্বর্গগত: এবং শ্বাশুরী ঠাকুরাণীও বিবাহের কতিপয় বৎসর পর তদানুগামিনী হইয়াছিলেন, তথাপী শ্বশুরালয়ের সুখ সৌভাগ্যে আমি কখনও বঞ্চিত হই নাই।
  • achintyarup | 59.93.246.129 | ০৮ অক্টোবর ২০১১ ০৫:৩৩480405
  • খুড়্‌তত শশ্রুঠাকুরাণী বর্ত্তমান পর্য্যন্ত ঠাকুরাণীর অবসর নিবন্ধন যে অভাব জ্ঞান, তাহা বোধ করিবার অবসর প্রাপ্ত হই নাই। কারণ শশ্রুমাতা ঠাকুরাণী যেরূপ ভাবে আহারাদির পরিচর্য্যা করিতেন, ছোট ঠাকুরাণী ততোধিক রূপে আয়োজন উদ্যোগাদি করিয়া সন্তুষ্টি জন্মাইতে কখনও ত্রুটী বা শৈথিল্য করেন নাই। তাঁহার অভাবের পরও শ্যালকবর্গ ও তদ্দিগের সহধর্ম্মিণীগণ তাঁহাদের পূর্ব্ববর্ত্তীর আচার ও নিয়মানুকরণে বিশেষ যত্নবান ও যত্নবতী হইতে ভূলে নাই। শ্বশুরালয়ের এ হেন সৌভাগ্য ও আনন্দানুভব অল্প লোকেরই অদৃষ্টে প্রতিফলিত হয়।

    পূজ্যপাদঁ খুল্লতাত শ্বশুর গঙ্গাপ্রসাদ ঘোষ মহাশয় অতি সহৃদয় অমায়িক ও উদার প্রকৃতির লোক ছিলেন, তিনি আমাকে যেরূপ স্নেহ নয়নে দৃষ্টিপাত করিতেন, অনেকের শ্বশুর শ্বাশুরী দূরের কথা, পিতা মাতাও পুত্রকে সেরূপ মমতাপূর্ণ স্নেহের চক্ষে অবলোকন করিতে দেখা যায় না। আমাকে পুত্রাধিক স্নেহ ত করিতেনই তদোপরি আবার আর একটা ভাব তাঁহার অন্তরে সর্ব্বদাই জাগরুক দেখিয়াছি। তিনি মনে করিতেন আমি সাংসারিক জ্ঞানে তাঁহা অপেক্ষাও অভিজ্ঞ, এই হেতু সাংসারিক, বৈষয়িক কি অপরবিধ যে কার্য্যই হউক আমার মতামতের উপর নির্ভর করিতেন। আমার সহিত পরামর্শ ও আলোচনা না করিয়া কোন কার্য্যই করিতেন না। এই ভাবটা একদিকে যেমন স্নেহমূলক অন্যদিকে তেমন গৌরবাত্মকও বলা যায়। এই গৌরবাত্মক ভাবে তিনি আমাকে উচ্চ আসন প্রদান করিতেন এবং শিশুর ন্যায় সরল ভাবে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ ও ব্যবহার করিতেন। অনেক সময় তাঁহার এই বালকের ন্যায় সরলতা দৃষ্টে বিস্মিত ও কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছি।

    তিনি আজীবন মাতা পিতা হইতেও অধিক যত্নে ও উদ্‌যোগে আমার সর্ব্ব বিষয়ে মনস্তুষ্টী বিধানে তৎপর ছিলেন। ""কলারা'' পীড়ার সময় তিনি উপস্থিত না থাকিলে আমার জীবনের আশা বোধহয় সেই সময়েই শেষ হইত। পিতৃদেব ও মাতুল মহাশয় স্বর্গগত: হওয়ার পর, নিস্বার্থবান্‌ ও স্নেহশীল অভিভাবক তাঁহার ন্যায় দ্বিতীয় আমি আর কাহাকে পাই নাই। আমি কখনও শ্বশুর মহাশয়ের অভাবজনিত কোন চিন্তা মনে স্থান দিবার অবসর প্রাপ্ত হই নাই, তিনিই যে একাধারে শ্বশুর, পিতা ও অভিভাবক ইহাই যেন অনুক্ষণ স্মৃতিপথে জাগরুক রহিয়াছে। আমার মোক্তারী পাসের তিনিই একমাত্র ভিত্তি। তাঁহার উপদেশ, উৎসাহোদ্দিপক বাক্য ও প্ররোচনাই আমার এই কর্ম্মজীবন ও অর্থোপার্জ্জনের মূল সূত্র। প্রসার প্রতির মূলেও তাঁহারই আগ্রহব্যঞ্জক হস্ত সর্ব্বদা প্রসারিত দেখিয়াছি।

    আমার এই বাড়ী গমনাগমন কালে হেমন্ত ঋতুতে তাঁহাদের বাড়ী না হইয়া যাওয়ার অন্য উপায় ছিল না, কিন্তু বর্ষা সমাগমে ১/২ মাইল পথ কটীয়াদির বাজার হইতে কুমার গর্ত্ত নামক স্থান পর্য্যন্ত অতিক্রম করণান্তর পুন: নৌকাপথে একবারে বাড়ীর ঘাটলায় পঁহুছিতে হইত। তখন "মাগুরা' শ্বশুরালয়াবস্থান পরিত্যাগ করিলেও চলিত। কিন্তু পূজ্যপাদ শ্বশুর মহাশয় সর্ব্বদাই বলিতেন ""আমাদের বাড়ী না হইয়া কখনও বাড়ী যাইবেন না, পথের ক্লান্তি দূর ও বিশ্রাম করত: আহারাদি করিয়া বাড়ী গেলে কোন অসুখ, অশান্তীর সম্ভাবনা থাকে না''। তিনি বাড়ী থাকিলে ত আর কথাই ছিল না, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ও আহারাদি করা অবশ্য কর্ত্তব্য মধ্যেই গণ্য হইত। এরূপে দীর্ঘ ৩৫ বৎসরাধিক কাল যাতায়াতে এক দিকে যেমন শ্বশুরালয়ের সুখ সুবিধা ভোগ করিয়াছি, অন্যদিকে নৌকায় ভ্রমণের আমোদও ভোগ করিয়াছি।

    কাঁওরাইদ হইতে কটীয়াদি এক দিবসের নৌকাপথ, অর্থাৎ সারাদিন ও সারারাত্রি নৌকা চলিলে গন্তব্য স্থানে পঁহুছা যায়। এই জলপথ ভ্রমণ যে আমার পক্ষে কত আনন্দজনক ছিল, তার স্মৃতিমাত্রে এখনও মনে সুখানুভব হয়। কখন২ নৌকাতে পাক করিয়াই আহার হইত। ভৃত্য সঙ্গে না থাকিলে নিজেই রান্না করিয়াছি, বেশ পরিতৃপ্তি সহকারে ভোজন হইয়াছে, মাল্লারাও প্রসাদ পাইয়া সন্তুষ্ট চিত্তে নৌকা পরিচালনা করিয়াছে। আমার এই বহুবার যাতায়াত জন্য নৌকা ও মাল্লা নির্দ্দিষ্টই থাকিত, ভাড়ার হারও নির্দ্দিষ্টই ছিল। সংবাদ দিয়া নৌকা রাখার ঘাটে পঁহুছিলেই সব প্রস্তুত পাওয়া যাইত। কর্ম্মজীবনের এই সুখময় চলাচলটা বিস্মৃত হইবার নহে বলিয়াই অকিঞ্চিৎকর ঘটনা হইলে মসী লেখনীর সদ্‌ব্যবহারে যত্ন করিলাম।
  • ranjan roy | 14.97.120.133 | ০৯ অক্টোবর ২০১১ ০০:০২480407
  • একটু ফুট না কেটে থাকতে পারছিনা।
    এক, কুমুদিনীর অত্যন্ত প্রাসংগিক টিপ্পনী:
    ---------------------------------
    সত্যি কথা, গগনচন্দ্র দুনিয়াভরের পাব্লিককে নিয়ে দেদার লিখেছেন,
    ঋণস্বীকার করেছেন, কিন্তু নিজের স্ত্রী শ্রীমতী সুখময়ী রায়কে নিয়ে প্রায়
    কিছুই লেখেন নি।
    কেন?
    হটাৎ চোখে পড়ল কয়েক পোস্ট আগে একটি লাইন, যেখানে গগনচন্দ্র অনেক পরিশ্রম করে যশ-খ্যাতিলাভ করলেও সমসাময়িক সফল মোক্তারদের মত সম্পত্তিবৃদ্ধি করতে পারেন নি বলে একটু আফশোষ করেছেন। আর কারণ হিসেবে পরিবারের লোকেদের আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধির প্রতি ইঙ্গিত করেচেন। মনে হয়, এটা ওনার নিজের স্ত্রী বিষয়ে কমেন্ট।
    এর পরে পাঠক দেখবেন গগনচন্দ্র নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসেবে চতুরাশ্রম মেনে বানপ্রস্থ-সন্ন্যাস সবই পালন করেছেন।
    স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন কি এর পেছনে কাজ করেছিল?
    আমি গগনচন্দ্রের স্ত্রী সুখময়ী রায়কে ওনার ৯৬ বছরে প্রয়াণ অব্দি দেখেছি। উনি আমার বড়মা( বাবার ঠাকুমা)। গগনচন্দ্র বেশ কালো ছিলেন, বড়মা অত্যন্ত ফর্সা।
    গগনচন্দ্রের নিজের ফর্সা ছোট মেয়ে সম্বন্ধে মন্তব্য খেয়াল করুন।
    বড়মা দেশের বাড়িতে তালুকদারির আয়ব্যয় সব ছেলের সাহায্যে দেখতেন এবং বাড়ির ছুতোরমিস্ত্রির
    ছেলেরও ঘটা করে অন্নপ্রাশন করতেন বলে শুনেছি। ওনার ভাল গানের গলা ছিল। মৃত্যুর দিনও দুপুরে( আমি তখন ক্লাস ফাইভে) গোবিন্দদাসের পদ গাইছিলেন। আমাদের( নাতির ঘরের পুতিদের) লুকিয়ে নিষিদ্ধ আচার জাতীয় খাদ্যদ্রব্য খুব খাইয়েছেন।
    কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়তে গিয়ে রামের জন্মের বর্ণনায় ""সাবধানে করিলেক নালিকা ছেদন'' পড়ে আটকে যাওয়ায় বড়মা আমাকে বায়োলজির ফান্ডা বুঝিয়ে নিজের ছেলেবৌয়ের কাছে বকুনি খেলেন।
    দুই , সৌরভ প্রেসের মালিক কেদারনাথ মজুমদারের লেখা ""ময়মনসিংহের ইতিহাস'' আজও দে'জ পাবলিশিং এর দোকানে পাওয়া যায়।
    তিন,
    ওনার ভাগ্নে সতীশচন্দ্র কারকুনের কথা লিখেছেন। উনি আবার ""গুরুচন্ডালী''র আরেক ফাউন্ডার-মেম্বার দময়ন্তী তালুকদারের মায়ের দিক দিয়ে আত্মীয়।
    চার, নিজের আপন ভাই গুরুদাস রায়ের ব্যাপারে পাসিং রেফারেন্সের বেশি কিছু নেই।
    অথচ, উনি ছিলেন স্বভাবে গগনচন্দ্রের একেবারে উল্টো এক কালারফুল ক্যারেকটার। একেবারেই বিদ্যানুরাগী ন'ন। রোজ নিয়মকরে মুগুরভাঁজা,
    দুপুরে ঘুম এবং রাত্তিরে কালো পোষাক পরে কিছু চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে লোকের বাড়িতে উৎপাত, ভিনগাঁয়ে
    হাঙ্গামা-হুজ্জোত ইত্যাদির জন্যে বদনাম হয়ে কাছের দশগাঁয়ে বিয়ের সম্বন্ধ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্পষ্টত: গগনচন্দ্র ওনাকে পছন্দ করতেন না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন